ভোটের ৪ টি অর্থ বা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রয়েছে
সারাদেশে কয়েক ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চলছে৷ এ নির্বাচনকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও বলা হয়৷ ইউনিয়ন পরিষদ ব্যবস্থায় নির্বাচন একটি অপরিহার্য বিষয়৷ নির্বাচনে রাষ্ট্রের নাগরিকগণ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে বাছাই করার সুযোগ পায়৷ বর্তমানে প্রার্থীর দৃষ্টিতে ভোট হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়ার মোক্ষম হাতিয়ার৷
প্রার্থী মনে করে ভোট হচ্ছে ভিআইপি মর্যাদা অর্জন করা, টেন্ডারবাজি করা, আধিপত্য অর্জন করা এবং জনগণের উপর শোষণের ক্ষমতা অর্জন করার একটি শ্রেষ্ঠ মাধ্যম৷ আর অনেক ভোটার মনে করে ভোট মানে প্রার্থী থেকে কিছু টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়া৷ তবে সাধারণত এলাকার উন্নয়ন যাকে দিয়ে বেশি হবে বলে মনে করে ভোটাররা তাকেই ভোট দিয়ে থাকে৷ অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে এই ভোটের গুরুত্ব অপরিসীম৷ ইসলামে কাউকে ভোট দেওয়ার অর্থ সুদূর প্রসারী৷
ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিটি ভোট ৪টি অর্থ
প্রদান করে৷
১. সাক্ষ্য প্রদান করা ২. সুপারিশ করা ৩. প্রতিনিধি নিয়োগ করা ও ৪. আমানত তার প্রাপকের কাছে পৌঁছে দেওয়া৷
শরীয়তে উপরোক্ত বিষয়গুলোর গুরুত্ব খুবই বেশি৷ ভোটার কোন প্রার্থীকে ভোট দেওয়া মানে প্রার্থীর ভবিষ্যতের সকল কাজ কর্মের জিম্মাদারী নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া৷ প্রার্থী ভালো কাজ করলে ভোটার যেভাবে তার থেকে সওয়াব পাবে, তেমনি প্রার্থী খারাপ কাজ করলেও তার দায়ভার ভোটারের কাঁধে বর্তাবে৷ উল্লেখিত ৪টি বিষয় নিয়ে নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হলো৷
১, সাক্ষ্য দেয়া ঃ
আমরা জানি ‘মিথ্যা সাক্ষ্য’ হচ্ছে একটি ভয়াবহ কবীরা গুনাহের নাম৷ ভোটার যদি প্রার্থীর আমানতের খেয়ানত, বে-আমল, বাজে স্বভাব, দুর্নীতি ও অযোগ্যতার ব্যাপারে অবগত হওয়ার পরেও তাকে ভোট প্রদান করে থাকে, তাহলে ভোটার প্রার্থীর ব্যাপারে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করল, যা একটি স্পষ্টত কবিরা গুনাহ৷
হযরত আবূ বাকরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড় গুনাহ সম্পর্কে সতর্ক করব না?’ আমরা বললাম, ‘অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল!’
তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে শরীক স্থাপন করা ও পিতা-মাতার নাফরমানী করা৷ (এ কথা বলার সময় তিনি হেলান দিয়ে বসে ছিলেন৷ এরপর সোজা হয়ে) বসে বললেন) সাবধান! মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া৷ সাবধান! মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া৷ অতঃপর ক্রমাগত বলেই চললেন। এমনকি আমি মনে মনে বললাম, তিনি মনে হয় আর থামবেন না’৷- (বুখারী শরীফ: হাদীস নং ৫৯৭৬)
২, সুপারিশ করাঃ
কুরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি কেউ কোনো ভালো (কাজের) সুপারিশ করে তাহলে তাতে তার অংশ থাকবে, আর কেউ কোনো মন্দ (কাজের) সুপারিশ করলে তাতে তার অংশ থাকবে; আর আল্লাহ সর্ব বিষয়ে নযর রাখেন৷-(সূরা নিসা: আয়াত নং ৮৫)
আয়াতের মর্ম খুবই স্পষ্ট- প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে যদি ভালো কাজ করে তাহলে ভোটার তা থেকে সওয়াব পাবে, আর যদি প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে খারাপ কাজ করে তাহলেও ভোটার সে খারাপ কাজের গুনাহের যিম্মাদার হবে৷ সুতরাং ভোট প্রদানের সময় ভোটারের বিবেচনা করা উচিত- প্রার্থীর কাজ ভোটারের আমলনামার নেকির পাল্লা ভারি করবে, নাকি গোনাহের পাল্লা৷
৩, প্রতিনিধি নিয়োগ করাঃ
বর্তমানে ভোটার জনপ্রতিনিধি নিয়োগ করে তার অর্থ সম্পদ ও পেশী শক্তির বিবেচনায়, অথচ জনপ্রতিনিধি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল তার সততা ইনসাফ ও জ্ঞানের পরিধির প্রতি লক্ষ্য রেখে।
একটি জাতির জন্য আল্লাহ তা‘আলা জনপ্রতিনিধি নিয়োগ করেছিলেন এভাবে-
‘আর তাদের নবী তাদেরকে বলেছিল, আল্লাহ্ অবশ্যই তালুতকে তোমাদের রাজা করেছেন। তারা বললো, আমাদের উপর তার রাজত্ব কীরূপে হবে; যখন আমরা তার অপেক্ষা রাজত্বের অধিক হক্দার এবং তাকে প্রচুর ঐশ্বর্য্য দেয়া হয়নি। নবী বললেন, আল্লাহ অবশ্যই তাকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি তাকে জ্ঞানে ও দেহে সমৃদ্ধ করেছেন, আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা স্বীয় রাজত্ব দান করেন। আল্লাহ্ প্রাচুর্যময়, প্রজ্ঞাবান।’ (সূরা বাকারা: আয়াত নং ২৪৭)
৪, আমানত প্রাপকের কাছে পৌঁছে
দেওয়াঃ
ভোট একটি আমানত৷ আমানত তার প্রাপকের কাছে পৌঁছে দেওয়া ঈমানদারদের জন্য ওয়াজিব৷ আল্লাহ তা‘আলা আমানতকে তার যথাযথ প্রাপকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন৷ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা আমানতকে তার যথাযথ প্রাপকের কাছে পৌঁছে দাও।’ – (সূরা নিসা: আয়াত নং ৫৮)
আমানত রক্ষার গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমানত রক্ষা করে না, তার কোনো ঈমান নেই। যে ব্যক্তি কথা রক্ষা করে না তার কোনো দ্বীন নেই।’ – (সুনানুল বায়হাকি কুবরা: ১২৪৭০)
আমরা অনেকে মনে করি ভোট প্রদান একটি পার্থিব বিষয় মাত্র, বিষয়টি মোটেও এমন নয়; বরং এ ভোটের মাধ্যমে ইসলামের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিধান সংযুক্ত রয়েছে এই ভোটের সাথে৷ দল বা প্রতিকের প্রতি আবেগী না হয়ে প্রার্থীকে যাচাই করা উচিত শরীয়তের মানদণ্ডে তার সততা নিষ্ঠা ও যোগ্যতা কত টুকু আছে।
অথচ তা বিবেচনায় না নিয়ে সামান্য এক কাপ চা বা ৫ শত বা হাজার টাকার বিনিময়ে এ মহান কাজটিকে বিতর্কিত করে আমার ঈমান বিক্রি করছিনা তো!
আল্লাহ তা‘আলা যেন এই গুরু দায়িত্বকে যথাযথভাবে আদায় করার তাওফীক দান করেন আমিন।
মূল
লেখক: মুফতি নাজমুল হাসান
নবীন আলেম, লেখক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট৷
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন