সোমবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৩

৬ এপ্রিল লংমার্চ-পরবর্তী মতিঝিল শাপলা চত্বরে শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ্ আহমদ শফীর পঠিত ভাষণ

সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত, নিশ্চয়ই মিথ্যা অপসৃয়মাণ (আল-কোরআন)। হাজারো বাধা প্রতিবন্ধকতার জাল ছিন্নভিন্ন করে সকল অপশক্তির রক্তচক্ষু এবং তাদের তাবত্ ষড়যন্ত্র ও বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ১৩ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আজকের এই মহাজনসমুদ্রে উপস্থিত দেশের ওলামা-মাশায়েখ, ছাত্র-শিক্ষক ও আমার সংগ্রামী তৌহিদি জনতা।
সত্যের কথা বললে, ন্যায় ও ইনসাফের কথা বললে বাতিল অপশক্তির গাত্রদাহ শুরু হয়, সত্যের টুঁটি চেপে ধরে হত্যা করার অপচেষ্টা করা হয়; কিন্তু বাতিল অপশক্তি কোনোকালেই টিকে থাকতে পারেনি, অত্যন্ত গ্লানিকর অবস্থায় তাদের পরাজয় হয়েছে, ইতিহাস তার জ্বলন্ত সাক্ষী। এখনও কোনো বাতিল শক্তি টিকে থাকতে পারবে না। তারাই ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। বিজয় হবে সত্যবাদীদের এই বিশ্বাস আমাদের আছে। কেননা আল্লাহর ইরশাদ : ‘সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত নিশ্চয়ই মিথ্যা অপসৃয়মাণ।’ এই বাণী অচিরেই বাংলার মাটিতে বাস্তবায়িত হবে ইনশাল্লাহ! আপনারা হিম্মত করে বাতিলকে রুখে দাঁড়ান, বাতিল অপশক্তি আপনাদের পায়ের নিচে মাথানত করতে বাধ্য হবেই হবে।
শয়তান হজরত আদম (আ.)-কে মিথ্যার পথে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। হজরত আদম (আ.) শয়তানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই শয়তান হয়েছে অভিশপ্ত, লানতপ্রাপ্ত ও বিতাড়িত। হজরত নূহ (আ.) সত্যের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন বলেই তার বিপথগামী জাতি ধ্বংস হয়েছিল। হজরত লুত (আ.), হজরত ইউনুস (আ.) সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন বলেই তাদের বিজয় অর্জিত হয়েছে। হজরত মুসা (আ.) সত্যের পতাকা বহন করেছিলেন বলেই ফেরাউন ও তার বাহিনী সাগরে নিমজ্জিত হয়ে ধ্বংস হয়েছে। হজরত ইবরাহিম (আ.) সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন বলেই আগুন তাকে জ্বালাতে পারেনি; বরং একটি সামান্য মশার আক্রমণে নমরূদের অপমানজনক মৃত্যু হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী, আবরাহা আল্লাহর ঘর ধ্বংস করতে বিশাল হস্তিবাহিনী নিয়ে এগিয়ে এলে তাকে এবং তার বাহিনীকে ছোট পাখির দ্বারা আল্লাহতায়ালা ধ্বংস করে দিয়েছেন। আমাদের প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যের আহ্বানকে স্তিমিত করার হীন মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল আবু জাহেল, আবু লাহাবসহ আরবের কাফের মুশরিকচক্র; কিন্তু তারাই পৃথিবীর আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। আর ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র বিশ্ব-জাহানে।
এরপর বহুবার চেষ্টা করা হয়েছে ইসলামের আলোকে নিভিয়ে দেয়ার; কিন্তু ইসলামের আলো নেভাতে সক্ষম হয়নি ইসলামের দুশমনরা। সত্যের পতাকাবাহীরা বাতিল শক্তিকে চুরমার করে দিয়ে তাদের ষড়যন্ত্রের জালকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন সব যুগেই। সেই ইতিহাস সবারই জানা।
বাতিলের এই আক্রমণ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে; কিন্তু সাময়িক সফলতার আস্ফাালন দেখালেও চূড়ান্ত সফলতা মুসলমানদেরই হবে।
বাংলাদেশের মুসলমানরা বাতিলের ভয়ঙ্কর থাবায় আক্রান্ত, সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা বিশ্বাস মুছে দিয়ে ফেরাউনি ও নমরূদী শাসনব্যবস্থা কায়েমের অপচেষ্টা দেশে খোদায়ি গজব অনিবার্য করে তুলছে। আল্লাহকে কটাক্ষ করার মতো দুঃসাহস দেখানো হচ্ছে। আমার পেয়ারা নবী (সা.) এবং আমাদের প্রাণপ্রিয় ধর্ম ইসলামের অবমাননা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করার কারণে তার শাস্তির ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া হলেও আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর বিরুদ্ধে কটূক্তিকারীদের শাস্তির আওতায় আনার কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না; বরং হাইকোর্টের একজন বিচারপতি এ বিষয়টি সহযোগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গেলে তার বিরুদ্ধে সরকারি নির্দেশে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে হয়রানিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ব্লগার রাজীবকে শহীদ আখ্যা দেয়া হয়েছে, সংসদে তার প্রতি সম্মান দেখানো হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শাহবাগের নাস্তিক ব্লগারদের ইসলামের বিরুদ্ধে উসকে দেয়া হয়েছে। তারা ইসলামি রাজনীতি বন্ধের দাবি জানিয়ে স্পিকারকে স্মারকলিপি দেয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছে। ইসলামের নিদর্শনাবলিকে চরমভাবে অবমাননা করা হয়েছে।
কোরআন-সুন্নাহবিরোধী নারীনীতি, ইসলামবিরোধী শিক্ষানীতি পাস করা হয়েছে। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ বিভিন্ন মসজিদে নামাজের সময় বিভিন্নভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং আলেম, ইমাম, খতিবদের হক-কথা বলার কারণে তাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালানো হচ্ছে, হত্যা, হুমকি-ধমকি, হামলা-মামলার মাধ্যমে তাদের দমিয়ে রাখার অপচেষ্টা ও চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। কাদিয়ানি এনজিওসহ ইসলামবিরোধী অপশক্তিকে বিভিন্নভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। মুসলিম সভ্যতা সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে বিজাতীয় সভ্যতা সংস্কৃতি ও বেহায়াপনা বেলেল্লাপনা আমদানি করা হচ্ছে। মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলন, ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপনসহ শেরেকি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুসলিম এ দেশটিকে অগ্নিপূজারি ও মূর্তিপূজারিদের দেশ বানানোর চক্রান্ত হচ্ছে। ইসলামের কথা বললেই তাকে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদের অপবাদ দিয়ে এ দেশ থেকে চিরতরে ইসলাম উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র চালানো হচ্ছে। জঙ্গিবাদ দমনের নামে ইসলাম নির্মূলের উদ্দেশ্যে বিদেশি সৈনিকদের এদেশে ডেকে আনার পাঁয়তারা চলছে।
এদেশের কোটি কোটি তৌহিদি জনতাকে সঙ্গে নিয়ে হেফাজতে ইসলাম শান্তিপূর্ণ উপায়ে দেশ ও ইসলামবিরোধী এসব অপতত্পরতা বন্ধে বদ্ধপরিকর। কোনো অপশক্তিই হেফাজতে ইসলামকে তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে দমাতে পারবে না। এ লক্ষ্যেই হেফাজতে ইসলাম দেশ এবং ঈমান রক্ষার তাগিদে সুস্পষ্ট ১৩ দফা দাবি পেশ করে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এসব দাবি কোনো রাজনৈতিক দাবি নয়। ক্ষমতা থেকে কাউকে সরানো বা কাউকে ক্ষমতায় বসানোর দাবি নয়; কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে হলে এসব দাবি মেনেই থাকতে হবে, আবার ক্ষমতায় যেতে হলেও এসব দাবি মেনেই যেতে হবে।
আমরা বার বার বলেছি, আমাদের আন্দোলন ঈমান ও দেশরক্ষার অহিংস আন্দোলন। এ আন্দোলনকে দমানোর অপচেষ্টা করা হলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। সরকার নির্বাচনের আগে ইসলামবিরোধী, কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী কোনো কাজ না করার অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতাসীন হলেও এখন তারা সুস্পষ্ট ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সরকার আমাদের দাবি-দাওয়ার প্রতি কর্ণপাত না করে দেশের কোটি কোটি মুসলমানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আমাদের আজকের এই লংমার্চ কর্মসূচিকে একটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও সরকার লক্ষ কোটি জনতার এই কর্মসূচি বানচালের সব প্রচেষ্টাই চালিয়েছে। সরকারের সহযোগী নাস্তিক মুরতাদদের ঘাদানি কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, পরিকল্পনামন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম এবং শাহবাগি নাস্তিক মুরতাদদের তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চের মাধ্যমে হরতাল অবরোধ আহ্বান করিয়ে আমাদের শান্তিপূর্ণ এই কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। তারপরও আজকের এই মহাসমুদ্র প্রমাণ করেছে এদেশে নাস্তিক মুরতাদ ইসলামবিরোধীদের ঠাঁই নেই। ঈমানদার জনতাই এ দেশ নিয়ন্ত্রণের অধিকার রাখে।
আজ সারা বাংলাদেশে মহাগণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি না মানা পর্যন্ত এই আন্দোলন আরও তীব্র থেকে তীব্রতর রূপ ধারণ করবে; যে আন্দোলনের তোড়ে এই ইসলামবিরোধী সরকারের পরিণতি হবে ফেরাউন, নমরূদ, সাদ্দাদ, হামান, আবু জাহেল, আবু লাহাবের চেয়ে আরও ভয়াবহ। তাই এখনও সময় আছে আল্লাহর গজব আসার আগেই আমাদের দাবিগুলো মেনে নিয়ে নিজেরাও বাঁচুন, দেশ ও দেশের জনগণকে বাঁচান।
আজকের এই জনসমুদ্র প্রমাণ করেছে—এদেশ চলবে আলেম-ওলামা ও তৌহিদি জনতার কথায়, নাস্তিক মুরতাদ ব্লগারদের কথায় নয়। জীবন বাজি রেখে লংমার্চে অংশগ্রহণ করে আজকের এই মহাজনসমুদ্রে নিজের অর্থ-শ্রম খরচ করে সশরীরে হাজির হয়ে ঈমানি দায়িত্ব পালন করার জন্য হেফাজতে ইসলামের সকল নেতাকর্মী, অন্যান্য সংগঠন, দল, দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামা-মাশায়েখ, ইসলামি চিন্তাশীল ব্যক্তি, সামাজিক সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠন, মাদরাসা, স্কুল, ভার্সিটির ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন ও মোবারকবাদ জানাচ্ছি। যুবক-তরুণ তোমরা ইসলামের মূলশক্তি, তাবত্ বাতিল জাগরণ স্তিমিত করার জন্য আজকের মতো ভবিষ্যতেও জীবন বাজি রেখে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে শহীদ হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমি ঢাকা ও তার আশপাশের অঞ্চলের মানুষের লংমার্চ কাফেলাকে সার্বিক সহযোগিতার জন্যও আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।
পরিশেষে ঈমান ও দেশরক্ষার যে আন্দোলনের সূচনা হয়ে গেছে, মনজিলে মকসুদে পৌঁছার আগপর্যন্ত আমাদের আর ঘরে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই।

[গত ৬ এপ্রিল লংমার্চ-পরবর্তী মতিঝিল শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির, ঐতিহ্যবাহী জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ্ আহমদ শফীর পঠিত ভাষণ।]
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2013/04/08/195620#.UWKaGx_pfIU
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন