ব্লগে বিভিন্ন সময়ে শিয়া-সুন্নি, দেওবন্দী-ওহাবি ইত্যাদি শব্দের অপব্যবহার দেখা যায়, কাদা ছুড়া-ছুড়ি হয়ে থাকে। আর এর মাঝে এগুলো দেখে হাসতে থাকে নাস্তিক ব্লগাররা। তাই বিজ্ঞ ব্লগার ও সাধারন পাঠকদের সুবিধার্তে গবেষণামূলক উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মারকাযুদ্ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর মুখপত্র মাসিক আল-কাউসারে (View this link)প্রকাশিত আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সঠিক পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য ধারাবাহিক ভাবে কয়েক কিস্তিতে প্রকাশ করা হবে।
প্রবন্ধটির লেখক মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক।
প্রতি মাসে কোনো না কোনো বিষয়ের উপর মুহাযারার (বিষয়ভিত্তিক আলোচনার) চেষ্টা করা হয়। আজকের মজলিসের আলোচ্য বিষয়, ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য’। আল্লাহ রাববুল আলামীন যদি তাওফীক দেন তাহলে কিছু আলোচনা হবে।
হাদীস শরীফে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাজাতপ্রাপ্ত দলের বৈশিষ্ট্য ও মানদন্ড উল্লেখ করেছেন। সেই মানদন্ড ও তার বাস্তব প্রয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করার ইচ্ছা আছে। এতে বোঝা যাবে কারা সেই বৈশিষ্ট্যের ধারক ও সেই মানদন্ডে উত্তীর্ণ। আর কারা তা ধারণে ব্যর্থ এবং কোথায় কোথায় ব্যর্থ।
আলোচনার প্রেক্ষাপট
গত শনিবার দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জে একটি মজলিস হয়েছিল। কথা ছিল, মুনাযারা বা বহছের মজলিস হবে। কিন্তু দুই দলের এক দল উপস্থিত না হওয়ায় বহসের মজলিস হয়নি। তবে একে কেন্দ্র করে বড় সমাবেশ হয়েছিল। অনেক তালিবুল ইলম, বিভিন্ন মাদরাসার মুদাররিস এবং আশপাশ থেকে অনেক সাধারণ মানুষ একত্র হয়েছিলেন। ওখানে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ হয়। কিন্তু যতটা বিস্তারিতভাবে, আরো দলিল-প্রমাণের উদ্ধৃতি সহকারে আলোচনার প্রয়োজন ছিল তখন সময় ও পরিবেশ না থাকায় তা হয়ে উঠেনি। আমাদের মনে হয়েছে, আমরা ঐ আলোচনা তালিবুল ইলম ভাইদের জন্য আরো বিশদভাবে করি। কারণ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা দলিল-প্রমাণের সাথে ভালোভাবে বুঝে নেওয়া সবার জন্য জরুরি।
কারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ নামের অধিকারী
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ অর্থ যারা সুন্নাহ ও জামাআকে ধারণ করে। শুধু দাবি করলেই এ নামের অধিকারী হওয়া যায় না। যারা মৌলিকভাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আদর্শ অনুসরণ করে, কিন্তু কোথাও কোথাও বিচ্যুত হয়ে যায়, তো যে অংশে বিচ্যুত হল সে অংশে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, ততটুকুর মধ্যে সে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর অন্তর্ভুক্ত নয়।
আরেকজন মৌলিকভাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আদর্শের উপর নেই, কিন্তু আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর একটি গুণ বা বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে আছে তাহলে ততটুকুর মধ্যে সে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর অনুসারী। তবে এভাবে শুধু একটি বা দুটি বৈশিষ্ট্যের দ্বারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ উপাধি অর্জন করা যাবে না।
আজকাল এই কথাটা আমাদের চিন্তায় থাকে না। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.
ما أنا عليه وأصحبابي
হাদীসটির ব্যাখ্যায় এ কথাটা বলেছেন। খুতবাতে হাকীমুল উম্মতে আছে। ইবনে রজব হাম্বলী রাহ.ও ‘জামেউল উলূমি ওয়াল হিকাম’ কিতাবে (পৃষ্ঠা : ৩২০, হাদীস : ২৭)
عليكم بسنتي হাদীসটির ব্যাখ্যায় তা লিখেছেন।
থানভী রাহ. বলেছেন, আকাইদ, মুয়ামালা, মুয়াশারা, এভাবে দ্বীনের সকল ক্ষেত্রে আপনাকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আদর্শের উপর থাকতে হবে। আপনি যদি শুধু আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আদর্শের উপর থাকেন, অন্যান্য বিষয়ে না থাকেন তাহলে আপনাকে কামিল সুন্নী বলা হবে না। সুতরাং এই চিন্তা ভুল যে, ইনতিসাব ও সম্বন্ধ হলেই সব হয়ে গেল বা উসূল ও আকাইদের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আদর্শ অনুসরণ করলেই সবকিছুর মধ্যে তাদের অনুসরণ হয়ে গেল কিংবা এক অংশে অনুসরণ হলেই সব অংশে অনুসরণ হয়ে গেল ইত্যাদি। এগুলো ভুল চিন্তা।
তেমনি যে বা যারা উসূল ও আকীদার ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আদর্শের উপর নেই তবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর একটি গুণ তার বা তাদের মধ্যে আছে, এই গুণটিকে অস্বীকার করাও ভুল। তো প্রথমে আমাদেরকে মানদন্ডটি ভালোভাবে বুঝতে হবে এবং বাস্তব জীবনে তা অনুসরণের চেষ্টা করতে হবে।
নামের শেষে নিসবত লাগানো কি জরুরি
আমাদের ইনতিসাব ও সম্বন্ধ দারুল উলূম দেওবন্দের সাথে। কারণ আমাদের সকল উস্তাদ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দারুল উলূম দেওবন্দের ফয়েযপ্রাপ্ত। আমাদের তালীম-তরবিয়ত হয়েছে আকাবিরে দেওবন্দের হাতে। কিন্তু এ কারণে নামের শেষে দেওবন্দী লাগাতে হবে এটা জরুরি নয়। আমাদের আকাবির তা জরুরি মনে করতেন না। হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রাহ.কে ‘থানভী’ বলা হয়। কারণ তার বাড়ি থানাভবনে। রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ.-যিনি দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, তাঁকে গাঙ্গুহী বলা হয়। কারণ তাঁর বাড়ি গঙ্গোহ গ্রামে। কাসেম নানুতুবী রাহ.কে ‘নানুতুবী’ বলা হয়। কারণ নানুতা তাঁর বাড়ি। তেমনি ইয়াককুব নানুতুবী রাহ.। মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রাহ.কে ‘দেওবন্দী’ বলা হয়। কারণ তার বাড়ি দেওবন্দে। মুফতী শফী রাহ. দেওবন্দী। কারণ তাঁর বাড়ি দেওবন্দ। এরপরেও তিনি অনেক সময় এ নিসবত লিখতেন না। তিনি বলতেন, আমার বাড়ি দেওবন্দ, পড়েছিও দেওবন্দে। তাহলে দুই দিক থেকে আমি দেওবন্দী। মাদরাসার দিকে নিসবত করেও দেওবন্দী বলতে পারি। আমার বাড়ি দেওবন্দ এ হিসেবেও দেওবন্দী বলতে পারি। এরপরেও এ নিসবত আমার পছন্দ নয়। কারণ অনেকে এ নিসবতের অপপ্রয়োগ করে। এ নিসবতগুলো তো আসাবিয়ত ও সাম্প্রদায়িতকার জন্য নয়। শুধু নিসবতের দ্বারা কোনো কিছু সাব্যস্ত হয় না, আবার কোনো কিছুর বিলোপও ঘটে না। অনেকে নিসবত থেকে আসাবিয়ত ও সাম্প্রদায়িকতার দুর্গন্ধ পায়। অথচ যিনি নিসবত ব্যবহার করেছেন তার চিন্তার সুদূর প্রদেশেও এই নাপাকী ছিল না।
হযরত যে কখনো দেওবন্দী লিখতেন না তা নয়। তবে অধিকাংশ সময় লিখতেন না। লিখলেও শুধু এজন্য লিখতেন যে, দেওবন্দ তাঁর বাড়ি এবং দেওবন্দ মাদরাসায় তিনি পড়াশোনা করেছেন।
কারো অন্যায় যেন আমাদেরকে না-ইনসাফীর উপর উদ্বুদ্ধ না করে
আমাদের সমাজে আরেকটি ভুলও ব্যাপকভাবে হয়। তা হচ্ছে, কুরআন মজীদের এই শিক্ষার উপর মযবুতীর সাথে না থাকা-
لا يجرمنكم شنآن قوم على ان لا تعدلوا اعدلوا هو اقرب للتقوى.
এ আয়াতের শিক্ষা হল, কারও অন্যায় ও শত্রুতা যেন আমাদেরকে না-ইনসাফীতে প্ররোচিত না করে।
এটা কোনো কথা হয় না যে, অমুক আমাকে গালি দিয়েছে, আমিও তাকে গালি দিব। অমুক আমাকে গোমরাহ বলেছে, আমিও তাকে গোমরাহ বলব। অমুক আমাকে বেদআতী বলেছে, আমিও তাকে বেদআতী বলব। অমুক আমাকে কাফির বলেছে, আমিও তাকে কাফির বলব। অমুক আমাকে ইংরেজের দালাল বলেছে আমিও তাকে ইংরেজের দালাল বলব। অমুক আমাকে ইহুদি-খৃস্টানের দালাল বলেছে, আমিও তাকে ইহুদি-খৃস্টানের দালাল বলব। এটা শরীয়তের শিক্ষা না। আল্লাহর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সুন্নাহ না। কুরআনের শিক্ষা হল-
ادفع بالتى هى احسن
হাঁ, এক জায়গায় আছে-
لا يحب الله الجهر بالسوء من القول الا من ظلم وكان الله سميعا عليما
এ আয়াতে মযলুমকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এখান থেকে একটা সুযোগ সীমিত পর্যায়ে বের হয়। তবে সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না। না-ইনসাফী করা যাবে না। কেউ যদি ভুল পথে চলে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর নীতি ও আদর্শের উপর না থাকে, এমনকি ইসলামের উপরও না থাকে, (নাউযুবিল্লাহ, নাউযুবিল্লাহ) তার ক্ষেত্রেও আমি ইনসাফ থেকে সরতে পারি না, তার উপর জুলুম করতে পারি না। তার সাথে আমার আচরণ হবে ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ অনুযায়ী। এটা আমাদেরকে মনে রাখতে হবে। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন। আমীন।
আজকের মূল বিষয় আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য। এ বিষয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ রাববুল আলামীন সহীহ বলার তাওফীক নসীব করুন। আমীন।
আলোচনার ভিত্তি কী হবে
এই পুরো আলোচনার ভিত্তি হবে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতু রাসূলিল্লাহ। আমরা আলোচনা শুরু করব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি প্রসিদ্ধ হাদীস দ্বারা, যে হাদীসটি দ্বীনের একটি বুনিয়াদী নীতির বাহক। হাদীসটি সুনান, মাসানীদ ও সিহাহ কিতাবসমূহে রয়েছে।
সিহাহ শব্দটি সহীহ শব্দের বহুবচন। যেসব কিতাবের সংকলকগণ শুধু সহীহ হাদীস সংকলনের নীতি গ্রহণ করেছেন সেসব কিতাবকে ‘সহীহে মুজাররাদ’-এর কিতাব বলা হয়। ‘সিহাহ সিত্তা’ শব্দটির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। এখানেও সিহাহ শব্দটি সহীহ-এর বহুবচন।
সিহাহ সিত্তা বা হাদীসের প্রসিদ্ধ ছয় কিতাবের প্রতিটির সকল হাদীস সহীহ-এই ধারণা ঠিক নয়। সুনানে ইবনে মাজাহসহ সুনানের অন্যান্য কিতাবে সহীহ-হাসানের বাইরে বিভিন্ন প্রকারের যয়ীফ হাদীসও রয়েছে।
তেমনি এ ধারণাও ঠিক নয় যে, এই ছয় কিতাবের বাইরে আর কোনো ‘সহীহ’ কিতাব নেই। এই ছয় কিতাবের বাইরে আরো ‘সহীহ’ কিতাব রয়েছে, যার সংকলকগণ শুধু সহীহ বা হাসান হাদীস সংকলনের নীতি গ্রহণ করেছেন। যেমন-মুয়াত্তা ইমাম মালেক ইবনে আনাস (মৃত্যু : ১৭৯ হিজরী), কিতাবুল আছার ইমাম আবু হানীফা (মৃত্যু : ১৫০ হি.) সহীহ ইবনে খুযায়মা (মৃত্যু : ৩১১ হিজরী) , সহীহ ইবনে হিববান (মৃত্যু : ৩৫৪ হিজরী)। সহীহ হাদীস সংকলনের উদ্দেশ্যে এই কিতাবগুলো লেখা হয়েছে। তেমনি যিয়াউদ্দীন আলমাকদেসীও এই নীতি গ্রহণ করেছেন। সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমের উপর যারা ‘মুস্তাখরাজ’ লিখেছেন, তাদের অনেকেরই এই নীতি ছিল। তদ্রূপ এই দুই কিতাবের উপর যেসব ‘মুসতাদরাক’ লেখা হয়েছে তার অনেকগুলোতেই এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।
আপনারা জানেন, ‘মুসতাদরাক’ বলা হয় বিশেষ ধরনের হাদীসের কিতাবকে। যেসব সহীহ ও হাসান হাদীস কিংবা প্রমাণ হিসেবে সরাসরি গ্রহণযোগ্য বা শাওয়াহেদ ও সমর্থক বর্ণনার সাথে গ্রহণযোগ্য যেসব হাদীস সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে সংকলিত হয়নি সেসব হাদীস যেসব গ্রন্থে সংকলন করা হয় তাকে ‘মুসতাদরাক আলাস সহীহাইন’ বলে।
এ রকম একটি প্রসিদ্ধ ‘মুসতাদরাক’ হচ্ছে হাকিম আবু আবদুল্লাহ (মৃত্যু : ৪০৫ হিজরী) সংকলিত মুসতাদরাক। এতে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। তবে এটি স্বীকৃত কথা যে, তিনি যেসব হাদীস সংকলন করেছেন বা যেগুলোকে সহীহ বলেছেন তার সবগুলো বাস্তবেও সহীহ এমন নয়। তবে এতে এমন অনেক হাদীস রয়েছে, যা বুখারী-মুসলিম বা তাদের কোনো একজনের শর্তে উত্তীর্ণ। হাফেয ইবনে হাজার রাহ. ‘আননুকাত’ কিতাবে এমন হাদীসের সংখ্যা হাজার খানেক বলেছেন। যদ্দুর মনে পড়ে, نحو ألف শব্দ সেখানে আছে।
তো আমি এখন যে হাদীসটি পড়ব তা সুনান-মাসানীদসহ অনেক কিতাবে আছে। এমনকি সহীহ শিরোনামে সংকলিত কোনো কোনো কিতাবেও আছে। যেমন, সহীহ ইবনে হিববানে হাদীসটি আছে। আমি এখন ইমাম বুখারী রাহ. ও ইমাম আবু দাউদ রাহ.সহ আরো অনেক ইমামের উস্তাদ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর সংকলিত ‘মুসনাদ’ থেকে হাদীসটি পড়ছি।
আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. বলেন-
حدثنا الوليد بن مسلم، حدثنا ثور بن يزيد، حدثنا خالد بن معدان قال : حدثنا عبد الرحمن بن عمرو السلمي وحجر بن حجر قالا : أتينا العرباض بن سارية وهو ممن نزل فيه، ولا على الذين إذا ما أتوك لتحملهم قلت لا أجد أحملكم عليه فسلمنا وقلنا : أتيناك زائرين وعائدين ومقتبسين، فقال عرباض : صلى بنا رسول الله صلى الله عليه وسلم الصبح ذات يوم، ثم أقبل علينا، فوعظنا موعظة بليغة ذرفت منها العيون، ووجلت منها القلوب، فقال قائل : يا رسول الله! كأن هذه موعظة مودع، فماذا تعهد إلينا؟ فقال : أوصيكم بتقوى الله، والسمع والطاعة، وإن كان عبدا حبشيا، فإنه من يعش منكم بعدي فسيرى اختلافا كثيرا. فعليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين، تمسكوا بها، وعضوا عليها بالنواجذ، وإياكم ومحدثات الأمور، فإن كل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة.
হাদীস : ১৭১৪৫, ২৮/৩৭৫; মুয়াসসাসাতুর রিসালা থেকে প্রকাশিত শায়খ শুয়াইব আলআরনাউত ও তাঁর সঙ্গীদের তাহকীককৃত (সম্পাদিত নুসখা)।
এরপর আরো দুটি সনদ রয়েছে। ১৭১৪২ নং রেওয়াতের টীকায় শায়খ শুয়াইব আলআরনাউত ও তাঁর সঙ্গীরা উক্ত হাদীসের বিভিন্ন রেওয়াত, সমর্থক বর্ণনা ও তাখরীজসহ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
মূল হাদীসের তরজমা
ইরবায ইবনে সারিয়া রা. বলেন, একদিন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিয়ে ফজরের নামায পড়লেন। এরপর আমাদের দিকে ফিরে এক সারগর্ভ বক্তৃতা করলেন। এতে আমাদের চোখ অশ্রুসজল হল এবং হৃদয় ভীতকম্পিত হল। একজন আরজ করলেন, আল্লাহর রাসূল! এ যেন বিদায়কালের উপদেশ। আপনি আমাদের (আরো) কী অসীয়ত করছেন? আল্লাহর রাসূল বললেন, তোমাদেরকে অসীয়ত করছি আল্লাহকে ভয় করার এবং আমীর হাবাশী গোলাম হলেও তার আনুগত্য করার। কারণ আমার পর তোমাদের যারা বেঁচে থাকবে তারা বহু ইখতিলাফ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাহ ও আমার হেদায়েতের পথের পথিক খলীফাগণের সুন্নাহকে সর্বশক্তি দিয়ে ধারণ করবে। আর সকল নবউদ্ভাবিত বিষয় থেকে দূরে থাকবে। কারণ সকল নবউদ্ভাবিত বিষয় বিদআত। আর সকল বিদআত গুমরাহী।
হাদীসের ব্যাখ্যা
আল্লাহর রাসূলের বয়ান থেকে সাহাবায়ে কেরামের মনে হয়েছে, এটি তাঁর বিদায়ী বয়ান। তাই তাঁরা কিছু মৌলিক নীতি চেয়েছেন, যা তাঁর অনুপস্থিতে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে। জওয়াব থেকে বোঝা যাচ্ছে, তাঁরা একটি মানদন্ড চেয়েছেন, যার দ্বারা দ্বন্দ ও মতভেদের ক্ষেত্রে ফয়সালা করা যাবে। আল্লাহর রাসূল বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আমার পর বেঁচে থাকবে তারা বহু ইখতিলাফ দেখতে পাবে।’
এখানে ইখতিলাফটা ব্যাপক। যে কোনো ধরনের ইখতিলাফ হতে পারে। ইখতিলাফ যখন হবে তখন করণীয় কী? আল্লাহর রাসূল বললেন, ‘আমার সুন্নাহ ও আমার হেদায়েতপ্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নাহকে সর্বশক্তি দিয়ে ধরে রাখবে। অর্থাৎ যে সরল পথ ও উজ্জ্বল আদর্শের উপর তোমাদেরকে রেখে যাচ্ছি এর উপর অটল-অবিচল থাকতে চাইলে আমার সুন্নাহ এবং রাশেদ ও মাহদী খলীফাগণের সুন্নাহকে আকড়ে ধরে রাখবে। এরপর বলেছেন, ‘নবআবিষ্কৃত বিষয়াদি থেকে দূরে থাকবে।’
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের হাদীসে আছে-
من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد
যে আমাদের এই বিষয়ে (দ্বীন ও শরীয়তে) নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটায় তা পরিত্যাজ্য।
এ হাদীসের আলোকে উপরের হাদীসের অর্থ হয়, দ্বীনের নামে যা কিছু প্রচার করা হবে অথচ তা দ্বীন হওয়ার কোনো দলিল নেই, তা পরিত্যাজ্য। এ হাদীসে وكل بدعة ضلالة পর্যন্ত আছে। অর্থাৎ সকল বিদআত গোমরাহী। সহীহ মুসলিমে জাবির রা.-এর হাদীসে আরেকটি কথা আছে। তা হল-وكل ضلالة في النار অর্থাৎ সকল গোমরাহীর ঠিকানা জাহান্নাম।
হাদীসের মান
হাদীসটি সহীহ। পরিভাষায় ‘সহীহ’ ও ‘হাসান’ বলে যে পার্থক্য করা হয় তা একটি পারিভাষিক পার্থক্য। উসূলে হাদীস অনুযায়ী দু ধরনের হাদীসই দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য। মূলত তা সহীহ হাদীসেরই দুটি স্তরের নাম। ‘সহীহ’ প্রথম স্তরের। ‘হাসান’ দ্বিতীয়
স্তরের, তবে এর দ্বারাও শরীয়তের আহকাম ও বিধান প্রমাণ হয়। আমাদের আলোচিত হাদীসটি পরিভাষার দিক থেকেও সহীহ। আবার সাধারণ সহীহ নয়; বরং ঐ প্রকারের সহীহ, যাকে পরিভাষায় الصحيح المتلقى بالقبول বলে। অর্থাৎ আহলে ইলম ও আহলুল হাদীসের মাঝে যেটি সহীহ হওয়ার বিষয়ে কোনো মতভেদ নেই, সকলেই যাকে শরীয়তের সূত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন-এটি এমন পর্যায়ের সহীহ হাদীস।
দেখুন, আমি যে ‘আহলুল হাদীস’ শব্দটি বললাম এর অর্থ হাদীসশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ মনীষীবৃন্দ, যারা নকদে হাদীস ও নকদে ইসনাদ তথা হাদীসের সনদ-মতন বিচারের শাস্ত্রসমূহের পারদর্শী। এটিই এ শব্দের পুরনো ব্যবহার। যাই হোক, এটা এখন আলোচ্য বিষয় নয়।
ইমাম আবু নুয়াইম আলআসফাহানী রাহ. (মৃত্যু : ৪৩০ হিজরী)-এর মন্তব্য
ইমাম আবু নুয়াইম রাহ. সহীহ মুসলিমের উপর ‘মুসতাখরাজ’ লিখেছেন। ঐ কিতাবের ভূমিকায় তিনি এ হাদীস সহীহ হওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর আরেকটি কিতাব ‘কিতাবুয যুআফা।’ এটি মূলত ‘আলমুসতাখরাজ’-এর মুকাদ্দামা, যা আলাদাভাবে ছাপা হয়েছে বা তিনি নিজেই আলাদা করে সংকলন করেছেন। এতেও এ হাদীস সহীহ হওয়ার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তার আলোচনাটি পড়ছি :
هذا حديث جيد من صحيح حديث الشاميين، وهو وإن تركه الإمامان محمد بن إسماعيل البخاري ومسلم بن الحجاج فليس ذلك من جهة انكسار منهما له، فإنهما رحمهما الله قد تركا كثيرا مما هو بشرطهما أولى وإلى طريقتهما أقرب، وقد روى هذا الحديث عن العرباض بن سارية ثلاثة من تابعي الشام معروفين مشهورين.
এ আরবী পাঠে ‘ইনকিসার’ শব্দটি ছাপার ভুল। সঠিক পাঠ হল ‘ইনকার’। ইবনে রজব হাম্বলী রাহ. আবু নুয়াইম রাহ.-এর হাওয়ালায় ‘জামিউল উলুমি ওয়াল হিকাম’ কিতাবে এই ইবারত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে ‘ইনকিসার’ এর পরিবর্তে ‘ইনকার’ শব্দ আছে।
ইমাম আবু নুয়াইম বলেন, এটি একটি ‘জাইয়েদ’ হাদীস, যা শামের রাবীদের সূত্রে বর্ণিত সহীহ হাদীসের অন্যতম। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাইল বুখারী ও ইমাম মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ যদিও হাদীসটি তাঁদের কিতাবে আনেননি, তবে তা হাদীসটিকে সহীহ মনে না করার কারণে নয়। তাঁরা তো এমন অনেক হাদীস ছেড়ে দিয়েছেন যেগুলো তাদের সংকলিত হাদীস থেকেও- তাঁদের নীতি ও মানদন্ডের অধিক নিকটবর্তী। এ হাদীসটি ইরবায ইবনে ছারিয়া রা. থেকে বর্ণনা করেছেন শামের প্রসিদ্ধ ও বিখ্যাত তিনজন তাবেয়ী।
এরপর একটু সামনে গিয়ে এ হাদীসের নির্দেশনা সম্পর্কে বলেন-
فتلقت الهداة العقلاء وصية نبيهم صلى الله عليه وسلم بالقبول ولزموا التوطن على سنته وسنة الهداة المرشدة من الخلفاء، فلم يرغبوا عنه بل علموا أن الثبوت عليه غير ممكن إلا بتتبع ما سنه عليه السلام وسنه بعده أئمة الهدى الذين هم خلفائه في أمته فتركوا الاشتغال بهواجس النفوس وخواطر القلوب، وما يتولد من الشبهات التي تولد آراء النفوس وقضايا العقول خوفا من أن يزيغوا عن المحجة التي فارقهم عليها رسول الله صلى الله عليه وسلم الذي شبه ليلها بنهارها مع ما جاءهم عن الله تعالى من الوعيد البليغ المصرح بنفي الإيمان عما خالفه عليه السلام أوطعن على أحكامه ولم تطب نفسه بالتسليم له. انتهى (المستخرج على صحيح المسلم)
অর্থাৎ তো হেদায়েতের দিশারী প্রাজ্ঞজনরা তাঁদের নবীর এই অসীয়তকে শিরোধার্য করেছেন এবং তাঁর সুন্নাহ ও খলীফাগণের সুন্নাহর উপর নিজেদেরকে আবদ্ধ রেখেছেন, যারা ছিলেন হেদায়েতপ্রাপ্ত ও হেদায়েতের দিশারী। তা থেকে বিমুখ হননি। বরং তারা নিশ্চিত জেনেছেন যে, আল্লাহর রাসূল যে সুন্নাহ জারি করেছেন এবং তাঁর পর হেদায়েতের ইমামগণ যে সুন্নাহ জারি করেছেন, যাঁরা ছিলেন উম্মতের মাঝে তাঁরই উত্তরসূরী, তা অন্বেষণ করা ছাড়া দ্বীনের উপর অবিচল থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং তারা মনের খেয়াল, মস্তিষ্কের কল্পনা এবং বুদ্ধি ও প্রবৃত্তির মত ও মতবাদ থেকে জন্ম নেওয়া সংশয় ও বিভ্রান্তিতে আত্মনিয়োগে করেননি। ঐ উজ্জ্বল রাজপথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার ভয়ে, যার উপর দাড় করিয়ে আল্লাহর রাসূল তাদের থেকে বিদায় নিয়েছেন। উপরন্তু আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে এসেছে ঈমান হারা হওয়ার কঠিন হুঁশিয়ারি তাদের জন্য, যারা আল্লাহর রাসূলের বিরোধিতা করে, তাঁর বিধি বিধানের নিন্দা করে কিংবা তাঁর প্রতি আত্মসমর্পিত হতে বিরত থাকে।-আলমুসতাখরাজ ১/৩৭
এটি দ্বীনের একটি বুনিয়াদী হাদীস এবং সর্বসম্মতভাবে সহীহ। অথচ এই বুনিয়াদী হাদীসটি সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমে নেই। এ কারণে কোনো হাদীস শুধু ঐ দুই কিতাবে না থাকলে তা হাসান বা যয়ীফ মনে করা সম্পূর্ণ ভুল। এ হাদীস একটি স্পষ্ট উদাহরণ যে, সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের বাইরেও সহীহ হাদীস আছে।
তেমনি যারা মনে করেন, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ছাড়া কোথাও সহীহ হাদীস নেই। থাকলেও তা দ্বিতীয় পর্যায়ের সহীহ হাদীস-তাদের ধারণাও ভুল। কেননা ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম সকল সহীহ হাদীস সংকলনের ইচ্ছাও করেননি। এ কথা তাঁরা স্পষ্ট ভাষায় বলে গেছেন। বিভিন্ন সনদে তাঁদের এই কথা বর্ণিত আছে। খাত্তাবী রাহ. সহীহ বুখারীর ভাষ্যগ্রন্থের ভূমিকায় তা উদ্ধৃত করেছেন। আরো অনেকেই উল্লেখ করেছেন।
তো এই হাদীসের মান বিষয়ক আলোচনায় আমরা একটি সুন্দর ফায়দাও পেলাম। তা হচ্ছে কোনো সহীহ হাদীস সহীহাইনে না থাকলে এ আপত্তি করা যাবে না যে, কেন তা ঐ দুই কিতাবে নেই!
তো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর পরিচয় ও বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে এটি বুনিয়াদী হাদীস। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইখতিলাফ হলে আমার সুন্নাহ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহকে ধারণ করবে। তাহলে বুঝা গেল, নাজাতপ্রাপ্ত দলের একটি মানদন্ড সুন্নাহ, অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর দ্বিতীয় রোকন ‘আলজামাআ’। এটিও হাদীস শরীফে আছে। এ সংক্রান্ত হাদীসটি সুনানে আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ ও সুনানে দারেমী ইত্যাদি কিতাবে আছে। সুনানে আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমদে হাদীসটি যেভাবে আছে তা হল-
عن أبي عامر عبد الله بن لحي قال : حججنا مع معاوية بن أبي سفيان، فلما قدمنا مكة قام حين صلى صلاة الظهر، فقال : إن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : إن أهل الكتابين افترقوا في دينهم على ثنتين وسبعين ملة، وإن هذه الأمة ستفترق على ثلاث وسبعين ملة، يعني الأهوءا، كلها في النار إلا الواحدة، وهي الجماعة … انتهى.
আবু আমির আবদুল্লাহ বলেন, আমরা মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান রা.-এর সাথে হজ্ব করলাম। যখন মদীনায় এলাম যোহরের নামাযের পর তিনি দাঁড়ালেন এবং বললেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পূর্বের দুই কিতাবধারী সম্প্রদায় তাদের ধর্মে বায়াত্তর মিল্লাতে বিভক্ত হয়েছিল। আর এই উম্মত বিভক্ত হবে তেয়াত্তর মিল্লাতে। অর্থাৎ নিজস্ব খেয়াল-খুশির অনুসারী বিভিন্ন দল। সবগুলো দল জাহান্নামী হবে একটি ছাড়া। আর সেটি হচ্ছে ‘আলজামাআ’।-মুসনাদে আহমদ ২৮/১৩৪ (মুয়াসসাসাতুর রিসালা থেকে প্রকাশিত শায়খ শুআইব আলআরনাউত কর্তৃক সম্পাদিত নুসখা), হাদীস : ১৬৯৬৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪৫৯৭
হাদীসটির মান
এ হাদীস সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেছেন-
الحديث صحيح مشهور في السنن والمسانيد، كسنن أبي داود والترمذي والنسائي وغيرهم
অর্থ : হাদীসটি সহীহ। এটি সুনান ও মাসানীদের কিতাবের মশহূর হাদীস। আবু দাউদ, তিারমিযী, নাসায়ী ও অন্যান্যদের সুনানে তা আছে।-মাজমুউল ফাতাওয়া ৩/৩৪৫
জামে তিরমিযীতে হাদীসটির পাঠ এই-
تفترق أمتي على ثلاث وسبعين ملة، كلهم في النار إلا ملة واحدة، قالوا : من هي يا رسول الله؟ قال : ما أنا عليه وأصحابي.
অর্থাৎ আমার উম্মত তিয়াত্তর মিল্লাতে বিভক্ত হবে। একটি ছাড়া বাকি সবগুলোই যাবে জাহান্নামে। সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর রাসূল! সেই এক দলে কারা থাকবেন? বললেন, মা আনা আলাইহি ওয়া আসহাবী। অর্থাৎ যারা আমার ও আমার সাহাবীদের আদর্শের উপর থাকবে।-জামে তিরমিযী ২/৯২, হাদীস : ২৮৩২
ইমাম তিরমিযী রাহ. বলেছেন-
هذا حديث حسن غريب مفسر لانعرفه مثل هذا إلا من هذا الوجه
অর্থ : এটি হাসান, গরীব ও মুফাসসার হাদীস; হাদীসটি এভাবে শুধু এই সূত্রেই আমরা পাই।-জামে তিরমিযী ২/৯২, হাদীস : ২৮৩২
ما أنا عليه وأصحابي অর্থাৎ নাজাতপ্রাপ্ত তারা, যারা ঐ পথে আছে, যে পথে আমি ও আমার সাহাবীরা রয়েছি। এখানে ‘মা’ দ্বারা সুন্নাহকে নির্দেশ করা হয়েছে। তাহলে এই হাদীসে ‘মা-আনা আলাইহি’ শব্দে তাই বলা হয়েছে, যা আগের হাদীসে ‘আলাইকুম বিসুন্নাতী’ শব্দে বলা হয়েছিল। অর্থাৎ আমার সুন্নাহকে ধারণ কর।
তাহলে আমরা দুটি বিষয় পেলাম : ১. সুন্নাহ তথা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ, যা সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাহও বটে। ২. জামাআ।
ইনশাআল্লাহ পরবর্তী পর্বে আসসুন্নাহ ও আলজামাআ শব্দের বিশ্লেষণ
http://www.islamforuniverse.com/archives/2125
প্রবন্ধটির লেখক মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক।
প্রতি মাসে কোনো না কোনো বিষয়ের উপর মুহাযারার (বিষয়ভিত্তিক আলোচনার) চেষ্টা করা হয়। আজকের মজলিসের আলোচ্য বিষয়, ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য’। আল্লাহ রাববুল আলামীন যদি তাওফীক দেন তাহলে কিছু আলোচনা হবে।
হাদীস শরীফে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাজাতপ্রাপ্ত দলের বৈশিষ্ট্য ও মানদন্ড উল্লেখ করেছেন। সেই মানদন্ড ও তার বাস্তব প্রয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করার ইচ্ছা আছে। এতে বোঝা যাবে কারা সেই বৈশিষ্ট্যের ধারক ও সেই মানদন্ডে উত্তীর্ণ। আর কারা তা ধারণে ব্যর্থ এবং কোথায় কোথায় ব্যর্থ।
আলোচনার প্রেক্ষাপট
গত শনিবার দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জে একটি মজলিস হয়েছিল। কথা ছিল, মুনাযারা বা বহছের মজলিস হবে। কিন্তু দুই দলের এক দল উপস্থিত না হওয়ায় বহসের মজলিস হয়নি। তবে একে কেন্দ্র করে বড় সমাবেশ হয়েছিল। অনেক তালিবুল ইলম, বিভিন্ন মাদরাসার মুদাররিস এবং আশপাশ থেকে অনেক সাধারণ মানুষ একত্র হয়েছিলেন। ওখানে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ হয়। কিন্তু যতটা বিস্তারিতভাবে, আরো দলিল-প্রমাণের উদ্ধৃতি সহকারে আলোচনার প্রয়োজন ছিল তখন সময় ও পরিবেশ না থাকায় তা হয়ে উঠেনি। আমাদের মনে হয়েছে, আমরা ঐ আলোচনা তালিবুল ইলম ভাইদের জন্য আরো বিশদভাবে করি। কারণ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা দলিল-প্রমাণের সাথে ভালোভাবে বুঝে নেওয়া সবার জন্য জরুরি।
কারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ নামের অধিকারী
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ অর্থ যারা সুন্নাহ ও জামাআকে ধারণ করে। শুধু দাবি করলেই এ নামের অধিকারী হওয়া যায় না। যারা মৌলিকভাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আদর্শ অনুসরণ করে, কিন্তু কোথাও কোথাও বিচ্যুত হয়ে যায়, তো যে অংশে বিচ্যুত হল সে অংশে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, ততটুকুর মধ্যে সে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর অন্তর্ভুক্ত নয়।
আরেকজন মৌলিকভাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আদর্শের উপর নেই, কিন্তু আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর একটি গুণ বা বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে আছে তাহলে ততটুকুর মধ্যে সে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর অনুসারী। তবে এভাবে শুধু একটি বা দুটি বৈশিষ্ট্যের দ্বারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ উপাধি অর্জন করা যাবে না।
আজকাল এই কথাটা আমাদের চিন্তায় থাকে না। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.
ما أنا عليه وأصحبابي
হাদীসটির ব্যাখ্যায় এ কথাটা বলেছেন। খুতবাতে হাকীমুল উম্মতে আছে। ইবনে রজব হাম্বলী রাহ.ও ‘জামেউল উলূমি ওয়াল হিকাম’ কিতাবে (পৃষ্ঠা : ৩২০, হাদীস : ২৭)
عليكم بسنتي হাদীসটির ব্যাখ্যায় তা লিখেছেন।
থানভী রাহ. বলেছেন, আকাইদ, মুয়ামালা, মুয়াশারা, এভাবে দ্বীনের সকল ক্ষেত্রে আপনাকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আদর্শের উপর থাকতে হবে। আপনি যদি শুধু আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আদর্শের উপর থাকেন, অন্যান্য বিষয়ে না থাকেন তাহলে আপনাকে কামিল সুন্নী বলা হবে না। সুতরাং এই চিন্তা ভুল যে, ইনতিসাব ও সম্বন্ধ হলেই সব হয়ে গেল বা উসূল ও আকাইদের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আদর্শ অনুসরণ করলেই সবকিছুর মধ্যে তাদের অনুসরণ হয়ে গেল কিংবা এক অংশে অনুসরণ হলেই সব অংশে অনুসরণ হয়ে গেল ইত্যাদি। এগুলো ভুল চিন্তা।
তেমনি যে বা যারা উসূল ও আকীদার ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আদর্শের উপর নেই তবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর একটি গুণ তার বা তাদের মধ্যে আছে, এই গুণটিকে অস্বীকার করাও ভুল। তো প্রথমে আমাদেরকে মানদন্ডটি ভালোভাবে বুঝতে হবে এবং বাস্তব জীবনে তা অনুসরণের চেষ্টা করতে হবে।
নামের শেষে নিসবত লাগানো কি জরুরি
আমাদের ইনতিসাব ও সম্বন্ধ দারুল উলূম দেওবন্দের সাথে। কারণ আমাদের সকল উস্তাদ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দারুল উলূম দেওবন্দের ফয়েযপ্রাপ্ত। আমাদের তালীম-তরবিয়ত হয়েছে আকাবিরে দেওবন্দের হাতে। কিন্তু এ কারণে নামের শেষে দেওবন্দী লাগাতে হবে এটা জরুরি নয়। আমাদের আকাবির তা জরুরি মনে করতেন না। হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রাহ.কে ‘থানভী’ বলা হয়। কারণ তার বাড়ি থানাভবনে। রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ.-যিনি দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, তাঁকে গাঙ্গুহী বলা হয়। কারণ তাঁর বাড়ি গঙ্গোহ গ্রামে। কাসেম নানুতুবী রাহ.কে ‘নানুতুবী’ বলা হয়। কারণ নানুতা তাঁর বাড়ি। তেমনি ইয়াককুব নানুতুবী রাহ.। মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রাহ.কে ‘দেওবন্দী’ বলা হয়। কারণ তার বাড়ি দেওবন্দে। মুফতী শফী রাহ. দেওবন্দী। কারণ তাঁর বাড়ি দেওবন্দ। এরপরেও তিনি অনেক সময় এ নিসবত লিখতেন না। তিনি বলতেন, আমার বাড়ি দেওবন্দ, পড়েছিও দেওবন্দে। তাহলে দুই দিক থেকে আমি দেওবন্দী। মাদরাসার দিকে নিসবত করেও দেওবন্দী বলতে পারি। আমার বাড়ি দেওবন্দ এ হিসেবেও দেওবন্দী বলতে পারি। এরপরেও এ নিসবত আমার পছন্দ নয়। কারণ অনেকে এ নিসবতের অপপ্রয়োগ করে। এ নিসবতগুলো তো আসাবিয়ত ও সাম্প্রদায়িতকার জন্য নয়। শুধু নিসবতের দ্বারা কোনো কিছু সাব্যস্ত হয় না, আবার কোনো কিছুর বিলোপও ঘটে না। অনেকে নিসবত থেকে আসাবিয়ত ও সাম্প্রদায়িকতার দুর্গন্ধ পায়। অথচ যিনি নিসবত ব্যবহার করেছেন তার চিন্তার সুদূর প্রদেশেও এই নাপাকী ছিল না।
হযরত যে কখনো দেওবন্দী লিখতেন না তা নয়। তবে অধিকাংশ সময় লিখতেন না। লিখলেও শুধু এজন্য লিখতেন যে, দেওবন্দ তাঁর বাড়ি এবং দেওবন্দ মাদরাসায় তিনি পড়াশোনা করেছেন।
কারো অন্যায় যেন আমাদেরকে না-ইনসাফীর উপর উদ্বুদ্ধ না করে
আমাদের সমাজে আরেকটি ভুলও ব্যাপকভাবে হয়। তা হচ্ছে, কুরআন মজীদের এই শিক্ষার উপর মযবুতীর সাথে না থাকা-
لا يجرمنكم شنآن قوم على ان لا تعدلوا اعدلوا هو اقرب للتقوى.
এ আয়াতের শিক্ষা হল, কারও অন্যায় ও শত্রুতা যেন আমাদেরকে না-ইনসাফীতে প্ররোচিত না করে।
এটা কোনো কথা হয় না যে, অমুক আমাকে গালি দিয়েছে, আমিও তাকে গালি দিব। অমুক আমাকে গোমরাহ বলেছে, আমিও তাকে গোমরাহ বলব। অমুক আমাকে বেদআতী বলেছে, আমিও তাকে বেদআতী বলব। অমুক আমাকে কাফির বলেছে, আমিও তাকে কাফির বলব। অমুক আমাকে ইংরেজের দালাল বলেছে আমিও তাকে ইংরেজের দালাল বলব। অমুক আমাকে ইহুদি-খৃস্টানের দালাল বলেছে, আমিও তাকে ইহুদি-খৃস্টানের দালাল বলব। এটা শরীয়তের শিক্ষা না। আল্লাহর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সুন্নাহ না। কুরআনের শিক্ষা হল-
ادفع بالتى هى احسن
হাঁ, এক জায়গায় আছে-
لا يحب الله الجهر بالسوء من القول الا من ظلم وكان الله سميعا عليما
এ আয়াতে মযলুমকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এখান থেকে একটা সুযোগ সীমিত পর্যায়ে বের হয়। তবে সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না। না-ইনসাফী করা যাবে না। কেউ যদি ভুল পথে চলে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর নীতি ও আদর্শের উপর না থাকে, এমনকি ইসলামের উপরও না থাকে, (নাউযুবিল্লাহ, নাউযুবিল্লাহ) তার ক্ষেত্রেও আমি ইনসাফ থেকে সরতে পারি না, তার উপর জুলুম করতে পারি না। তার সাথে আমার আচরণ হবে ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ অনুযায়ী। এটা আমাদেরকে মনে রাখতে হবে। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন। আমীন।
আজকের মূল বিষয় আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য। এ বিষয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ রাববুল আলামীন সহীহ বলার তাওফীক নসীব করুন। আমীন।
আলোচনার ভিত্তি কী হবে
এই পুরো আলোচনার ভিত্তি হবে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতু রাসূলিল্লাহ। আমরা আলোচনা শুরু করব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি প্রসিদ্ধ হাদীস দ্বারা, যে হাদীসটি দ্বীনের একটি বুনিয়াদী নীতির বাহক। হাদীসটি সুনান, মাসানীদ ও সিহাহ কিতাবসমূহে রয়েছে।
সিহাহ শব্দটি সহীহ শব্দের বহুবচন। যেসব কিতাবের সংকলকগণ শুধু সহীহ হাদীস সংকলনের নীতি গ্রহণ করেছেন সেসব কিতাবকে ‘সহীহে মুজাররাদ’-এর কিতাব বলা হয়। ‘সিহাহ সিত্তা’ শব্দটির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। এখানেও সিহাহ শব্দটি সহীহ-এর বহুবচন।
সিহাহ সিত্তা বা হাদীসের প্রসিদ্ধ ছয় কিতাবের প্রতিটির সকল হাদীস সহীহ-এই ধারণা ঠিক নয়। সুনানে ইবনে মাজাহসহ সুনানের অন্যান্য কিতাবে সহীহ-হাসানের বাইরে বিভিন্ন প্রকারের যয়ীফ হাদীসও রয়েছে।
তেমনি এ ধারণাও ঠিক নয় যে, এই ছয় কিতাবের বাইরে আর কোনো ‘সহীহ’ কিতাব নেই। এই ছয় কিতাবের বাইরে আরো ‘সহীহ’ কিতাব রয়েছে, যার সংকলকগণ শুধু সহীহ বা হাসান হাদীস সংকলনের নীতি গ্রহণ করেছেন। যেমন-মুয়াত্তা ইমাম মালেক ইবনে আনাস (মৃত্যু : ১৭৯ হিজরী), কিতাবুল আছার ইমাম আবু হানীফা (মৃত্যু : ১৫০ হি.) সহীহ ইবনে খুযায়মা (মৃত্যু : ৩১১ হিজরী) , সহীহ ইবনে হিববান (মৃত্যু : ৩৫৪ হিজরী)। সহীহ হাদীস সংকলনের উদ্দেশ্যে এই কিতাবগুলো লেখা হয়েছে। তেমনি যিয়াউদ্দীন আলমাকদেসীও এই নীতি গ্রহণ করেছেন। সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমের উপর যারা ‘মুস্তাখরাজ’ লিখেছেন, তাদের অনেকেরই এই নীতি ছিল। তদ্রূপ এই দুই কিতাবের উপর যেসব ‘মুসতাদরাক’ লেখা হয়েছে তার অনেকগুলোতেই এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।
আপনারা জানেন, ‘মুসতাদরাক’ বলা হয় বিশেষ ধরনের হাদীসের কিতাবকে। যেসব সহীহ ও হাসান হাদীস কিংবা প্রমাণ হিসেবে সরাসরি গ্রহণযোগ্য বা শাওয়াহেদ ও সমর্থক বর্ণনার সাথে গ্রহণযোগ্য যেসব হাদীস সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে সংকলিত হয়নি সেসব হাদীস যেসব গ্রন্থে সংকলন করা হয় তাকে ‘মুসতাদরাক আলাস সহীহাইন’ বলে।
এ রকম একটি প্রসিদ্ধ ‘মুসতাদরাক’ হচ্ছে হাকিম আবু আবদুল্লাহ (মৃত্যু : ৪০৫ হিজরী) সংকলিত মুসতাদরাক। এতে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। তবে এটি স্বীকৃত কথা যে, তিনি যেসব হাদীস সংকলন করেছেন বা যেগুলোকে সহীহ বলেছেন তার সবগুলো বাস্তবেও সহীহ এমন নয়। তবে এতে এমন অনেক হাদীস রয়েছে, যা বুখারী-মুসলিম বা তাদের কোনো একজনের শর্তে উত্তীর্ণ। হাফেয ইবনে হাজার রাহ. ‘আননুকাত’ কিতাবে এমন হাদীসের সংখ্যা হাজার খানেক বলেছেন। যদ্দুর মনে পড়ে, نحو ألف শব্দ সেখানে আছে।
তো আমি এখন যে হাদীসটি পড়ব তা সুনান-মাসানীদসহ অনেক কিতাবে আছে। এমনকি সহীহ শিরোনামে সংকলিত কোনো কোনো কিতাবেও আছে। যেমন, সহীহ ইবনে হিববানে হাদীসটি আছে। আমি এখন ইমাম বুখারী রাহ. ও ইমাম আবু দাউদ রাহ.সহ আরো অনেক ইমামের উস্তাদ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর সংকলিত ‘মুসনাদ’ থেকে হাদীসটি পড়ছি।
আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. বলেন-
حدثنا الوليد بن مسلم، حدثنا ثور بن يزيد، حدثنا خالد بن معدان قال : حدثنا عبد الرحمن بن عمرو السلمي وحجر بن حجر قالا : أتينا العرباض بن سارية وهو ممن نزل فيه، ولا على الذين إذا ما أتوك لتحملهم قلت لا أجد أحملكم عليه فسلمنا وقلنا : أتيناك زائرين وعائدين ومقتبسين، فقال عرباض : صلى بنا رسول الله صلى الله عليه وسلم الصبح ذات يوم، ثم أقبل علينا، فوعظنا موعظة بليغة ذرفت منها العيون، ووجلت منها القلوب، فقال قائل : يا رسول الله! كأن هذه موعظة مودع، فماذا تعهد إلينا؟ فقال : أوصيكم بتقوى الله، والسمع والطاعة، وإن كان عبدا حبشيا، فإنه من يعش منكم بعدي فسيرى اختلافا كثيرا. فعليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين، تمسكوا بها، وعضوا عليها بالنواجذ، وإياكم ومحدثات الأمور، فإن كل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة.
হাদীস : ১৭১৪৫, ২৮/৩৭৫; মুয়াসসাসাতুর রিসালা থেকে প্রকাশিত শায়খ শুয়াইব আলআরনাউত ও তাঁর সঙ্গীদের তাহকীককৃত (সম্পাদিত নুসখা)।
এরপর আরো দুটি সনদ রয়েছে। ১৭১৪২ নং রেওয়াতের টীকায় শায়খ শুয়াইব আলআরনাউত ও তাঁর সঙ্গীরা উক্ত হাদীসের বিভিন্ন রেওয়াত, সমর্থক বর্ণনা ও তাখরীজসহ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
মূল হাদীসের তরজমা
ইরবায ইবনে সারিয়া রা. বলেন, একদিন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিয়ে ফজরের নামায পড়লেন। এরপর আমাদের দিকে ফিরে এক সারগর্ভ বক্তৃতা করলেন। এতে আমাদের চোখ অশ্রুসজল হল এবং হৃদয় ভীতকম্পিত হল। একজন আরজ করলেন, আল্লাহর রাসূল! এ যেন বিদায়কালের উপদেশ। আপনি আমাদের (আরো) কী অসীয়ত করছেন? আল্লাহর রাসূল বললেন, তোমাদেরকে অসীয়ত করছি আল্লাহকে ভয় করার এবং আমীর হাবাশী গোলাম হলেও তার আনুগত্য করার। কারণ আমার পর তোমাদের যারা বেঁচে থাকবে তারা বহু ইখতিলাফ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাহ ও আমার হেদায়েতের পথের পথিক খলীফাগণের সুন্নাহকে সর্বশক্তি দিয়ে ধারণ করবে। আর সকল নবউদ্ভাবিত বিষয় থেকে দূরে থাকবে। কারণ সকল নবউদ্ভাবিত বিষয় বিদআত। আর সকল বিদআত গুমরাহী।
হাদীসের ব্যাখ্যা
আল্লাহর রাসূলের বয়ান থেকে সাহাবায়ে কেরামের মনে হয়েছে, এটি তাঁর বিদায়ী বয়ান। তাই তাঁরা কিছু মৌলিক নীতি চেয়েছেন, যা তাঁর অনুপস্থিতে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে। জওয়াব থেকে বোঝা যাচ্ছে, তাঁরা একটি মানদন্ড চেয়েছেন, যার দ্বারা দ্বন্দ ও মতভেদের ক্ষেত্রে ফয়সালা করা যাবে। আল্লাহর রাসূল বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আমার পর বেঁচে থাকবে তারা বহু ইখতিলাফ দেখতে পাবে।’
এখানে ইখতিলাফটা ব্যাপক। যে কোনো ধরনের ইখতিলাফ হতে পারে। ইখতিলাফ যখন হবে তখন করণীয় কী? আল্লাহর রাসূল বললেন, ‘আমার সুন্নাহ ও আমার হেদায়েতপ্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নাহকে সর্বশক্তি দিয়ে ধরে রাখবে। অর্থাৎ যে সরল পথ ও উজ্জ্বল আদর্শের উপর তোমাদেরকে রেখে যাচ্ছি এর উপর অটল-অবিচল থাকতে চাইলে আমার সুন্নাহ এবং রাশেদ ও মাহদী খলীফাগণের সুন্নাহকে আকড়ে ধরে রাখবে। এরপর বলেছেন, ‘নবআবিষ্কৃত বিষয়াদি থেকে দূরে থাকবে।’
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের হাদীসে আছে-
من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد
যে আমাদের এই বিষয়ে (দ্বীন ও শরীয়তে) নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটায় তা পরিত্যাজ্য।
এ হাদীসের আলোকে উপরের হাদীসের অর্থ হয়, দ্বীনের নামে যা কিছু প্রচার করা হবে অথচ তা দ্বীন হওয়ার কোনো দলিল নেই, তা পরিত্যাজ্য। এ হাদীসে وكل بدعة ضلالة পর্যন্ত আছে। অর্থাৎ সকল বিদআত গোমরাহী। সহীহ মুসলিমে জাবির রা.-এর হাদীসে আরেকটি কথা আছে। তা হল-وكل ضلالة في النار অর্থাৎ সকল গোমরাহীর ঠিকানা জাহান্নাম।
হাদীসের মান
হাদীসটি সহীহ। পরিভাষায় ‘সহীহ’ ও ‘হাসান’ বলে যে পার্থক্য করা হয় তা একটি পারিভাষিক পার্থক্য। উসূলে হাদীস অনুযায়ী দু ধরনের হাদীসই দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য। মূলত তা সহীহ হাদীসেরই দুটি স্তরের নাম। ‘সহীহ’ প্রথম স্তরের। ‘হাসান’ দ্বিতীয়
স্তরের, তবে এর দ্বারাও শরীয়তের আহকাম ও বিধান প্রমাণ হয়। আমাদের আলোচিত হাদীসটি পরিভাষার দিক থেকেও সহীহ। আবার সাধারণ সহীহ নয়; বরং ঐ প্রকারের সহীহ, যাকে পরিভাষায় الصحيح المتلقى بالقبول বলে। অর্থাৎ আহলে ইলম ও আহলুল হাদীসের মাঝে যেটি সহীহ হওয়ার বিষয়ে কোনো মতভেদ নেই, সকলেই যাকে শরীয়তের সূত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন-এটি এমন পর্যায়ের সহীহ হাদীস।
দেখুন, আমি যে ‘আহলুল হাদীস’ শব্দটি বললাম এর অর্থ হাদীসশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ মনীষীবৃন্দ, যারা নকদে হাদীস ও নকদে ইসনাদ তথা হাদীসের সনদ-মতন বিচারের শাস্ত্রসমূহের পারদর্শী। এটিই এ শব্দের পুরনো ব্যবহার। যাই হোক, এটা এখন আলোচ্য বিষয় নয়।
ইমাম আবু নুয়াইম আলআসফাহানী রাহ. (মৃত্যু : ৪৩০ হিজরী)-এর মন্তব্য
ইমাম আবু নুয়াইম রাহ. সহীহ মুসলিমের উপর ‘মুসতাখরাজ’ লিখেছেন। ঐ কিতাবের ভূমিকায় তিনি এ হাদীস সহীহ হওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর আরেকটি কিতাব ‘কিতাবুয যুআফা।’ এটি মূলত ‘আলমুসতাখরাজ’-এর মুকাদ্দামা, যা আলাদাভাবে ছাপা হয়েছে বা তিনি নিজেই আলাদা করে সংকলন করেছেন। এতেও এ হাদীস সহীহ হওয়ার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তার আলোচনাটি পড়ছি :
هذا حديث جيد من صحيح حديث الشاميين، وهو وإن تركه الإمامان محمد بن إسماعيل البخاري ومسلم بن الحجاج فليس ذلك من جهة انكسار منهما له، فإنهما رحمهما الله قد تركا كثيرا مما هو بشرطهما أولى وإلى طريقتهما أقرب، وقد روى هذا الحديث عن العرباض بن سارية ثلاثة من تابعي الشام معروفين مشهورين.
এ আরবী পাঠে ‘ইনকিসার’ শব্দটি ছাপার ভুল। সঠিক পাঠ হল ‘ইনকার’। ইবনে রজব হাম্বলী রাহ. আবু নুয়াইম রাহ.-এর হাওয়ালায় ‘জামিউল উলুমি ওয়াল হিকাম’ কিতাবে এই ইবারত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে ‘ইনকিসার’ এর পরিবর্তে ‘ইনকার’ শব্দ আছে।
ইমাম আবু নুয়াইম বলেন, এটি একটি ‘জাইয়েদ’ হাদীস, যা শামের রাবীদের সূত্রে বর্ণিত সহীহ হাদীসের অন্যতম। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাইল বুখারী ও ইমাম মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ যদিও হাদীসটি তাঁদের কিতাবে আনেননি, তবে তা হাদীসটিকে সহীহ মনে না করার কারণে নয়। তাঁরা তো এমন অনেক হাদীস ছেড়ে দিয়েছেন যেগুলো তাদের সংকলিত হাদীস থেকেও- তাঁদের নীতি ও মানদন্ডের অধিক নিকটবর্তী। এ হাদীসটি ইরবায ইবনে ছারিয়া রা. থেকে বর্ণনা করেছেন শামের প্রসিদ্ধ ও বিখ্যাত তিনজন তাবেয়ী।
এরপর একটু সামনে গিয়ে এ হাদীসের নির্দেশনা সম্পর্কে বলেন-
فتلقت الهداة العقلاء وصية نبيهم صلى الله عليه وسلم بالقبول ولزموا التوطن على سنته وسنة الهداة المرشدة من الخلفاء، فلم يرغبوا عنه بل علموا أن الثبوت عليه غير ممكن إلا بتتبع ما سنه عليه السلام وسنه بعده أئمة الهدى الذين هم خلفائه في أمته فتركوا الاشتغال بهواجس النفوس وخواطر القلوب، وما يتولد من الشبهات التي تولد آراء النفوس وقضايا العقول خوفا من أن يزيغوا عن المحجة التي فارقهم عليها رسول الله صلى الله عليه وسلم الذي شبه ليلها بنهارها مع ما جاءهم عن الله تعالى من الوعيد البليغ المصرح بنفي الإيمان عما خالفه عليه السلام أوطعن على أحكامه ولم تطب نفسه بالتسليم له. انتهى (المستخرج على صحيح المسلم)
অর্থাৎ তো হেদায়েতের দিশারী প্রাজ্ঞজনরা তাঁদের নবীর এই অসীয়তকে শিরোধার্য করেছেন এবং তাঁর সুন্নাহ ও খলীফাগণের সুন্নাহর উপর নিজেদেরকে আবদ্ধ রেখেছেন, যারা ছিলেন হেদায়েতপ্রাপ্ত ও হেদায়েতের দিশারী। তা থেকে বিমুখ হননি। বরং তারা নিশ্চিত জেনেছেন যে, আল্লাহর রাসূল যে সুন্নাহ জারি করেছেন এবং তাঁর পর হেদায়েতের ইমামগণ যে সুন্নাহ জারি করেছেন, যাঁরা ছিলেন উম্মতের মাঝে তাঁরই উত্তরসূরী, তা অন্বেষণ করা ছাড়া দ্বীনের উপর অবিচল থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং তারা মনের খেয়াল, মস্তিষ্কের কল্পনা এবং বুদ্ধি ও প্রবৃত্তির মত ও মতবাদ থেকে জন্ম নেওয়া সংশয় ও বিভ্রান্তিতে আত্মনিয়োগে করেননি। ঐ উজ্জ্বল রাজপথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার ভয়ে, যার উপর দাড় করিয়ে আল্লাহর রাসূল তাদের থেকে বিদায় নিয়েছেন। উপরন্তু আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে এসেছে ঈমান হারা হওয়ার কঠিন হুঁশিয়ারি তাদের জন্য, যারা আল্লাহর রাসূলের বিরোধিতা করে, তাঁর বিধি বিধানের নিন্দা করে কিংবা তাঁর প্রতি আত্মসমর্পিত হতে বিরত থাকে।-আলমুসতাখরাজ ১/৩৭
এটি দ্বীনের একটি বুনিয়াদী হাদীস এবং সর্বসম্মতভাবে সহীহ। অথচ এই বুনিয়াদী হাদীসটি সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমে নেই। এ কারণে কোনো হাদীস শুধু ঐ দুই কিতাবে না থাকলে তা হাসান বা যয়ীফ মনে করা সম্পূর্ণ ভুল। এ হাদীস একটি স্পষ্ট উদাহরণ যে, সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের বাইরেও সহীহ হাদীস আছে।
তেমনি যারা মনে করেন, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ছাড়া কোথাও সহীহ হাদীস নেই। থাকলেও তা দ্বিতীয় পর্যায়ের সহীহ হাদীস-তাদের ধারণাও ভুল। কেননা ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম সকল সহীহ হাদীস সংকলনের ইচ্ছাও করেননি। এ কথা তাঁরা স্পষ্ট ভাষায় বলে গেছেন। বিভিন্ন সনদে তাঁদের এই কথা বর্ণিত আছে। খাত্তাবী রাহ. সহীহ বুখারীর ভাষ্যগ্রন্থের ভূমিকায় তা উদ্ধৃত করেছেন। আরো অনেকেই উল্লেখ করেছেন।
তো এই হাদীসের মান বিষয়ক আলোচনায় আমরা একটি সুন্দর ফায়দাও পেলাম। তা হচ্ছে কোনো সহীহ হাদীস সহীহাইনে না থাকলে এ আপত্তি করা যাবে না যে, কেন তা ঐ দুই কিতাবে নেই!
তো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর পরিচয় ও বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে এটি বুনিয়াদী হাদীস। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইখতিলাফ হলে আমার সুন্নাহ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহকে ধারণ করবে। তাহলে বুঝা গেল, নাজাতপ্রাপ্ত দলের একটি মানদন্ড সুন্নাহ, অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর দ্বিতীয় রোকন ‘আলজামাআ’। এটিও হাদীস শরীফে আছে। এ সংক্রান্ত হাদীসটি সুনানে আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ ও সুনানে দারেমী ইত্যাদি কিতাবে আছে। সুনানে আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমদে হাদীসটি যেভাবে আছে তা হল-
عن أبي عامر عبد الله بن لحي قال : حججنا مع معاوية بن أبي سفيان، فلما قدمنا مكة قام حين صلى صلاة الظهر، فقال : إن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : إن أهل الكتابين افترقوا في دينهم على ثنتين وسبعين ملة، وإن هذه الأمة ستفترق على ثلاث وسبعين ملة، يعني الأهوءا، كلها في النار إلا الواحدة، وهي الجماعة … انتهى.
আবু আমির আবদুল্লাহ বলেন, আমরা মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান রা.-এর সাথে হজ্ব করলাম। যখন মদীনায় এলাম যোহরের নামাযের পর তিনি দাঁড়ালেন এবং বললেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পূর্বের দুই কিতাবধারী সম্প্রদায় তাদের ধর্মে বায়াত্তর মিল্লাতে বিভক্ত হয়েছিল। আর এই উম্মত বিভক্ত হবে তেয়াত্তর মিল্লাতে। অর্থাৎ নিজস্ব খেয়াল-খুশির অনুসারী বিভিন্ন দল। সবগুলো দল জাহান্নামী হবে একটি ছাড়া। আর সেটি হচ্ছে ‘আলজামাআ’।-মুসনাদে আহমদ ২৮/১৩৪ (মুয়াসসাসাতুর রিসালা থেকে প্রকাশিত শায়খ শুআইব আলআরনাউত কর্তৃক সম্পাদিত নুসখা), হাদীস : ১৬৯৬৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪৫৯৭
হাদীসটির মান
এ হাদীস সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেছেন-
الحديث صحيح مشهور في السنن والمسانيد، كسنن أبي داود والترمذي والنسائي وغيرهم
অর্থ : হাদীসটি সহীহ। এটি সুনান ও মাসানীদের কিতাবের মশহূর হাদীস। আবু দাউদ, তিারমিযী, নাসায়ী ও অন্যান্যদের সুনানে তা আছে।-মাজমুউল ফাতাওয়া ৩/৩৪৫
জামে তিরমিযীতে হাদীসটির পাঠ এই-
تفترق أمتي على ثلاث وسبعين ملة، كلهم في النار إلا ملة واحدة، قالوا : من هي يا رسول الله؟ قال : ما أنا عليه وأصحابي.
অর্থাৎ আমার উম্মত তিয়াত্তর মিল্লাতে বিভক্ত হবে। একটি ছাড়া বাকি সবগুলোই যাবে জাহান্নামে। সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর রাসূল! সেই এক দলে কারা থাকবেন? বললেন, মা আনা আলাইহি ওয়া আসহাবী। অর্থাৎ যারা আমার ও আমার সাহাবীদের আদর্শের উপর থাকবে।-জামে তিরমিযী ২/৯২, হাদীস : ২৮৩২
ইমাম তিরমিযী রাহ. বলেছেন-
هذا حديث حسن غريب مفسر لانعرفه مثل هذا إلا من هذا الوجه
অর্থ : এটি হাসান, গরীব ও মুফাসসার হাদীস; হাদীসটি এভাবে শুধু এই সূত্রেই আমরা পাই।-জামে তিরমিযী ২/৯২, হাদীস : ২৮৩২
ما أنا عليه وأصحابي অর্থাৎ নাজাতপ্রাপ্ত তারা, যারা ঐ পথে আছে, যে পথে আমি ও আমার সাহাবীরা রয়েছি। এখানে ‘মা’ দ্বারা সুন্নাহকে নির্দেশ করা হয়েছে। তাহলে এই হাদীসে ‘মা-আনা আলাইহি’ শব্দে তাই বলা হয়েছে, যা আগের হাদীসে ‘আলাইকুম বিসুন্নাতী’ শব্দে বলা হয়েছিল। অর্থাৎ আমার সুন্নাহকে ধারণ কর।
তাহলে আমরা দুটি বিষয় পেলাম : ১. সুন্নাহ তথা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ, যা সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাহও বটে। ২. জামাআ।
ইনশাআল্লাহ পরবর্তী পর্বে আসসুন্নাহ ও আলজামাআ শব্দের বিশ্লেষণ
http://www.islamforuniverse.com/archives/2125
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন