কওমী মাদরাসা পাঠ্যক্রম’ এর জন্য আর্কাইভ; ক্যাটাগরি
কওমী মাদরাসা সিলেবাস : প্রাসঙ্গিক ভাবনা
মাওলানা কাজী ফজলুল করিম
ভূমিকা : ইদানীং কওমী মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার নেসাব তথা পাঠ্যক্রম বা সিলেবাস সম্পর্কে পরিমার্জন ও পরিবর্ধনের আওয়াজ বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্নভাবে বার বার ধ্বনিত হচ্ছে। যেসব লোক এই সমস্ত দ্বীনি মাদরাসাসমূহের নিয়মনীতির সাথে সরাসরি জড়িত নন এবং যাঁদের এ শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই, তাদের পক্ষ থেকেও এহেন অনধিকারচর্চামূলক বক্তব্য দিতে দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি এতই জোড়েশোরে আলোচিত হচ্ছে যে, এ ক্ষেত্রে অনেক কওমীপড়ুয়া নবীন আলেমগণও এই শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিশেষত্ব, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে তাদের সুরে সুর মিলিয়ে সিলেবাসে পরিবর্তন ও পরিমার্জনের আওয়াজ তুলে ধরছেন। এই নাজুক পরিস্থিতিতে কওমী মাদরাসার সিলেবাসের ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিশেষত্ব, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে মৌলিক চিন্তা-ফিকিরের প্রয়োজন পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি বলে অনুভূত হচ্ছে। কওমী মাদরাসা সিলেবাসের ইতিহাস-ঐতিহ্য : কওমী মাদরাসায় প্রচলিত সিলেবাস বা পাঠ্যক্রমের গোড়াপত্তনকারী মোল্লা নেযামুদ্দীন সাহালবী (রহ.)। তিনি ১০৮৮/৮৯ হিজরী মোতাবেক ১৬৭৭/৭৮ ঈসাব্দে ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহালী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। মোল্লা নেযামুদ্দীন সাহালবী স্বীয় পিতা মোল্লা কুতুবুদ্দীন শহীদ (রহ.)-এর নিকট প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ১১০৩ হিজরী মোতাবেক ১৬৯১ ঈসাব্দে সাহালী শহরের দুষ্কৃতিকারীরা মোল্লা কুতুবুদ্দীনকে শহীদ করে তাঁর গ্রন্থাগার ও সমূদয় সম্পদসহ বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। তখন মোল্লা নেযামুদ্দীন (রহ.)-এর বয়স ছিল ১৩ কিংবা ১৪। কৈশোরের এই বয়সে তিনি চলে যান লাক্ষেœৗ। অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে ২৪ বছর বয়সে শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং ৪০ বছর বয়সে শাহ আব্দুর রাযযাক (রহ.) (মৃত্যু-১১৩৬ হিজরী/১৭২৩ ঈসাব্দ)-এর নিকট কাদেরীয়া তরীকায় বায়’আত হন। তিনি ৭৫ বছর বয়সে ৯ জুমাদাল উলা, বুধবার ১১৬১ হিজরী মোতাবেক ১৭৪৮ ঈসাব্দে ইন্তেকাল করেন। (সূত্র : ইসলামী বিশ্বকোষ, চতুর্দশ খ-, পৃষ্ঠা-১১৭) উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হলো, তিনি ইলমে দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে ইলম অর্জনপূর্বক গুরুত্বপূর্ণ কিতাবগুলো এমন পর্যায়ক্রমিকভাবে বিন্যস্ত করেন, যার ফলে উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষা পদ্ধতি একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। এই কারণে আজো এই পদ্ধতিকে ‘দরসে নেযামী’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। মোল্লা নেযামুদ্দীন সাহালবী (রহ.) কর্তৃক প্রবর্তিত ‘দরসে নেযামী’ সিলেবাস ষোলো কলায় পূর্ণতা পায় শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহ.) (জন্ম : ১৭০৩ ঈসাব্দ, মৃত্যু : ১৭৬৫ ঈসাব্দ)-এর তত্ত্বাবধানে। দরসে নেযামী সিলেবাসের শেষ বর্ষকে দাওরায়ে হাদীসের বর্ষ নাম দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয় সিহাহ সিত্তাহসহ মুয়াত্তা মালেক, মুয়াত্তা মুহাম্মাদ ও তহাবী শরীফ। কালের বিবর্তনে ১৮৬৬ ঈসাব্দের ৩০ মে মোতাবেক ১৫ মুহাররম ১২৮৩ হিজরী ভারতের উত্তর প্রদেশে হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী (রহ.) (জন্ম : ১৮৩২ ঈসাব্দ, মৃত্যু : ১৮৮০ ঈসাব্দ) প্রতিষ্ঠা করেন দারুল উলুম দেওবন্দ। তখন এই দারুল উলুম দেওবন্দে যে সিলেবাস বা পাঠ্যক্রম গ্রহণ করা হয় তা ছিল ওই মোল্লা নেযামুদ্দীন সাহালবী (রহ.)-এর ‘দরসে নেযামী’ যা শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহ.) কর্তৃক পূর্ণাঙ্গতা পেয়েছিল। দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানুতবী (রহ.) দেওবন্দ মাদরাসায় উক্ত দরসে নেযামী সিলেবাসকে আরো সুসংহত ও যুগোপযোগী করার প্রয়াস পান। তিনি হিজরী ত্রয়োদশ শতক অর্থাৎ খ্রিষ্টীয় ্ঊনবিংশ শতাব্দীতে দিল্লি, লাক্ষেèৗ ও খায়রাবাদে যে তিন ধরনের ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল সেগুলোর মাঝে সমন্বয় সাধন করেন। দিল্লি কেন্দ্রের তাফসীর ও হাদীস চর্চা, লাক্ষেèৗয়ের ফিকহ চর্চা এবং খায়রাবাদের কালাম ও দর্শন চর্চার সমন্বিত পাঠ্যক্রম দারুল উলুম দেওবন্দে প্রবর্তন করা হয়। দারুল উলুম দেওবন্দে প্রবর্তিত পাঠ্যক্রমই বর্তমানে বাংলাদেশের কওমী মাদরাসাসমূহে নেসাব বা সিলেবাস হিসেবে বিদ্যমান। (সূত্র : ইসলামী বিশ্বকোষ, ত্রয়োদশ খ-, পৃষ্ঠা-৫৫৩) কওমী মাদরাসা সিলেবাসের বিশেষত্ব : মোল্লা নেযামুদ্দীন সাহালবী (রহ.) প্রবর্তিত দরসে নেযামী সিলেবাসের বিশেষত্ব নি¤œরূপ : (এক) তিনি এই সিলেবাস প্রণয়নে সংক্ষিপ্তকরণ নীতির প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখেন। (দুই) প্রতিটি বিষয়ের জন্য একাধিক কিতাব নির্বাচন করেন। (তিন) কিছু কিছু বিষয়ে নির্দিষ্ট কিতাবের বাছাইকৃত অংশ সিলেবাসভুক্ত করেন। (চার) শিক্ষার্থীরা যেন অধ্যয়ন কালে গভীর ভাবে চিন্তা-গবেষণা করার প্রশিক্ষণ পায় সেজন্য প্রতিটি বিষয়ের একটি করে জটিল কিতাব সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করেন। (পাঁচ) শিক্ষার্থীরা যেন প্রতিটি বিষয়ের বিষয়বস্তু সহজেই আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিটি বিষয়ের একটি করে সহজবোধ্য কিতাবও সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করেন। (ছয়) সিলেবাস এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে করে একজন শিক্ষার্থী প্রতিটি বিষয়কে সংক্ষিপ্তভাবেও পেশ করতে সক্ষম হয়, আবার ওই বিষয়কেই বিস্তারিতভাবেও তুলে ধরতে সক্ষম হয়। উদাহরণস্বরূপ হেদায়াতুন্নাহু, কাফিয়া ও শরহেজামী কিতাবের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। যথাক্রমে প্রথম কিতাবটি বিস্তারিত, দ্বিতীয় কিতাবটি সংক্ষিপ্ত, তৃতীয় কিতাবটি আবার গবেষণামূলক বিস্তারিত। (সাত) শিক্ষার্থীদের চিন্তার ভারসাম্য যেন ঠিক থাকে এবং কোনো একটি মতের দিকে যেন অন্ধভাবে ঝুঁকে না পড়ে সেজন্য দর্শন শাস্ত্রকেও সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। (আট) সিলেবাস এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে একজন শিক্ষার্থী এই পাঠ্যক্রম সমাপ্ত করে অন্য কিতাবাদি যত কঠিনই হোক না কেন, তা যেন বুঝতে সক্ষম হয়। (নয়) পাঠ্যক্রমে সকল দ্বীনি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাতে করে মধ্যম ধরনের মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরাও ষোল-সতের বছর বয়সে শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারে। (দশ) এমন সব কিতাবের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে, যাতে করে আপন পক্ষের সমর্থনের মনোভাবের চেয়ে চিন্তাশক্তি প্রখর হয়। (এগার) এই পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে এমন সব আলেম তৈরি হবে, যারা মুসলমানদের ধর্মীয় ব্যাপারে যে কোনো আক্রমণকে কুরআন ও হাদীসের পাশাপাশি যুক্তি ও চিন্তার সাহায্যে প্রতিহত করতে সক্ষম হবে। (বারো) এই পাঠ্যক্রম এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে করে মুতাকাদ্দিমীন (প্রাচীন) আলেমদের সাথে বর্তমান কালের আলেমদের চিন্তা ও গবেষণার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়। (সূত্র :ইসলামী বিশ্বকোষ, চতুর্দশ খ-, পৃষ্ঠা-১১৯) বর্তমানে কওমী মাদরাসাগুলোতে নিন্মোক্ত বিষয়সমূহ পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে : (১)আল-কুরআন (২) তাজবীদ-কুরআন পঠননীতি (৩) ইলমুল ক্বিরাআত-কুরআনের উচ্চারণনীতি (৪)তাফসীর-কুরআনের ব্যাখ্যা (৫) উসূলে তাফসীর-কুরআন ব্যাখ্যার নীতিমালা (৬) উলূমুল কুরআন- কুরআনের শাস্ত্রীয় জ্ঞান (৭) আল-হাদীস (৮) উসূলে হাদীস-হাদীস ব্যাখ্যার নীতিমালা (৯) উলূমুল হাদীস-হাদীসের শাস্ত্রীয় জ্ঞান (১০) ফিক্বহ-ইসলামী আইন (১১) উসূলে ফিক্বহ-ইসলামী আইনের নীতিমালা (১২) উলূমুল ফিক্বহ-ইসলামী আইনের শাস্ত্রীয় জ্ঞান(১৩)ফিক্বহে মুক্বারান-তুলনামূলক ইসলামী আইন (১৪) ইলমুল ফারায়েয-উত্তারাধিকার সম্পদ বণ্টন আইন (১৫) ইলমুল আক্বাইদ – ঈমানবিষয়ক জ্ঞান (১৬) মানতিক- যুক্তিবিদ্যা (১৭) ফালসাফা- দর্শনশাস্ত্র (১৮) আরবী ভাষা ও সাহিত্য (১৯) উর্দু (২০) বালাগাত- শব্দালংকার (২১) ফাসাহাত- বাক্যালংকার (২২) ইলমে মা’আনী-শব্দ তত্ত্ব (২৩) ইলমে বয়ান- বাক্য তত্ত্ব (২৪) ইলমে বাদী- বাচনিক তত্ত্ব (২৫) ইলমে নাহু-বাক্য প্রকরণ (২৬) ইলমে সরফ- শব্দ প্রকরণ (২৭) ইলমে লুগাহ- শব্দ কোষ (২৮) ইলমে তারিখ-ইতিহাস (৩০) সীরাত- রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জীবনী। এ ছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের বাংলা, অংক, ইংরেজি, সমাজ, বিজ্ঞান ও ফার্সি শিক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন মাদরাসায় কারিগরি প্রশিক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তি তথা কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্র রয়েছে। কওমী মাদরাসা সিলেবাসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য : কওমী মাদরাসা সিলেবাসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য মৌলিক অর্থে দারুল উলূম দেওবন্দের ৪টি বুনিয়াদ তথা বুনিয়াদে আরবাআ’র মাঝে প্রতিফলিত হয়েছে। দারুল উলূম দেওবন্দের ৪টি মৌলিক ভিত্তির প্রথমটি হলো : তাওহীদে খালিস (বিশুদ্ধ একত্ববাদ)। তাই, কওমী মাদরাসা সিলেবাসের মৌলিক একটি উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদেরকে খাঁটি একত্ববাদে দীক্ষিত করা। তাওহীদকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় এখানকার শিক্ষার্থীরা তাওহীদের শিক্ষা বুকে ধারণ করে ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বময়। দারুল উলূম দেওবন্দের দ্বিতীয় মৌলিক ভিত্তি হলো : ইত্তিবায়ে সুন্নাত (সুন্নাতের অনুসরন)। তাই, কওমী মাদরাসা সিলেবাসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীরা যেন ইলম অর্জনের সাথে সাথে সুন্নাতে নববীরও অনুসারী হয়। দারুল উলূম দেওবন্দের তৃতীয় মৌলিক ভিত্তি হলো : তায়াল্লুক মা’আল্লাহ (আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক)। তাই কওমী মাদরাসার সিলেবাসে একজন শিক্ষার্থী জ্ঞান অর্জন করার পর কেবল মাত্র তখনই পূর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন আলেম হতে পারবে, যখন ওই শিক্ষার্থী ইলম অর্জনের পর কোনো আহলুল্লাহ তথা কোনো আল্লাহ ওয়ালার সোহবতে (সান্নিধ্যে) থেকে ইলমে তাসাউফের গভীর সাগরে ডুব দিয়ে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হবে। দারুল উলূম দেওবন্দের চতুর্থ মৌলিক ভিত্তি হলো : ই’লায়ে কালিমাতুল্লাহ (আল্লাহর বিধান সুউচ্চকরণ)। তাই, এই সিলেবাসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো, একজন শিক্ষার্থী তার ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে নিজের জানমাল ও সময় কুরবান করে জান্নাতে আল্লাহর দীদার লাভে ধন্য হবে। বিজ্ঞানী, গণিতবিদ কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া উদ্দেশ্য নয় : আমাদের অনেক হিতাকাক্সক্ষী ভাইদের পক্ষ থেকে অনেক সময় এ ধরনের প্রস্তাব আসতে থাকে যে, এ সমস্ত মাদরাসার সিলেবাসে ‘বিজ্ঞান’ ‘গণিত’ ও ‘ইঞ্জিনিয়ারিং’ ইত্যাদির মানসম্পন্ন শিক্ষার ব্যবস্থা হওয়া চাই। তাহলে যে সকল আলেম এ সমস্ত মাদরাসা থেকে বের হবেন, তাঁরা দ্বীনি ইলমের সাথে সাথে এ সমস্ত বিষয়েও পুরোপুরি দক্ষতা ও দূরদর্শিতার অধিকারী হবেন। এ মতটি যত ভালো নিয়তেই পেশ করা হোক না কেন, এটা একেবারেই অপরিণামদর্শী মত। যার ভিত্তি মূলত দ্বীনি মাদরাসার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে অজ্ঞতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতপক্ষে দ্বীনি মাদরাসাসমূহের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো : এমন যোগ্যতাসম্পন্ন আলেম তৈরি করা, যারা কুরআন-সুন্নাহ ও এতদসংশ্লিষ্ট জ্ঞানসমূহে বিজ্ঞ ও পারদর্শী হবেন। আর এ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জন করার জন্য যে মানসিক একাগ্রতা ও পূর্ণ মনোযোগের প্রয়োজন, তাতে এক ব্যক্তি একই সময়ে উঁচুমানের আলেমে দ্বীনও হবেন আবার সাথে সাথে যোগ্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী অথবা অর্থনীতিবিদও হবেন, এটা আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। আজ যদি কোনো ব্যক্তি ডাক্তারি বিদ্যাকে নিজের নির্দিষ্ট বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করে নেয় এবং মেডিক্যাল সায়েন্সে নৈপূণ্য অর্জন করে, তখন কোনো বুদ্ধিমান তার সম্পর্কে এ আপত্তি করতে পারে না যে, সে ডাক্তার হওয়ার সাথে সাথে ইঞ্জিনিয়ার কেন হয়নি? অথবা যদি কোনো ব্যক্তি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে ডিগ্রি লাভ করে, তখন তার ওপর কোনো বিবেকবান এ প্রশ্ন করে না যে, মেডিক্যাল সায়েন্সে সে কেন পড়েনি? (সূত্র : কওমী মাদরাসার নেসাব ও নেযাম-দরসে নেযামীর কিতাবসমূহের পাঠদান পদ্ধতি। মূল : আল্লামা তাকী উসমানী, অনুবাদ : মাওলানা মুহাম্মাদ ওমর ফারুক, পৃষ্ঠা-১৫) হস্তশিল্প অথবা কারিগরি শিক্ষা দেওয়াও উদ্দেশ্য নয় : কোনো কোনো ব্যক্তি কওমী মাদরাসাসমূহের হিতাকাক্সক্ষী ও সহমর্মী হয়ে এখানে হস্তশিল্প ও কারিগরি শিক্ষার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যাতে করে উলামায়ে কেরাম অর্থনৈতিক দিক থেকে সমাজের বোঝা না হয়ে নিজ যোগ্যতায় জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করে বিনিময় ছাড়া দ্বীনের খিদমত আঞ্জাম দিতে পারেন। এই মতামতটি যদিও অত্যন্ত সুনিয়তে পেশ করা হয় এবং বাহ্যিকভাবে খুবই সুন্দর মনে হয়, কিন্তু বাস্তবে এই মতামতটিও সুচিন্তিত ও সুগভীর মতামত নয়। কেননা, কুরআন ও হাদীসের ন্যায় এমন একটি ব্যাপক বিষয়ের ওপর পারদর্শিতা অর্জনের পাশাপাশি হস্তশিল্প ও কারিগরি বিষয়ে সময় ব্যয় করা বাস্তবতার নিরিখে আসলে কোনো সুযোগ নেই। যেখানে চব্বিশ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে কুরআন-হাদীস ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যোগ্যতা অর্জন করা কঠিন, সেখানে হস্তশিল্প ও কারিগরি শিক্ষার পেছনে সময় ব্যয় করার সময় কোথায়? তা ছাড়াও অন্য কোনো বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা অর্জনকারীদের বেলায় এমন পরামর্শ তো দেয়া হচ্ছে না! কারণ, তারা তাদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান থেকে সমাজে যে সেবা দিয়ে থাকেন, সেই সেবার মাধ্যমে তাদের জীবিকার চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। তাহলে উলামায়ে কেরাম যদি সমাজের দ্বীনি চাহিদাসমূহ পূরণ করে সমাজের সেবা দিয়ে থাকেন, এ ক্ষেত্রে সেই মাধ্যম থেকে তাদের আর্থিক সুবিধা প্রাপ্তির বিষয়টিকে ‘সমাজের বোঝা’ বা ‘সমাজের করুণার পাত্র’ বলে মন্তব্য করা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় নয় কি? যদি কোনো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অর্থনীতিবিদ বা বিজ্ঞানী নিজ বিভাগ থেকে সমাজে সেবা প্রদান করেন এবং এর ভিত্তিতে সমাজ তাকে আর্থিক সুবিধা প্রদান করে, তবে এটা না তার প্রতি কোনো করুণা, আর না এ কারণে তাকে ‘সমাজের বোঝা’ বা ‘সমাজের করুণার পাত্র’ বলে মন্তব্য করা ঠিক হবে। বরং সমাজের অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের সেবা সমাজের সব মানুষ সব সময় গ্রহণ করে না। কিন্তু উলামায়ে কেরামের দ্বীনি সেবা সমাজের সব মানুষের সব সময় প্রয়োজন। তাই সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ওপর উলামায়ে কেরামের প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব অনেক অনেক বেশি। (সূত্র : কওমী মাদরাসার নেসাব ও নেযাম- দরসে নেযামীর কিতাবসমূহের পাঠদান পদ্ধতি। মূল : আল্লামা তাকী উসমানী, অনুবাদ : মাওলানা মুহাম্মাদ ওমর ফারুক, পৃষ্ঠা-১৭) বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বীকৃত একটি পন্থা এবং সময়ের দাবি : যদি কোনো বিজ্ঞানবিষয়ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর পূর্ণ জোর দেয়া হয়, তখন কোনো ব্যক্তি সেখানে এ আপত্তি পেশ করে না যে, এ প্রতিষ্ঠানে সাহিত্য, কবিতা অথবা কমার্স বিষয়ের শিক্ষা কেন দেয়া হয় না? কোনো কমার্স কলেজে এ প্রশ্ন করা হয় না যে, এখান থেকে ইঞ্জিনিয়ার কেন তৈরি হয় না? কোনো ল’ কলেজের ব্যাপারেও এ মতামত শোনা যায়নি যে, এর মধ্যে জ্যোতির্বিদ্যাও শিক্ষা দেয়া উচিত! তাহলে, তাফসীর হাদীস ফিক্বাহ ও দ্বীনসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো কি এমন শিক্ষা নয় যে, এগুলোর শিক্ষাদানের জন্য নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান থাকবে, সে সমস্ত প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণরূপে এ বিষয়গুলোর ওপর চেষ্টা-মেহনত করে এগুলোর খিদমত আঞ্জাম দেবে এবং এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ উলামা তৈরি করবে? কওমী মাদরাসাসমূহের সিলেবাস অক্ষুণœ রেখে আপন গতিতে থাকতে দেয়া যৌক্তিক দাবি : যদি কওমী মাদরাসাসমূহের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ইসলামী শিক্ষায় দক্ষ ব্যক্তি গঠনের প্রতি নিবদ্ধ হয়, আর সেখান থেকে কোনো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী বা অর্থনীতিবিদ তৈরি না হয়, তবে এ নিয়ে আপত্তি ও হৈচৈ করার কিছু নেই। বরং যে পরিমাণ ইসলামী শিক্ষা শরীয়তের দৃষ্টিতে ফরজে আইন ওই পরিমাণ ইসলামী শিক্ষা প্রতিটি বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে চালু করা ফরজ। ইলমে দ্বীনের খিদমত সমাজের কোনো প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত নয় কি? মুসলিম সমাজে এমন আলেমের প্রয়োজন নেই কি, যারা তাদের দ্বীনি চাহিদাগুলো পূরণ করবে? সমাজের নিত্যনতুন সমস্যাগুলোর শরয়ী সমাধান দেবে? মুসলিম সন্তানদেরকে দ্বীনি শিক্ষা দেবে? তাদের ভবিষ্যত ইসলামী জীবনের সংরক্ষণের জন্য নিজের পুরো জীবন ওয়াকফ করবে? দ্বীনের ওপর আগ্রাসী ফিতনাসমূহের কার্যকর মোকাবিলা করতে পারবে? হ্যাঁ, অবশ্যই এমন একদল আলেম থাকা চাই। নতুবা ইসলাম ও মুসলিম সমাজের চরম ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই কওমী মাদরাসা সিলেবাসে পরিবর্তন বা পরিমার্জনের আওয়াজ না তুলে বরং দ্বীনি বিষয়ের সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিতে আধুনিক বিষয়াদির অবতারণা করে পাঠদান পদ্ধতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। উদাহরণস্বরূপ হেদায়া কিতাবের ‘কিতাবুল বুয়ু’ পাঠদান কালে আধুনিক অর্থনীতি ও ব্যাংকিংয়ের আলোচনা, মানতিক ও ফালসাফা পাঠদান কালে যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনশাস্ত্রের পরিভাষাগত আলোচনা, মুখতাসারুল মা’আনী পাঠদান কালে বাংলা ভাষাতত্ত্ব ও অলংকারশাস্ত্রগত আলোচনা ইত্যাদি। আর আধুনিক বিশ্বে দ্বীন প্রচারের স্বার্থে প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি যেমনÑকম্পিউটার, ইন্টারনেট ইত্যাদির শিক্ষা প্রয়োজন অনুসারে নিজ নিজ উদ্যোগে শিখে নিতে হবে। সব বিষয়কেই সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন নেই। যে ব্যক্তি যে বিষয়ে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করতে চায়, কেবল সেই বিষয়কেই ওই ব্যক্তির জন্য সিলেবাসভুক্ত করা উচিত। সিলেবাসের দোষ নয়, দোষ আমাদের অলসতা ও অযোগ্যতার : আজ কওমী মাদরাসার সিলেবাসকে যুগোপযোগী মনে করা হচ্ছে না। এর কারণ যদি দ্বীনি বিষয় ছাড়া সমাজের অন্য বিষয়ের ওপর পারদর্শিতার কথা বলা হয়, তাহলে আপত্তিটা যথার্থ নয়। কেননা, কওমী মাদরাসার উদ্দেশ্যই হলো দ্বীনি বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করা। আর যদি দ্বীনি বিষয়ে পারদর্শিতার কথা বলা হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, দ্বীনি বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জনের ক্ষেত্রে কওমী মাদরাসার সিলেবাসের চেয়ে উত্তম কোনো সিলেবাস সত্যিই পৃথিবীতে বিরল। এই সিলেবাসে পড়ালেখা করেই নিকট অতীতেও বিশ্বসেরা ওলামায়ে কেরাম তৈরি হয়েছেন এবং হচ্ছেন। সুতরাং বলাই যায় যে, মৌলিক অর্থে সিলাবাসের দোষ নয়, দোষ আমাদের অলসতা ও অযোগ্যতার।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া শামসুল উলুম। নিশিন্দারা (কারবালা মাদরাসা) বগুড়া। ব-সধরষ : শভ.শধৎরস@ুধযড়ড়.পড়স
ভূমিকা : ইদানীং কওমী মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার নেসাব তথা পাঠ্যক্রম বা সিলেবাস সম্পর্কে পরিমার্জন ও পরিবর্ধনের আওয়াজ বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্নভাবে বার বার ধ্বনিত হচ্ছে। যেসব লোক এই সমস্ত দ্বীনি মাদরাসাসমূহের নিয়মনীতির সাথে সরাসরি জড়িত নন এবং যাঁদের এ শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই, তাদের পক্ষ থেকেও এহেন অনধিকারচর্চামূলক বক্তব্য দিতে দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি এতই জোড়েশোরে আলোচিত হচ্ছে যে, এ ক্ষেত্রে অনেক কওমীপড়ুয়া নবীন আলেমগণও এই শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিশেষত্ব, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে তাদের সুরে সুর মিলিয়ে সিলেবাসে পরিবর্তন ও পরিমার্জনের আওয়াজ তুলে ধরছেন। এই নাজুক পরিস্থিতিতে কওমী মাদরাসার সিলেবাসের ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিশেষত্ব, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে মৌলিক চিন্তা-ফিকিরের প্রয়োজন পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি বলে অনুভূত হচ্ছে। কওমী মাদরাসা সিলেবাসের ইতিহাস-ঐতিহ্য : কওমী মাদরাসায় প্রচলিত সিলেবাস বা পাঠ্যক্রমের গোড়াপত্তনকারী মোল্লা নেযামুদ্দীন সাহালবী (রহ.)। তিনি ১০৮৮/৮৯ হিজরী মোতাবেক ১৬৭৭/৭৮ ঈসাব্দে ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহালী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। মোল্লা নেযামুদ্দীন সাহালবী স্বীয় পিতা মোল্লা কুতুবুদ্দীন শহীদ (রহ.)-এর নিকট প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ১১০৩ হিজরী মোতাবেক ১৬৯১ ঈসাব্দে সাহালী শহরের দুষ্কৃতিকারীরা মোল্লা কুতুবুদ্দীনকে শহীদ করে তাঁর গ্রন্থাগার ও সমূদয় সম্পদসহ বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। তখন মোল্লা নেযামুদ্দীন (রহ.)-এর বয়স ছিল ১৩ কিংবা ১৪। কৈশোরের এই বয়সে তিনি চলে যান লাক্ষেœৗ। অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে ২৪ বছর বয়সে শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং ৪০ বছর বয়সে শাহ আব্দুর রাযযাক (রহ.) (মৃত্যু-১১৩৬ হিজরী/১৭২৩ ঈসাব্দ)-এর নিকট কাদেরীয়া তরীকায় বায়’আত হন। তিনি ৭৫ বছর বয়সে ৯ জুমাদাল উলা, বুধবার ১১৬১ হিজরী মোতাবেক ১৭৪৮ ঈসাব্দে ইন্তেকাল করেন। (সূত্র : ইসলামী বিশ্বকোষ, চতুর্দশ খ-, পৃষ্ঠা-১১৭) উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হলো, তিনি ইলমে দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে ইলম অর্জনপূর্বক গুরুত্বপূর্ণ কিতাবগুলো এমন পর্যায়ক্রমিকভাবে বিন্যস্ত করেন, যার ফলে উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষা পদ্ধতি একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। এই কারণে আজো এই পদ্ধতিকে ‘দরসে নেযামী’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। মোল্লা নেযামুদ্দীন সাহালবী (রহ.) কর্তৃক প্রবর্তিত ‘দরসে নেযামী’ সিলেবাস ষোলো কলায় পূর্ণতা পায় শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহ.) (জন্ম : ১৭০৩ ঈসাব্দ, মৃত্যু : ১৭৬৫ ঈসাব্দ)-এর তত্ত্বাবধানে। দরসে নেযামী সিলেবাসের শেষ বর্ষকে দাওরায়ে হাদীসের বর্ষ নাম দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয় সিহাহ সিত্তাহসহ মুয়াত্তা মালেক, মুয়াত্তা মুহাম্মাদ ও তহাবী শরীফ। কালের বিবর্তনে ১৮৬৬ ঈসাব্দের ৩০ মে মোতাবেক ১৫ মুহাররম ১২৮৩ হিজরী ভারতের উত্তর প্রদেশে হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী (রহ.) (জন্ম : ১৮৩২ ঈসাব্দ, মৃত্যু : ১৮৮০ ঈসাব্দ) প্রতিষ্ঠা করেন দারুল উলুম দেওবন্দ। তখন এই দারুল উলুম দেওবন্দে যে সিলেবাস বা পাঠ্যক্রম গ্রহণ করা হয় তা ছিল ওই মোল্লা নেযামুদ্দীন সাহালবী (রহ.)-এর ‘দরসে নেযামী’ যা শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহ.) কর্তৃক পূর্ণাঙ্গতা পেয়েছিল। দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানুতবী (রহ.) দেওবন্দ মাদরাসায় উক্ত দরসে নেযামী সিলেবাসকে আরো সুসংহত ও যুগোপযোগী করার প্রয়াস পান। তিনি হিজরী ত্রয়োদশ শতক অর্থাৎ খ্রিষ্টীয় ্ঊনবিংশ শতাব্দীতে দিল্লি, লাক্ষেèৗ ও খায়রাবাদে যে তিন ধরনের ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল সেগুলোর মাঝে সমন্বয় সাধন করেন। দিল্লি কেন্দ্রের তাফসীর ও হাদীস চর্চা, লাক্ষেèৗয়ের ফিকহ চর্চা এবং খায়রাবাদের কালাম ও দর্শন চর্চার সমন্বিত পাঠ্যক্রম দারুল উলুম দেওবন্দে প্রবর্তন করা হয়। দারুল উলুম দেওবন্দে প্রবর্তিত পাঠ্যক্রমই বর্তমানে বাংলাদেশের কওমী মাদরাসাসমূহে নেসাব বা সিলেবাস হিসেবে বিদ্যমান। (সূত্র : ইসলামী বিশ্বকোষ, ত্রয়োদশ খ-, পৃষ্ঠা-৫৫৩) কওমী মাদরাসা সিলেবাসের বিশেষত্ব : মোল্লা নেযামুদ্দীন সাহালবী (রহ.) প্রবর্তিত দরসে নেযামী সিলেবাসের বিশেষত্ব নি¤œরূপ : (এক) তিনি এই সিলেবাস প্রণয়নে সংক্ষিপ্তকরণ নীতির প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখেন। (দুই) প্রতিটি বিষয়ের জন্য একাধিক কিতাব নির্বাচন করেন। (তিন) কিছু কিছু বিষয়ে নির্দিষ্ট কিতাবের বাছাইকৃত অংশ সিলেবাসভুক্ত করেন। (চার) শিক্ষার্থীরা যেন অধ্যয়ন কালে গভীর ভাবে চিন্তা-গবেষণা করার প্রশিক্ষণ পায় সেজন্য প্রতিটি বিষয়ের একটি করে জটিল কিতাব সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করেন। (পাঁচ) শিক্ষার্থীরা যেন প্রতিটি বিষয়ের বিষয়বস্তু সহজেই আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিটি বিষয়ের একটি করে সহজবোধ্য কিতাবও সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করেন। (ছয়) সিলেবাস এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে করে একজন শিক্ষার্থী প্রতিটি বিষয়কে সংক্ষিপ্তভাবেও পেশ করতে সক্ষম হয়, আবার ওই বিষয়কেই বিস্তারিতভাবেও তুলে ধরতে সক্ষম হয়। উদাহরণস্বরূপ হেদায়াতুন্নাহু, কাফিয়া ও শরহেজামী কিতাবের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। যথাক্রমে প্রথম কিতাবটি বিস্তারিত, দ্বিতীয় কিতাবটি সংক্ষিপ্ত, তৃতীয় কিতাবটি আবার গবেষণামূলক বিস্তারিত। (সাত) শিক্ষার্থীদের চিন্তার ভারসাম্য যেন ঠিক থাকে এবং কোনো একটি মতের দিকে যেন অন্ধভাবে ঝুঁকে না পড়ে সেজন্য দর্শন শাস্ত্রকেও সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। (আট) সিলেবাস এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে একজন শিক্ষার্থী এই পাঠ্যক্রম সমাপ্ত করে অন্য কিতাবাদি যত কঠিনই হোক না কেন, তা যেন বুঝতে সক্ষম হয়। (নয়) পাঠ্যক্রমে সকল দ্বীনি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাতে করে মধ্যম ধরনের মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরাও ষোল-সতের বছর বয়সে শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারে। (দশ) এমন সব কিতাবের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে, যাতে করে আপন পক্ষের সমর্থনের মনোভাবের চেয়ে চিন্তাশক্তি প্রখর হয়। (এগার) এই পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে এমন সব আলেম তৈরি হবে, যারা মুসলমানদের ধর্মীয় ব্যাপারে যে কোনো আক্রমণকে কুরআন ও হাদীসের পাশাপাশি যুক্তি ও চিন্তার সাহায্যে প্রতিহত করতে সক্ষম হবে। (বারো) এই পাঠ্যক্রম এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে করে মুতাকাদ্দিমীন (প্রাচীন) আলেমদের সাথে বর্তমান কালের আলেমদের চিন্তা ও গবেষণার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়। (সূত্র :ইসলামী বিশ্বকোষ, চতুর্দশ খ-, পৃষ্ঠা-১১৯) বর্তমানে কওমী মাদরাসাগুলোতে নিন্মোক্ত বিষয়সমূহ পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে : (১)আল-কুরআন (২) তাজবীদ-কুরআন পঠননীতি (৩) ইলমুল ক্বিরাআত-কুরআনের উচ্চারণনীতি (৪)তাফসীর-কুরআনের ব্যাখ্যা (৫) উসূলে তাফসীর-কুরআন ব্যাখ্যার নীতিমালা (৬) উলূমুল কুরআন- কুরআনের শাস্ত্রীয় জ্ঞান (৭) আল-হাদীস (৮) উসূলে হাদীস-হাদীস ব্যাখ্যার নীতিমালা (৯) উলূমুল হাদীস-হাদীসের শাস্ত্রীয় জ্ঞান (১০) ফিক্বহ-ইসলামী আইন (১১) উসূলে ফিক্বহ-ইসলামী আইনের নীতিমালা (১২) উলূমুল ফিক্বহ-ইসলামী আইনের শাস্ত্রীয় জ্ঞান(১৩)ফিক্বহে মুক্বারান-তুলনামূলক ইসলামী আইন (১৪) ইলমুল ফারায়েয-উত্তারাধিকার সম্পদ বণ্টন আইন (১৫) ইলমুল আক্বাইদ – ঈমানবিষয়ক জ্ঞান (১৬) মানতিক- যুক্তিবিদ্যা (১৭) ফালসাফা- দর্শনশাস্ত্র (১৮) আরবী ভাষা ও সাহিত্য (১৯) উর্দু (২০) বালাগাত- শব্দালংকার (২১) ফাসাহাত- বাক্যালংকার (২২) ইলমে মা’আনী-শব্দ তত্ত্ব (২৩) ইলমে বয়ান- বাক্য তত্ত্ব (২৪) ইলমে বাদী- বাচনিক তত্ত্ব (২৫) ইলমে নাহু-বাক্য প্রকরণ (২৬) ইলমে সরফ- শব্দ প্রকরণ (২৭) ইলমে লুগাহ- শব্দ কোষ (২৮) ইলমে তারিখ-ইতিহাস (৩০) সীরাত- রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জীবনী। এ ছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের বাংলা, অংক, ইংরেজি, সমাজ, বিজ্ঞান ও ফার্সি শিক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন মাদরাসায় কারিগরি প্রশিক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তি তথা কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্র রয়েছে। কওমী মাদরাসা সিলেবাসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য : কওমী মাদরাসা সিলেবাসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য মৌলিক অর্থে দারুল উলূম দেওবন্দের ৪টি বুনিয়াদ তথা বুনিয়াদে আরবাআ’র মাঝে প্রতিফলিত হয়েছে। দারুল উলূম দেওবন্দের ৪টি মৌলিক ভিত্তির প্রথমটি হলো : তাওহীদে খালিস (বিশুদ্ধ একত্ববাদ)। তাই, কওমী মাদরাসা সিলেবাসের মৌলিক একটি উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদেরকে খাঁটি একত্ববাদে দীক্ষিত করা। তাওহীদকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় এখানকার শিক্ষার্থীরা তাওহীদের শিক্ষা বুকে ধারণ করে ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বময়। দারুল উলূম দেওবন্দের দ্বিতীয় মৌলিক ভিত্তি হলো : ইত্তিবায়ে সুন্নাত (সুন্নাতের অনুসরন)। তাই, কওমী মাদরাসা সিলেবাসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীরা যেন ইলম অর্জনের সাথে সাথে সুন্নাতে নববীরও অনুসারী হয়। দারুল উলূম দেওবন্দের তৃতীয় মৌলিক ভিত্তি হলো : তায়াল্লুক মা’আল্লাহ (আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক)। তাই কওমী মাদরাসার সিলেবাসে একজন শিক্ষার্থী জ্ঞান অর্জন করার পর কেবল মাত্র তখনই পূর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন আলেম হতে পারবে, যখন ওই শিক্ষার্থী ইলম অর্জনের পর কোনো আহলুল্লাহ তথা কোনো আল্লাহ ওয়ালার সোহবতে (সান্নিধ্যে) থেকে ইলমে তাসাউফের গভীর সাগরে ডুব দিয়ে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হবে। দারুল উলূম দেওবন্দের চতুর্থ মৌলিক ভিত্তি হলো : ই’লায়ে কালিমাতুল্লাহ (আল্লাহর বিধান সুউচ্চকরণ)। তাই, এই সিলেবাসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো, একজন শিক্ষার্থী তার ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে নিজের জানমাল ও সময় কুরবান করে জান্নাতে আল্লাহর দীদার লাভে ধন্য হবে। বিজ্ঞানী, গণিতবিদ কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া উদ্দেশ্য নয় : আমাদের অনেক হিতাকাক্সক্ষী ভাইদের পক্ষ থেকে অনেক সময় এ ধরনের প্রস্তাব আসতে থাকে যে, এ সমস্ত মাদরাসার সিলেবাসে ‘বিজ্ঞান’ ‘গণিত’ ও ‘ইঞ্জিনিয়ারিং’ ইত্যাদির মানসম্পন্ন শিক্ষার ব্যবস্থা হওয়া চাই। তাহলে যে সকল আলেম এ সমস্ত মাদরাসা থেকে বের হবেন, তাঁরা দ্বীনি ইলমের সাথে সাথে এ সমস্ত বিষয়েও পুরোপুরি দক্ষতা ও দূরদর্শিতার অধিকারী হবেন। এ মতটি যত ভালো নিয়তেই পেশ করা হোক না কেন, এটা একেবারেই অপরিণামদর্শী মত। যার ভিত্তি মূলত দ্বীনি মাদরাসার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে অজ্ঞতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতপক্ষে দ্বীনি মাদরাসাসমূহের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো : এমন যোগ্যতাসম্পন্ন আলেম তৈরি করা, যারা কুরআন-সুন্নাহ ও এতদসংশ্লিষ্ট জ্ঞানসমূহে বিজ্ঞ ও পারদর্শী হবেন। আর এ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জন করার জন্য যে মানসিক একাগ্রতা ও পূর্ণ মনোযোগের প্রয়োজন, তাতে এক ব্যক্তি একই সময়ে উঁচুমানের আলেমে দ্বীনও হবেন আবার সাথে সাথে যোগ্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী অথবা অর্থনীতিবিদও হবেন, এটা আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। আজ যদি কোনো ব্যক্তি ডাক্তারি বিদ্যাকে নিজের নির্দিষ্ট বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করে নেয় এবং মেডিক্যাল সায়েন্সে নৈপূণ্য অর্জন করে, তখন কোনো বুদ্ধিমান তার সম্পর্কে এ আপত্তি করতে পারে না যে, সে ডাক্তার হওয়ার সাথে সাথে ইঞ্জিনিয়ার কেন হয়নি? অথবা যদি কোনো ব্যক্তি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে ডিগ্রি লাভ করে, তখন তার ওপর কোনো বিবেকবান এ প্রশ্ন করে না যে, মেডিক্যাল সায়েন্সে সে কেন পড়েনি? (সূত্র : কওমী মাদরাসার নেসাব ও নেযাম-দরসে নেযামীর কিতাবসমূহের পাঠদান পদ্ধতি। মূল : আল্লামা তাকী উসমানী, অনুবাদ : মাওলানা মুহাম্মাদ ওমর ফারুক, পৃষ্ঠা-১৫) হস্তশিল্প অথবা কারিগরি শিক্ষা দেওয়াও উদ্দেশ্য নয় : কোনো কোনো ব্যক্তি কওমী মাদরাসাসমূহের হিতাকাক্সক্ষী ও সহমর্মী হয়ে এখানে হস্তশিল্প ও কারিগরি শিক্ষার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যাতে করে উলামায়ে কেরাম অর্থনৈতিক দিক থেকে সমাজের বোঝা না হয়ে নিজ যোগ্যতায় জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করে বিনিময় ছাড়া দ্বীনের খিদমত আঞ্জাম দিতে পারেন। এই মতামতটি যদিও অত্যন্ত সুনিয়তে পেশ করা হয় এবং বাহ্যিকভাবে খুবই সুন্দর মনে হয়, কিন্তু বাস্তবে এই মতামতটিও সুচিন্তিত ও সুগভীর মতামত নয়। কেননা, কুরআন ও হাদীসের ন্যায় এমন একটি ব্যাপক বিষয়ের ওপর পারদর্শিতা অর্জনের পাশাপাশি হস্তশিল্প ও কারিগরি বিষয়ে সময় ব্যয় করা বাস্তবতার নিরিখে আসলে কোনো সুযোগ নেই। যেখানে চব্বিশ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে কুরআন-হাদীস ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যোগ্যতা অর্জন করা কঠিন, সেখানে হস্তশিল্প ও কারিগরি শিক্ষার পেছনে সময় ব্যয় করার সময় কোথায়? তা ছাড়াও অন্য কোনো বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা অর্জনকারীদের বেলায় এমন পরামর্শ তো দেয়া হচ্ছে না! কারণ, তারা তাদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান থেকে সমাজে যে সেবা দিয়ে থাকেন, সেই সেবার মাধ্যমে তাদের জীবিকার চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। তাহলে উলামায়ে কেরাম যদি সমাজের দ্বীনি চাহিদাসমূহ পূরণ করে সমাজের সেবা দিয়ে থাকেন, এ ক্ষেত্রে সেই মাধ্যম থেকে তাদের আর্থিক সুবিধা প্রাপ্তির বিষয়টিকে ‘সমাজের বোঝা’ বা ‘সমাজের করুণার পাত্র’ বলে মন্তব্য করা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় নয় কি? যদি কোনো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অর্থনীতিবিদ বা বিজ্ঞানী নিজ বিভাগ থেকে সমাজে সেবা প্রদান করেন এবং এর ভিত্তিতে সমাজ তাকে আর্থিক সুবিধা প্রদান করে, তবে এটা না তার প্রতি কোনো করুণা, আর না এ কারণে তাকে ‘সমাজের বোঝা’ বা ‘সমাজের করুণার পাত্র’ বলে মন্তব্য করা ঠিক হবে। বরং সমাজের অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের সেবা সমাজের সব মানুষ সব সময় গ্রহণ করে না। কিন্তু উলামায়ে কেরামের দ্বীনি সেবা সমাজের সব মানুষের সব সময় প্রয়োজন। তাই সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ওপর উলামায়ে কেরামের প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব অনেক অনেক বেশি। (সূত্র : কওমী মাদরাসার নেসাব ও নেযাম- দরসে নেযামীর কিতাবসমূহের পাঠদান পদ্ধতি। মূল : আল্লামা তাকী উসমানী, অনুবাদ : মাওলানা মুহাম্মাদ ওমর ফারুক, পৃষ্ঠা-১৭) বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বীকৃত একটি পন্থা এবং সময়ের দাবি : যদি কোনো বিজ্ঞানবিষয়ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর পূর্ণ জোর দেয়া হয়, তখন কোনো ব্যক্তি সেখানে এ আপত্তি পেশ করে না যে, এ প্রতিষ্ঠানে সাহিত্য, কবিতা অথবা কমার্স বিষয়ের শিক্ষা কেন দেয়া হয় না? কোনো কমার্স কলেজে এ প্রশ্ন করা হয় না যে, এখান থেকে ইঞ্জিনিয়ার কেন তৈরি হয় না? কোনো ল’ কলেজের ব্যাপারেও এ মতামত শোনা যায়নি যে, এর মধ্যে জ্যোতির্বিদ্যাও শিক্ষা দেয়া উচিত! তাহলে, তাফসীর হাদীস ফিক্বাহ ও দ্বীনসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো কি এমন শিক্ষা নয় যে, এগুলোর শিক্ষাদানের জন্য নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান থাকবে, সে সমস্ত প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণরূপে এ বিষয়গুলোর ওপর চেষ্টা-মেহনত করে এগুলোর খিদমত আঞ্জাম দেবে এবং এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ উলামা তৈরি করবে? কওমী মাদরাসাসমূহের সিলেবাস অক্ষুণœ রেখে আপন গতিতে থাকতে দেয়া যৌক্তিক দাবি : যদি কওমী মাদরাসাসমূহের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ইসলামী শিক্ষায় দক্ষ ব্যক্তি গঠনের প্রতি নিবদ্ধ হয়, আর সেখান থেকে কোনো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী বা অর্থনীতিবিদ তৈরি না হয়, তবে এ নিয়ে আপত্তি ও হৈচৈ করার কিছু নেই। বরং যে পরিমাণ ইসলামী শিক্ষা শরীয়তের দৃষ্টিতে ফরজে আইন ওই পরিমাণ ইসলামী শিক্ষা প্রতিটি বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে চালু করা ফরজ। ইলমে দ্বীনের খিদমত সমাজের কোনো প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত নয় কি? মুসলিম সমাজে এমন আলেমের প্রয়োজন নেই কি, যারা তাদের দ্বীনি চাহিদাগুলো পূরণ করবে? সমাজের নিত্যনতুন সমস্যাগুলোর শরয়ী সমাধান দেবে? মুসলিম সন্তানদেরকে দ্বীনি শিক্ষা দেবে? তাদের ভবিষ্যত ইসলামী জীবনের সংরক্ষণের জন্য নিজের পুরো জীবন ওয়াকফ করবে? দ্বীনের ওপর আগ্রাসী ফিতনাসমূহের কার্যকর মোকাবিলা করতে পারবে? হ্যাঁ, অবশ্যই এমন একদল আলেম থাকা চাই। নতুবা ইসলাম ও মুসলিম সমাজের চরম ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই কওমী মাদরাসা সিলেবাসে পরিবর্তন বা পরিমার্জনের আওয়াজ না তুলে বরং দ্বীনি বিষয়ের সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিতে আধুনিক বিষয়াদির অবতারণা করে পাঠদান পদ্ধতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। উদাহরণস্বরূপ হেদায়া কিতাবের ‘কিতাবুল বুয়ু’ পাঠদান কালে আধুনিক অর্থনীতি ও ব্যাংকিংয়ের আলোচনা, মানতিক ও ফালসাফা পাঠদান কালে যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনশাস্ত্রের পরিভাষাগত আলোচনা, মুখতাসারুল মা’আনী পাঠদান কালে বাংলা ভাষাতত্ত্ব ও অলংকারশাস্ত্রগত আলোচনা ইত্যাদি। আর আধুনিক বিশ্বে দ্বীন প্রচারের স্বার্থে প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি যেমনÑকম্পিউটার, ইন্টারনেট ইত্যাদির শিক্ষা প্রয়োজন অনুসারে নিজ নিজ উদ্যোগে শিখে নিতে হবে। সব বিষয়কেই সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন নেই। যে ব্যক্তি যে বিষয়ে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করতে চায়, কেবল সেই বিষয়কেই ওই ব্যক্তির জন্য সিলেবাসভুক্ত করা উচিত। সিলেবাসের দোষ নয়, দোষ আমাদের অলসতা ও অযোগ্যতার : আজ কওমী মাদরাসার সিলেবাসকে যুগোপযোগী মনে করা হচ্ছে না। এর কারণ যদি দ্বীনি বিষয় ছাড়া সমাজের অন্য বিষয়ের ওপর পারদর্শিতার কথা বলা হয়, তাহলে আপত্তিটা যথার্থ নয়। কেননা, কওমী মাদরাসার উদ্দেশ্যই হলো দ্বীনি বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করা। আর যদি দ্বীনি বিষয়ে পারদর্শিতার কথা বলা হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, দ্বীনি বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জনের ক্ষেত্রে কওমী মাদরাসার সিলেবাসের চেয়ে উত্তম কোনো সিলেবাস সত্যিই পৃথিবীতে বিরল। এই সিলেবাসে পড়ালেখা করেই নিকট অতীতেও বিশ্বসেরা ওলামায়ে কেরাম তৈরি হয়েছেন এবং হচ্ছেন। সুতরাং বলাই যায় যে, মৌলিক অর্থে সিলাবাসের দোষ নয়, দোষ আমাদের অলসতা ও অযোগ্যতার।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া শামসুল উলুম। নিশিন্দারা (কারবালা মাদরাসা) বগুড়া। ব-সধরষ : শভ.শধৎরস@ুধযড়ড়.পড়স
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন