Translate

রবিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

ধর্মীয় সভা-সম্মেলনের তাৎপর্য ও উপকারিতা অপরিসীম

ধর্মীয় সভা-সম্মেলনের তাৎপর্য ও উপকারিতা আপরিসীম
আমাদের দেশে সারা বছর ব্যাপি বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করলেও কিন্তু শীতকালীন কয়েক মাসের আবহাওয়া ও পরিবেশ অনূকুল থাকায় সারা দেশের প্রায় কওমী মাদরাসা সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মসজিদ মাদরাসা হাট বাজার ইত্যাদিতে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল ,তাফসীরুল কোরআন মাহফিল ,হালকায়ে জিকীর ইত্যাদি সহ নানান নামে ইসলামী সন্মেলন ওয়াজ মাহফিল তুলনামূলক বেশী  হয়ে থাকে। এ সংক্রান্ত যুগোপযোগি একটি বক্তব্য ওস্তাদ মুহতারম জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ার স্বনামধন্য মহা পরিচালক বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও দার্শনিক
আল্লামা মুফতী মুহাম্মদ আবদুল হালীম বুখারী (দা. বা.)
বিগত  ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ জামিয়ার অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক ইসলামি মহাসম্মেলনের প্রস্তুতি উপলক্ষে জামিয়ার মেহমানখানায় অনুষ্ঠিত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের এক সাধারণ সভায় দেওয়া উদ্বোধনী বক্তব্যে একটি চমতকার আলোচনা পেশ করে থাকেন ।
এ সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে কওমি মাদরাসাসমূহের উদ্যোগে আয়োজিত বার্ষিক দীনী মাহফিলের গুরুত্ব ও উপকারিতার ওপর চমৎকার আলোচনা করা হয়েছে এবং আকাবির কর্তৃক প্রচলিত বার্ষিক মাহফিলগুলোকে হেকমতপূর্ণ দীনী দাওয়াতের অন্যতম অংশ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বক্তব্যটি গ্রন্থনা করেন পটিয়া আল জামিয়ার শিক্ষক মাওলানা মুহাম্মদ সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী—সম্পাদক)] পাঠকদের উদ্দ্যেশে সংযোজিত আকারে উপস্হাপন করা হল।




نحمده ونصلى علىٰ رسوله الكريم، أما بعد!

সম্মানিত মাশায়েখে ই’যাম ও আসাতেযায়ে কেরাম! প্রত্যেক বছর আমাদের মাদরাসাগুলোতে জলসা (সভা-সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের পূর্বপুরুষ আকাবিরগণ এ সভা-সম্মেলনের উপকারিতা উপলব্ধি করেছেন, তাই এ ধারাবাহিকতা চলে আসছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

اُدْعُ اِلٰى سَبِيْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ ؕ ۰۰۱۲۵



‘তোমরা হিকমত ও কৌশলে এবং ভাল ওয়ায-নসীহতের মাধ্যমে আল্লাহর রাস্তার দিকে মানুষকে আহ্বান কর।’[1]

একটি হাদিসে কুদসীতে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ h، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ ^: «يَقُوْلُ اللهُ تَعَالَىٰ: أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِيْ بِيْ، وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِيْ، فَإِنْ ذَكَرَنِيْ فِيْ نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِيْ نَفْسِيْ، وَإِنْ ذَكَرَنِيْ فِيْ مَلَإٍ ذَكَرْتُهُ فِيْ مَلَإٍ خَيْرٍ مِنْهُمْ».

‘হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি মানুষের সাথে তাদের ধারণা অনুযায়ী ব্যবহার করে থাকি। তারা আমাকে স্মরণ করলে আমি তাদের সঙ্গে থাকি। তারা যদি আমাকে মনে মনে স্মরণ করে/একাকি স্মরণ করে আমিও তাদেরকে মনে মনে/একাকি স্মরণ করি। আর তারা যদি কোন সভা-সম্মেলনে আমার আলোচনা করে আমিও তাদের আলোচনা এর চেয়ে উত্তম সভা-সম্মেলনে করি অর্থাৎ ফেরেশতাদের মাহফিলে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করি।’’[2]

তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে বিভিন্ন মাহফিলে বয়ান করেছেন। এমনকি জিনদেরকে নিয়েও ইশার নামাযের পর সম্মেলন করেছেন। লায়লাতুল জিনের হাদিস পড়লে তা বোঝা যায়।



عَنْ عَامِرٍ، قَالَ: سَأَلْتُ عَلْقَمَةَ هَلْ كَانَ ابْنُ مَسْعُوْدٍ شَهِدَ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ لَيْلَةَ الْـجِنِّ؟ قَالَ: فَقَالَ عَلْقَمَةُ، أَنَا سَأَلْتُ ابْنَ مَسْعُوْدٍ فَقُلْتُ: هَلْ شَهِدَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ لَيْلَةَ الْـجِنِّ؟ قَالَ: لَا وَلَكِنَّا كُنَّا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ ذَاتَ لَيْلَةٍ فَفَقَدْنَاهُ فَالْتَمَسْنَاهُ فِي الْأَوْدِيَةِ وَالشِّعَابِ. فَقُلْنَا: اسْتُطِيْرَ أَوِ اغْتِيْلَ. قَالَ: فَبِتْنَا بِشَرِّ لَيْلَةٍ بَاتَ بِهَا قَوْمٌ فَلَمَّا أَصْبَحْنَا إِذَا هُوَ جَاءٍ مِنْ قِبَلَ حِرَاءٍ. قَالَ: فَقُلْنَا يَا رَسُوْلَ اللهِ فَقَدْنَاكَ فَطَلَبْنَاكَ فَلَمْ نَجِدْكَ فَبِتْنَا بِشَرِّ لَيْلَةٍ بَاتَ بِهَا قَوْمٌ، فَقَالَ: «أَتَانِيْ دَاعِي الْـجِنِّ فَذَهَبْتُ مَعَهُ فَقَرَأْتُ عَلَيْهِمُ الْقُرْآنَ»، قَالَ: فَانْطَلَقَ بِنَا فَأَرَانَا آثَارَهُمْ وَآثَارَ نِيرَانِهِمْ وَسَأَلُوهُ الزَّادَ، فَقَالَ: لَكُمْ كُلُّ عَظْمٍ ذُكِرَ اسْمُ اللهِ عَلَيْهِ يَقَعُ فِيْ أَيْدِيكُمْ أَوْفَرَ مَا يَكُونُ لَـحْمًا وَكُلُّ بَعْرَةٍ عَلَفٌ لِدَوَابِّكُمْ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ: «فَلَا تَسْتَنْجُوا بِهِمَا فَإِنَّهُمَا طَعَامُ إِخْوَانِكُمْ».

‘আমের (রহ.) বলেন, আমি আলকমা (রহ.) (ইবনে মাসউদ রাযি.-এর ছাত্র)-কে জিজ্ঞাসা করলাম ইবনে মাসউদ (রাযি.) কি জিনের রজনীতে রাসুলের সাথে ছিলেন? তখন তিনি বলেন, আমি একথা ইবনে মাসউদ (রাযি.)-কে জিজ্ঞাসা করে ছিলাম যে, জিনের রজনীতে রাসুলের সাথে কী কেউ ছিলেন? তখন তিনি বলেন, না। তবে হ্যাঁ, এক রজনীতে আমরা রাসূলের সাথে ছিলাম। হঠাৎ আমরা তাঁকে হারিয়ে ফেললাম। আমরা তাঁকে শহর-উপত্যকায় তালাশ করলাম। আমরা তাঁকে পেলাম না। তখন আমরা বললাম, হয়তো তাঁকে গুম করা হয়েছে কিংবা খুন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা খুবই মন্দভাবে রাত যাপনক রলাম। সকালবেলা তিনি হেরার দিক থেকে আমাদের দিকে আগমন করলেন। তিনি বলেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে হারিয়ে আমরা অনেক খোজাখুঁজি করেছি। তবে আপনাকে পেলাম না। তাই আমরা অস্থির অবস্থায় রাত যাপন করেছি। তখন তিনি বলেন, ‘আমার নিকট জিনের পক্ষ থেকে আহ্বানকারী এসেছে। আমি তার সাথে চলে গিয়েছিলাম। আমি তাদেরকে কুরআন শিক্ষা দিয়েছি (ওয়ায-নসীহত করেছি)।’ তিনি বলেন, অতঃপর তিনি আমাদেরকে নিয়ে চললেন আর আমরা তাদের পদচিহ্ন ও আগুনের চিহ্ন দেখলাম। তারা রাসুলের নিকট খাবার চাইলেন। সুতরাং তিনি তার আলোচনা করলেন। অতঃপর রাসূল (সা.) বলেন, তোমরা হাড্ডি এবং গোবর দ্বারা ঢিলা-কুলখ নেবে না। কেননা তা তোমাদের ভাই জিনজাতির খাবার।’’[3]



তেমনি একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) ঈদের খুতবায় সাহাবায়ে কেরামকে ওয়ায-নসীহত করেন। আর ওই ওয়ায মহিলারা পেছনে থাকার কারণে শুনতে পায়নি (যেহেতু তখন মাইকের ব্যবস্থা ছিল না) তাই, রাসুল (সা.) হযরত বিলাল (রাযি.)-কে সাথে নিয়ে মহিলাদের ক্যাম্পে গিয়ে পুনরায় আলোচনা করেছেন। সেই আলোচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মহিলারা নিজেদের স্বর্ণের গহনা খুলে সাদকা করে দেন। হযরত বিলাল (রাযি.) কাপড়ের কোণায় করে সেগুলো সংগ্রহ করেছেন।

عَنْ عَطَاءٍ، قَالَ: سَمِعْتُ ابْنَ عَبَّاسٍ، يَقُوْلُ: «أَشْهَدُ أَنِّي شَهِدْتُ الْعِيْدَ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ ^، فَبَدَأَ بِالصَّلَاةِ قَبْلَ الْـخُطْبَةِ، ثُمَّ خَطَبَ فَرَأَىٰ أَنَّهُ لَـمْ يُسْمِعَ النِّسَاءَ فَأَتَى النِّسَاءَ فَوَعَظَهُنَّ، وَذَكَّرَهُنَّ وَأَمَرَهُنَّ بِالصَّدَقَةِ وَمَعَهُ بِلَالٌ قَائِلٌ بِثَوْبِهِ هَكَذَا أَيْ فَاتِحَهُ فَجَعَلَتِ الْمَرْأَةُ تُلْقِي الْـخُرْصَ، وَالْـخَاتَمَ، وَالشَّيْءَ».

‘হযরত আতা (রহ.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.)-কে বলতে শুনেছি, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি রাসুলের সাথে ঈদে শরিক হয়েছি। তিনি খুতবার পূর্বে নাময আদায় করলেন। অতঃপর খুতবা দিলেন। আমি লক্ষ করলাম যে, তিনি মহিলাদেরকে শোনাতে পারেননি। তাই তিনি তাদেরকে পৃথকভাবে ওয়ায করেছেন এবং উপদেশ দিয়েছেন। তাদেরকে সদকার জন্য আদেশ করেন। তাঁর সাথে হযরত বেলাল (রাযি.) ছিলেন। তিনি তার চাদর বিছিয়ে দেন। মহিলারা সেখানে নিজেদের কানের দুল, আংটি ও অন্যান্য জিনিস প্রদান করেন।’[4]

আল-হামদু লিল্লাহ আমাদের জামিয়ায়ও প্রতিবছর জলসা হয়ে থাকে। সম্মেলনের উদ্দেশ্য মানুষের হিদায়ত। একজন মানুষও যদি এ জলসার মাধ্যমে হিদায়তপ্রাপ্ত হয় তাহলে এটি আমাদের জন্য বড় পাওয়া। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) হযরত আলী (রাযি.)-কে বলেন, তোমার প্রচেষ্টায় আল্লাহ যদি একজন মানুষকেও হিদায়ত দান করেন তাহলে তা আরবের লাল লাল উট (যা খুবই মূল্যবান) সবগুলো সাদকা করার চেয়েও উত্তম।[5]



عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ، أنَّ النَّبيَّ ﷺ قَالَ لِعَليًّ: «فَوَاللهِ لَأَنْ يَهْدِيَ اللهُ بِكَ رَجُلًا وَاحِدًا، خَيْرٌ لَكَ مِنْ أَنْ يَكُونَ لَكَ حُمْرُ النَّعَمِ».

এজন্যেই কিছুদিন পড়া-শোনা বন্ধ করে, জামিয়ার সকল বিভাগে ছুটি ঘোষণা করে এ জলসার ইহতিমাম করা হয়।

সংকলন:
মুহাম্মদ সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী
শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
সূত্র
[1] আল-কুরআন, সুরা আন-নাহল, ১৬:১২৫

[2] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৯, পৃ. ১২১, হাদীস: ৭৪০৫

[3] মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান, খ. ১, পৃ. ৩৩২, হাদীস: ৪৫০

[4] আন-নাসায়ী, আস-সুনানুল কুবরা, মুআস্সিসা আর-রিসালা, বয়রুত, লেবনান, খ. ২, পৃ. ৩০০, হাদীস: ১৭৭৯

[5] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৫, পৃ. ১৮, হাদীস: ৩৭০১

সন্মনীত পাঠক বৃন্দ
এখানে ওস্তাদ মোহতারম এর আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে সক্ষম হয়েছি যে ,এ সকল সভা সমিতি,ইসলামি সন্মেলন গুলো শুধু প্রথাগত কোন প্রোগ্রাম নয় বরং এর শরয়ী গ্রহনযোগ্যতাও আছে ।তা উক্ত আলোচনায় ফুটে উঠেছে।

তাছাডা এ সকল সভা সেমিনার ও ইসলামী সন্মেলন গুলোতে যে সকল মানুষ সারা বছর গাফেল থাকে দ্বীনের ধারে কাছেও যায়না  কিন্তু এ ওয়াজের মৌসুমে তারা ওয়াজ নসিহত শুনার মাধ্যমে নিত্য নতুন মাসয়ালা মাসায়েল শুনে নিজেদের জীবনকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হন। অপর দিকে দ্বীনের দায়িরাও এ সুযোগে  দ্বীনের কথা গুলো সমাজের  বঞ্চিত নীপিডিত মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌছাতে সক্ষম হন।

তাছাডা যে সকল ভাইয়েরা সারা বছর নফলি দান ছদকা করার থেকে বিরত থাকেন  বা গাফেল থাকেন তাদের জন্যও মন ভরে দান ছদকা করার একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যা কিনা আখেরাতের পুঁজি সংগ্রহের একটি মাধ্যম।অপর দিকে আমাদের দেশের প্রায় দ্বীনি প্রতিষ্ঠান/ মাদরাসা / মসজিদ বিশেষত ক্বওমী মাদরাসা গুলো জনগনের নিঃস্বার্থ দান অনুদানে পরিচালিত হয়ে থাকে এ ওয়াজ মাহফিল/ইসলামি সন্মেলনের উসিলায় তারা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রেও কিছু দান অনুদানের মাধ্যমে বাডতি অর্থ যোগানে সক্ষম হয়ে থাকেন।
সুতরাং  ধর্মীয় সভা-সম্মেলনের তাৎপর্য ও উপকারিতা বর্ননা করে শেষ করা যাবেনা

ইসলামের প্রচার-প্রসার, বিস্তৃতি ও স্থায়িত্বে ওয়াজ মাহফিলের অবদান এবং প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। যুগে যুগে মুসলিম জনসাধারণের সংশোধন ও ইসলামি চেতনায় উজ্জ্বীবিত হওয়ার পেছনেও ওয়াজ মাহফিলের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সর্বস্তরের জনসাধারণকে ইসলামমুখী করার জন্য, ইসলামি আদর্শে অনুপ্রাণিত করার জন্য ওয়াজ মাহফিলের কোনো বিকল্প নেই।


মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়তের গুরুদায়িত্ব লাভের পর যখন মানুষের কাছে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের আসমানি আদেশ পেলেন তখন মক্কার পাহাড়ে উঠে এক একটি গোত্রের নাম ধরে সবাইকে পাহাড়ের পাদদেশে সমবেত হওয়ার আহ্বান করলেন। সবাই সমবেত হলে তিনি আল্লাহর একত্ববাদের যৌক্তিকতা তাদের সামনে উপস্থাপন করেন। সেই থেকে শুরু হয় ওয়াজ মাহফিলের সোনালী অধ্যায়।

পরবর্তীতে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কাবাসীদের বিভিন্ন গনজমায়েতে উপস্থিত হয়ে ইসলামের আবেদন ও সৌন্দর্য তুলে ধরে উপস্থিত জনতাকে সম্বোধন করে ভাষণ দিতেন। আরও পরে তিনি সাহাবিদেরও ওয়াজ করার জন্য বিভিন্ন স্থানে পাঠাতেন।

সাহাবাদের পরে তাবেইন ও তাবে-তাবেইনরা ওয়াজ করার জন্য বিভিন্ন স্থানে যেতেন। তাদের অবর্তমানে যুগের উলামা-মাশায়েখ ও আল্লাহর অলিরা ওয়াজের মঞ্চগুলোকে অলংকৃত করেছেন। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইসলাম পৌঁছেছে ওয়াজ মাহফিলে নিরবিচ্ছিন্ন ধারায়। ওয়াজের এই ধারা কখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি কিংবা বন্ধ হয়নি।

বর্তমানে যে হারে ইসলাম বিরোধী ভাবধারার প্রচারণা বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে ওয়াজ মাহফিলের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। বাস্তবতা হলো, বর্তমানে যে পরিমাণ ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় বেশ কম। সময়ের চাহিদার প্রয়োজনে ওয়াজ মাহফিলের সংখ্যা, পরিধি ও বিস্তৃতি আরও বেশি হওয়া দরকার। মাহফিলগুলো শুধু শীতকালে সীমিত না রেখে সারা বছর হওয়া দরকার। মাহফিলের পরিধি শুধু শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ না রেখে পাড়ায়-পাড়ায় হওয়া সময়ের দাবী।

সেই সঙ্গে দরকার মাহফিলের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়ার। যেহেতু ওয়াজ মাহফিলগুলো ইসলাম প্রচারের বাতিঘর, এ বাতিঘর যেনো সবসময় আলো বিলাতে পারে সে জন্যই এ বিষয়গুলো খেয়াল রাখা দরকার।

এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, সময়ের সুদীর্ঘ পরিক্রমায় ওয়াজ মাহফিলগুলোর ব্যবস্থাপনা ও আয়োজন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা সবাই যদি ইসলামের মহব্বতে ও উম্মতের দরদে সমস্যাগুলো সমাধানে আন্তরিক হই, তবে সংখ্যায় অপর্যাপ্ত হলেও যে সামন্য পরিমাণ ওয়াজ মাহফিল প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে; সেগুলো আরও বেশি ফলপ্রসু হবে- ইনশাআল্লাহ।

ওয়াজ মাহফিল নিছক একটি দ্বীনী কার্যক্রম। তা ফলপ্রসু হবে একমাত্র দ্বীনী নমুনায় ও দ্বীনী তরিকায় সম্পন্ন হলে। ওয়াজ মাহফিল বাস্তবায়নের আদর্শিক বিচ্যুতি মাহফিলগুলোর নূরানি আবহকে নিষ্প্রভ করে দিচ্ছে এবং বলতে গেলে তা বর্তমানে যতোটা না আদর্শের প্রচার, তার চেয়ে বেশি বিনোদন। ক্ষেত্রবিশেষে তা সম্পূর্ণই বিনোদনের রূপ ধারণ করে থাকে।

এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সতর্ক, সচেতন, যত্নবান ও কঠোর হওয়া দরকার তাদের, যারা মাহফিলগুলোর আয়োজন করে থাকেন। মাহফিলের আয়োজনে নামার আগে নিজেদের হাজারবার প্রশ্ন করুন- কেন এ কর্মযজ্ঞে নামছেন? প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লাভের জন্য? তহবিল বাড়ানোর জন্য? বিরাট গণ জমায়েত করার জন্য? সুখ্যাতি লাভের জন্য? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়। তবে বিনয়ের সঙ্গে বলি, দরকার নেই মাহফিল আয়োজনের; বিরত থাকুন। মাহফিলের আয়োজন করা আপনার কাজ নয়। আল্লাহর দ্বীনকে পার্থিব উদ্দেশ্যে ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।

আর যদি সদিচ্ছা থাকে যে, যোগ্য ও বিজ্ঞ আলেমদের কাছ থেকে দ্বীন শিখবেন, তাদের নসিহত শোনে নিজেদের বিশ্বাস ও চেতনার ভুলগুলো জানবেন, আলেমদের বক্তৃতা শোনে নিজেদের আমলের ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করবেন; এক কথায় নিজে ইসলাম সম্পর্কে শিখবেন ও সংশোধন হবেন তাহলেই কেবল ওয়াজের আয়োজন করুন। তবেই মাহফিলের আয়োজন আপনার দু’জাহানের কামিয়াবিকে নিশ্চিত করবে।

এ ক্ষেত্রে আরেকটি কথা অবশ্যই মনে রাখবেন, ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন কিন্তু করতে হবে সম্পূর্ণ দ্বীনী আবহে। দ্বীনের কাজ করতে যেয়ে নিজেরা যেন দ্বীন থেকে বের হয়ে না যান। ইসলামের সেবা করতে যেয়ে নিজেরা যেন ইসলামকে লংঘন না করেন।


এম এম আবদুল্লাহ ভূঁইয়া
প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক নূরুলগনি ইসলামি একাডেমী
জোরারগঞ্জ, কাটাছরা, মিরসরাই, চট্টগ্রাম



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন