গায়েবানা জানাযা বিষয়ে ফক্বীহদের মতামত
ইমাম আযম আবু হানীফা (রাহ.) ও তার অনুগামী সকল ইমাম এবং ইমাম মালেক (রাহ.)এর মতে- গায়েবানা জানাযা জায়েয নেই। চাই দাফনের আগে হোক বা পরে। মাইয়্যিত শহরের ভিতরে থাক বা বাইরে। (মাবসূতে সারাখসী- ২/৬৭, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, মানহুল জালীল- ১/৩৭৬ পৃষ্ঠা)।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহ.) থেকে জায়েয হওয়ার একটি উক্তি থাকলেও স্বীয় শাগরিদ ইবনে আবী মুসা তাঁর থেকে নাজায়েয হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। হাম্বলী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফিক্বাহ্বিদ আল্লামা ইবনে কুদামা (রাহ.) এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, অর্থাৎ- “ইমাম মালেক (রাহ.) ও ইমাম আবু হানীফা (রাহ.) উভয়ে বলেন, গায়েবানা জানাযা জায়েয নেই। ইমাম আহমদ (রাহ.) থেকে ইবনে আবী মুসা উক্ত ইমামদ্বয়ের অনুরূপ (নাজায়েয হওয়ার) একটি উক্তি বর্ণনা করেছেন।” (আলমুগনী, ইবনে কুদামা (রাহ.)- ২/৩৮৬ পৃষ্ঠা)।
ইমাম শাফেয়ী (রাহ.) ও ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রাহ.)এর মতে মাইয়্যিত ভিন্ন শহরে থাকলে গায়েবানা জানাযা জায়েয। কিন্তু শহরের ভিতরে থাকার মাইয়্যেতের গায়েবানা জানাযা জায়েজ নয়। মাইয়্যেতকে উপস্থিত করতে হবে। (আল-ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু- ১/৫০৪, মাকতাবাতুল হক্কানিয়্যাহ, পাকিস্তান, আল মাজমু- ৫/২৫৩)।
আল্লামা ইবনু আবদিল বার (রাহ.) গায়েবানা জানাযা নাজায়েয হওয়ার উক্তিকে জমহুর ফুক্বাহা তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামায়ে কেরামের মতামত বলে অভিহিত করেছেন। যেমনটি উল্লেখ করেছেন বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার শাইখুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া (রাহ.)। তিনি বলেন, “হানাফী ও মালেকী ওলামাগণ বলেন, গায়েবানা জানাযা শরীআত সম্মত নয়। ইবনু আবদিল বার (রাহ.) এ উক্তিকে অধিকাংশ ওলামাদের মত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।” (লামিউদ দারারী- ৪/৪৩২ পৃষ্ঠা)।
বিশুদ্ধতম মত
অনুপস্থিত ব্যক্তির জানাজা বা গায়েবানা জানাযা বলতে কোন শব্দ কুরআন, হাদীসের কোথাও নেই। এর কোন প্রমাণ না কুরআনে আছে, না হাদীসে আছে। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীগণ, তাবে তাবেয়ীগণ থেকে এ শব্দের কোন জানাযার প্রমাণ পাওয়া যায় না।
তাই গায়েবানা জানাযা পড়া জায়েজ নেই। এটি বিদআত।
রাসূল সাঃ ও খুলাফায়ে রাশেদীন কোন দিন কারো গায়েবানা জানাযা আদায় করেননি
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যুম রহঃ বলেন, মুসলমানদের মাঝে অনেক এমন ব্যক্তি ইন্তেকাল করেছেন যারা রাসূল সাঃ থেকে দূরে তথা গায়েব ছিলেন। কিন্তু নবীজী সাঃ কারোরই গায়েবানা জানাযা পড়েননি। {যাদুল মাআদ-১/৫১৯}
এমনিভাবে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাঃ এর আমলে কত কারী সাহাবীকে মুসাইলামায়ে কাজ্জাব শহীদ করেছে। আরো কত সাহাবী জিহাদের ময়দানে শহীদ হয়েছেন কিন্তু হযরত আবু বকর রাঃ এবং অন্যান্য সাহাবীগণ কেউই গায়েবানা জানাযা আদায় করেননি।
হযরত উমর রাঃ এর আমলে কত জিহাদ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কত হাজার হাজার সাহাবা জিহাদের ময়দানে মদীনা থেকে বহু দূরে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু কোন একজনেরও গায়েবানা জানাযা হযরত উমর রাঃ আমলে অনুষ্ঠিত হয়েছে মর্মে কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না।
পারবে না হযরত উসমান রাঃ ও হযরত আলী রাঃ এর আমলের কোন উদাহরণ পেশ করতে। অথচ হযরত উসমান রাঃ ও হযরত আলী রাঃ আমলেও কত হাজার হাজার সাহাবা ও তাবেয়ীগণ শহীদ হয়েছেন। কিন্তু কোন সাহাবীই গায়েবানা জানাযার ইলান করেছেন বা নিজে গায়েবানা জানাযার নামায পড়েছেন মর্মে কোন প্রমাণ না হাদীস থেকে পেশ করতে পারবে, না ইতিহাস থেকে পেশ করতে পারবে।
গায়েবানা জানাযা জায়েয প্রবক্তাদের দলীল ও তার খন্ডনঃ
দলীল
বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) সূত্রে একটি বর্ণনায় রয়েছে, “মহানবী (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে বাদশাহ নাজাশীর মৃত্যু সংবাদ দিলেন। অতঃপর জানাযার জন্য অগ্রসর হলেন। সাহাবায়ে কেরাম তাঁর পিছনে কাতার বন্দী হয়ে দাঁড়ালে নবীজী (সা.) চারটি তাকবীর বললেন।” (বুখারী শরীফ, দিল্লী- ১/ ১৬৭ পৃষ্ঠা)।
একই বর্ণনা সহীহ ইবনে হিব্বানে (১/১৬৭) হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে ।
আর নাজাশী যেহেতু মদীনায় উপস্থিত ছিল না, অথচ রাসূল সাঃ তাদের নাজাশীর জানাযা নামায পড়িয়েছেন, তাই বুঝা গেল যে, গায়েবানা জানাযা পড়া জায়েজ। রাসূল সাঃ থেকেই গায়েবানা জানাযা পড়ার প্রমাণ রয়েছে।
উত্তর
১ম জবাব
প্রথমে আমরা দেখে নেই উক্ত হাদীসটি কোন রাবী বর্ণনা করেছেন? উক্ত হাদীসের বর্ণনাকারীগণ নাজাশীর জানাযা সংশ্লিষ্ট হাদীস থেকে গায়েবানা জানাযা জায়েজ হবার দলীল হিসেবেই বুঝেছেন না ভিন্ন কিছু?
উক্ত হাদীসের প্রসিদ্ধতম রাবী রয়েছেন তিনজন। যথা-
১- হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ।
২- হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাঃ।
৩- হযরত ইমরান বিন হুসাইন রাঃ।
বাদশা নাজাশী ইন্তেকাল করেছেন নবম হিজরীর রজব মাসে। {হাশিয়ায়ে মুয়াত্তা মালিক-২০৮}
আর হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ ইন্তেকাল করেছেন ৫৯ হিজরীতে। অর্থাৎ উক্ত ঘটনার পর হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ প্রায় ৫০ বছর জীবিত ছিলেন। হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাঃ ইন্তেকাল করেছেন ৭৯ হিজরীতে ইন্তেকাল করেছেন। সেই হিসেবে তিনি উক্ত ঘটনার পর ৭০ বছর জীবিত ছিলেন। আর হযরত ইমরান বিন হুসাইন রাঃ উক্ত ঘটনার পর জীবিত ছিলেন প্রায় ৪৩ বছর।
কিন্তু হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ এ ৫০ বছরের মাঝে, হযরত জাবের রাঃ পুরো ৭০ বছরের মাঝে এবং হযরত ইমরান বিন হুসাইন রাঃ তার জীবনের এই ৪৩ বছরের মাঝে কোনদিন কারো গায়েবানা জানাযা পড়েছেন, কিংবা গায়েবানা জানাযা পড়তে বলেছেন কেউ প্রমাণ দেখাতে পারবে?
এত দীর্ঘ বেঁচে থাকার পরও উক্ত ঘটনা থেকে এসকল সাহাবাগণ যদি গায়েবানা জানাযা জায়েজের প্রমাণই বুঝে থাকতেন, তাহলে তাদের জমানায় ইন্তেকাল হওয়া অসংখ্য সাহাবীদের গায়েবানা জানাযা তাদের পড়ার কথা। কিন্তু একজনের গায়েবানা জানাযা পড়ানোর কোন প্রমাণ না কোন হাদীস গ্রন্থে আছে না কোন ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায়। যা পরিস্কার প্রমাণ করছে যে, উক্ত ঘটনা দ্বারা কোন সাহাবী গায়েবানা জানাযা জায়েজ বুঝেননি। বরং বিষয় ছিল ভিন্ন। আসলে কি হয়েছিল তখন? আমরা যদি উক্ত ঘটনার বর্ণনা সম্বলিত সকল হাদীসকে সামনে রাখি, তাহলে আমাদের কাছে উক্ত বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
২য় জবাব
নাজাশীর ঘটনা সম্বলিত হাদীসমূহ
১
হযরত ইমরান বিন হুসাইন রাঃ বলেন- وَمَا نَحْسِبُ الْجِنَازَةَ إِلَّا مَوْضُوعَةً بَيْنَ يَدَيْهِতথা আমরা জানাযার ব্যাপারে এটাই অনুধাবন করছিলাম যে, তা আমাদের সামনে রাখা আছে। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২০০০৫}
২
হযরত ইমরান বিন হুসাইন রাঃ বলেন- وَهُمْ لَا يَظُنُّونَ إِلَّا أَنَّ جَنَازَتَهُ بَيْنَ يديهতথা “সাহাবায়ে কেরামের বিশ্বাস এটাই ছিল যে, জানাযা হুযূর (সা.)এর সামনে উপস্থিত। {সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৩১০২}
৩
এছাড়া উক্ত বর্ণনাটি হযরত আবান (রাহ.) সূত্রে হযরত ইমরান ইবনে হাছীন থেকে বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে, “যখন নবীজী (সা.)এর পিছনে জানাযা পড়েছি, তখন নাজাশীর লাশকে আমাদের সামনে উপস্থিত দেখতে পেয়েছি।” (উমদাতুল কারী শরহুল বুখারী- ৭/৩৩, মাকতাবায়ে তাওফীকিয়া, মিসর; ফাতহুল বারী- ৩/২৪৩ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ)।
৪
আবু আওয়ানাতে এ শব্দ এসেছে যে, نحن لا نرى ان الجنازة قدمناতথা আমরা দেখছিলাম যে, আমাদের সামনে জানাযা রাখা।
উপরোক্ত সকল বর্ণনার দিকে তাকালে পরিস্কার হয়ে যাবে, নাজাশীর জানাযা বর্ণনাকারী সাহাবীগণ কেন উক্ত ঘটনা দ্বারা গায়েবানা জায়েজের দলীল মনে করেননি। নাজাশীর জানাযার বর্ণনা করলেও জীবনে কোনদিন নিজে গায়েবানা জানাযা পড়েননি। কারণ তারা পরিস্কার বুঝেছিলেন নাজাশীর জানাযার নামাযটি গায়েবানা জানাযা নয়। বরং উপস্থিত ব্যক্তির জানাযা। রাসূল সাঃ এর মুজেযা স্বরূপ নাজাশীকে নবীজী সাঃ এর সামনে উপস্থিত করে দেয়া হয়েছিল। আর সেই জানাযা সামনে নিয়ে নবীজী সাঃ জানাযা পড়িয়েছেন। আর সামনে নিয়ে জানাযা পড়ার নাম উপস্থিত ব্যক্তির জানাযা গায়েবানা জানাযা নয়। সাহাবাগণ এ ভেদ জানার কারণে কোন সাহাবী জীবনে কোনদিন গায়েবানা জানাজা পড়েননি। কিংবা গায়েবানা জানাযা পড়ার দাবিও করেননি, কিংবা গায়েবানা জানাযার পক্ষে উক্ত হাদীসের দলীলও পেশ করেননি। কারণ তারা জানতেন আসলে উক্ত ঘটনাটি একটি মুজেজা। যাতে নাজাশী গায়েব ছিল না, আল্লাহর কুদরতে নবীজী সাঃ এর মুজেজা স্বরূপ উপস্থিত ছিল।
দূরের বস্তু উপস্থিত হয়ে যাওয়ার মুজেজার প্রমাণ কি?
আল্লাহ তাআলার জন্য কোন কিছুই অসম্ভব নয়। নবীদের মুজেজা আর ওলীদের কারামত সত্য। এটাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের আকিদা। রাসূল সাঃ থেকে আল্লাহ তাআলা অনেক মুজেজা প্রকাশিত করেছেন। এর মাঝে এটাও ছিল যে, মাঝে মাঝে দূরের বস্তুকে কাছে করে দিতেন। এসব করায় রাসূল সাঃ এর নিজের কোন ক্ষমতা ছিল না। পুরোটাই আল্লাহ প্রদত্ব।
বেশ কিছু মুজেজাপূর্ণ ঘটনায় দূরের বস্তু কাছে দেখেছেন রাসূল সাঃ। যেমন-
১
রাসূল সাঃ মদীনায় ছিলেন। তুমুল যুদ্ধ চলছিল তখন মুতা প্রান্তরে। সাহাবাগণ জীবন বাজি রেখে দ্বীনের জন্য লড়াই করে যাচ্ছিলেন। মদীনায় বসে শত শত মাইল দূরের মুতা প্রান্তরের বর্ণনা রাসূল সাঃ দিচ্ছিলেন। বলতেছিলেন, “জায়েদ ঝান্ডা নিয়েছে এবং শহীদ হয়ে গেছে। তারপর ঝান্ডা জাফর নিয়েছে সেও শহীদ হয়ে গেছে। তারপর ঝান্ডা আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা নিয়েছে সেও শহীদ হয়ে গেছে।” এ পর্যায়ে রাসূল সাঃ কেঁদে দিলেন। বলতে লাগলেন-“এবার ঝান্ডা খালিদ বিন ওয়ালিদ নিয়েছে আর বিজয়ী হয়ে গেছে।”। {সহীহ বুখারী-১/১৬৭}
২
মক্কায় অবস্থান করা অবস্থায় হাজার মাইল দূরের বাইতুল মাকদিসের পূর্ণ হালাত দেখে দেখে কাফেরদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন। {বুখারী-১/৫৪৮}
হাবশা, মুতা আর বাইতুল মাকদিসতো দূনিয়ার স্থান। আমাদের নবীতো মদীনায় বসে থেকে জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেছেন। {বুখারী-১/৭৭,১০৩,১২৬,১৪৪,১৬৪}
৩য় জবাব
এ ঘটনা রাসূল সাঃ এর সাথে বৈশিষ্টমন্ডিত। যদি রাসূল সাঃ এর সাথে বৈশিষ্টমন্ডিত না হতো, তাহলে রাসূল সাঃ পরবর্তীতে অন্যান্য সাহাবীদের গায়েবানা জানাযা পড়তেন। খুলাফায়ে রাশেদীন ও অন্যান্য সাহাবাগণও পড়তেন। অথচ কারো থেকেই গায়েবানা জানাযা পড়ার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। মালেকী মাযহাবের ইমাম আল্লামা ইল্লিশ রহঃ লিখেছেনঃ “মদীনায় নাজাশীর গায়েবানা জানাযা পড়ার বিষয়টি রাসূলের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। কেননা, উম্মত রাসূলের জানাযা আদায় করার প্রতি অধিক আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর গায়েবানা জানাযা আদায় করেনি। এবং নাজাশীর লাশকে অলৌকিকভাবে রাসূলের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। ফলে রাসূল (সা.) নাজাশীর লাশ সামনে দেখেই তার জানাযা পড়েছেন। যেমন, মাইয়্যিত ইমামের সামনে থাকা অবস্থায় ইমাম মাইয়িতকে দেখতে পায়, কিন্তু অনেক মুক্তাদী দেখতে পায় না। আর এ ক্ষেত্রে নামায সহীহ হওয়ার ব্যাপারে কোন মতানৈক্য নেই।” (মানহুল জালীল- ১/৩১৬-৩১৭)।
৪র্থ জবাব
শায়েখ জাকারিয়া রহঃ লিখেনঃ, “আমার নিকট সঠিক এটাই মনে হয় যে, ইমাম বুখারী (রাহ.) এ মাসআলাটিতে হানাফী ও মালেকী মতকে সমর্থন করেছেন এবং “আল-জানাযাতু আলাস সুফূফ” তথা ‘জানাযাতে কাতারবন্দী হওয়া’ শিরোনাম স্থাপন করে ইঙ্গিত করেছেন যে, নাজাশীর জানাযা দৃশ্যমান ছিল; গায়েব ছিল না। আর এটাই উক্ত মাযহাবদ্বয়ের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যা (যা আলোচ্য বিষয়কে সমর্থন করে)। তাইতো হাদীস থাকা সত্ত্বেও তিনি “আল-গায়েবু আলাস সফূফ” তথা ‘অনুপস্থিত ব্যক্তির জানাযা’ অধ্যায় স্থাপন করেননি। তাছাড়া বুখারী শরীফে শিরোনাম স্থাপনের নীতিমালার ৬৫ নম্বরে উল্লেখ রয়েছে, কোন মাসআলা ইমাম বুখারী (রাহ.)এর মতামতের পরিপন্থী হলে শিরোনাম হিসেবে উল্লেখ করেন না”। (হাশীয়া লামিউদ দারারী শরহুল বুখারী- ২/১২২, মাকতাবাতুল আশরাফিয়া দিল্লী)।
সুতরাং বুঝা গেল যে, ইমাম বুখারী রহঃ নিজেই উক্ত হাদীসকে গায়েবানা জানাযা জায়েজের দলীল মনে করেননি।
একটি হাস্যকর দলীল ও জবাব
অনেক ভাই গায়েবানা জানাযাকে জায়েজ প্রমাণ করার জন্য একটি হাস্যকর দলীল পেশ করে থাকেন। তারা বলে থাকেন, গায়েবানা জানাযা পড়া যে, জায়েজ এর পরিস্কার দলীল হল, জানাযার নামাযে যে দুআ পড়া হয়, তাতে বলা হয়, “শাহিদিনা ওয়া গায়িবিনা” তথা উপস্থিত ও অনুপস্থিত উভয় ব্যক্তির জন্যই দুআ করা হয়ে থাকে। আর জানাযা নামায যেহেতু দুআ। আর তাতে উপস্থিত ও অনুপস্থিত উভয় ব্যক্তির জন্যই মাগফিরাতের কথা এসেছে, তাই বুঝা যাচ্ছে অনুপস্থিত ব্যক্তির জানাযাও জায়েজ আছে। অর্থাৎ গায়েবানা জানাযা বৈধ।
জবাব
আসলে এ দলীলটি খুবই হাস্যকর দলীল। যদি গায়িবিনা তথা অনুপস্থিত ব্যক্তির মাগফিরাতের কথা উল্লেখ থাকায় গায়েবানা জানাযা জায়েজ হয়ে যায়, তাহলেতো একই যুক্তিতেই জীবিত ব্যক্তির জানাযা পড়া জায়েজ হয়ে যাবে। কারণ জানাযার নামাযের দুআয় পড়া হয়, আল্লাহুম্মাগফিরলী হাইয়্যিনা ওয়া মাইয়্যিতিনা” তথা হে আল্লাহ! তুমি আমাদের জীবিত ও মৃতদের মাফ করে দাও।
লক্ষ্য করুন, মাফ চাওয়া হয় প্রথমে জীবিতদের ব্যাপারে। তারপর বলা হয় “ওয়া শাহিদিনা ও গায়িবিনা”।
যদি “গায়িবিনা” শব্দ থাকায় অনুপস্থিত ব্যক্তির জানাযা পড়া জায়েজ হয়ে যায়, তাহলে “হাইয়্যিানা” শব্দ থাকায় জীবিত ব্যক্তির জানাযা কেন জায়েজ হবে না?
আসলে এ দলীলটি খুবই হাস্যকর ও বোকামীসূলভ।
যাইহোক, উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা আশা করি এ বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেছে যে, গায়েবানা জানাযা পড়ার কোন দলীল কুরআন ও হাদীস এবং সাহাবাগণের আমল দ্বারা প্রমাণিত নয়। তাই একাজটি সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের এসব রূসুম রেওয়াজ থেকে মুক্ত হয়ে সঠিকভাবে দ্বীন পালন করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
_______________
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহ.) থেকে জায়েয হওয়ার একটি উক্তি থাকলেও স্বীয় শাগরিদ ইবনে আবী মুসা তাঁর থেকে নাজায়েয হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। হাম্বলী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফিক্বাহ্বিদ আল্লামা ইবনে কুদামা (রাহ.) এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, অর্থাৎ- “ইমাম মালেক (রাহ.) ও ইমাম আবু হানীফা (রাহ.) উভয়ে বলেন, গায়েবানা জানাযা জায়েয নেই। ইমাম আহমদ (রাহ.) থেকে ইবনে আবী মুসা উক্ত ইমামদ্বয়ের অনুরূপ (নাজায়েয হওয়ার) একটি উক্তি বর্ণনা করেছেন।” (আলমুগনী, ইবনে কুদামা (রাহ.)- ২/৩৮৬ পৃষ্ঠা)।
ইমাম শাফেয়ী (রাহ.) ও ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রাহ.)এর মতে মাইয়্যিত ভিন্ন শহরে থাকলে গায়েবানা জানাযা জায়েয। কিন্তু শহরের ভিতরে থাকার মাইয়্যেতের গায়েবানা জানাযা জায়েজ নয়। মাইয়্যেতকে উপস্থিত করতে হবে। (আল-ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু- ১/৫০৪, মাকতাবাতুল হক্কানিয়্যাহ, পাকিস্তান, আল মাজমু- ৫/২৫৩)।
আল্লামা ইবনু আবদিল বার (রাহ.) গায়েবানা জানাযা নাজায়েয হওয়ার উক্তিকে জমহুর ফুক্বাহা তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামায়ে কেরামের মতামত বলে অভিহিত করেছেন। যেমনটি উল্লেখ করেছেন বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার শাইখুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া (রাহ.)। তিনি বলেন, “হানাফী ও মালেকী ওলামাগণ বলেন, গায়েবানা জানাযা শরীআত সম্মত নয়। ইবনু আবদিল বার (রাহ.) এ উক্তিকে অধিকাংশ ওলামাদের মত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।” (লামিউদ দারারী- ৪/৪৩২ পৃষ্ঠা)।
বিশুদ্ধতম মত
অনুপস্থিত ব্যক্তির জানাজা বা গায়েবানা জানাযা বলতে কোন শব্দ কুরআন, হাদীসের কোথাও নেই। এর কোন প্রমাণ না কুরআনে আছে, না হাদীসে আছে। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীগণ, তাবে তাবেয়ীগণ থেকে এ শব্দের কোন জানাযার প্রমাণ পাওয়া যায় না।
তাই গায়েবানা জানাযা পড়া জায়েজ নেই। এটি বিদআত।
তাই গায়েবানা জানাযা পড়া জায়েজ নেই। এটি বিদআত।
রাসূল সাঃ ও খুলাফায়ে রাশেদীন কোন দিন কারো গায়েবানা জানাযা আদায় করেননি
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যুম রহঃ বলেন, মুসলমানদের মাঝে অনেক এমন ব্যক্তি ইন্তেকাল করেছেন যারা রাসূল সাঃ থেকে দূরে তথা গায়েব ছিলেন। কিন্তু নবীজী সাঃ কারোরই গায়েবানা জানাযা পড়েননি। {যাদুল মাআদ-১/৫১৯}
এমনিভাবে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাঃ এর আমলে কত কারী সাহাবীকে মুসাইলামায়ে কাজ্জাব শহীদ করেছে। আরো কত সাহাবী জিহাদের ময়দানে শহীদ হয়েছেন কিন্তু হযরত আবু বকর রাঃ এবং অন্যান্য সাহাবীগণ কেউই গায়েবানা জানাযা আদায় করেননি।
হযরত উমর রাঃ এর আমলে কত জিহাদ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কত হাজার হাজার সাহাবা জিহাদের ময়দানে মদীনা থেকে বহু দূরে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু কোন একজনেরও গায়েবানা জানাযা হযরত উমর রাঃ আমলে অনুষ্ঠিত হয়েছে মর্মে কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না।
পারবে না হযরত উসমান রাঃ ও হযরত আলী রাঃ এর আমলের কোন উদাহরণ পেশ করতে। অথচ হযরত উসমান রাঃ ও হযরত আলী রাঃ আমলেও কত হাজার হাজার সাহাবা ও তাবেয়ীগণ শহীদ হয়েছেন। কিন্তু কোন সাহাবীই গায়েবানা জানাযার ইলান করেছেন বা নিজে গায়েবানা জানাযার নামায পড়েছেন মর্মে কোন প্রমাণ না হাদীস থেকে পেশ করতে পারবে, না ইতিহাস থেকে পেশ করতে পারবে।
গায়েবানা জানাযা জায়েয প্রবক্তাদের দলীল ও তার খন্ডনঃ
দলীল
বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) সূত্রে একটি বর্ণনায় রয়েছে, “মহানবী (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে বাদশাহ নাজাশীর মৃত্যু সংবাদ দিলেন। অতঃপর জানাযার জন্য অগ্রসর হলেন। সাহাবায়ে কেরাম তাঁর পিছনে কাতার বন্দী হয়ে দাঁড়ালে নবীজী (সা.) চারটি তাকবীর বললেন।” (বুখারী শরীফ, দিল্লী- ১/ ১৬৭ পৃষ্ঠা)।
দলীল
বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) সূত্রে একটি বর্ণনায় রয়েছে, “মহানবী (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে বাদশাহ নাজাশীর মৃত্যু সংবাদ দিলেন। অতঃপর জানাযার জন্য অগ্রসর হলেন। সাহাবায়ে কেরাম তাঁর পিছনে কাতার বন্দী হয়ে দাঁড়ালে নবীজী (সা.) চারটি তাকবীর বললেন।” (বুখারী শরীফ, দিল্লী- ১/ ১৬৭ পৃষ্ঠা)।
একই বর্ণনা সহীহ ইবনে হিব্বানে (১/১৬৭) হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে ।
আর নাজাশী যেহেতু মদীনায় উপস্থিত ছিল না, অথচ রাসূল সাঃ তাদের নাজাশীর জানাযা নামায পড়িয়েছেন, তাই বুঝা গেল যে, গায়েবানা জানাযা পড়া জায়েজ। রাসূল সাঃ থেকেই গায়েবানা জানাযা পড়ার প্রমাণ রয়েছে।
উত্তর
১ম জবাব
প্রথমে আমরা দেখে নেই উক্ত হাদীসটি কোন রাবী বর্ণনা করেছেন? উক্ত হাদীসের বর্ণনাকারীগণ নাজাশীর জানাযা সংশ্লিষ্ট হাদীস থেকে গায়েবানা জানাযা জায়েজ হবার দলীল হিসেবেই বুঝেছেন না ভিন্ন কিছু?
