বুধবার, ২০ আগস্ট, ২০১৪

নিমগাছ. ‘জিয়া ট্রি’ ‘জিয়া সাজারাহ’। আরাফাত ময়দানে . একুশ শতকের বৃক্ষ।

নিম এক সময় ভারতবর্ষের ঐতিহ্য ছিল। ছিল অকৃত্রিম সম্পদ। হালে তা বিনষ্ট হতে চলেছে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং ইরানের দক্ষিণাঞ্চলে নিমগাছ জন্মে। আফ্রিকার কোথাও কোথাও নিম জাতীয় গাছ দেখা যায়। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু কিছু স্থানে নিমগাছ আছে। হজের মৌসুমে হাজীরা দিনে মক্কার কাছে আরাফাত ময়দানে অবস্থান করেছেন। বিশাল আরাফাত ময়দানে কয়েক লাখ নিমগাছ শোভা পাচ্ছে। ওইসব নিমগাছ বাংলাদেশ থেকে গিয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সৌদি সরকারকে ওই নিমগাছ উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। ওই গাছগুলো দিন দিন বড় হচ্ছে। এক সময় দিগন্তজোড়া আরাফাত ময়দান বাংলাদেশী নিমগাছে ছেয়ে যাবে। ধূসর মরু সবুজে সতেজ হবে। আরাফাত ময়দানে এখন মশা দেখা যায়। ধারণা করা হচ্ছে নিমগাছের প্রভাবে মশা-মাছি এক সময় আর থাকবে না। শুষ্ক এলাকায় নিমগাছ জন্মে, যেখানে তাপমাত্রা ২০-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থাকে। তবে ৩ ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা হলে সেখানে এ গাছ বাঁচে না। আরাফাত ময়দানে শুষ্ক মরুভূমিতে নিমগাছকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পানির টেপ আছে ময়দানজুড়ে। সপ্তাহের বিভিন্ন সময় ওই টেপ দিয়ে গাছে পানি দেয়া হয়। এ জন্য কোনো লোকের প্রয়োজন হয় না। কেবল পাম্প চালানোর জন্য লোক লাগে। সৌদি সরকার ওই গাছগুলোর অনেক যত্ন নেয়। দুর্ভাগ্য, যে দেশ থেকে ওই গাছগুলো গেল, সে দেশেই নিমের কদর নেই। আমরা যতটা যত্নবান একটা ফলদ গাছ অর্থাত্ আম ও কাঁঠাল গাছের প্রতি, ততটা যত্নবান নই ঔষধি গাছের প্রতি। অথচ একটা নিমগাছ থেকে অনেক দিক দিয়ে লাভবান হওয়া যায়। নিমগাছের কাঠ দিয়ে শুধু লাকড়ি হয় না। পূর্ণ বয়স্ক নিমগাছের কাঠ দিয়ে মূল্যবান আসবাবপত্র প্রস্তুত করা যায়। নিম কাঠের আসবাবপত্র কখনও পোকায় কাটে না বা ঘুণে ধরে না। উই পোকায় খেতে পারে না।


গাছ জীবনের বন্ধু। গাছ জীবনের প্রতীক। নিমগাছ মানুষের বন্ধু। ঔষধি বৃক্ষ হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে এর সুপরিচিতি থাকলেও আজকাল এ গাছের উত্পাদন কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে বসতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গাছ কাটা হচ্ছে। নতুন করে নিমের চারা লাগানো হচ্ছে না। অথচ এক সময় গ্রাম্য ঔষধালয়খ্যাত নিমগাছ গ্রামগঞ্জে প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় শোভা পেত। নানা রোগের নিরাময়ের জন্য এ গাছকে ওষুধের ভাণ্ডারও বলা হয়। কীটনাশক, মশা-মাছি বিতারক হিসেবে এর পরিচিতি রয়েছে। সৌন্দর্যচর্চায় নিমের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। নিম পেস্ট প্রসাধনী হিসেবে আজকাল শহুরে বিউটি পার্লারের যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কীটনাশক ও প্রাকৃতিক সার হিসেবে নিমপাতা কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়। অর্গেনিক ফুড, অর্গেনিক ভেজিটেবল, অর্গেনিক টি ইত্যাদি চাষাবাদে নিম কার্যকর। চর্মরোগের মহৌষধরূপে নিমপাতা পানিতে সিদ্ধ করে ব্যবহার করা হয়। কচি নিমপাতা তেলে ভেজে ভাতের সঙ্গে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এতে রক্ত পরিশুদ্ধ হয়। বাড়ির আঙিনায় নিমগাছ থাকলে পোকামাকড় ও মশা-মাছির উপদ্রব কম হয়। নিম থেকে টুথ পেস্ট তৈরি হয়। নিমগাছের ডাল দিয়ে প্রস্তুত দাঁতের মিসওয়াক এক সময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। নিমগাছের বাঁকল, বীজ এবং ফল থেকে নিমের তেল প্রস্তুত করা হয়, যা অনেক কাজে ব্যবহার করা হয়। তবে নিম তেল খাবার জন্য ব্যবহৃত হয় না। এই তেল দিয়ে প্রসাধনী, সাবান, সেম্পু, ক্রিম ও মলম তৈরি করা হয়। টুথ পেস্টেও এই তেল ব্যবহৃত হয়। কারও কারও মতে, নিমগাছ বাতাস থেকে অধিক পরিমাণে কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে বাতাসকে পরিশুদ্ধ করে।





অনুসন্ধানে জানা গেল, সালটা ছিল ১৯৭৭ ইংরেজি। বাদশাহ ফাহদের আমন্ত্রণে সৌদি আরব যান বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। আর উপহার হিসেবে সাথে নিয়ে যান বেশ কিছু নিমগাছের চারা।

বাদশাহকে উপহার দেয়ার সময় বলেন, গরিব মানুষের দেশের গরিব রাষ্ট্রপতির পkko থেকে আপনার জন্য এই সামান্য উপহার। বাদশাহ ফাহদ বহু দেশ থেকে বহু মূল্যবান উপহার পেয়েছেন; কিন্তু এমন মূল্যবান উপহার আর পাননি। আবেগে আপ্লুত বাদশাহ জড়িয়ে ধরেন রাষ্ট্রপতি জিয়াকে।

তিনি বলেন, আজ থেকে সৌদি আরব ও বাংলাদেশ পরস্পর অকৃত্রিম বন্ধু। তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নে অর্থ সাহায্য দিতে চান। জিয়াউর রহমান এ সময় বলেন, আমাদের দেশের মানুষ গরিব, কিন্তু তারা পরিশ্রম করতে জানে। আপনার দেশের উন্নয়ন কাজের জন্য হাজার হাজার শ্রমিক দরকার। একটি নব্য স্বাধীন মুসলিম দেশের জন্য যদি আন্তরিকভাবে সাহায্য করতে চান, তবে আমার দেশের বেকার মানুষদের কাজ দিন। বাদশাহ ফাহদ রাজি হলেন। উন্মোচিত হলো এক নতুন দিগন্ত।

আর জিয়ার দেয়া সেই নিমের চারাগুলো আজ মহীরূহ ! ছড়িয়ে পড়েছে পুরো সৌদি আরবে। মরুভূমিতে যেন টিকে গেছে বাংলাদেশের স্মৃতি উঁচু করে। আরাফাতের ময়দানে সবুজ শীতল ছায়া দিয়ে চলেছে অসংখ্য নিমগাছ। সৌদি আরবে এখন এসব গাছকে সবাই চেনে ‘জিয়া ট্রি’ হিসেবেই। আরবিতে কেউ কেউ বলেনÑ‘জিয়া সাজারাহ’।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৌদি সরকার যখন দেখল খেজুরগাছ নয়, নিমগাছই মরুভূমিতে শীতল ছায়া ছড়ানোর উপযোগী। এ গাছ কম পানিতে দীর্ঘ দিন টিকে থাকতে পারে, গাছের পাতায় প্রচুর পানি ধরে রাখে। বৃষ্টির জন্যও নিমগাছ যথেষ্ট সহায়ক। দেখা গেছে, যে এলাকায় নিমগাছ আছে সেখানে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হচ্ছে এবং মানুষের অসুখ-বিসুখও কম হচ্ছে। তখন তারা ব্যাপকভাবে নিমের চারা রোপণের কাজে হাত দেন। ১৯৮৩-৮৪ সালে সৌদি সরকার সর্বপ্রথম আরাফাত ময়দানে ব্যাপকভাবে নিমের চারা রোপণ করে। আরাফাত ময়দানে আজ তাই হাজার হাজার নিমগাছ। হাজীরা এই নিমগাছের শীতল ছায়ায় হজ পালন করেন। প্রচণ্ড গরমে নিমগাছের বাতাস তাদের প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। আরাফাতের ময়দানের জাবালে রহমতে (রহমতের পাহাড়) উঠে চার দিকে তাকালে দেখা যায়, পাহাড়ঘেরা বিশাল এলাকাজুড়ে শুধু নিমগাছ আর নিমগাছ।

‘এগুলো বাংলাদেশের গাছ, জানেন? আমাদের জিয়াউর রহমান এই গাছ সৌদি সরকারকে উপহার দিয়েছিলেন।’  হাজীদের জন্য এই নিমগাছ রহমত। নিমগাছের কারণে এই আরাফাতের ময়দানে গরমও কম।

সারা বছরই এসব গাছের সেবা করার জন্য লোক রাখা আছে। গাছের গোড়ায় নিয়মিত পানি দেয়া হয়। ডালপালা ছেঁটে দেয়া হয়। পোকামাকড় থেকে মুক্ত রাখতে ছিটানো হয় কীটনাশক। সৌদি নাগরিক ও হাজীরা নিমগাছের ডালকে দাঁত মাজার মেসওয়াক হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেন।


সৌদি আরবে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সভাপতি, বিএনপি নেতা আবদুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, জিয়া ট্রির জন্য আমরা গর্বিত। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিমগাছ উপহার হিসেবে দিয়ে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে গেছেন।

শুধু আরাফাত ময়দানে নয়, নিমগাছ এখন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো সৌদি আরবেই। জেদ্দায় বিশাল আকৃতির মোটা এক নিমগাছ দেখে রীতিমতো বিস্ময় জাগে। বাংলাদেশেও এত বড় নিমগাছ খুব একটা দেখা যায় না।

নিমগাছ : নিম একটি ঔষধি গাছ, (বৈজ্ঞানিক নাম : AZADIRACHTA INDICA)। এর ডাল, পাতা, রস, সবই কাজে লাগে। নিম একটি শতায়ু ও চির হরিৎ বৃ। এই গাছ ৪০-৫০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। এর কাণ্ড ২০-৩০ ইঞ্চি ব্যাস হতে পারে। ডালের চার দিকে ১০-১২ ইঞ্চি যৌগিকপত্র জন্মে। পাতা কাস্তের মতো বাঁকানো থাকে এবং পাতায় ১০-১৭টি করে কিনারা খাঁজকাটা পত্রক থাকে। পাতা ২ দশমিক ৫-৪ ইঞ্চি লম্বা হয়। নিমগাছে একধরনের ফল হয়। আঙুরের মতো দেখতে এ ফলের একটিই বিচি থাকে। জুন-জুলাইতে ফল পাকে, ফল তেতো স্বাদের। বাংলাদেশের সর্বত্রই জন্মে নিমগাছ। প্রাপ্তবয়স্ক হতে সময় লাগে ১০ বছর। নিমগাছ সাধারণত উষ্ণ আবহাওয়া অঞ্চলে ভালো হয়। নিমের পাতা থেকে আজকাল প্রসাধনীও তৈরি হচ্ছে। কৃমিনাশক হিসেবে নিমের রস খুবই কার্যকর। নিমের কাঠ খুবই শক্ত। এ কাঠে কখনো ঘুন ধরে না। পোকা বাসা বাঁধে না। এ কারণে নিম কাঠের আসবাবপত্রও তৈরি হচ্ছে আজকাল। এ ছাড়া প্রাচীনকাল থেকেই বাদ্যযন্ত্র বানানোর জন্য এ কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। নিমের

নানাবিধ গুণাগুণের কথা বিবেচনা করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই গাছকে

‘একুশ শতকের বৃ’ বলে ঘোষণা করেছে।

নিমের প্রসারের জন্য সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি করা আবশ্যক। দেশের সব পাঠশালা, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যান্য গাছের সঙ্গে সঙ্গে নিমগাছ লাগানো যায়। নিমগাছের খুব একটা পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। সুস্থ জীবনের লক্ষ্যে নিমগাছ হোক আমাদের পরম বন্ধু, আমাদের নিত্য সহচর। নিম হোক একুশ শতকের বৃক্ষ।

sonkolito

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন