শনিবার, ২৬ মে, ২০১২

ইমাম বুখারীর দেশ সমরকন্দ - বোখারা

ইমাম বুখারীর দেশে
হযরত মাওলানা মুফতি তকী উছমানী
কিছুদিন আগে ওলামায়ে কেরামের সাথে উযবেকিস্তানের সফর হয়েছে। কিছু বন্ধু সে সফরের কারগুযারী শোনানোর অনুরোধ করলেন। আমারও মনে হল যে, এ সফরে আল্লাহ তাআলা অনেক শিক্ষণীয় বিষয় দান করেছেন, যা আলোচনা করা আমাদের সবার জন্য ফায়েদাজনক হতে পারে। তাই এখন এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করার ইচ্ছা করেছি।

উযবেকিস্তান দীর্ঘ দিন যাবৎ রাশিয়ার আগ্রাসনের শিকার ছিল। অল্প কিছু দিন পূর্বে তা স্বাধীন হয়েছে। সে সময় পরিস্থিতি এত কঠিন ছিল যে, কোনোদিন এই সব স্থান দেখার সুযোগ হবে তা ছিল কল্পনারও অতীত। অথচ এই ভূখণ্ডই একদিন ইসলাম ও ইসলামী উলূমের মারকায ছিল। আপনারা হয়তো বুখারা-সমরকন্দের নাম শুনেছেন। এই দুই বিখ্যাত শহরে মুসলিমজাহানের বহু নামজাদা মনীষী জন্মলাভ করেছেন। আপনারা ‘সিহাহ সিত্তা’র নাম শুনেছেন, যা হাদীস শরীফের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সংকলন। আল্লাহ তাআলা এই গ্রন্থগুলোকে এমন মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা দান করেছেন যে, মুসলিমজাহানে এগুলোকে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্যরূপে গ্রহণ করা হয়। কুদরতের আজীব কারিশমা যে, হাদীসের এই ছয় ইমামের কেউই আরবে জন্ম গ্রহণ করেননি। তাঁরা সবাই ছিলেন অনারব এবং এই ভূখণ্ডের অধিবাসী। ইমাম বুখারী রাহ. যাঁর সংকলিত হাদীসগ্রন্থ ‘সহীহ বুখারী’ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর কিতাবের পর এটিই সর্বাধিক বিশুদ্ধ কিতাব, তাঁর জন্মও বুখারায়। এজন্য তাকে বুখারী বলা হয়। তাঁর ইন্তেকালও হয়েছে সমরকন্দের নিকটবর্তী একটি ছোট্ট গ্রামে। গোটা জীবন হাদীস শরীফের চর্চায় কাটিয়ে দিয়েছেন। নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে ইরাক, হিজায, শাম সফর করেছেন। কত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও হাদীস অন্বেষণ অব্যাহত রেখেছেন তা একটি দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যাবে। ইমাম বুখারী রাহ. এক শায়খের নিকট হাজির হলেন। তিনি সম্ভবত বাগদাদের একজন মুহাদ্দিস ছিলেন। একদিন শায়খ দেখলেন, মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল (ইমাম বুখারী) দরসে অনুপস্থিত। এমন অনেক ছাত্র থাকে যারা কখনো দরসে থাকে, কখনো থাকে না। কিন্তু ইমাম বুখারী ওই সকল তালিবে ইলমের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যারা সময়ের আগেই দরসে উপস্থিত হয় এবং সর্বদা সামনের সারিতে থাকে। যাদের অনুপস্থিতি উস্তাদ কল্পনাও করতে পারেন না। তো হঠাৎ একদিন তাকে অনুপস্থিত দেখে উস্তাদ ভাবলেন, হয়তো কোনো অসুবিধা হয়েছে। পরের দিন শায়খ দরসে এসে দেখলেন, আজও তিনি অনুপস্থিত। শায়খ চিন্তিত হলেন সে কি অসুস্থ হয়ে পড়েছে কিংবা অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে! সে তো না আসার মতো ছাত্র নয়। তো শায়খ একজনকে পাঠালেন, খোঁজ নাও সে কেন দরসে আসছে না। মসজিদের নিকটে একটি ছোট হুজরায় ইমাম বুখারী থাকতেন। সেই তালিবে ইলম গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ল। ভিতর থেকে আওয়াজ এল, কে? কেন এসেছেন? সেই তালিবে ইলম বলল, একটু বাইরে আসুন, শায়খ আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। ইমাম বুখারী বললেন, ভাই! আমি বাইরে আসতে অপারগ। আপনি ওখান থেকেই বলুন কেন এসেছেন? আগন্তুক বললেন, আপনি কেন দরসে আসছেন না? আপনি যদি অসুস্থ হয়ে থাকেন তাহলে আমরা আপনার সেবা-শুশ্রূষা করব। অন্য কোনো সমস্যা থাকলে তা দূর করার চেষ্টা করব। আপনার অনুপস্থিতির কারণে শায়খ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়েছেন। তার বারংবার পীড়াপীড়ির পর ইমাম বুখারী বললেন, পরিধানের একটি মাত্র কাপড় ছিল যা ধুয়ে ধুয়ে পরিধান করতাম। কিন্তু এখন তা বিভিন্ন জায়গায় এতই ছিড়ে গিয়েছে যে, সতর আবৃত রাখা সম্ভব নয়। তাই আমি অপারগ হয়ে ঘরে বসে আছি।
চিন্তা করুন, কী অবস্থার মধ্য দিয়ে ইমাম বুখারী ইলম হাসিল করেছেন। এমনি এমনি ইমাম বুখারী হওয়া যায় না এবং এমনি এমনি জগৎ কাউকে ইমাম ও মুকাতাদা হিসেবে গ্রহণ করে না।
আজ আমাদের সামনে তৈরি-রুটির মতো হাদীসের কিতাবসমূহ বিদ্যমান। কত আরামে বসে হাদীস পড়ছি ও শুনছি। অথচ মুহাদ্দিসগণ এক একটি হাদীস অর্জনের জন্য যে ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করেছেন তা চিন্তা করলেও অভিভূত হয়ে যেতে হয়। এভাবে ইলম হাসিল করার পর ইমাম বুখারী নিজ দেশ বুখারায় ফিরে যান। সেখানে একটি মাদরাসা আছে ‘মীরে আরব’ নামে, আজো বিদ্যমান রয়েছে। সে মাদরাসা যিয়ারতের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ওই মাদরাসায় তিনি তাঁর সংকলিত হাদীসগ্রন্থ আলজামিউস সহীহ লিপিবদ্ধ করিয়েছেন। সে যুগে ছাপাখানা ছিল না যে, কিতাব ছাপা হয়ে সবখানে ছড়িয়ে যাবে। তখন উস্তাদ হাদীস লেখাতেন, আর তালিবে ইলমরা তা লিপিবদ্ধ করত। এভাবে সেই মাদরাসায় ইমাম বুখারী রাহ. সহীহ বুখারীর নব্বই হাজার কপি লিখিয়েছেন।
এখন তো লাউড স্পীকারের যুগ। কিছু লোক উপস্থিত হলেই লাউড স্পীকার প্রয়োজন হয়। অথচ সে যুগে মুহাদ্দিসীনে কেরামের এক এক দরসে তালিবে ইলমের সংখ্যা এত বেশি হত, যা আজ বড় বড় সমাবেশেও হয় না। এক মুহাদ্দিস সম্পর্কে লিখেছে যে, তাঁর এক দরসে পনের হাজার দোয়াত-কলম গণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ হাদীস লিপিবদ্ধকারী তালিবে ইলম ছিল এই পরিমাণ। আর যারা শুধু হাদীস শোনার জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন তাদের সংখ্যা এর বাইরে।
হযরত ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. যিনি অনেক বড় মুহাদ্দিস ছিলেন, তাঁর দরস সকালে ইশরাকের পর শুরু হত। দরসে শরীক হওয়ার জন্য লোকেরা আগের দিন আসরের সময় গিয়ে জায়গা দখল করত।
এই বিপুল সমাবেশে দরস এভাবে হত যে, উস্তাদ সনদের একটি শব্দ বা হাদীসের একটি বাক্য বলতেন, যতদূর আওয়াজ যেত সবাই লিখত। এরপর একজন দাঁড়িয়ে উচ্চ স্বরে পুনরায় ওই শব্দ বা বাক্যটি বলত। যতদূর আওয়াজ যেত, তার শেষ মাথায় আরেকজন দাঁড়িয়ে উস্তাদের ওই শব্দ উচ্চারণ করত।
এভাবে অনেক দূর পর্যন্ত আওয়াজ পৌঁছানো হত। বিখ্যাত মুহাদ্দিসদের দরসগুলো এভাবেই হত। ইমাম বুখারী রাহ.ও এভাবে মাদরাসা ‘মীরে আরব’-এ বুখারী শরীফের নব্বই হাজার কপি লিখিয়েছেন।
ইমাম তিরমিযী রাহ. তিরমিযের লোক ছিলেন। সেটাও উযবেকিস্তানের অংশ। আরো বড় বড় ওলী বুযুর্গ এই অঞ্চলে পয়দা হয়েছেন। আপনারা সিলসিলায়ে নকশবন্দিয়ার কথা শুনে থাকবেন, যা তাসাওউফের অনেক বড় সিলসিলা। আমাদের এখানে হযরত থানভী রাহ. এর যে সিলসিলা আছে, তাতে চারো সিলসিলায় বায়আত করানো হয়। এর মধ্যে নকশবন্দিয়াও রয়েছে। এই সিলসিলার ইমাম হলেন, হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দী রাহ.। তিনিও ওই ভূখণ্ডের অধিবাসী ছিলেন। সমরকান্দের কাছে তার কবর আছে। হযরত খাজা উবায়দুল্লাহ আহরার রাহ., যিনি মাওলানা আবদুর রহমান জামী রাহ. এর শায়খ ও উস্তায ছিলেন তাঁর ঘটনা সম্ভবত আপনাদের বলেছি যে, এক লোক তাঁর বুযুর্গীর কথা শুনে তার কাছে এল। এসে দেখে তিনি বড় ব্যবসায়ী মানুষ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারবার নিয়ে ব্যস্ত। কিছু কিছু লোক আসে, তাদের কিছু নসীহতও করেন। তবে বেশিরভাগ সময় ব্যবসায় কাটাচ্ছেন। সে ভাবতে লাগল, আমি তো মনে করেছিলাম, তিনি আল্লাহর ওলী হবেন। বসে বসে আল্লাহ আল্লাহ করবেন। কিন্তু এখন দেখছি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারবার নিয়ে ব্যস্ত। এইসব ভাবনা তার অন্তরে আসতে লাগল। বিকেলে খাজা উবায়দুল্লাহ আহরার রাহ. হাঁটতে বের হলেন। এই লোকও সাথে চলল। হঠাৎ খাজা সাহেব রাহ. বললেন, আমার হজ্বে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। সঙ্গী লোকটি বলল, হযরত এ তো খুব ভালো কথা। আমিও আপনার সফরসঙ্গী হতে চাই। হযরত খাজা সাহেব রাহ. বললেন, ঠিক আছে চল।
সেই লোক বলল, হযরত এখনি? বললেন, হ্যাঁ, এখনি।
সে বলল, হযরত ঘরে আমার চাদর রেখে এসেছি। সেটা একটু নিয়ে আসি। হযরত বললেন, ভাই তোমার সামান্য চাদরের এত ফিকির যে, তা ছাড়া তুমি হজ্বে যেতে পারবে না, আর আমার দেখ কত ব্যবসা! কত কর্মচারী। সবকিছু ছেড়ে আমি যেতে তৈরি। আসল কথা হচ্ছে, তোমার মন আটকে আছে সেই চাদরে। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, আমার ব্যবসা খুব চলছে, অন্তর কোথাও বাধা পড়ে নেই। আর দুনিয়া তাকেই বলে যাতে মানুষের মন বাঁধা পড়ে থাকে। ছোট্ট একটা চাদরের মধ্যে বাঁধা পড়লে সেটাই দুনিয়া। আর অনেক বিত্তসম্পদের পরও যদি তাতে মন বাঁধা না থাকে তাহলে তা দুনিয়া নয়। খাজা উবায়দুল্লাহ আহরার রাহ.-এর কবরও সমরকন্দেই অবস্থিত।
তাঁর আরেকটি প্রসিদ্ধ ঘটনা আছে। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে সাথে বাদশাহর ইসলাহরও ফিকির করতেন। তার কাছে গিয়ে ওয়ায-নসীহত করতেন। মানুষ মনে করত যে, এই লোক একে তো ব্যবসায়ী তদুপরি রাজা-বাদশাহর সঙ্গেও তার ওঠা-বসা। জনৈক বুযুর্গ তাঁকে পত্র লিখলেন যে, হযরত আপনি এই ভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত আবার রাজা-বাদশার দরবারেও আসা যাওয়া করেন। এমন করা থেকে বিরত থাকুন যাতে মানুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়। উত্তরে তিনি একটি পংক্তি লিখলেন, যা অত্যন্ত প্রসিদ্ধ।
অর্থাৎ যদি পীর হতে চাই তাহলে কোনো পীর আর মুরীদই পাবে না। মানুষকে ইসলাহর প্রতি উদ্বুদ্ধ করা এবং নিজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রেখে তাদের ইসলাহ করার যোগ্যতাও আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। তাই আমি যদি পীর হয়ে যাই তাহলে কোনো পীরের আর মুরীদ জুটবে না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা আমাকে ভিন্ন কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং আমি তা করছি। তা হচ্ছে শাসক ও ক্ষমতাশালী লোকদের সংশোধন। আল্লাহ তাআলা যদি কবুল করেন তাহলে এটাই আমার আখেরাতের সম্বল।
হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচাত ভাই, হযরত কুসাম ইবনে আব্বাস রা.-এর কবরও সেখানে। তিনি এই অঞ্চলে সর্বপ্রথম ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আসেন এবং শহীদ হন। মোটকথা, এ ভূখণ্ড ইসলামের ইতিহাসের বড় বড় ব্যক্তিত্বকে বুকে ধারণ করে আছে। বড় বড় ফকীহ, ওলী, মুহাদ্দিস এবং ইলমে কালাম ও আকায়েদের বড় বড় ইমাম এখানে সমাহিত। কিন্তু আমাদের বদ আমলের পরিণামে যে মারকায সদা ক্বালাল্লাহ ও ক্বালার রাসূলের আওয়াজে প্রকম্পিত থাকত তা কমিউনিস্টদের আগ্রাসনের শিকার হয়ে যায়। কমিউনিজমের বিপ্লবের পর তারা ধীরে ধীরে এই সকল অঞ্চল কব্জা করে ফেলে। এই যে তুর্কিস্থান, যা ইতিহাসে তুর্কিস্থান, তুরান আবার কখনো ফারেহান নামে প্রসিদ্ধ, তার আয়তন এত বড় ছিল যে, সমগ্র হিন্দুস্থান, পাকিস্থান, বাংলাদেশ ও সাউদী আরব মিলেও তার সমান হওয়া কঠিন। কিন্তু রুশরা একে খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলেছে। আর যুলুম-নির্যাতনের এমন দাস্তান কায়েম করেছে যে, দুনিয়ার আর কোথাও এর নজির পাওয়া মুশকিল হবে।
সেখানে আযান নিষিদ্ধ করা হল। মসজিদগুলো বন্ধ করে দেওয়া হল। নামায পড়ার অনুমতি ছিল না। কালিমা পড়ার অনুমতি ছিল না। মসজিদগুলোকে কোথাও সিনেমা হলে পরিবর্তন করা হল, কোথাও গুদাম, কোথাও ওয়ার্কশপ, আবার কোথাও অফিস বানানো হল। কেউ নামায পড়তে চাইলে তার উপর এমন পাশবিক ও ভয়ানক শাস্তি নেমে আসত, যার দৃষ্টান্ত পাওয়া দুষ্কর। আলিমগণ বিশেষ টার্গেটে পরিণত হলেন। ইতিপূর্বে তারা ছিলেন অত্যন্ত সম্মানের পাত্র। তাদেরকে ‘মোল্লা’ বলা হত। ইংরেজরা এ শব্দকে সমাজে অপাংক্তেয় করে দিয়েছে। এটা এখন গালি হয়ে গিয়েছে। অথচ তা ছিল অত্যন্ত মর্যাদার শব্দ। বড় আলেম, ফাযেল ও শিক্ষিত লোককে সম্মানের জন্য মোল্লা উপাধি দেওয়া হত। ইংরেজরা যখন দেখল, মোল্লা সমপ্রদায়ই আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু তখন তারা বিভিন্ন কৌশলে এর এত নিন্দা করল যে, এখন তা গালিতে পরিণত হয়েছে। অথচ মোল্লাগণই দীর্ঘ ৭০ বছরের আগ্রাসনকালে সকল প্রকার জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে এই জাতির ঈমানকে টিকিয়ে রেখেছে। যার সম্পর্কে সন্দেহ হত যে, ইলমে দ্বীনের সাথে তার সামান্যতম সম্পর্ক রয়েছে, উলামাদের সঙ্গে তাকেও উত্তপ্ত চুনভর্তি গর্তে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হত। কাউকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন দেওয়া হত, যেখানে তাপ মাত্রা মাইনাস ৬০ ডিগ্রী। অনেকের নখ উপড়ে ফেলা হত। চামড়া খসিয়ে ফেলা হত। আর এসব ছিল প্রতিদিনের দৃশ্য। এই পাশবিকতা ও বর্বরতার মাঝেও তারা দ্বীনী ইলমের চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। লুকিয়ে লুকিয়ে, ভূ-গর্ভের গোপন কক্ষে তারা ক্বালাল্লাহ-ক্বালার রাসূলের পঠন-পাঠন অব্যাহত রেখেছেন।
আমরা সমরকন্দে এক মসজিদের ইমাম সাহেবের মেহমান হয়েছিলাম। তিনি সে অঞ্চলের একজন প্রসিদ্ধ ইমাম। তিনি আমাদের বলেছেন, এ মসজিদটি রুশ বিপ্লবের পর সিনেমা হল বানানো হয়েছিল। কিছুদিন আগে এলেও আমি আপনাদের সিনেমার পোস্টারগুলো দেখাতে পারতাম, যা এর দেয়ালে লাগানো ছিল। সে সময় নামায পড়ার অনুমতি ছিল না। আমার আব্বা ছিলেন এই মসজিদের খাদেম। বিপ্লবের পর তাকে ক্ষেতের কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তাকে ক্ষেতের কাজে ব্যস্ত থাকতে হত। দুপুরে ঘরে এসে নামায পড়তেন। ঘরে জায়নামায রাখার তো প্রশ্নই আসে না। কারণ যে কোনো সময় তল্লাশী হতে পারে। তখন যদি জায়নামায পাওয়া যায় তাহলে পুরা পরিবারের আর রক্ষা ছিল না। তাই মেঝেতেই নামায পড়তে হত। এতেও বিপদের আশঙ্কা ছিল। আম্মাকে বলতেন, তুমি চা বানিয়ে রাখ। যেন কেউ আসলে বলা যায় যে, চা তৈরি হচ্ছিল বা চা পান করছিল। এভাবে আব্বা নামায পড়তেন।
ইমাম সাহেব বলেন, আমি তখন ৪-৫ বছরের শিশু। আমাকে দরজায় দাঁড় করিয়ে দিতেন যেন আমি বাইরে নজর রাখি এবং কেউ আসলে বলি, আব্বা ভিতরে চা পান করছেন। কমিউনিস্ট সরকারের লোকেরা রাস্তায় ঘোরাফেরা করত। তারা এসে আমাকে আখরোট দিয়ে জিজ্ঞাসা করত, তোমার আব্বা ভিতরে কী করছেন? আমি বলতাম, চা পান করছেন। তারা বলত, না ভিতরে হয়ত নামায-টামায পড়ছে। এভাবে আমাকে ফুসলাতে চেষ্টা করত। তিনি বলেন, শৈশবের দিনগুলোর কথা আমার আজো মনে আছে। সারাদিন খাটা-খাটুনির পর রাতে যখন বসতির লোকজন ঘুমিয়ে পড়ত, তখন আব্বা আমাকে গোপন কক্ষে নিয়ে কুরআন মজীদ পড়াতেন। সেই কক্ষটা এমন ছিল যে, বাইরে থেকে দেখতে একটা আলমারীর মতো মনে হত। তার উপর বাসন-পেয়ালা ইত্যাদি রেখে দেওয়া হত। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল গোপন কক্ষে যাওয়ার দরজা। সেখানে আব্বা আমাকে কুরআন মজীদের তা’লীম দিতেন। শুধু কুরআন মজীদই নয়; আরবী ভাষার ও ইসলামী উলূমের তা’লীমও আমি সেখানেই হাসিল করি।
সারা দিন ক্ষেতের পরিচর্যা, আর রাতে বাচ্চাদের গোপনে পড়ানো এই ছিল তার কাজ।
সেসময় আব্বা আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, যা এখনো মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘বেটা, আমার জীবনের তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর পরোয়ানা এসে যেতে পারে। এই দ্বীন তোমার কাছে আমানত রেখে যাচ্ছি। এটা হল সেই যমানা, যার সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গেছেন, ‘এক সময় এমন আসবে যখন দ্বীনের উপর থাকা হাতের মুঠোয় আগুনের অঙ্গার ধরে রাখার মতো কঠিন হবে। বেটা, তোমার হাতে এই অঙ্গার আমি রেখে যাচ্ছি। যা তুমি ফেলে দিতে পারবে না। যদি ফেলে দাও তাহলে জাহান্নামের আগুন তোমাকে গ্রাস করবে। আর যতক্ষণ ধরে রাখবে, তোমাকে এর জ্বলন সহ্য করতে হবে।
এভাবে আল্লাহর বান্দারা দ্বীন হিফাযত করেছেন। যেখানেই কোনো মোল্লা ছিল তার ঘর ছিল একটি মাদরাসা। রাতের আঁধারে, ভূ-গর্ভের গোপন কক্ষে এই মাদরাসাগুলো চলত।
আজ মোল্লাদের নিন্দা করার লোক অনেক আছে। কিন্তু তারা জানে না যে, আল্লাহ তাআলা তাদের মাধ্যমেই তার কালিমাকে হিফাযত করেছেন। অনাহারে, অর্ধাহারে থেকে, সকল যন্ত্রণা সহ্য করে এবং মাথার উপর মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে তারা শুধু চেষ্টাই করেছেন যে, এই কালিমা উম্মতের মাঝে অক্ষত থাকুক। আজো সেসব অঞ্চলে যতটুকু দ্বীন আছে তা এসকল কুরবানীরই ফসল।
সেখানে অনেক আলিমের সাথে আমাদের দেখা হয়েছে। তাদের সাথে আরবীতে কথা হত। এছাড়া কথা বলার আর কোনো উপায়ও ছিল না। তারা খুব ভালো আরবী বলেন। তো যাকেই জিজ্ঞাসা করেছি, ভাই আপনি আরবী কোথায় শিখেছেন তিনিই উত্তরে বলেছেন, ‘হুজরাতে শিখেছি’। হুজরা মানে কক্ষ। প্রত্যেক মোল্লার বাড়িতে গোপন ঘরে ইলম চর্চার যে ব্যবস্থা ছিল এরই নাম হুজরা। সাধারণ মানুষ সুখ-নিদ্রায় বিভোর হত আর তারা দ্বীনের চর্চায় মশগুল হতেন। এভাবে আল্লাহ তাদের ঈমান হিফাযত করেছেন। শুধু তা-ই নয় আল্লাহ তাদেরকে ঈমানের মিষ্টতাও দান করেছেন।
আমরা তো উত্তরাধিকার সূত্রে ইসলামকে পেয়েছি। আল্লাহ তাআলা নিজ মেহেরবানীতে মুসলমান পিতামাতার সন্তান বানিয়েছেন। তাই অতি সহজে ঈমান ও ইসলামের দৌলত আমরা পেয়ে গেছি। একটি কাঁটাও আমাদের পায়ে বিঁধেনি। ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করতে হয়নি। ত্যাগ ও কুরবানীর সম্মুখিন হতে হয়নি। আল্লাহ তাআলা মেহেরবানী করে এই নিয়ামত দিয়ে দিয়েছেন। তাই এর কদর নেই।
এর মূল্য তাদেরকে জিজ্ঞাসা করুন, যারা ঈমান রক্ষার জন্য প্রাণ বিপন্ন করেছেন। এটা সহজ কথা নয় যে, সত্তর বছর নির্যাতন-নিপীড়নের চাকায় পিষ্ট হওয়ার পরও তারা পুনরায় মুসলমানরূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। শেষ দিকে রুশ সরকারও কিছু মসজিদ-মাদরাসা খুলে দিয়েছিল। মানুষ গেলে দেখাত যে, আমাদের এখানে মসজিদ-মাদরাসা আছে। কিন্তু এর সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। রুশদের সময় সবচেয়ে বড় মাদরাসা ছিল তাশখন্দে, তাতে সর্বোচ্চ চল্লিশ জন ছাত্রের পড়ার অনুমতি ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর এখন ছোট ছোট মাদরাসায় গিয়ে দেখুন, কোথাও ছাত্রসংখ্যা দুই শত, কোথাও পাঁচশত আবার কোথাও হাজার। আল্লাহ তাআলার মেহেরবানীতে তালিবে ইলমের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা এজন্য শোকরগোযারী করেন যে, আলহামদুলিল্লাহ আমরা কুরআন মজীদ পড়তে পারছি। কিন্তু কুরআন মজীদের নুসখা তাদের কাছে নেই। মসজিদ মুসল্লী দ্বারা পরিপূর্ণ। কিন্তু কুরআনের নুসখা নেই।
আমাদের এক সাথীর সাথে কুরআন মজীদ ছিল। সে জুমআর দিন মসজিদে বসে তিলাওয়াত করছিল। মসজিদে পাঁচশ’র মতো মুসল্লী নামায পড়তে এসেছিল। যে-ই আসত সেই কুরআন মজীদের নুসখাটির দিকে অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকত যে, আহা! কি নিয়ামত নিয়ে সে বসে আছে! কুরআন মজীদের নুসখা এতই কম যে, তাদের কাছে এ রকম নুসকা থাকাটা রীতিমতো একটা বিস্ময়কর ব্যাপার।
বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য নূরানী কায়দা নেই। যে কপিটি পড়ানো হচ্ছিল তা দেখলাম ১৯১৭ সনের ছাপা। অর্থাৎ রুশ বিপ্লবের সময়কার। তা-ই ফটোকপি করে পড়ানো হচ্ছে। এই রকম উপায়-উপকরণহীন অবস্থায় সময় কেটেছে। এরপরে আল্লাহ তাআলা এই ঈমানের মূল্য বোঝার তাওফীক দান করেছেন। পক্ষান্তরে এমনও অনেক ছিল যারা সেই স্রোতে ভেসে গিয়েছে। যারা মোল্লার অধীন ছিল না। মোল্লার সঙ্গে যাদের সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। তারা এমনভাবে ভেসে গিয়েছে যে, কালিমা জানে না। কালিমা কী জিনিস চিনে না। নাম তো মুসলমান, কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে কিছুই সে জানে না। এই হচ্ছে অবস্থা যা আমরা সেসব এলাকায় প্রত্যক্ষ করেছি।
কিছুদিন পূর্বে আমার চীন সফরের সুযোগ হয়েছিল। সেখানেও কম-বেশি একই রকম অবস্থা চোখে পড়েছে। দীর্ঘ দিন যাবৎ চীনে নামায পড়া নিষিদ্ধ ছিল। মসজিদগুলো তালাবদ্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও আল্লাহর বান্দারা দ্বীনের হিফাযত করেছেন। মাটির নিচের গোপন কক্ষে কিতাব সংরক্ষণ করেছেন। চীনে আমরা এক আশ্চর্য বিষয় দেখেছি। এক মাদরাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে ছোট ছোট বাচ্চাদের মাথায় পাগড়ি বাঁধা। বারো-তেরো বছরের বাচ্চা। প্রত্যেকের মাথায় পাগড়ি। আমি বললাম, মাশাআল্লাহ, খুব সুন্দর লাগছে দেখতে। বাচ্চাদের মাথায় এমনিতেও পাগড়ি খুব সুন্দর লাগে। মনে হচ্ছে সুন্নতের অনেক যত্ন রয়েছে এখানে। আপনারা কোত্থেকে এই রীতি চালু করলেন? মজমায় তো কেউ এর উত্তর দেয়নি। পরে একান্তে একজন ইমাম সাহেব বললেন, আসল কথা এই যে, কিছু দিন হল এখানে বাচ্চাদের ধর্মীয় শিক্ষার অনুমতি পাওয়া গেছে। কিন্তু এখনো আইন আছে যে, আঠারো বছরের নিচে কোনো বাচ্চাকে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া যাবে না। তাই আমরা বাচ্চাদের মাথায় পাগড়ি বেঁধে দিয়েছি। এতে বাচ্চাদের একটু বড় বয়সের মনে হয়। হঠাৎ যদি ইন্সপেকশন শুরু হয় তাহলে দূর থেকে দেখে যেন মনে হবে, এখানে সব বড় বাচ্চারা পড়ে। কোনো ছোট বাচ্চা নেই। এই ভাবে আল্লাহর বান্দারা দ্বীনকে হিফাযত করেছেন এবং এ যুগেও দ্বীনের জন্য কুরবানী দেওয়ার দৃষ্টান- স্থাপন করেছেন।
উযবেকিস্তানের এই সফরে যে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে তাতে আমাদের জন্য চিন্তার অনেকগুলি বিষয় রয়েছে। এক. আল্লাহ তাআলা আমাদের অসংখ্য নিয়ামত দান করেছেন। পরাধীনতার যুগ আমাদের উপর দিয়েও গিয়েছে। ইংরেজ শাসনামলে আমরাও পরাধীন ছিলাম, কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, তখনও নামাযের উপর, কুরআন মজীদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়নি। অথবা শুধু মুসলমান হওয়াই অপরাধ বলে গণ্য হয়নি। জুলুম-অত্যাচার আমাদের উপরও হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি আলহামদুলিল্লাহ। আর এখন আযাদীর পর তো আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। স্বাধীনতার নেয়ামত আল্লাহ আমাদের দান করেছেন। কিন্তু এই নেয়ামত পাওয়ার পর গাফলত, না-কদরী আমাদের পেয়ে বসেছে। আজো অনেকের মুখে শোনা যায় যে, ভাই! এই যুগে দ্বীনের উপর চলা বড় মুশকিল। আরে মুশকিল কী জিনিস তা তো তুমি দেখইনি! এটা তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, যারা শুধু এক ওয়াক্ত নামায পড়ার জন্য জান কুরবান করে দিয়েছেন। এই সফরে প্লেনে এক ব্যক্তির সাথে কথা হয়েছে, আন্দাজানের এক মসজিদের ইমাম, ফারগানার বাসিন্দা। তিনি বলেছেন, আমি এক জায়গায় আযান দিয়েছিলাম সেজন্য ছয় বছর জেল খাটতে হয়েছে। আজ তো কেউ আমাদের দিকে বন্দুকের নল উঁচিয়ে বলছে না যে, নামায পড়তে পারবে না। রোযা রাখতে পারবে না। বাচ্চাদের কুরআন শেখাতে পারবে না।
জায়গায় জায়গায় আলহামদুলিল্লাহ কুরআন মজীদের মকতব আছে। মাদরাসা আছে। আলেম-ওলামা আছে। বিনা বেতনে শিক্ষা দেওয়ার লোকও আছেন। ডেকে ডেকে বলা হচ্ছে, আমাদের এখানে আসুন, বাচ্চাদের ভর্তি করান। দ্বীনী ইলম শেখান। কিন্তু সেদিকে আমাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। বাচ্চা সামান্য পড়া-শোনার উপযুক্ত হলেই তাকে গিট-পিট (হাবি-জাবি) শেখাও। তাকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে, নার্সারীতে ভর্তি করাও। কুরআন মজীদ পড়ানোর দরকার নেই। ইসলামী শিক্ষা, দ্বীনী ইলম শেখানো সময়ের অপচয়মাত্র। (নাউযুবিল্লাহ!) যদি সেই আল্লাহর বান্দারা আমাদের অবস্থা দেখেন যারা নিজ সন্তানকে দ্বীনী ইলম শেখানোর জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, তাহলে তাদের সন্দেহ হবে যে, সত্যিই এরা মুসলমান কি না। তাই আমাদের চিন্তা করা উচিত যে, তারা কত কষ্ট-ক্লেশ ও উপায়-উপকরণহীনতার মাঝে ঈমানের হিফাযত করেছেন। পক্ষান্তরে এত নেয়ামত থাকা সত্ত্বেও আমাদের মাঝে কত অবহেলা ও গাফলত!
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে : আমার শ্রদ্ধেয় আব্বাজান রাহ. বলতেন, আজ যত ইসলামবিরোধী আন্দোলন, তাদের প্রথম টার্গেট উলামায়ে কেরাম। তারা মানুষকে বোঝায় ভাই! আমরা ইসলাম বিরোধী নই। ইসলাম তো অনেক ভালো জিনিস। কিন্তু এই মৌলভীরা ইসলামের নানা রকম ভুল ব্যাখ্যা করে একে অত্যন্ত খারাপ করে ফেলেছে। যত বাতিল ফেরকা, তাদের প্রথম টার্গেট আলেম সমপ্রদায়। আব্বাজান রাহ. বলতেন, এর কারণ হচ্ছে, যদি এক পাল ভেড়া রাস্তা দিয়ে যেতে থাকে আর নেকড়ে তার উপর আক্রমণ করতে চায় তাহলে তার প্রথম উদ্দেশ্য হয় রাখালকে শেষ করা। যখন রাখাল থাকবে না তখন ভেড়াগুলোকে খাওয়া সহজ হবে। আর যদি রাখাল জীবিত থাকে, তাহলে দু একটি ভেড়া কোনোভাবে খেতে পারলেও সে নিস্তার পাবে না। নেকড়েকে শেষ করে দিবে। তাই আব্বাজান রাহ. বলতেন, সকল ইসলাম বিরোধী বাতিল শক্তির প্রথম টার্গেট মৌলভীদের শেষ করে দেওয়া। এদের বদনাম করা। জনগণকে এদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। এদেরকে সমাজের নিচু শ্রেণীতে পরিণত করা। কেননা, আলেম-ওলামা তাদের পথের কাঁটা। এই কাঁটা সরিয়ে দিতে পারলে সাধারণ মানুষকে শিকার করা অত্যন্ত সহজ। যতক্ষণ এই মৌলভী বসা আছে, সে সবকিছুর উপর আপত্তি তুলবে। মতলব হাসিলে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। আর এরা এমন কঠিন প্রাণী যে, এদের উপর রাইফেল-মেশিনগানের গুলিও কোনো ক্রিয়া করে না। নির্বাসন এর উপর কোনো প্রভাব ফেলে না। অনাহার-অর্ধাহারের পরোয়া করে না। সকল প্রতিকূল অবস্থাতেও ক্বালাল্লাহ, ক্বালার রাসূল ছাড়তে রাজি নয়। তাই এদের খতম কর। যতক্ষণ এরা নিশ্চিহ্ন না হবে ততক্ষণ এই জাতি তোমাদের কব্জায় আসবে না। এটাই সকল বাতিলপন্থীর পলিসি। রাশিয়ার ওই ভূ-খণ্ডেও তা প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু দুনিয়া দেখেছে যে, সে অন্ধকার যুগে যে ব্যক্তি মোল্লার সাথে নিজেকে জুড়ে রেখেছিল তাকে আল্লাহ তাআলা হিফাযত করেছেন। তার ঈমান বেঁচে গিয়েছে। আর যে বিচ্ছিন্ন সে সয়লাবে ভেসে গেছে।
মরহুম ইকবাল যিনি আমাদের উর্দূ ভাষার প্রসিদ্ধ কবি। তাঁর অনেক কবিতাই প্রসিদ্ধ। মোল্লাদের বিরুদ্ধেও তার অনেক কবিতা আছে। মোল্লাদের সম্পর্কে ইংরেজরা তার মানসপটে যে চিত্র অঙ্কিত করেছিল তাতে তিনি ‘মোল্লার আযান’ ও ‘মুজাহিদের আযান’ ইত্যাদি লিখেছিলেন। তিনি এক কবিতায় অত্যন্ত মূল্যবান কথা বলেছেন। ইংরেজদের চিন্তা উন্মোচন করে তিনি বলেন,
‘‘যদি আফগানীদের মন থেকে দ্বীনী আত্মমর্যাদাবোধ বের করতে হয় তবে তার একমাত্র পথ হচ্ছে আফগানিস্তানের পর্বতরাজি থেকে মোল্লাদের বের করে দাও।’’ কারণ যতক্ষণ এরা থাকবে ততক্ষণ আফগানীদের অন্তর থেকে ঈমানের আলো নির্বাপিত হবে না। এই পলিসি ইংরেজদেরও ছিল। ইসলামের সকল দুশমনেরও একই পলিসি। কারণ সরাসরি ইসলামের বিরুদ্ধে হামলা করলে সাধারণ মানুষ তা বরদাশত করবে না। কেউ যদি বলে ভাই! ইসলাম ছেড়ে দাও, তাহলে সে যত বে আমলই হোক বলবে, নাউযুবিল্লাহ! মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়ে যাবে কিন্তু ইসলাম ছাড়তে রাজি হবে না। তাই তারা এই কৌশল অবলম্বন করে যে, মৌলভীদেরকে আস্থাহীন করে দাও, তাদের সম্পর্ক জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দাও, যখন এই মৌলভীরা থাকবে না, দ্বীনের কথা বলার লোক থাকবে না তখন মুসলমানদের গ্রাস করা সহজ হবে। আজ আমাদের সমাজে এটা রীতিমতো একটা আন্দোলনের রূপ ধারণ করেছে। আমার সম্মানিত পিতা অত্যন্ত সুন্দর বলতেন। লোকেরা বলত ভাই! মৌলভী একসময় অত্যন্ত ভালো সমপ্রদায় ছিল। কিন্তু আজ আর তেমন নেই। এরা এখন ধোঁকাবাজ হয়ে গিয়েছে। তাই আমরা এখন কোথায় যাব?
আল্লামা ইকবাল বলেন,
অর্থাৎ এই মৌলভী, দরবেশ, সুফীরা নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্য বিভিন্ন ধান্দা করে, তাই আমরা সাধারণ মানুষ কোথায় যাব? আমার শ্রদ্ধেয় আব্বাজান এর উত্তরে বলতেন, ভাই! যুগটাই হচ্ছে ভেজালের। খাঁটি কোনো জিনিস এখন পাওয়া যায় না। আমাদের দেশের অবস্থা দেখুন,
তেল, আটা, ঘি কোনো কিছুই খাঁটি পাওয়া যায় না, এমনকি কেউ কেউ বলে যে, খাঁটি বিষও পাওয়া যায় না। এক লোক ভেজাল খেতে খেতে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যা করার জন্য বিষ পান করল। এখন সে বিষ পান করে অপেক্ষা করছে যে, কখন মৃত্যু আসবে। কিন্তু মৃত্যু তো আসছে না। পরে বোঝা গেল যে, ওই বিষেও ভেজাল ছিল। কিন্তু তাই বলে কি আমরা সবকিছু ছেড়ে দিয়েছি। আমরা কি বলি, আটা খাঁটি পাওয়া যায় না তাই আটা খাব না, ভূষি খাব! ঘি-তেল খাঁটি পাওয়া যায় না তো গিরিস খাব। এমন তো কেউ বলে না; বরং তালাশ করে বের করে কোন দোকানে খাঁটি ঘি পাওয়া যায়। কোন দোকানে ভালো চিনি পাওয়া যায়। তাই সাইনবোর্ড লাগিয়ে বসে আছে, আর মানুষের প্রাণ, সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। কিন্তু কেউ বলে না যে, সব ডাক্তার ধোঁকাবাজ, সব ইঞ্জিনিয়ার ধোঁকাবাজ, সব উকিল ধোঁকাবাজ, পয়সা খাওয়ার লোক। তাই এদের পরিত্যাগ কর। এমন কেউ করে না। সকল ভেজাল সত্ত্বেও যে অনুসন্ধান করে, সে খাঁটি জিনিস খুঁজে বের করেই ফেলে। তাই আমার শ্রদ্ধেয় পিতা বলেন, আজো যদি কেউ সত্যিকারের তলব নিয়ে তালাশ করে, তাহলে সে আজো পাবে। এটা কুরআনের ওয়াদা। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা) হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।-সূরা তাওবা : ১১৯)
এই সত্যাবাদীদের দল কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। তবে অনুসন্ধানকারীর আগ্রহ দরকার। সামান্য মেহনত ও তালাশের প্রয়োজন। তাই এর কারণে পুরো গোষ্ঠীর ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করা আর তাদের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া এটা কোনোভাবেই ঠিক নয়।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরেকটি মূল্যবান কথা বলেছেন, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। তিনি বলেন, সমস্যা আরো আছে। তা হচ্ছে : আজ যখন কেউ পীর ও মুরশিদ তালাশ করে তো নিজের আমল-আখলাক যতই খারাপ হোক না কেন পীর চায় জুনাইদ বাগদাদী আর শিবলীর মতো। আবদুল কাদের জীলানী আসলে, শিবলী আসলে, জুনায়েদ বাগদাগী আসলে তাদের রাহনুমায়ী কবুল করব। অন্যথায় সাধারণ লোকাদের রাহনুমায়ী আমি কবুল করতে পারি না। এই ইবলিস আমাদের দেমাগে সওয়ার হয়ে আছে। আরে ভাই! সেই মাপের লোক এখন কোত্থেকে আসবে? আমার আব্বা বলতেন, ভাই! যেমন রূহ তেমন ফেরেশতা। যেমন মুরীদ তেমন তার পীর। জুনাইদ আর শিবলী না হোক, তুমি যে স্তরের সেই স্তরের পীর আজো আছে। আর আলহামদুলিল্লাহ এটাই তোমার জন্য যথেষ্ট।
এক ব্যক্তি তাকে বলেছিলেন যে, হযরত কী করব? কোনো দিকে মন নিশ্চিন্ত হয় না। যার দিকে দেখি তার কোনো না কোনো দোষ সামনে এসে যায়। মন তার দিকে আকৃষ্ট হয় না। তাই কী করব? কার কাছে যাব?
তিনি বলেন, এই চোখে না লাগার কারণ হচ্ছে চোখে অহংকারের ঠুলি দিয়ে রেখেছে। তুমি গিয়ে তোমার মসজিদের মুআযযিনের সংস্পর্শে থাক, তার দ্বারা তোমার ফায়দা হবে। কারণ মসজিদের মুআযযিন দিনে পাঁচবার আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তাই তুমি যখন পিপাসা নিয়ে যাবে তখন তার দ্বারাও তোমার ফায়দা হবে। কারণ দেওয়ার মালিক তো আল্লাহ তাআলা। আগেও কয়েকবার বলেছি যে, কোনো শায়খের ক্ষমতা নেই যে, কিছু দেবে। দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ। তাই যখন তুমি সত্যিকারের তলব নিয়ে এমন লোকের কাছে যাবে যার মধ্যে শরীয়তবিরোধী কোনো কিছু নেই, তোমার ফায়দা হবে। যদি অন্য কাউকে না পাওয়া যায় তখন মসজিদের মুআযযিনের সংস্পর্শে বস, তোমার উপকার হবে। বাস্তবিক পক্ষে এটা অনেক বড় একটি চক্রান্ত যে, উলামাদের উপর অভিযোগ উত্থাপন করে, ভাই! আমরা ইসলামের কোনো কিছু নেই, তোমার ফায়দা হবে। যদি অন্য কাউকে না পাওয়া যায় তখন মসজিদের মুআযযিনের সংস্পর্শে বস, তোমার উপকার হবে। বাস্তবিক পক্ষে এটা অনেক বড় একটি চক্রান্ত যে, উলামাদের উপর অভিযোগ উত্থাপন করে, ভাই! আমরা ইসলামের শত্রু নই, আমরা এই মৌলভীদের বিরোধিতা করি, যারা ইসলামকে ভুল বুঝিয়েছে। ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করেছে। এদের উপর আমাদের অভিযোগ। আল্লাহ তাআলা এই সম্প্রদায়কে মর্যাদা দান করেছেন যে, এদেরকে ইসলামের জন্য ঢাল বানিয়ে দিয়েছেন। শত্রুরা ইসলামের উপর অভিযোগ তুলতে চায়, কিন্তু যেহেতু ইসলামের উপর অভিযোগ উঠানোর সাহস হয় না তাই এই বেচারাদের উপর আপত্তি উঠায়। এই চক্রান্তের বিষফল যা আমি ইতিপূর্বে আপনাদের বলেছি যে, যারা এদের (উলামাদের) সাথে সম্পৃক্ত ছিল না তারা বে-দ্বীনীর সয়লাবে ভেসে গিয়েছে। আজ কালিমাও জানে না। তাই এই প্রোপাগাণ্ডায় কখনোই জড়ানো উচিত নয়।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলের হিফাযত করুন। আহলে হকের সাথে সর্বদা আমাদেরকে জুড়ে রাখুন এবং দ্বীন ও ঈমানের মূল্য বোঝার তাওফীক দান করুন। আমীন

বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১২

কলম্বাসের পূর্বেই মুসলমান কর্তৃক আমেরিকা আবিষ্কার এবং আমেরিকায় ইসলাম বিস্তৃতির ক্রমধারা র বিস্তারীত আলোচনা

কলম্বাসের পূর্বে মুসলমান কর্তৃক আমেরিকা আবিষ্কার এবং আমেরিকায় ইসলাম বিস্তৃতির ক্রমধারা

Share0 ShareThis
১৮৩৫ সালে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত লেমিন কেবে (Lamine Kebe) বলেন “আমেরিকায় কিছু ভাল মানুষ আছে, কিন্তু আফ্রিকা এবং ইসলাম সম্পর্কে তারা সকলে খুবই অজ্ঞ (There are good men in America, but all are very ignorant of Africa and very ignorant of Islam)”। আমেরিকান জনগনের ইসলাম সম্পর্কে কোন ধারনা না থাকলেও বহু পূর্ব থেকেই আমেরিকায় মুসলমানদের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। কলম্বাস পূর্ব যুগে দু একজন মুসলমানের আমেরিকায় আগমনের ইতিহাস পাওয়া গেলেও মূলত ষোড়শ শতক হতে আফ্রিকা থেকে ধৃত মুসলমান দাস দাসীদের মাধ্যমেই মুসলমানরা তাদের স্বীয় ঐতিয্য স্বল্প পরিসরে হলেও টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয় স্বমহিমায়।
কলম্বাস পূর্বযুগে আমরেরিকায় মুসলমান
১১৭৮ সালে সং শাসনামলে (Song Dynasty) সারকা (Circa) নামে একজন চাইনিজ লেখক কর্তৃক লিখিত একটি দলীল সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে যা সুং দলীল (Sung Document) নামে পরিচিত। সুং দলীল থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় ১১৭৮ সালে চীন থেকে যাত্রা শুরু করে একদল মুসলমান নাবিক “Mu-Lan-Pi (বর্তমান ক্যালিফোর্নিয়া)” নামক আমেরিকার একটি অঞ্চলে পৌছায়। সে মোতাবেক কলম্বাসের তিন শতক আগে মুসলমানেরাই প্রথম আমেরিকায় আবিষ্কার করে।
ব্রিটিশ নৌ ইতিহাসবিদ গ্যাভিন মানজিস (Gavin Manzies) তার লিখিত বই “১৪২১” এ উল্লেখ করেছেন ১৪২১ সালে ঝেং হি (Zheng He) নামে একজন চাইনিজ মুসলমান কলম্বাসেরও ৭১ বছর পূর্বে আমেরিকায় গমন করেন। ঝেং হি তার নৌ অভিযান পরিচালনা করার জন্য ফুজিয়ান, গুয়াংডোং এবং ঝেজিয়াং (Fujian, Guangdong and Zhejiang) প্রদেশ থেকে বাছাই করে দক্ষ মুসলমান নাবিক সংগ্রহ করেন। অতঃপর ঝেং হি চুয়াঝৌ (Quazhou) প্রদেশে গমন করেন এবং সুন্দর ও নিরাপদ ভ্রমন প্রার্থনায় স্থানীয় মসজিদে নামাজ আদায় করেন। সেখান থেকেই ঝেং তার দলবল নিয়ে নৌ অভিযান শুরু করেন এবং আমেরিকায় পৌছতে সক্ষম হন।
সুং ডকুমেন্ট এবং ব্রিটিশ লেখক গ্যাভিন মানজিসের লেখার বিষয়বস্তু এখনও বিষদভাবে প্রমানিত হয় নি যদিও অনেক ইতিহাসবিদ তখনকার সার্বিক অবস্থা মূল্যায়ন করে ঘটনা দুটি সত্য হিসেবে প্রতিপাদ্য করেছেন। কর্নেল কেন্নোন (Colonel Kennon) নামক একজন নৌ ইতিহাসবিদ বলেছেন, “এশিয়া থেকে আমেরিকার গতিপথ যতটুকু আমি জানি, এবং জাপানিজ ও চাইনিজদের আমি যতটুকু দেখেছি, তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই অনেক গোড়া থেকেই তারা মাঝে মাঝে আমেরিকা উপকূল ভ্রমন করত (From what I know of the track across from Asia to America, and from what I have seen of the Japanese and Chinese, I have no doubt whatever that from very early times they occasionally visited our American shores (Kennon, 2005))।” উপরন্তু তখনকার সময়ে মুসলমানরা ছিল শিক্ষা দীক্ষাসহ সর্বেক্ষেত্রে আগ্রগামী। সমুদ্রে জাহাজ পরিচালনায়ও মুসলমানদের ছিল অসামান্য দক্ষতা। সে হিসেবেও ঘটনা দুটিকে সত্য প্রতিপাদন করা যায়।
কলম্বাসের ভারত বা জাপান (আমেরিকা) অভিযান
কারো কারো মতে ১৪৯২ সালে কলম্বাস কর্তৃক ভারত বা জাপান অভিযানের সময় তার প্রধান কয়েকজন সহযোগী ছিল মুসলমান। ১৪৯২ সালে স্পেনে সর্বশেষ মুসলিম খলীফার পতন হলে রাতারাতি রানী ইসাবেলা এবং ফার্দিনান্দ মুসলমানদের অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে যান। গ্রানাডা জয় করার দুই তিন মাস পর একই বছর অর্থাৎ ১৪৯২ সালে রানীর অর্থনৈতিক সহযোগীতায় আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে কলম্বাস ভারত বা জাপান গমন করতে তার প্রাথমিক যাত্রা শুরু করেন। তার সঙ্গীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পিজোঁ ব্রাদার মার্টিন অ্যালঞ্চো পিজোঁ (Pinjon) এবং সেন্ট ইয়ানেজ পিজোঁ। পিজোঁ ভ্রাতৃদ্বয় ছিল মরক্কোর মুসলিম পরিবার আবু জাইয়ান পরিবারের উত্তরসূরী যাদেরকে জোরপূর্বক খ্রিস্টান হতে বাধ্য করা হয়েছিল। পিজোঁ শব্দটি এসেছে মূলত আবু জাইয়ান শব্দ থেকে। কারো কারো মতে শুধু পূর্ব পুরুষরাই নয়, পিজোঁ ভ্রাতৃদ্বয়ও মুসলমান ছিল যদিও তারা তা গোপন রেখেছিল।
ঐসময়ে মুসলমানেরা ছিল সর্বক্ষেত্রে অগ্রসর। বিশেষ করে সমুদ্রে জাহাজ পরিচালনায় তাদের দক্ষতা ছিল অত্যন্ত উচু মানের। আর একারনেই মূলত কলম্বাস পিজো ভ্রাতৃদ্বয়কে তার অন্যতম সঙ্গী হিসেবে বেছে নেন। যাত্রা শুরুর কয়েক মাস পূর্বে কলম্বাস স্পেনের পশ্চিম প্রান্তস্থ অ্যারাবিদা (Arrábida) নামক একটি ছোট্ট শহরে বসবাস শুরু করেন সেখান থেকেই সমুদ্র অভিযানের যাবতীয় পরিকল্পনা সম্পন্ন করেন। বস্তুত অ্যারাবিদা নামক শহরটি পূর্বে ‘আর রবিতা’ নামে পরিচিত ছিল। মুসলমানদের পরাজয়ের ফলে পরবর্তীতে এই শহরের প্রকৃত নাম বিকৃত করে ‘অ্যারাবিদা’ নামকরন করা হয় যা বর্তমানে পর্তুগালের অন্তর্ভুক্ত। অনেকের মতে কলম্বাসের সঙ্গীদের অনেকেই মুসলমান ছিল, তবে সেটা এখন পর্যন্ত প্রমানিত হয় নি। তবে ঐ অভিযানে পিজো ভাইদের মত আরো অনেকেই ছিলেন যাদের পূর্বপুরুষদেরকে জোরপূর্বক খ্রিস্টধর্ম গ্রহনে বাধ্য করা হয়েছিল বলে প্রমানিত হয়েছে।
ষোড়শ শতকে আমেরিকায় মুসলমান
ষোড়শ শতকে আমেরিকার সন্ধান পাওয়া একজন মুসলমান ছিলেন এস্তেফানিকো। যার প্রকৃত নাম ছিল মুস্তাফা আঝ-জামুরি এবং তিনি ১৫৩৯ সালে মৃত্যুবরন করেন। মুস্তফা আঝ-জামুরি ছিলেন মরক্কোর অধিবাসী। একদল পর্তুগীজ নাবিক কর্তৃক বন্দী করে ১৫২৭ সালে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং দাস হতে বাধ্য করা হয়। দু একটি সূত্রমতে পরবর্তীতে তাকে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহনেও বাধ্য করা হয়। জানা যায় মুস্তাফা আঝ-জামুরি ছিলেন ঔষুধ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, কারো মতে তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক।
অষ্টাদশ শতকে আমেরিকায় মুসলমান ও ইসলাম
অষ্টাদশ শতকে অসংখ্য আফ্রিকান নাগরিকদের অপহরন করে আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে দাস হতে বাধ্য করা হত। ইতিহাসবিদদের মতে মোট দাসদের মধ্যে কমপক্ষে শতকরা দশ ভাগ ছিল মুসলমান। এমনই একজন মুসলমান দাস ছিলেন আইয়ুব বিন সোলাইমান (Jon Ben Solomon) যিনি ১৭৩১ সালে গাম্বিয়া থেকে অপহৃত হন। আইয়ুব বিন সোলায়মান ছিলেন শিক্ষিত, বিচক্ষন এবং দাবী আদায়ে বদ্ধ পরিকর। উল্লেখ্য তখনকার সময়ে মুসলমানরা ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি শিক্ষিত। তারা পড়তে এবং লিখতে পারতেন। দাস হওয়া সত্ত্বেও আইয়ুব বিন সোলায়মান মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী শিক্ষা প্রচারে লিপ্ত ছিলেন। একদিন কতিপয় আমেরিকান তার নগ্ন ছবি অঙ্কন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন। অতপর আইয়ুব বিন সোলায়মান নগ্ন হতে অস্বীকার করলেন এবং পোষাক পরিহিত অবস্থায়ই তাদেরকে তার নগ্ন ছবি অঙ্কন করতে বললেন। জবাবে আমেরিকান লোকেরা বলল, আমরা তোমার শরীর না দেখে কিভাবে তা চিত্রায়িত করব। বিন সোলায়মান উত্তর দিলেন সামান্য পোষাকের অন্তরালে থাকা শরীরের ছবিই তোমরা অঙ্কন করতে পার না; তাহলে কিভাবে তোমদের কিছু চিত্রকর সৃষ্টিকর্তার ছবি অঙ্কন করে যাকে কেউই কখনও অবলোকন করে নি? শেষ পর্যন্ত তিনি যুক্তরাজ্যে রাজ পরিবারের সাথে দেখা করতে সমর্থ হন এবং দাস থেকে মুক্তি পেয়ে ১৭৩৪ সালে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। থমাস ব্লুয়েট (Thomas Bluett) নামক একজন আইনজীবী যিনি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমন করেছিলেন, আইয়ুব সোলাইমান সম্পর্কে বলে, “তার সাথে কথোপকথন এবং তার প্রতি সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করার আগে তিনি একটি বা দুটি চরন লিখলেন এবং অতঃপর যখন সেটা পড়লেন, তিনি ‘আল্লাহ’ এবং ‘মুহাম্মাদ’ শব্দগুলো উচ্চারন করলেন; তিনি এক গ্লাস মদ গ্রহন করতেও অস্বীকার করেছিলেন যা আমাদের পক্ষ থেকে তাকে দেওয়া হয়েছিল, আমরা উপলব্ধি করলাম তিনি একজন মুহাম্মাদীন (মুসলিম), কিন্তু ঠিক কোন দেশ থেকে এসেছে তা ঠাহর করতে পারলাম না….আমরা বুঝতে পারলাম তিনি কোন সাধারন দাস ছিলেন না (Upon our Talking and making Signs to him, he wrote a Line or two before us, and when he read it, pronounced the Words Allah and Mahommed; by which, and his refusing a Glass of Wine we offered him, we perceived he was a Mahometan, but could not imagine of what Country he was…. we could perceive he was no common Slave)”

আইয়ুব বিন সোলায়মান, ১৭৭৩
আঠার শতকের আরও একজন উল্লেখযোগ্য আফ্রিকান বংশোদ্ভুত মুসলমান দাস ছিলেন বিলালী মুহাম্মাদ যাকে জর্জিয়ার স্যাপেলো দ্বীপে (Salelo Island) একজন দাস ব্যবসায়ীর কাছে বক্রি করা হয়। উল্লেখ্য বিলালী মুহাম্মাদের মালিক ছিলেন খুবই সহিষ্ণু এবং উদার মানসিকতা সম্পন্ন যিনি পরবর্তীতে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার জন্য চেষ্টা সাধনা করেন। ইতিহাসবিদদের মতে ১৭৭০ সালের দিকে বিলালী মুহাম্মাদ সিয়েরালয়নের একটি শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। কিশোর বয়সেই বিলালীকে অপহরন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথায় বাধ্য করা হয়। বিলালী মুহাম্মাদ ছিলেন কুরআন এবং ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী। বিলালী মুহাম্মাদ তার দাস জীবনের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেই জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা বিশেষ করে ইসলামী আইন কানুন বিষয়ে লেখালেখি করেন যা বর্তমানে বিলালী দলিল (Bilali Document) নামে পরিচিত। ১৮৫৭ সালে জর্জিয়ায় বিলালী মুহাম্মাদের মৃত্যুর পর তার কামরা থেকে ১৩ পৃষ্ঠার হস্তলিখিত একটি দলিল উদ্ধার করা হয়। বিলালী মুহাম্মাদের হস্তলিখিত দলিল আরবি ভাষায় লিখিত হওয়ায় অনেক দিন ধরে যাদুঘরে পড়েছিল এবং ধারনা করা হয়েছিল এটা বিলালী মুহাম্মাদের ব্যক্তিগত ডায়েরী। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় ‘বিলালী দলিল’ ছিল মূলত ইসলামী শরীয়তের বিভিন্ন দিক নিয়ে দিক নির্দেশনা যাকে বর্তমান সময়ের ইসলামী পন্ডিতরা আমরেরিকার ‘প্রথম ফিকাহ’ শাস্ত্র হিসেবে অভিহিত করেন। অপহৃত অবস্থায় এক কাপড়ে আমেরিকায় যেতে বাধ্য হওয়ার অন্যদের মত বই পুস্তকতো দূরের কথা পবিত্র কুরআন শরীফটাও সাথে নিতে পারেন নি বিলালী মুহাম্মাদ। তাই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় তিনি যা লিখেছিলেনন প্রকৃতপক্ষে তার পুরোটাই ছিল অতীতের পড়াশোনার উপর ভিত্তি করে তৎকালীন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে।
শুধু হস্তলিখিত দলিলই নয়, বিলালী মুহাম্মাদ কর্তৃক ইসলামের জন্য কাজ করার প্রমান পাওয়া যায়। উনিশ শতকের চল্লিশ দশকের শুরুর দিকে একজন গবেষক স্যাপেলো দ্বীপ ভ্রমন করেন। উক্ত গবেষক সেখানে বসবাসরত বেশকিছু আফ্রো-আমেরিকান নাগরিকের সাথে কথা বলেন যাদের অনেকের পূর্বপুরুষ ছিল মুসলমান। কেটি ব্রাউন নামক একজন মহিলা তার দাদা দাদী সম্পর্কে বলেন, সে তার দাদা দাদীকে নিয়মিত সুর্যদয় এবং সুর্যাস্তের মুহুর্তে এবং ঠিক দুপুরে নামাজ পড়তে দেখতেন। আরেক ব্যক্তি বলেন, আমি আমার চাচা ক্যালিনা এবং চাচী হেনা অনেক মজার বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেখতাম এবং তারা তাদের নামাজের ব্যাপারে ছিল খুবই সময়নিষ্ঠ। শ্যাড হল নামক আরেকজন লোক বলেন, দ্রুত অনেকে মাঠের মধ্যে জড়ো হত এবং কাপড় বিছিয়ে তার উপর তারা সুর্যদ্বয়, সুর্যাস্ত এবং ঠিক দুপুরে নামাজ আদায় করত। অপর একজন বৃদ্ধ মহিলা বলেন, আমি আমার দাদী/নানীকে একটি বই পড়তে দেখতাম এবং আমরা ছেলেমেয়েরা যখন খেলাধুলা করতাম যতদূর মনে পড়ে তখন তিনি আমাদেরকে বলতেন “আশামানাগাদ (Ashamanagad)”। ধারনা করা হয় কথাটি ছিল আসলে “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদ”, “আশামানাগাদ” নয়।
এছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন দাস দাসী সম্পর্কে জানা যায় যারা মুসলমান ছিলেন। প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা থাকায় তারাও গোপনে নিজেদের মধ্যে ইসলামী বিধি বিধান চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন।
অষ্টাদশ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিশেষ তৎপরতা
১৭৯০ সালে জর্জ ওয়াশিংটন ধর্মসভা (Synagog) সমীপে লিখিত তার প্রথম চিঠিতে লিখেন, “ইব্রাহীমের অধিকারে থাকা শিশুরা যারা এই ভূমিতে বসবাস করে তারা অব্যাহতভাবে এখানে বিয়ে করতে পারবে এবং অন্যান্য অধিবাসীদের সাথে শান্তিপূর্নভাবে বসবাস করবে যেখানে প্রত্যকেই আত্মমর্যাদা এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে নিরাপদে থাকবে, তাদেরকে কোনরুপ ভয়ভীতি দেখানোর মত কেউ থাকবে না (May the children of the stock of Abraham who dwell in the land continue to marry and enjoy the goodwill of the other inhabitants while everyone shall safely under his own vain and fitly, there shall be none to make him afraid)”। অন্য একটি চিঠিতে তিনি লিখেন, এমনকি তিনি মুহাম্মাদীনদেরকেও স্বাগত জানাবেন যদি তারা ভাল কর্মী হয়।
১৭৯০ সালে সাউথ ক্যারোলিনার বিধান সভা (legislative body) মরক্কোর একটি সম্প্রদায়ের জন্য প্রথম বিশেষ আইনগত অবস্থান (Special segal status) অনুমোদন করে। মূলত এই সকল মরক্কোন মুসলমানদেরকে ধরে নিয়ে দাস-দাসী হতে বাধ্য করা হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে তারা এধরনের অমানবিক আচরনের বিরুদ্ধে কংগ্রেস এবং প্রেসিডেন্ট বরাবর একটি আবেদন জানায়। আবেদনে তারা উল্লেক করে তারা ককেশিয়ানও নয়, আফ্রিকানও নয়; সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জাতি, মূর (Moors)। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৭৯৬ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস ‘মূর সান্ড্রি অ্যাক্ট (Moors sundry acts)’ নামে একটি চুক্তিতে সাক্ষর যাতে তিনি ঘোষনা করেন, “মুসলমানদের আইন, ধর্ম এবং প্রশান্তির বিরুদ্ধে যায় এমন কোন বিরুদ্ধবাদী চরিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেই (The United states had no character of enmity against the laws, religion or tranquility of Musalman)”।
উনিশ শতকের বিভিন্ন লেখকের লেখনীতে মুসলমানদের অস্তিত্ব
আঠার উনিশ শতকে কয়েকজন শিক্ষিত দাসসহ বেশ কিছু লেখকের গ্রন্থ থেকেও তখনকার সময়ে আমেরিকায় মুসলমানদের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৮৫৪ সালে চার্লস বল (Charles Ball) নামে একজন দাস যিনি ছিলেন খিস্টধর্মাবলম্বী একজন শিক্ষিত ব্যক্তি তার লিখিত একটি বইয়ে উল্লেখ করেন, “আমি কয়েকজন দাসকে চিনতাম যারা ছিল মুহাম্মাদ (স) এর অনুসারী শিক্ষিত লোক। সে সময় পর্যন্ত আমি কখনই মুহাম্মাদের ধর্ম (ইসলাম) সম্পর্কে কিছুই শুনিনি। আমার উপনিবেশে একজন লোক ছিল যিনি প্রত্যহ পাচঁ বার নামাজ আদায় করতেন, এবং নামাজ আদায় করার সময় সর্বদাই পূর্ব দিকে ঘুরে দাড়াতেন (I knew of several slaves who must have been from what I have seen learned Mohammadin. I knew of people I did not know who they were back then, now I know they were Muslims. At that time I had never heard of the religion of Muhammad. There was a man on my plantation who prayed five times a day, always turning to the east when he performed his prayer)”।
১৮৩৪ সালে অ্যালেন ডি অস্টিন (Allan D. Austin) তার “African Muslims in Antebellum America” বইয়ে বেশ কয়েকজন আফ্রিকান বংশোদ্ভুত দাসদের জীবনালেখ্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাদের মধ্য ছিলেন আবু বকর সিদ্দিক নামক একজন মুসলমান যিনি তার জীবনচরিতে লিখেছেন, আমাদের গোত্রের বিশ্বাসই হচ্ছে ইসলামের প্রতি বিশ্বাস। যখন আমার দাস জীবন শুরু হয়েছিল তখন থেকে আজ পর্যন্ত তাদের কাছে থেকে দাস জীবনের অনেক তিক্ততার স্বাদ গ্রহন করেছি। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, সকল প্রশংসা আল্লাহর যার অধীনস্ত সকল ক্ষমতা এবং সকল কিছু, তিনি যা চান তাই করেন, এমন কেউ নেই আল্লাহ যা হুকুম করেছেন তা বাতিল করতে পারে আথবা আল্লাহর পক্ষ থেকে যা দেওয়া হয়েছে তা অনুমোদন করতে পারে (The faith of our family is the faith of Islam. That was the beginning of my slavery life when I captured until this day, I tasted the bitterness of slavery from them but Alhamdulillah “all praise be to Allah under whose power or all things, He does whatever He wills, no one can turn aside what He has decreed or drained nor can any one with hold what he has given)”। ধারনা করা হয় তিনি কুরআন থেকে কথাগুলো লেখার চেষ্টা করেছিলেন।
আমেরিকায় প্রথম ধর্মান্তরিত মুসলমান
ইতিহাসবিদদের মতে এডোয়ার্ড উইলমোট ব্লাইডেন (Edward Wilmot Blyden) আধুনিক যুগের অন্যতম পুরনো একজন ধর্মান্তরিত মুসলমান। ব্লাইডেন ১৮৩২ সালের ৩ আগস্ট বর্তমান যুক্তরষ্ট্রের ভার্জিনিয়া দ্বীপে জন্মগ্রহন করেন। ব্লাইডেনের মা বাবা ছিলেন নাইজেরীয় বংশোদ্ভূত। ১৮৮৯ সালে ব্লাইডেন ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। পরবর্তীতে তিনি লাইবেরিয়া গমন করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে লাইবেরিয়ার ইসলামী শিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।

এডোয়ার্ড উইলমোট ব্লাইডেন, ১৮৬০
ব্লাইডেনের ইসলাম গ্রহনের চার বছর ১৮৮৮ সালে মুহাম্মাদ আলেকজান্ডার রাসেল ওয়েব (Muhammad Alexandar Russel webb) নামক আরেকজন অমুসলিম ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। রাসেল ওয়েব ১৮৪৬ সালের ৯ নভেম্বর নিউইয়র্কের হাডসনে জন্মগ্রহন করেন। রাসেল ওয়েব ছিলেন একাধারে লেখক, প্রকাশক এবং সমসাময়িক সময়ের অন্যতম সেরা সাংবাদিক। ১৮৮৭ সালে মিস্টার ওয়েব ম্যানিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বানিজ্য দূত (Consular Representative) হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। রাসেল ওয়েব ভারতের বেশ কয়েকজন মুসলমানের সাথে যোগাযোগ করতে সমর্থ হন। পরবর্তীতে তিনি ভারত ভ্রমন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসে স্ত্রী এবং তিন সন্তানসহ ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। ১৮৯৩ সালে রাসেল ওয়েব নিউইয়র্কে ‘আমেরিকান মুসলিম ব্রাদারহুড (American Muslim Brotherhood)’ নামক একটি ইসলামী সংগঠন প্রতিষঠা করেন যা আমেরিকার অন্যতম পুরনো একটি ইসলামী সংগঠন। তারপর থেকে ১৯১৬ সালের ১ অক্টোবর মৃত্যু পর্যন্ত ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রান হিসেবে কাজ করে যান এবং আমেরিকান মুসলমানদের একজন মুখপাত্রে পরিনত হন।
উনিশ শতকে আমেরিকায় প্রথম কোন কাদিয়ানীর আগমন অতঃপর
১৯২০ সালে সর্বপ্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভুত ড: মুফতি মুহাম্মাদ সাদিক নামক একজন কাদিয়ানী আমেরিকায় গমন করেন এবং শিকাগো শহরে বসবাস শুরু করেন। ড: সাদেক শিকাগোতে ১৯২১ সালে আহমদিয়া মুসলিম কমিউনিটি (Ahmadia Muslim Community) নামে একটি সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেন। মুফতি সাদেকের আগমনের কয়েক বছর পর ওয়ালেস ডি ফারদ (Wallace Fard Muhammad) কর্মের সন্ধানে আমেরিকায় গমন করেন। তরা পিতা ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভিত কাদিয়ানী এবং মা ছিলেন নিউজিল্যান্ডের নাগরিক। ওয়ালেস ডি ফার্দ শিকাগোর কাদিয়ানী উপাসনালয়ে যাতায়াত করতেন। সে হিসেবে ধারনা করা হয় তিনি প্রথমদিকে কাদিয়ানী ধর্ম অনুসরন করতেন। ১৯৩০ সালে ‘দ্য লস্ট-ফাউন্ড নেশন অফ ইসলাম ইন দি ওয়াইল্ডার্নেস অফ নর্থ আমেরিকা (The Lost-Found Nation of Islam in the Wilderness of North America)’ নামে ডি ফার্দ একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীতে নেশন অব ইসলাম (Nation of Islam) নাম ধারন করে যার মাধ্যমে মুলত কাদিয়ানী ধর্ম প্রচার করা হত। ১৯৩৪ সালে ওয়ালেস ডি ফার্দ নিখোজ হলে তার সহচর এলাইজা মুহাম্মাদ (Elijah Muhammad) নেশন অব ইসলামের নেতা হন এবং আস্তে আস্তে কাদিয়ানী মতবাদ থেকে দূরে সরে সম্পূর্ন নতুন একটি মতবাদ প্রবর্তন করেন। এলাইজা মুহাম্মাদ ওয়ালেস ডি ফার্দকে ‘আল্লাহ’ ঘোষনা করেন। পাশাপাশি তিনি নিজেকে নবী দাবী করে বসেন। বস্তুত পূর্বে এলাইজা মুহাম্মাদ ছিলেন একজন মদ্যপায়ী বিপদগামী ব্যক্তি যিনি সাংসারিক জীবনেও ছিলেন অসুখী।
পরবর্তীতে এলাইজা মুহাম্মাদ তার ছেলে আকবার মুহাম্মাদকে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য পঠান। আকবার সেখানে প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন এবং পিতার মতবাদের সাথে দ্বিমত পোষন করেন। ১৯৭৫ সালে এলাইজা মুহাম্মাদের মৃত্যুর পর তার অপর ছেলে ওয়ারিথ দীন মুহাম্মাদ (Warith Deen Muhammad) নেশন অব ইসলামের প্রধান নির্বাচিত হন। তিনি ওয়ালেস ডি মুহাম্মাদকে আল্লাহ এবং এলিজাহ মুহাম্মাদকে নবী মানতে অস্বীকার করেন। পিতার ভ্রান্ত মতবাদ পরিহার করে ইসলামের মূল পাচটি স্তম্ভের সাথে এলাইজা মুহাম্মাদের অনুসারীদের পরিচয় করিয়ে দেন এবং পবিত্র কুরআন এবং রাসুল (স) এর আদর্শের দিকে তাদেরকে আহবান জানান। তিনি নেশন অব ইসলামের ৪০০ উপাসনালয়কে মসজিদে রুপান্তর করেন। আকবর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষনা করেন মুহাম্মাদ (স) হচ্ছেন আমাদের শেষ নবী, এর পরে আর কোন নবী বা রাসূল নেই। ১৯৭৬ সালে সর্বোচ্চ নেতা (Supreme Leader) উপাধির পরিবর্তে ওয়ারীথ দীন মুহাম্মাদ সাধারন ইমাম উপাধি গ্রহন করেন এবং ‘নেশন অব ইসলাম’ নামক সংগঠন হৃদ করে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড কমিউনিটি অফ আল-ইসলাম ইন দ্য ওয়েস্ট (The World Community of Al-Islam in the West)’ নামে মূল ধারার ইসলামী আন্দোলন শুরু করেন যা পরবর্তীতে ‘আমেরিকান সোসাইটি অফ মুসলিমস (American Society of Muslims)’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। একই বছর প্রথমবারের মত এলাইজা মুহাম্মাদ মসজিদে ১০০০০ মুসল্লীর উপস্থিতিতে ঈদ-উল-ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৭ সালে লুইস ফারাখান (Louis Farrakhan) ওয়ারিথ দীন মুহাম্মাদের পুনগঠিত সংগঠন থেকে পদত্যাগ করেন এবং পুনরায় নেশন অব ইসলামের কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে আকবর মুহাম্মাদও প্রকাশ্য তার পিতার প্রচারিত ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং কুরআন সুন্নাহের দিকে সকলকে আহবান জানান। ১৯৮০ সালে দীন মুহাম্মাদ তার নাম পরিবর্তন করে ওয়ারিদুদ্দিন মুহাম্মাদ নামকরন করেন। ২০০৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আল্লাহ প্রদত্ত এবং তার রাসূল (স) শেখানো ইসলাম প্রচারে লিপ্ত ছিলেন ওয়ারিদুদ্দিন মুহাম্মাদ।

কনফারেন্সে ওয়ারিথ দীন মুহাম্মাদ (মাঝে)
আমেরিকায় ইমিগ্রান্ট মুসলমান
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী ফিলিপ টেদ্র (Philip Tedro) যিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে একজন গ্রীক নাগরিক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গমন করে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। তিনি তার নাম পরিবর্তন করেন এবং পবিত্র হজ্জ্ব পালন করার পর হাজী আলী নাম ধারন করেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার মরুভূমি বিষয়ে সেনাবাহিনীকে দক্ষ করার পরিকল্পনা হাতে নেয়। সেজন্য মধ্যেপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে সরকার বেশ কিছু সংখ্যক উট ক্রয় করে এবং উটগুলো পরিচর্যা করার জন্য বেশ কিছু বিদেশী নাগরিককে ভাড়া করে যাদের মধ্যে একজন ছিলেন মুসলমান এবং তিনি ছিলেন হাজী আলী। ১৮৫৬ সালে হাজী আলী উট পরিচর্চা দলের সদস্য এবং সরদার বা পরিচালক নিয়োগ করা হয়। আমেরিকানরা হাজী আলীকে হাইজলি বলে ডাকত। ১৯০৩ সালে হাজী আলীর মৃত্যুর পর তাকে কোর্টসাইট অ্যারিজোনা (Quartzsite Arizona) নামক একটি স্থানে দাফন করা হয় এবং তার করবটি বর্তমানে কোর্টসাইট অ্যারিজোনার বৃহত্তম পর্যটন কেন্দ্র। হাজী তার জীবনে অ্যারিজোনার একজন ইমাম ছিলেন।
উনিশ শতকের প্রথদিকে মার্কিন যুক্টরাষ্ট্রে ইমিগ্রেশন বিষয়ক কোন আইন ছিল না। যে কোন ব্যক্তি মাত্র ৫০ সেন্ট পরিশোধ করে মার্কিন যুক্টরাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারত। ১৮৯৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট সরকার সে দেশের নির্দিষ্ট এলাকায় অন্যান্য দেশের নাগরিকদের বসবাস করার অনুমতি দেয়। তখন থেকেই মুসলমানরা নিজেদের বিভিন্ন কমিউনিটি গড়ে তোলে। ১৮৯৯ সালে হাসান জুমআ সিরিয়া ও অন্যান্য দেশ থেকে আমেরিকার নর্থ ডেকোটা অঙ্গরাজ্যে (North Dakota) আগত প্রায় বিশ ত্রিশটি মুসলিম পরিবারের সমন্বয়ে গঠিত এমনই একটি কমিউনিটিকে নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করেন। ১৯২৯ সালে নোর্থ ডেকোটায় তারা একটি মসজিদ নির্মান করেন যেটি ছিল আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম একটি পুরনো মসজিদ। তার আগে লেবানন, জর্ডান, সিরিয়াসহ বিভিন্ন আরবদেশ থেকে আগত মুসলমানরা ১৯০৮ সালে আমেরিকায় প্রথম মসজিদ নির্মান করেন। এভাবে ক্রমাগত আলবেনিয়া, তুর্কিসহ অন্যান্য দেশ থেকে আগত মুসলমানরা আমেরিকায় মসজিদ নির্মানসহ ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।
মার্কিন যুক্টরাষ্ট্রে ক্রমাগত মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় যুক্টরাষ্ট্র সরকার ভীত হয়ে ১৯২৪ সালে “ন্যাশনাল অরিজিন অ্যাক্ট অথবা এশিয়ান এক্সক্লুশন অ্যাক্ট (National origin act or Asian exclusion act)” নামে নতুন ইমিগ্রেশন আইন প্রনয়ন করে যার মাধ্যমে চীন, জাপান, ভারতসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশগুলোর নাগরিকদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আভিবাসীত্ব গ্রহনের অধিকার খর্ব করা হয়।
১৯২৮ সালে শেখ আলহাজ দাউদ আহমেদ ফায়সাল (Shaikh Al-haj Daoud Ahmed Faisal) নিউইয়র্কে দ্য ইসলামিক প্রোপাগেশান সেন্টার অফ আমেরিকা (The Islamic Propagacation Center of America) নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ‘ইসলামিক মিশন সোসাইটি (Islamic Mision Society)’ নামেও আরেকটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন যা ১৯৩৯ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। জানা যায় আমেরিকায় ইসলাম প্রচারের জন্য জর্ডানের শায়খ খালিদ এবং সৌদী বাদশাহ সৌদ শেখ ফায়সালকে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগীতা করেন। ১৯৩০ সালে প্রফেসর এজেনদিন (Professor Ezeldeen) এর নেতৃত্বে ‘দ্য আদ্দিনু আল্লাহ ইউনিভার্সাল আরব অ্যাসোসিয়েশান (The Addeynu Allah Universal Arab Association)’ সংগঠনের সূচনা হয়।

শেখ দাউদ আহমেদ ফায়সাল (বাম থেকে দ্বিতীয়), ১৯৬৪/৬৫
১৯৫৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার ইসলামী সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে ‘দ্য ফেডারেশন অফ ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশান অফ দ্য ইউএস অ্যান্ড কানাডা (The Federation of Islamic Associations (FIA) of the US and Canada)’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৫ সালে শেখ দাউদ আহমেদ ফায়সাল নিউইয়র্ক সিটিতে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত করেন যা এখনও চালু রয়েছে।১৯৫৭ সালের ২৮ জুন কয়েকটি মুসলিম দেশের অর্থায়নে The Islamic Center of Washington Dc” প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট সেন্টারটির উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট ডুইট ডি এইসেনহাওয়ার (Dwight D. Eisenhower) বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অধিনে অন্যান্য ধর্মের ইমারাতের মতই এই কেন্দ্রটি, উপসনা করার এই জায়গাটিকেও স্বাগতম। তোমাদের নিজস্ব ধর্ম এবং নীতি অনুযায়ী উপসনা করা এবং নিজস্ব চার্চ (মসজিদ) থাকার অধিকারের ব্যাপারে আমেরিকানরা সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করে যাবে (Under the American Constitution this Center, this place of worship is as welcome as could be any similar edifice of any religion. Americans would fight with all their strength for your right to have your own church and worship according to your own conscience and own beliefs)”। এটি ছিল মার্কিন যুক্টরাষ্টের ইতিহাসে প্রথম আনুষ্ঠানিক মসজিদ। ১৯৬২ সালে আফ্রো-আমেরিকান মুসলমানদের দ্বারা ‘দার-উল-ইসলাম মুভমেন্ট (Dar-ul-Islam Movement)’ নামক আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮২-৮৩ সালে এই সংগঠনের অবলুপ্তির আগ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসলাম প্রচারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ১৯৬৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ

আল-কুরআন সংরক্ষণ : স্রষ্টার বিস্ময়কর ৯টি ব্যবস্থা

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন,
‘নিশ্চয় আমিই কুরআন নাজিল করেছি আর আমিই তা হেফাজত করব।’ (সূরা হিজর)
এটাই একমাত্র আসমানী কিতাব যার হেফাজতের দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা নিজে গ্রহণ করেছেন। এটা আসমানী ওয়াদা। আর কুরআনের ঘোষণা হল,
‘আল্লাহ কখনও ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।’ (সূরা আলে ইমরান)

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর এ ওয়াদা পূর্ণ করেছেন এবং তাঁর কিতাব হেফাজতের বিস্ময়কর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
 ফলে কুরআনের শব্দ সংরক্ষিত, অর্থ সংরক্ষিত, লিখনপদ্ধতি সংরক্ষিত, কুরআনের আমলিরূপ সংরক্ষিত, যে ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে সে ভাষা সংরক্ষিত, এর পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা সংরক্ষিত, যে মহান ব্যক্তিত্বের ওপর তা অবর্তীণ হয়েছিল তাঁর জীবনচরিত সংরক্ষিত, এমনকি যাদেরকে সম্বোধন করে তা অবতীর্ণ হয় তাদের জীবনেতিহাস পর্যন্ত সংরক্ষিত আছে। মোটকথা, আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীম হেফাজতের জন্য যত উপায় হতে পারে সকল উপায়ে তা সংরক্ষিত হয়েছে। এভাবে এই পবিত্র কিতাব সর্বদিক থেকে পূর্ণাঙ্গরূপে সংরক্ষিত হয়ে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ, আজ চৌদ্দ শতাধিক বছর পরেও এতে বিন্দু পরিমাণ পরিবর্তন-পরিবর্ধনের আঁচড় লাগেনি। লাখো চেষ্টা ও অপচেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু কোনোটিই সফল হয়নি। আর কেয়ামত পর্যন্ত হবেও না।

কুরআনে কারীম কীভাবে হেফাযত করা হয়েছে?

কুরআনে কারীম হেফাযতের লক্ষে নয়টি জিনিস হেফাযত করা হয়েছে, নিম্নে সে বিষয়ে আলোচনা করা হল : এক. কুরআনের মতন অর্থাৎ হুবহু ওই শব্দগুলো যা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ওহীর মাধ্যমে আখেরী নবীর ওপর অবতীর্ণ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর যখন ওহী নাজিল হত তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে ওহী-লেখক কোনো সাহাবীর দ্বারা তা লিখিয়ে নিতেন। এরপর সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সা. এর পবিত্র যবানে তা শুনতেন এবং মুখস্থ করে ফেলতেন। এভাবে তেইশ বছর পর্যন্ত কুরআন নাযিলের সময়ই তা লিখে রাখা হত। এবং সাহাবায়ে কেরাম তা মুখস্থ'ও রাখতেন। কেননা নবী করীম সা. কুরআন হিফজের বিশেষ ফযিলত বর্ণনা করেছেন। এক বর্ণনা মোতাবেক সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ কুরআনে কারীম হিফয করেন হযরত উসমান ইবনে আফফান রা.। নবী-যুগের পর হযরত আবু বকর রা.-এর খিলাফতের আমলে হযরত ওমর রা. এবং অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের পরামর্শক্রমে কুরআনে কারীম একত্রে সংকলন করা হয়। আর হযরত উসমান রা.-এর যুগে তা এক মুসহাফে বাঁধাই করে একাধিক নুসখা তৈরি করা হয়। অর্থাৎ এর বিভিন্ন অনুলিপি তৈরি করে কুফা, বসরা, সিরিয়া, মক্কা অর্থাৎ মুসলমানদের কেন্দ্রীয় শহরগুলিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এটা তো হল লিখিত আকারে হেফাযত। এ ছাড়াও শব্দে শব্দে মুখস্থ করার ব্যাপারেও উৎসাহিত করা হয়। এভাবে কুরআন সীনায় ও লিখনি উভয়ভাবে সংরক্ষিত হয়ে যায়। আর এই ধারাবাহিকতা বংশানুক্রমে আজও জারী আছে। কেয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে ইনশাআল্লাহ।
দুই. আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনের শব্দাবলি যেমন হেফাযত করেছেন, তেমনি এর অর্থ ও মর্ম হেফাযতেরও ব্যবস্থা করেছেন। কারণ শুধু শব্দাবলি সংরক্ষিত থাকাটা যথেষ্ট নয়। অর্থ ও মর্মার্থ হেফাযত না হলে এর বিকৃতি ও অপব্যাখ্যা অনেকটা অবধারিত। পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের ক্ষেত্রে এমনই হয়েছে। সেগুলোতে যেমন শব্দের বিকৃতি ও প্রক্ষেপ ঘটেছে তেমনি অর্থগত বিকৃতি ও অপব্যাখ্যাও হয়েছে। কেননা, শব্দের মতো মর্মের সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি। তারা তাদের নবীদের কথা, কাজ ও জীবনী সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ফলে ছিঁটে ফোটা কিছু শব্দ কোথাও থেকে গেলেও তা কোনো কাজে আসেনি। উদাহরণস্বরূপ খৃষ্টধর্মের কথা বলা যায়। তারা বলে থাকেন, আমাদেরকে দুটি মৌলিক বিষয়ের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং আমরা এর ধারক-বাহক : ১. ন্যায় ও সুবিচার, ২. মহব্বত ও ভালবাসা। কিন্তু আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন যে, ন্যায় ও সুবিচার অর্থ কী? তারা এর মর্মার্থ বয়ান করতে পারবে না। একই অবস্থা মহব্বত ও ভালবাসার ক্ষেত্রেও। ফলে লাখো নয়, কোটি মানুষকে খৃষ্টবাদে দীক্ষিত না হওয়ার কারণে নির্দয়ভাবে তারা হত্যা করে দিয়েছে। আর এর ধারাবাহিকতা আজো পর্যন্ত থামেনি। এমনিভাবে ইহুদী ধর্মের মৌলিক বুনিয়াদ হল, তোমরা তোমাদের প্রতিবেশীদের জন্য সেটাই পছন্দ কর যা নিজেদের জন্য পছন্দ করে থাক। কিন্তু আপনি যদি ইহুদীদের ইতিহাস অধ্যয়ন করেন তাহলে জানতে পারবেন যে, তারা তাদের প্রতিবেশীদের যত কষ্ট দিয়েছে এত কষ্ট দুনিয়ার আর কেউ তাদের প্রতিবেশীদের দেয়নি। সে ধারা আজো বহমান, যা ইসরাইলী বর্বরতার মাধ্যমে কিছুটা প্রকাশ পাচ্ছে। পক্ষান্তরে ইসলাম, সুন্নাতে নববীর দ্বারা নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত অর্থাৎ সম্পূর্ণ কুরআনী শিক্ষা সুন্নতে নববীর দ্বারা সুস্পষ্টরূপে ব্যাখ্যাত হয়ে সংরক্ষিত হয়ে আসছে। এমনিভাবে আল্লাহ তাআলা সুন্নাতে রাসূল দ্বারা অর্থ, মর্মার্থ ও প্রভুর উদ্দেশ্য হেফাযতের ব্যবস্থা করেছেন। কারণ নবী করীম সা. কুরআনের যে তাফসীর করেছেন, যাকে ‘তাফসীর বিল মাছুর’ বলা হয়, যার ওপর ইমাম সুয়ূতী, ইমাম ইবনে কাসীর প্রমুখ অসংখ্য ওলামায়ে কেরাম তাফসীর লিখেছেন, প্রতিটি আয়াতের তাফসীর হাদীসে রাসূল দ্বারা করে দেখিয়েছেন, তা মূলত আল্লাহরই পক্ষ থেকে। কেননা কুরআনে বলে দেয়া হয়েছে, ‘এ কুরআনের ব্যাখ্যাও আমি আমার জিম্মায় নিয়েছি।’ (সূরা কিয়ামাহ) অন্যত্র আছে, ‘কুরআন জমা করার দায়িত্বও আমার।’ অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘(মুহাম্মদ সা.) কোনো কথা নিজের প্রবৃত্তি থেকে বলেন না। বরং এসব কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী।’ উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, তাফসীর বিল মাছুর মূলত আল্লাহর পক্ষ হতে কৃত তাফসীর। আর একথা স্পষ্ট যে, আল্লাহই তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক অবগত। সুতরাং হাদীসের হেফাযত দ্বারা আল্লাহর কালামের অর্থ ও মর্মও সংরক্ষিত হয়ে গেছে। আল্লাহ আমাদেরকে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নতে রাসূলের ওপর অটল থাকার তাওফীক দিন।
তিন. কুরআনের শব্দ ও অর্থের পাশাপাশি তা যে ভাষায় নাযিল হয়েছে অর্থাৎ আরবী ভাষা, তা-ও সংরক্ষিত। এর জন্যও আল্লাহ তাআলা আশ্চর্য ব্যবস্থা করেছেন। আপনি যদি বিভিন্ন ভাষার ইতিহাস অধ্যয়ন করেন তাহলে দেখবেন, দুনিয়ার কোনো ভাষা তিন চারশ বছরের বেশি টিকে থাকেনি। হয়ত ভাষাটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে কিংবা অন্য কোনো ভাষার সঙ্গে মিশে গেছে। অথবা এত পরিবর্তিত হয়ে গেছে যে, আগের নিয়মে এর পাঠোদ্ধার করা সুকঠিন। কিন্তু আরবী ভাষা মুসলমানদের এমন যত্ন ও মনোযোগ লাভ করেছে যা বলে শেষ করার নয়। প্রথমত নবী করীম সা. নিজে সাহাবায়ে কেরামের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে আরবী ভাষার বিশুদ্ধতার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। এরপর সাহাবায়ে কেরামও এদিকে মনোনিবেশ করেছেন। যেমন হযরত আবু বকর রা., হযরত ওমর রা. প্রমুখ সাহাবীর জীবনচরিত অধ্যয়ন করলে জানা যায়। এমনকি হযরত আলী রা. তো আরবী ভাষায় ছরফ ও নাহু শাস্ত্রের উদ্ভাবন করে তাকে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেন। তাঁর পরে উম্মতের এমন একটি শ্রেণী অস্তিত্ব লাভ করে যারা তাদের গোটা জীবন এ ভাষার সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছেন। আবুল আসওয়াদ দুয়ালী, ইমাম সিবাওয়াইহ, ইমাম খলীল ফারাহেদী, ইমাম কিসায়ী, ইমাম ফাররা, ইমাম মুবাররাদ, ইমাম আখফাশ, ইমাম সা’লাব, ইমাম ইবনে হাজিব, ইমাম ইবনে হিশাম, ইমাম ইবনে আকীল, ইমাম ইবনে জিন্নী প্রমুখ তাদের গোটা জীবন ছরফ, নাহু, বায়ান তথা আরবী ভাষার জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছেন। যার বরকতে আরবী ভাষা আজও ওই অবস্থায় টিকে আছে যে অবস্থায় ছিল কুরআন নাযিলের সময়। কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যতক্ষণ আল্লাহ তাআলা কুরআনকে টিকিয়ে রাখতে চান-উম্মতের একটি জামাত এ মহৎ কাজে মশগুল থাকবে ইনশাআল্লাহ।
চার. শুধু শব্দ, অর্থ এবং কুরআনী ভাষার হেফাযতের উপরই নির্ভর করা হয়নি; বরং এর প্রায়োগিকরূপ সংরক্ষণেরও পুরোপুরি ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর পদ্ধতি হলো, কুরআন যে শব্দে অবতীর্ণ হয়েছে নবী করীম সা. এর মর্মার্থ ওহীর আলোকে সাহাবায়ে কেরামকে বুঝিয়েছেন। এরপর তা বাস্তবে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন। আজকের ভাষায় বললে ‘থিউরির সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল মুসালসাল। যেমন নামাযের ব্যাপারে কুরআনে শুধু বলা হয়েছে, ‘তোমরা সালাত আদায় কর।’ কিন্তু কুরআনের কোথাও বিস্তারিত ও ধারাবাহিকভাবে নামাযের পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়নি। কোথাও কিয়াম, কোথাও রুকু, কোথাও সেজদার কথা বিচ্ছিন্নভাবে আছে। নবী করীম সা. এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা সাহাবায়ে কেরামকে বলেছেন। এরপর বাস্তবে আদায় করে দেখিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘তোমরা নামায আদায় কর এমনভাবে যেমন আমাকে নামায আদায় করতে দেখেছ।’ সাহাবায়ে কেরাম সেভাবেই করেছেন। রাসূলের পরও তারা এর ওপর আমল অব্যাহত রেখেছেন। এরপর তাবেয়ীরাও সাহাবায়ে কেরামের মতোই করেছেন। এরপর তাবে তাবেয়ীন ও প্রতি যুগের মনীষী ও মুসলিম উম্মাহ যুগের পর যুগ এভাবে আমল করে আসছে। এভাবে আমলের বাস্তব রূপটাও সংরক্ষিত হয়ে গেছে। এটা তো একটি উদাহরণ, এছাড়াও সালাতুল ঈদ, সালাতুর জানাযা, যাকাত, সদকা, কুরবানী, কুরআন তেলাওয়াত সবগুলোরই প্রায়োগিক রূপ আজ পর্যন্ত উম্মতের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হেফাযত করেছেন। এজন্য যখন কেউ কুরআনের তাফসীর ও ব্যাখ্যায় মনগড়া কিছু করার অপচেষ্টা করে তখন উম্মতের মধ্যে তা গ্রহণযোগ্যতা পায় না। তবে কিছু লোক যারা কায়েমী স্বার্থবাদী অথবা যাদের ইসলামের প্রকৃত দীক্ষা হাসিল হয়নি অথবা প্রয়োজনীয় ইলমে দীন নেই-তারা ওই লোকদের অনুসারী হয়ে যায়। আরবীতে একটি প্রবাদ আছে, ‘পড়ে থাকা প্রতিটি বস্তু কেউ না কেউ উঠিয়ে নেয়।’ মোটকথা, কুরআনের মর্মার্থ ও উদ্দেশ্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উম্মাহর ধারাবাহিক আমলের মাধ্যমেও হেফাযত করেছেন। বস্তুত দুনিয়ার কোনো শক্তি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সিদ্ধান্তে প্রতিবন্ধক হতে পারবে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তাআলা প্রতিটি বিষয়ে বিজয়ী, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।’ (সূরা ইউসূফ)
পাঁচ. আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার কিতাব সংরক্ষণের জন্য এমন এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন যে, চিন্তার গতি থমকে যায়। এবং মানুষ তাঁর অলৌকিক কর্ম-কুশলতায় অভিভূত হয়ে যায়। এর একটি দৃষ্টান্ত হল, যে পরিবেশে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল এবং কুরআনের আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার যে প্রেক্ষাপট ছিল সেই পরিবেশ ও প্রেক্ষাপটকে পর্যন্ত অমরত্ব দান করেছেন। হাদীসের বিশাল ভাণ্ডার সেই সম্পূর্ণ পরিবেশ, আমাদের চোখের সামনে মূর্ত করে দিয়েছে। হাদীসের কোনো ছাত্র যখন তা পাঠ করে তখন সেই দৃশ্য জীবন্ত হয়ে সামনে এসে যায়। একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি : এক ধরনের হাদীস আছে যাকে পরিভাষায় ‘হাদীসে মুসালসাল’ বলা হয়; এর অর্থ হল, যখন বর্ণনাকারী হাদীসটি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছ থেকে শুনেছেন অথবা তাঁকে সেই কাজ করতে দেখেছেন তখন যে অবস্থা ছিল, বর্ণনা করার সময়ও ওই অবস্থা অনুসরণ করা। উদাহরণস্বরূপ, ‘হাদীসে মুসালসাল বিত-তাশবীক’ এর কথা বলা যায়। তা এই যে, একবার নবী করীম সা. সাহাবায়ে কেরামের সামনে গোনাহ ও তওবার সময় ঈমানের অবস্থার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, বান্দা যখন গোনাহ করে তখন ঈমান তার দিল থেকে চলে যায়। আর যখন তওবা করে তখন পুনরায় তা প্রবেশ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের হাতের আঙ্গুলগুলো আলাদা করে বললেন, গোনাহের সময় ঈমান এভাবে বেরিয়ে যায়। আর যখন তওবা করে পুনরায় তা ফিরে আসে-একথা বলার সময় এক হাতের আঙ্গুল অন্য হাতের আঙ্গুলের মাঝে প্রবেশ করালেন (যাকে আরবীতে তাশবীকুল আসাবিঈ বলে)। সাহাবায়ে কেরাম যখন এ হাদীস বর্ণনা করেন তখন তারাও তেমনি করেছেন যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে করতে দেখেছেন। এভাবে হাদীসটি বর্ণনার সময় আঙ্গুল দ্বারা ওই অবস্থা দেখানোর ধারাবাহিকতা আজ পর্যন্ত চলে এসেছে। বক্তব্য বোঝানোর জন্য এই অনুকরণের তেমন প্রয়োজন না থাকলেও এতে এই ফায়দা আছে যে, এর দ্বারা মানুষ ওই পরিবেশে চলে যায় যে পরিবেশে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। যে স্থানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীস বর্ণনা করেছিলেন, মনে হতে থাকে যে, আমি সেখানে স্বশরীরে বিদ্যমান। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই আমলকে সাহাবা, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন এবং হাদীসের উস্তাদ-শাগরেদদের মাধ্যমে দেখে এসেছি। ঠিক এমনি অবস্থা ‘আসবাবে নুযুলে আয়াত’ বলার ও শোনার সময়ও হয়ে থাকে। সববে নুযুল বলা হয় হাদীসে উল্লিখিত ওই সব ঘটনাকে যা কোনো আয়াত নাযিলের সময় সংঘটিত হয়েছিল। এর দ্বারা কুরআনের ভাবার্থ বোঝার ক্ষেত্রে বড় সহযোগিতা পাওয়া যায়। কেননা আয়াত নাযিল হওয়ার কারণ ও প্রেক্ষাপট যখন জানা যাবে তখন এতে আলোচিত আহকামের স্তরও বুঝা যাবে। যদিও এটা জরুরী নয় যে, প্রতিটি আয়াতেরই শানে নুযুল থাকবে, তবুও ওলামায়ে কেরাম এর ওপর স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী, ইমাম ওয়াহেদী প্রমুখ।
ছয়. কুরআনে কারীম সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সীরাতে নববী তথা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনচরিত সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। কেননা স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন মোতাবেক আমল করে দেখিয়ে দিয়েছেন, যাতে পরবর্তী কেউ বলতে না পারে যে, কুরআন মোতাবেক আমল করা কঠিন। অতএব আমরা তা করতে পারব না। এজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমল করে দেখিয়ে দিয়েছেন। আর আমলও এমন পর্যায়ের যেভাবে আমল করা চাই। তাই তো হযরত আয়েশা রা.-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমলের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘তোমরা কি কুরআন পড়নি?’ সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হ্যাঁ। আয়েশা রা. বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের জীবন্ত নমুনা ছিলেন।’ যখনই কোনো আহকাম নাজিল হত তিনি সবার আগে এর ওপর আমল করতেন। এজন্যই কুরআন ঘোষণা দিয়েছে, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম নমুনা।’ (সূরা আহযাব) দুনিয়ার কোনো ব্যক্তিত্বের ওপর এত কাজ হয়নি যত কাজ হয়েছে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর। আর এখনও অনবরত হচ্ছে। আজও এর ফায়দায় কোনো কমতি অনুভব করা যাচ্ছে না। উপরন্ত এর ফায়দা শুধু দিনদিন বেড়েই চলেছে। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে রাসূলের প্রতি আনুগত্যশীল ও তাঁর প্রকৃত অনুসারী বানিয়ে দাও।
সাত. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র সত্তাকে আল্লাহ তাআলা তার আখেরী কিতাব কুরআন নাযিলের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তাঁর জন্য আখেরী দীন-দীনে ইসলামকে নির্বাচন করেছেন। কুরআনের সত্যতা টিকিয়ে রাখার জন্য এবং এর উচ্চ মর্যাদা প্রমাণ করার জন্য যিনি কুরআনের বাহক তার মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুণ্ন রাখাও অনিবার্য ছিল। আল্লাহ তাআলা এর জন্য বিস্ময়কর ব্যবস্থা করেছেন। প্রথমত তাঁর বংশ মোবারককেও সংরক্ষণ করেছেন। আরবের লোকেরা যদিও উম্মী ছিল, লেখাপড়া জানত না, তবুও বংশপরম্পরা স্মরণ রাখার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করত। পরবর্তী সময়ে এটি এক স্বতন্ত্র শাস্ত্রের মর্যাদা লাভ করে। ইলমুল আনসাব বা নসব-শাস্ত্র এমন এক রেকর্ড যাতে বংশ ও বংশ ধারা সংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ সংরক্ষণ করা হয়। কেউ হয়তো বলতে পারেন, আরবদের এ বিষয়ে বিশেষ ঝোঁক থাকতে পারে। অথবা এ ধরনের ভাণ্ডার সংরক্ষণে তারা উৎসাহী ছিল। ড. মাহমুদ আহমদ গাজী এ সম্পর্কে বিস্ময়কর এক তথ্য দিয়েছেন। তিনি লেখেন, ‘যখন আমরা নসবশাস্ত্রের কিতাবাদি পর্যালোচনা করি তখন এমন একটি বিষয় আমাদের সামনে আসে, যা অতি মাত্রায় আশ্চর্যের। একে নিছক কাকতালীয় বলা যাবে না। তা এই যে, এ বিষয়ে যত জ্ঞানভাণ্ডার আমাদের সামনে আসে তা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যক্তিত্ব ও তাঁর বংশকে ঘিরেই আবর্তিত। অথচ যে সময় বংশ পরম্পরা সংরক্ষণের কাজ শুরু হয় ওই সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মই গ্রহণ করেননি। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা এই ছিল যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বংশ পরম্পরা পূর্ণাঙ্গ ও সবিস্তরে হেফাযত করবেন, যাতে তাঁর পূর্বপুরুষদের উঁচু মর্যাদা পরিস্ফুট হয় এবং তাদের নিষ্কলুষতার দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বংশীয় সম্ভ্রান্তা প্রমাণিত হয়। আর এতে কুরআনের বাহকের শানও কুরআনের মতোই উচ্চতর প্রমাণিত হয়। এছাড়া চেতনাসম্পন্ন ও বুদ্ধিমান কারো জন্য তাঁকে মিথ্যারোপ করার কোনো অবকাশ যেন থেকে না যায়। হ্যাঁ, যাদের মধ্যে হিংসা ও উগ্রতা রয়েছে তাদের কথা ভিন্ন। এভাবেই কুরআনের মর্যাদা সংরক্ষণ এবং এর সত্যতা প্রমাণের জন্য আল্লাহ তাআলা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বংশ ধারা সংরক্ষণ করেছেন। নিশ্চয়ই ‘আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ ‘আল্লাহ তার কর্মে বিজয়ী কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।’

 
আট. কুরআন নাযিলের সময় তার প্রথম সম্বোধিত এবং প্রথম ধারক ছিলেন হযরত সাহাবায়ে কেরাম। কুরআন হেফাযতের একটি দিক এই যে, সাহাবায়ে কেরামের জীবনচরিতও হেফাযত করা হয়েছে। এক পরিসংখ্যান মতে সাহাবায়ে কেরামের সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জীবনের শেষ প্রানে- এসে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। প্রথম পর্যায়ে যাদেরকে ইসলাম বা মুমিনদের প্রথম সারির বলে গণ্য করা হয় তাদের সংখ্যাও প্রায় পনের, বিশ হাজার। যে সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অধিক ফয়েয হাসিল করেছেন তাদের জীবনচরিতও আল্লাহ তাআলা হেফাযত করেছেন। যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পাশাপাশি তাদের জীবনচরিত সম্পর্কেও ধারণা লাভ করা যায় এবং ঈমানী দাবী ও ইসলামী চাহিদা মোতাবেক তারা তাদের আমলকে কিভাবে সুসজ্জিত করেছিলেন তা একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে বিদ্যমান থাকে। যেন কেউ বলতে না পারে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো রাসূল ছিলেন, আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত তার সহায় ছিল, তিনি আমল করলে সেটা তাঁর নিজস্ব বিশেষত্ব হতে পারে। কিন্তু যখন সাহাবায়ে কেরামের জীবনেও কুরআনের পূর্ণ অনুসরণ দেখা যায় তখন প্রমাণ হয়ে যায় যে, বিষয়টি আসলে এমন নয়। বস্তুত যে কোনো মানুষ ইচ্ছে করলে ঈমানের দাবি পুরা করতে পারে, যেমন করেছেন সাহাবায়ে কেরাম। এজন্য কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ঈমান আন যেমন ঈমান এনেছে ওই সব মানুষ।’ এখানে ‘ওই সব মানুষ’ বলে সাহাবায়ে কেরামকে বোঝানো হয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের জীবনচরিতের মাঝে বিস্ময়কর একটি দিক হচ্ছে, যে সাহাবী নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যত ঘনিষ্ঠ ছিলেন তার জীবনচরিত তত সবিস্তারে পাওয়া যায়। সাহাবায়ে কেরামের জীবনচরিত হেফাযতের একটি উদ্দেশ্য এটাও ছিল যে, কুরআনের বাহকের সঙ্গীদের ব্যাপারে যখন জানা যাবে তখন বাহকের (রাসূলুল্লাহর) সর্বাঙ্গীন সৌন্দর্যেরও কিছুটা অনুমান করা যাবে। কেননা মানুষকে জানা যায় তার বন্ধুদের মাধ্যমে। মানবতার ইতিহাসে নবীদের পরে সর্বোত্তম মর্যাদাবান ও উত্তম সমপ্রদায়ের নাম যদি নিতে হয় তাহলে তা সাহাবায়ে কেরাম। সুতরাং কুরআন ও কুরআনের বাহককে জানার জন্য এটাও জানা জরুরি ছিল যে, কুরআনের ওপর সামষ্টিক আমল কিভাবে হবে? সুন্নাত ও কুরআনের সম্মিলিত রূপায়ন কিভাবে হবে? কুরআন ও হাদীসের আলোকে উম্মত কিভাবে জন্ম নিয়েছে? এসব প্রশ্নের জবাব পূর্ণাঙ্গ হত না যদি না সাহাবায়ে কেরামের জীবনচরিত জানা যেত। আল্লাহ তাআলা সে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কুরআনের প্রথম পর্যায়ের ধারক ও আমলকারী প্রায় পনের হাজার পবিত্র সত্তার জীবনচরিত নাম-বংশসহ বিস্তারিতভাবে সংরক্ষিত। আলহামদুলিল্লাহ, উম্মত সে সময় থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত এবং কিয়ামত পর্যন্ত তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে উপকৃত হবে। আর কুরআনের ওপর আমল করার ক্ষেত্রে এটাকে অত্যন্ত সহায়ক মনে করবে।

নয়. সাহাবায়ে কেরাম যারা কুরআনের শব্দ ও অর্থের পাশাপাশি ব্যক্তি ও সামষ্টিকভাবে আমলকারী ছিলেন, যারা দুনিয়াকে একথা জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, কুরআন শুধু আমলযোগ্যই নয়, দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্যের চাবিকাঠি-তাদের পূর্ণ ইতিহাস জানার জন্য তাদের সহচর, যাদেরকে তাবেয়ীন বলা হয়, তাদের জীবনচরিত লিখিত হওয়াও জরুরি ছিল। যাতে সাহাবায়ে কেরামের জীবনচরিত পরবর্তীদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছে। এজন্য তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনের জীবনচরিতও সঙ্কলিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। আল্লাহর কারিশমা দেখুন, এ পর্যায়ের ছয় লাখ লোকের পূর্ণাঙ্গ বায়োডাটাও আল্লাহ তাআলা হেফাজত করেছেন। আর তা অনুমাননির্ভর কোনো তথ্য নয়, বরং পূর্ণ প্রামাণ্যের সঙ্গে ও বিস্তারিতভাবে তিনি কে ছিলেন, তার ইলম ও প্রজ্ঞা কোন পর্যায়ের ছিল, তিনি কার কার নিকট থেকে ইলম হাসিল করেছেন, তার স্মৃতিশক্তি কেমন ছিল, তার তাকওয়া-পরহেযগারী ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য কেমন ছিল ইত্যাদি সকল বিষয় তাতে সন্নিবেশিত হয়েছে। একে ‘আসমায়ে রিজাল শাস্ত্র’ নামে অভিহিত করা হয়। এটা এমন এক শাস্ত্র, যার দৃষ্টান্ত অন্য কোনো জাতির মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় না।
কুরআন সংরক্ষণের জন্য আল্লাহ তাআলা বিস্ময়কর যে ব্যবস্থা করেছেন সেগুলো সংক্ষিপ্তাকারে এখানে আলোকপাত করা হল। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দিন আমরা যেন কুরআনের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারি। আর তিনি যেন আমাদের জাহের ও বাতেনকে কুরআনের চাহিদা মোতাবেক বানিয়ে দেন। আমীন। 

সোমবার, ২১ মে, ২০১২

আন্তঃধর্ম বিয়ে :সেকুলার প্রজন্ম গড়ার চূড়ান্ত মিশন!

আন্তঃধর্ম বিয়ে : সেকুলার প্রজন্ম গড়ার চূড়ান্ত মিশন!

মুহাম্মদ আমিনুল হক


‘বিশেষ বিবাহ আইন’ প্রণয়ন করে আন্ত:ধর্ম বিয়ে সম্পাদনের জন্য সম্প্রতি আইন মন্ত্রনালয় কর্তৃক বিশেষ কাজী নিয়োগ এবং ছেলে না থাকলে কন্যাসন্তানকে পুরো সম্পদের মালিক করে মুসলিম পারিবারিক আইন সংশোধনের উদ্যোগকে কেন্দ্র করে সারা বাংলাদেশে মিছিল-মিটিং, আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় বইছে। ধর্মপ্রাণ মানুষেরা কোনোভাবেই সরকারের এ উদ্যোগকে মেনে নিতে পারছে না। বিজ্ঞ আলেমদের মতে, সরকারের এই উদ্যোগ সরাসরি আল্লাহর আইনের বিরোধী যা কোনো মুসলিম মেনে নিতে পারে না।

জানা গেছে, এই আইন অনুযায়ী একজন মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি কিংবা অন্য যেকোনো ধর্মের যে কেউ কাউকে বিয়ে করতে পারবে। এজন্য পাত্র-পাত্রী কাউকেই ধর্মান্তরিত হতে হবে না। ধর্ম পরিবর্তন ছাড়াই তারা দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করতে পারবে। ইচ্ছে করলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে অথবা যেকোনো একজন নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস বাদ দিতে পারে। এ ধরনের বিয়ের মাধ্যমে জন্ম নেয়া সন্তানদের কোনো ধর্মীয় পরিচয় থাকবে না। বড় হয়ে তারা যেকোনো ধর্ম বেছে নিতে পারবে অথবা ধর্ম বিশ্বাস ছাড়াই জীবন যাপন করতে পারবে।

উপরোক্ত আইনটি পড়ে যে কেউ সহজেই বুঝতে পারে, এটি ১০০ ভাগ ইসলাম ধর্ম বিরোধী আইন। ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী মুসলিম ব্যক্তি কোনো অমুসলিমকে বিয়ে করতে পারে না। আল্লাহ বলেন, “আর তোমরা মুশরিক নারীদের বিয়ে করো না, যতন না তারা ঈমান গ্রহণ করে। অবশ্যই মুসলিম ক্রীতদাসী মুশরিক নারী থেকে উত্তম যদিও তাদেরকে তোমাদের কাছে ভালো লাগে। এবং তোমরা (নারীরা) কোনো মুশরিকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ো না, যে পর্যন্ত না সে ঈমান আনে। একজন মুসলমান ক্রীতদাসও একজন মুশরেকের তুলনায় অনেক ভালো, যদিও তোমরা তাদের দেখে মোহিত হও। তারা দোযখের দিকে আহ্বান করে, আর আল্লাহ নিজের হুকুমের মাধ্যমে আহ্বান করেন জান্নাত ও মার দিকে”(সূরা আল বাক্বারা:২২১)। আল-কুরআনের এই অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছে যে, বেঈমান মুশরিকের সাথে কোনো ঈমানদার মুসলিমের বিয়ে হতে পারে না। কেন পারে না তাও আল্লাহ পরিস্কার করে বলেছেন। তবে ইহুদী ও খ্রিস্টানগণ এই হুকুমের অন্তর্ভূক্ত হবে না। কেননা তারা আহলে কিতাব। আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে বলেন, “...তোমাদের জন্যে হালাল সতী সাধ্বী মুসলিম নারী এবং তাদের সতী সাধ্বী নারী, যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তোমাদের পূর্বে...”(সূরা আল মায়েদাহ:০৫)।

বর্তমান যুগের সেরা আলেমে দ্বীন আল্লামা ইউসুফ আল কারদাভী বলেন, আহলে কিতাবদের থেকে বিয়ে করা যাবে যদি নিম্নের শর্তগুলো পাওয়া যায়: এক. বাস্তবিকই আহলে কিতাব হতে হবে। শুধু নামে ইহুদী কিংবা খ্রিস্টান হলে চলবে না। নামে ইহুদী-খ্রিস্টান অথচ সে নাস্তিক কিংবা নিজ ধর্মকে বিশ্বাস করে না; তাহলে চলবে না। দুই. অবশ্যই তাকে পবিত্র হতে হবে। ব্যভিচারিনী হলে চলবে না। তিন. এমন কাউকে বিয়ে করা যাবে না যার জাতি পুরো মুসলিম উম্মতের সাথে ঘোর শত্রুতা পোষণ করে, যেমন- বর্তমান সময়ের ইসরাঈলের ইহুদীগণ। চার. বিয়ের কারণে স্বামীর সন্তানের কোনো বৈষয়িক ক্ষতি সাধিত হওয়ার আশংকা থাকলেও আহলে কিতাব বিয়ে করা যাবে না। বিজ্ঞ আলেমগণ মনে করেন, যদিওবা আহলে কিতাবদের বিয়ে করা যায় তারপরও তা মাকরূহ বা অপছন্দনীয়। কেননা এই বিয়েতে কোনো সুখ হয় না। মহিলা তার সৌন্দর্য ও উদ্ভট চলা-ফেরার মাধ্যমে সংসারে ফ্যাসাদ তৈরী করবে। সন্তানদের ভবিষ্যৎ হুমকির মধ্যে পড়বে এবং তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মায়ের ধর্মে ধাবিত হবে; যাতে ইসলামের কোনো ফায়দা নেই।

আন্ত:ধর্ম বিয়ের আইনটি যে পুরো জাতিকে সেকুলার জাতিতে পরিণত করার মানসে করা হয়েছে তা আইনটি একটু পড়লেই অনুমান করা যায়। বলা হয়েছে, ‘একজন মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি কিংবা অন্য যেকোনো ধর্মের যে কেউ কাউকে বিয়ে করতে পারবে। এজন্য পাত্র-পাত্রী কাউকেই ধর্মান্তরিত হতে হবে না। ধর্ম পরিবর্তন ছাড়াই তারা দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করতে পারবে’। আইনটির প্রতিটি লাইন সাংঘর্ষিক। আল্লাহ বলছেন একজন মুসলিম মুশরিককে বিয়ে করতে পারবে না আর আইন বলছে পারবে। আইন বলছে, ধর্ম ত্যাগ না করেই অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করা যাবে আর ইসলাম বলছে, এধরনের কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া যেখানে যেকোনো মুসলিম যেকোনো মুসলিম নারীকে যখন তখন বিয়ে করতে পারে না সেখানে কিভাবে অমুসলিমকে বিয়ে করা সম্ভব? ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো মুসলিম নর কিছু নারীকে তো আজীবন বিয়ে করতে পারে না, যেমন- মা, বোন, ভাগ্নি, খালা, নানী, নাতনি ইত্যাদি। কেউ কেউ সাময়িক সময়ের জন্য হারাম। তালাকপ্রাপ্তা নারীর ইদ্দত শেষ না হলে বিয়ে করা যায় না। দুই বোনকে একসাথে বিয়ে করা হারাম। স্বামী থেকে তালাক না নিয়ে অন্যত্র বিয়ে করাও অবৈধ। মহিলাদের মাসিক ও ঋতুস্রাব চলাকালীন সহবাস নিষিদ্ধ। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার মধ্যেও আছে নানান ধরনের শর্ত। এধরনের কঠোর বিধিমালা মেনে নিয়েই মুসলিম নর-নারী বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়। অন্যথা সে মুসলিম থাকতে পারে না। সেই মুসলিম কিভাবে অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করে নিজ ধর্মের ওপর অটল থাকতে পারে তা আমাদের বোধগম্য নয়। বিয়ে করার অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে নর-নারীর মানসিক শান্তি। সেই শান্তির জায়গায় যদি অশান্তি ভীড় করে তাহলে বিয়েতে ফায়দা কি? কুফুতে না মেলার কারণে যদি একই ধর্মের হয়েও চট্টগ্রামের মেয়ের সাথে সিলেটের ছেলের সাথে বিয়ে না হয়, তাহলে কিভাবে চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতা, ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে ভিন্নতর হয়ে নর-নারীর মধ্যে বিয়ে সম্ভব?

বিশেষ বিবাহ আইনটি কার্যকর হলে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হবে দু’ধর্ম পালনকারী স্বামী-স্ত্রীর সন্তানরা। মানসিকভাবে তারা বিকারগ্রস্থ হবে। মুসলিম বাবা বলবেন, আল্লাহ এক আর মা বলবেন আমি Trinity অথবা বহু খোদা’য় বিশ্বাস করি। মুসলিম বাবা যেটাকে বলবেন সত্য সেটাকেই অমুসলিম মা বলবেন অসত্য। মা বাবার এই বিপরীত অবস্থান থেকে সন্তানের মনে ঘৃণার জন্ম নেবে। ১৮ বছর যাবত সে ভোগতে থাকবে মানসিক ব্যধিতে। এছাড়া উত্তরাধিকার হয়ে মা বাবার সম্পত্তি ভোগ করতেও ঝামেলায় পড়তে হবে সন্তানকে। মোটকথা নৈরাজ্য ছাড়া উপায় নেই। গত ১৬ নভেম্বর’২০১১ দৈনিক আমার দেশে প্রকাশিত শাকিল ওয়াহেদের ‘সুলেমানের কোরবানী দেখা’ লেখাটি যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই একটু হলেও বুঝতে পেরেছেন যে দু’ধর্ম ওয়ালা মা বাবার সংসারে কী মানসিক যন্ত্রনায় দিন কাটছে সুলেমানের। ২০১১ সালের ৩০ জুলাই দৈনিক ইত্তেফাকেও বিষয়টি ফুটে উঠেছে। বলা হয়েছে, আন্ত:ধর্ম বিয়ের কারণে সমাজে গড়ে উঠছে নতুন আরেক জাতি; যাদের ধর্মীয় কোনো পরিচয় নেই। এ নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

সরকারের পক্ষ থেকে নাকি বলা হয়েছে, এই আইনটি ১৮৭২ সনের বৃটিশ আইন এবং মুসলমানের জন্য নয়, অন্য ধর্মের লোকদের জন্য। এটি আসলে ভাওতাবাজি। তা না হলে হঠাৎ করে দু’জন কাজী নিয়োগ করে বলা হচ্ছে কেন যে, সারাদেশেও প্রয়োজন হলে এ ধরনের কাজী নিয়োগ হবে। যেখানে বছরে দু-চারজন নিজ ধর্ম ছেড়ে অন্য ধর্ম গ্রহণ করে বিয়ে শাদী করছে সেখানে কাজী লাগে কয়জন? তাছাড়া ১৮৭২ সনের বৃটিশ আইন আমাদের রাখার দরকার কি? প্রতিনিয়ত সবকিছু উল্টাতে পারলে ওই আইন কেন বাদ দেয়া যাবে না?

সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর আস্থাকে বাদ দিয়ে সেকুলারিজমকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। সারাদেশে সেকুলার শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। পর্দার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। কুরআন বিরোধী নারী নীতিমালা পাশ করা হয়েছে। ইসলামপ্রিয় জনতা ও আলেম-ওলামাদের কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। এসব করা হয়েছে ইসলামের বিরুদ্ধে যায়, কুরআনের বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু করা হবে না ঘোষণা দিয়েই। এত্থেকে বোঝা যায় যে, সরকার পরিকল্পিতভাবেই তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। আর তা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জাতিকে ধর্মহীন করা। কেননা সেকুলার রাষ্ট্র কায়েম করতে হলে ধর্মকে সাগরে ছুড়ে ফেলতে হবে। সেকুলারিজমের সংজ্ঞাতেই যা অনুমেয়, Secular spirit or tendency especially a system of political or social philosophy that rejects all form of religious faith. অর্থাৎ- ‘সেক্যুলারিজম হচ্ছে এমন একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক দর্শন যা সকল ধর্ম বিশ্বাসকেই প্রত্যাখ্যান করে’। অতএব ধর্মকে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ থেকে বিদায় করতেই হবে, বিশেষ করে ইসলামকে।

আন্ত:ধর্ম বিয়ের পরিণতি হবে ভয়াবহ। এদেশে কোনো ধর্ম আর টিকে থাকবে না। সবচেয়ে বড় আঘাত আসবে হিন্দু এবং ইসলাম ধর্মের ওপর। আগে দেখা যেত, কেউ নিজের ধর্ম ব্যতিত অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাইলে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে বিয়ে করতে হতো বিধায় সহজে কেউ ওপথে হাটতো না। এখন বিষয়টি সহজ হয়ে যাবে। ধর্ম ত্যাগ না করেই যুবক যুবতীরা তাদের রঙ্গলীলা সাঙ্গ করতে নেমে পড়বে। প্রত্যেক ধর্মের স্বকীয়তা আর থাকবে না। যার ফল দাঁড়াবে অদূর ভবিষ্যতে গোটা সমাজ ব্যবস্থাই ধর্মহীন হয়ে পড়বে। জন্ম নেবে জারজ সন্তান। একদিন জারজ সন্তানে দেশ ভরে যাবে। ধর্মের আর দাম রইবে না। আরিক অর্থে নয়, বাস্তবিকই রক্ত-মাংসে সেকুলার রাষ্ট্রে পরিণত হবে বাংলাদেশ! আর তা যদি পুরোপুরি নাও হয় সামাজিক বিশৃংখলা যে দেখা দেবে তা তো হলফ করেই বলা যায়।

বিবাহ একটি সামাজিক প্রথা। তাই বলে আমার ইচ্ছে মতো এই প্রথাকে পরিবর্তন করতে পারব না। ইসলাম ধর্ম মানুষের সকল কিছুকে অন্তর্ভূক্ত করেছে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কেমন হবে, দিয়েছে তার গাইড লাইন। এই গাইড লাইন আল্লাহ প্রদত্ত বিধায় এর মধ্যে কোনো গলদ নেই। সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিবাহের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনার বিকল্প নেই। এর বাইরে যাওয়ার চেষ্টা মানেই নিজেদের ধ্বংস নিজেরা ডেকে আনা। ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম দিয়ে বল্গাহীনভাবে কিছু করার স্বাধীনতা ইসলামে নেই। যারা নিজের স্বাধীনতা দিয়ে অন্যের ধর্ম, সম্মান, রীতি-নীতি ও স্বাধীনতাকে নষ্ট করে তারা মানবতার শত্রু। আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দিন। আমীন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।
ই-মেইল: aminulhoque_iiuc@yahoo.com
http://www.sonarbangladesh.com/articles/MuhammadAminulHaque

রবিবার, ২০ মে, ২০১২

মীলাদ ও ঈদে মীলাদুন্নবী /ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী পালন অবৈধঃ

মীলাদ ও ঈদে মীলাদুন্নবীর ইতিহাস


১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ৮:৩৪







আসসালামু আলাইকুম

মাঝে মাঝে কিছু ব্লগার ধর্মীয় ব্যপারে এমন কিছু পোষ্ট দেন যা সাধারন মুসলিমগন পড়ে ওটাকেই সঠিক বলে মনে নেন এমনকি কোরআনের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে এসকল সাধারণ মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে নাড়া দিয়ে সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্যে পরিনত করেন। এটা একটা বড় ধরনের গোনাহের কাজ, যদি ধর্ম সম্পর্কে সঠিক এবং সহীহ কোন দলীল খুঁজে না পাওয়া যায় তার প্রচার এবং প্রসার থেকে আমাদের অবশ্যই সাবধান থাকা উচিত। মনে রাখতে হবে যে ইসলাম পরিপূর্ণ ধর্ম এবং এখানে কোন কিছুর নতুন সংযোজন বা বিয়োজনের সুযোগ নাই। সত্যের জয় সর্বদাই হবে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হবেই কারন মিথ্যা বিলুপ্ত হবার জন্যই।

আসুন মিলাদ এবং ঈদে মিলাদুন্নবীর ইতিহাস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। অতঃপর সিদ্ধান্ত নেই কোনটা সঠিক এবং বেঠিক। ইতিহাস না জানলে এই সিদ্ধান্তে আসা বড়ই কষ্টকর।আমাদের সমাজে বিদআ'ত এমন ভাবে ঢুকে গেছে যে তার বিরূদ্ধে কথা বললে আলিম সমাজ 'অমুসলিম' বলে গালি দিতে এবং 'ইসলাম থেকে খারিজ' করতে ডানে বায়ে তাকায় না। এসব বিদআ'ত শরীরে টিউমারের মতো জেগে উঠেছে আর আমাদের আলিম সমাজ এসকল টিউমার অপারেশনের পরিবর্তে স্বাস্থ্যের অংশ বলে প্রচার প্রসার করে বেড়াচ্ছেন, আর সাধারন মুসলমানগণ ভাবছেন 'আরে তাইতো, নিশ্চই টিউমার সুস্বাস্থের অংশ!!"

মীলাদঃ

পাক ভারত ও বাংলার মুসলিম সমাজে প্রচলিত ও সবচেয়ে আকর্ষনীয় এবং ব্যাপকভাবে পালনীয় অনুষ্ঠানটি হচ্ছে মীলাদ মাহফিল ও মীলাদুন্নবী দিবস। কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজের সূচনায় মীলাদ যেন অপরিহার্য এবং মহা ধুমধামে ঈদে মীলাদুন্নবী উৎসব পালন করা যেন বিরাট সাওয়াবের কাজ। অথচ এই মীলাদ এর কথা মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও রাসুলূল্লা (সাঃ) এর হাদীস কোনটিতেই নেই। অথবা মীলাদ কোন সাহাবী, তাবিঈ, তাবি তাবিঈ, কোন ইমাম করেছেন বা করতে বলেছেন তার কোন দলীল প্রমান ও নাই। এটা কোন নির্ভরযোগ্য আলিমের দ্বারাও চালু হয়নি। এমনকি যারা এর ধারক বাহক হয়ে সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত নবী প্রেমের নামে এই মীলদ বা ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করে আসছেন তারাও স্বীকার করে থাকেন যে, এটার কোন দলীল নাই। মীলাদ চালু হয়েছে রাজা বাদশাহ বা স্বল্প শিক্ষিত সুফীদের দ্বারা। তাই সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত নবী প্রেমের নামে এই মীলাদ বা ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করা ইসলামরে কোন অংশ নয়। বরং এটা ধর্মের নামে নবআবিষ্কৃত বিদআ'ত। তাই এখানে মীলাদুন্নবী ও মীলাদের সূচনা, তার ইতিহাস, মীলাদ ও কিয়ামের নামে যে সব শিরকী ও বিদআ'তী কাজ হচ্ছে এবং এ সম্পর্কে হানাফী আলিমদের সহ বিখ্যাত জ্ঞাণী-গুণীদের মন্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। যেন সমাজে প্রচলিত এসব বিদআ'ত থেকে জাতি মুক্ত হতে পারে।

মীলাদ ও ঈদে মীলাদুন্নবীর অর্থঃ

আরবী 'মীলাদ' শব্দের অর্থ জন্মের সময়- (আল-কামূস ১ম খন্ড, ২১৫ পৃঃ, নওলকিশোর ছাপা, মিসবা-হুল লুগা-ত ৯৫৪ পৃঃ, ৫ম খন্ড সংস্করণ, দিল্লী ছাপা)।
এবং ঈদে মীলাদুন্নবীর অর্থ হচ্ছে নাবীর জন্মদিনের আনন্দোৎসব। বর্তমানে ১২ই রবিউল আউয়ালকে ঈদে মীলাদুন্নবী অর্থাৎ নাবী (সাঃ) এর জন্মের আনন্দ উৎসব দিবস বলে জোর প্রচার করা হচ্ছে। যদিও রাসূল (সাঃ) এর জন্ম দিবস নিয়ে বিভিন্ন রকম মত আছে তার মধ্যে ১২ই রবিউল আউয়ালের মত হচ্ছে অন্যান্য মতের তুলনায় দুর্বল। এ সম্পর্কে সামনে আলোচনা করা হয়েছে।

মীলাদ ও মীলাদুন্নবীর ইতিহাসঃ

নাবী (সাঃ) এর সময়, খুলাফায়ে রাশেদীনদের সময় বা উমাইয়া খলিফাদের যুগে এগুলো ছিল না। এর বীজ বপন করে আব্বাসীয় খলিফাদের যুগে জনৈক মহিলা। মাদীনাহ শরীফে প্রিয় নাবী (সাঃ) এর রওযা মোবারক যিয়ারত করার ও সেখানে দু'আ করার যে ব্যবস্থা রয়েছে ঠিক সেভাবে আল্লাহর নাবী (সাঃ) মক্কায় যে ঘরে ভূমিষ্ট হয়েছিলেন সেই ঘরটির যিয়ারত ও সেখানে দু'আ করার প্রথা সর্বপ্রথম চালু করেন বাদশাহ হারুনুর রশিদের মা খায়যুরান বিবি (মৃত্যু ১৭৩ হিজরী ৭৮৯ ঈসায়ী) পরবর্তীকালে ১২ই রবিউল আউয়ালকে আল্লাহর নাবী (সাঃ) এর জন্ম ও মৃত্যু দিবস ধরে নিয়ে তীর্থ যাত্রীগন ঐ ঘরে এসে দু'আ করা ছাড়াও বারকাতের আশায় ভূমিষ্ট হওয়ার স্থানটি স্পর্শ ও চুম্বন করতো। (ইবনু জুবায়ের ১১৪, ৬৩ পৃঃ ও আল-বাতালুনী ৩৪ পৃঃ) এখানে ব্যক্তিগত যিয়ারত ছাড়াও একটি উৎসব অনুষ্ঠিত হতো। তা ইবনু জুবাইরের (মৃত্যু ৬১৪ হিঃ) গ্রন্থের ১১৪ ও ১১৫ পৃষ্ঠায় প্রথম জানা যায়।

অতঃপর হিজরীয় চতুর্থ শতকে উবাইদ নামে এক ইয়াহুদী ইসলাম গ্রহণ করে। তার নাম রাখা হয় উবাইদুল্লাহ। তিনি নিজেকে ফা-তিমাহ (রাঃ) এর সম্ভ্রান্ত বংশধর বলে দাবী করেন এবং মাহদী উপাধি ধারণ করেন। এঁরই প্রপৌত্র (পৌত্রের ছেলে) মুয়িব লিদীনিল্লাহ ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের জন্মবার্ষিকীর অনুকরণে ছয় রকম জন্মবার্ষিকী ইসলামে আমদানী করেন এবং মিশরের ফাতিমী শিয়া শাসকরা মুসলিমদের মধ্যে জন্মবার্ষিকী পালনের রীতি চালু করেন। এই ফাতিমী শিয়া খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা আবূ মুহাম্মাদ ইবাইদুল্লাহ ইবনু মায়মূন প্রথমে ইয়হূদী ছিলেন- (আল বিদা-য়াহ আননিহাইয়া একাদশ ১৭২ পৃঃ) কারো মতে তিনি ছিলেন অগ্নিপূজারী- (মাকরিজীর আল খুতাত আল আ-সার ১ম খন্ড ৪৮ পৃঃ) ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, মিশরের ফিরআউন জন্মোৎসব পালন করতেন- (ফাতা-ওয়া নাযীরিয়্যাহ ১ম খন্ড, ১৯৯ পৃঃ) ফিরআউন ছিল ইয়াহুদী। তারপর ঐ ইয়হুদী রীতি খৃষ্টানদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়। ফলে তারা তাদের নাবী ঈসা (আঃ)- এর পন্মবার্ষিকী 'ক্রিসমাস ডে' পালন করতে থাকে।

মুসলিমদের মাঝে এই জন্মবার্ষিকী রীতি চালু হওযার একশ তিন বছর পর অর্থাৎ ৪৬৫ হিজরীতে আফজাল ইবনু আমীরুল জাইশ মিশরের ক্ষমতা দখল করে রাসূল (সাঃ), আলী (রাঃ), ফাতিমাহ (রাঃ), হাসান (রাঃ), হোসেন (রাঃ)- এর নাম সহ প্রচলিত ছয়টি জন্মবার্ষিকী পালনের রীতি বাতিল করে দেন। (মিশরের মুফতী শায়খ মুহাম্মাদ রচিত আহসানউল কালা-ম ফী মাইয়্যাতা আল্লাকু বিস সুন্নাতি অল বিদআ'তী মিনাল আহকাম, ৪৪-৪৫ পৃঃ বরাতে তাম্মিহু উলিল আবসা-রা ইলা কামা লিদ্দিন আমা ফিল বিদআ'য়ী মিনাল আখতা-র ২৩০পৃঃ) এর পর ত্রিশ বছর বন্ধ থাকার পর ফাতিমী শিয়া খলিফা আমির বি-আহকা-মিল্লা-হ পুনরায় এই প্রথা চালু করেন। তখন থেকেই জন্মবার্ষিকী পালনের রীতি চালূ হয়ে এখনও চলছে। (ঐ ২৩০-২৩১ পৃঃ)

ঐতিহাসিক অন্যান্য বর্ণনা থেকে জানা জায়, জন্মবার্ষিকী পালনের এই রীতি ঐ মীলাদ প্রথা খালিফা মুস্তালি বিল্লাহর প্রধান মন্ত্রী বদল আল জামালী বাতিল করে দেয়। এবং তার মৃত্যুর পর পুনরায় চালূ হলে পরবর্তীতে কুরআন-হাদীসের অনুসারী সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ূবী এই সব জন্মবার্ষিকী ও মীলাদ প্রথা বাতিল করে দেন। কিন্তু সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ূবীর ভগ্নিপতি আরবিলের শাসনকর্তা মুজাফফরউদ্দিন ছাড়া কেউ এর বিরোধিতা করেন নাই। ঐতিহাসিকরা বলেন যে, বাদশাহ মোজাফফারউদ্দিনের মীলাদ মাহফিল গুলোতে নামধারী সুফীরা উপস্থিত হন এবং এই মাহফিল ফজর থেকে যোহর পর্যন্ত চলত। বাদশাহ এই মীলাদের জন্য তিনলক্ষ স্বর্ণমুদ্রারও অধিক বেশী খরচ করতেন। (মাকরিজীর আল খুতাত ১ম খন্ড ৪৯০ পৃঃ, মিরআতুয জামা-ন ফী তা-রিখীল আ'ইয়্যান ৮ম খন্ড ৩১০ পৃঃ, পূর্বোক্ত তানবিহু উলিল আবসা-র ৩২ পৃঃ)

সুন্নীদের মাঝেও মীলাদুন্নবী ঢুকে প্রড়। তাই শাইখ ওমার ইবনু মুহাম্মাদ মোল্লা নামে এক প্রসিদ্ধ সৎব্যক্তি মুসিলে মীলাদুন্নবী করে ফেলেন এরই অনুসরণ করেন ইরবিলের শাসনকর্তা মুজাফফরউদ্দিন- (কিতাবুল বা-য়িস আলা ইনকা-রিল-বিদায়ী আল হাওয়া-দিস ৯৬ পৃঃ) মোল্লা ওমার ইবনু মুহাম্মাদ মুসিলের বাসিন্দা ছিলেন। আর ইরবিল মুসিলেরই নিকটবর্তী এলাকা ছিল। তাই আনুমানিক ৬০৪ হিজরীতে সুন্নীদের মধ্যে মীলাদুন্নবীর সূত্রপাত হয়। অতঃপর ইরবিলের শাসনকর্তা মুজাফফর উদ্দিন তা ধূমধামের সাথে মানতে থাকে। এমন সময় স্পেনের এক ইসলামী বিদ্বান আবুল খাত্তা-ব ওমার ইবনুল হাসান ইবনু দিহইয়াহ মরক্কো ও আফ্রিকা, শিসর ও সিরিয়া, ইরাক ও খোরাসান প্রভৃতি দেশ ঘুরতে ঘুরতে ৬০৪ হিজরীতে ইরবিলে প্রবেশ করেন এবং বাদশাহ মুজাফফার উদ্দিনকে মীলাদুন্নবী পালনের ভক্ত হিসাবে দেখতে পান। তাই তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মীলাদ সম্পর্কে একটি বই লেখেন- 'কিতাবুত তানভীল ফি মাওলিদিস সিরাজিল মুনীর' নামে। অতঃপর তিনি এটাকে ৬২৬ হিজরীতে ছ'টি মাসলিসে বাদশাহ মুজাফফর উদ্দিীনের নিকট পড়ে শোনান। বাদশাহ তাতে সন্তুষ্ট হতে তাঁকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা দান করেন- (আফাইয়া-তুল আ'য়া-ন ৩য় খন্ড, ১২২ পৃঃ) ফলে মুসীম জাহানের বিভিন্ন দেশে জন্মবার্ষিকী পালনের রীতি ছড়িয়ে পড়ে। তাই মরক্কোবাসীরা এই মীলাদের নাম দিয়েছেন 'মাওসম' আলজেরিয়াবাসিীরা এর নাম দিয়েছে 'যারদাহ' মিশর ও মধ্যপ্রাচ্য বাসীরা এর নাম দেয় 'মাওলিদ'। (আলইনসা-ফ ফীমা কীলা ফিল মাওলিদ মিনাল গুলুয়ে আলইজহা-ফ ২৭ পৃঃ)

আর ভারতীয় উপমহাদেশে মীলাদুন্নবী আমদানীকারীরা ছিল শিয়া। যেমন ইসলামের মধ্যে প্রথম মীলাদ আমদানীকারক ছিল শিয়া খলীফা মুয়ীয লিদীনিল্লাহ। ভারতের মোঘল সম্রাটদের কিছু মন্ত্রী ও পরামর্শদাতা ছিল শিয়া।যেমন মোঘল সম্রাট হুমায়ূন ও সম্রাট আকবরের মা শিয়া ছিল। আকবরের অভিভাবক বৈরাম খাঁ কট্টর শিয়া ছিরেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাষ্ট্রদূত শিয়া ছিলেন। বাদশাহ বাহদুর শাহ শিয়া ছিলেন। তাঁরাই এই উপমহাদেশে সুন্নীদের মধ্যে মীলাদুন্নবীর চলন করে দেন। ফলে ফিয়া- মীলাদুন্নবীর আনুষঙ্গিক ব্যাপারগুলো সুন্নীদের মধ্যে প্রচলিত হয়ে পড়ে। যেমন- আলোকসজ্জা ও মিছিল প্রভৃতি। (শায়খ আইনুল বারী আলিয়াবীর কর্তৃক রচিত 'মীলাদুন্নবী ও বিভিন্ন বার্ষিকী' পুস্তকের ৩৩ পৃঃ)

অন্য র্বনা থেকে জানা যায় যে, মীলদ পাঠের নিয়ম ৫৯০ হিজরী সনে বরকুক সুলতান ফরাহ ইবনু নসরের যুগে প্রচলিত হয়। তিনি খুব আরামপ্রিয় সুলতান ছিলেন। শরীআ'তের কড়াকড়ি নির্দেশ তিনি মেনে চলতেন না। সামান্য কাজে কিভাবে বেশী সাওয়াব পাওয়া যায় তিনি এরূপ কাজের অনুসন্ধান করতেন। অবশেষে শাফিঈ মাযহাবের এক বিদআ'তী পীর প্রচলিত মীলাদ পাঠের পদ্ধতি আবিস্কার করে সুলতানকে উপহার দেন। সুলতান বড় সাওয়াবের কাজ মনে করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্ম পালনের নামে মীলাদ পাঠের ব্যবস্থা চালূ করেন। সেখান থেকেই প্রচলিত মীলাদের উদ্ভব ঘটে।

এই মীলাদের পূর্ণ বিবরণ পরবর্তীকালে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনু খাল্লিকান (৬৮১ হিজরী) তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তারপর জালালুদ্দীন আস-সয়ূতী (মৃত্যু ৯১১ হিজরী) তাঁর হুসনুল মুহাযরা ফী 'আমালিল মাওয়ালীদ গ্রন্থে ইবনু খাল্লিকানের লেখার উপর নির্ভর করে মীলাদের বিবরণ পেশ করেছেন। সুলতান মুজাফফরউদ্দীন যে মীলাদ চালু করেছিলেন তাতে যথেষ্ট খৃস্টীয় প্রভাব বিদ্যমান ছিল। কারণ সে সময় ক্রুসেড যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ সৈন্য সিরিয়া, জেরুজালেম প্রভৃতি এলাকায় আগমণ করেছিল। তারা যীশুখৃষ্টের জন্মদিন পালন করতো। এসব দেখে শুনে সুলতান মুজাফফরউদ্দীনের মনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্ম দিবস তথা মীলাদের অনুষ্ঠান করার প্রেরণা পেগে উঠে। সুফীদের সাথে যোযোগ রেখে তিনি ৪টি খানকাহ নির্মাণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ইনতে কালের প্রায় ৪০০ বছর পর খৃস্টানদের মধ্যস্থতায় প্লাটিনাসের নূরের মতবাদ ইসলামের হিকামাতুল ইরাব বা ফালাসাফাতুল ইসলাহ নামে ইসলামী লেবাসে প্রথমে সুফিদের মধ্যে ও পরে মীলাদের মাধ্যমে ইসলামে প্রবেশ লাভ করে।

এছাড়াও মীলদের ইতিহাস সম্পর্কে প্রখ্যাত হানাফী আলিম ও বহু গ্রন্থের প্রণেতা মরহুম মাওলানা আঃ রহীম তার সুন্নত ও বিদআ'ত বইয়ের ২২৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ মীলাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হলোঃ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর মৃত্যুর ২০০ বছর পর এমন এক বাদশাহ প্রচলন করেন যাকে ইতিহাসে ফাসিক ব্যক্তি কলে উল্লেখ করা হয়েছে। জামে আজহারের শিক্ষক ডঃ আহমদ শারবাকী লিখেছেনঃ ৪০০ হিজরীতে ফাতিমী শাসকরা মিশরে এর প্রচলন করেন। একথাও বলা হয় যে শাইখ ইবনু মুহাম্মদ নামক এক ব্যক্তি ইরাকের মুসিল শহরে এর প্রচলন করেছেন। পরে আল মুজাফফর আবূ সাঈদ বাদশা ইরাকের ইরবিল শহরে মীলাদ চালু করেন। ইবনু দাহইয়া এ বিষয়ে একখানা কিতাব লিখে তাকে দেন। বাদশাহ তাকে এক হাজার দীনার পুরস্কার দেন- ( ইয়াসআলুনাকা আনিদ-দীনি ওয়াল হায়া-হ ১ম খন্ড ৪৭১ পৃঃ)
এই মীলাদুন্নবী ও মীলাদ-এর ইতিহাস থেকে জানা যাচ্ছে যে এগুলো কুরআন ও হাদীস সমর্থিত নয় বরং ইয়াহুদী, খৃষ্টা ও অগ্নিপূজকদের রীতি অনুকরণ ও অনুসরণ। আর অন্য জাতীর সাদৃশ্য গ্রহণ সম্পর্কে বিশ্বনাবী (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করে সে তার দলভূক্ত হয়ে থাকে। (আবূ দাউদ ২ং খন্ড ২৩০ পৃঃ, মুসনাদে আহমাদ ২য় খন্ড ৫০ ও ৯২ পৃঃ, মিশকাত ৩৭৫ পৃঃ)

অন্যান্য বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, সে আমাদের দলের নয় যে ব্যক্তি আমাদের ছাড়া অণ্যের সাদৃশ্য গ্রহণ করে।তোমরা ইয়াহুদীদের সাদৃশ্য গ্রহণ কর না এবং খৃষ্টানদেরও না। (তিরমিযী ২য় খন্ড ৫৪ পৃঃ, মিশকাত ৩৯৯ পৃঃ) অতএব মহানবী (সাঃ) এর প্রতি যদি সত্যই কারো ভালোবাসা থেকে থাকে তাহলে তাঁর উক্ত হাদীস দুটি জানার পর ইহুদী-খৃষ্টান ও অগ্নিপূজারীদের সাদৃশ্য গ্রহণ করে কোন মু'মিন মুসলিম মীলাদুন্নবী, জন্মবাষিকী ও আলোকসজ্জা প্রভৃতি অনৈসলামিক কাজ করতে পারে না। এবং এই ধরনের বিদআ'তি কাজ কারার জন্য যারা উৎসাহ ও প্ররচনা দিয়ে থাকে তারা কেউই সহীহ হাদীস পেশ করতে পারেন না। কেহ বা বলে থাকেন কোরআনে অনেক ঈদকরার কথা বলা আছে যা ঈদে মীলাদুন্নবীর ইঙ্গিত। এগুলো হচ্ছে সরল মুসলিমদের ধোকা দিয়ে তাদের ঘোর অন্ধকারে রাখা এবং জনমত সৃষ্টি করা এক কথায় দল ভারী করা এবং ভারী দল দেখিয়ে বলা যে "আমরা এতোগুলো মানুষ কি ভুল করছি?" সর্বদা মনে রাখতে হবে যে সত্য যদি একজনও বলে সেটা সব সময়ের জন্যই সত্য।

ঐতিহাসিকভাবে রাসুলূল্লাহ (সাঃ) এর জন্ম তারিখ কোনটি?

ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলোর ভিত্তিতে অধিকাংশের মতে মহানবী (সাঃ) এর জন্ম মাস রবিউল আউয়াল মাস। আল্লামা ইবনুল জওযী বলেন, অধিকাংশ বিদ্বানের ঐক্যমতে রাসূল (সাঃ) এর জন্ম রবিউল আউয়াল মাসে- (সীরাতুল মুস্তফা ১ খন্ড, ৫১ পৃঃ ২নং টীকা) তবে জন্ম তারিখের ব্যাপারে মতভেদ আছে যেমন এ ব্যাপারে আটটি উক্তি আছে। যথা-
(১) ২, ৮,১০, ১২ ও ১৩ ই রবিউল আউয়াল। (সিফাতুস সফঅহ ১ম খন্ড, ১৪ পৃঃ, আলঅফা বি-আহওয়া-লিল মুস্তফার উর্দু তর্জমা সীরাতে সাইয়িদুল আম্বিয়া ১১৭ পৃঃ)

(২) মুসান্নাফ ইবনু শাইবায় জাবির ও ইবনু আব্বাস থেকে বর্ণিত ১৮ই রবিউল আউয়াল। (আল বিদা-য়াহ আননিহা-য়াহ ২য় খন্ড ২৪২ পৃঃ)

(৩) ১ লা রবিউল আউয়াল। (আলইস্তীআ-ব ১৩ পৃঃ)

(৪) ইবনু হিশাম বলেন, আল্লামা তাবারী ও ইবনু খালদূনও বলেন ১২ই রবিউল আউয়াল। (তাহযীবু সীরাতে ইবনু হিশাম ৩৬ পৃঃ) (তারিখুল উমাম অলমুলক ১ম খন্ড, ৫৭১ পৃঃ,)

(৫) আল্লামা ইবনু আব্দিল বার ২রা রবিউল আউয়াল বলা সত্বেও বলেন যে, ঐতিহাসিকগণ ৮ই রবিউল আউয়ালের সোমবারকেই সঠিক বলেছেন। (আলইস্তীআ-ব ১৪ পৃঃ)

(৬) ইবনু সা'দ বলেন, আবূ জা'ফর মুহাম্মাদ ইবনু আলীর মতে ১০ই রবিউল আউয়াল এবং আবূ মা'শার নাজীহ মাদানীর মতে ২রা রবিউল আউয়াল সোমবার। (তাবাকাতে ইবনু সা'দ ১ম খন্ড ৮০, ৮১ পৃঃ)

(৭) কনষ্টান্টিনোপলের বিখ্যাত জোতির্বিদ মাহমূদ পাশা তাঁর যুগ থেকে মুহাম্মাদ (সাঃ) পর্যন্ত ক্যালেন্ডার ঘেটে প্রমাণ করেছেন "সোমবার" দিনটি ১২ই রবিউল আউয়ালে কোন মতেই পড়ে না। বরং তা ৯ই রবিউল আউয়ালেই সঠিক হয়। এজন্য সঠিক বর্ণনা ও জ্যোতির্বিদদের গণনা হতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্ম দিনের নির্ভর যোগ্য তারিখ ৯ই রবিউল আউয়াল। (কাসাসুল কুরআন ৪র্থ খন্ড, ২৫৩-২৫৪ পৃঃ)

(৮) হাদীস ও ইতিহাসের বহু মহাবিদ্বান- যেমন আল্লামা হুমাইদী, ইমাম ইবনু হাযম, ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ, ইবনুল কাইয়িম, ইবনু কাসীর, ইবনু হাজার আসকালানী ও বাদরুদ্দীন আইনি প্রমুখের মতে ৯ই রবিউল আউয়াল সোমবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্ম দিন। (কাসাসুল কুরআন ৪র্থ খন্ড, ২৫৩ পৃষ্ঠা) সমস্ত বর্ণনা প্রমান করে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্ম ক্ষন, জন্ম তারিখ, জন্মসন এসবেই মতভেদ আছে। কেবল একটা ব্যপারে সবাই একমত যে, তাঁর জন্মদিনটি ছিল সোমবার। (মুসলিম ১ম খন্ড, ৩৬৮পৃঃ)

এবং প্রায় সবাই একমত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মৃত্যু হয়েছিল রবিউল আউয়াল মাসে। এ সম্পর্কে যদি তর্কের খাতিরে মেনে নেয়া হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্ম ও মৃত্যু হয়েছিল ১২ই রবিউল আউয়ালে তাহলে ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের অনুকরণে ১২ই রবিউল আউয়ালে ঈদে মীলাদুন্নবী তথা নাবী (সাঃ) এর জন্মবার্ষিকী খুশী মানানো হয় অথচ ঐ দিনেই নাবীজীর ইন্তেকালের শোক পালন করা হয় না কেন? এ কথায় সবাই একমত যে, একই আনন্দ ও দুঃখ একত্রিত হলে দুঃখের মধ্যে আনন্দ ম্লান হয়ে যায়। তাই ১২ই রবিউল আউয়াল মীলাদুন্নবীর উৎসব পালন না করে নাবীর মৃত্যু শোক পালনক করাই যুক্তিযুক্ত হতো।

ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী পালন অবৈধঃ

আল কুরআনের কোন আয়াত বা কোন হাদীস দ্বারা কারো জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালনের কোনই প্রমাণ পাওয়া যায় না।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে যাঁর সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতেন সে সব সাহাবাগণ বিশ্বনবী (সাঃ) এর জীবিতকালে অথবা তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর জন্ম বা মৃত্যু বার্ষিকী পালন করেননি। এমনকি রাসূল (সাঃ) এর একমাত্র পূত্র ইবরাহীম ছাড়া বাকী পুত্রগণ তাদের জন্মের এক বছরের মধ্যেই মারা যায়। শুধু মাত্র ইবরাহীম ষোল মাস বয়সে মারা যায়।এজন্য নাবী (সাঃ) এতই দুঃখিত হন যে, তাঁর চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত) কিন্তু এই আদরের ছেলেটির জন্মের দ্বিতীয় বছরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার "মৃত্যু" অথবা "জন্মোৎসব পালন করেননি।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবিতকালে ওয়াহী দিবস, কুরআন নাযিল দিবস, পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম (আঃ) এর জন্ম বা মৃত্যু দিবস, মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আঃ) এর জন্ম বা মৃত্যু দিবস এসেছে কিন্তু রাসূল (সাঃ) এভাবে কোন নবীর স্মরণে বা কোন সাহাবার শাহাদাত দিবস অথবা কোন জিহাদের দিবস পালন করেন নাই এবং নির্দেশও দেন নাই। বরং তিনি বলে গেছেন , আমার পরে আমার শরীআ'তের মধ্যে যে সকল নতুন কাজকর্ম আবিষ্কার হবে, আমি তা হতে সম্পর্কহীন এবং ঐ সকল কাজকর্ম মারদূদ পরিত্যাজ্য ও ভ্রষ্ট। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত) তাই মীলাদুন্নবী ও মৃত্যুবার্ষিকী কিংবা কোন জীবিত ও মৃত ব্যক্তির জন্মবার্ষিকী বা মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা কুরআন ও হাদীসের দৃষ্টিতে বিদ'আত তথা মনগড়া কাজ। আর ইতিহাসের দৃষ্টিতে ইয়াহুদী, খৃষ্টান ও অগ্নিপুজকদের অন্ধ অনুসরণ তথা ইসলাম বিরোধী কাজ। আর এসব জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকী পালন কার তো বৈধ নয়ই বরং এগুলো থেকে অবশ্যই বিরত থাকা জরুরী।

মীলাদ সম্পর্কে মনীষীদের মন্তব্য

@ বিশ্ব বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ তাফসীর ইবনু কাসীরের লেখক মীলাদ প্রবর্তনকারীদের উদ্দেশ্যে বলেনঃ তারা কাফির ও ফাসিক। (মুহাম্মাদ বিন জামিল যাইনু রচিত বাংলা অনুবাদকৃত মুক্তিপ্রাপ্ত দলের পাথেয় ৭৭ পৃঃ)

@ আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী বলেনঃ বর্তমানে প্রচলিত মওলুদ (মীলাদ) ৬০০ হিজরীতে ইরবিলের সুলতানের যুগে চালু হয়। শরীআ'তে মুহাম্মাদীতে এর কোন অস্তিত্ব নেই বরং এই বিদআ'ত সম্পর্কে এমন কোন কিতাব নাই যা হাফিজ ও মুহাদ্দিসীনদের হাতে নেবার উপযুক্ত। (আল-আরফুশ-শাজী ও আল জামে তিরমিযী ২৩২ পৃঃ)

@ হাফিয আবূ বকর বাগদাদী হানাফী ওরফে ইবনু নক্বতা তদীয় ফাতাওয়ায় লিখেছেনঃ মীলাদ মাহফিল সলফ বা অতীত মুসলিম সুধীবৃন্দ হতে উল্লেখিত নাই এবং ঐ সকল কাজকর্মে মোটেও কোনও মঙ্গল নাই। এটা অতীত সুধীবৃন্দ কর্তৃক সম্পাদিত হয়নি।

@ হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত আলিম আল্লামা তাজুদ্দীন ফাকেহানী মীলাদ অনুষ্ঠান সম্পর্কে বলেছেনঃ আমি পবিত্র কুরআনে ও হাদীসে মীলাদ মাহফিলের কোন প্রমাণ পাইনি। উম্মতে মুহাম্মাদীর মধ্যে দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে বিজ্ঞ মহামতি নেতৃস্থানীয় ওলামাগণের কেউই এ কাজ (মীলাদ) করেছেন এমন কোন রিওয়ায়াতও বর্ণিত হয়নি। বরং এ মীলাদ একান্তই নব্য প্রসূত বিদআ'ত। এবং পেটপূজার জন্যই এটা আবিস্কৃত হয়েছে। (মদখুল ফাতাওয়ায়ে সাত্তারিয়া ১ম খন্ড ১৭৯ পৃঃ)

@ হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত আলিম মওলানা আশরাফ আলী থানবী মীলাদের আসল স্বরূপ উদঘাটন করে দিয়ে তার তরীকায়ে মওলেদ কিতাবে লিখেছেন- মীলাদ অনুষ্ঠান শরীআ'তে বিলকুল নাজায়িয গুনাহের কাজ। তিনি আরো বলেন, প্রচলিত মীলাদ ও কিয়াম যা নবআবিষ্কৃত ও নিষিদ্ধ বিষয় সমূহের অন্তর্ভূক্ত তা নাজায়িয ও বিদআ'ত। যেহেতু হাদীসে আছে "প্রত্যেক বিদআ'তই গুমরাহী, পাপ ও মহাপাপ" (বেহেশতী জেওর ও তরীকায়ে মওলিদ)

@ ইমাম আহমদ বসরী স্বীয় পুস্তক কওল-ই-মু'তামাদ এর মধ্যে লিখেছেনঃ চার মাযহাবের আলিমগণ মীলাদ অনুষ্ঠানের উপর দোষারোপে ঐক্যমত প্রকাশ করেছেন।

মীলাদুন্নবী উদযাপন সম্পর্কে মনীষীদের মন্তব্যঃ

@ মওলানা শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী স্বরচিত তুহফা-ই-ইসনা আশারিয়া পুস্তকে লিখেছেন- কোন নাবীর জন্ম ও মৃত্যু দিবসকে ঈদ উৎসবে পরিণত করা বৈধ নয়।

@ শাইখ আবদুর রহমান মাগরিবী হানাফী তার ফাতাওয়ায় বলেনঃ মীলাদুন্নবীর কাজ বিদআ'ত। যা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং খলীফাগণ ও ইমামগণ বলেননি ও করেননি। (তুহফাতুল কূযা-৩, তারীখে মীলাদ ১১১ পৃঃ)

@ মেখল হামিউস সুন্নাহ মাদরাসাহ, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম- মুফতী মোঃ ইব্রাহীম খাঁন বলেন, রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ নির্দিষ্ট করে উক্ত তারিখে প্রচলিত মীলাদ মাহফিলের ব্যবস্থা করা, জশনে জুলুস বের করা, ঐ দিনকে নির্দিষ্ট করে উক্ত দিনে ফকির মিসকিন এবং মানুষ একত্রিত করে খাওয়া দাওয়া ইত্যাদির ব্যবস্থা অর্থাৎ উরস করা, নাবী (সাঃ) থেকে সাহাবা কিরাম (রাঃ) এবং সোনালী যুগ থেকে তার কোন প্রমাণ নেই। যদি তার প্রমাণ থাকত, তাহলে সে ব্যপারে সমালোচনা করার মত কারও অধিকার থাকত না। কেননা তারা যা করেছেন তাদের আনুগত্য করা এবং যা পরিহার করেছেন তা বর্জন করার নামই হলো দীন। আর তার বিপরীত করাই হলো বেদীন এবং লা-শরি'আত বা শরি'আত পরিপন্থী। (শরীয়ত ও প্রচলিত কুসংস্কার ৪৪ পৃঃ)


আল্লাহকে খুশী করার জন্য আল্লাহর নাবী (সাঃ) আমাদের যে সকল বিধান দিয়েছেন তা পালন করাই যথেষ্ট, নতুন করে কিছু আবিষ্কার করার অবকাশ কোথায়?

আল্লাহ পাক আমাদের সহীহ হাদীস অনুসারে চলার তৌফিক দান করুন। আমীন......

.