ইমাম বুখারীর দেশে
হযরত মাওলানা মুফতি তকী উছমানী
কিছুদিন আগে ওলামায়ে কেরামের সাথে উযবেকিস্তানের সফর হয়েছে। কিছু বন্ধু সে সফরের কারগুযারী শোনানোর অনুরোধ করলেন। আমারও মনে হল যে, এ সফরে আল্লাহ তাআলা অনেক শিক্ষণীয় বিষয় দান করেছেন, যা আলোচনা করা আমাদের সবার জন্য ফায়েদাজনক হতে পারে। তাই এখন এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করার ইচ্ছা করেছি।
উযবেকিস্তান দীর্ঘ দিন যাবৎ রাশিয়ার আগ্রাসনের শিকার ছিল। অল্প কিছু দিন পূর্বে তা স্বাধীন হয়েছে। সে সময় পরিস্থিতি এত কঠিন ছিল যে, কোনোদিন এই সব স্থান দেখার সুযোগ হবে তা ছিল কল্পনারও অতীত। অথচ এই ভূখণ্ডই একদিন ইসলাম ও ইসলামী উলূমের মারকায ছিল। আপনারা হয়তো বুখারা-সমরকন্দের নাম শুনেছেন। এই দুই বিখ্যাত শহরে মুসলিমজাহানের বহু নামজাদা মনীষী জন্মলাভ করেছেন। আপনারা ‘সিহাহ সিত্তা’র নাম শুনেছেন, যা হাদীস শরীফের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সংকলন। আল্লাহ তাআলা এই গ্রন্থগুলোকে এমন মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা দান করেছেন যে, মুসলিমজাহানে এগুলোকে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্যরূপে গ্রহণ করা হয়। কুদরতের আজীব কারিশমা যে, হাদীসের এই ছয় ইমামের কেউই আরবে জন্ম গ্রহণ করেননি। তাঁরা সবাই ছিলেন অনারব এবং এই ভূখণ্ডের অধিবাসী। ইমাম বুখারী রাহ. যাঁর সংকলিত হাদীসগ্রন্থ ‘সহীহ বুখারী’ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর কিতাবের পর এটিই সর্বাধিক বিশুদ্ধ কিতাব, তাঁর জন্মও বুখারায়। এজন্য তাকে বুখারী বলা হয়। তাঁর ইন্তেকালও হয়েছে সমরকন্দের নিকটবর্তী একটি ছোট্ট গ্রামে। গোটা জীবন হাদীস শরীফের চর্চায় কাটিয়ে দিয়েছেন। নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে ইরাক, হিজায, শাম সফর করেছেন। কত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও হাদীস অন্বেষণ অব্যাহত রেখেছেন তা একটি দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যাবে। ইমাম বুখারী রাহ. এক শায়খের নিকট হাজির হলেন। তিনি সম্ভবত বাগদাদের একজন মুহাদ্দিস ছিলেন। একদিন শায়খ দেখলেন, মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল (ইমাম বুখারী) দরসে অনুপস্থিত। এমন অনেক ছাত্র থাকে যারা কখনো দরসে থাকে, কখনো থাকে না। কিন্তু ইমাম বুখারী ওই সকল তালিবে ইলমের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যারা সময়ের আগেই দরসে উপস্থিত হয় এবং সর্বদা সামনের সারিতে থাকে। যাদের অনুপস্থিতি উস্তাদ কল্পনাও করতে পারেন না। তো হঠাৎ একদিন তাকে অনুপস্থিত দেখে উস্তাদ ভাবলেন, হয়তো কোনো অসুবিধা হয়েছে। পরের দিন শায়খ দরসে এসে দেখলেন, আজও তিনি অনুপস্থিত। শায়খ চিন্তিত হলেন সে কি অসুস্থ হয়ে পড়েছে কিংবা অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে! সে তো না আসার মতো ছাত্র নয়। তো শায়খ একজনকে পাঠালেন, খোঁজ নাও সে কেন দরসে আসছে না। মসজিদের নিকটে একটি ছোট হুজরায় ইমাম বুখারী থাকতেন। সেই তালিবে ইলম গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ল। ভিতর থেকে আওয়াজ এল, কে? কেন এসেছেন? সেই তালিবে ইলম বলল, একটু বাইরে আসুন, শায়খ আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। ইমাম বুখারী বললেন, ভাই! আমি বাইরে আসতে অপারগ। আপনি ওখান থেকেই বলুন কেন এসেছেন? আগন্তুক বললেন, আপনি কেন দরসে আসছেন না? আপনি যদি অসুস্থ হয়ে থাকেন তাহলে আমরা আপনার সেবা-শুশ্রূষা করব। অন্য কোনো সমস্যা থাকলে তা দূর করার চেষ্টা করব। আপনার অনুপস্থিতির কারণে শায়খ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়েছেন। তার বারংবার পীড়াপীড়ির পর ইমাম বুখারী বললেন, পরিধানের একটি মাত্র কাপড় ছিল যা ধুয়ে ধুয়ে পরিধান করতাম। কিন্তু এখন তা বিভিন্ন জায়গায় এতই ছিড়ে গিয়েছে যে, সতর আবৃত রাখা সম্ভব নয়। তাই আমি অপারগ হয়ে ঘরে বসে আছি।
চিন্তা করুন, কী অবস্থার মধ্য দিয়ে ইমাম বুখারী ইলম হাসিল করেছেন। এমনি এমনি ইমাম বুখারী হওয়া যায় না এবং এমনি এমনি জগৎ কাউকে ইমাম ও মুকাতাদা হিসেবে গ্রহণ করে না।
আজ আমাদের সামনে তৈরি-রুটির মতো হাদীসের কিতাবসমূহ বিদ্যমান। কত আরামে বসে হাদীস পড়ছি ও শুনছি। অথচ মুহাদ্দিসগণ এক একটি হাদীস অর্জনের জন্য যে ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করেছেন তা চিন্তা করলেও অভিভূত হয়ে যেতে হয়। এভাবে ইলম হাসিল করার পর ইমাম বুখারী নিজ দেশ বুখারায় ফিরে যান। সেখানে একটি মাদরাসা আছে ‘মীরে আরব’ নামে, আজো বিদ্যমান রয়েছে। সে মাদরাসা যিয়ারতের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ওই মাদরাসায় তিনি তাঁর সংকলিত হাদীসগ্রন্থ আলজামিউস সহীহ লিপিবদ্ধ করিয়েছেন। সে যুগে ছাপাখানা ছিল না যে, কিতাব ছাপা হয়ে সবখানে ছড়িয়ে যাবে। তখন উস্তাদ হাদীস লেখাতেন, আর তালিবে ইলমরা তা লিপিবদ্ধ করত। এভাবে সেই মাদরাসায় ইমাম বুখারী রাহ. সহীহ বুখারীর নব্বই হাজার কপি লিখিয়েছেন।
এখন তো লাউড স্পীকারের যুগ। কিছু লোক উপস্থিত হলেই লাউড স্পীকার প্রয়োজন হয়। অথচ সে যুগে মুহাদ্দিসীনে কেরামের এক এক দরসে তালিবে ইলমের সংখ্যা এত বেশি হত, যা আজ বড় বড় সমাবেশেও হয় না। এক মুহাদ্দিস সম্পর্কে লিখেছে যে, তাঁর এক দরসে পনের হাজার দোয়াত-কলম গণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ হাদীস লিপিবদ্ধকারী তালিবে ইলম ছিল এই পরিমাণ। আর যারা শুধু হাদীস শোনার জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন তাদের সংখ্যা এর বাইরে।
হযরত ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. যিনি অনেক বড় মুহাদ্দিস ছিলেন, তাঁর দরস সকালে ইশরাকের পর শুরু হত। দরসে শরীক হওয়ার জন্য লোকেরা আগের দিন আসরের সময় গিয়ে জায়গা দখল করত।
এই বিপুল সমাবেশে দরস এভাবে হত যে, উস্তাদ সনদের একটি শব্দ বা হাদীসের একটি বাক্য বলতেন, যতদূর আওয়াজ যেত সবাই লিখত। এরপর একজন দাঁড়িয়ে উচ্চ স্বরে পুনরায় ওই শব্দ বা বাক্যটি বলত। যতদূর আওয়াজ যেত, তার শেষ মাথায় আরেকজন দাঁড়িয়ে উস্তাদের ওই শব্দ উচ্চারণ করত।
এভাবে অনেক দূর পর্যন্ত আওয়াজ পৌঁছানো হত। বিখ্যাত মুহাদ্দিসদের দরসগুলো এভাবেই হত। ইমাম বুখারী রাহ.ও এভাবে মাদরাসা ‘মীরে আরব’-এ বুখারী শরীফের নব্বই হাজার কপি লিখিয়েছেন।
ইমাম তিরমিযী রাহ. তিরমিযের লোক ছিলেন। সেটাও উযবেকিস্তানের অংশ। আরো বড় বড় ওলী বুযুর্গ এই অঞ্চলে পয়দা হয়েছেন। আপনারা সিলসিলায়ে নকশবন্দিয়ার কথা শুনে থাকবেন, যা তাসাওউফের অনেক বড় সিলসিলা। আমাদের এখানে হযরত থানভী রাহ. এর যে সিলসিলা আছে, তাতে চারো সিলসিলায় বায়আত করানো হয়। এর মধ্যে নকশবন্দিয়াও রয়েছে। এই সিলসিলার ইমাম হলেন, হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দী রাহ.। তিনিও ওই ভূখণ্ডের অধিবাসী ছিলেন। সমরকান্দের কাছে তার কবর আছে। হযরত খাজা উবায়দুল্লাহ আহরার রাহ., যিনি মাওলানা আবদুর রহমান জামী রাহ. এর শায়খ ও উস্তায ছিলেন তাঁর ঘটনা সম্ভবত আপনাদের বলেছি যে, এক লোক তাঁর বুযুর্গীর কথা শুনে তার কাছে এল। এসে দেখে তিনি বড় ব্যবসায়ী মানুষ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারবার নিয়ে ব্যস্ত। কিছু কিছু লোক আসে, তাদের কিছু নসীহতও করেন। তবে বেশিরভাগ সময় ব্যবসায় কাটাচ্ছেন। সে ভাবতে লাগল, আমি তো মনে করেছিলাম, তিনি আল্লাহর ওলী হবেন। বসে বসে আল্লাহ আল্লাহ করবেন। কিন্তু এখন দেখছি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারবার নিয়ে ব্যস্ত। এইসব ভাবনা তার অন্তরে আসতে লাগল। বিকেলে খাজা উবায়দুল্লাহ আহরার রাহ. হাঁটতে বের হলেন। এই লোকও সাথে চলল। হঠাৎ খাজা সাহেব রাহ. বললেন, আমার হজ্বে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। সঙ্গী লোকটি বলল, হযরত এ তো খুব ভালো কথা। আমিও আপনার সফরসঙ্গী হতে চাই। হযরত খাজা সাহেব রাহ. বললেন, ঠিক আছে চল।
সেই লোক বলল, হযরত এখনি? বললেন, হ্যাঁ, এখনি।
সে বলল, হযরত ঘরে আমার চাদর রেখে এসেছি। সেটা একটু নিয়ে আসি। হযরত বললেন, ভাই তোমার সামান্য চাদরের এত ফিকির যে, তা ছাড়া তুমি হজ্বে যেতে পারবে না, আর আমার দেখ কত ব্যবসা! কত কর্মচারী। সবকিছু ছেড়ে আমি যেতে তৈরি। আসল কথা হচ্ছে, তোমার মন আটকে আছে সেই চাদরে। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, আমার ব্যবসা খুব চলছে, অন্তর কোথাও বাধা পড়ে নেই। আর দুনিয়া তাকেই বলে যাতে মানুষের মন বাঁধা পড়ে থাকে। ছোট্ট একটা চাদরের মধ্যে বাঁধা পড়লে সেটাই দুনিয়া। আর অনেক বিত্তসম্পদের পরও যদি তাতে মন বাঁধা না থাকে তাহলে তা দুনিয়া নয়। খাজা উবায়দুল্লাহ আহরার রাহ.-এর কবরও সমরকন্দেই অবস্থিত।
তাঁর আরেকটি প্রসিদ্ধ ঘটনা আছে। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে সাথে বাদশাহর ইসলাহরও ফিকির করতেন। তার কাছে গিয়ে ওয়ায-নসীহত করতেন। মানুষ মনে করত যে, এই লোক একে তো ব্যবসায়ী তদুপরি রাজা-বাদশাহর সঙ্গেও তার ওঠা-বসা। জনৈক বুযুর্গ তাঁকে পত্র লিখলেন যে, হযরত আপনি এই ভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত আবার রাজা-বাদশার দরবারেও আসা যাওয়া করেন। এমন করা থেকে বিরত থাকুন যাতে মানুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়। উত্তরে তিনি একটি পংক্তি লিখলেন, যা অত্যন্ত প্রসিদ্ধ।
অর্থাৎ যদি পীর হতে চাই তাহলে কোনো পীর আর মুরীদই পাবে না। মানুষকে ইসলাহর প্রতি উদ্বুদ্ধ করা এবং নিজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রেখে তাদের ইসলাহ করার যোগ্যতাও আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। তাই আমি যদি পীর হয়ে যাই তাহলে কোনো পীরের আর মুরীদ জুটবে না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা আমাকে ভিন্ন কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং আমি তা করছি। তা হচ্ছে শাসক ও ক্ষমতাশালী লোকদের সংশোধন। আল্লাহ তাআলা যদি কবুল করেন তাহলে এটাই আমার আখেরাতের সম্বল।
হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচাত ভাই, হযরত কুসাম ইবনে আব্বাস রা.-এর কবরও সেখানে। তিনি এই অঞ্চলে সর্বপ্রথম ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আসেন এবং শহীদ হন। মোটকথা, এ ভূখণ্ড ইসলামের ইতিহাসের বড় বড় ব্যক্তিত্বকে বুকে ধারণ করে আছে। বড় বড় ফকীহ, ওলী, মুহাদ্দিস এবং ইলমে কালাম ও আকায়েদের বড় বড় ইমাম এখানে সমাহিত। কিন্তু আমাদের বদ আমলের পরিণামে যে মারকায সদা ক্বালাল্লাহ ও ক্বালার রাসূলের আওয়াজে প্রকম্পিত থাকত তা কমিউনিস্টদের আগ্রাসনের শিকার হয়ে যায়। কমিউনিজমের বিপ্লবের পর তারা ধীরে ধীরে এই সকল অঞ্চল কব্জা করে ফেলে। এই যে তুর্কিস্থান, যা ইতিহাসে তুর্কিস্থান, তুরান আবার কখনো ফারেহান নামে প্রসিদ্ধ, তার আয়তন এত বড় ছিল যে, সমগ্র হিন্দুস্থান, পাকিস্থান, বাংলাদেশ ও সাউদী আরব মিলেও তার সমান হওয়া কঠিন। কিন্তু রুশরা একে খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলেছে। আর যুলুম-নির্যাতনের এমন দাস্তান কায়েম করেছে যে, দুনিয়ার আর কোথাও এর নজির পাওয়া মুশকিল হবে।
সেখানে আযান নিষিদ্ধ করা হল। মসজিদগুলো বন্ধ করে দেওয়া হল। নামায পড়ার অনুমতি ছিল না। কালিমা পড়ার অনুমতি ছিল না। মসজিদগুলোকে কোথাও সিনেমা হলে পরিবর্তন করা হল, কোথাও গুদাম, কোথাও ওয়ার্কশপ, আবার কোথাও অফিস বানানো হল। কেউ নামায পড়তে চাইলে তার উপর এমন পাশবিক ও ভয়ানক শাস্তি নেমে আসত, যার দৃষ্টান্ত পাওয়া দুষ্কর। আলিমগণ বিশেষ টার্গেটে পরিণত হলেন। ইতিপূর্বে তারা ছিলেন অত্যন্ত সম্মানের পাত্র। তাদেরকে ‘মোল্লা’ বলা হত। ইংরেজরা এ শব্দকে সমাজে অপাংক্তেয় করে দিয়েছে। এটা এখন গালি হয়ে গিয়েছে। অথচ তা ছিল অত্যন্ত মর্যাদার শব্দ। বড় আলেম, ফাযেল ও শিক্ষিত লোককে সম্মানের জন্য মোল্লা উপাধি দেওয়া হত। ইংরেজরা যখন দেখল, মোল্লা সমপ্রদায়ই আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু তখন তারা বিভিন্ন কৌশলে এর এত নিন্দা করল যে, এখন তা গালিতে পরিণত হয়েছে। অথচ মোল্লাগণই দীর্ঘ ৭০ বছরের আগ্রাসনকালে সকল প্রকার জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে এই জাতির ঈমানকে টিকিয়ে রেখেছে। যার সম্পর্কে সন্দেহ হত যে, ইলমে দ্বীনের সাথে তার সামান্যতম সম্পর্ক রয়েছে, উলামাদের সঙ্গে তাকেও উত্তপ্ত চুনভর্তি গর্তে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হত। কাউকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন দেওয়া হত, যেখানে তাপ মাত্রা মাইনাস ৬০ ডিগ্রী। অনেকের নখ উপড়ে ফেলা হত। চামড়া খসিয়ে ফেলা হত। আর এসব ছিল প্রতিদিনের দৃশ্য। এই পাশবিকতা ও বর্বরতার মাঝেও তারা দ্বীনী ইলমের চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। লুকিয়ে লুকিয়ে, ভূ-গর্ভের গোপন কক্ষে তারা ক্বালাল্লাহ-ক্বালার রাসূলের পঠন-পাঠন অব্যাহত রেখেছেন।
আমরা সমরকন্দে এক মসজিদের ইমাম সাহেবের মেহমান হয়েছিলাম। তিনি সে অঞ্চলের একজন প্রসিদ্ধ ইমাম। তিনি আমাদের বলেছেন, এ মসজিদটি রুশ বিপ্লবের পর সিনেমা হল বানানো হয়েছিল। কিছুদিন আগে এলেও আমি আপনাদের সিনেমার পোস্টারগুলো দেখাতে পারতাম, যা এর দেয়ালে লাগানো ছিল। সে সময় নামায পড়ার অনুমতি ছিল না। আমার আব্বা ছিলেন এই মসজিদের খাদেম। বিপ্লবের পর তাকে ক্ষেতের কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তাকে ক্ষেতের কাজে ব্যস্ত থাকতে হত। দুপুরে ঘরে এসে নামায পড়তেন। ঘরে জায়নামায রাখার তো প্রশ্নই আসে না। কারণ যে কোনো সময় তল্লাশী হতে পারে। তখন যদি জায়নামায পাওয়া যায় তাহলে পুরা পরিবারের আর রক্ষা ছিল না। তাই মেঝেতেই নামায পড়তে হত। এতেও বিপদের আশঙ্কা ছিল। আম্মাকে বলতেন, তুমি চা বানিয়ে রাখ। যেন কেউ আসলে বলা যায় যে, চা তৈরি হচ্ছিল বা চা পান করছিল। এভাবে আব্বা নামায পড়তেন।
ইমাম সাহেব বলেন, আমি তখন ৪-৫ বছরের শিশু। আমাকে দরজায় দাঁড় করিয়ে দিতেন যেন আমি বাইরে নজর রাখি এবং কেউ আসলে বলি, আব্বা ভিতরে চা পান করছেন। কমিউনিস্ট সরকারের লোকেরা রাস্তায় ঘোরাফেরা করত। তারা এসে আমাকে আখরোট দিয়ে জিজ্ঞাসা করত, তোমার আব্বা ভিতরে কী করছেন? আমি বলতাম, চা পান করছেন। তারা বলত, না ভিতরে হয়ত নামায-টামায পড়ছে। এভাবে আমাকে ফুসলাতে চেষ্টা করত। তিনি বলেন, শৈশবের দিনগুলোর কথা আমার আজো মনে আছে। সারাদিন খাটা-খাটুনির পর রাতে যখন বসতির লোকজন ঘুমিয়ে পড়ত, তখন আব্বা আমাকে গোপন কক্ষে নিয়ে কুরআন মজীদ পড়াতেন। সেই কক্ষটা এমন ছিল যে, বাইরে থেকে দেখতে একটা আলমারীর মতো মনে হত। তার উপর বাসন-পেয়ালা ইত্যাদি রেখে দেওয়া হত। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল গোপন কক্ষে যাওয়ার দরজা। সেখানে আব্বা আমাকে কুরআন মজীদের তা’লীম দিতেন। শুধু কুরআন মজীদই নয়; আরবী ভাষার ও ইসলামী উলূমের তা’লীমও আমি সেখানেই হাসিল করি।
সারা দিন ক্ষেতের পরিচর্যা, আর রাতে বাচ্চাদের গোপনে পড়ানো এই ছিল তার কাজ।
সেসময় আব্বা আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, যা এখনো মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘বেটা, আমার জীবনের তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর পরোয়ানা এসে যেতে পারে। এই দ্বীন তোমার কাছে আমানত রেখে যাচ্ছি। এটা হল সেই যমানা, যার সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গেছেন, ‘এক সময় এমন আসবে যখন দ্বীনের উপর থাকা হাতের মুঠোয় আগুনের অঙ্গার ধরে রাখার মতো কঠিন হবে। বেটা, তোমার হাতে এই অঙ্গার আমি রেখে যাচ্ছি। যা তুমি ফেলে দিতে পারবে না। যদি ফেলে দাও তাহলে জাহান্নামের আগুন তোমাকে গ্রাস করবে। আর যতক্ষণ ধরে রাখবে, তোমাকে এর জ্বলন সহ্য করতে হবে।
এভাবে আল্লাহর বান্দারা দ্বীন হিফাযত করেছেন। যেখানেই কোনো মোল্লা ছিল তার ঘর ছিল একটি মাদরাসা। রাতের আঁধারে, ভূ-গর্ভের গোপন কক্ষে এই মাদরাসাগুলো চলত।
আজ মোল্লাদের নিন্দা করার লোক অনেক আছে। কিন্তু তারা জানে না যে, আল্লাহ তাআলা তাদের মাধ্যমেই তার কালিমাকে হিফাযত করেছেন। অনাহারে, অর্ধাহারে থেকে, সকল যন্ত্রণা সহ্য করে এবং মাথার উপর মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে তারা শুধু চেষ্টাই করেছেন যে, এই কালিমা উম্মতের মাঝে অক্ষত থাকুক। আজো সেসব অঞ্চলে যতটুকু দ্বীন আছে তা এসকল কুরবানীরই ফসল।
সেখানে অনেক আলিমের সাথে আমাদের দেখা হয়েছে। তাদের সাথে আরবীতে কথা হত। এছাড়া কথা বলার আর কোনো উপায়ও ছিল না। তারা খুব ভালো আরবী বলেন। তো যাকেই জিজ্ঞাসা করেছি, ভাই আপনি আরবী কোথায় শিখেছেন তিনিই উত্তরে বলেছেন, ‘হুজরাতে শিখেছি’। হুজরা মানে কক্ষ। প্রত্যেক মোল্লার বাড়িতে গোপন ঘরে ইলম চর্চার যে ব্যবস্থা ছিল এরই নাম হুজরা। সাধারণ মানুষ সুখ-নিদ্রায় বিভোর হত আর তারা দ্বীনের চর্চায় মশগুল হতেন। এভাবে আল্লাহ তাদের ঈমান হিফাযত করেছেন। শুধু তা-ই নয় আল্লাহ তাদেরকে ঈমানের মিষ্টতাও দান করেছেন।
আমরা তো উত্তরাধিকার সূত্রে ইসলামকে পেয়েছি। আল্লাহ তাআলা নিজ মেহেরবানীতে মুসলমান পিতামাতার সন্তান বানিয়েছেন। তাই অতি সহজে ঈমান ও ইসলামের দৌলত আমরা পেয়ে গেছি। একটি কাঁটাও আমাদের পায়ে বিঁধেনি। ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করতে হয়নি। ত্যাগ ও কুরবানীর সম্মুখিন হতে হয়নি। আল্লাহ তাআলা মেহেরবানী করে এই নিয়ামত দিয়ে দিয়েছেন। তাই এর কদর নেই।
এর মূল্য তাদেরকে জিজ্ঞাসা করুন, যারা ঈমান রক্ষার জন্য প্রাণ বিপন্ন করেছেন। এটা সহজ কথা নয় যে, সত্তর বছর নির্যাতন-নিপীড়নের চাকায় পিষ্ট হওয়ার পরও তারা পুনরায় মুসলমানরূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। শেষ দিকে রুশ সরকারও কিছু মসজিদ-মাদরাসা খুলে দিয়েছিল। মানুষ গেলে দেখাত যে, আমাদের এখানে মসজিদ-মাদরাসা আছে। কিন্তু এর সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। রুশদের সময় সবচেয়ে বড় মাদরাসা ছিল তাশখন্দে, তাতে সর্বোচ্চ চল্লিশ জন ছাত্রের পড়ার অনুমতি ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর এখন ছোট ছোট মাদরাসায় গিয়ে দেখুন, কোথাও ছাত্রসংখ্যা দুই শত, কোথাও পাঁচশত আবার কোথাও হাজার। আল্লাহ তাআলার মেহেরবানীতে তালিবে ইলমের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা এজন্য শোকরগোযারী করেন যে, আলহামদুলিল্লাহ আমরা কুরআন মজীদ পড়তে পারছি। কিন্তু কুরআন মজীদের নুসখা তাদের কাছে নেই। মসজিদ মুসল্লী দ্বারা পরিপূর্ণ। কিন্তু কুরআনের নুসখা নেই।
আমাদের এক সাথীর সাথে কুরআন মজীদ ছিল। সে জুমআর দিন মসজিদে বসে তিলাওয়াত করছিল। মসজিদে পাঁচশ’র মতো মুসল্লী নামায পড়তে এসেছিল। যে-ই আসত সেই কুরআন মজীদের নুসখাটির দিকে অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকত যে, আহা! কি নিয়ামত নিয়ে সে বসে আছে! কুরআন মজীদের নুসখা এতই কম যে, তাদের কাছে এ রকম নুসকা থাকাটা রীতিমতো একটা বিস্ময়কর ব্যাপার।
বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য নূরানী কায়দা নেই। যে কপিটি পড়ানো হচ্ছিল তা দেখলাম ১৯১৭ সনের ছাপা। অর্থাৎ রুশ বিপ্লবের সময়কার। তা-ই ফটোকপি করে পড়ানো হচ্ছে। এই রকম উপায়-উপকরণহীন অবস্থায় সময় কেটেছে। এরপরে আল্লাহ তাআলা এই ঈমানের মূল্য বোঝার তাওফীক দান করেছেন। পক্ষান্তরে এমনও অনেক ছিল যারা সেই স্রোতে ভেসে গিয়েছে। যারা মোল্লার অধীন ছিল না। মোল্লার সঙ্গে যাদের সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। তারা এমনভাবে ভেসে গিয়েছে যে, কালিমা জানে না। কালিমা কী জিনিস চিনে না। নাম তো মুসলমান, কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে কিছুই সে জানে না। এই হচ্ছে অবস্থা যা আমরা সেসব এলাকায় প্রত্যক্ষ করেছি।
কিছুদিন পূর্বে আমার চীন সফরের সুযোগ হয়েছিল। সেখানেও কম-বেশি একই রকম অবস্থা চোখে পড়েছে। দীর্ঘ দিন যাবৎ চীনে নামায পড়া নিষিদ্ধ ছিল। মসজিদগুলো তালাবদ্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও আল্লাহর বান্দারা দ্বীনের হিফাযত করেছেন। মাটির নিচের গোপন কক্ষে কিতাব সংরক্ষণ করেছেন। চীনে আমরা এক আশ্চর্য বিষয় দেখেছি। এক মাদরাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে ছোট ছোট বাচ্চাদের মাথায় পাগড়ি বাঁধা। বারো-তেরো বছরের বাচ্চা। প্রত্যেকের মাথায় পাগড়ি। আমি বললাম, মাশাআল্লাহ, খুব সুন্দর লাগছে দেখতে। বাচ্চাদের মাথায় এমনিতেও পাগড়ি খুব সুন্দর লাগে। মনে হচ্ছে সুন্নতের অনেক যত্ন রয়েছে এখানে। আপনারা কোত্থেকে এই রীতি চালু করলেন? মজমায় তো কেউ এর উত্তর দেয়নি। পরে একান্তে একজন ইমাম সাহেব বললেন, আসল কথা এই যে, কিছু দিন হল এখানে বাচ্চাদের ধর্মীয় শিক্ষার অনুমতি পাওয়া গেছে। কিন্তু এখনো আইন আছে যে, আঠারো বছরের নিচে কোনো বাচ্চাকে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া যাবে না। তাই আমরা বাচ্চাদের মাথায় পাগড়ি বেঁধে দিয়েছি। এতে বাচ্চাদের একটু বড় বয়সের মনে হয়। হঠাৎ যদি ইন্সপেকশন শুরু হয় তাহলে দূর থেকে দেখে যেন মনে হবে, এখানে সব বড় বাচ্চারা পড়ে। কোনো ছোট বাচ্চা নেই। এই ভাবে আল্লাহর বান্দারা দ্বীনকে হিফাযত করেছেন এবং এ যুগেও দ্বীনের জন্য কুরবানী দেওয়ার দৃষ্টান- স্থাপন করেছেন।
উযবেকিস্তানের এই সফরে যে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে তাতে আমাদের জন্য চিন্তার অনেকগুলি বিষয় রয়েছে। এক. আল্লাহ তাআলা আমাদের অসংখ্য নিয়ামত দান করেছেন। পরাধীনতার যুগ আমাদের উপর দিয়েও গিয়েছে। ইংরেজ শাসনামলে আমরাও পরাধীন ছিলাম, কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, তখনও নামাযের উপর, কুরআন মজীদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়নি। অথবা শুধু মুসলমান হওয়াই অপরাধ বলে গণ্য হয়নি। জুলুম-অত্যাচার আমাদের উপরও হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি আলহামদুলিল্লাহ। আর এখন আযাদীর পর তো আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। স্বাধীনতার নেয়ামত আল্লাহ আমাদের দান করেছেন। কিন্তু এই নেয়ামত পাওয়ার পর গাফলত, না-কদরী আমাদের পেয়ে বসেছে। আজো অনেকের মুখে শোনা যায় যে, ভাই! এই যুগে দ্বীনের উপর চলা বড় মুশকিল। আরে মুশকিল কী জিনিস তা তো তুমি দেখইনি! এটা তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, যারা শুধু এক ওয়াক্ত নামায পড়ার জন্য জান কুরবান করে দিয়েছেন। এই সফরে প্লেনে এক ব্যক্তির সাথে কথা হয়েছে, আন্দাজানের এক মসজিদের ইমাম, ফারগানার বাসিন্দা। তিনি বলেছেন, আমি এক জায়গায় আযান দিয়েছিলাম সেজন্য ছয় বছর জেল খাটতে হয়েছে। আজ তো কেউ আমাদের দিকে বন্দুকের নল উঁচিয়ে বলছে না যে, নামায পড়তে পারবে না। রোযা রাখতে পারবে না। বাচ্চাদের কুরআন শেখাতে পারবে না।
জায়গায় জায়গায় আলহামদুলিল্লাহ কুরআন মজীদের মকতব আছে। মাদরাসা আছে। আলেম-ওলামা আছে। বিনা বেতনে শিক্ষা দেওয়ার লোকও আছেন। ডেকে ডেকে বলা হচ্ছে, আমাদের এখানে আসুন, বাচ্চাদের ভর্তি করান। দ্বীনী ইলম শেখান। কিন্তু সেদিকে আমাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। বাচ্চা সামান্য পড়া-শোনার উপযুক্ত হলেই তাকে গিট-পিট (হাবি-জাবি) শেখাও। তাকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে, নার্সারীতে ভর্তি করাও। কুরআন মজীদ পড়ানোর দরকার নেই। ইসলামী শিক্ষা, দ্বীনী ইলম শেখানো সময়ের অপচয়মাত্র। (নাউযুবিল্লাহ!) যদি সেই আল্লাহর বান্দারা আমাদের অবস্থা দেখেন যারা নিজ সন্তানকে দ্বীনী ইলম শেখানোর জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, তাহলে তাদের সন্দেহ হবে যে, সত্যিই এরা মুসলমান কি না। তাই আমাদের চিন্তা করা উচিত যে, তারা কত কষ্ট-ক্লেশ ও উপায়-উপকরণহীনতার মাঝে ঈমানের হিফাযত করেছেন। পক্ষান্তরে এত নেয়ামত থাকা সত্ত্বেও আমাদের মাঝে কত অবহেলা ও গাফলত!
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে : আমার শ্রদ্ধেয় আব্বাজান রাহ. বলতেন, আজ যত ইসলামবিরোধী আন্দোলন, তাদের প্রথম টার্গেট উলামায়ে কেরাম। তারা মানুষকে বোঝায় ভাই! আমরা ইসলাম বিরোধী নই। ইসলাম তো অনেক ভালো জিনিস। কিন্তু এই মৌলভীরা ইসলামের নানা রকম ভুল ব্যাখ্যা করে একে অত্যন্ত খারাপ করে ফেলেছে। যত বাতিল ফেরকা, তাদের প্রথম টার্গেট আলেম সমপ্রদায়। আব্বাজান রাহ. বলতেন, এর কারণ হচ্ছে, যদি এক পাল ভেড়া রাস্তা দিয়ে যেতে থাকে আর নেকড়ে তার উপর আক্রমণ করতে চায় তাহলে তার প্রথম উদ্দেশ্য হয় রাখালকে শেষ করা। যখন রাখাল থাকবে না তখন ভেড়াগুলোকে খাওয়া সহজ হবে। আর যদি রাখাল জীবিত থাকে, তাহলে দু একটি ভেড়া কোনোভাবে খেতে পারলেও সে নিস্তার পাবে না। নেকড়েকে শেষ করে দিবে। তাই আব্বাজান রাহ. বলতেন, সকল ইসলাম বিরোধী বাতিল শক্তির প্রথম টার্গেট মৌলভীদের শেষ করে দেওয়া। এদের বদনাম করা। জনগণকে এদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। এদেরকে সমাজের নিচু শ্রেণীতে পরিণত করা। কেননা, আলেম-ওলামা তাদের পথের কাঁটা। এই কাঁটা সরিয়ে দিতে পারলে সাধারণ মানুষকে শিকার করা অত্যন্ত সহজ। যতক্ষণ এই মৌলভী বসা আছে, সে সবকিছুর উপর আপত্তি তুলবে। মতলব হাসিলে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। আর এরা এমন কঠিন প্রাণী যে, এদের উপর রাইফেল-মেশিনগানের গুলিও কোনো ক্রিয়া করে না। নির্বাসন এর উপর কোনো প্রভাব ফেলে না। অনাহার-অর্ধাহারের পরোয়া করে না। সকল প্রতিকূল অবস্থাতেও ক্বালাল্লাহ, ক্বালার রাসূল ছাড়তে রাজি নয়। তাই এদের খতম কর। যতক্ষণ এরা নিশ্চিহ্ন না হবে ততক্ষণ এই জাতি তোমাদের কব্জায় আসবে না। এটাই সকল বাতিলপন্থীর পলিসি। রাশিয়ার ওই ভূ-খণ্ডেও তা প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু দুনিয়া দেখেছে যে, সে অন্ধকার যুগে যে ব্যক্তি মোল্লার সাথে নিজেকে জুড়ে রেখেছিল তাকে আল্লাহ তাআলা হিফাযত করেছেন। তার ঈমান বেঁচে গিয়েছে। আর যে বিচ্ছিন্ন সে সয়লাবে ভেসে গেছে।
মরহুম ইকবাল যিনি আমাদের উর্দূ ভাষার প্রসিদ্ধ কবি। তাঁর অনেক কবিতাই প্রসিদ্ধ। মোল্লাদের বিরুদ্ধেও তার অনেক কবিতা আছে। মোল্লাদের সম্পর্কে ইংরেজরা তার মানসপটে যে চিত্র অঙ্কিত করেছিল তাতে তিনি ‘মোল্লার আযান’ ও ‘মুজাহিদের আযান’ ইত্যাদি লিখেছিলেন। তিনি এক কবিতায় অত্যন্ত মূল্যবান কথা বলেছেন। ইংরেজদের চিন্তা উন্মোচন করে তিনি বলেন,
‘‘যদি আফগানীদের মন থেকে দ্বীনী আত্মমর্যাদাবোধ বের করতে হয় তবে তার একমাত্র পথ হচ্ছে আফগানিস্তানের পর্বতরাজি থেকে মোল্লাদের বের করে দাও।’’ কারণ যতক্ষণ এরা থাকবে ততক্ষণ আফগানীদের অন্তর থেকে ঈমানের আলো নির্বাপিত হবে না। এই পলিসি ইংরেজদেরও ছিল। ইসলামের সকল দুশমনেরও একই পলিসি। কারণ সরাসরি ইসলামের বিরুদ্ধে হামলা করলে সাধারণ মানুষ তা বরদাশত করবে না। কেউ যদি বলে ভাই! ইসলাম ছেড়ে দাও, তাহলে সে যত বে আমলই হোক বলবে, নাউযুবিল্লাহ! মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়ে যাবে কিন্তু ইসলাম ছাড়তে রাজি হবে না। তাই তারা এই কৌশল অবলম্বন করে যে, মৌলভীদেরকে আস্থাহীন করে দাও, তাদের সম্পর্ক জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দাও, যখন এই মৌলভীরা থাকবে না, দ্বীনের কথা বলার লোক থাকবে না তখন মুসলমানদের গ্রাস করা সহজ হবে। আজ আমাদের সমাজে এটা রীতিমতো একটা আন্দোলনের রূপ ধারণ করেছে। আমার সম্মানিত পিতা অত্যন্ত সুন্দর বলতেন। লোকেরা বলত ভাই! মৌলভী একসময় অত্যন্ত ভালো সমপ্রদায় ছিল। কিন্তু আজ আর তেমন নেই। এরা এখন ধোঁকাবাজ হয়ে গিয়েছে। তাই আমরা এখন কোথায় যাব?
আল্লামা ইকবাল বলেন,
অর্থাৎ এই মৌলভী, দরবেশ, সুফীরা নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্য বিভিন্ন ধান্দা করে, তাই আমরা সাধারণ মানুষ কোথায় যাব? আমার শ্রদ্ধেয় আব্বাজান এর উত্তরে বলতেন, ভাই! যুগটাই হচ্ছে ভেজালের। খাঁটি কোনো জিনিস এখন পাওয়া যায় না। আমাদের দেশের অবস্থা দেখুন,
তেল, আটা, ঘি কোনো কিছুই খাঁটি পাওয়া যায় না, এমনকি কেউ কেউ বলে যে, খাঁটি বিষও পাওয়া যায় না। এক লোক ভেজাল খেতে খেতে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যা করার জন্য বিষ পান করল। এখন সে বিষ পান করে অপেক্ষা করছে যে, কখন মৃত্যু আসবে। কিন্তু মৃত্যু তো আসছে না। পরে বোঝা গেল যে, ওই বিষেও ভেজাল ছিল। কিন্তু তাই বলে কি আমরা সবকিছু ছেড়ে দিয়েছি। আমরা কি বলি, আটা খাঁটি পাওয়া যায় না তাই আটা খাব না, ভূষি খাব! ঘি-তেল খাঁটি পাওয়া যায় না তো গিরিস খাব। এমন তো কেউ বলে না; বরং তালাশ করে বের করে কোন দোকানে খাঁটি ঘি পাওয়া যায়। কোন দোকানে ভালো চিনি পাওয়া যায়। তাই সাইনবোর্ড লাগিয়ে বসে আছে, আর মানুষের প্রাণ, সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। কিন্তু কেউ বলে না যে, সব ডাক্তার ধোঁকাবাজ, সব ইঞ্জিনিয়ার ধোঁকাবাজ, সব উকিল ধোঁকাবাজ, পয়সা খাওয়ার লোক। তাই এদের পরিত্যাগ কর। এমন কেউ করে না। সকল ভেজাল সত্ত্বেও যে অনুসন্ধান করে, সে খাঁটি জিনিস খুঁজে বের করেই ফেলে। তাই আমার শ্রদ্ধেয় পিতা বলেন, আজো যদি কেউ সত্যিকারের তলব নিয়ে তালাশ করে, তাহলে সে আজো পাবে। এটা কুরআনের ওয়াদা। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা) হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।-সূরা তাওবা : ১১৯)
এই সত্যাবাদীদের দল কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। তবে অনুসন্ধানকারীর আগ্রহ দরকার। সামান্য মেহনত ও তালাশের প্রয়োজন। তাই এর কারণে পুরো গোষ্ঠীর ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করা আর তাদের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া এটা কোনোভাবেই ঠিক নয়।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরেকটি মূল্যবান কথা বলেছেন, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। তিনি বলেন, সমস্যা আরো আছে। তা হচ্ছে : আজ যখন কেউ পীর ও মুরশিদ তালাশ করে তো নিজের আমল-আখলাক যতই খারাপ হোক না কেন পীর চায় জুনাইদ বাগদাদী আর শিবলীর মতো। আবদুল কাদের জীলানী আসলে, শিবলী আসলে, জুনায়েদ বাগদাগী আসলে তাদের রাহনুমায়ী কবুল করব। অন্যথায় সাধারণ লোকাদের রাহনুমায়ী আমি কবুল করতে পারি না। এই ইবলিস আমাদের দেমাগে সওয়ার হয়ে আছে। আরে ভাই! সেই মাপের লোক এখন কোত্থেকে আসবে? আমার আব্বা বলতেন, ভাই! যেমন রূহ তেমন ফেরেশতা। যেমন মুরীদ তেমন তার পীর। জুনাইদ আর শিবলী না হোক, তুমি যে স্তরের সেই স্তরের পীর আজো আছে। আর আলহামদুলিল্লাহ এটাই তোমার জন্য যথেষ্ট।
এক ব্যক্তি তাকে বলেছিলেন যে, হযরত কী করব? কোনো দিকে মন নিশ্চিন্ত হয় না। যার দিকে দেখি তার কোনো না কোনো দোষ সামনে এসে যায়। মন তার দিকে আকৃষ্ট হয় না। তাই কী করব? কার কাছে যাব?
তিনি বলেন, এই চোখে না লাগার কারণ হচ্ছে চোখে অহংকারের ঠুলি দিয়ে রেখেছে। তুমি গিয়ে তোমার মসজিদের মুআযযিনের সংস্পর্শে থাক, তার দ্বারা তোমার ফায়দা হবে। কারণ মসজিদের মুআযযিন দিনে পাঁচবার আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তাই তুমি যখন পিপাসা নিয়ে যাবে তখন তার দ্বারাও তোমার ফায়দা হবে। কারণ দেওয়ার মালিক তো আল্লাহ তাআলা। আগেও কয়েকবার বলেছি যে, কোনো শায়খের ক্ষমতা নেই যে, কিছু দেবে। দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ। তাই যখন তুমি সত্যিকারের তলব নিয়ে এমন লোকের কাছে যাবে যার মধ্যে শরীয়তবিরোধী কোনো কিছু নেই, তোমার ফায়দা হবে। যদি অন্য কাউকে না পাওয়া যায় তখন মসজিদের মুআযযিনের সংস্পর্শে বস, তোমার উপকার হবে। বাস্তবিক পক্ষে এটা অনেক বড় একটি চক্রান্ত যে, উলামাদের উপর অভিযোগ উত্থাপন করে, ভাই! আমরা ইসলামের কোনো কিছু নেই, তোমার ফায়দা হবে। যদি অন্য কাউকে না পাওয়া যায় তখন মসজিদের মুআযযিনের সংস্পর্শে বস, তোমার উপকার হবে। বাস্তবিক পক্ষে এটা অনেক বড় একটি চক্রান্ত যে, উলামাদের উপর অভিযোগ উত্থাপন করে, ভাই! আমরা ইসলামের শত্রু নই, আমরা এই মৌলভীদের বিরোধিতা করি, যারা ইসলামকে ভুল বুঝিয়েছে। ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করেছে। এদের উপর আমাদের অভিযোগ। আল্লাহ তাআলা এই সম্প্রদায়কে মর্যাদা দান করেছেন যে, এদেরকে ইসলামের জন্য ঢাল বানিয়ে দিয়েছেন। শত্রুরা ইসলামের উপর অভিযোগ তুলতে চায়, কিন্তু যেহেতু ইসলামের উপর অভিযোগ উঠানোর সাহস হয় না তাই এই বেচারাদের উপর আপত্তি উঠায়। এই চক্রান্তের বিষফল যা আমি ইতিপূর্বে আপনাদের বলেছি যে, যারা এদের (উলামাদের) সাথে সম্পৃক্ত ছিল না তারা বে-দ্বীনীর সয়লাবে ভেসে গিয়েছে। আজ কালিমাও জানে না। তাই এই প্রোপাগাণ্ডায় কখনোই জড়ানো উচিত নয়।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলের হিফাযত করুন। আহলে হকের সাথে সর্বদা আমাদেরকে জুড়ে রাখুন এবং দ্বীন ও ঈমানের মূল্য বোঝার তাওফীক দান করুন। আমীন
হযরত মাওলানা মুফতি তকী উছমানী
কিছুদিন আগে ওলামায়ে কেরামের সাথে উযবেকিস্তানের সফর হয়েছে। কিছু বন্ধু সে সফরের কারগুযারী শোনানোর অনুরোধ করলেন। আমারও মনে হল যে, এ সফরে আল্লাহ তাআলা অনেক শিক্ষণীয় বিষয় দান করেছেন, যা আলোচনা করা আমাদের সবার জন্য ফায়েদাজনক হতে পারে। তাই এখন এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করার ইচ্ছা করেছি।
উযবেকিস্তান দীর্ঘ দিন যাবৎ রাশিয়ার আগ্রাসনের শিকার ছিল। অল্প কিছু দিন পূর্বে তা স্বাধীন হয়েছে। সে সময় পরিস্থিতি এত কঠিন ছিল যে, কোনোদিন এই সব স্থান দেখার সুযোগ হবে তা ছিল কল্পনারও অতীত। অথচ এই ভূখণ্ডই একদিন ইসলাম ও ইসলামী উলূমের মারকায ছিল। আপনারা হয়তো বুখারা-সমরকন্দের নাম শুনেছেন। এই দুই বিখ্যাত শহরে মুসলিমজাহানের বহু নামজাদা মনীষী জন্মলাভ করেছেন। আপনারা ‘সিহাহ সিত্তা’র নাম শুনেছেন, যা হাদীস শরীফের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সংকলন। আল্লাহ তাআলা এই গ্রন্থগুলোকে এমন মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা দান করেছেন যে, মুসলিমজাহানে এগুলোকে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্যরূপে গ্রহণ করা হয়। কুদরতের আজীব কারিশমা যে, হাদীসের এই ছয় ইমামের কেউই আরবে জন্ম গ্রহণ করেননি। তাঁরা সবাই ছিলেন অনারব এবং এই ভূখণ্ডের অধিবাসী। ইমাম বুখারী রাহ. যাঁর সংকলিত হাদীসগ্রন্থ ‘সহীহ বুখারী’ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর কিতাবের পর এটিই সর্বাধিক বিশুদ্ধ কিতাব, তাঁর জন্মও বুখারায়। এজন্য তাকে বুখারী বলা হয়। তাঁর ইন্তেকালও হয়েছে সমরকন্দের নিকটবর্তী একটি ছোট্ট গ্রামে। গোটা জীবন হাদীস শরীফের চর্চায় কাটিয়ে দিয়েছেন। নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে ইরাক, হিজায, শাম সফর করেছেন। কত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও হাদীস অন্বেষণ অব্যাহত রেখেছেন তা একটি দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যাবে। ইমাম বুখারী রাহ. এক শায়খের নিকট হাজির হলেন। তিনি সম্ভবত বাগদাদের একজন মুহাদ্দিস ছিলেন। একদিন শায়খ দেখলেন, মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল (ইমাম বুখারী) দরসে অনুপস্থিত। এমন অনেক ছাত্র থাকে যারা কখনো দরসে থাকে, কখনো থাকে না। কিন্তু ইমাম বুখারী ওই সকল তালিবে ইলমের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যারা সময়ের আগেই দরসে উপস্থিত হয় এবং সর্বদা সামনের সারিতে থাকে। যাদের অনুপস্থিতি উস্তাদ কল্পনাও করতে পারেন না। তো হঠাৎ একদিন তাকে অনুপস্থিত দেখে উস্তাদ ভাবলেন, হয়তো কোনো অসুবিধা হয়েছে। পরের দিন শায়খ দরসে এসে দেখলেন, আজও তিনি অনুপস্থিত। শায়খ চিন্তিত হলেন সে কি অসুস্থ হয়ে পড়েছে কিংবা অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে! সে তো না আসার মতো ছাত্র নয়। তো শায়খ একজনকে পাঠালেন, খোঁজ নাও সে কেন দরসে আসছে না। মসজিদের নিকটে একটি ছোট হুজরায় ইমাম বুখারী থাকতেন। সেই তালিবে ইলম গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ল। ভিতর থেকে আওয়াজ এল, কে? কেন এসেছেন? সেই তালিবে ইলম বলল, একটু বাইরে আসুন, শায়খ আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। ইমাম বুখারী বললেন, ভাই! আমি বাইরে আসতে অপারগ। আপনি ওখান থেকেই বলুন কেন এসেছেন? আগন্তুক বললেন, আপনি কেন দরসে আসছেন না? আপনি যদি অসুস্থ হয়ে থাকেন তাহলে আমরা আপনার সেবা-শুশ্রূষা করব। অন্য কোনো সমস্যা থাকলে তা দূর করার চেষ্টা করব। আপনার অনুপস্থিতির কারণে শায়খ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়েছেন। তার বারংবার পীড়াপীড়ির পর ইমাম বুখারী বললেন, পরিধানের একটি মাত্র কাপড় ছিল যা ধুয়ে ধুয়ে পরিধান করতাম। কিন্তু এখন তা বিভিন্ন জায়গায় এতই ছিড়ে গিয়েছে যে, সতর আবৃত রাখা সম্ভব নয়। তাই আমি অপারগ হয়ে ঘরে বসে আছি।
চিন্তা করুন, কী অবস্থার মধ্য দিয়ে ইমাম বুখারী ইলম হাসিল করেছেন। এমনি এমনি ইমাম বুখারী হওয়া যায় না এবং এমনি এমনি জগৎ কাউকে ইমাম ও মুকাতাদা হিসেবে গ্রহণ করে না।
আজ আমাদের সামনে তৈরি-রুটির মতো হাদীসের কিতাবসমূহ বিদ্যমান। কত আরামে বসে হাদীস পড়ছি ও শুনছি। অথচ মুহাদ্দিসগণ এক একটি হাদীস অর্জনের জন্য যে ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করেছেন তা চিন্তা করলেও অভিভূত হয়ে যেতে হয়। এভাবে ইলম হাসিল করার পর ইমাম বুখারী নিজ দেশ বুখারায় ফিরে যান। সেখানে একটি মাদরাসা আছে ‘মীরে আরব’ নামে, আজো বিদ্যমান রয়েছে। সে মাদরাসা যিয়ারতের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ওই মাদরাসায় তিনি তাঁর সংকলিত হাদীসগ্রন্থ আলজামিউস সহীহ লিপিবদ্ধ করিয়েছেন। সে যুগে ছাপাখানা ছিল না যে, কিতাব ছাপা হয়ে সবখানে ছড়িয়ে যাবে। তখন উস্তাদ হাদীস লেখাতেন, আর তালিবে ইলমরা তা লিপিবদ্ধ করত। এভাবে সেই মাদরাসায় ইমাম বুখারী রাহ. সহীহ বুখারীর নব্বই হাজার কপি লিখিয়েছেন।
এখন তো লাউড স্পীকারের যুগ। কিছু লোক উপস্থিত হলেই লাউড স্পীকার প্রয়োজন হয়। অথচ সে যুগে মুহাদ্দিসীনে কেরামের এক এক দরসে তালিবে ইলমের সংখ্যা এত বেশি হত, যা আজ বড় বড় সমাবেশেও হয় না। এক মুহাদ্দিস সম্পর্কে লিখেছে যে, তাঁর এক দরসে পনের হাজার দোয়াত-কলম গণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ হাদীস লিপিবদ্ধকারী তালিবে ইলম ছিল এই পরিমাণ। আর যারা শুধু হাদীস শোনার জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন তাদের সংখ্যা এর বাইরে।
হযরত ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. যিনি অনেক বড় মুহাদ্দিস ছিলেন, তাঁর দরস সকালে ইশরাকের পর শুরু হত। দরসে শরীক হওয়ার জন্য লোকেরা আগের দিন আসরের সময় গিয়ে জায়গা দখল করত।
এই বিপুল সমাবেশে দরস এভাবে হত যে, উস্তাদ সনদের একটি শব্দ বা হাদীসের একটি বাক্য বলতেন, যতদূর আওয়াজ যেত সবাই লিখত। এরপর একজন দাঁড়িয়ে উচ্চ স্বরে পুনরায় ওই শব্দ বা বাক্যটি বলত। যতদূর আওয়াজ যেত, তার শেষ মাথায় আরেকজন দাঁড়িয়ে উস্তাদের ওই শব্দ উচ্চারণ করত।
এভাবে অনেক দূর পর্যন্ত আওয়াজ পৌঁছানো হত। বিখ্যাত মুহাদ্দিসদের দরসগুলো এভাবেই হত। ইমাম বুখারী রাহ.ও এভাবে মাদরাসা ‘মীরে আরব’-এ বুখারী শরীফের নব্বই হাজার কপি লিখিয়েছেন।
ইমাম তিরমিযী রাহ. তিরমিযের লোক ছিলেন। সেটাও উযবেকিস্তানের অংশ। আরো বড় বড় ওলী বুযুর্গ এই অঞ্চলে পয়দা হয়েছেন। আপনারা সিলসিলায়ে নকশবন্দিয়ার কথা শুনে থাকবেন, যা তাসাওউফের অনেক বড় সিলসিলা। আমাদের এখানে হযরত থানভী রাহ. এর যে সিলসিলা আছে, তাতে চারো সিলসিলায় বায়আত করানো হয়। এর মধ্যে নকশবন্দিয়াও রয়েছে। এই সিলসিলার ইমাম হলেন, হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দী রাহ.। তিনিও ওই ভূখণ্ডের অধিবাসী ছিলেন। সমরকান্দের কাছে তার কবর আছে। হযরত খাজা উবায়দুল্লাহ আহরার রাহ., যিনি মাওলানা আবদুর রহমান জামী রাহ. এর শায়খ ও উস্তায ছিলেন তাঁর ঘটনা সম্ভবত আপনাদের বলেছি যে, এক লোক তাঁর বুযুর্গীর কথা শুনে তার কাছে এল। এসে দেখে তিনি বড় ব্যবসায়ী মানুষ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারবার নিয়ে ব্যস্ত। কিছু কিছু লোক আসে, তাদের কিছু নসীহতও করেন। তবে বেশিরভাগ সময় ব্যবসায় কাটাচ্ছেন। সে ভাবতে লাগল, আমি তো মনে করেছিলাম, তিনি আল্লাহর ওলী হবেন। বসে বসে আল্লাহ আল্লাহ করবেন। কিন্তু এখন দেখছি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারবার নিয়ে ব্যস্ত। এইসব ভাবনা তার অন্তরে আসতে লাগল। বিকেলে খাজা উবায়দুল্লাহ আহরার রাহ. হাঁটতে বের হলেন। এই লোকও সাথে চলল। হঠাৎ খাজা সাহেব রাহ. বললেন, আমার হজ্বে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। সঙ্গী লোকটি বলল, হযরত এ তো খুব ভালো কথা। আমিও আপনার সফরসঙ্গী হতে চাই। হযরত খাজা সাহেব রাহ. বললেন, ঠিক আছে চল।
সেই লোক বলল, হযরত এখনি? বললেন, হ্যাঁ, এখনি।
সে বলল, হযরত ঘরে আমার চাদর রেখে এসেছি। সেটা একটু নিয়ে আসি। হযরত বললেন, ভাই তোমার সামান্য চাদরের এত ফিকির যে, তা ছাড়া তুমি হজ্বে যেতে পারবে না, আর আমার দেখ কত ব্যবসা! কত কর্মচারী। সবকিছু ছেড়ে আমি যেতে তৈরি। আসল কথা হচ্ছে, তোমার মন আটকে আছে সেই চাদরে। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, আমার ব্যবসা খুব চলছে, অন্তর কোথাও বাধা পড়ে নেই। আর দুনিয়া তাকেই বলে যাতে মানুষের মন বাঁধা পড়ে থাকে। ছোট্ট একটা চাদরের মধ্যে বাঁধা পড়লে সেটাই দুনিয়া। আর অনেক বিত্তসম্পদের পরও যদি তাতে মন বাঁধা না থাকে তাহলে তা দুনিয়া নয়। খাজা উবায়দুল্লাহ আহরার রাহ.-এর কবরও সমরকন্দেই অবস্থিত।
তাঁর আরেকটি প্রসিদ্ধ ঘটনা আছে। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে সাথে বাদশাহর ইসলাহরও ফিকির করতেন। তার কাছে গিয়ে ওয়ায-নসীহত করতেন। মানুষ মনে করত যে, এই লোক একে তো ব্যবসায়ী তদুপরি রাজা-বাদশাহর সঙ্গেও তার ওঠা-বসা। জনৈক বুযুর্গ তাঁকে পত্র লিখলেন যে, হযরত আপনি এই ভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত আবার রাজা-বাদশার দরবারেও আসা যাওয়া করেন। এমন করা থেকে বিরত থাকুন যাতে মানুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়। উত্তরে তিনি একটি পংক্তি লিখলেন, যা অত্যন্ত প্রসিদ্ধ।
অর্থাৎ যদি পীর হতে চাই তাহলে কোনো পীর আর মুরীদই পাবে না। মানুষকে ইসলাহর প্রতি উদ্বুদ্ধ করা এবং নিজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রেখে তাদের ইসলাহ করার যোগ্যতাও আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। তাই আমি যদি পীর হয়ে যাই তাহলে কোনো পীরের আর মুরীদ জুটবে না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা আমাকে ভিন্ন কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং আমি তা করছি। তা হচ্ছে শাসক ও ক্ষমতাশালী লোকদের সংশোধন। আল্লাহ তাআলা যদি কবুল করেন তাহলে এটাই আমার আখেরাতের সম্বল।
হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচাত ভাই, হযরত কুসাম ইবনে আব্বাস রা.-এর কবরও সেখানে। তিনি এই অঞ্চলে সর্বপ্রথম ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আসেন এবং শহীদ হন। মোটকথা, এ ভূখণ্ড ইসলামের ইতিহাসের বড় বড় ব্যক্তিত্বকে বুকে ধারণ করে আছে। বড় বড় ফকীহ, ওলী, মুহাদ্দিস এবং ইলমে কালাম ও আকায়েদের বড় বড় ইমাম এখানে সমাহিত। কিন্তু আমাদের বদ আমলের পরিণামে যে মারকায সদা ক্বালাল্লাহ ও ক্বালার রাসূলের আওয়াজে প্রকম্পিত থাকত তা কমিউনিস্টদের আগ্রাসনের শিকার হয়ে যায়। কমিউনিজমের বিপ্লবের পর তারা ধীরে ধীরে এই সকল অঞ্চল কব্জা করে ফেলে। এই যে তুর্কিস্থান, যা ইতিহাসে তুর্কিস্থান, তুরান আবার কখনো ফারেহান নামে প্রসিদ্ধ, তার আয়তন এত বড় ছিল যে, সমগ্র হিন্দুস্থান, পাকিস্থান, বাংলাদেশ ও সাউদী আরব মিলেও তার সমান হওয়া কঠিন। কিন্তু রুশরা একে খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলেছে। আর যুলুম-নির্যাতনের এমন দাস্তান কায়েম করেছে যে, দুনিয়ার আর কোথাও এর নজির পাওয়া মুশকিল হবে।
সেখানে আযান নিষিদ্ধ করা হল। মসজিদগুলো বন্ধ করে দেওয়া হল। নামায পড়ার অনুমতি ছিল না। কালিমা পড়ার অনুমতি ছিল না। মসজিদগুলোকে কোথাও সিনেমা হলে পরিবর্তন করা হল, কোথাও গুদাম, কোথাও ওয়ার্কশপ, আবার কোথাও অফিস বানানো হল। কেউ নামায পড়তে চাইলে তার উপর এমন পাশবিক ও ভয়ানক শাস্তি নেমে আসত, যার দৃষ্টান্ত পাওয়া দুষ্কর। আলিমগণ বিশেষ টার্গেটে পরিণত হলেন। ইতিপূর্বে তারা ছিলেন অত্যন্ত সম্মানের পাত্র। তাদেরকে ‘মোল্লা’ বলা হত। ইংরেজরা এ শব্দকে সমাজে অপাংক্তেয় করে দিয়েছে। এটা এখন গালি হয়ে গিয়েছে। অথচ তা ছিল অত্যন্ত মর্যাদার শব্দ। বড় আলেম, ফাযেল ও শিক্ষিত লোককে সম্মানের জন্য মোল্লা উপাধি দেওয়া হত। ইংরেজরা যখন দেখল, মোল্লা সমপ্রদায়ই আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু তখন তারা বিভিন্ন কৌশলে এর এত নিন্দা করল যে, এখন তা গালিতে পরিণত হয়েছে। অথচ মোল্লাগণই দীর্ঘ ৭০ বছরের আগ্রাসনকালে সকল প্রকার জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে এই জাতির ঈমানকে টিকিয়ে রেখেছে। যার সম্পর্কে সন্দেহ হত যে, ইলমে দ্বীনের সাথে তার সামান্যতম সম্পর্ক রয়েছে, উলামাদের সঙ্গে তাকেও উত্তপ্ত চুনভর্তি গর্তে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হত। কাউকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন দেওয়া হত, যেখানে তাপ মাত্রা মাইনাস ৬০ ডিগ্রী। অনেকের নখ উপড়ে ফেলা হত। চামড়া খসিয়ে ফেলা হত। আর এসব ছিল প্রতিদিনের দৃশ্য। এই পাশবিকতা ও বর্বরতার মাঝেও তারা দ্বীনী ইলমের চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। লুকিয়ে লুকিয়ে, ভূ-গর্ভের গোপন কক্ষে তারা ক্বালাল্লাহ-ক্বালার রাসূলের পঠন-পাঠন অব্যাহত রেখেছেন।
আমরা সমরকন্দে এক মসজিদের ইমাম সাহেবের মেহমান হয়েছিলাম। তিনি সে অঞ্চলের একজন প্রসিদ্ধ ইমাম। তিনি আমাদের বলেছেন, এ মসজিদটি রুশ বিপ্লবের পর সিনেমা হল বানানো হয়েছিল। কিছুদিন আগে এলেও আমি আপনাদের সিনেমার পোস্টারগুলো দেখাতে পারতাম, যা এর দেয়ালে লাগানো ছিল। সে সময় নামায পড়ার অনুমতি ছিল না। আমার আব্বা ছিলেন এই মসজিদের খাদেম। বিপ্লবের পর তাকে ক্ষেতের কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তাকে ক্ষেতের কাজে ব্যস্ত থাকতে হত। দুপুরে ঘরে এসে নামায পড়তেন। ঘরে জায়নামায রাখার তো প্রশ্নই আসে না। কারণ যে কোনো সময় তল্লাশী হতে পারে। তখন যদি জায়নামায পাওয়া যায় তাহলে পুরা পরিবারের আর রক্ষা ছিল না। তাই মেঝেতেই নামায পড়তে হত। এতেও বিপদের আশঙ্কা ছিল। আম্মাকে বলতেন, তুমি চা বানিয়ে রাখ। যেন কেউ আসলে বলা যায় যে, চা তৈরি হচ্ছিল বা চা পান করছিল। এভাবে আব্বা নামায পড়তেন।
ইমাম সাহেব বলেন, আমি তখন ৪-৫ বছরের শিশু। আমাকে দরজায় দাঁড় করিয়ে দিতেন যেন আমি বাইরে নজর রাখি এবং কেউ আসলে বলি, আব্বা ভিতরে চা পান করছেন। কমিউনিস্ট সরকারের লোকেরা রাস্তায় ঘোরাফেরা করত। তারা এসে আমাকে আখরোট দিয়ে জিজ্ঞাসা করত, তোমার আব্বা ভিতরে কী করছেন? আমি বলতাম, চা পান করছেন। তারা বলত, না ভিতরে হয়ত নামায-টামায পড়ছে। এভাবে আমাকে ফুসলাতে চেষ্টা করত। তিনি বলেন, শৈশবের দিনগুলোর কথা আমার আজো মনে আছে। সারাদিন খাটা-খাটুনির পর রাতে যখন বসতির লোকজন ঘুমিয়ে পড়ত, তখন আব্বা আমাকে গোপন কক্ষে নিয়ে কুরআন মজীদ পড়াতেন। সেই কক্ষটা এমন ছিল যে, বাইরে থেকে দেখতে একটা আলমারীর মতো মনে হত। তার উপর বাসন-পেয়ালা ইত্যাদি রেখে দেওয়া হত। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল গোপন কক্ষে যাওয়ার দরজা। সেখানে আব্বা আমাকে কুরআন মজীদের তা’লীম দিতেন। শুধু কুরআন মজীদই নয়; আরবী ভাষার ও ইসলামী উলূমের তা’লীমও আমি সেখানেই হাসিল করি।
সারা দিন ক্ষেতের পরিচর্যা, আর রাতে বাচ্চাদের গোপনে পড়ানো এই ছিল তার কাজ।
সেসময় আব্বা আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, যা এখনো মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘বেটা, আমার জীবনের তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর পরোয়ানা এসে যেতে পারে। এই দ্বীন তোমার কাছে আমানত রেখে যাচ্ছি। এটা হল সেই যমানা, যার সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গেছেন, ‘এক সময় এমন আসবে যখন দ্বীনের উপর থাকা হাতের মুঠোয় আগুনের অঙ্গার ধরে রাখার মতো কঠিন হবে। বেটা, তোমার হাতে এই অঙ্গার আমি রেখে যাচ্ছি। যা তুমি ফেলে দিতে পারবে না। যদি ফেলে দাও তাহলে জাহান্নামের আগুন তোমাকে গ্রাস করবে। আর যতক্ষণ ধরে রাখবে, তোমাকে এর জ্বলন সহ্য করতে হবে।
এভাবে আল্লাহর বান্দারা দ্বীন হিফাযত করেছেন। যেখানেই কোনো মোল্লা ছিল তার ঘর ছিল একটি মাদরাসা। রাতের আঁধারে, ভূ-গর্ভের গোপন কক্ষে এই মাদরাসাগুলো চলত।
আজ মোল্লাদের নিন্দা করার লোক অনেক আছে। কিন্তু তারা জানে না যে, আল্লাহ তাআলা তাদের মাধ্যমেই তার কালিমাকে হিফাযত করেছেন। অনাহারে, অর্ধাহারে থেকে, সকল যন্ত্রণা সহ্য করে এবং মাথার উপর মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে তারা শুধু চেষ্টাই করেছেন যে, এই কালিমা উম্মতের মাঝে অক্ষত থাকুক। আজো সেসব অঞ্চলে যতটুকু দ্বীন আছে তা এসকল কুরবানীরই ফসল।
সেখানে অনেক আলিমের সাথে আমাদের দেখা হয়েছে। তাদের সাথে আরবীতে কথা হত। এছাড়া কথা বলার আর কোনো উপায়ও ছিল না। তারা খুব ভালো আরবী বলেন। তো যাকেই জিজ্ঞাসা করেছি, ভাই আপনি আরবী কোথায় শিখেছেন তিনিই উত্তরে বলেছেন, ‘হুজরাতে শিখেছি’। হুজরা মানে কক্ষ। প্রত্যেক মোল্লার বাড়িতে গোপন ঘরে ইলম চর্চার যে ব্যবস্থা ছিল এরই নাম হুজরা। সাধারণ মানুষ সুখ-নিদ্রায় বিভোর হত আর তারা দ্বীনের চর্চায় মশগুল হতেন। এভাবে আল্লাহ তাদের ঈমান হিফাযত করেছেন। শুধু তা-ই নয় আল্লাহ তাদেরকে ঈমানের মিষ্টতাও দান করেছেন।
আমরা তো উত্তরাধিকার সূত্রে ইসলামকে পেয়েছি। আল্লাহ তাআলা নিজ মেহেরবানীতে মুসলমান পিতামাতার সন্তান বানিয়েছেন। তাই অতি সহজে ঈমান ও ইসলামের দৌলত আমরা পেয়ে গেছি। একটি কাঁটাও আমাদের পায়ে বিঁধেনি। ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করতে হয়নি। ত্যাগ ও কুরবানীর সম্মুখিন হতে হয়নি। আল্লাহ তাআলা মেহেরবানী করে এই নিয়ামত দিয়ে দিয়েছেন। তাই এর কদর নেই।
এর মূল্য তাদেরকে জিজ্ঞাসা করুন, যারা ঈমান রক্ষার জন্য প্রাণ বিপন্ন করেছেন। এটা সহজ কথা নয় যে, সত্তর বছর নির্যাতন-নিপীড়নের চাকায় পিষ্ট হওয়ার পরও তারা পুনরায় মুসলমানরূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। শেষ দিকে রুশ সরকারও কিছু মসজিদ-মাদরাসা খুলে দিয়েছিল। মানুষ গেলে দেখাত যে, আমাদের এখানে মসজিদ-মাদরাসা আছে। কিন্তু এর সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। রুশদের সময় সবচেয়ে বড় মাদরাসা ছিল তাশখন্দে, তাতে সর্বোচ্চ চল্লিশ জন ছাত্রের পড়ার অনুমতি ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর এখন ছোট ছোট মাদরাসায় গিয়ে দেখুন, কোথাও ছাত্রসংখ্যা দুই শত, কোথাও পাঁচশত আবার কোথাও হাজার। আল্লাহ তাআলার মেহেরবানীতে তালিবে ইলমের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা এজন্য শোকরগোযারী করেন যে, আলহামদুলিল্লাহ আমরা কুরআন মজীদ পড়তে পারছি। কিন্তু কুরআন মজীদের নুসখা তাদের কাছে নেই। মসজিদ মুসল্লী দ্বারা পরিপূর্ণ। কিন্তু কুরআনের নুসখা নেই।
আমাদের এক সাথীর সাথে কুরআন মজীদ ছিল। সে জুমআর দিন মসজিদে বসে তিলাওয়াত করছিল। মসজিদে পাঁচশ’র মতো মুসল্লী নামায পড়তে এসেছিল। যে-ই আসত সেই কুরআন মজীদের নুসখাটির দিকে অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকত যে, আহা! কি নিয়ামত নিয়ে সে বসে আছে! কুরআন মজীদের নুসখা এতই কম যে, তাদের কাছে এ রকম নুসকা থাকাটা রীতিমতো একটা বিস্ময়কর ব্যাপার।
বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য নূরানী কায়দা নেই। যে কপিটি পড়ানো হচ্ছিল তা দেখলাম ১৯১৭ সনের ছাপা। অর্থাৎ রুশ বিপ্লবের সময়কার। তা-ই ফটোকপি করে পড়ানো হচ্ছে। এই রকম উপায়-উপকরণহীন অবস্থায় সময় কেটেছে। এরপরে আল্লাহ তাআলা এই ঈমানের মূল্য বোঝার তাওফীক দান করেছেন। পক্ষান্তরে এমনও অনেক ছিল যারা সেই স্রোতে ভেসে গিয়েছে। যারা মোল্লার অধীন ছিল না। মোল্লার সঙ্গে যাদের সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। তারা এমনভাবে ভেসে গিয়েছে যে, কালিমা জানে না। কালিমা কী জিনিস চিনে না। নাম তো মুসলমান, কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে কিছুই সে জানে না। এই হচ্ছে অবস্থা যা আমরা সেসব এলাকায় প্রত্যক্ষ করেছি।
কিছুদিন পূর্বে আমার চীন সফরের সুযোগ হয়েছিল। সেখানেও কম-বেশি একই রকম অবস্থা চোখে পড়েছে। দীর্ঘ দিন যাবৎ চীনে নামায পড়া নিষিদ্ধ ছিল। মসজিদগুলো তালাবদ্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও আল্লাহর বান্দারা দ্বীনের হিফাযত করেছেন। মাটির নিচের গোপন কক্ষে কিতাব সংরক্ষণ করেছেন। চীনে আমরা এক আশ্চর্য বিষয় দেখেছি। এক মাদরাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে ছোট ছোট বাচ্চাদের মাথায় পাগড়ি বাঁধা। বারো-তেরো বছরের বাচ্চা। প্রত্যেকের মাথায় পাগড়ি। আমি বললাম, মাশাআল্লাহ, খুব সুন্দর লাগছে দেখতে। বাচ্চাদের মাথায় এমনিতেও পাগড়ি খুব সুন্দর লাগে। মনে হচ্ছে সুন্নতের অনেক যত্ন রয়েছে এখানে। আপনারা কোত্থেকে এই রীতি চালু করলেন? মজমায় তো কেউ এর উত্তর দেয়নি। পরে একান্তে একজন ইমাম সাহেব বললেন, আসল কথা এই যে, কিছু দিন হল এখানে বাচ্চাদের ধর্মীয় শিক্ষার অনুমতি পাওয়া গেছে। কিন্তু এখনো আইন আছে যে, আঠারো বছরের নিচে কোনো বাচ্চাকে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া যাবে না। তাই আমরা বাচ্চাদের মাথায় পাগড়ি বেঁধে দিয়েছি। এতে বাচ্চাদের একটু বড় বয়সের মনে হয়। হঠাৎ যদি ইন্সপেকশন শুরু হয় তাহলে দূর থেকে দেখে যেন মনে হবে, এখানে সব বড় বাচ্চারা পড়ে। কোনো ছোট বাচ্চা নেই। এই ভাবে আল্লাহর বান্দারা দ্বীনকে হিফাযত করেছেন এবং এ যুগেও দ্বীনের জন্য কুরবানী দেওয়ার দৃষ্টান- স্থাপন করেছেন।
উযবেকিস্তানের এই সফরে যে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে তাতে আমাদের জন্য চিন্তার অনেকগুলি বিষয় রয়েছে। এক. আল্লাহ তাআলা আমাদের অসংখ্য নিয়ামত দান করেছেন। পরাধীনতার যুগ আমাদের উপর দিয়েও গিয়েছে। ইংরেজ শাসনামলে আমরাও পরাধীন ছিলাম, কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, তখনও নামাযের উপর, কুরআন মজীদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়নি। অথবা শুধু মুসলমান হওয়াই অপরাধ বলে গণ্য হয়নি। জুলুম-অত্যাচার আমাদের উপরও হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি আলহামদুলিল্লাহ। আর এখন আযাদীর পর তো আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। স্বাধীনতার নেয়ামত আল্লাহ আমাদের দান করেছেন। কিন্তু এই নেয়ামত পাওয়ার পর গাফলত, না-কদরী আমাদের পেয়ে বসেছে। আজো অনেকের মুখে শোনা যায় যে, ভাই! এই যুগে দ্বীনের উপর চলা বড় মুশকিল। আরে মুশকিল কী জিনিস তা তো তুমি দেখইনি! এটা তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, যারা শুধু এক ওয়াক্ত নামায পড়ার জন্য জান কুরবান করে দিয়েছেন। এই সফরে প্লেনে এক ব্যক্তির সাথে কথা হয়েছে, আন্দাজানের এক মসজিদের ইমাম, ফারগানার বাসিন্দা। তিনি বলেছেন, আমি এক জায়গায় আযান দিয়েছিলাম সেজন্য ছয় বছর জেল খাটতে হয়েছে। আজ তো কেউ আমাদের দিকে বন্দুকের নল উঁচিয়ে বলছে না যে, নামায পড়তে পারবে না। রোযা রাখতে পারবে না। বাচ্চাদের কুরআন শেখাতে পারবে না।
জায়গায় জায়গায় আলহামদুলিল্লাহ কুরআন মজীদের মকতব আছে। মাদরাসা আছে। আলেম-ওলামা আছে। বিনা বেতনে শিক্ষা দেওয়ার লোকও আছেন। ডেকে ডেকে বলা হচ্ছে, আমাদের এখানে আসুন, বাচ্চাদের ভর্তি করান। দ্বীনী ইলম শেখান। কিন্তু সেদিকে আমাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। বাচ্চা সামান্য পড়া-শোনার উপযুক্ত হলেই তাকে গিট-পিট (হাবি-জাবি) শেখাও। তাকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে, নার্সারীতে ভর্তি করাও। কুরআন মজীদ পড়ানোর দরকার নেই। ইসলামী শিক্ষা, দ্বীনী ইলম শেখানো সময়ের অপচয়মাত্র। (নাউযুবিল্লাহ!) যদি সেই আল্লাহর বান্দারা আমাদের অবস্থা দেখেন যারা নিজ সন্তানকে দ্বীনী ইলম শেখানোর জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, তাহলে তাদের সন্দেহ হবে যে, সত্যিই এরা মুসলমান কি না। তাই আমাদের চিন্তা করা উচিত যে, তারা কত কষ্ট-ক্লেশ ও উপায়-উপকরণহীনতার মাঝে ঈমানের হিফাযত করেছেন। পক্ষান্তরে এত নেয়ামত থাকা সত্ত্বেও আমাদের মাঝে কত অবহেলা ও গাফলত!
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে : আমার শ্রদ্ধেয় আব্বাজান রাহ. বলতেন, আজ যত ইসলামবিরোধী আন্দোলন, তাদের প্রথম টার্গেট উলামায়ে কেরাম। তারা মানুষকে বোঝায় ভাই! আমরা ইসলাম বিরোধী নই। ইসলাম তো অনেক ভালো জিনিস। কিন্তু এই মৌলভীরা ইসলামের নানা রকম ভুল ব্যাখ্যা করে একে অত্যন্ত খারাপ করে ফেলেছে। যত বাতিল ফেরকা, তাদের প্রথম টার্গেট আলেম সমপ্রদায়। আব্বাজান রাহ. বলতেন, এর কারণ হচ্ছে, যদি এক পাল ভেড়া রাস্তা দিয়ে যেতে থাকে আর নেকড়ে তার উপর আক্রমণ করতে চায় তাহলে তার প্রথম উদ্দেশ্য হয় রাখালকে শেষ করা। যখন রাখাল থাকবে না তখন ভেড়াগুলোকে খাওয়া সহজ হবে। আর যদি রাখাল জীবিত থাকে, তাহলে দু একটি ভেড়া কোনোভাবে খেতে পারলেও সে নিস্তার পাবে না। নেকড়েকে শেষ করে দিবে। তাই আব্বাজান রাহ. বলতেন, সকল ইসলাম বিরোধী বাতিল শক্তির প্রথম টার্গেট মৌলভীদের শেষ করে দেওয়া। এদের বদনাম করা। জনগণকে এদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। এদেরকে সমাজের নিচু শ্রেণীতে পরিণত করা। কেননা, আলেম-ওলামা তাদের পথের কাঁটা। এই কাঁটা সরিয়ে দিতে পারলে সাধারণ মানুষকে শিকার করা অত্যন্ত সহজ। যতক্ষণ এই মৌলভী বসা আছে, সে সবকিছুর উপর আপত্তি তুলবে। মতলব হাসিলে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। আর এরা এমন কঠিন প্রাণী যে, এদের উপর রাইফেল-মেশিনগানের গুলিও কোনো ক্রিয়া করে না। নির্বাসন এর উপর কোনো প্রভাব ফেলে না। অনাহার-অর্ধাহারের পরোয়া করে না। সকল প্রতিকূল অবস্থাতেও ক্বালাল্লাহ, ক্বালার রাসূল ছাড়তে রাজি নয়। তাই এদের খতম কর। যতক্ষণ এরা নিশ্চিহ্ন না হবে ততক্ষণ এই জাতি তোমাদের কব্জায় আসবে না। এটাই সকল বাতিলপন্থীর পলিসি। রাশিয়ার ওই ভূ-খণ্ডেও তা প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু দুনিয়া দেখেছে যে, সে অন্ধকার যুগে যে ব্যক্তি মোল্লার সাথে নিজেকে জুড়ে রেখেছিল তাকে আল্লাহ তাআলা হিফাযত করেছেন। তার ঈমান বেঁচে গিয়েছে। আর যে বিচ্ছিন্ন সে সয়লাবে ভেসে গেছে।
মরহুম ইকবাল যিনি আমাদের উর্দূ ভাষার প্রসিদ্ধ কবি। তাঁর অনেক কবিতাই প্রসিদ্ধ। মোল্লাদের বিরুদ্ধেও তার অনেক কবিতা আছে। মোল্লাদের সম্পর্কে ইংরেজরা তার মানসপটে যে চিত্র অঙ্কিত করেছিল তাতে তিনি ‘মোল্লার আযান’ ও ‘মুজাহিদের আযান’ ইত্যাদি লিখেছিলেন। তিনি এক কবিতায় অত্যন্ত মূল্যবান কথা বলেছেন। ইংরেজদের চিন্তা উন্মোচন করে তিনি বলেন,
‘‘যদি আফগানীদের মন থেকে দ্বীনী আত্মমর্যাদাবোধ বের করতে হয় তবে তার একমাত্র পথ হচ্ছে আফগানিস্তানের পর্বতরাজি থেকে মোল্লাদের বের করে দাও।’’ কারণ যতক্ষণ এরা থাকবে ততক্ষণ আফগানীদের অন্তর থেকে ঈমানের আলো নির্বাপিত হবে না। এই পলিসি ইংরেজদেরও ছিল। ইসলামের সকল দুশমনেরও একই পলিসি। কারণ সরাসরি ইসলামের বিরুদ্ধে হামলা করলে সাধারণ মানুষ তা বরদাশত করবে না। কেউ যদি বলে ভাই! ইসলাম ছেড়ে দাও, তাহলে সে যত বে আমলই হোক বলবে, নাউযুবিল্লাহ! মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়ে যাবে কিন্তু ইসলাম ছাড়তে রাজি হবে না। তাই তারা এই কৌশল অবলম্বন করে যে, মৌলভীদেরকে আস্থাহীন করে দাও, তাদের সম্পর্ক জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দাও, যখন এই মৌলভীরা থাকবে না, দ্বীনের কথা বলার লোক থাকবে না তখন মুসলমানদের গ্রাস করা সহজ হবে। আজ আমাদের সমাজে এটা রীতিমতো একটা আন্দোলনের রূপ ধারণ করেছে। আমার সম্মানিত পিতা অত্যন্ত সুন্দর বলতেন। লোকেরা বলত ভাই! মৌলভী একসময় অত্যন্ত ভালো সমপ্রদায় ছিল। কিন্তু আজ আর তেমন নেই। এরা এখন ধোঁকাবাজ হয়ে গিয়েছে। তাই আমরা এখন কোথায় যাব?
আল্লামা ইকবাল বলেন,
অর্থাৎ এই মৌলভী, দরবেশ, সুফীরা নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্য বিভিন্ন ধান্দা করে, তাই আমরা সাধারণ মানুষ কোথায় যাব? আমার শ্রদ্ধেয় আব্বাজান এর উত্তরে বলতেন, ভাই! যুগটাই হচ্ছে ভেজালের। খাঁটি কোনো জিনিস এখন পাওয়া যায় না। আমাদের দেশের অবস্থা দেখুন,
তেল, আটা, ঘি কোনো কিছুই খাঁটি পাওয়া যায় না, এমনকি কেউ কেউ বলে যে, খাঁটি বিষও পাওয়া যায় না। এক লোক ভেজাল খেতে খেতে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যা করার জন্য বিষ পান করল। এখন সে বিষ পান করে অপেক্ষা করছে যে, কখন মৃত্যু আসবে। কিন্তু মৃত্যু তো আসছে না। পরে বোঝা গেল যে, ওই বিষেও ভেজাল ছিল। কিন্তু তাই বলে কি আমরা সবকিছু ছেড়ে দিয়েছি। আমরা কি বলি, আটা খাঁটি পাওয়া যায় না তাই আটা খাব না, ভূষি খাব! ঘি-তেল খাঁটি পাওয়া যায় না তো গিরিস খাব। এমন তো কেউ বলে না; বরং তালাশ করে বের করে কোন দোকানে খাঁটি ঘি পাওয়া যায়। কোন দোকানে ভালো চিনি পাওয়া যায়। তাই সাইনবোর্ড লাগিয়ে বসে আছে, আর মানুষের প্রাণ, সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। কিন্তু কেউ বলে না যে, সব ডাক্তার ধোঁকাবাজ, সব ইঞ্জিনিয়ার ধোঁকাবাজ, সব উকিল ধোঁকাবাজ, পয়সা খাওয়ার লোক। তাই এদের পরিত্যাগ কর। এমন কেউ করে না। সকল ভেজাল সত্ত্বেও যে অনুসন্ধান করে, সে খাঁটি জিনিস খুঁজে বের করেই ফেলে। তাই আমার শ্রদ্ধেয় পিতা বলেন, আজো যদি কেউ সত্যিকারের তলব নিয়ে তালাশ করে, তাহলে সে আজো পাবে। এটা কুরআনের ওয়াদা। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা) হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।-সূরা তাওবা : ১১৯)
এই সত্যাবাদীদের দল কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। তবে অনুসন্ধানকারীর আগ্রহ দরকার। সামান্য মেহনত ও তালাশের প্রয়োজন। তাই এর কারণে পুরো গোষ্ঠীর ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করা আর তাদের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া এটা কোনোভাবেই ঠিক নয়।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরেকটি মূল্যবান কথা বলেছেন, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। তিনি বলেন, সমস্যা আরো আছে। তা হচ্ছে : আজ যখন কেউ পীর ও মুরশিদ তালাশ করে তো নিজের আমল-আখলাক যতই খারাপ হোক না কেন পীর চায় জুনাইদ বাগদাদী আর শিবলীর মতো। আবদুল কাদের জীলানী আসলে, শিবলী আসলে, জুনায়েদ বাগদাগী আসলে তাদের রাহনুমায়ী কবুল করব। অন্যথায় সাধারণ লোকাদের রাহনুমায়ী আমি কবুল করতে পারি না। এই ইবলিস আমাদের দেমাগে সওয়ার হয়ে আছে। আরে ভাই! সেই মাপের লোক এখন কোত্থেকে আসবে? আমার আব্বা বলতেন, ভাই! যেমন রূহ তেমন ফেরেশতা। যেমন মুরীদ তেমন তার পীর। জুনাইদ আর শিবলী না হোক, তুমি যে স্তরের সেই স্তরের পীর আজো আছে। আর আলহামদুলিল্লাহ এটাই তোমার জন্য যথেষ্ট।
এক ব্যক্তি তাকে বলেছিলেন যে, হযরত কী করব? কোনো দিকে মন নিশ্চিন্ত হয় না। যার দিকে দেখি তার কোনো না কোনো দোষ সামনে এসে যায়। মন তার দিকে আকৃষ্ট হয় না। তাই কী করব? কার কাছে যাব?
তিনি বলেন, এই চোখে না লাগার কারণ হচ্ছে চোখে অহংকারের ঠুলি দিয়ে রেখেছে। তুমি গিয়ে তোমার মসজিদের মুআযযিনের সংস্পর্শে থাক, তার দ্বারা তোমার ফায়দা হবে। কারণ মসজিদের মুআযযিন দিনে পাঁচবার আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তাই তুমি যখন পিপাসা নিয়ে যাবে তখন তার দ্বারাও তোমার ফায়দা হবে। কারণ দেওয়ার মালিক তো আল্লাহ তাআলা। আগেও কয়েকবার বলেছি যে, কোনো শায়খের ক্ষমতা নেই যে, কিছু দেবে। দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ। তাই যখন তুমি সত্যিকারের তলব নিয়ে এমন লোকের কাছে যাবে যার মধ্যে শরীয়তবিরোধী কোনো কিছু নেই, তোমার ফায়দা হবে। যদি অন্য কাউকে না পাওয়া যায় তখন মসজিদের মুআযযিনের সংস্পর্শে বস, তোমার উপকার হবে। বাস্তবিক পক্ষে এটা অনেক বড় একটি চক্রান্ত যে, উলামাদের উপর অভিযোগ উত্থাপন করে, ভাই! আমরা ইসলামের কোনো কিছু নেই, তোমার ফায়দা হবে। যদি অন্য কাউকে না পাওয়া যায় তখন মসজিদের মুআযযিনের সংস্পর্শে বস, তোমার উপকার হবে। বাস্তবিক পক্ষে এটা অনেক বড় একটি চক্রান্ত যে, উলামাদের উপর অভিযোগ উত্থাপন করে, ভাই! আমরা ইসলামের শত্রু নই, আমরা এই মৌলভীদের বিরোধিতা করি, যারা ইসলামকে ভুল বুঝিয়েছে। ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করেছে। এদের উপর আমাদের অভিযোগ। আল্লাহ তাআলা এই সম্প্রদায়কে মর্যাদা দান করেছেন যে, এদেরকে ইসলামের জন্য ঢাল বানিয়ে দিয়েছেন। শত্রুরা ইসলামের উপর অভিযোগ তুলতে চায়, কিন্তু যেহেতু ইসলামের উপর অভিযোগ উঠানোর সাহস হয় না তাই এই বেচারাদের উপর আপত্তি উঠায়। এই চক্রান্তের বিষফল যা আমি ইতিপূর্বে আপনাদের বলেছি যে, যারা এদের (উলামাদের) সাথে সম্পৃক্ত ছিল না তারা বে-দ্বীনীর সয়লাবে ভেসে গিয়েছে। আজ কালিমাও জানে না। তাই এই প্রোপাগাণ্ডায় কখনোই জড়ানো উচিত নয়।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলের হিফাযত করুন। আহলে হকের সাথে সর্বদা আমাদেরকে জুড়ে রাখুন এবং দ্বীন ও ঈমানের মূল্য বোঝার তাওফীক দান করুন। আমীন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন