প্রশ্ন পরিবার রেখে দীর্ঘদিনের তাবলীগী সফর শরিয়ত সন্মত কিনা ?
১- আমাদের নবিজি কি কখনো তার বিবিদের রেখে অন্য জায়গায় গিয়া ৪০ বা ১২০ রাত্রি যাপন করেছেন কি না আর যদি করেন তার রেফারন্স কি?
২-ঘরে বিবি উপযুক্ত বোন বা মেয়ে রেখে কি তাবিলিগে যাওয়া যাবে তার রেফারেন্স ?...
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
আপনি প্রথমে একটি প্রশ্নের জবাব দিন। যদি কোন রেফারেন্স না পাওয়া যায় যে, রাসূল সাঃ বা রাসূল সাঃ এর আদেশে সাহাবায়ে কেরাম ৪০ দিন বা এর চেয়ে বেশি সময় বিবি-বাচ্চা রেখে বাহিরে থেকেছেন। তাহলে কি আপনি বলবেন যে, অর্থ কামানোর জন্য বিবি-বাচ্চা রেখে বিদেশে গিয়ে ৪০ দিন বা এর চেয়ে বেশি সময় থাকা হারাম?
যদি তাই বলে থাকেন, তাহলে আপনি এ প্রশ্ন করতে পারেন। আর যদি বলেন, যে না এটি হারাম নয়। তাহলে দ্বীনের প্রচারের জন্য বাহিরে থাকাতে পরিবারের প্রতি এত অযথা দয়া উপছে উঠছে কেন?
টাকা কামানোর জন্য বিদেশ গমন করে বছরের পর বছর পরে থাকলেও এ নিয়ে প্রশ্ন না করে, দ্বীনের কাজে বাহিরে থাকায় প্রশ্ন কেন? দ্বীনের কাজের সাথে এত দুশমনী কেন?
قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ ۗ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ [٩:٢٤]
বল, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোত্র তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান-যাকে তোমরা পছন্দ কর-আল্লাহ, তাঁর রসূল ও তাঁর রাস্তায় জেহাদ তথা চেষ্টা-মেহনত [তাবলীগী সফর] করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর, আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত, আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না। {সূরা তাওবা-২৪}
এ আয়াতে স্পষ্ট ভাষায় সন্তান সন্ততি, স্ত্রী আর বাসস্থানের মোহাব্বতে আল্লাহর রাস্তায় বের না হওয়ার ব্যাপারে কঠিন হুশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে। যা স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, পরিবারের প্রতি খেয়াল রাখার ঠুনকো ওজর দেখিয়ে এ থেকে বিরত থাকা সরাসরি আল্লাহর ধমকিতে নিপতিত হওয়ার নামান্তর।
তবে সফরকালীন সময়ে পরিবারের ভরনপোষনের ব্যবস্থা অবশ্যই করে যেতে হবে। এটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু দ্বীনী সফরই করা যাবে না পরিবার থাকায়। এমনটি ধারণা করা দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচয়।
পরিবার ছাড়া সাহাবাদের দ্বীনী সফর
রাসূল সাঃ পবিত্র স্ত্রীগণকে রেখে একত্রে ২৯ দিন অন্যত্র অবস্থান করেছেন মর্মে স্পষ্ট বর্ণনা হাদীসে এসেছে। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৪৯৮৪}
রাসূল সাঃ পরিবার সঙ্গে না নিয়ে একাধিক সফর করেছেন। আর রাসূল সাঃ এর আদেশে সাহাবায়ে কেরাম রাঃ বছরের অধিক সময়ও পরিবার ছাড়া দ্বীনী সফরে রত ছিলেন। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হল,
১-
عن البراء « أن النبي صلى الله عليه وسلم بعث خالد بن الوليد إلى أهل اليمن يدعوهم إلى الإسلام ، قال البراء : فكنت فيمن خرج مع خالد بن الوليد فأقمنا ستة أشهر ندعوهم إلى الإسلام فلم يجيبوه ، ثم إن النبي صلى الله عليه وسلم بعث علي بن أبي طالب رضي الله عنه فأمره أن يقفل خالدا إلى رجل كان ممن يمم مع خالد ، ومن أحب أن يعقب مع علي فليعقب معه ، قال البراء فكنت فيمن عقب مع علي ، فلما دنونا من القوم خرجوا لنا فصلى بنا علي ثم صفنا صفا واحدا ، ثم تقدم بين أيدينا وقرأ عليهم كتاب رسول الله صلى الله عليه وسلم ، فأسلمت همدان جمعا ، فكتب علي إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم بإسلامهم ، فلما قرأ رسول الله صلى الله عليه وسلم الكتاب خر (1) ساجدا ، ثم رفع رأسه فقال : » السلام على همدان ، السلام على همدان « أخرجه البخاري في الصحيح مختصرا من وجه آخر عن إبراهيم بن يوسف .
অনুবাদ- হযরত বারা রাঃ বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়ামান প্রদেশে তাবলীগের উদ্দেশ্যে হযরত খালীদ ইবেন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে পাঠান। আমিও তাঁদের সাথে ছিলাম। আমরা দীর্ঘ ৬মাস যাবত সেখানে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ অনবরত করে চলেছিলাম, কিন্তু তাদের কেউ তখনো আমাদের দাওয়াত কবুল করছিলো না। অতপর হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে রাসূল সাঃ আমীরের দায়িত্ব দিয়ে , খালীদ রাযিয়াল্লাহু কে ফিরে যেতে বলেন এবং তাঁর সাথে যারা ফিরতে চায় তারা ফিরতে পারবে আর যারা থেকে যেতে চায় তারা থাকতে পারে। আমি হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর সাথে আরো সময় বাড়িয়ে নিলাম।
অতপর, আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু আমাদেরকে নিয়ে নামাজ আদায় করলেন। পরে আমরা কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়ালাম, এরপরে তিনি আমাদের মাঝে এগিয়ে এসে রাসূলুল্লাহর দাওয়াতনামা পড়ে শুনালেন। সাথে সাথে হামদান গোত্রের সবাই একই সাথে ইসলাম কবুল করে নিলেন।
এই খুশির সংবাদ লিখে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাঃ এর নিকট পত্র পাঠালেন। যখন রাসূল সাঃ উক্ত পত্রখানি পড়লেন, তখন সেজদায় লুটিয়ে পড়লেন। অতপর, মাথা উঠিয়ে বললেন, হামদান গোত্রের উপর শান্তি বর্ষিত হোক, হামদান গোত্রের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।
অন্য রেওয়াতে আছে, উক্ত জামাত নিয়ে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু ৪ মাস পর ফিরে এলেন, বিদায় হজ্বের সময়। অতএব, উভয় আমীরের নেতৃত্বে আমাদের সময় অতিবাহিত হলো, প্রায় ১ বৎসর। (দালায়েলুন নাবাবিয়্যাহ লিলবায়হাকী, হাদীস নং-২১৩২, হায়াতুস সাহাবাহ, ১ম খ, পৃষ্ঠাঃ ১৭৯/ ১৪০, বুখারী শরীফ ২য় খন্ড, কিতাবুল মাগাজী।
২-
হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাঃ এর নেতৃত্বে জামাত। ১ম হিজরীর রবিউল আউয়াল মাস থেকে ছয় মাস পর্যন্ত নাজরান ও ইয়ামেনে অবস্থান করেন। {বুখারী-২/৬২৩, তাবারী-৩/১২৬, ইবনে খালদুন-১/৮২৮}
৩-
হযরত আলী রাঃ এর নেতৃত্বে ১ম হিজরীতে চার মাসের সফর হামাদানও ইয়ামেনে। {বুখারী-২/৬২৩, তাবারী-৩/১৩১-১৩২, ইবনু সাআদ-২/১৬৯-১৭২}
৪-
হযরত জারীর বিন আব্দুল্লাহ রাঃ এর নেতৃত্বে বাজীলাহ ও ইয়ামানে ২ মাসের সফর। {তাবারী-৩/১৫৮, ইবনে সাআদ-২/২৬৬, ইবনে খালদুন-১/৮৪৫}
৫-
হযরত জারীর বিন ইবনে আব্দুল্লাহ রাঃ এর নেতৃত্বে বাজীলাহ ও ইয়ামানে ২ মাসের সফর। {ইবনে খালদুন-২/৮৪৫, তাবারী-৩/১৭৮, বুখারী-২/৬২৫}
৬-
হযরত তামীমে দারী রাঃ এর নেতৃত্বে লাখম উপগোত্রে ৪০ দিনের সফর। {ইবনে সাআদ-১/৩৪৩-৩৪৪, মাজমূআত-৪২-৪৩}
কতিপয় দ্বীন বিরোধী, ঈমানের দুশমনদের কথায় দ্বীনের কাজের ক্ষেত্রে অযথা সন্দেহ সৃষ্টি থেকে আল্লাহ পাক সকলকে হিফাযত করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন।
আরও বিস্তারীত জানতে
http://www.youtube.com/watch?v=owSwH1bx4RY&feature=youtu.be
https://www.facebook.com/photo.php?fbid=162263760630985&set=a.162263743964320.1073741859.100005420863115&type=3&theater
প্রশ্ন
অনেকেই বলে থাকেন যে, তাবলীগ করার জন্য আলেম হওয়ার শর্ত। তাই বর্তমান প্রচলিত তাবলীগ জামাতে সাধারণ মুসলমানগণ যে, তাবলীগ করছেন, তা ঠিক নয়। তাদের জন্য এ কাজ করা জায়েজ নয়। বরং তাবলীগ করার জন্য আলেম হওয়া শর্ত। তাই আমার প্রশ্ন হল-তাবলীগ করার জন্য কি আলেম হওয়া শর্ত?
জনৈক ব্যক্তি
ঢাকা, বাংলাদেশ
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
না, তাবলীগ করার জন্য আলেম হওয়া জরুরী নয়। তবে আলেম হলে উত্তম। এক হল হিফাযতে দ্বীন তথা দ্বীনের মৌলিকত্ব রক্ষা করা। আরেক হল ইশাআতে দ্বীন তথা দ্বীন প্রচার করা।
হিফাযতে দ্বীন তথা দ্বীনের মৌলিকত্ব রক্ষার জন্য আলেম হওয়া জরুরী। কেননা, কোন কাজ বেদআত, কোন কাজ শিরকী? কোন কাজ কুফরী? কোন কাজ হারাম? এসকল বিষয় কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে প্রাজ্ঞতা ছাড়া জানা সম্ভব নয়। তাই এসব বিষয় সমাজে প্রবিষ্ট করলে তা প্রতিরোধ করার জন্য কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে প্রাজ্ঞ উলামা প্রয়োজন। উলামা ছাড়া এসব প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।
পক্ষান্তরে দ্বীন প্রচার সাধারণ মুসলমান দিয়েও হতে পারে। এ কারণেই রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ بَلِّغُوا عَنِّي وَلَوْ آيَةً
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেনঃ আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও পৌঁছে দাও। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩২৭৪, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-১৪৯, সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-১৪৭, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-৫৪২}
এখানে আলেম, গায়রে আলেম কাউকেই সুনির্দিষ্ট করেননি। বরং সকল মুসলমানদের উপর দায়িত্ব হল, যিনি দ্বীনের যে বিষয় জেনেছেন তা অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়া। এর নামইতো তাবলীগ।
আর দ্বীনের জটিল বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞ ও গায়রে আলেমদের আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নির্দেশনা দিয়েছেন, যেন তারা আলেম ও ফক্বীহ মুজতাহিদদের অনুসরণ করে চলতে। নিজে নিজে মনগড়া মত প্রকাশ না করতে। ইরশাদ হচ্ছে-
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ [١٦:٤٣]
আপনার পূর্বেও আমি প্রত্যাদেশসহ মানবকেই তাদের প্রতি প্রেরণ করেছিলাম অতএব জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তোমাদের জানা না থাকে; {সুরা নাহল-৪৩}
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে-
وَإِذَا جَاءَهُمْ أَمْرٌ مِّنَ الْأَمْنِ أَوِ الْخَوْفِ أَذَاعُوا بِهِ ۖ وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَىٰ أُولِي الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنبِطُونَهُ مِنْهُمْ ۗ وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ لَاتَّبَعْتُمُ الشَّيْطَانَ إِلَّا قَلِيلًا [٤:٨٣]তাদের কাছে যখন কোন সংবাদ আসে, তা শান্তির হোক বা ভীতির, তারা তা [যাচাই বাছাই না করেই] প্রচার শুরু করে দেয়। তারা যদি তা রাসূল বা যারা কর্তৃত্বের অধিকারী তাদের কাছে নিয়ে যেত, তবে তাদের মাঝে যারা তার তথ্য অনুসন্ধানী তারা তার বাস্তবতা জেনে নিত। {সূরা নিসা-৮৩}
কিন্তু দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে এরকম কোন বাধ্যবধকতা নেই। বরং মুর্খরাও দ্বীন প্রচার করতে পারে। যেমনটি রাসূল সাঃ এর আরো হাদীস থেকে প্রতিয়মান হয়।
যেমন রাসূল সাঃ বিদায় হজ্বের সময় উপস্থিত লাখো সাহাবাগণকে সম্বোধন করে বলেছেন- فَلْيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ তথা উপস্থিত ব্যক্তিরা অনুপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দাও। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১০৪, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৪৪৬, ১৩৫৪}
সুনিশ্চিতভাবে বিদায় হজ্বের ঐ ভাষণের সময় উপস্থিত সকল সাহাবাগণ আলেম ছিলেন না। কারণ সেখানে এমন ব্যক্তিরাও উপস্থিত ছিলেন, যাদের অনেকেই তখন নতুন মুসলমান হয়েছেন। অনেকে রাসূল সাঃ কে সর্বপ্রথম দেখেছেন। সুতরাং তাদের আলেম হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। অথচ রাসূল সাঃ সবাইকেই দায়িত্ব দিয়েছেন, যেন তারা দ্বীনের এ দাওয়াতকে অন্যের কাছে পৌঁছে দেন।
সুতরাং এর দ্বারা একথা স্পষ্টভাবে প্রতিয়মান যে, দ্বীন প্রচারের জন্য আলেম হওয়ার দাবিটি বোকামী সূলভ দাবি।
আল্লাহ তাআলা আমাদের দ্বীনের সহীহ বুঝ দান করুন।
والله اعلم بالصواب
১- আমাদের নবিজি কি কখনো তার বিবিদের রেখে অন্য জায়গায় গিয়া ৪০ বা ১২০ রাত্রি যাপন করেছেন কি না আর যদি করেন তার রেফারন্স কি?
২-ঘরে বিবি উপযুক্ত বোন বা মেয়ে রেখে কি তাবিলিগে যাওয়া যাবে তার রেফারেন্স ?...
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
আপনি প্রথমে একটি প্রশ্নের জবাব দিন। যদি কোন রেফারেন্স না পাওয়া যায় যে, রাসূল সাঃ বা রাসূল সাঃ এর আদেশে সাহাবায়ে কেরাম ৪০ দিন বা এর চেয়ে বেশি সময় বিবি-বাচ্চা রেখে বাহিরে থেকেছেন। তাহলে কি আপনি বলবেন যে, অর্থ কামানোর জন্য বিবি-বাচ্চা রেখে বিদেশে গিয়ে ৪০ দিন বা এর চেয়ে বেশি সময় থাকা হারাম?
যদি তাই বলে থাকেন, তাহলে আপনি এ প্রশ্ন করতে পারেন। আর যদি বলেন, যে না এটি হারাম নয়। তাহলে দ্বীনের প্রচারের জন্য বাহিরে থাকাতে পরিবারের প্রতি এত অযথা দয়া উপছে উঠছে কেন?
টাকা কামানোর জন্য বিদেশ গমন করে বছরের পর বছর পরে থাকলেও এ নিয়ে প্রশ্ন না করে, দ্বীনের কাজে বাহিরে থাকায় প্রশ্ন কেন? দ্বীনের কাজের সাথে এত দুশমনী কেন?
قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ ۗ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ [٩:٢٤]
বল, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোত্র তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান-যাকে তোমরা পছন্দ কর-আল্লাহ, তাঁর রসূল ও তাঁর রাস্তায় জেহাদ তথা চেষ্টা-মেহনত [তাবলীগী সফর] করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর, আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত, আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না। {সূরা তাওবা-২৪}
এ আয়াতে স্পষ্ট ভাষায় সন্তান সন্ততি, স্ত্রী আর বাসস্থানের মোহাব্বতে আল্লাহর রাস্তায় বের না হওয়ার ব্যাপারে কঠিন হুশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে। যা স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, পরিবারের প্রতি খেয়াল রাখার ঠুনকো ওজর দেখিয়ে এ থেকে বিরত থাকা সরাসরি আল্লাহর ধমকিতে নিপতিত হওয়ার নামান্তর।
তবে সফরকালীন সময়ে পরিবারের ভরনপোষনের ব্যবস্থা অবশ্যই করে যেতে হবে। এটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু দ্বীনী সফরই করা যাবে না পরিবার থাকায়। এমনটি ধারণা করা দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচয়।
পরিবার ছাড়া সাহাবাদের দ্বীনী সফর
রাসূল সাঃ পবিত্র স্ত্রীগণকে রেখে একত্রে ২৯ দিন অন্যত্র অবস্থান করেছেন মর্মে স্পষ্ট বর্ণনা হাদীসে এসেছে। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৪৯৮৪}
রাসূল সাঃ পরিবার সঙ্গে না নিয়ে একাধিক সফর করেছেন। আর রাসূল সাঃ এর আদেশে সাহাবায়ে কেরাম রাঃ বছরের অধিক সময়ও পরিবার ছাড়া দ্বীনী সফরে রত ছিলেন। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হল,
১-
عن البراء « أن النبي صلى الله عليه وسلم بعث خالد بن الوليد إلى أهل اليمن يدعوهم إلى الإسلام ، قال البراء : فكنت فيمن خرج مع خالد بن الوليد فأقمنا ستة أشهر ندعوهم إلى الإسلام فلم يجيبوه ، ثم إن النبي صلى الله عليه وسلم بعث علي بن أبي طالب رضي الله عنه فأمره أن يقفل خالدا إلى رجل كان ممن يمم مع خالد ، ومن أحب أن يعقب مع علي فليعقب معه ، قال البراء فكنت فيمن عقب مع علي ، فلما دنونا من القوم خرجوا لنا فصلى بنا علي ثم صفنا صفا واحدا ، ثم تقدم بين أيدينا وقرأ عليهم كتاب رسول الله صلى الله عليه وسلم ، فأسلمت همدان جمعا ، فكتب علي إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم بإسلامهم ، فلما قرأ رسول الله صلى الله عليه وسلم الكتاب خر (1) ساجدا ، ثم رفع رأسه فقال : » السلام على همدان ، السلام على همدان « أخرجه البخاري في الصحيح مختصرا من وجه آخر عن إبراهيم بن يوسف .
অনুবাদ- হযরত বারা রাঃ বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়ামান প্রদেশে তাবলীগের উদ্দেশ্যে হযরত খালীদ ইবেন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে পাঠান। আমিও তাঁদের সাথে ছিলাম। আমরা দীর্ঘ ৬মাস যাবত সেখানে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ অনবরত করে চলেছিলাম, কিন্তু তাদের কেউ তখনো আমাদের দাওয়াত কবুল করছিলো না। অতপর হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে রাসূল সাঃ আমীরের দায়িত্ব দিয়ে , খালীদ রাযিয়াল্লাহু কে ফিরে যেতে বলেন এবং তাঁর সাথে যারা ফিরতে চায় তারা ফিরতে পারবে আর যারা থেকে যেতে চায় তারা থাকতে পারে। আমি হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর সাথে আরো সময় বাড়িয়ে নিলাম।
অতপর, আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু আমাদেরকে নিয়ে নামাজ আদায় করলেন। পরে আমরা কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়ালাম, এরপরে তিনি আমাদের মাঝে এগিয়ে এসে রাসূলুল্লাহর দাওয়াতনামা পড়ে শুনালেন। সাথে সাথে হামদান গোত্রের সবাই একই সাথে ইসলাম কবুল করে নিলেন।
এই খুশির সংবাদ লিখে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাঃ এর নিকট পত্র পাঠালেন। যখন রাসূল সাঃ উক্ত পত্রখানি পড়লেন, তখন সেজদায় লুটিয়ে পড়লেন। অতপর, মাথা উঠিয়ে বললেন, হামদান গোত্রের উপর শান্তি বর্ষিত হোক, হামদান গোত্রের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।
অন্য রেওয়াতে আছে, উক্ত জামাত নিয়ে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু ৪ মাস পর ফিরে এলেন, বিদায় হজ্বের সময়। অতএব, উভয় আমীরের নেতৃত্বে আমাদের সময় অতিবাহিত হলো, প্রায় ১ বৎসর। (দালায়েলুন নাবাবিয়্যাহ লিলবায়হাকী, হাদীস নং-২১৩২, হায়াতুস সাহাবাহ, ১ম খ, পৃষ্ঠাঃ ১৭৯/ ১৪০, বুখারী শরীফ ২য় খন্ড, কিতাবুল মাগাজী।
২-
হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাঃ এর নেতৃত্বে জামাত। ১ম হিজরীর রবিউল আউয়াল মাস থেকে ছয় মাস পর্যন্ত নাজরান ও ইয়ামেনে অবস্থান করেন। {বুখারী-২/৬২৩, তাবারী-৩/১২৬, ইবনে খালদুন-১/৮২৮}
৩-
হযরত আলী রাঃ এর নেতৃত্বে ১ম হিজরীতে চার মাসের সফর হামাদানও ইয়ামেনে। {বুখারী-২/৬২৩, তাবারী-৩/১৩১-১৩২, ইবনু সাআদ-২/১৬৯-১৭২}
৪-
হযরত জারীর বিন আব্দুল্লাহ রাঃ এর নেতৃত্বে বাজীলাহ ও ইয়ামানে ২ মাসের সফর। {তাবারী-৩/১৫৮, ইবনে সাআদ-২/২৬৬, ইবনে খালদুন-১/৮৪৫}
৫-
হযরত জারীর বিন ইবনে আব্দুল্লাহ রাঃ এর নেতৃত্বে বাজীলাহ ও ইয়ামানে ২ মাসের সফর। {ইবনে খালদুন-২/৮৪৫, তাবারী-৩/১৭৮, বুখারী-২/৬২৫}
৬-
হযরত তামীমে দারী রাঃ এর নেতৃত্বে লাখম উপগোত্রে ৪০ দিনের সফর। {ইবনে সাআদ-১/৩৪৩-৩৪৪, মাজমূআত-৪২-৪৩}
কতিপয় দ্বীন বিরোধী, ঈমানের দুশমনদের কথায় দ্বীনের কাজের ক্ষেত্রে অযথা সন্দেহ সৃষ্টি থেকে আল্লাহ পাক সকলকে হিফাযত করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন।
আরও বিস্তারীত জানতে
http://www.youtube.com/watch?v=owSwH1bx4RY&feature=youtu.be
https://www.facebook.com/photo.php?fbid=162263760630985&set=a.162263743964320.1073741859.100005420863115&type=3&theater
প্রশ্ন
অনেকেই বলে থাকেন যে, তাবলীগ করার জন্য আলেম হওয়ার শর্ত। তাই বর্তমান প্রচলিত তাবলীগ জামাতে সাধারণ মুসলমানগণ যে, তাবলীগ করছেন, তা ঠিক নয়। তাদের জন্য এ কাজ করা জায়েজ নয়। বরং তাবলীগ করার জন্য আলেম হওয়া শর্ত। তাই আমার প্রশ্ন হল-তাবলীগ করার জন্য কি আলেম হওয়া শর্ত?
জনৈক ব্যক্তি
ঢাকা, বাংলাদেশ
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
না, তাবলীগ করার জন্য আলেম হওয়া জরুরী নয়। তবে আলেম হলে উত্তম। এক হল হিফাযতে দ্বীন তথা দ্বীনের মৌলিকত্ব রক্ষা করা। আরেক হল ইশাআতে দ্বীন তথা দ্বীন প্রচার করা।
হিফাযতে দ্বীন তথা দ্বীনের মৌলিকত্ব রক্ষার জন্য আলেম হওয়া জরুরী। কেননা, কোন কাজ বেদআত, কোন কাজ শিরকী? কোন কাজ কুফরী? কোন কাজ হারাম? এসকল বিষয় কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে প্রাজ্ঞতা ছাড়া জানা সম্ভব নয়। তাই এসব বিষয় সমাজে প্রবিষ্ট করলে তা প্রতিরোধ করার জন্য কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে প্রাজ্ঞ উলামা প্রয়োজন। উলামা ছাড়া এসব প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।
পক্ষান্তরে দ্বীন প্রচার সাধারণ মুসলমান দিয়েও হতে পারে। এ কারণেই রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ بَلِّغُوا عَنِّي وَلَوْ آيَةً
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেনঃ আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও পৌঁছে দাও। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩২৭৪, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-১৪৯, সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-১৪৭, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-৫৪২}
এখানে আলেম, গায়রে আলেম কাউকেই সুনির্দিষ্ট করেননি। বরং সকল মুসলমানদের উপর দায়িত্ব হল, যিনি দ্বীনের যে বিষয় জেনেছেন তা অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়া। এর নামইতো তাবলীগ।
আর দ্বীনের জটিল বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞ ও গায়রে আলেমদের আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নির্দেশনা দিয়েছেন, যেন তারা আলেম ও ফক্বীহ মুজতাহিদদের অনুসরণ করে চলতে। নিজে নিজে মনগড়া মত প্রকাশ না করতে। ইরশাদ হচ্ছে-
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ [١٦:٤٣]
আপনার পূর্বেও আমি প্রত্যাদেশসহ মানবকেই তাদের প্রতি প্রেরণ করেছিলাম অতএব জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তোমাদের জানা না থাকে; {সুরা নাহল-৪৩}
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে-
وَإِذَا جَاءَهُمْ أَمْرٌ مِّنَ الْأَمْنِ أَوِ الْخَوْفِ أَذَاعُوا بِهِ ۖ وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَىٰ أُولِي الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنبِطُونَهُ مِنْهُمْ ۗ وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ لَاتَّبَعْتُمُ الشَّيْطَانَ إِلَّا قَلِيلًا [٤:٨٣]তাদের কাছে যখন কোন সংবাদ আসে, তা শান্তির হোক বা ভীতির, তারা তা [যাচাই বাছাই না করেই] প্রচার শুরু করে দেয়। তারা যদি তা রাসূল বা যারা কর্তৃত্বের অধিকারী তাদের কাছে নিয়ে যেত, তবে তাদের মাঝে যারা তার তথ্য অনুসন্ধানী তারা তার বাস্তবতা জেনে নিত। {সূরা নিসা-৮৩}
কিন্তু দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে এরকম কোন বাধ্যবধকতা নেই। বরং মুর্খরাও দ্বীন প্রচার করতে পারে। যেমনটি রাসূল সাঃ এর আরো হাদীস থেকে প্রতিয়মান হয়।
যেমন রাসূল সাঃ বিদায় হজ্বের সময় উপস্থিত লাখো সাহাবাগণকে সম্বোধন করে বলেছেন- فَلْيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ তথা উপস্থিত ব্যক্তিরা অনুপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দাও। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১০৪, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৪৪৬, ১৩৫৪}
সুনিশ্চিতভাবে বিদায় হজ্বের ঐ ভাষণের সময় উপস্থিত সকল সাহাবাগণ আলেম ছিলেন না। কারণ সেখানে এমন ব্যক্তিরাও উপস্থিত ছিলেন, যাদের অনেকেই তখন নতুন মুসলমান হয়েছেন। অনেকে রাসূল সাঃ কে সর্বপ্রথম দেখেছেন। সুতরাং তাদের আলেম হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। অথচ রাসূল সাঃ সবাইকেই দায়িত্ব দিয়েছেন, যেন তারা দ্বীনের এ দাওয়াতকে অন্যের কাছে পৌঁছে দেন।
সুতরাং এর দ্বারা একথা স্পষ্টভাবে প্রতিয়মান যে, দ্বীন প্রচারের জন্য আলেম হওয়ার দাবিটি বোকামী সূলভ দাবি।
আল্লাহ তাআলা আমাদের দ্বীনের সহীহ বুঝ দান করুন।
والله اعلم بالصواب
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন