দ্বিতীয় হিজরিতে উম্মতে মুহাম্মদির ওপর রমজান মাসের রোজা ফরজ করার সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলমানদের ‘সাদাকাতুল ফিতর’ আদায় করার নির্দেশ দেন, একে সাধারণত রোজার ‘ফিতরা’ বলা হয়। এটা মূলত মাহে রমজানেরই নির্ধারিত সাদকা বা দান। শরিয়তের পরিভাষায় রমজান মাস শেষে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদ্যাপন উপলক্ষে মাথাপিছু যে নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্থিক সাহায্য গরিব-মিসকিনদের সাদকা করা হয়, একে ‘সাদাকাতুল ফিতর’ বলে। রোজা পালনে বা সিয়াম সাধনায় অত্যন্ত সতর্কতা সত্ত্বেও যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়, তার প্রতিকার ও প্রতিবিধান বা ক্ষতিপূরণের জন্য রমজান মাসের শেষে সাদাকাতুল ফিতরকে ওয়াজিব করে দেওয়া হয়েছে। ধনীদের পাশাপাশি গরিবেরাও যেন ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারে, সে জন্য ইসলামি শরিয়তে ঈদুল ফিতরে ধনীদের ওপর ‘সাদাকাতুল ফিতর’ ওয়াজিব করা হয়েছে।
সাদাকাতুল ফিতরের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈদের খুশিতে গরিব শ্রেণীর লোককেও শামিল করে নেওয়া। সাদাকাতুল ফিতর দ্বারা রোজার মধ্যে ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণও হবে এবং গরিব-দুঃখী মুসলমান নিশ্চিন্ত মনে খাওয়া-পরার জিনিসপত্র সংগ্রহ করে অন্য মুসলমানের সঙ্গে ঈদের জামাতে শরিক হতে পারবেন। এর মাধ্যমে ধনী-গরিবের মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবধান কমে আসে এবং সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি গড়ে ওঠে। নবী করিম (সা.) সাদাকাতুল ফিতর এ জন্য নির্ধারিত করেছেন যাতে ভুলক্রমে অনর্থক কথাবার্তা ও গুনাহ থেকে রোজা পবিত্র হয় এবং মিসকিনদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা হয়। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘সাদাকাতুল ফিতর দ্বারা রোজা পালনের সকল দোষত্রুটি দূরীভূত হয়, গরিবের পানাহারের ব্যবস্থা হয়।’ (আবু দাউদ)
যে ব্যক্তির কাছে ঈদের দিন সুবহে সাদিকের সময় জীবিকা নির্বাহের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ ব্যতীত সাড়ে ৭ তোলা সোনা অথবা সাড়ে ৫২ তোলা রুপা অথবা সমমূল্যের অন্য কোনো সম্পদ থাকে তার ওপর সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। এ পরিমাণ সম্পদকে শরিয়তের পরিভাষায় ‘নিসাব’ বলা হয়। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিককে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। এসব সম্পদ বা অর্থ যদি কারও হাতে ঈদের দিন সুবহে সাদিকের সময়ও আসে, তবু তাকে ফিতরা দিতে হবে। কেউ যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নাও হন, অথচ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সাদাকাতুল ফিতর আদায় করেন, তাহলে তিনি অশেষ সওয়াব পাবেন।
রমজান মাস শেষ দশক আসার সঙ্গে সঙ্গে রোজাদারের অপরিহার্য কর্তব্য হলো নির্ধারিত পরিমাণে সাদাকাতুল ফিতর বা ফিতরা আদায় করা। খেজুর, কিশমিশ, মুনাক্কা এবং যব দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা হলে ১ সা অর্থাৎ তিন কেজি ৩০০ গ্রাম অথবা এর মূল্য আদায় করতে হবে। আটা বা গম দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা হলে অর্ধ সা অর্থাৎ এক কেজি ৬৫০ গ্রাম বা এর সমান মূল্য আদায় করতে হবে। মাথাপিছু এক কেজি ৬৫০ গ্রাম গম বা আটা অথবা এর স্থানীয় বাজারমূল্যের সমান ফিতরা দিতে হয়। (উল্লেখ্য, এবারের ফিতরা জনপ্রতি সর্বনিম্ন 65 টাকা করে নির্ধারণ করা হয়েছে।)
গম ছাড়া খেজুর, কিশমিশ, পনির ও যব দিয়েও সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের নির্দেশনা হাদিস শরিফে উল্লেখ রয়েছে। তবে এসব খাদ্যপণ্য তিন কেজি ২৭০ গ্রামের বাজারমূল্য হিসাব করে আদায় করতে হবে।
তাই এগুলোর মধ্য থেকে যেকোনো একটির বাজারমূল্য দিয়েও যে কেউ ইচ্ছে করলে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সামর্থ্য অনুযায়ী অধিক মূল্যমান খাদ্যপণ্যের বাজারমূল্য হিসাবে আদায় করাই উত্তম।
দেশের বিভিন্ন বাজারমূল্যে তারতম্য হতে পারে। তাই যেকোনো বাজারমূল্য হিসাব করে আদায় করলেও সাদাকাতুল ফিতর আদায় হয়ে যাবে। এখানে শুধু ঢাকার বাজারমূল্য সংগ্রহ করে হিসাব করা হয়েছে। নিম্নে এসব খাদ্যপণ্যের বাজারমূল্য দেয়া হলো।
খেজুর-৭০ টাকা কেজি বাজারদরে মাথাপিছু-২৩০ টাকা; ২. খেজুর-৪৮০ টাকা কেজি বাজারদরে মাথাপিছু-১৫৭০ টাকা; ৩. খেজুর-১০০০ টাকা কেজি বাজারদরে মাথাপিছু-৩২৭০ টাকা; ৪. কিশমিশ-৩৭০ টাকা কেজি বাজারদরে মাথাপিছু-১২১০ টাকা; ৫. পনির-৪৫০ টাকা কেজি বাজারদরে মাথাপিছু-১৪৭০ টাকা; ৬. যব-১৮০ টাকা কেজি বাজারদরে মাথাপিছু ৫৮৮ টাকা। বিজ্ঞপ্তি।
সামর্থ্যবান পিতার ওপর তার নাবালক ছেলেমেয়েদের পক্ষ থেকেও সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। সুতরাং নিজের ও নাবালক সন্তানাদির পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। মহিলাদের কেবল নিজের পক্ষে ফিতরা দেওয়া ওয়াজিব। নাবালক সন্তানের নিজের সম্পদ থাকলে তা থেকেই ফিতরা দেওয়া হবে। আর বালক সন্তানের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা মুস্তাহাব। গৃহকর্তা এবং তার পোষ্যদের সংখ্যাকে হিসাব করে প্রতিজনের বিপরীতে নির্ধারিত অর্থমূল্যে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা বাঞ্ছনীয়। ফিতরা সেসব গরিব-মিসকিনই পাবেন, যাঁরা জাকাত পাওয়ার উপযুক্ত।
সাদাকাতুল ফিতর ঈদের দু-তিন দিন আগে আদায় করলে অধিক সওয়াব পাওয়া যায়। ফিতরা ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে আদায় করা সুন্নত। তবে ঈদের নামাজের আগে আদায় করতে না পারলে ঈদের নামাজের পর অবশ্যই আদায় করতে হবে। ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) সাদাকায়ে ফিতরের ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তা লোকেরা সালাতের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগেই আদায় করে। নবী করিম (সা.) নিজেও ঈদের দু-এক দিন আগে ফিতরা আদায় করে দিতেন।’ (আবু দাউদ)
ঈদের নামাজের আগেই ফিতরা দিয়ে দেওয়া উত্তম, নতুবা পরে আদায় করতে হবে। মহানবী (সা.) ঈদের দু-তিন দিন আগেই লোকদের একত্র করে ফিতরা বের করার নির্দেশ দিতেন। এতে করে গরিব-মিসকিনরা নিজ নিজ প্রয়োজন পূরণে সক্ষম হবেন এবং ঈদের দিনে তাঁরাও পানাহারের ব্যবস্থা করতে সমর্থ হবেন। ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) রোজাদার ব্যক্তির অসৎ কাজকর্ম থেকে সিয়ামকে পবিত্র করার জন্য এবং অভাবীদের ঘরে খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য সাদাকাতুল ফিতরের বিধান দিয়েছেন। যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে এ ফিতরা আদায় করে দেবেন, তা জাকাত হিসেবে কবুল হবে আর নামাজের শেষে আদায় করা হলে তখন তা সাদকা হিসেবে কবুল হবে।’ (আবু দাউদ, ইবনে মাজা)
মাহে রমজানে মনপ্রাণ খুলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আর্তমানবতার সেবায় কয়েক হাজার টাকা সাদকা-ফিতরা প্রদান তেমন কষ্টকর কিছু নয়, প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছার। সুতরাং দাতার কথাবার্তা বা কার্যকলাপ দ্বারা যেন এ কথা প্রকাশ না পায় যে সে গ্রহীতাকে সাহায্য করছে। এ সাদকা তো দাতার দান নয়, বরং সাদকা দিয়ে সে দায়মুক্ত হলো মাত্র। আর সওয়াব বা প্রতিদান তো আল্লাহরই কাছে পাবেন। উপরন্তু গ্রহীতা তা গ্রহণের ফলেই দাতা দায়িত্বমুক্ত হতে পেরেছে। এ অর্থে বরং গ্রহীতাই দাতার উপকার করেছে। এ জন্য মাহে রমজানে সাদাকাতুল ফিতর বা ফিতরা যথাসম্ভব রোজা শেষ হওয়ার আগেই দিয়ে দেওয়া উচিত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন