আজ শতাব্দীর দীর্ঘতম চন্দ্রগ্রহণ
আজ ২৭ জুলাই ২০১৮ রাত ১১টা ১৩মিনিট (বাংলাদেশ সময়) থেকে শুরু হবে একবিংশ শতাব্দীর দীর্ঘতম চন্দ্রগ্রহণ। আংশিক ও পূর্ণগ্রাস মিলে মোট ৩ ঘন্টা ৫৫ মিনিট স্থায়ী থাকবে আজকের এই চন্দ্রগ্রহণ। উল্লেখ্য, এর আগের দীর্ঘ চন্দ্রগ্রহণ হয় ২০১১ সালের ১৫ জুন। সেটা ১০০ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল।
উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মানুষ ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার মানুষ এই চন্দ্রগ্রহণ অবলোকন করতে পারবেন।
সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ যখন একই সরল রেখা বরাবর অবস্থান করে এবং পৃথিবীর ছায়া সরাসরি চাঁদকে ঢেকে ফেলে। তখন চাঁদকে সাময়িকভাবে দেখা যায়না। চাঁদের এই অবস্থাকে বলা হয় চন্দ্রগ্রহণ।
আজকের এই পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণে লালচে রঙ ধারণ করবে চাঁদ। চাঁদের এই অবস্থার নাম দেয়া হয়েছে ‘ব্লাড মুন’। আজ চাঁদের জোসনা মিলিয়ে যাবে। চাঁদ হয়ে উঠবে রক্তিমবর্ণ।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের সময় কুসুফ (সূর্যগ্রহণ) ও খুসুফ(চন্দ্রগ্রহণ)এর নামাজ আদায় করতেন।
এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন, ‘চন্দ্র-সূর্য আল্লাহতায়ালার দু’টি বিরাট নিদর্শন। কারও জন্ম বা মৃত্যুতে তার আলো নিষ্প্রভ হয় না। বরং আল্লাহতায়ালা এর মাধ্যমে মানুষকে ভীতি প্রদর্শন ও সতর্ক করেন। সুতরাং চন্দ্র-সূর্য আলোহীন হয়ে পড়লে তোমরা নামাজে দাঁড়িয়ে যাও এবং দয়াময় আল্লাহকে কায়মনোবাক্যে ডাক, যতক্ষণ না সে অবস্থার পরিবর্তন হয়।’ (সহিহ বোখারি)
সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের সময় রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর চেহারা ভয়ে বিবর্ণ হয়ে যেত। তখন তিনি সাহাবীদের নিয়ে জামাতে নামাজ পড়তেন। কান্নাকাটি করতেন। আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন।
তাই আজ চন্দ্রগ্রহণের সময় আনন্দ উল্লাস না করে খুসুফের নামাজ পড়াই হবে উত্তম কাজ বা আমল।
গর্ভবতীর ওপর কি সত্যিই চন্দ্রগ্রহণের প্রভাব পড়ে?’
আবদুর রহমান। পেশায় নির্মাণ শ্রমিক। সদ্যবিবাহিত ২৫ বছর বয়সী যুবকটি কাজের ফাঁকে নাশতা করার জন্য একটি দোকানে এলেন। এক টুকরা কেক আর একটি কলা খাবেন। একটি জোড়া কলা নিতে গেলে পাশে বসা একজন বৃদ্ধ বলে উঠলেন, ‘না! জোড়া কলা খাবেন না। খেলে যমজ সন্তান হবে। ’ ‘জোড়া কলা খেলে যমজ সন্তান হবে’—এমন অনেক বিশ্বাস সমাজে প্রচলিত। এগুলোর একটি হলো চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের সময় গর্ভবতী মা যদি কিছু কাটাকাটি করেন, তাহলে গর্ভস্থ সন্তান কান কাটা বা ঠোঁট কাটা অবস্থায় জন্ম নেয়।
এ সময় গর্ভবতী নারীদের ঘুম বা পানাহার থেকে বারণ করা হয়। আসলে কোরআন ও হাদিসে এ ধরনের বিশ্বাসের অস্তিত্ব কতটুকু?
প্রতিনিয়ত মহান আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের জানান দিতে থাকা সৃষ্টিগুলোর বড় দুটি হলো সূর্য ও চন্দ্র। চাঁদের আলোর উৎস হলো সূর্য।
১৩ লাখ ৯৪ হাজার কিলোমিটার ব্যাসের এ নক্ষত্রের সঙ্গে পৃথিবী ও জীবজগতের সম্পর্ক সুনিবিড়। সূর্যের তাপে মহান আল্লাহ সতেজ আর সজীব রেখেছেন পৃথিবীর সব কিছু। উদ্ভিদ এই সূর্যালোক থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। যদি পৃথিবীতে সূর্যের তাপ ও আলো না আসত, তাহলে বিপন্ন হতো প্রাণিকুলের জীবন। পুরো পৃথিবী পরিণত হতো একখণ্ড বরফে। অন্যদিকে সূর্য যদি তার ভেতরকার সব তাপ পৃথিবীর ওপর উগড়ে দিত, তাহলেও পৃথিবী পরিণত হতো শ্মশানে।
পবিত্র কোরআনে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে সূর্য ও চন্দ্র প্রসঙ্গ। আমরা বাংলায় সূর্যালোক অথবা চন্দ্রালোক বলি। ইংরেজিতে বলি Sunlight এবং Moonlight। কিন্তু পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই সত্তা, যিনি সূর্যকে কিরণোজ্জ্বল ও চাঁদকে স্নিগ্ধ আলোয় আলোকিত করেছেন। ’ (সুরা ইউনুস : ৫) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি সৃষ্টি করেছি একটি প্রজ্বলিত বাতি। ’ (সুরা নাবা : ১৩) সূর্যের আলোচনায় কোরআনুল কারিমে সব জায়গায়ই ‘প্রজ্বলিত বাতি’, ‘তেজোদীপ্ত’, ‘উজ্জ্বল জ্যোতি’, ‘চমক/ঝলক’, ‘শিখা’ বলা হয়েছে। যার অর্থ সূর্য নিজে দহনক্রিয়ার মাধ্যমে প্রচণ্ড তাপ ও আলো উৎপন্ন করে; পক্ষান্তরে চাঁদের আলোচনায় বলা হয়েছে, ‘স্নিগ্ধ আলো’। বিজ্ঞানও গবেষণা করে ঠিক তা-ই বলেছে। বিজ্ঞান বলছে, সূর্য তার কেন্দ্রভাগে নিউক্লীয়
সংযোজন বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতি সেকেন্ডে ৬২ কোটি মেট্রিক টন হাইড্রোজেন পুড়িয়ে হিলিয়াম উৎপাদন করে। সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৫৭৭৮ কেলভিন বা ৫৫০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ বিজ্ঞানের বক্তব্যেও সূর্যই তাপশক্তির ও আলোর প্রধান উৎস। পক্ষান্তরে চাঁদের ব্যাপারে বিজ্ঞানের বক্তব্য হলো, চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই। সূর্যের প্রতিফলিত আলোই তার সম্বল। পবিত্র কোরআন আরো স্পষ্ট করে বলছে, ‘আল্লাহ চাঁদকে স্থাপন করেছেন আলোরূপে, আর সূর্যকে স্থাপন করেছেন প্রদীপরূপে। ’ (সুরা নুহ : ১৬)
চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ হলো আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত একটি প্রক্রিয়া। চাঁদ যখন পরিভ্রমণ অবস্থায় কিছুক্ষণের জন্য পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে, তখন পৃথিবীর কোনো দর্শকের কাছে কিছু সময়ের জন্য সূর্য আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায়। এটাই সূর্যগ্রহণ (Solar eclipse) বা কুসুফ। আর পৃথিবী যখন তার পরিভ্রমণ অবস্থায় চাঁদ ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে, তখনই পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে চাঁদ কিছুক্ষণের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়। এটাই চন্দ্রগ্রহণ (Lunar eclipse) বা খুসুফ।
সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক কুসংস্কার আছে। ওই সময় খেতে নেই, তৈরি করা খাবার ফেলে দিতে হবে, গর্ভবতী মায়েরা এ সময় যা করেন, তার প্রভাব সন্তানের ওপর পড়ে, চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের সময় যদি গর্ভবতী নারী কিছু কাটাকাটি করেন, তাহলে গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতি হয়—এটি ভুল বিশ্বাস। এ সময় কোনো নারীকে ঘুম বা পানাহার থেকে বারণ করাও অন্যায়। ইসলামী শরিয়াহ ও বাস্তবতার সঙ্গে এগুলোর কোনো মিল নেই। জাহেলি যুগেও এ ধরনের কিছু ধারণা ছিল। সেকালে মানুষ ধারণা করত যে চন্দ্রগ্রহণ কিংবা সূর্যগ্রহণ হলে অচিরেই দুর্যোগ বা দুর্ভিক্ষ হবে। চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণ পৃথিবীতে কোনো মহাপুরুষের জন্ম বা মৃত্যুর বার্তাও বহন করে বলে তারা মনে করত। বিশ্বমানবতার পরম বন্ধু, মহান সংস্কারক, প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সেগুলোকে ভ্রান্ত ধারণা হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেছেন। মুগিরা ইবনু শুবা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পুত্র ইবরাহিমের ইন্তিকালের দিনটিতেই সূর্যগ্রহণ হলে আমরা বলাবলি করছিলাম যে নবীপুত্রের মৃত্যুর কারণেই সূর্যগ্রহণ হয়েছে। এসব কথা শুনে নবীজি (সা.) বললেন, ‘সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহ তাআলার অগণিত নিদর্শনের দুটি। কারো মৃত্যু বা জন্মের কারণে চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ হয় না। ’ (সহিহ বুখারি : ১০৪৩) চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণকে আল্লাহ তাআলার কুদরত হিসেবে অভিহিত করে অন্য হদিসে নবীজি (সা.) সাহাবিদের চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের সময় নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কোনো লোকের মৃত্যুর কারণে কখনো সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ হয় না। তবে তা আল্লাহ তাআলার নিদর্শনগুলোর দুটি। তোমরা সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ হতে দেখলে নামাজে দাঁড়িয়ে যাবে। (সহিহ বুখারি : ৯৮৪)
নবীজি (সা.)-এর হাদিসগুলো থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণের কোনো প্রভাব সৃষ্টির ওপর পড়ে না। সমাজে প্রচলিত বিশ্বাসগুলো নিছকই কুসংস্কার।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি এর নেতিবাচক কোনো প্রভাব সৃষ্টির ওপর না-ই পড়বে, তাহলে কেন নবীজি (সা.) এ সময় নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহ তাআলার সাহায্য চাইতে বলেছেন? শুধু নামাজে দাঁড়াতেই বলেননি, বরং চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণে তিনি কিয়ামতের মহাপ্রলয়ের আশঙ্কাও করেছেন। হজরত আবু মুসা (রা.) বলেন, নবীজি (সা.)-এর সময় সূর্যগ্রহণ হলে তিনি এ আশঙ্কায় করলেন যে কিয়ামতের মহাপ্রলয় বুঝি সংঘটিত হবে। তিনি (তাড়াতাড়ি) মসজিদে এলেন। অত্যন্ত দীর্ঘ কিয়াম, দীর্ঘ রুকু, সিজদাসহ নামাজ আদায় করলেন। (বর্ণনাকারী বলেন) আমি নবীজি (সা.)-কে এমন করতে আগে আর কখনো দেখিনি। অতঃপর তিনি বললেন, ‘আল্লাহর প্রেরিত এসব নিদর্শন কারো মৃত্যু বা জন্মের (ক্ষতি করার) জন্য হয় না। যখন তোমরা তা দেখবে, তখনই আতঙ্কিত হৃদয়ে আল্লাহ তাআলার জিকির ও ইস্তিগফারে মশগুল হবে। ’ (সহিহ মুসলিম : ১৯৮৯) অন্য হাদিসে চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণকে আল্লাহর পক্ষ থেকে ভীতি প্রদর্শন হিসেবে উল্লেখ করে তা থেকে দ্রুত উদ্ধারে সদকা করার কথা বলেছেন।
নবীজি (সা.) তাঁর উম্মতকে চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণে আতঙ্কিত হয়ে তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য নামাজের নির্দেশ দিয়েছেন। আধুনিক বিজ্ঞানও বলছে যে সত্যি চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণ পৃথিবীর জন্য আতঙ্কের বিষয়। সৌরজগতে মঙ্গল ও বৃহস্পতির কক্ষপথের মধ্যবলয়ে অ্যাস্টেরয়েড (Asteroid), মিটিওরাইট (Meteorite), উল্কাপিণ্ড প্রভৃতি পাথরের এক সুবিশাল বেল্ট আছে বলে বিজ্ঞানীরা ১৮০১ সালে আবিষ্কার করেন। এ বেল্টে ঝুলন্ত একেকটা পাথরের ব্যাস ১২০ থেকে ৪৫০ মাইল। গ্রহাণুপুঞ্জের এ পাথরখণ্ডগুলো পরস্পর সংঘর্ষের ফলে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথরখণ্ড প্রতিনিয়ত পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে। কিন্তু সেগুলো বায়ুমণ্ডলে এসে জ্বলে-পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। কিন্তু গ্রহাণুপুঞ্জের বৃহদাকারের পাথরগুলো যদি পৃথিবীতে আঘাত করে, তাহলে ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন হবে পৃথিবী। বিজ্ঞানীরা বলেন, সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সময় সূর্য, চন্দ্র ও পৃথিবী একই সমান্তরালে, একই অক্ষ বরাবর থাকে বলে এ সময়ই গ্রহাণুপুঞ্জের ঝুলন্ত বড় পাথরগুলো পৃথিবীতে আঘাত হানার আশঙ্কা বেশি। বৃহদাকারের পাথর পৃথিবীর দিকে ছুটে এলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের পক্ষে তা প্রতিহত করা অসম্ভব। ধ্বংসই হবে পৃথিবীর পরিণতি।
তাই তো মহাবিজ্ঞানী আল্লাহ তাআলার প্রিয়তম হাবিব মুহাম্মদ (সা.) এ সময় আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়েছেন। আমাদের উচিত কুসংস্কারগুলো পরিহার করে সুন্নত অনুযায়ী চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের সময় এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা চাওয়া।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন