বুধবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১২

প্রসঙ্গ মাদরাসা শিক্ষা ও শ্রেণীবৈষম্য



গত ৭ এপ্রিল দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় বিশিষ্ট কলামিষ্ট ও বুদ্ধিজীবি জনাব বদরুদ্দীন উমরের ‘মাদ্রাসা শিক্ষা ও শিক্ষাক্ষেত্রে শ্রেণীবৈষম্য’ শীর্ষক লেখাটি পড়ে বিস্মিত হয়েছি। ইন্টারনেট ভিত্তিক পত্রিকা সোনার বাংলাদেশে ঢুকেও দেখলাম, উল্লেখিত লেখাটি পড়ে প্রায় সবাই- এরকম একপেশে ও তথ্যবিবর্জিত লেখার জন্য লেখকের কঠোর সমালোচনা করে রেটিং অপশনে মাইনাস দিয়ে ভরে রেখেছেন (দেখুন: http://www.sonarbangladesh.com/article.php?ID=5329)। যাইহোক বিবেকের তাড়না, অনেকের অনুরোধ ও এ বিষয়ে মানুষকে সত্য ইতিহাস জানানোর মানসে এই অধমের কলম ধরা।




ইসলামের প্রথম শিক্ষক হযরত মুহাম্মদ (স.) এর হাত ধরে দারুল আরক্বাম ও মসজিদে নাববীতে যে শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়েছিল, সেই শিক্ষাব্যবস্থাই কালের পরিক্রমায় মাদরাসা নাম ধারণ করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় দীপ্তি ছড়িয়ে দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের উৎকর্ষে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলছে। ইসলাম ধর্ম যেমন আচার অনুষ্ঠান সর্বস্ব নিছক কোন ধর্ম নয়, তেমনি ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা তথা মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাও নিছক ধর্ম শেখানোর মাধ্যম নয়। ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থাকে কেউ যদি হিন্দু ধর্মের টোল ও খ্রিষ্টান ধর্মের সেমিনারি শিক্ষাব্যবস্থার সাথে তুলনা করে তাহলে তিনি ভুল করবেন। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা নিজ ধর্ম শেখার জন্য টোল ও সেমিনারি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করলেও ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য ব্যাপক ও সামগ্রিক। পবিত্র কুরআনের নাযিলকৃত প্রথম আয়াতই ছিল পড়া সংক্রান্ত। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন: “পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না” (সূরা আলাক্ব: ১-৫ )। উল্লেখিত আয়াতগুলোর প্রথম আয়াতে আল্লাহর নামে পড়তে বলার পরপরই ‘সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে’ একথা বলে আল্লাহ তায়ালা বুঝিয়ে দিয়েছেন মুসলমানরা আল্লাহর নামে শুধু ধর্ম শিক্ষাই নেবে না বরং জ্ঞান-বিজ্ঞানে নিজেদের নিমজ্জিত করবে। আল্লাহ কিভাবে মানুষকে ও গোটা সৃষ্টিজগতকে তৈরী করেছেন তা নিয়ে গবেষণা করবে। পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে চিন্তার জগত প্রসারিত করে বিজ্ঞানমনষ্ক হয়ে গবেষণা করতে বলেছেন। আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয় আসমান ও যমীন সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্য” (সূরা আল-ইমরান: ১৯০)। “তোমাদের কি হল যে, তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব আশা করছ না। অথচ তিনি তোমাদেরকে বিভিন্ন রকমে সৃষ্টি করেছেন। তোমরা কি লক্ষ কর না যে, আল্লাহ কিভাবে সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। এবং সেখানে চন্দ্রকে রেখেছেন আলোরূপে এবং সূর্যকে রেখেছেন প্রদীপরূপে। আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে মৃত্তিকা থেকে উদ্গত করেছেন। অতঃপর তাতে ফিরিয়ে নিবেন এবং আবার পুনরুত্থিত করবেন” (সূরা নূহ:১৩-১৮)। নবী (স.) বলেন: ‘প্রত্যেক নর-নারীর উপর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ’। তিনি আরো বলেন: ‘জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজন হলে সুদূর চীন যেতে হলেও গমন কর’।



আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশনা কাজে লাগিয়ে মুসলমানগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানে আত্মনিয়োগ করে গোটা বিশ্বকে জয় করে নেয়। প্রাথমিক যুগে মসজিদভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চললেও পরবর্তীতে তা মসজিদের গন্ডি ছাড়িয়ে আরো বিস্তৃতি লাভ করে। উমাইয়া ও আব্বাসীয় আমলে শিক্ষার ব্যাপক উন্নতি ঘটে। আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুন ৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে বায়তুল হিকমা নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ততকালীন সময়ে বায়তুল হিকমা জ্ঞান-বিজ্ঞানে ব্যাপক অবদান রাখে। গণিত, ভূগোল, আকাশ বিদ্যা, ফিজিক্স, ক্যামেস্ট্রি, মেডিকেল সায়েন্সসহ বিজ্ঞানের সকল শাখায় মুসলমানরা যে অবদান রেখেছে তা অনবদ্য। মূলত: তাদের আবিস্কৃত সূত্রের ওপর ভর করেই এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞান চর্চা চলছে। খলদুন, রূশদ, ফারাবি, খারেজমি, ইবনে সিনাদের অবদান সারাবিশ্ব কিয়ামত পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য। মুসলমানরা স্পেন বিজয় করে সেখানে ৮০০ শত বছরের শাসনামলে শত শত মসজিদ ও পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেছিল। গ্রানাডা ও কর্ডোভার পাঠশালাগুলোতে খ্রিষ্টানরা এসে মুসলমানদের থেকে জ্ঞান আহরণ করতো। তখনকার সময় পাঠশালাগুলো ছিল একেকটা বিশ্ববিদ্যালয়; জ্ঞান-বিজ্ঞানের দূর্গ।



ভারতবর্ষে মুসলমানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৮০০ বছরেরও আগে। তখন গোটা ভারতবর্ষের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা ছিল মাদরাসা শিক্ষা। শিক্ষা, সংস্কৃতি, আইন, চিকিৎসা, স্থাপত্য, রাষ্ট্রনীতি সব শিক্ষাই ছিল মাদরাসা ভিত্তিক। ১৭৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কলিকাতা আলীয়া মাদরাসা। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে অবিভক্ত বাংলায় ইংরেজ শাসনের প্রবর্তন ঘটে। এর প্রায় ৫০ বছর পরে ১৮০১ সালে পোর্ট উইলিয়াম কলেজের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ইংরেজী শিক্ষা চালু হয়। এর আগে ভারতবর্ষে ইংরেজী শিক্ষা বা আজকের দিনের জেনারেল শিক্ষার কোন অস্তিত্ব ছিল না। ইংরেজদের শাসন শুরু হওয়ার সাথে সাথে শুরু হয় মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের কাজ। কেননা ইংরেজরা ভাল করে জানে যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানরা এগিয়ে থাকলে তারা কখনো প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, এমন শিক্ষাব্যবস্থা গড়তে হবে যার ছাত্র থাকবে এদেশের মুসলমান এবং চিন্তা-চেতনা থাকবে ইংরেজদের আদলে। মগজ ধোলাই যাকে বলে। ইংরেজ আমলের শেষভাগে জেনারেল শিক্ষাই জাতীয় শিক্ষায় রূপ নেয়। তখন মাদরাসা শিক্ষাকে ইংরেজদের জেনারেল শিক্ষার সাথে সমন্বিত করার দাবি উঠলে মাদরাসাগুলোতে নিউ স্কিম নামে স্বতন্ত্র মাদরাসা চালু হয়। ১৯১৪-১৫ সাল থেকে নিউ স্কিম ও ওল্ড স্কীম নামে মাদরাসায় দুটি ধারা চালু হয়। পরে কালক্রমে নিউস্কীম মাদরাসা সাধারণ স্কুল কলেজের রূপ ধারণ করে। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৭ সনে সরকারীভাবে ঘোষণা দিয়ে অসংখ্য মাদরাসাকে স্কুল কলেজে পরিণত করা হয়। যার সংখ্যা ছিল ১৯৭৪ সালের হিসাব অনুযায়ী ১০৭৪। ঢাকার বর্তমান নজরুল কলেজ, চট্টগ্রামের মহসিন কলেজ, রাজশাহীর হাই মাদরাসা এককালের মাদরাসা থাকলেও এখন তা কলেজ হয়ে মুসলমানের সৌর্য-বীর্য হারানোর সাক্ষী হয়ে আছে।



ইংরেজদের নীতি হচ্ছে- ''Divide and Rule' তথা ‘বিভেদ তৈরী করে শাসন কর’। সেই নীতির ভিত্তিতে এদেশে যে দুই ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছিল তার মাধ্যমেই সর্বপ্রথম এদেশে শ্রেণীবৈষম্য শুরু হয়। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ইংরেজদের সেক্যুলার চিন্তা চেতনা বিদ্যমান থাকায় ঐ শিক্ষায় শিক্ষিতরা একই দেশের একই জাতের মাদরাসা পড়ুয়াদের অন্য চোখে দেখা শুরু করল। আবার মাদরাসায় শিক্ষিতদের চোখেও অনুরূপ চিত্র ফুটে উঠতে লাগল। একই দেশে এই দুই ধারা ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করে জাতি এখন দুইভাগে বিভক্ত। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে মুসলমানদেরে চিন্তা-চেতনার আলোকে যদি একই ধারার সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা (Integrated Education System) চালু করা যেত তাহলে আর এই শ্রেণীবৈষম্য তৈরী হত না। কিন্তু ইংরেজরা চলে গেলেও তাদের রেখে যাওয়া গোলামেরা ইংরেজদের চেতনাকে আরো পাকাপোক্ত করার জন্য নিরলস কাজ করে গেছে আর মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করার ব্যর্থ চেষ্টা করে তার মধ্যেই এখন সেক্যুলারিজমের বিষ ঢালা শুরু করেছে।



যারা মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে সেকেলে কিংবা প্রগতির অন্তরায় ভাবেন। তারা আসল কথা মানুষকে বলেন না; তা হচ্ছে- মাদরাসা শিক্ষা যদি ভালোভাবে চালু হয় তাহলে সেক্যুলারপন্থীদের কপাল পোড়া যাবে, ইসলামপন্থীরাই সবকিছুর নেতৃত্ব দেবে। এ কারণেই সংবিধানের দেয়া মৌলিক অধিকারকে বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে তথাকথিত অসাম্প্রদায়িকরা (?) মাদরাসা ছাত্রদের কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু বিষয়ে ভর্তির সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের ভয়, মাদরাসার ছাত্ররা সাংবাদিকতা, অর্থনীতি, আইন, বাংলা ও ইংরেজির মত গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্টে পড়লেতো প্রগতিশীলদের জায়গা বেদখল হয়ে যাবে। তাই যেভাবে হোক মাদরাসা ছাত্রদের নেতৃত্বে আসার পথ রুদ্ধ করতেই হবে। তা না হলে স্যামুয়েল হান্টিংটনের ঘোষণা অনুযায়ী মুসলিম নিধন যে কঠিন হয়ে পড়বে। একদিকে মাদরাসা ছাত্রদের জঙ্গি বানানোর চেষ্টা আর একদিকে তাদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পথ রুদ্ধ করা দ্বিমূখী নীতি নয় কি?



ইসলামের দৃষ্টিতে সাধারণ শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। জগতের সব জ্ঞানই ইসলামী জ্ঞান যদি না তার মধ্যে ইসলামী চেতনার পরিপন্থি কিছু থাকে। গণিত, ভূগোল, চিকিৎসা বিজ্ঞান, প্রকৌশল, প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদবিজ্ঞান, মৃত্তিকাবিজ্ঞান, গার্হ্যস্থ অর্থনীতি, সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, ইতিহাস, আইনসহ সকল জ্ঞানই ইসলামী জ্ঞান। আরববিশ্বে স্কুলকে মাদরাসা, কলেজকে কুল্লিয়াহ এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে জামিয়াহ নামে বলা হয়। আর যে দেশের ভাষা আরবী নয় সেদেশের প্রচলিত শব্দ দিয়েই স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ বোঝানো হয়। কখনো আরবী নামে কখনো ইংরেজী নামে। ইরাক, ইরান, সিরিয়া, লেবানন, মিশর, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় যে একমূখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে তা ধর্মকে আলাদা করে নয়। ঐ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কখনো নাস্তিক উৎপাদন হয় না। ওখানকার ছাত্রদের আধুনিক শিক্ষা দানের পাশাপাশি ''Spiritual Development' তথা আত্মিক উন্নয়নের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয়। সৌদি আরবে একটি ছেলে স্কুলের গন্ডি পেরোনের আগেই কুরআনের হাফেজ হয়, ইসলামী শরীয়াতের খুটিনাটি জ্ঞানও তাকে শেখানো হয়। তাই ওখানকার একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার আমাদের দেশের একজন ভালো মানের মুফতি, মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরের চেয়ে উত্তম। মালয়েশিয়ায় সরকারীভাবে প্রত্যেক মুসলমানকে শুদ্ধ কুরআন শেখানো এবং ইসলামী শরীয়াতের আবশ্যকীয় জ্ঞান দান করা হয়। শুধু তাই নয় ইসলামী পন্ডিত তৈরী করার জন্য মিশরে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে হোস্টেল নির্মাণ করে মালয়শিয়ার সরকার তাদের বাছাই করা সন্তানদের মোটা অঙ্কের বৃত্তি দিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার অনেক মুসলমান বেশ চমৎকার আরবী বলতে পারেন যা আমাদের দেশে বিরল। মিশরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টির সংখ্যা প্রায় সত্তুরটি যা অনেক আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়েও নেই।



ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য থাকে জাগতিক উৎকর্ষতার পাশাপাশি আত্মিক উৎকর্ষ সাধন। একজন শিক্ষার্থী যখন উচ্চ শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা তথা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস, আখিরাতের ভয়, তাক্বওয়া, মানুষের হক্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন তখন তার জ্ঞানের দ্বারা অপরের ক্ষতি সাধন হয় না। সে তার প্রযুক্তিগত জ্ঞানকে চুরি, বদমাশী, পর্ণোগ্রাফি তৈরীতে ব্যবহার করে না। এর সত্যতা আমাদের দেশের মাদরাসা শিক্ষিতদের দিকে তাকালে পাওয়া যায়। আমি বাংলাদেশে ইভটিজিং নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ইভটিজার হিসাবে একজন মাদরাসা ছাত্রের নামও পাইনি। আবার যেসকল মেয়েরা মাদরাসায় পড়ে অথবা তাদের মত বোরকা পড়ে রাস্তায় চলাচল করে তারা ইভটিজিংয়ের শিকার হন না বললেই চলে। আমাদের দেশের থানাগুলিতে খুন, চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, অপহরণ, নারী নির্যাতনের যে রেকর্ড আছে তাতেও মাদরাসা ছাত্রদের নাম খুব একটা দেখা যায় না। এর কারণ হচ্ছে তাদের মধ্যে হালাল হারামের জ্ঞান আছে। খারাপ কাজ করলে আখিরাতে আল্লাহ কঠিন পাকড়াও করবেন এ বিশ্বাস তাদের আছে। মাদরাসার ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আধুনিক বিষয় সমূহে ও মেডিকেল কলেজেও ভালো রেজাল্ট করছে। চাকুরীজীবনেও বেশ পারঙ্গমতা দেখাচ্ছে।



কিন্তু তারপরও আমাদের দেশের মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করা হয়। মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় যে ত্রুটি আছে তাতে সন্দেহ নেই। এই ত্রুটিগুলো মূলত: শাসকগোষ্ঠিরা বরাবর জিইয়ে রেখেছেন জাতিকে বিভক্ত রাখার জন্য। আবার মাদরাসা ছাত্ররা ভালো রেজাল্ট করলেও তাদেরকে বঞ্চিত করা হচ্ছে নানান ছুতায়। সরকারী চাকুরী পাওয়াতো মাদরাসা ছাত্রদের জন্য সোনার হরিণ। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও মাদরাসা ছাত্র হলে রক্ষা নেই, ভাইভা পরীক্ষায় আটকিয়ে দেয়া হয়। পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠির জন্য ১৯২১ সালের জুলাই মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তখন নাস্তিক্যবাদী ইসলাম বিরোধী শক্তিরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস! কালের পরিক্রমায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদরাসা ছাত্রদের ভর্তির দুয়ার প্রায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঢাবি প্রতিষ্ঠার বিরোধীতাকারী প্রেতাত্মারাই এখন ঢাবির নিয়ন্ত্রক!



সাধারণ শিক্ষার্থী ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে শ্রেণীবৈষম্য মূলত: মাদরাসা ছাত্রদের প্রতি সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণের কারণেই জন্ম নিয়েছে। তাই অনেকে মাদরাসা শিক্ষা মনেপ্রাণে ভালোবাসলেও নিজ সন্তানের চাকুরীর নিশ্চয়তা ও ভবিষৎ চিন্তা করে তাদের সন্তানদের মাদরাসায় ভর্তি করান না। আর মাদরাসার অধিকাংশ ছাত্র গরীব, এর কারণ দুটি। প্রথমত, বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিকই গরীব। আমাদের দেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বরা বাল্যবয়সে কত অনাহারে থেকেছেন তার ইয়ত্তা নেই। বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের বর্তমান গভর্ণর জনাব আতিউর রহমান ছাত্র জীবনে মাদরাসার হুজুরদের বদান্যতায় ধন্য হয়েছেন। উল্লেখ্য বদরুদ্দীন উমরের বাবাও একজন জাদরেল আলেম ছিলেন। এরকম অসংখ্য নজির আছে। বর্তমান সময়ের অনেক বাম-নাস্তিকরা হুজুরদের বোগলের তলে থেকেই বড় হয়েছেন। দ্বিতীয়ত, দরিদ্র শ্রেণীর মানুষেরা আল্লাহভীরু বেশী হয়। কারণ ধনীদের ধন যেরকম মানুষকে অহঙ্কারী করে; গরীবদের দারিদ্র তেমনি তাকে বিনয়ী করে। তাই ধার্মিক মানুষেরা তাদের সন্তানকে মাদরাসায় পাঠিয়ে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করেন। তবে সম্পদশালী লোকদের সন্তানরাও এখন মাদরাসায় পড়ে, এ সংখ্যাও কম নয়।



সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ও ইসলামী শিক্ষিতদের মধ্যকার বৈষম্য দূর করতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠের চেতনার ভিত্তিতে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। তবে এদেশে তা সম্ভব নয়। অন্তত সেক্যুলারপন্থী কমরেডরা তা হতে দিবে না। বিগত জোট সরকারের আমলে একমূখী শিক্ষাব্যবস্থা চালুর চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু তা বামপন্থীরা রুখে দিয়েছে। এই সরকার আবার একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে, তবে তা সংখ্যাগরিষ্ঠের চেতনার বিপরীতে সংখ্যালঘু সেক্যুলার চেতনার ভিত্তিতে। এতে হিতে বিপরীত হবে তা হলফ করে বলা যায়। তাই মাদরাসা রক্ষায় আলেম-ওলামাদেরকেই সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করতে হবে। নিজেদের মধ্যের সব ভেদাভেদ দূরে ঠেলে দিয়ে একই প্লাটফর্মে দাড়াতে হবে অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই। না হয় আরেকটি স্পেনের ভাগ্যবরণের প্রস্তুতি নিতে হবে।



লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।



http://www.sonarbangladesh.com/articles/MuhammadAminulHaque

http://www.sonarbangladesh.com/article.php?ID=5434

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন