সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

চট্টগ্রাম নামের উৎস ৪৮টি

চট্টগ্রাম নামের উৎস
বৈচিত্রময়ী চট্টগ্রামের নামও বৈচিত্রে ভরা। খ্রিষ্টীয় দশক শতকের আগে চট্টগ্রাম নামের অস্তিত্ব ছিল না। অর্থাৎ চট্টগ্রাম নামের কোন উৎসের সন্ধান পাওয়া যায় না। তাই দেখা যায় যে, সুপ্রাচীনকাল থেকে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পরিব্রাজক, ভৌগোলিক এবং পন্ডিতগণের লিখিত বিবরণে, অঙ্কিত মানচিত্রে, এখানকার শাসক গৌড়ের সুলতান ও রাজাদের মুদ্রায় চট্টগ্রামকে বহু নামে খ্যাত করেছিলেন। এ পর্যন্ত চট্টগ্রামের ৪৮টি নাম পাওয়া গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‌‌-সুহ্মদেশ, ক্লীং, রম্যভূমি, চাতগাঁও, চট্টল, চৈত্যগ্রাম, সপ্তগ্রাম, চট্টলা, চক্রশালা, শ্রীচট্টল, চাটিগাঁ, পুস্পপুর, চিতাগঞ্জ, চাটিগ্রাম ইত্যাদি।[৫] কিন্তু কোন নামের সঙ্গে পাঁচজন একমত হন না। সে সব নাম থেকে চট্টগ্রামের নাম উৎপত্তির সম্ভাব্য ও চট্টগ্রামের নামের সঙ্গে ধ্বনিমিলযুক্ত তেরটি নামের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো।[৬]
  • চৈত্যগ্রাম: চট্টগ্রামের বাঙালি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অভিমত এই যে, প্রাচীনকালে এখানে অসংখ্য বৌদ্ধ চৈত্য অবস্থিত ছিল বলে এ স্থানের নাম হয় চৈত্যগ্রাম। চৈত্য অর্থ বৌদ্ধমন্দির কেয়াং বা বিহার। এই চৈত্যের সঙ্গে গ্রাম শব্দ যুক্ত হয় বলে চৈত্যগ্রাম নামের উদ্ভব হয়। পরবর্তীকালে চৈত্যগ্রাম নাম বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম রূপ প্রাপ্ত হয়।
  • চতুঃগ্রাম: ব্রিটিশ আমলের গেজেটিয়ার লেখক ও'মলি সাহেবের মতে, সংস্কৃত চতুঃগ্রাম শব্দ থেকে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি। চতুঃ অর্থ চার। চতুঃ শব্দের সঙ্গে গ্রাম শব্দ যুক্ত হয়ে চতুঃগ্রাম হয়। চতুঃগ্রাম বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম রূপ প্রাপ্ত হয়।
  • চট্টল: চট্টগ্রামের তান্ত্রিক ও পৌরাণিক নাম ছিল চট্টল। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন তন্ত্র ও পুরাণগ্রন্থে চট্টল নামের উল্লেখ দেখা যায়।
দেবী পুরাণ চন্ডিকা খন্ডেঃ
বিন্ধ্য পর্বতমারভ্য বিন্ধ্যাচলাবধি প্রিয়ে,
অশ্বাক্রান্তেতি বিখ্যাতং বিষ্ণুলোকেষু দুর্লভং,
বিন্দু পর্বত মারভ্য যাবৎ চট্টল বাসিনী,
চুড়ামণি তন্ত্রেঃ
চট্টলে দক্ষ বাহুর্যে ভৈরবচন্দ্র শেখরঃ,
ব্যক্ত রূপা ভগবতী ভবানীতন্ত্র দেবতা।
বারাহী তন্ত্রেঃ
চট্টলে দক্ষিণোবাহু ভৈরবচন্দ্র শেখরঃ,
সস্যৈব কতিদেশস্থো বিরূপাক্ষ মহেশ্বর।
কলৌস্থানঞ্চ সর্ব্বোষাৎ দেষানাৎ চট্টল শুভে।
যোগিনী তন্ত্রেঃ
সাদ্ধ ত্রিকোটি দেবানাৎ বসতিশ্চৎ চট্টল শুভে।
ত্রিপুরার রাজমালাঃ
গ্রন্থকারের মতে প্রাচীনকালে এখানে চট্টভট্ট নামক কুলীন ব্রাহ্মণ জাতির নিবাস ছিল বলে এই স্থানের নামকরণ হয়েছিল চট্টল।
  • শ্যাৎগাঙ্গ: বার্ণোলী সাহেবের মতে আরবি শ্যাৎগাঙ্গ শব্দ বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম নামের উদ্ভব হয়েছে। শ্যাৎ অর্থ বদ্বীপ, গাঙ্গ অর্থ গঙ্গানদী। চট্টগ্রাম গঙ্গানদীর মোহনাস্থিত বদ্বীপ- প্রাচীন আরব বণিক-নাবিকদের এই ধারণা থেকে এর নামকরণ করা হয়েছিল শ্যাৎগাঙ্গ। পরবর্তীকালে শ্যাৎগাঙ্গ নাম বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি।
  • চিৎ-তৌৎ-গৌং: খ্রিষ্টীয় দশম শতকের মধ্যবর্তীকাল অবধি ফেনী নদীর দক্ষিণ তীর থেকে নাফ নদীর উত্তর তীরের মধ্যবর্তী ভূভাগটির চট্টগ্রাম নাম প্রচলিত ছিল না। তখন এই ভূরাজ্যটি আরাকানরাজ্যভূক্ত ছিল। তৎকালীন আরাকানরাজ সুলতইং চন্দ্র ৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে নিজ অধিকৃত রাজ্যাংশের উক্ত ভূভাগের বিদ্রোহী 'সুরতন'কে ( সুলতানকে ) দমন করতে এসে সসৈন্য আধুনিক সীতাকুন্ড থানার কুমিরার কাউনিয়া ছড়ার দক্ষিণ তীর অবধি অগ্রসর হন এবং সেখানে একটি পাথরের বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করে তাতে চিৎ-তৌৎ-গৌং (যুদ্ধ করা অনুচিত) বাণী উৎকীর্ণ করে স্বদেশে ফিরে যান। তখন থেকে এই ভূভাগটি চিৎ-তৌৎ-গৌং নামে খ্যাত হয়। আরাকানের প্রাচীন রাজাদের ইতিহাস রাজোয়াং সূত্রে এ তথ্য জানা যায়। কালক্রমে চিৎ-তৌৎ-গৌং নাম বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম নামের উদ্ভব হয়।
  • চাটিগ্রাম: সম্ভবত রাজোয়াং বর্ণিত উপরোক্ত চিৎ-তৌৎ-গৌং নামটি মধ্যযুগে বিবর্তিত ও সংস্কৃতায়িত হয়ে চাটিগ্রাম রূপ প্রাপ্ত হয়। গৌড়ের রাজা গণেশ দনুজমর্দন দেবের ১৩৩৯-১৩৪০ শকাব্দে ও রাজা মহেন্দ্র দেবের ১৩৪০ শকাব্দে চট্টগ্রামে তৈরি মুদ্রায় টাকশালের নাম চাটিগ্রাম উল্লেখ দেখা যায়। বাংলার সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্‌ ( ১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি. ) ও সৈয়দ নাসির উদ্দিন নশরত শাহ্‌র আমলে (১৫১৯-১৫৩২ খ্রি.) কবীন্দ্র পরমেশ্বর বিরচিত পরাগলী মহাভারতে এবং বৈষ্ণব সাহিত্য চৈতন্য-ভাগবত প্রভৃতিতে চাটিগ্রাম নামের উল্লেখ রয়েছে।
  • চাটিগাঁ: চট্টগ্রামের মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত জনশ্রুতি থেকে জানা যায় যে, প্রাচীনকালে চট্টগ্রাম ছিল জ্বীনপরী অধ্যুষিত দেশ। পীর বদর শাহ্‌ এখানে আগমন করে অলৌকিক চাটির (মৃৎ-প্রদীপ) আলোর তেজের সাহায্যে জ্বীনপরী বিতাড়িত করার ফলে এই স্থানের নাম হয় চাটিগাঁ।
  • চতকাঁও/চাটগাঁও: চাটিগাঁর ফারসি রূপ চতকাঁও বা চাটগাঁও। বাংলার সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ্‌র (১৩৮৯-১৪০৯ খ্রি.) ও সুলতান জালালুদ্দিন মোহাম্মদ শাহ্‌র (১৪১৮-১৪৩২ খ্রি.) মুদ্রায় চতকাঁও টাকশালের নাম উৎকীর্ণ দেখা যায়। ১৩৯৭ খ্রিস্টাব্দে লিখিত সুবিখ্যাত সুফি সাধক মুজাফফর শামস বলখির চিঠিতে চাটগাঁও নামের উল্লেখ দেখা যায়।
  • সুদকাওয়ান: আফ্রিকা মহাদেশের অন্তর্গত মরক্কোর অধিবাসী ইবনে বতুতা ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে বঙ্গ ও আসাম পরিভ্রমণ করেন। তিনি তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে চট্টগ্রামকে সুদকাওয়ান নামে উল্লেখ করেন।
  • চাটিকিয়াং: চীন দেশ থেকে ১৪০৯, ১৪১২, ১৪১৫, ১৪২২ বা ১৪২৩, ১৪২৯ ও ১৪৩২ খ্রিস্টাব্দে মোট সাতবার বাংলার সুলতানদের দরবারে রাজদূত প্রেরিত হয়েছিল। তাদের লিখিত বিবরণে চট্টগ্রামকে চাটিকিয়াং রূপে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
  • শাতজাম: তুর্কি সুলতান সোলায়মানের রেডফ্লিটের ক্যাপ্টেন সিদি আলী চেহেলভি ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে জাহাজযোগে ভারত মহাসাগরীয় দেশসমূহ পরিভ্রমণ করেন। এবং এ সময় তিনি আরাকান থেকে চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূল হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আগমন করেন। তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে চট্টগ্রামের নাম শাতজাম নামে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
  • চার্টিগান: পরিব্রাজক রালফ ফিচ ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম পরিভ্রমণ করেন। তাঁর লিখিত ভ্রমণকাহিনীতে চট্টগ্রামের নাম চার্টিগান রূপে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
  • জেটিগা: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে ফ্যান্ডেন ব্রুক অঙ্কিত মানচিত্রে চট্টগ্রামের নাম জেটিগা রূপে লিখিত 
http://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%9A%E0%A6%9F%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%B0_%E0%A6%87%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B8 



 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন