মৃত ব্যক্তির নামে কোরবানি দেওয়া যাবে কি যাবে না?
প্রশ্ন : আমার পিতা গত বছর ইন্তেকাল করেছেন। আমি তার নামে কোরবানি করার নিয়ত করেছি। প্রশ্ন হল, মৃত ব্যক্তির নামে দেওয়া কোরবানির গোশত কী করতে হবে? তার অংশের পুরো গোশতই কি সদকা করতে হবে, নাকি নিজেরাও তা খেতে পারব?
উত্তর : মূলত কোরবানি যথাসময়ে জীবিত ব্যক্তির তরফ থেকেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। অবশ্য ইচ্ছা করলে তার সওয়াবে জীবিত অথবা মৃত আত্মীয়-স্বজনকেও শরীক করতে পারে। যেহেতু আমরা দেখি রাসূলুল্লাহ [সা.] ও তাঁর সাহাবাগণ নিজেদের এবং পরিবার-পরিজনদের তরফ থেকে কোরবানি করতেন। অনেকের ধারণা কোরবানি শুধু মৃত ব্যক্তিদের জন্য বা তাদের পক্ষ থেকে করা হবে। এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। মৃত ব্যক্তির তরফ থেকে পৃথক কোরবানি করার কোন দলীল নেই। তবে মৃত ব্যক্তিদের জন্য কোরবানি করা জায়েয ও একটি সওয়াবের কাজ। কোরবানি একটি সাদকা। আর মৃত ব্যক্তির নামে যেমন সদকা করা যায় তেমনি তার নামে কোরবানিও দেয়া যায়। মৃতব্যক্তি এর দ্বারা উপকৃত হবে, ইনশাআল্লাহ।
মৃত ব্যক্তি যদি কোরবানির জন্য ওসিয়ত না করে থাকে তবে তার পক্ষ থেকে দেওয়া কোরবানির গোশতের হুকুম সাধারণ কোরবানির মতো; নিজেরাও খেতে পারবে অন্যদেরকেও দিতে পারবে। পুরোটা সদকা করা জরুরি নয়। তবে মৃত ব্যক্তি যদি অসিয়ত করে যায় এবং তার সম্পদ দ্বারাই কোরবানি করা হয়ে থাকে তাহলে এ কোরবানির পুরো গোশত সদকা করা জরুরি। এ থেকে নিজেদের খাওয়া জায়েয হবে না। [ফাতাওয়া বাযযাযিয়া ৬/২৯৫; আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৭৩; ফাতাওয়া খানিয়া ৩/৩৫২; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩৩৫]
তবে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, একটি কোরবানিকে নিজের তরফ থেকে না দিয়ে কেবলমাত্র মৃতের জন্য নির্দিষ্ট করা ঠিক নয় এবং এতে আল্লাহ তাআলার সীমাহীন করুণা থেকে বঞ্চিত হওয়া উচিত নয়। বরং উচিত হচ্ছে, নিজের নামের সাথে জীবিত-মৃত অন্যান্য আত্মীয়-পরিজনকে কোরবানির নিয়তে শামিল করা। যেমন- আল্লাহর নবী (সা.) কোরবানি জবেহ করার সময় বলেছেন, হে আল্লাহ! এ (কোরবানি) মুহাম্মাদের তরফ থেকে এবং মুহাম্মাদের বংশধরের তরফ থেকে। সুতরাং তিনি নিজের নাম প্রথমে নিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে বংশধরদেরকেও তার সওয়াবে শরীক করেছেন।
কোরবানির গরুতে আকিকা দেওয়া যাবে নাকি যাবে না?
প্রশ্ন : জুমআর বয়ানে খতীবসাহেব বললেন, ‘অনেকে কুরবানীর সাথে আকীকার অংশ দিয়ে থাকেন এভাবে করা জায়েয নয়। কুরবানির সাথে আকীকার অংশ দিলে আকিকা আদায় হবে না।’ সঠিক মাসআলাটি জানতে চাই!
উত্তর : কুরবানি ও আকীকা আলাদাভাবেই করা উচিৎ। তবে একত্রে করলে আদায় হবে না তা নয়। একত্রে করলেও কুরবানী-আকীকা দুটোই আদায় হবে। কারণ আকীকাও এক ধরনের কুরবানী। হাদীস শরীফে আকীকার উপরও ‘নুসুক’ শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। আর এখানে ‘নুসুক’ অর্থ কুরবানী। হাদীসের আরবী পাঠ এই-
سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن العقيقة، فقال : لا أحب العقوق كأنه كره الاسم، قالوا يا رسول الله! نسألك عن أحدنا يولد له، فقال : من أحب منكم أن ينسك عن ولده فليفعل، على الغلام شاتان مكافأتان، وعلى الجارية شاة.
[দ্র. আলমুসান্নাফ, আব্দুর রাযযাক : ৭৯৬১; আলমুসনাদ, আহমদ : ৬৭১৩, ৬৭২২; আসসুনান, আবু দাউদ (আকীকা অধ্যায়)২৮৪২; আস-সুনান, নাসায়ী : ৭/১৬২, ১৬৩; আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা ১২/৩২৪ হাদীস : ২৪৭২৭; আলমুসতাদরাক,হাকিম, ৫/৩৩৭, হাদীস : ৭৬৬৬]
سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن العقيقة، فقال : لا يحب الله العقوق، من ولد له منكم ولد فأحب أن ينسك عنه فليفعل.
[দ্র. আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা ১২/৩২১, হাদীস : ২৪৭২২; আলমুয়াত্তা, ইমাম মালিক, আকীকা অধ্যায়, হাদীস : ৬৫৮]
আকীকাও যখন এক প্রকারের কোরবানী তখন একটি গরু বা উট দ্বারা একাধিক ব্যক্তির (সাত জন পর্যন্ত) আলাদা-আলাদা কুরবানী আদায় হওয়ার হাদীসগুলো থেকে কুরবানী-আকীকা একত্রে আদায়েরঅবকাশও প্রমাণিত হয়। এটা শরীয়তের পক্ষ হতে প্রশস্ততা যে, গরু বা উটের ক্ষেত্রে একটি‘জবাই’ সাত জনের সাতটি জবাইয়ের স্থালাভিষিক্ত গণ্য হয়। একারণে একটি উট বা গরু সাতজনের পক্ষে যথেষ্ট হয়। সহীহ মুসলিমে সাহাবী জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমরা হজ্বের ইহরামবেঁধে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বের হলাম। তিনি আমাদেরকেআদেশ করলেন যেন প্রত্যেক উট ও গরুতে সাতজন করে শরীক হয়ে কুরবানী করি।’ [সহীহমুসলিম, কিতাবুল হজ্ব, হাদীস : ১৩১৮/৩৫১]
خرجنا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم مهلين بالحج، فأمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم أن نشترك في الإبل والبقر، كل سبعة منا في بدنة.
অন্য বর্ণনায় আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘(একটি) গরু সাতজনের পক্ষহতে এবং (একটি) উট সাতজনের পক্ষ হতে (কুরবানী করা যাবে)।’
البقرة عن سبعة والجزور عن سبعة.
[আস-সুনান, আবু দাউদ, হাদীস : ২৮০১, কিতাবুল আযাহী]
সারকথা, ‘নুসুক’ বা কুরবানীর ক্ষেত্রে শরীয়তের প্রতিষ্ঠিত মূলনীতি এই যে, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বারক্ষেত্রে একটি ‘জবাই’ (إراقة الدم) দ্বারা একটি কুরবানী আদায় হলেও উট ও গরুর ক্ষেত্রে একটি‘জবাই’ দ্বারা সাতটি কুরবানী আদায় হতে পারে। অর্থাৎ এখানে ‘জবাইয়ে শরীক হওয়া’ও (সর্বোচ্চসাত জনের) কুরবানী আদায়ের পক্ষে যথেষ্ট। আকীকাও যেহেতু ‘নুসুক’ বা কুরবানী তাই এ মূলনীতিতে আকীকাও শামিল থাকবে। সুতরাং ‘একটি পশু জবাই’ করা দ্বারা যেমন তা আদায় হবে, তেমনি নির্ধারিত নিয়মে ‘জবাইয়ে শরীক হওয়ার’ (شركة في دم) দ্বারাও তা আদায় হবে।
সুতরাং এ প্রশ্নের অবকাশ নেই যে, ‘আকীকায় তো পশু জবাই করতে বলা হয়েছে। অতএব অন্ততএকটি পশু জবাইয়ের দ্বারাই তা আদায় হতে পারে।’ কারণ শরীয়তের দৃষ্টিতে পশু জবাই (إراقة الدم)-এর দায়িত্ব যেমন একটি পশু জবাই করার দ্বারা আদায় হয় তেমনি নির্ধারিত পশুতে ‘শরীকহওয়ার’ দ্বারাও (شركة في دم) আদায় হয়। আকীকার ক্ষেত্রে এই মূলনীতি প্রযোজ্য নয় বলে দাবি করলে ব্যতিক্রমের বিধান সম্বলিত দলীল লাগবে। আমাদের জানামতে এমন কোনো দলীল নেই।
গ্রন্থনা ও সম্পাদনা : মাওলানা মিরাজ রহমান
সৌজন্যে : মাসিক আল-কাউসার