প্রথমে আমরা দেখে নেই উক্ত হাদীসটি কোন রাবী বর্ণনা করেছেন? উক্ত হাদীসের বর্ণনাকারীগণ নাজাশীর জানাযা সংশ্লিষ্ট হাদীস থেকে গায়েবানা জানাযা জায়েজ হবার দলীল হিসেবেই বুঝেছেন না ভিন্ন কিছু?
উক্ত হাদীসের প্রসিদ্ধতম রাবী রয়েছেন তিনজন। যথা-
১- হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ।
২- হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাঃ।
৩- হযরত ইমরান বিন হুসাইন রাঃ।
বাদশা নাজাশী ইন্তেকাল করেছেন নবম হিজরীর রজব মাসে। {হাশিয়ায়ে মুয়াত্তা মালিক-২০৮}
আর হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ ইন্তেকাল করেছেন ৫৯ হিজরীতে। অর্থাৎ উক্ত ঘটনার পর হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ প্রায় ৫০ বছর জীবিত ছিলেন। হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাঃ ইন্তেকাল করেছেন ৭৯ হিজরীতে ইন্তেকাল করেছেন। সেই হিসেবে তিনি উক্ত ঘটনার পর ৭০ বছর জীবিত ছিলেন। আর হযরত ইমরান বিন হুসাইন রাঃ উক্ত ঘটনার পর জীবিত ছিলেন প্রায় ৪৩ বছর।
কিন্তু হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ এ ৫০ বছরের মাঝে, হযরত জাবের রাঃ পুরো ৭০ বছরের মাঝে এবং হযরত ইমরান বিন হুসাইন রাঃ তার জীবনের এই ৪৩ বছরের মাঝে কোনদিন কারো গায়েবানা জানাযা পড়েছেন, কিংবা গায়েবানা জানাযা পড়তে বলেছেন কেউ প্রমাণ দেখাতে পারবে?
এত দীর্ঘ বেঁচে থাকার পরও উক্ত ঘটনা থেকে এসকল সাহাবাগণ যদি গায়েবানা জানাযা জায়েজের প্রমাণই বুঝে থাকতেন, তাহলে তাদের জমানায় ইন্তেকাল হওয়া অসংখ্য সাহাবীদের গায়েবানা জানাযা তাদের পড়ার কথা। কিন্তু একজনের গায়েবানা জানাযা পড়ানোর কোন প্রমাণ না কোন হাদীস গ্রন্থে আছে না কোন ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায়। যা পরিস্কার প্রমাণ করছে যে, উক্ত ঘটনা দ্বারা কোন সাহাবী গায়েবানা জানাযা জায়েজ বুঝেননি। বরং বিষয় ছিল ভিন্ন। আসলে কি হয়েছিল তখন? আমরা যদি উক্ত ঘটনার বর্ণনা সম্বলিত সকল হাদীসকে সামনে রাখি, তাহলে আমাদের কাছে উক্ত বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
২য় জবাব
নাজাশীর ঘটনা সম্বলিত হাদীসমূহ
১
হযরত ইমরান বিন হুসাইন রাঃ বলেন- وَمَا نَحْسِبُ الْجِنَازَةَ إِلَّا مَوْضُوعَةً بَيْنَ يَدَيْهِতথা আমরা জানাযার ব্যাপারে এটাই অনুধাবন করছিলাম যে, তা আমাদের সামনে রাখা আছে। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২০০০৫}
২
হযরত ইমরান বিন হুসাইন রাঃ বলেন- وَهُمْ لَا يَظُنُّونَ إِلَّا أَنَّ جَنَازَتَهُ بَيْنَ يديهতথা “সাহাবায়ে কেরামের বিশ্বাস এটাই ছিল যে, জানাযা হুযূর (সা.)এর সামনে উপস্থিত। {সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৩১০২}
৩
এছাড়া উক্ত বর্ণনাটি হযরত আবান (রাহ.) সূত্রে হযরত ইমরান ইবনে হাছীন থেকে বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে, “যখন নবীজী (সা.)এর পিছনে জানাযা পড়েছি, তখন নাজাশীর লাশকে আমাদের সামনে উপস্থিত দেখতে পেয়েছি।” (উমদাতুল কারী শরহুল বুখারী- ৭/৩৩, মাকতাবায়ে তাওফীকিয়া, মিসর; ফাতহুল বারী- ৩/২৪৩ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ)।
৪
আবু আওয়ানাতে এ শব্দ এসেছে যে, نحن لا نرى ان الجنازة قدمناতথা আমরা দেখছিলাম যে, আমাদের সামনে জানাযা রাখা।
উপরোক্ত সকল বর্ণনার দিকে তাকালে পরিস্কার হয়ে যাবে, নাজাশীর জানাযা বর্ণনাকারী সাহাবীগণ কেন উক্ত ঘটনা দ্বারা গায়েবানা জায়েজের দলীল মনে করেননি। নাজাশীর জানাযার বর্ণনা করলেও জীবনে কোনদিন নিজে গায়েবানা জানাযা পড়েননি। কারণ তারা পরিস্কার বুঝেছিলেন নাজাশীর জানাযার নামাযটি গায়েবানা জানাযা নয়। বরং উপস্থিত ব্যক্তির জানাযা। রাসূল সাঃ এর মুজেযা স্বরূপ নাজাশীকে নবীজী সাঃ এর সামনে উপস্থিত করে দেয়া হয়েছিল। আর সেই জানাযা সামনে নিয়ে নবীজী সাঃ জানাযা পড়িয়েছেন। আর সামনে নিয়ে জানাযা পড়ার নাম উপস্থিত ব্যক্তির জানাযা গায়েবানা জানাযা নয়। সাহাবাগণ এ ভেদ জানার কারণে কোন সাহাবী জীবনে কোনদিন গায়েবানা জানাজা পড়েননি। কিংবা গায়েবানা জানাযা পড়ার দাবিও করেননি, কিংবা গায়েবানা জানাযার পক্ষে উক্ত হাদীসের দলীলও পেশ করেননি। কারণ তারা জানতেন আসলে উক্ত ঘটনাটি একটি মুজেজা। যাতে নাজাশী গায়েব ছিল না, আল্লাহর কুদরতে নবীজী সাঃ এর মুজেজা স্বরূপ উপস্থিত ছিল।
দূরের বস্তু উপস্থিত হয়ে যাওয়ার মুজেজার প্রমাণ কি?
আল্লাহ তাআলার জন্য কোন কিছুই অসম্ভব নয়। নবীদের মুজেজা আর ওলীদের কারামত সত্য। এটাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের আকিদা। রাসূল সাঃ থেকে আল্লাহ তাআলা অনেক মুজেজা প্রকাশিত করেছেন। এর মাঝে এটাও ছিল যে, মাঝে মাঝে দূরের বস্তুকে কাছে করে দিতেন। এসব করায় রাসূল সাঃ এর নিজের কোন ক্ষমতা ছিল না। পুরোটাই আল্লাহ প্রদত্ব।
বেশ কিছু মুজেজাপূর্ণ ঘটনায় দূরের বস্তু কাছে দেখেছেন রাসূল সাঃ। যেমন-
১
রাসূল সাঃ মদীনায় ছিলেন। তুমুল যুদ্ধ চলছিল তখন মুতা প্রান্তরে। সাহাবাগণ জীবন বাজি রেখে দ্বীনের জন্য লড়াই করে যাচ্ছিলেন। মদীনায় বসে শত শত মাইল দূরের মুতা প্রান্তরের বর্ণনা রাসূল সাঃ দিচ্ছিলেন। বলতেছিলেন, “জায়েদ ঝান্ডা নিয়েছে এবং শহীদ হয়ে গেছে। তারপর ঝান্ডা জাফর নিয়েছে সেও শহীদ হয়ে গেছে। তারপর ঝান্ডা আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা নিয়েছে সেও শহীদ হয়ে গেছে।” এ পর্যায়ে রাসূল সাঃ কেঁদে দিলেন। বলতে লাগলেন-“এবার ঝান্ডা খালিদ বিন ওয়ালিদ নিয়েছে আর বিজয়ী হয়ে গেছে।”। {সহীহ বুখারী-১/১৬৭}
২
মক্কায় অবস্থান করা অবস্থায় হাজার মাইল দূরের বাইতুল মাকদিসের পূর্ণ হালাত দেখে দেখে কাফেরদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন। {বুখারী-১/৫৪৮}
হাবশা, মুতা আর বাইতুল মাকদিসতো দূনিয়ার স্থান। আমাদের নবীতো মদীনায় বসে থেকে জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেছেন। {বুখারী-১/৭৭,১০৩,১২৬,১৪৪,১৬৪}
৩য় জবাব
এ ঘটনা রাসূল সাঃ এর সাথে বৈশিষ্টমন্ডিত। যদি রাসূল সাঃ এর সাথে বৈশিষ্টমন্ডিত না হতো, তাহলে রাসূল সাঃ পরবর্তীতে অন্যান্য সাহাবীদের গায়েবানা জানাযা পড়তেন। খুলাফায়ে রাশেদীন ও অন্যান্য সাহাবাগণও পড়তেন। অথচ কারো থেকেই গায়েবানা জানাযা পড়ার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। মালেকী মাযহাবের ইমাম আল্লামা ইল্লিশ রহঃ লিখেছেনঃ “মদীনায় নাজাশীর গায়েবানা জানাযা পড়ার বিষয়টি রাসূলের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। কেননা, উম্মত রাসূলের জানাযা আদায় করার প্রতি অধিক আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর গায়েবানা জানাযা আদায় করেনি। এবং নাজাশীর লাশকে অলৌকিকভাবে রাসূলের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। ফলে রাসূল (সা.) নাজাশীর লাশ সামনে দেখেই তার জানাযা পড়েছেন। যেমন, মাইয়্যিত ইমামের সামনে থাকা অবস্থায় ইমাম মাইয়িতকে দেখতে পায়, কিন্তু অনেক মুক্তাদী দেখতে পায় না। আর এ ক্ষেত্রে নামায সহীহ হওয়ার ব্যাপারে কোন মতানৈক্য নেই।” (মানহুল জালীল- ১/৩১৬-৩১৭)।
৪র্থ জবাব
শায়েখ জাকারিয়া রহঃ লিখেনঃ, “আমার নিকট সঠিক এটাই মনে হয় যে, ইমাম বুখারী (রাহ.) এ মাসআলাটিতে হানাফী ও মালেকী মতকে সমর্থন করেছেন এবং “আল-জানাযাতু আলাস সুফূফ” তথা ‘জানাযাতে কাতারবন্দী হওয়া’ শিরোনাম স্থাপন করে ইঙ্গিত করেছেন যে, নাজাশীর জানাযা দৃশ্যমান ছিল; গায়েব ছিল না। আর এটাই উক্ত মাযহাবদ্বয়ের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যা (যা আলোচ্য বিষয়কে সমর্থন করে)। তাইতো হাদীস থাকা সত্ত্বেও তিনি “আল-গায়েবু আলাস সফূফ” তথা ‘অনুপস্থিত ব্যক্তির জানাযা’ অধ্যায় স্থাপন করেননি। তাছাড়া বুখারী শরীফে শিরোনাম স্থাপনের নীতিমালার ৬৫ নম্বরে উল্লেখ রয়েছে, কোন মাসআলা ইমাম বুখারী (রাহ.)এর মতামতের পরিপন্থী হলে শিরোনাম হিসেবে উল্লেখ করেন না”। (হাশীয়া লামিউদ দারারী শরহুল বুখারী- ২/১২২, মাকতাবাতুল আশরাফিয়া দিল্লী)।
সুতরাং বুঝা গেল যে, ইমাম বুখারী রহঃ নিজেই উক্ত হাদীসকে গায়েবানা জানাযা জায়েজের দলীল মনে করেননি।
একটি হাস্যকর দলীল ও জবাব
অনেক ভাই গায়েবানা জানাযাকে জায়েজ প্রমাণ করার জন্য একটি হাস্যকর দলীল পেশ করে থাকেন। তারা বলে থাকেন, গায়েবানা জানাযা পড়া যে, জায়েজ এর পরিস্কার দলীল হল, জানাযার নামাযে যে দুআ পড়া হয়, তাতে বলা হয়, “শাহিদিনা ওয়া গায়িবিনা” তথা উপস্থিত ও অনুপস্থিত উভয় ব্যক্তির জন্যই দুআ করা হয়ে থাকে। আর জানাযা নামায যেহেতু দুআ। আর তাতে উপস্থিত ও অনুপস্থিত উভয় ব্যক্তির জন্যই মাগফিরাতের কথা এসেছে, তাই বুঝা যাচ্ছে অনুপস্থিত ব্যক্তির জানাযাও জায়েজ আছে। অর্থাৎ গায়েবানা জানাযা বৈধ।
জবাব
আসলে এ দলীলটি খুবই হাস্যকর দলীল। যদি গায়িবিনা তথা অনুপস্থিত ব্যক্তির মাগফিরাতের কথা উল্লেখ থাকায় গায়েবানা জানাযা জায়েজ হয়ে যায়, তাহলেতো একই যুক্তিতেই জীবিত ব্যক্তির জানাযা পড়া জায়েজ হয়ে যাবে। কারণ জানাযার নামাযের দুআয় পড়া হয়, আল্লাহুম্মাগফিরলী হাইয়্যিনা ওয়া মাইয়্যিতিনা” তথা হে আল্লাহ! তুমি আমাদের জীবিত ও মৃতদের মাফ করে দাও।
লক্ষ্য করুন, মাফ চাওয়া হয় প্রথমে জীবিতদের ব্যাপারে। তারপর বলা হয় “ওয়া শাহিদিনা ও গায়িবিনা”।
যদি “গায়িবিনা” শব্দ থাকায় অনুপস্থিত ব্যক্তির জানাযা পড়া জায়েজ হয়ে যায়, তাহলে “হাইয়্যিানা” শব্দ থাকায় জীবিত ব্যক্তির জানাযা কেন জায়েজ হবে না?
আসলে এ দলীলটি খুবই হাস্যকর ও বোকামীসূলভ।
যাইহোক, উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা আশা করি এ বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেছে যে, গায়েবানা জানাযা পড়ার কোন দলীল কুরআন ও হাদীস এবং সাহাবাগণের আমল দ্বারা প্রমাণিত নয়। তাই একাজটি সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের এসব রূসুম রেওয়াজ থেকে মুক্ত হয়ে সঠিকভাবে দ্বীন পালন করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
_______________
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন