সোমবার, ২১ মে, ২০১২

আন্তঃধর্ম বিয়ে :সেকুলার প্রজন্ম গড়ার চূড়ান্ত মিশন!

আন্তঃধর্ম বিয়ে : সেকুলার প্রজন্ম গড়ার চূড়ান্ত মিশন!

মুহাম্মদ আমিনুল হক


‘বিশেষ বিবাহ আইন’ প্রণয়ন করে আন্ত:ধর্ম বিয়ে সম্পাদনের জন্য সম্প্রতি আইন মন্ত্রনালয় কর্তৃক বিশেষ কাজী নিয়োগ এবং ছেলে না থাকলে কন্যাসন্তানকে পুরো সম্পদের মালিক করে মুসলিম পারিবারিক আইন সংশোধনের উদ্যোগকে কেন্দ্র করে সারা বাংলাদেশে মিছিল-মিটিং, আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় বইছে। ধর্মপ্রাণ মানুষেরা কোনোভাবেই সরকারের এ উদ্যোগকে মেনে নিতে পারছে না। বিজ্ঞ আলেমদের মতে, সরকারের এই উদ্যোগ সরাসরি আল্লাহর আইনের বিরোধী যা কোনো মুসলিম মেনে নিতে পারে না।

জানা গেছে, এই আইন অনুযায়ী একজন মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি কিংবা অন্য যেকোনো ধর্মের যে কেউ কাউকে বিয়ে করতে পারবে। এজন্য পাত্র-পাত্রী কাউকেই ধর্মান্তরিত হতে হবে না। ধর্ম পরিবর্তন ছাড়াই তারা দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করতে পারবে। ইচ্ছে করলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে অথবা যেকোনো একজন নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস বাদ দিতে পারে। এ ধরনের বিয়ের মাধ্যমে জন্ম নেয়া সন্তানদের কোনো ধর্মীয় পরিচয় থাকবে না। বড় হয়ে তারা যেকোনো ধর্ম বেছে নিতে পারবে অথবা ধর্ম বিশ্বাস ছাড়াই জীবন যাপন করতে পারবে।

উপরোক্ত আইনটি পড়ে যে কেউ সহজেই বুঝতে পারে, এটি ১০০ ভাগ ইসলাম ধর্ম বিরোধী আইন। ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী মুসলিম ব্যক্তি কোনো অমুসলিমকে বিয়ে করতে পারে না। আল্লাহ বলেন, “আর তোমরা মুশরিক নারীদের বিয়ে করো না, যতন না তারা ঈমান গ্রহণ করে। অবশ্যই মুসলিম ক্রীতদাসী মুশরিক নারী থেকে উত্তম যদিও তাদেরকে তোমাদের কাছে ভালো লাগে। এবং তোমরা (নারীরা) কোনো মুশরিকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ো না, যে পর্যন্ত না সে ঈমান আনে। একজন মুসলমান ক্রীতদাসও একজন মুশরেকের তুলনায় অনেক ভালো, যদিও তোমরা তাদের দেখে মোহিত হও। তারা দোযখের দিকে আহ্বান করে, আর আল্লাহ নিজের হুকুমের মাধ্যমে আহ্বান করেন জান্নাত ও মার দিকে”(সূরা আল বাক্বারা:২২১)। আল-কুরআনের এই অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছে যে, বেঈমান মুশরিকের সাথে কোনো ঈমানদার মুসলিমের বিয়ে হতে পারে না। কেন পারে না তাও আল্লাহ পরিস্কার করে বলেছেন। তবে ইহুদী ও খ্রিস্টানগণ এই হুকুমের অন্তর্ভূক্ত হবে না। কেননা তারা আহলে কিতাব। আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে বলেন, “...তোমাদের জন্যে হালাল সতী সাধ্বী মুসলিম নারী এবং তাদের সতী সাধ্বী নারী, যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তোমাদের পূর্বে...”(সূরা আল মায়েদাহ:০৫)।

বর্তমান যুগের সেরা আলেমে দ্বীন আল্লামা ইউসুফ আল কারদাভী বলেন, আহলে কিতাবদের থেকে বিয়ে করা যাবে যদি নিম্নের শর্তগুলো পাওয়া যায়: এক. বাস্তবিকই আহলে কিতাব হতে হবে। শুধু নামে ইহুদী কিংবা খ্রিস্টান হলে চলবে না। নামে ইহুদী-খ্রিস্টান অথচ সে নাস্তিক কিংবা নিজ ধর্মকে বিশ্বাস করে না; তাহলে চলবে না। দুই. অবশ্যই তাকে পবিত্র হতে হবে। ব্যভিচারিনী হলে চলবে না। তিন. এমন কাউকে বিয়ে করা যাবে না যার জাতি পুরো মুসলিম উম্মতের সাথে ঘোর শত্রুতা পোষণ করে, যেমন- বর্তমান সময়ের ইসরাঈলের ইহুদীগণ। চার. বিয়ের কারণে স্বামীর সন্তানের কোনো বৈষয়িক ক্ষতি সাধিত হওয়ার আশংকা থাকলেও আহলে কিতাব বিয়ে করা যাবে না। বিজ্ঞ আলেমগণ মনে করেন, যদিওবা আহলে কিতাবদের বিয়ে করা যায় তারপরও তা মাকরূহ বা অপছন্দনীয়। কেননা এই বিয়েতে কোনো সুখ হয় না। মহিলা তার সৌন্দর্য ও উদ্ভট চলা-ফেরার মাধ্যমে সংসারে ফ্যাসাদ তৈরী করবে। সন্তানদের ভবিষ্যৎ হুমকির মধ্যে পড়বে এবং তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মায়ের ধর্মে ধাবিত হবে; যাতে ইসলামের কোনো ফায়দা নেই।

আন্ত:ধর্ম বিয়ের আইনটি যে পুরো জাতিকে সেকুলার জাতিতে পরিণত করার মানসে করা হয়েছে তা আইনটি একটু পড়লেই অনুমান করা যায়। বলা হয়েছে, ‘একজন মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি কিংবা অন্য যেকোনো ধর্মের যে কেউ কাউকে বিয়ে করতে পারবে। এজন্য পাত্র-পাত্রী কাউকেই ধর্মান্তরিত হতে হবে না। ধর্ম পরিবর্তন ছাড়াই তারা দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করতে পারবে’। আইনটির প্রতিটি লাইন সাংঘর্ষিক। আল্লাহ বলছেন একজন মুসলিম মুশরিককে বিয়ে করতে পারবে না আর আইন বলছে পারবে। আইন বলছে, ধর্ম ত্যাগ না করেই অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করা যাবে আর ইসলাম বলছে, এধরনের কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া যেখানে যেকোনো মুসলিম যেকোনো মুসলিম নারীকে যখন তখন বিয়ে করতে পারে না সেখানে কিভাবে অমুসলিমকে বিয়ে করা সম্ভব? ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো মুসলিম নর কিছু নারীকে তো আজীবন বিয়ে করতে পারে না, যেমন- মা, বোন, ভাগ্নি, খালা, নানী, নাতনি ইত্যাদি। কেউ কেউ সাময়িক সময়ের জন্য হারাম। তালাকপ্রাপ্তা নারীর ইদ্দত শেষ না হলে বিয়ে করা যায় না। দুই বোনকে একসাথে বিয়ে করা হারাম। স্বামী থেকে তালাক না নিয়ে অন্যত্র বিয়ে করাও অবৈধ। মহিলাদের মাসিক ও ঋতুস্রাব চলাকালীন সহবাস নিষিদ্ধ। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার মধ্যেও আছে নানান ধরনের শর্ত। এধরনের কঠোর বিধিমালা মেনে নিয়েই মুসলিম নর-নারী বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়। অন্যথা সে মুসলিম থাকতে পারে না। সেই মুসলিম কিভাবে অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করে নিজ ধর্মের ওপর অটল থাকতে পারে তা আমাদের বোধগম্য নয়। বিয়ে করার অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে নর-নারীর মানসিক শান্তি। সেই শান্তির জায়গায় যদি অশান্তি ভীড় করে তাহলে বিয়েতে ফায়দা কি? কুফুতে না মেলার কারণে যদি একই ধর্মের হয়েও চট্টগ্রামের মেয়ের সাথে সিলেটের ছেলের সাথে বিয়ে না হয়, তাহলে কিভাবে চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতা, ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে ভিন্নতর হয়ে নর-নারীর মধ্যে বিয়ে সম্ভব?

বিশেষ বিবাহ আইনটি কার্যকর হলে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হবে দু’ধর্ম পালনকারী স্বামী-স্ত্রীর সন্তানরা। মানসিকভাবে তারা বিকারগ্রস্থ হবে। মুসলিম বাবা বলবেন, আল্লাহ এক আর মা বলবেন আমি Trinity অথবা বহু খোদা’য় বিশ্বাস করি। মুসলিম বাবা যেটাকে বলবেন সত্য সেটাকেই অমুসলিম মা বলবেন অসত্য। মা বাবার এই বিপরীত অবস্থান থেকে সন্তানের মনে ঘৃণার জন্ম নেবে। ১৮ বছর যাবত সে ভোগতে থাকবে মানসিক ব্যধিতে। এছাড়া উত্তরাধিকার হয়ে মা বাবার সম্পত্তি ভোগ করতেও ঝামেলায় পড়তে হবে সন্তানকে। মোটকথা নৈরাজ্য ছাড়া উপায় নেই। গত ১৬ নভেম্বর’২০১১ দৈনিক আমার দেশে প্রকাশিত শাকিল ওয়াহেদের ‘সুলেমানের কোরবানী দেখা’ লেখাটি যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই একটু হলেও বুঝতে পেরেছেন যে দু’ধর্ম ওয়ালা মা বাবার সংসারে কী মানসিক যন্ত্রনায় দিন কাটছে সুলেমানের। ২০১১ সালের ৩০ জুলাই দৈনিক ইত্তেফাকেও বিষয়টি ফুটে উঠেছে। বলা হয়েছে, আন্ত:ধর্ম বিয়ের কারণে সমাজে গড়ে উঠছে নতুন আরেক জাতি; যাদের ধর্মীয় কোনো পরিচয় নেই। এ নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

সরকারের পক্ষ থেকে নাকি বলা হয়েছে, এই আইনটি ১৮৭২ সনের বৃটিশ আইন এবং মুসলমানের জন্য নয়, অন্য ধর্মের লোকদের জন্য। এটি আসলে ভাওতাবাজি। তা না হলে হঠাৎ করে দু’জন কাজী নিয়োগ করে বলা হচ্ছে কেন যে, সারাদেশেও প্রয়োজন হলে এ ধরনের কাজী নিয়োগ হবে। যেখানে বছরে দু-চারজন নিজ ধর্ম ছেড়ে অন্য ধর্ম গ্রহণ করে বিয়ে শাদী করছে সেখানে কাজী লাগে কয়জন? তাছাড়া ১৮৭২ সনের বৃটিশ আইন আমাদের রাখার দরকার কি? প্রতিনিয়ত সবকিছু উল্টাতে পারলে ওই আইন কেন বাদ দেয়া যাবে না?

সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর আস্থাকে বাদ দিয়ে সেকুলারিজমকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। সারাদেশে সেকুলার শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। পর্দার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। কুরআন বিরোধী নারী নীতিমালা পাশ করা হয়েছে। ইসলামপ্রিয় জনতা ও আলেম-ওলামাদের কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। এসব করা হয়েছে ইসলামের বিরুদ্ধে যায়, কুরআনের বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু করা হবে না ঘোষণা দিয়েই। এত্থেকে বোঝা যায় যে, সরকার পরিকল্পিতভাবেই তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। আর তা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জাতিকে ধর্মহীন করা। কেননা সেকুলার রাষ্ট্র কায়েম করতে হলে ধর্মকে সাগরে ছুড়ে ফেলতে হবে। সেকুলারিজমের সংজ্ঞাতেই যা অনুমেয়, Secular spirit or tendency especially a system of political or social philosophy that rejects all form of religious faith. অর্থাৎ- ‘সেক্যুলারিজম হচ্ছে এমন একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক দর্শন যা সকল ধর্ম বিশ্বাসকেই প্রত্যাখ্যান করে’। অতএব ধর্মকে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ থেকে বিদায় করতেই হবে, বিশেষ করে ইসলামকে।

আন্ত:ধর্ম বিয়ের পরিণতি হবে ভয়াবহ। এদেশে কোনো ধর্ম আর টিকে থাকবে না। সবচেয়ে বড় আঘাত আসবে হিন্দু এবং ইসলাম ধর্মের ওপর। আগে দেখা যেত, কেউ নিজের ধর্ম ব্যতিত অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাইলে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে বিয়ে করতে হতো বিধায় সহজে কেউ ওপথে হাটতো না। এখন বিষয়টি সহজ হয়ে যাবে। ধর্ম ত্যাগ না করেই যুবক যুবতীরা তাদের রঙ্গলীলা সাঙ্গ করতে নেমে পড়বে। প্রত্যেক ধর্মের স্বকীয়তা আর থাকবে না। যার ফল দাঁড়াবে অদূর ভবিষ্যতে গোটা সমাজ ব্যবস্থাই ধর্মহীন হয়ে পড়বে। জন্ম নেবে জারজ সন্তান। একদিন জারজ সন্তানে দেশ ভরে যাবে। ধর্মের আর দাম রইবে না। আরিক অর্থে নয়, বাস্তবিকই রক্ত-মাংসে সেকুলার রাষ্ট্রে পরিণত হবে বাংলাদেশ! আর তা যদি পুরোপুরি নাও হয় সামাজিক বিশৃংখলা যে দেখা দেবে তা তো হলফ করেই বলা যায়।

বিবাহ একটি সামাজিক প্রথা। তাই বলে আমার ইচ্ছে মতো এই প্রথাকে পরিবর্তন করতে পারব না। ইসলাম ধর্ম মানুষের সকল কিছুকে অন্তর্ভূক্ত করেছে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কেমন হবে, দিয়েছে তার গাইড লাইন। এই গাইড লাইন আল্লাহ প্রদত্ত বিধায় এর মধ্যে কোনো গলদ নেই। সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিবাহের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনার বিকল্প নেই। এর বাইরে যাওয়ার চেষ্টা মানেই নিজেদের ধ্বংস নিজেরা ডেকে আনা। ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম দিয়ে বল্গাহীনভাবে কিছু করার স্বাধীনতা ইসলামে নেই। যারা নিজের স্বাধীনতা দিয়ে অন্যের ধর্ম, সম্মান, রীতি-নীতি ও স্বাধীনতাকে নষ্ট করে তারা মানবতার শত্রু। আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দিন। আমীন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।
ই-মেইল: aminulhoque_iiuc@yahoo.com
http://www.sonarbangladesh.com/articles/MuhammadAminulHaque

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন