Translate

সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৮

দেশ স্বাধীনতায় আলেম মুক্তিযোদ্ধা

দেশ স্বাধীনতায় আলেম মুক্তিযোদ্ধা :
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
স্ব-অধীনতা থেকে স্বাধীনতা শব্দের উৎস যার
অর্থ নিজের অধীনে হওয়া। অন্য কথায় নিজের
ইচ্ছা অভিপ্রায় অনুযায়ী চলা। কিন্তু প্রকৃতার্থে
কোন মানুষই স্বাধীন নয়। তাকে স্রষ্টার
অধীনে থাকতে হয়। আবার নিজের স্বাধীনতা
ভোগ করতে গিয়ে অন্যের স্বাধীনতায়
হস্তক্ষেপ করাও স্বধীনতা বিরোধী কাজ। তাই
মানুষ ইচ্ছে করলেই তার সকল কাংখিত জিনিস অর্জন
করতে পারে না। পারে না চিরদিন বেঁচে থাকতে।
অতএব নিজের সকল আশা আকাংখা পূরণের নাম
স্বাধীনতা নয়; বরং আল্লাহর প্রদত্ত বিধি-বিধানের
সীমার মাঝে অবস্থান করে প্রত্যেক ব্যক্তি
সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত সকল
নেয়ামতের যতটুকু তার অধিকার ততটুকু ভোগ-
ব্যবহার ও প্রয়োগ করতে পারাকে স্বাধীনতা
বলে। অথবা স্বাধীনতা মানে মানুষের মৌলিক অধিকার
নিশ্চিত করা। আর তা হল স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন ও
বেঁচে থাকার অধিকার। খাদ্য-বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা ও
চিকিৎসার অধিকার, জান-মালের ইজ্জত রক্ষার অধিকার।
যে দেশে জাতির এসব অধিকার ভোগ করতে বাধা
বিপত্তির শিকার হয় না তারাই প্রকৃত স্বাধীন। শুধু এক
টুকরো স্বাধীন ভূমি আর পতাকা অর্জনের নাম
স্বাধীনতা নয়; তবে স্বাধীনতা ছাড়া কে চায়
বাচতে? জন্ম স্বাধীন মানুষ পরাধীনতার আত্মীয়
নয়। আর বাংলাদেশ চিরদিনই স্বাধীনতার জন্য সেই
ব্রাহ্মবাদের কবল থেকে নিস্তারের লড়াই করে
আসছে। আর কেনই বা করবে না, মাতৃভূমির প্রতি
ভালবাসা সে যে ঈমানেরই অংশ! তাই সেন রাজাদের
আধিপত্য থেকে মুক্তির আকুতি হাজার বছর আগের।
সেই আকুতিতে ছিল স্বাধীনতার তামান্না, মুক্তির
স্বপ্ন, অপরদিকে উলামায়ে কিরামের সমৃদ্ধ ইতিহাস-
ঐতিহ্য। ধর্ম দেশ জাতি এমনকি সকল ক্ষেত্রে
রয়েছে তাদের গৌরবময় অবদান। এ ধারাবাহিকতার
ব্যত্যয় ঘটেনি ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধেও;
এমনকি সকল স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেম সমাজ
ছিলেন অগ্রগামী।
প্রিয় পাঠক !
স্বাধীনতার ইতিহাস আলোচনা করতে হলে
প্রথমে দৃষ্টি যায় স্বাধীনতার দুটি অধ্যায়ের দিকে
(১) বৃটিশের কবল থেকে ভারত পাকিস্তানের
স্বাধীনতা
(২) পাকিস্তানের কবল থেকে বাংলাদেশের
স্বাধীনতা।
কারণ ভারত পাকিস্তান স্বাধীন না হলে বাংলাদেশ
স্বাধীন হত না। এছাড়াও ইসলামের পূর্বে আরবরা
ভারতের বিভিন্ন স্থান দিয়ে চীনে ব্যবসার জন্য
আসা-যাওয়া করত। যখন আরবরা মুসলমান হলো তখন
তারা ব্যবসার উদ্দেশ্য বাদ দিয়ে ইসলাম প্রচারের
জন্য ভারত আসতে লাগল ও তাদের সততা আচরণে
অনেকে মুসলমান হয়ে গেলো, এমনকি
ততকালীন ভারতের বাদশাহ চেরোমোন
পোরোমলও মুসলমান হয়েছিল। সেসময় তিনি
অনেক মসজিদও তৈরি করছেন। আবার ভারতে
অনেক ওলী দরবেশের আগমনও ঘটেছে।
মুসলমানরা ৭৫০ বছর বিশাল ভারত শাসন করল। কিন্তু এক
পর্যায়ে ইংরেজরা ব্যবসার নামে ভারতে আসতে
শুরু করল। আস্তে আস্তে তাদের অর্থনৈতিক ও
সামরিক শক্তি মজবুত হলো আর মুসলিম শাসকদের
উদাসিনতার সুযোগে ভারতের শাসন ক্ষমতা হস্তগত
করতে থাকে। তারা পুরো ভারত দখলের চক্রান্তে
মেতে উঠে। এর প্রতিবাদে মুসলমানদের
উদ্যোগে ১৭৫৭ সালে পলাশীল প্রান্তর রক্তাক্ত
হয়। অতপর ১৭৯৯ সালে কুরআনের হাফেজ বিশিষ্ট
আলেম ফতেহ আলী উরুফে টিপু সুলতানের
নেতৃত্বে হায়দারাবাদে ইংরেজদের বিরুদ্ধে
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। ইংরেজদের কবল থেকে
১৯৪৭ সালে এ দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত
র্দীঘ দুইশত বছর বিভিন্ন যুদ্ধ আভিযানে আলেম
সমাজই নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন। আরো আগ বাড়িয়ে
বলা যায় ১৭৬৩ সালে বৃটিশদের বিরুদ্ধে ফকীর
বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন মাদানী তরীক্বার
পীর ফকীর নেতা মজনু শাহ। ১৮১৮ সালে
ফারায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন মাওলানা
হাজী শরীয়তুল্লাহ। ৬ মে ১৮৩১ সালে
ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক বালাকোটের
যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন এবং শেষ পর্যন্ত শহীদ হন
মাওলানা সায়্যিদ আহমাদ ও মাওলানা ইসমাঈল শহীদ রহ.।
১৮৩১ সালে বাশেরকেল্লার নেতৃত্ব দেন সায়্যিদ
আহমাদ শহীদের শিষ্য হাফেজ নেসার আলী
উরফে তীতুমীর। ইংরেজ ও তাদের দোসর
শিখদের বিরুদ্ধে শামেলীর যুদ্ধে সেনাপতি
ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা
কাসেম নানুতবী রহ.। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব
বনাম জনতার বিপ্লবের নেতৃত্ব দেন শায়খ
ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী, মাওলানা কাসেম
নানুতবী, মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী, মাওলানা
যামেন শহীদ, মাওলানা জাফর থানেশ্বরী প্রমূখ
রহ.। ১৮৬৬ সালে দেওবন্দ আন্দোলনের
নেতৃত্ব দেন সমস্ত উলামায়ে দেওবন্দ। ১৯১৬
সালে রেশমী রুমাল আন্দোলনের নেতৃত্ব
দেন শাঈখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী
ও মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী এবং মাওলানা উবাইদুল্লাহ
সিন্ধী রহ.। ১৯২০ সালে খেলাফত আন্দোলনের
নেতৃত্ব দেন মাওলানা শওকত আলী ও মুহাম্মাদ
আলী রহ. ভ্রাতৃদ্বয়। মোট কথা পরাধীনতার পর
থেকে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত
ছোট-বড় সকল আন্দোলনে আলেম সমাজই
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এমনিভাবে পাকিস্তান
গঠনের দুই বছরের মাথায় রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবীতে
সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ৯ম মার্চ ১৯৪৯ ইং এই কমিটির
সভাপতি ছিলেন মাওলানা আকরাম খাঁ। তারপর ১৯৫২ সালে
যখন বাংলার দামাল ছেলেরা ভাষা আন্দোলন করে
তখন আলেম সমাজের প্রতিনিধি মাওলানা আতহার
আলী রহ. বলেছিলেন উর্দুর সাথে বাংলা ভাষাকেও
রাষ্ট্র ভাষা ঘোষণা করতে হবে। অন্যদিকে
মুজাহিদে আযম শামসুল হক্ব ফরিদপুরী রহ. সেদিন
সিংহের ন্যায় গর্জে উঠে বলেছিলেন, বাংলা ভাষা
কে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেওয়া ন্যায্য অধিকার।
আমাদের এ দাবী মানতেই হবে। আরেক বীর
পুরষ মাওলান আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ যিনি
সর্বপ্রথম পাকিস্তানের গণ পরিষদে ইংরেজী ও
উর্দুর পরিবর্তে বাংলা ভাষায় বক্তব্য দেন। এটা
তখনকার কথা যখন এ দুঃসাহস আর কোন বাঙালী
নেতা দেখাতে পারেনি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের
কিংবদন্তি মাওলানা ইসমাইল হুসাইন সিরাজী রহ. ও মাওলানা
আব্দুল হামীদ খান ভাষানী রহ. এর ইতিহাস তাঁরকার
ন্যায় উজ্জ্বল। এমনি ভাবে ৫২ এর ভাষা
আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন আরেক প্রবাদ
পুরুষ মাওলানা মহিউদ্দীন খান যিনি মাসিক মদিনার সম্পাদক।
ভাষা আন্দোলনের সময় ছাত্রদের বিশাল মিছিল
নিয়ে তিনি ভিক্টোরিয়া পার্কে যান।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের এই দেশ
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী থেকে মুক্ত হয়।
এদেশের আলেম সমাজ সহ অনেকেই
এদেশের মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে
দেশের মানুষকে পাকিস্তানী জালিম শাসকদের
কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন। অসংখ্য উলামায়ে
কেরামগণ তাদের জান মাল, শক্তি সামর্থ দিয়ে এ
দেশের মাজলুম জনগণের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধে
অংশ গ্রহণ করেছেন।
সবচেয়ে বেশী #রক্ত ঝরেছে এবং #লাশ
পড়েছে তাঁদেরই (আল্লাহ তাঁদের জান্নাতের উচ্চ
মাকাম ও উচ্চ শ্রেণীর শহীদ হিসেবে কবুল
করুন । আমীন) । অমানবিক নির্যাতনের শিকার
হয়েছেন তাঁরাই। প্রতিটি আন্দোলনের মূল চালিকা
শক্তি ও উদ্যোগ ও নেতৃত্বে ছিলেন আলেম
সমাজ। কিন্তু আজ তা চাঁপা পড়ে আছে; বরং বলা যায়
চেঁপে রাখা হচ্ছে। চেপে রাখা সেই বিপ্লবী ও
সোনালি ইতিহাস খানিকটা তুলে ধরার চেষ্টা করব
ইনশাআল্লাহ।
“মুক্তিযুদ্ধ কালিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি
রাষ্ট্রদূত আগা শাহীর সাক্ষাৎকার, যা মার্কিন টেলিভিশন
এ.বি.সি. এর মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল। ওই
সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক বব ক্লার্কের এক প্রশ্ন
থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, আলেম সমাজ
মুক্তিযুদ্ধে জনগণের পাশে ছিলেন এবং সার্বিক
ভাবে সহযোগিতা করেছেন।
[এম আর আখতার মুকুল, আমি বিজয় দেখেছি,
বিস্তারিত পৃষ্ঠা নং – ১৬৭]
১৯৭১ সালে ইসলাম রক্ষার নামে পাকিস্তানি হানাদার
বাহিনী নিরাপরাধ বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ফলে মুলত ৭১ সালে ইসলাম ও মুসলমানই সবচেয়ে
বেশি আক্রান্ত হয়েছিল। তৎকালিন পাকিস্তানের
করাচির অনেক আলেমও শেখ মুজিব তথা
বাংলাদেশকে সমর্থন জানিয়ে ছিলেন। সিলেটের
জকিগঞ্জ এলাকার মাওলানা আব্দুস সালাম ১৯৭১ সালে
করাচির ইউসুফ বিন্নুরী মাদরাসার ছাত্র ছিলেন।
বাংলাদেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে এক ছাত্র করাচি
মাদরাসার ইমাম মুফতি মাহমুদ সাহেবকে প্রশ্ন
করলেন, ‘হযরত মুজিব গাদ্দার কো গ্রেফতার কর
লে আয়া, লেকিন আবি তক কতল বী নেহি কিয়া?’
শেখ মুজিব গাদ্দারকে তো ধরে নিয়ে আসা
হয়েছে কিন্তু এখনও হত্যা করা হয় নাই? প্রশ্ন
শুনেই মুফতি সাহেব খুব ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন,
‘শেখ মুজিব গাদ্দার নেহি, অহ সুন্নি মুসলমান হে,
ইয়াহিয়া আওর ভূট্টো শিয়া হে। হর সুন্নি মুসলমানে কি
জান আওর মাল কি হেফাজত করনা হর সুন্নি
মুসলমানকে লিয়ে ওয়াজীব হে’। শেখ মুজিব
গাদ্দার না; বরং তিনি একজন সুন্নি মুসলমান। ইয়াহয়া এবং
ভুট্রো শিয়া ! প্রত্যেক সুন্নি মুসলমানের উপর
অপর সুন্নি মুসলমানের জান মাল হেফাজত করা
ওয়াজিব। বাংলাদেশের বিখ্যাত আলেম ও বুযুর্গ
আল্লামা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর রহ. এবং এমদাদুল
হক আড়ইহাজারী রহ. ১৯৭১ সালে বলেছিলেন, “এ
যুদ্ধ ইসলাম আর কুফরের যুদ্ধ নয়, এটা হল জালেম
আর মাজলুমের যুদ্ধ”। পাকিস্তানীরা জালেম আর এ
দেশের বাঙ্গালীরা মাজলুম।
কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক উনার মা উপন্যাসে সাফিয়া
বেগমের কথা উল্লেখ করেছেন। সাফিয়া বেগম
উনার ছেলে আজাদ কে পুরান ঢাকার জুরাইন
পীরের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে প্রেরন করেন।
এই জুরাইন পীরের অনেক মুরীদ মুক্তিযোদ্ধা
ছিল। সক্রিয় ভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ
করেছেন অসংখ্য উলাময়ে কেরাম। তাদের মাঝে
উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন-আল্লামা
হাফেজ্জি হুজুর, আল্লামা লুৎফুর রহমান বরুণী,
আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ, আল্লামা মুফতি নুরুল্লাহ,
আল্লামা এমদাদুল হক আড়াই হাজারী, আল্লামা শামসুদ্দিন
কাসেমী রহ. প্রমুখ। বাংলাদেশের কওমী
মাদরাসাগুলির মধ্যে আয়তনের দিক থেকে
সবচেয়ে বড় মাদরাসা হল চট্রগ্রামের জামেয়া
ইসলামিয়া পটিয়া মাদরাসা। ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসে
মেজর জিয়াউর রহমান এই চট্রগ্রামের পটিয়া মাদরাসায়
আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। জিয়াউর রহমান কে আশ্রয়
দেয়ার অপরাধে পটিয়া মাদরাসার শিক্ষক আল্লামা
দানেশ কে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা হত্যা করে।
“পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন নিশ্চিত হয় পটিয়া মাদরাসার
আলেমরা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছে, তখনি
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সেই পটিয়া মাদরাসার উপর
জঙ্গি বিমান দিয়ে বোমা বর্ষণ করা শুরু করে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এই বোমা বর্ষণে পটিয়া
মাদরাসার শিক্ষক আল্লামা দানেশ ও ক্বারী জেবুল
হাসান সহ অনেকেই শহীদ হন।
[বেলাল মোহাম্মদ ; স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র;
পৃষ্ঠা – ৫৪, ৫৫ ও ১০২]
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আল বদর রাজাকার
বাহিনীর হাতে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করার কারণে
দেশের একজন স্বনামধন্য মাওলানাও শহীদ
হয়েছিলেন। উনার নাম- মাওলানা অলিউর রহমান। ১৪
ডিসেম্বর উনার ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায় রায়ের
বাজার। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা বেয়নেট দ্বারা
খুচিয়ে খুচিয়ে উনাকে হত্যা করে। ১৯৭২ সালে তৈরি
শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকায় মাওলানা অলিউর
রহমানের নাম আছে।
১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর মাওলানা মুখলেছুর
রহমানের কাছে কুমিল্লার চান্দিনা থানা পাক হানাদার
বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয় এবং ১৩৯৫ জন পাক
আর্মি আত্মসমর্পন করে। ১৯৭১ সালে মাওলানা
মুখলেছুর রহমান চাঁদপুরের কচুয়া মাদরাসায়
তাফসীরে জালালাইন পড়াতেন। মাওলানা মুখলেছুর
রহমান এর মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট এর সনদ ক্রমিক
নং ২০২০৬।
“মুক্তিবাহিনীকে সমর্থন করার জন্য রাজবাড়ী
জেল খানার মাওলানা কাজী ইয়াকুব আলীকে হত্যা
করে পাকিস্তানি বাহিনী। মাওলানা কাজী ইয়াকুব
আলীকে গলা কেটে হত্যা করে তারপর তার
পেটের মাঝখানে পাকিস্তানি পতাকা পুঁতে দিয়ে
বলে, ‘আভি শালা জয় বাংলা বোলো’ এখন শালা
জয়বাংলা বল। ( আল্লাহ সেই জালিমের উপযুক্ত
প্রতিদান দিন )
পাবনা সদরের একজন বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ ছিলেন,
মাওলানা কাশেম উদ্দিন। শুধু তাই নয় ১৯৭১ সালে এই
দেশে ভারতের দেওবন্দ মাদরাসা কেন্দ্রিক যে
আলেমদের সংগঠন “জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ” ছিল
উনারাও কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের
মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে অনেক ফতোয়া দিয়ে
ছিলেন। “১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রধান মুহাদ্দিস
শায়খুল ইসলাম আমীমুল এহসান রহ. পাকিস্তানি হানাদার
বাহিনীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন।
পরবর্তীতে ইয়াহিয়া সরকার উনাকে জোর করে
সৌদি আরব পাঠিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হবার পর উনি
বাংলাদেশে ফিরলে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে
বায়তুল মোকাররম মসজিদের প্রধান খতীব হিসাবে
নিযুক্ত করেন। [শায়খুল ইসলাম আমীমুল এহসান রহ.
এর জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ]
১৯৭১ সালে ব্রাক্ষণবাড়িয়া সদরের সবচেয়ে বড়
কওমী মাদরাসার প্রধান মুহতামিম ফখরে বাঙ্গাল
আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ. পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর
বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়ে ছিলেন। ব্রাক্ষণবাড়িয়া
জেলায় অনেক বড় বড় আলেম উনার ফতোয়া
শুনে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পরেছিলেন। “অনেক
মুক্তিযুদ্ধাকে ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম
রহ. নিজের বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। দেশ
স্বাধীন হবার পর শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে ধন্যবাদ
জানিয়ে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন।
১৯৭১ এ যদি অধিকাংশ মুসলিম মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী
থাকতো তাহলে এই দেশ কোনোদিন স্বাধীন
হতো না। সাংবাদিক শাকের হোসাইন শিবলি সাহেব
সহস্রাধিক পৃষ্ঠার একটি বই লিখেছেন। বহুল প্রশংসিত
সেই বইটির নাম ‘আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে’।
এ বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে জালেমের
বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইয়ের ইতিহাস। এ চেতনায়
শত শত আলেমের অস্ত্র তুলে নেবার
রোমাঞ্চকর ইতিবৃত্ত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে
বাংলার বিভিন্ন মত ও পেশার লোকেরা অংশ গ্রহণ
করেছিলেন। বাংলার আলেম সমাজও এর থেকে
দূরে ছিলেন না। ঐ আলেমরা কিন্তু শুধু দেশ মাতৃকার
টানে ও নির্যাতিত নারীদের কে পাকিস্তানী হানদার
বাহিনীর লালসার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই
মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। তাই বাংলাদেশ স্বাধীনতা
অর্জনের ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরামের ভূমিকা
কম ছিল না। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন একেকজন
সিপাহসালার। তাদের বক্তৃতা, সমাবেশ, চেতনা এবং
হুংকারে বহু লোক জালেমের বিরুদ্ধে মাতৃদেশ
বাংলাকে স্বাধীন করার আপ্রাণ চেষ্টায়
রণক্ষেত্রে ঝাপিয়ে পড়ছিল। আমরা তাদেরকে
ভুলে গেলে চলবে না। তাই আসুন স্বাধীনতার এই
মাসে প্রত্যেকেই যেন সূরা ফাতিহা একবার সূরা
এখলাস তিনবার পড়ে তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা
করি। আর কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি মুক্তি যুদ্ধে
যে সকল মুসলমান শহীদ হয়েছে তাদের জান্নাত
নসীব করুন। আমিন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন