শনিবার, ১৪ জুলাই, ২০১২

দেওবন্দ মাদ্রাসায় হারমে মক্কার ইমাম শাইখ সউদ বিন ইবরাহীম আশশুরাইম এর ইমান দীপ্ত ভাষণ



দেওবন্দ মাদ্রাসার রশিদিয়া জামে মসজিদে গত ৪ ঠা মার্চ ২০১২ তারিখে তিনি এই ভাষণ দেন
প্রথমেই তিনি আল্লাহর প্রশংসা করেন এবং রসুল সঃ এর প্রতি দরুদ পাঠ করেন
তারপরে বলেন

হযরত মাওলানা ছৈয়দ আরশাদ মাদানি, হযরত মাওলানা মুফতি আবুল কাছেম নোমানী এবং সম্মানিত উপস্থিতি আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু। আমি যখন জানতে পারলাম যে আমার এই [ ভারত ] ছফরে আমার সেই সব ভাইদের সাথেও দেখা হবে যাদের সম্পর্কে আমি অনেক কিছুই শুনতাম। কোনোও বৈঠকে যদি ভারতের মুসলমানদের আলোচনা আসত তখন সেখানে দেওবন্দের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আলোচনা অবশ্যই হত।
এমন কোনো মানুষ আমি দেখিনি যে ভারত আর ভারতের মুসলমানদের অবস্থা আলোচনা করেছে অথচ দেওবন্দের আলোচনা করেনি। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের [দেওবন্দ] দীনি খেদমত শুধু ভারতে নয় বরং সারা বিশ্বে বিস্তার লাভ করেছে। ভারত আর ভারতের মুসলমানদের দীনি খেদমাতের আলোচনার অনুষ্ঠানে এই প্রতিষ্ঠানের আলোচনা নাহলে সেটা অবশ্যই দেওবন্দের হক আদায় না করার শামিল হবে শুধু তাই নয় বরং সেটা অগ্রহণযোগ্য আচরণও হবে।
যুগ যুগ ধরে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা সর্বজন বিধিত। শুধু ভারত বলে কথা নয় সারা বিশ্বে মানুষের মুখে মুখে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম শুনা যায়। আল্লাহর শুকর যে তিনি আমাকে সেই প্রতিষ্ঠানে এসে আপনাদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ দিয়েছেন যে প্রতিষ্ঠানের কথা আমি অনেকে দিন ধরে শুনে আসছি।

যেহেতু এই অনুষ্ঠানে বাছাই করা, ভদ্র, শিক্ষিত, কোরান হাদিসের ধারক বাহকগণ উপস্থিত আছেন, তাই আমি এই খুশির সময় দরকারি একটি বিষয়ে কিছু কথা পেশ করার আশা রাখি। যে বিষয়টিতে প্রত্যেক মুসলমানের বিশেষ করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্রদের অংশ গ্রহণ খুব জরুরী। আর তাহলো দীনের দাওয়াতের জন্য প্রত্যেকের সর্ব শক্তি নিয়োগ করা এবং এই দাওয়াতের গুরুত্বপূর্ণ জিম্মাদারি আদায় করতে সব রকমের সুযোগকে কাজে লাগানো। এর জন্য দুটি বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরী।

প্রথমত: এখলাছ। দাওয়াতের কাজ অবশ্যই এখলাছের সাথে করতে হবে। সুতরাং দাওয়াতের কাজ যদি দায়ীর উপাধি অর্জন করার জন্য হয় বা এলম অন্বেষণের উদ্দেশ্য যদি আলেম উপাধি অর্জন করা হয় অথবা এই কাজের উদ্দেশ্য যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া দুনিয়াবি অন্য কোনো কিছু অর্জন করা হয় তাহলে এই মেহনত আর এই চেষ্টা সব ব্যর্থ বলে সাব্যস্ত হবে।
আর দ্বিতীয়ত: এই দাওয়াতের কাজ করতে হবে নবী করীম সঃ এর পবিত্র সুন্নাতের আলোকে। এবং দায়ীকে খেয়াল রাখতে হবে তিনি যেন নবী সঃ এর অনুসরণ থেকে চুল পরিমাণও সরে না যান। অন্যথায় এই কাজ বাতিল বলে গণ্য হবে এবং অনর্থক হবে। রাসুলের সুন্নাতের অনুসরণ ছাড়া কাজ করা হলে মানুষের সময়ও নষ্ট হয় এবং এই কাজের বিনিময়ে সে দুনিয়াতেও কিছু পায় না আর আখেরাতেও কিছু পায় না।

ছাত্রদেরকে বিশেষ করে দারুল উলূমের ছাত্রদেরকে এই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে যে অমুসলিমদের সাথে আপনাদের আচার-আচরণ চলা-ফেরা যেন নম্র, ভদ্র, মার্জিত আর সুন্দর হয়। আপনাদের অনেকটা সময় তাদের সাথে অতিবাহিত হয়, তাই খেয়াল রাখতে হবে তাদের কোনো আচরণের যেন আপনাদের মনে খারাপ ধারণা জন্ম না নেয়। আর আপনাদের আচরণেও যেন তারা মনে কষ্ট না পায়। তাদের কোনো কাজের যদি প্রতি উত্তর দিতে ইচ্ছে হয় তাহলে শুধু এটাই করা উচিত যে আপনি কামনা করুন সে যেন মুসলমান হয়ে যায়। যেভাবে আপনি মুসলমান হওয়ার কারণে আল্লাহর বড় এক নেয়ামতের অধিকারী হয়েছেন ঠিক সেভাবে আপনার সেই ভাইও যেন আল্লাহর নেয়ামত প্রাপ্ত হতে পারে সেই কামনা করুন।

আল্লাহ তালা নবী করিম সঃ এর গুনাগুণের মধ্যে “তলোয়ারের শক্তি” বা “অতুলনীয় বাহাদুর” বলেননি। বরং বলেছেন তিনি উন্নত চরিত্রের অধিকারী। তার নম্র স্বভাব আর দয়া মায়ার কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ ﴿٤﴾ আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী। সুরা আল কলম।= ৪ فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّـهِ لِنتَ لَهُمْ ۖ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন পক্ষান্তরে আপনি যদি রাগ ও কঠিন হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। সুরা আলে ইমরান =১৫৯ لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُم بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ ﴿١٢٨﴾ তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়। সুরা আত তওবা = ১২৮

عَزِيزٌ এর অর্থ এই যে উম্মতের দুরবস্থা আর দীন থেকে দূরে থাকাটা রসুল সঃ এর কাছে দুঃসহ ছিল। حَرِيصٌ عَلَيْكُم তোমাদের কল্যাণের প্রবল আগ্রহী আর رَّحِيمٌ بكم তোমাদের উপর দয়াবান, এই দুটি গুন ছাত্রদের কাছে থাকা খুব দরকার। আপনাদের কামনাও এই হওয়া উচিত যে আপনার প্রতিবেশী যেন মুসলমান হয়ে যায়। এজন্য তার সাথে নম্র আচরণ করতে হবে। আপনাকে দেখে যেন সে ইসলামের প্রতি আগ্রহী হয়।
কঠোরতা দাওয়াতি কাজের জন্য ক্ষতিকর। এর দ্বারা ঘৃণাই শুধু বাড়ে। প্রমাণ হিসেবে সেই গ্রাম্য ব্যাক্তির কিচ্ছা স্মরণ করা যেতে পারে যে মসজিদে নববীতে এসে পেশাব করে দিয়েছিল। সাহাবায়ে কেরাম তাকে বকাবকি করতে লাগলেন। তখন রসুল সঃ তাদেরকে কঠোরতা থেকে বিরত থাকতে বললেন।এবং তার সাথে নম্র ব্যবহারের আদেশ দিলেন। কেননা রসুল সঃ জানতেন যে এই ব্যাক্তি অজ্ঞতার কারণে এই কাজ করেছে। আর নাহলে সে মসজিদে নববীর মত পবিত্র জায়গায় এই অনুচিত কাজ করতো না।

এখানে লক্ষ্য করার বিষয় এইযে সেই ব্যাক্তি নিশ্চয় বড় অন্যায় করেছে কিন্তু নবী করিম সঃ জানতেন যে এই ব্যাক্তির সাথে নম্র ব্যবহারের ফলে যে ফলাফল হতে পারে তা কঠোরতার দ্বারা হতে পারে না। একারণেই রসুল সঃ তার সাথে নম্র ব্যবহার করলেন এবং সাহাবায়ে কেরামকেও তার সাথে নম্র ব্যবহারের আদেশ দিলেন। পরে যখন রসুল সঃ তাকে নরম ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন যে এটা মসজিদ এখানে আল্লাহর ইবাদাত করা হয়। তখন সেই গ্রাম্য ব্যাক্তি কি বলল? বলল হে আল্লাহ আমারকে আর মুহাম্মদকে ক্ষমা করুন। আর কাওকে ক্ষমা করবেন না।
দেখুন সেই গ্রাম্য ব্যাক্তি শুধু তার জন্য দোয়া করেছে যে তার সাথে নম্র ব্যবহার করেছে। আর যারা তার সাথে কঠোরতা করেছে তারা দোয়া থেকে বঞ্চিত হল।

এরকম আরোও একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। নবী করীম সঃ এক ইহুদির প্রতিবেশীর অসুখের সময় তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। সেই ব্যাক্তি মুসলমানও ছিলনা তারপরে রসুল সঃ তাকে দেখতে গেলেন। তিনি একথা বলেননি যে সেতো অমুসলিম, আমি তাকে দেখতে যাব কেন? তাই প্রত্যেক ব্যাক্তিকেই দাওয়াতের গুরুত্ব বুঝতে হবে। কামনা করতে হবে আমার আত্মীয় স্বজন আমার প্রতিবেশী এমনকি দেশের প্রত্যেক অধিবাসী যেন মুসলমান হয়ে যায়। রসুল সঃ এই উদ্দেশ্যেই ইহুদিকে অসুখের সময় দেখতে গিয়েছিলেন। নিশ্চয় এটি বড় একটি উদ্দেশ্য। তিনি একারণে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন যে এটি সেই ইহুদির জন্য ইসলাম গ্রহণে সহায়ক হতে পারে।এটাই ছিল রসুল সঃ এর উন্নত চরিত্র। উম্মতের প্রত্যেক ব্যাক্তির জন্য রসুল সঃ এর পদাঙ্ক অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরী।
আল্লাহর শুকর যে এই দারুল উলূমে ফিকাহ, হাদিস, তাফসীর, আক্বীদা সহ সব ধরণেই ইসলামী জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হয়। সাথে সাথে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে আমাদের আচরণ যেন মুসলমান আর অমুসলিম সবার সাথে একই রকমের হয়। আপনাদের কাছে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে আপনারা কী চান যে অমুসলিমরা ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হোক? নিশ্চয় আপনাদের জবাব হবে ইতিবাচক। তাহলে মনে রাখতে হবে শুধু ইতিবাচক জবাব দ্বারাই সেই আশা পূরণ হতে পারে না যদি আমাদের আচরণ রসুল সঃ এর আচরণের মত নাহয়।

এজন্য মানুষের অন্তরকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে তাদেরকে বুঝাতে হবে যে এই দীন পুরোপুরিই আল্লাহর রহমত। এখানে অনিয়ম, ভারসাম্যহীনতা, কঠোরতা এবং ঘৃণার কোনোও স্থান নাই। এটা হচ্ছে ভাতৃত্ব, মায়া মমতা, মান সম্মান, নম্রতা, এবং পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতার ধর্ম। বন্ধুগণ আমাদেরকে এই সব গুন অর্জন করতে হবে। এই অল্প সময়ে এই সংক্ষিপ্ত কথা পেশ করলাম। আল্লাহ তালার কাছে দোয়া করি তিনি যেন আমাদেরকে তার নাম ও গুণাবলির বরকতে তার মর্জি মতে চলার তাওফিক দেন।

দোয়া।
হে আল্লাহ আমাদেরকে ভাল কাজ করার আর ভাল কথা বলার তাওফিক দিন। খারাপ কথা আর খারাপ কাজ থেকে আমাদেরকে হেফাজত করুন। আপনি ছাড়া আর কেও আমাদের হেফাজত কারী নাই। হে আল্লাহ আমাদের অন্তর আর আমাদের জিহ্বাকে আপনি হেদায়েতের আলোয় আলোকিত করে দিন। আর আমাদের কাজ ও কথাকে আপনি ঠিক করে দিন। হে আল্লাহ আপনি যাদেরকে হেদায়েত দিয়েছেন তাদের সাথে আমাদেরকেও হেদায়েত দিন আর আপনি যাদেরকে [আফিয়ত ] নিরাপত্তা দিয়েছেন তাদের সাথে আমাদেরকেও নিরাপত্তা দিন। আর যাদেরকে আপনি পথ প্রদর্শন করেছেন তাদের সাথে আমাদেরকেও পথ প্রদর্শন করুন। আমাদেরকে দেয়া আপনার নেয়ামত গুলোতে বরকত দিন। হে আল্লাহ আমাদের পরিণতি ভাল করুন। হে আল্লাহ আমাদের সব কাজের ফলাফল আপনি ভালই করুন। আমাদেরকে দুনিয়ার অপমান এবং আখেরাতের আযাব থেকে রক্ষা করুন।

হে আল্লাহ আপনি আমাদের উপর সন্তুষ্ট থাকা অবস্থায় যেন আমাদের মৃত্যু হয়, আপনার অসন্তুষ্ট অবস্থায় যেন না হয়। হে আল্লাহ দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার সময় আমাদের মুখে যেন কালেমায়ে শাহাদাত থাকে সেই ব্যবস্থা আপনি করুন। হে আল্লাহ আমাদেরকে আপনার দীনের উপর স্থায়ী রাখুন। হে অন্তরের মালিক আপনি আমাদের অন্তর সমূহকে আপনার দীনের সাথে লাগিয়ে রাখুন। হে আল্লাহ হেদায়েতের পরে আবার আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করবেন না। আপনার বিশেষ রহমত দিয়ে আমাদেরকে ঢেকে দিন। হে আল্লাহ আমাদেরকে দুনিয়া এবং আখেরাতের সফলতা দিয়ে জাহান্নাম থেকে আমাদেরকে বাঁচিয়ে দিন।
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু।
 
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন