Translate

রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৩

ভারত উপমহাদেশের নামধারী মাজার পন্থী সুন্নী ও অপরাপর সুন্নী গ্রুপের (দেওবন্দী, ও সৌদী ওহাবী)মাঝে বিদ্যমান মতপার্থক্যসমূহ

ভারত উপমহাদেশের নামধারী সুন্নী ও অপরাপর সুন্নী গ্রুপের (দেওবন্দী, সৌদী ওহাবী)মাঝে বিদ্যমান মতপার্থক্যসমূহ

ব্লগারের প্রোফাইল ছবি

ভারত উপমহাদেশের ইসলামী সুন্নী দলগুলো বৃহৎ তিনটি গ্রুপে বিভক্ত।   

    ১. আধ্যাত্মিকতা/তরীকত পন্থী ও মাযহাব মান্যকারী(পীর মাশায়েখদের দরবার সমূহ) (পীর সাহেবগণ ও দেওবন্দী ওলামায় কেরামগণ),      
২.

 আধ্যাত্মিকতা ও মাজহাবকে  স্বীকারকা রী  (জামাতে ইসলামী, ও মাজহাবকে অস্বীকারকারী  আহলে হাদীস, ও সৌদী সালাফী বা ওহাবীজম) 


 ৩. এ দুটি দলের বাহিরে আরেকটি ক্ষুদ্র গ্রুপ রয়েছে,
যারা নিজেদের নামকরণ করেছেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বা সুন্নী এবং তারা অপর দুটি গ্রপের প্রতিষ্ঠাতাদেরকে কাফের হিসেবে ফতোয়া দিয়েছেন। আমি এ পোষ্টে এই নামধারী সুন্নী ও অপর দুটি গ্রুপের মাঝে বিবাদমান কিছু এখতেলাফী মাসআলার বর্ণণা সম্বলীত কিছু নিবন্ধ একত্রে সংকলন করেছি মাত্র। পোষ্টটি একান্তই ইসলামের আভ্যন্তরীন বিষয়ক



কোরআন-হাদীসের আলোকে
সুন্নী (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত) ও নামধারী সুন্নী (রেজভী/বেদাতীদের) স্বরূপ বিশ্লেষণ

সুন্নী কারা :
সুন্নত শব্দ থেকে সুন্নী নামের উৎপত্তি। শরীয়তে তিনটি ক্ষেত্রে সুন্নত শব্দটি ব্যাবহৃত হয়। যথা :- 1. যে আমল বা কাজের মান ফরজ-ওয়াজিবের নিচে এবং নফল-মুস্তাহাবের ঊপরে। 2. হযরত রাসুলে পাক (স:) এর হাদীস। 3. আর সুন্নত শব্দের তৃতীয় অর্থ হচ্ছে তরীকা, মতাদর্শ, অনুসরণীয় পথ। (হাদীসের তত্ব ও ইতিহাস)। মূলত এই তিন নং অর্থকে কেন্দ্র করেই সুন্নী নামের উৎপত্তি। অর্থাৎ এক কথায় সুন্নী বা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত হল ঐ দল যারা রাসুলে পাক (স:) এর সুন্নত ও সাহাবায় কেরামের জামাতের অনুসরণ করে। নিম্নোক্ত হাদীসটি থেকে এ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত নামের উৎপত্তি। “ হযরদ রাসূলে আকরাম (স:) এরশাদ করেন, বনী ইস্রাইল (হযরত ইয়াকুব (আ:) এর পরবর্তী বংশধর) বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল। আর আমার উম্মত (মুসলমান) তিহাত্তর দলে বিভক্ত হবে। তন্মধ্যে একটি মাত্র দল ছাড়া বাকী বাহাত্তর দলই জাহান্নামী হবে। উপস্থিত সাহাবায় কেরাম (রা:) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (স:) ! এই বেহেশতি দলটি কারা ? উত্তরে রাসূলে পাক (স:) বললেন, যারা আমার ও আমার সাহাবায়ে কেরামের পথের অনুসরন কারী হবে। “(মেশকাত শরীফ: 1/30)।

এ হাদীসটিই হচ্ছে ’আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’ নামের উৎস। এ হাদীসে যে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ শব্দ রয়েছে, তা হচ্ছে- 1.সুন্নত আর 2. জামাত। অর্থাৎ রাসূল (স:) এর সুন্নত এবং সাহাবায় কেরাম (রা:) এর জামাতই হচ্ছে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত (সুন্নী) এর মাপকাঠি। মোটকথা মুসলমানদের তেয়াত্তর দলের মধ্যে বাহাত্তর দল বাতিল ও জাহান্নামী। আর একটি মাত্র দল হক বা বেহেশতী। আর এই সমস্ত বাতিল দল থেকে হক দলটি পরিচয় করার মাপকাঠি হচ্ছে দুটি বস্তু। সুন্নতে রাসূল (স:) ও জামাতে সাহাবা।

পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও উপরোক্ত হাদীস দ্বারা সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত যে, মুসলমানদের মধ্যে কোন্ দলগুলো বাতিল আর কোন দলটি হক, তা যাচাইয়ের মাপকাঠি হচ্ছে দুটি। একটি হচ্ছে রাসূলের (স:) সুন্নত আর অপরটি হচ্ছে সাহাবাগনের জামাত। এ দু’টি মাপকাঠি যাচাইয়ে যারা টিকবে, তারাই রাসূল (স:) এর ভাষায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত (সুন্নী) নামে অভিহিত হবে। এর অর্থ হচ্ছে সুন্নাতে রাসূল ও জামাতে সাহাবার অনুসারী। এজন্যই একমাত্র সুন্নাতে রাসূল (স:) ও জামাতে সাহাবা (রা:) কে বলা হয় সত্যের মাপকাঠি।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকায়েদ সম্পর্কীয় জ্ঞানকে বলা হয় ইলমে কালাম। ইমাম তাহাভী (র:) এর লিখিত কিতাব “আকিদাতুত্তাহাবিয়্যাহ” কালাম শাস্ত্রের নির্ভর যোগ্য গ্রন্থ। উক্ত কিতাবের শরাহ বা ব্যাখ্যা গ্রন্থ শরহে আকিদাতুত্তাহাবিয়্যাহতে লিখিত আছে : “মি’য়ারে হক বা সত্যের মাপকাঠি হচ্ছে দু’টি। একটি সুন্নত (অর্থাৎ সুন্নাতে রাসূল (স:) আর অপরটি তার সঠিক অনুসারী (অর্থাৎ জামাতে সাহাবা রা:)। এ দুটি মাপকাঠির কোন একটিকে বাদ দিয়ে শুধু অপরটি সত্যের মাপকাঠি হতে পারে না।”

উক্ত কিতাবে আরো উল্ল্যেখ আছে যে, “সুন্নাত ও তার অনুসারী জামাত পরস্পর এমনভাবে জড়িত যে, এর একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির অস্থিত্ব থাকতে পারে না। অর্থাৎ জামাতের দ্বারাই সুন্নত প্রতিষ্ঠিত, আর সুন্নতের সঠিক অনুসরনেই জামাত স্বীকৃত। সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মাপকাঠি শুধু সুন্নত অথবা শুধু জামাত হতে পারে না। বরং সুন্নাতে রাসূল ও জামাতে সাহাবার উভয়টাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের মাপকাঠি। এজন্যই দলটির নামকরণও করা হয়েছে রাসূল (স:) এর ভাষায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত।

অতএব মুসলমানদের মধ্যে যারা সুন্নাতে রাসূল (স:) ও জামাতে সাহাবার আর্দশে বিশ্বাসী, তারাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত বা সুন্নী। আর এ আদর্শ থেকে বিচ্যুতরাই বেদয়াতী বা গুমরাহ। সুতরাং সুন্নাতে রাসূল (স:) ও জামাতে সাহাবার আর্দশের রূপরেখাটা কি? সুন্নাতে রাসূল ও জামাত সাহাবার আদর্শ মোতাবেক ইসলামী আকীদা বিশ্বাস স্থাপন করাই হচ্ছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মূল ভিত্তি । আর এ আদশের্র মর্ম হচ্ছে পবিত্র কোরআন সুন্নাহর নিশ্চিত অকাট্য দলীল এবং তার সরল ব্যাখ্যা অবলম্বনে ইসলামী আকীদা পোষণ করা। পক্ষান্তরে এরুপ দলীল ও ব্যাখ্যার পরির্বতে কারো কোন ব্যক্তিগত যুক্তি-তর্ক অথবা কুরআন-সুন্নাহর গরল বা ভ্রান্ত ব্যাখ্যা অবলম্বনে ইসলামী আকীদা পোষণ করাই হচ্ছে বেদয়াতী বা গোমরাহী বা পথভ্রষ্টতা।

বর্তমানে আমাদের দেশের নামধারী সুন্নীদের পরিচয়:
বর্তমানে যারা নিজেদেরকে সুন্নী বলে পরিচয় দেয় আর অন্য সকল মুসলমানদেরকে ওহাবী/কাফের বলে বেড়ায় তারা মূলত সূন্নী নয় বরং তারা হল রেজভী বা ইংরেজ দালাল আহমদ রেযা খার অনুসারী। এরা ইংরেজদের দালালীর ঐতিহাসিক কুখ্যাতিকে সুন্নী নামের অন্তরালে ঢেকে রাখার অসৎ উদ্দেশ্যে নিজেদেরকে সুন্নী বলে প্রচার করে বেড়ায়। এরা ইংরেজের পক্ষের দালালীর কুখ্যাতিকে সমাজের চোখে আড়াল করে রাখার জন্য নিজেরা সুন্নী নামের মুখোশ ধারণ করে নিয়েছে। যদিও বর্তমানে এদেশে ইংরেজ শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের পক্ষে দালালী করার সেই পরিবেশ নেই, কিন্তু ধর্মীয় ব্যাপারে রেজভীরা এখন অতি সূক্ষ্ন চক্রান্তের মাধ্যমে ইংরেজদের পক্ষে দালালী করে যাচ্ছে।

উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হযরত রাসূলে পাক (স:) এর প্রতি তাদের লোক দেখানো অতিভক্তি প্রদর্শণ করতে গিয়ে রাসূলে পাক (স:) কে স্বয়ং ‍আল্লাহর জাতি নূর (মানি আল্লাহর স্বত্তার অংশ) আলেমুল গাইব, হাযির নাযির বলে প্রচার করে এবং রাসূল (স:) সর্ম্পকে এ সকল ভ্রান্ত আকীদা বিশ্বাস স্থাপন করাকে সুন্নী হওয়ার জন্য শর্ত হিসেবে আরোপ করে থাকে। শুধু তাই নয়, বরং যারা রাসূল (স:) সর্ম্পকে এ সকল ভ্রান্ত ধারনা রাখেনা, তাদেরকেই ওহাবী কাফের বলে প্রচারণা চালিয়ে সমাজে ফেরকাবাজীর বীজ বপন করে থাকে।

অথচ তাদের লোক দেখানো নবী-ভক্তিমূলক এ সকল নব উদ্ভাবিত আকীদা গুলো হচ্ছে শিরকী আকীদা। এসকল শিরকী আকীদা পোষন না করলেই যদি রেজভীদের ভাষায় ওহাবী কাফের হয়ে যায়, তাহলে রেজভীদের পূর্ব-পুরুষগণ সহ প্রায় দেড় হাজার বৎসরের মুসলিম উম্মাহকে কি বলতে হবে ? কারন তাদের কেউই তো রাসূল (স:) সর্ম্পকে এ সকল শিরকী আকীদা পোষণ করতেন না। আসল ব্যাপার হচ্ছে এ সকল শিরকী আকীদাকে সুন্নী আকীদা আখ্যা দিয়েই রেজভীরা ধর্মীয় ক্ষেত্রে আতি তীক্ষ্নভাবে ইংরেজদের দালালী করে যাচ্ছে। আমরা তাদের হাযির-নাযির ও আলিমুল গাইব এর শিরকী আকীদার বিরুদ্ধে ইসলামী আকীদা বিস্তারিত দলীল সহ পরবর্তীতে আলোচনা করব, তার আগে দেখে নেই যে, কিভাবে তারা এ শিরকী আকীদাগুলো দ্বারা মূলত এখনো ইংরেজদের দালালীই করে যাচ্ছে।


রাসূল(স:) খোদার জাতি (আল্লাহর নূরে সৃষ্টি) না মানুষ জাতি :
নূর শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে আলো। এ অর্থে আল্লাহর জাত বা সত্তা নূর হতে পারে না। বরং আল্লাহকে নূর বলা কুফরী। কারণ আলো হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্ট, আর তিনি হচ্ছেন স্রষ্টা ।এ মর্মে আল্লাহ পাক সূরায়ে আনয়ামের প্রথম আয়াতে বলেন : “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আসমান-যমীন এবং আলো-আধাঁর সৃষ্টি করেছেন।” এ আয়াতে সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অন্ধকারের বিপরীতার্থে যে আলো আছে, তা আল্লাহর সৃষ্ট। আর আল্লাহকে সৃষ্ট বলা কুফর তা বলারই অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং আল্লাহকে নূর বলা যে কুফর, তা সন্দেহাতীত ভাবেই প্রমানিত।

বাকী রইল যে আয়াতে আল্লাহকে নূর বলা হয়েছে সে আয়াতের মর্ম। যেমন সূরায়ে নূর এর 35 নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “ আল্লাহ আসমান-যমীনের নূর।” এখানে নূর শব্দকে তার পূর্বোক্ত আভিধানিক অর্থে নয়, বরং পবিত্র কুরআনের পারিভাষিক অর্থে বলা হয়েছে। ‍আর সে অর্থটি হচ্ছে হেদায়েত। অর্থাৎ আসমান-যমীনের বাসিন্দাদের হেদায়েত দানের প্রকৃত মালিক হচ্ছেন আল্লাহ। [ছহীহ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ফাতহুল বারী: 3/3]।

ছহীহ মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ শরহে নুবুভী 1/99 তে উল্লেখ আছে : ‘আল্লাহকে আভিধানিক অর্থে নূর বলা যাবে না। কারণ এ অর্থে নূরেরও আকৃতি আছে। অথচ আল্লাহ দেহ বা আকৃতির গন্ডী থেকে উর্দ্ধে। এটাই মুসলিম উম্মাহর সকল ইমামগণের মাযহাব। আর পবিত্র কুরআনে যে আয়াতে এবং যে সকল হাদীসে আল্লাহকে নূর বলা হয়েছে, এর অর্থ হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা, আসমান-যমীনের বাসিন্দাদের হেদায়েত দাতা এবং মুমিন বান্দাগণের অন্তর রৌশনকারী।

উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা পরিস্কার হয়ে গেল যে, আল্লাহর জাত বা সত্তাই নূর নয়। এমতাবস্থায় হযরত রাসূলে পাক (স:) আল্লাহর জাতি নূর বা আল্লাহর জাত বা সত্বাগত নূর হওয়ার তো কোন প্রশ্নই আসে না। তদুপরি একটু সময়ের জন্য ও যদি আল্লাহর জাত বা সত্ত্বাকে নূর বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলে রাসূল (স:) কে আল্লাহর জাতি নূর বলতে গেলে প্রশ্ন দাড়ায় যে, এর অর্থ কি রাসূল স্বয়ং আল্লাহর জাত বা সত্ত্বা ? যদি তাই হয়, তাহলে এর সুস্পষ্ট মর্ম দাঁড়ায় আল্লাহই রাসূল এবং রাসূলই আল্লাহ। আর এটা যে প্রকাশ্য ‍কুফর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর যদি বলা হয় রাসূল আল্লাহর জাতি নূর মানে হুবহু আল্লাহর সত্ত্বা নন, বরং তাঁর সত্ত্বার অংশ বিশেষ, তাহলে এর পরিস্কার মর্ম দাড়ায় আল্লাহর জাত বা সত্তায় রাসূল অংশীদার। অথচ এটা যে প্রকাশ্য শিরক তা বলাই বাহুল্য।

পক্ষান্তরে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং অগণিত হাদীসে পরিস্কার ভাষায় উল্লেখ রয়েছে যে, হযরত মুহাম্মদ (স:) সর্বশেষ নবী ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হওয়া সত্ত্বেও তিনি সহ সকল নবী রাসূলগণ মানুষ জাতি। এ মর্মে সূরা কাহফ এর 110 নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “হে রাসূল (স:) আপনি বলে দিন যে, তোমরা যেমন মানুষ আমিও মানুষ ছাড়া অন্য কিছু নই।” সূরায়ে বনী ইসরাঈল এর 93 নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “হে রাসূল (স:) আপনি বলে দিন যে, আমার প্রভু পবিত্র, আমি মানুষ রাসূল ছাড়া অন্য কিছু নই। ”

এছাড়া বিভিন্ন হাদীস এবং ইসলামের ইতিহাসে পরিস্কার ভাষায় বিবৃত হয়েছে যে, হযরত মুহাম্মদ (স:) জাতিগত ভাবে মানুষ, তার পিতা-মাতা উভয়েই মানুষ ছিলেন। সুতরাং তিনি মানুষের সন্তান মানুষ। এদিকে তৃত্ববাদী মুশরিক খৃষ্টানদের আকীদা বা ধর্ম বিশ্বাস হচ্ছে তাদের নবী যীশু (হযরত ঈসা আ:) খোদার পুত্র। অথচ যে ব্যাক্তি যার পুত্র বা সন্তান হয়, নি:সন্দেহে সে তারই জাতি বা সত্ত্বার অংশ ‍বিশেষ হয়। যেমন মানুষের সন্তান হয় মানুষ জাতি, পশুর সন্তান হয় পশু জাতি এবং জ্বিনের সন্তান হয় জ্বিন জাতি। মোটকথা ইংরেজরা হযরত ঈসা (আ:) কে খোদার পুত্র বলে দাবী করত: তাকে খোদার জাতিতে অংশীদার সাব্যস্ত করেছে। অথচ কুরআনে এ দাবীকে প্রকাশ্য কুফর এবং শিরক বলে ঘোষণা দে‍য়া হয়েছে । যেমন সূরায়ে মায়েদার 72 ও 73 নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “ যারা মরিয়ম পুত্র (হযরত ঈসা আ:) কে (খোদার পুত্র) খোদা বলেছে, তারা অবশ্যই কুফরী করেছে। অথচ মসীহ (আ:) বলেছেন হে বনী ইসরাঈলগণ! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, যিনি আমার এবং তোমাদের সকলের প্রভূ। বস্তুত: যারা আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করে আল্লাহ তাদের জন্য বেহেশত হারাম করেন। আর তাদের ঠিকানা জাহান্নাম এবং জালেমদের কোন সাহায্যকারী নেই।”সূরায় এখলাসে আল্লাহ বলেন, “হে রাসূল (স:) আপনি বলে দিন যে, আল্লাহ একক, আল্লাহ স্বনির্ভর। তিনি কারো জন্মদাতা পিতা নন এবং কারো সন্তানও নন। আর তার কোন সমকক্ষ নেই।”

অথচ রাসূলে কারীম (স:) কে আল্লাহর জাতি নূর বললে যে, তাকে আল্লার জাত বা সত্ত্বার সমকক্ষ করা হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়া পবিত্র কুরআনের আরও বহু আয়াত দ্বারা প্রমানিত যে, কাউকে আল্লাহর সন্তান বা আল্লাহর জাতি বলা প্রকাশ্য শিরক। তাই ইংরেজরা মুসলমানদের কাছে তাদের নবী যীশুকে আল্লাহর জাতি বা সত্ত্বা অথবা সত্ত্বার অংশ বিশেষ হওয়ার ভ্রান্ত দাবী প্রমাণ করতে পারেনি।

এহেন পরিস্থিতিতে রেজভীরা আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (স:) কে আল্লাহর জাতি বলে প্রচার করার অর্থ কি এই নয় যে, মুসলমানেরা যদি এ কুফরী এবং শিরকী কথাটা মেনে নেয় তাহলে ইংরেজরা বিশ্ব মুসলিমের সামনে এ চ্যালেঞ্জ নিয়ে দাঁড়াতে পারবে যে, হে মুসলমানগণ! মানব জাতিতে নবী মুহাম্মদ (স:) এর পিতা থাকা সত্ত্বেও যদি অযৌক্তিক ভাবেই তিনি আল্লাহর জাতি হতে পারেন, তাহলে আমাদের নবী যীশুর কোন পিতা মানব জাতিতে না থাকা অবস্থায় যুক্তি সঙ্গত ভাবেই (?) তিনি খোদার জাতি হতে পারবেন না কেন ? এই হচ্ছে রেজভীদের লোক দেখানো নবী ভক্তির নামে তাকে আল্লাহর জাতি নূর বলে প্রচারের মাধ্যমে ধর্মীয় ক্ষেত্রে ইংরেজদের পক্ষে দালালীর স্বরূপ।

উপরোক্ত আলোচনায় দেখা গেল রেজভীরা রসূলে পাক (স:) কে আল্লাহর জাতি নূর বলে প্রচার করার দ্বারা ইংরেজদের নবী যীশুকে খোদার জাতি প্রমাণ করার পথ সুগম করে দিচ্ছে । তদুপরী রাসূল (স:) কে আলিমুল গাইব ও হাজির নাজির বলে প্রচার করার মাধ্যমে তাকে আল্লাহর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গুণাবলীতে অংশীদার সাব্যস্ত করত: ইংরেজদের বাইবেলের আরেকটা শিরকী উক্তিকে সত্যরূপে প্রমাণ করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে । যেমন, মুহিউস সুন্নাহ হযরত মাও: সরফরায খান সাহেব তার তাবরীদুন নাওয়াযের কিতাবের 79 পৃষ্ঠায় বইবেলের উদ্ধুতি দিয়ে উল্যেখ করেছেন যে, ইংরেজরা তাদের বিকৃত বাইবেলে যীশুকে হাযির নাযির বলে দাবী করেছে। এবার রেজভীদের কথায় মুসলমানরা নিজেদের নবী হযরত মুহাম্মদ (স:) কে তাযীমের নামে হাযির নাযির বলে মেনে নিলে এ ব্যাপারেও ইংরেজরা সলমানদেরকে চ্যালেঞ্জ প্রদান করতে পারবে যে, তোমাদের নবী যদি তোমাদের ধর্মগ্রন্থ ‍কুরআনের স্বীকৃতি ছাড়াই হাযির নাযির প্রমাণিত হতে পারেন, তাহলে আমাদের যীশু আমাদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের স্বীকৃতি পেয়েও (?) হাযির নাযির হতে পারবেন না কেন ?
রেজভীদের নিকট আমাদের প্রশ্ন, নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আদম সন্তানের বাইরে না ভিতরে? যদি বলে বাইরে তবে তো তার সাথে কথা বলা অনর্থক। আর যদি বলে যে, তিনিও আদম সন্তানের মধ্যে গণ্য, তখন আমরা বলব আদম (আলাইহিস্ সালাম) কিসের তৈরী, নুরের না মাটির? যদি বলে ‘মাটির তৈরী’ আর এটা বলতে তারা বাধ্য- তাহলে তাদের নিকট প্রশ্নঃ মাটির তৈরী পিতার সন্তান কিভাবে নূরের তৈরী হল? তাদের নিকট আরেকটি প্রশ্নঃ আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মহান আল্লাহর নিম্ন বর্ণিত বাণীর বাইরে না ভিতরেঃ ‘এ মাটি থেকেই আমি তোমাদেরকে সৃজন করেছি, এতেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে দিব এবং পুনরায় এ থেকেই আমি তোমাদেরকে উত্থিত করব। (সূরা ত্বো-হা:৫৫)
যদি তারা স্বীকার করে যে, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)ও উক্ত আয়াতের আওতাভুক্ত তাহলে তো তারা স্বীকার করেই নিল যে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও মাটির তৈরী, আর তা স্বীকার করাই ঈমানের দাবী। আর যদি বলে যে, না তিনি উক্ত আয়াতের আওতাভুক্ত নন তবে তো তাদের সাথে আর কোন কথাই নেই। কারণ তারা কুরআন ও হাদীছ অস্বীকারকারী বলে গণ্য হবে, যার ফলে কুফরী ফতওয়ার শিকার হবে।
আসলেই পৃথিবীতে যত বিদআতী রয়েছে, তারা সকলেই স্থূল বিবেকের অধিকারী। তারা সকলেই কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সঠিক মর্মবাণী অনুধাবন করতে ব্যর্থ, তাই তাদের এ অবস্থা যে, তারা কুরআন ও হাদীছের বিরোধিতায় লিপ্ত রয়েছে। তারা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দেখেও আমল করে না। বরং ইহুদীদের মত তার বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে।
তাদেরকে আরেকটি প্রশ্নঃ নূরের তৈরী ব্যক্তির সন্তান-সন্তনি কিসের তৈরী? যেমন আমাদের নবী যদি নূরের তৈরী হন, তবে তার সন্তান-সন্ততি যেমন-ফাতেমা, যায়নাব, রুকাআইয়া, উম্মুকুলছুম এবং ক্বাসেম ও ইবরাহীম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) তাঁরা তাহলে কিসের তৈরী? তাদের যারা সন্তান যেমন ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনাহা)-এর সন্তান হাসান ও হুসাইন-তারা কিসের তৈরী?
যদি বলেঃ তারা মাটির তৈরী, নূরের তৈরী নন, তাহলে আমরা বলবঃ নূরের তৈরী ব্যক্তির সন্তান মাটির তৈরী কোন্ যুক্তিতে হবে? যিনি নূরের তৈরী হবেন (তার সন্তান-সন্ততি হলে)তার সন্তান-সন্ততিও নূরের তৈরী হবে এটাইতো স্বাভাবিক, তাহলে তারা নূরের তৈরী হলেন না কেন? আর যদি তারা বলে যে, নবীর মত তার সন্তান-সন্ততি যেমন-ফাতেমা, যায়নাব, রুকাআইয়া, উম্মুকুলছুম এবং ক্বাসেম ও ইবরাহীম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) তাঁরাও নূরের তৈরী! তাদের যারা সন্তান যেমন ফাতেমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর সন্তান হাসান ও হুসাইন-তাঁরাও নূরের তৈরী? যদি এমনটি তারা বলে তাহলে তো তাদের সঙ্গে আর কথাই নেই, কারণ তারা এমনই একটা কথা বলেছে যার মিথ্যাচারিতা ও ভিত্তিহীনতা একটা পাগলের নিকটও সুস্পষ্ট। ঐরূপ কথাতে বিবেকবান তো দূরের কথা পাগলরাই অট্টহাসি দিবে। কারণ একথা সর্বজন বিদিত যে বনী আদমের প্রজন্ম হিসাবে তাঁরাও সৃষ্টিগত দিক থেকে মাটির তৈরী।

(খ) ‘নবী সৃষ্টিগত দিক থেকে আমাদের মত মানুষ’ মর্মে হাদীছ থেকে প্রমাণঃ

১নং হাদীছঃ নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম) বলেনঃ তোমরা সকলেই আদমের সন্তান, আর আদম মাটি থেকে সৃষ্টি। (বায্ যার প্রভৃতি, হাদীছ ছহীহ, দ্রঃ ছহীহুল জামে’ হা/৪৫৬৮)।
২নং হাদীছঃ ‘তিনি আরো বলেনঃ আমি তো একজন মানুষ, আমিও তোমাদের মত ভুলে যাই, কাজেই আমি ভুলে গেলে আমাকে তোমরা স্মরণ করিয়ে দিবে। (বুখারী, ছালাত অধ্যায়, হা/৩৮৬, মুসলিম মসজিদ ও ছালাতের স্থান অধ্যায়, হা/৮৮৯)
৩নং হাদীছঃ ‘তিনি আরো বলেনঃ আমি তো একজন মানুষ, আমার নিকট বাদী আসে, সম্ভবত তোমাদের একজন অপর জন অপেক্ষা বেশি বাকপটু হবে, তাই আমি ধারণা করে নিতে পারি যে সে সত্য বলেছে কাজেই সে মতে আমি তার পক্ষে ফায়ছালা দিয়ে দিতে পারি। তাই আমি যদি তার জন্য কোন মুসলিমের হক ফায়ছালা হিসাবে দিয়ে থাকি, তাহলে সেটা একটা জাহান্নামের টুকরা মাত্র। অতএব সে তা গ্রহণ করুক বা বর্জন করুক। (বুখারী, মাযালিম অধ্যায়, হা/২২৭৮)।
‘মা আয়েশাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম) বাড়িতে থাকাকালীন কী কাজ করতেন? তদুত্তরে তিনি বলেছিলেনঃ তিনি তো অন্যান্য মানুষের মত একজন মানুষ ছিলেন। তিনি তার কাপড় সেলাই করতেন, নিজ বকরীর দুধ দোহন করতেন, নিজের সেবা নিজেই করতেন। (আহমাদ,হা/২৪৯৯৮, আল আদাবুল মুফরাদ প্রভৃতি, হাদীছ ছহীহ, দ্রঃ ছহীহুল আদাব আল্ মুফরাদ, হা/৪২০, মুখতাতাছার শামায়েলে তিরমিযী, হা/২৯৩, ছহীহাহ, হা/৬৭১)

*নবীকে যেসব দলীলের ভিত্তিতে বিদআতীরা নূরের সৃষ্টি প্রমাণ করতে চায় সেগুলি পর্যালোচনাসহ নিম্নে পরিবেশিত হলঃ বিদআতীরা নবীকে নূর প্রমাণ করতে যেয়ে দলীল স্বরূপ কুরআন থেকে কতিপয় আয়াত পেশ করে থাকে। যেমন,

মহান আল্লাহ এরশাদ করেনঃ ‘তোমাদের নিকট নূর-তথা একটি উজ্জ্বল জ্যোতি এবং স্পষ্ট কিতাব এসেছে। এর দ্বারা আল্লাহ যারা তার সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদেরকে নিরাপত্তার পথ প্রদর্শন করেন, এবং তাদেরকে স্বীয় নির্দেশ দ্বারা অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে আনয়ন করেন এবং সরল পথে পরিচালনা করেন’(সূরাহ আল্ মায়িদাহঃ ১৫-১৬)।
অত্র আয়াতে নবীর গুণ স্বরূপ তাকে নূর বা জ্যোতি বলা হয়েছে, সৃষ্টিগতভাবে তাকে নূরের তৈরী বলা হয়নি। আর কিভাবে তিনি গুণগতভাবে নূর বা জ্যোতি হলেন, তা সাথে সাথে আল্লাহ পরের আয়াতেই ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন। কাজেই একথা বলাই বাহুল্য যে, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম)সৃষ্টিগতভাবে নয়, বরং গুণগতভাবে ‘নূর’ (সৃষ্টিগতভাবে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম) আব্দুল্লাহ ও আমেনার ঔরষজাত সন্তান এটা কে না জানে? এমনকি বিদআতীরা রেজভীরা এই বাস্তব সত্যকে স্বীকার করে থাকে।
তবে যেহেতু তারা ‘নূর পার্টি’, তাই বলে থাকেঃ আব্দুল্লাহ ও আমেনার মিলনের মাধ্যমে তিনি আসেন নি, বরং আব্দুল্লাহর কপালে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম) নূর আকারে ছিলেন, তিনি আমেনাকে চুম্বন করলে সেই নূর তার উদরে চলে যায়। এভাবে নূর পার্টি রেজভীরা আরেকটা আজগুবি কথা বলে থাকে। ঐমর্মে তারা একটা লম্বা চওড়া কিচ্ছাও জনগণের সামনে মধুর সূরে কেরাত করে করে বলে থাকেন। অথচ কিচ্ছাটি যে মিথ্যা ও বানাওয়াট তা তারা বেমালুম ভুলে গেছে।

এভাবে মহান আল্লাহ নবীকে অন্যত্রে উজ্জ্বল প্রদীপ বলেও আখ্যা দিয়েছেন।
এরশাদ হচ্ছেঃ ‘হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি। এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে আহবায়করূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপরূপে। (সূরা আল্ আহযাব: ৪৫-৪৬)

নবীকে উক্ত আয়াতে যে মহান আল্লাহ গুণগত দিক থেকে নূর বা জ্যোতি বলেছেন তা অত্র আয়াতেই স্পষ্ট। নাকি বিদআতী রেজভীরা বলবে ‘উনি আসলেই সৃষ্টিগত দিক থেকে উজ্জ্বল চেরাগ ছিলেন’! তার থেকে আগুণ নিয়ে মানুষ নিজেদের রান্না-বান্নার কাজ করতেন, তাদের চুলায় আগুণ ধরাতেন, বাড়ির চেরাগ জ্বালাতেন…?

মহান আল্লাহ আল কুরআনকেও ‘নূর-জ্যোতি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
এরশাদ হচ্ছে: ‘অতএব তোমরা আল্লাহ তাঁর রাসূল এবং অবতীর্ণ নূরের প্রতি ঈমান আনয়ন কর। তোমরা যা কর, সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত। (সূরাহ আত্ তাগাবুন:৮)
অন্য সূরায় মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘সুতরাং যারা তাঁর (মুহাম্মাদ এর) উপর ঈমান এনেছে, তাঁকে সম্মান করেছে, সাহায্য করেছে এবং তার উপর যে নূর অবতীর্ণ করা হয়েছে তার অনুসরণ করেছে তারাই হল প্রকৃত সফলকাম। (সূরা আল্ আরাফ: ১৫৭)
উক্ত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ কুরআনকেও ‘নূর’ বলেছেন। জানিনা নূর পার্টি রেভীরা কুরআনের ক্ষেত্রে কী বলবে। নাকি বলবে কুরাআনও নূরের সৃষ্টি! অথচ কুরআন মহান আল্লাহর বাণী ইহাই সকল সুন্নী মুসলিমদের বিশ্বাস। কুরআনকে সৃষ্টবস্তু জ্ঞান করা স্পষ্ট কুফরী, এই জঘণ্য আক্বীদাহ সর্ব প্রথম ইসলামের ঘোরতর বিদআতী দল মুতাযিলারা অবলম্বন করে। আশা করি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এই বিদআতীরা ঐ বিদআতের সহমত হবে না। বরং তারাও বলবে যে, কুরআন আল্লাহর সৃষ্টি নয়, বরং তা আল্লাহর বাণী..।

অতএব, কুরআনকে নূর বলার পরও যদি নূরের সৃষ্টি না বলা হয়, তবে রাসূলকে নূরের সৃষ্টি কোন্ যুক্তিতে বলা হবে? কারণ মহান আল্লাহ নবীকে যেমন ‘নূর’ বলেছেন, ঠিক তেমনিভাবে পবিত্র আল কুরআনকেও ‘নূর’ বলেছেন। অতএব কুরআনে করীম সম্পর্কে নূর পার্টিদের যা উত্তর আমাদেরও ঠিক সেটিই উত্তর ‘নবী করীম’ সম্পর্কে। আল্লাহ সকল পথভ্রষ্টদেরকে হিদায়াত দান করুন-আমীন।
¬উল্লেখ্য, নূর পার্টিদের দলীলগুলি সবই এই পর্যায়ের, কুরআনের আয়াতের মন গড়া ব্যাখ্যা, আর হাদীছের নামে বানাওয়াট জাল হাদীছ হল তাদের সম্বল। যে সব ছহীহ হাদীছ তারা তাদের মতের পক্ষে পেশ করে থাকে তারা তার প্রকৃত ব্যাখ্যা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। গভীর দৃষ্টিতে দেখলে দিবালোকের ন্যায় প্রমাণ হবে যে, তাদের পেশকৃত ছহীহ হাদীছ তাদের মতের মোটেই সমর্থন করে না। বরং দাবীর সাথে দলীলের কোন মিল নেই।
মোট কথাঃ ‘নবী নূরের তৈরী’ মর্মে না কুরআনের আয়াত আছে, না নবীর ছহীহ হাদীছ আছে, নবীর নূর সংক্রান্ত যেসব হাদীছ নূর পাটিরা বলে থাকে তার সবগুলোই জাল এবং মিথ্যার ঝুলি। নূরপার্টিদের পূর্বসূরীরা ওগুলো নিজেরা তৈরী করে নবীর নামে, আল্লাহর নামে জুড়ে দিয়েছে। এ জন্যই এসব হাদীছের একটি হাদীছও হাদীছের নির্ভরযোগ্য কোন কিতাবে পাওয়া যায় না। ঐমর্মের হাদীছ গুলি জাল বিধায় জাল হাদীছের কিতাবেই পাওয়া যায়, আরো পাওয়া যায় ঐসব সীরাত গ্রন্থে যেগুলি গ্রন্থের লেখকগণ ঐসব বর্ণনা উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হয়েছেন, ওগুলির সত্যাসত্যের দায়-দায়িত্ব মোটেই গ্রহণ করেন নি, এ দিক থেকে তাদেরকে সাংবাদিকদের সাথে তুলনা করা যায়। এ সব জাল হাদীছ গ্রন্থ এবং অনির্ভরযোগ্য সীরাত গ্রন্থ থেকেই নূর পার্টিরা ঐ হাদীছ গুলি গ্রহণ করেছে।

হাযির নাযির এর ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত ও বেদাতী রেজভীদের আকীদার বিবরন :
হাযির অর্থ উপস্থিত আর নাযির অর্থ যিনি দেখেন। এ দু’শব্দের মিলিত অর্থ এমন এক সত্ত্বা, যার অস্তিত্ব একই সময়ে সহবস্থানে বিরাজমান এবং একই সময়ে সৃষ্টির প্রতিটি বস্তুর অণু-পরমাণু তাঁর নিকট দৃশ্যমান। এ অর্থে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ হাযির-নাযির নন।

কুরআনের ভাষায় আল্লাহ হাযির-নাযির :
“ তিনি জানেন যা কিছু ভূমিতে প্রবেশ করে ও যা কিছু তা হতে বের হয় এবং আকাশ হতে যা কিছু নামে ও আকাশে যা কিছু উঠে। তোমরা যেখানেই থাকনা কেন, তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তা দেখেন।” (সূরা হাদীদ : 4)

আমিই মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার আত্মা তাকে যে কুমন্ত্রণা দেয় তা আমি জানি । আমি তার ঘাড়ের রগ আপেক্ষাও নিকটতর। ” (সূরা কাফ: 16)।

আমার বান্দাহগণ যখন আমার সম্বন্ধে আপনাকে প্রশ্ন করে, আমিতো নিকটেই। ” (সূরা বাকারা : 186)।

আল্লাহর শ্রবণ ও দর্শন :
হযরত আয়েশা (রা:) বলেন, সব প্রশংসা সেই সত্তার যার কান সব আওয়াজ শুনে থাকে। ঝগড়াকারিনী ‘খাওলা’ রাসূলুল্লাহ (স:) এর কাছে এল। সে ঘরের এক কোনে বসে তাঁর সাথে কথা বলছিল। আমি তার কথা শুনতে পাইনি। আল্লাহ তা’য়ালা সাত আসমানের উপর হতে তার কথা শুনলেন এবং এ আয়াত নাযিল করলেন : “ হে রাসূল! আল্লাহ শুনেছেন সেই নারীর কথা যে তার স্বামীর বিষয়ে আপনার সাথে বদানুবাদ করছে এবং আল্লাহর নিকট ফরিয়াদও করছে আল্লাহে তোমাদের কথোপকথন শুনেন; আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। ” (সূরা মুজাদালা : 1)

আমরা জানি যে দু’জাহানের সর্দার মহাবিশ্বের রহমত রাসূলুল্লাহ (স:) মদীনা শরীফে রওযা পাকে জীবিত অবস্থায় শুয়ে আছেন। তাই নবী-প্রেমিকগণ মদীনা শরীফে উপস্থিত হয়ে রওযা পাকের কাছে দাঁডিয়ে নবীজীকে দরুদ ও সালাম জানাতে ব্যাকুল থাকেন । নবী (স:) বলেন, যে ব্যাক্তি আমার কবরের পাশে দরুদ পাঠ করে, আমি তা নিজ কানে শুনতে পাই। আর যে ব্যাক্তি দূর হতে দরুদ পাঠ করে আমার কাছে তা পৌছিয়ে দেয়া হয় (মেশকাত শরীফ)। অর্থাৎ আমি সর্বত্র হাযির-নাযির নই বলে দূর থেকে প্রেরিত দরূদ সরাসরি শুনতে পাই না । নবী (স:) কে সর্বত্র হাযির-নাযির মনে করা শরীযতসম্মত তো নয়ই বরং সুস্থ বিবেকসম্মতও নয়। এটা আল্লাহ তা’য়ালার একক গুণ। আল্লাহর একক গুণের সাথে কাউকে শরীক করলে সেটা হবে শিরক। শিরক গানাহর ক্ষমা নেই। আল্লাহ বলেন : “ আল্লাহ তার শরীক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যে কেউ আল্লাহর শরীক করে সে এক মহাপাপ করে। (সূরা নিসা : 48)।

আল্লাহ সর্বত্র হাযির অথচ অতীতকালে বহু ঘটনার স্থলে নবী করীম (স:) হাযির ও নাযির ছিলেন না। যেমন আল্লাহ বলেন- “এটা গাযেবের খবর যা আপনাকে আমি ওহী দ্বারা অবহিত করছি। আপনি তো তাদের (ইউসুফের ভাইদের) সাথে ছিলেন না যখন তারা (ইউসুফকে কূপে নিক্ষেপ করার ষড়যন্ত্রমূলক কাজে) মতৈক্যে পৌঁছেছিল এবং (পিতা ইয়াকুবকে ফাজি দেবার জন্য রকমারী) চক্রান্ত করেছিল।” (সূরা ইউসুফ : 102)।

“ এ সব গায়েবের খবর আমি আপনাকে ওহী দ্বারা অবহিত করছি যা এর আগে আপনি জানতেন না এবং আপনার জাতিও জানত না। সুতরাং ধৈর্য ধারণ করুন, শুভ পরিণাম মুত্তাকীদেরই জন্যে। ” (সূরা হুদ : 49)

হযরত মরিয়াম (আ:) এর লালন-পালনের ভার কে গ্রহণ করবে এ বিয়য়ে যখন তীর চালনা হচ্ছিল তখন নবী (স:) সেখানে হাযির ছিলেন না এবং ঐ ঘটনার দর্শকও ছিলেন না। আল্লাহ বলেন- “ এটা গায়েবের খবর যা আপনাকে আমি ওহী দ্বারা অবহিত করছি। মরিয়ামের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তাদের মধ্যে কে গ্রহণ করবে এ জন্য যখন তারা তাদের কলম (লেখনী বা তীর) নিক্ষেপ করছিল আপনি তখন তাদের নিকট ছিলেন না এবং তারা যখন (এ বিষয়ে) বদানুবাদ করছিল তখনও আপনি তাদের নিকট ছিলেন না।(সূরা আল-ইমরান : 44)।
অনুরূপভাবে আল্লাহ বলেন- “ মুসাকে যখন আমি বিধান দিয়েছিলাম তখন আপনি (তূর এর) পশ্চিম পান্তে হাযির ছিলেন না। ( সূরা কাসাস : 44)।
এমনকি ঐ যমানায় সংঘটিত ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীও ছিলেন না, যেমন- “ এবং আপনি প্রত্যক্ষদর্শীও ছিলেন না। ” (সূরা কাসাস : 44)
তিনি ঐ সব উল্লিখিত সময়ে ও ঘটনাস্থলে হাযির-নাযির ছিলেন না বলেই ঐ সব বিবরণকে আল্লাহ তা’য়ালা “আম্বাউল গায়েব” বা গায়েবের খবর বলেছেন।

রেজভীরা বলে নবী হাযির নাযির। তিনি কি দুনিয়ার জন্য হাযির-নাযির না ঊর্দ্ধ জগতের জন্যও হাযির-নাযির ? যদি ঊর্দ্ধ জগতের জন্যও হাযির-নাযির হয়ে থাকেন তবে জিব্রাইল (আ:) কুরআন নিয়ে রাসূলুল্লাহ (স:) এর নিকট আসতেন না। কেননা, কুরআন সংরক্ষণের স্থান-লওহে মাহফুজে হাযির-নাযির অবস্থায় সম্পূর্ণ কোরআন দেখে নিতে পারতেন। অথচ একবার কিছু দিনের জন্য কুরআন নাযিল বন্ধ হয়ে গেলে তিনি এমন অস্থির হয়ে পড়েন যে, কোন কোন সময় মনে করতেন পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়েন। নাযির হলে তো এমন অস্থির হতেন না। লওহে মাহফুজে সংরক্ষিত কুরআন দেখেই নিতেন এবং নাযিলের পূর্বেই বলে দিতে পারতেন।

হাযির-নাযিরের অপব্যাখ্যা :

বেদাতী রেজভীরা হাযির-নাযিরের অপব্যাখ্যায় কুরআন মাজীদের কতিপয় আয়াত পেশ করে থাকে। যেমন- “ এবং তোমাদের মধ্যে তার রাসূল রয়েছেন। ” (সূরা আল-ইমরান: 101)
“ আল্লাহ এমন নন যে, আপনি তাদের মধ্যে থাকবেন আর তিনি তাদেরকে শাস্তি দিবেন। ” (সূরা আনফাল-33)
“ তোমরা জেনে রাখ যে, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছেন। ” (সূরা হুজরাত : 7)

এ সব কুরআনী আয়াতাংশের অপব্যাখ্যায় রাসূলুল্লাহ (স:) এব সর্ব সময় সর্বত্র হাযির-নাযির থাকার কথা তারা প্রমাণ করার অপচেষ্টা করেন। তাফসীরে ইবনে কাসীর গন্থে “ এবং তোমাদের মধ্যে তার রাসূল রয়েছেন” আয়াতের ব্যাখ্যায় একখানা হাদীসের উল্ল্যেখ আছে এভাবে- নবী করীম (স:) একদিন সাহাবায় কেরামকে জিঞ্জেস করলেন, “ তোমাদের মধ্যে উঁচু পর্যায়ের ঈমানদার কে আছ ? ” তারা ফেরেস্তাদের কথা বললেন, রাসূলুল্লাহ (স:) বললেন, “ তাদের ঈমান থাকবে না কেন ? তারাতো নিজেরাই আল্লাহ তা’য়ালার ওহীকৃত খবরের বাহক।” সাহাবায় কেরাম নিজেদের কথা উল্ল্যেখ করলে রাসূলুল্লাহ (স:) বললেন, “ তোমরাই বা ঈমানদার হবে না কেন ? তোমাদের মধ্যে স্বয়ং আমি হাযির আছি।” তখন সাহাবায় কেরামের অনুরোধে রাসূলুল্লাহ (স:) বললেন, “ সবার মধ্যে উঁচু পর্যায়ের ঈমানদার ঐ সব লোক, যারা পরবর্তী যুগে আসবে। আর তারা দ্বীনের বিধি-বিধানের যা কিছু কিতাবে লিখিত আকারে পাবে তার উপরই পুরোপুরি ঈমন আনবে।” কাজেই “ ঈমান বিল গায়েব আফজাল হায়” এ হাদীসকে সত্য সাব্যস্ত করা হলে রাসূলুল্লাহ (স:) কে তার ইন্তিকালের পর সর্বত্র সর্বদাই হাযির-নাযির ধারণ করা কোনক্রমেই শরীয়ত সম্মত নয়। অন্যথায় ইবনে কাসীর বর্ণীত হাদীস ও উক্ত আয়াতের মধ্যে বিরোধ এসে যায়।

এ সব আয়াত যে সাহাবায় কেরামকে লক্ষ্য করে নাযিল হয়েছে তার প্রমাণ নিম্নের আয়াতে পাওয়া যায়- “ তোমরা জেনে রাখ যে, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছেন। তিনি বহু বিষয়ে তোমাদের কথা শুনলে তোমরাই কষ্ট পেতে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের নিকট ঈমানকে প্রিয় করেছেন। কুফরী, পাপাচার ও অবাধ্যতাকে কেরেছেন তোমাদের নিকট অপ্রিয়, তারাই সৎ পথ অবলম্বনকারী।”

একটি বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে এর আগের আয়াত (49:6) নাযিল হয়। ঘটনাটি ছিল এরুপ যে, বনী মুস্তালিক গোত্রের সর্দার উম্মুল মু’মিনীন হযরত জুয়াইবিয়া (রা:) এর পিতা হারিস ইবনে যিরার বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (স:) এর খেদমতে হাযির হলে তিনি আমাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং যাকাত প্রদানের আদেশ দিলেন। আমি ইসলাম কবুল করলাম। আমি বললাম, আমি ফিরে গিয়ে আমার গোত্রের লোকদের ইসলামের দাওয়াত দিব। এবং যাকাত প্রদানের কথা বলব। যারা আমার কথা মানবে এবং যাকাত দিবে আমি তাদের যাকাত একত্র করে আমার নিকট রেখে দিব। আপনি অমুক মাসের অমুক তারিখ পর্যন্ত কোন দূত আমার কাছে পাঠাবেন, যেন আমি যাকাতের ‍আদায়কৃত অর্থ তার হাত তুলে দিতে পারি। এরপর হারিস (রা:) যখন যাকাতের অর্থ জমা করলেন এবং নির্ধারিত মাস ও তারিখ অতিক্রান্ত হবার পরও কোন দূত এল না তখন হারিস (রা:) আশংকা করলেন যে, সম্ভবত কোন কারনে রাসূল (স:) আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। নতুবা দূত না পাঠাবার কোন কারণ থাকতে পারে না। হযরত হারিসের আশংকার কথা ইসলাম গ্রহণকারী গোত্রের নেতৃস্থানীয় লোকদের নিকট প্রকাশ করলেন। সবাই মিলে রাসূলুল্লাহ (স:) এর খিদমতে হাযির হওয়ার ইচ্ছা করলেন।

ওদিকে রাসূলুল্লাহ (স:) নির্ধারিত তারিখে ওয়ালীদ ইবনে উকবা (রা:) কে যাকাত গ্রহনের জন্য পাঠিয়েছিলেন। পথিমধ্যে ওয়ালীদ (রা:) এর মনে এ ধারনা জাগল যে, এ গোত্রের সাথে তার পুরাতন শত্রুতা আছে। কোথাও তারা তাকে হত্যা না করে ফেলে। এ চিন্তা করে তিনি সেখান হতেই ফিরে আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (স:) কে বললেন- তারা যাকাত দিতে অস্বীকার করেছে এবং আমাকে হত্যা করারও ইচ্ছা করেছে । তার কথায় রাসূল (স:) রাগান্বিত হয়ে খালীদ বিন ওয়ালীদ (রা:) এর নেতৃত্বে তাদের বিরুদ্ধে এক দল মুজাহিদ পাঠালেন। একদিকে মুজাহিদ বাহিনী রওয়ানা হল অন্যদিকে হারিস (র:) তার সাথীদের নিয়ে রাসূল (স:) এর খিদমতে হাযির হবার জন্যে বের হলেন। মদীনার অদূরে উভয় দল মুখোমুখি হলেন। মুজাহিদ বাহিনীকে হারিস (রা:) জিঞ্জাসা করলেন, আপনারা কোন গোত্রের প্রতি প্রেরিত হয়েছেন ? উত্তর হলো- আমরা তোমাদের প্রতিই প্রেরিত হয়েছি। হারিস (রা:) কারণ জিঞ্জাসা করলে তাকে ওয়ালীদ ইবনে উকবা (রা:)-কে প্রেরণ ও তার প্রত্যাবর্নের কাহিনী শুনানো হল। তাদেরকে এ কথাও শুনানো হল যে, তারা যাকাত দিতে অস্বীকার করেছে এবং ওয়ালীদ ইবনে উকবাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছে। হারিস (র:) বললেন, সেই আল্লাহর কসম, যিনি মুহাম্মদ (স:) কে সত্য রাসূল করে পাঠিয়েছেন। আমি ওয়ালীদ ইবনে উকবাকে দেখিনি এবং সে আমার কোছে যায়ওনি। এরপর হারিস (রা:) রাসূলুল্লাহ (স:) এর খিদমতে হাযির হলে তিনি জিঞ্জাসা করলেন, তুমি কি যাকাত দিতে অস্বীকার করেছ ? তুমি কি আমার দূতকে হত্যা করতে চেয়েছ ? হারিস (র:) বললেন, কখনোই নয়। সেই আল্লাহর কসম , যিনি আপনাকে সত্য পয়গামসহ পাঠিয়েছেন, সে আমার নিকট যায়নি এবং আমি তাকে দেখিনি। নির্ধারিত তারিখে আপনার দূত যায়নি দেখে আমার আশংকা হল যে, বোধহয় কোন ত্রুটির কারনে আপনি আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তাই আমরা আপনার খিদমতে হাযির হয়েছি। হারিস (র:) বলেন, এ ঘটনার প্রেক্ষিতে হুজরাতের উক্ত আয়াত নাযিল হয়। আর এ ঘটনার প্রেক্ষিতেই আল্লাহ পাক বলেন- “ তোমরা জেনে রেখ তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছেন। তিনি বহু েবিষয়ে তোমাদের কথা শুনলে তোমরাই কষ্ট পেতে। ”

এ ঘটনায় একটা কথা দিবালকের মত প্রকাশ পায় যে, তিনি ‘আমিমুল গায়েব’ ছিলেন না এবং এ ঘটনার স্থলে হাযির ও ছিলেন না।
রেজভীরা বলে, ‘“ তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছেন“ অর্থ রাসূলুল্লাহ (স:) আমাদের মধ্যে রয়েছেন, তাদের এ ধরনের কথায় খলীল পাগলার কথা মনে পড়ে যায়। একদিন খলিল পাগলা নেকড়ায় জড়ানো বহু পরতের ভিতর থেকে কিছু পয়সা বের করে আমোদের বলল, গুণে দেখুন কত পয়সা। আমরা গুনে বললাম 70 পয়সা। খলীল পাগলা সাথে সাথে বলে উঠল, “মিলে গেছে , মিলে গেছে”। কি যে মিলে গেছে তা সেদিন বুঝিনি। আজও বুঝিনা।

হাযির নাযির এ বিশ্বাসী রেজভীরা খলীল পাগলার মতই এক তরফা বলেন, আয়াত মিলে গেছে। রাসূল (স:) তো আমাদের মধ্যেই আছেন। খলীল পাগলা নামায পড়ত। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করতাম। আর খলীল পাগলা শহীদ মনারের উপর দাড়িয়ে পূর্ব দিকে মুখ করে একাকী নামায আদায় করত। সে বলত, তার নামাজই শুদ্ধ তরীকায় আদায় হয়। আমরা তার সাথে তর্ক করতাম না। কারন পাগলের সাথে বাহাস করা পাগলামী ছাড়া আর কিছুই নয়। পাগল কুরআন-হাদীসের ধার ধারে না।
তদ্রুপ রেজভীরা মনগড়া কিয়াসী উপমার আশ্রয় নিয়ে শিরক বেদআত বিশেষ করে রাসূলুল্লাহ (স:) কে হাযির-নাযির ও আলিমুল গাইব প্রতিপন্ন করার অপব্যাখ্যায় লিপ্ত। তারা নিত্য-নতুন বিদআত প্রচলনের মাধ্যমে কামাই রোজগারের সুবিধা হাসিল করে চলেছে। এতে কার ঈমান থাকল আর কার ইমানই বা ধ্বংস হল এ চিন্তা তাদের নেই।

রেজভীরা হাযীর-নাযিরের দলীল পেশ করে যে আয়াতের মাধ্যমে তা হল- “ হে নবী! আমি তো আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে” (সূরা আহযাব : 45)

তারা বলে, যেহেতু রাসূলুল্লাহ (স:) কে সাক্ষী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে তাই তার জন্য সর্বত্র হাজির-নাযির থাকা অপরিহার্য। তা না হলে তিনি কি করে সাক্ষী দিবেন। সাক্ষীর জন্য চাক্ষুস দেখা শর্ত। তাদের অবগতির জন্য আমরা নিম্নের আয়াত পেশ করছি। আল্লাহ পাক বলেন, “ এভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি, যাতি তোমরা মানব জাতির জন্য সাক্ষী স্বরূপ এবং রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষী স্বরূপ হবেন। ” (সূরা বাকারা : 143)

এ হিসাবে উম্মতী মুহাম্মাদী সবাইকে পূর্বকর্তী যামানায় সংঘটিত নবী-রাসূলদের ঘটনাস্থলে হাযির-নাযির বলে মেনে নিতে হয়। তা না হলে অদেখা বিষয়ে সাক্ষ্যদান গ্রহণ হওয়ার কথা নয়। উক্ত আয়াত অনুযায়ী সাক্ষ্য দানের জন্য আমাদের পুরোনো ঘটনায় সরে যমীনে হাযির-নাযির না থাকার কারণ ও কৈফিয়ৎ কি ? তাহলে একই ফর্মূলা অনুযায়ী শাহীদ বা শুহাদা হিসেবে আমরাও সব সময় সব স্থানে হাযির-নাযির সাব্যস্ত হয়ে যাই। (নাউযুবিল্লাহ)। এরূপ ধরণা করা নিরেট মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। একমাত্র কুদরত ক্ষমতাসম্পন্ন আল্লাহ তায়ালাই সর্বকালে সর্বস্থানে সর্বদর্শী। সাক্ষ্যদানের জন্য রাসূলুল্লাহ (স:) কে সর্বদা সর্বত্রই হাযির-নাযির সাব্যস্ত করতে যাওয়া প্রলাপোক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। সুমহান আল্লাহর নিয়জিত ফোরেশতা মারফত এই আখেরী উম্মতের আমলনামা রাসূলুল্লাহ (স:) এর রওযা মুবারকে পেশ করা হয় বলেই হাশর ময়দানে তিনি তার উম্মতের সাক্ষ্যদাতা হবেন। চাক্ষুষ না দেখেও আমরা প্রতিদিনের আযান ইকামতে সাক্ষী দিচ্ছি-আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মাবূদ নেই এবং মুহাম্মদ (স:) আল্লাহর রাসূল। আসলে ঈমান একিনের পর্যায়ে কোন কিছুর উপরে দৃঢ় বিশ্বাস রাখলেই সাক্ষ্যদাতা-শাহীদ হওয়া যায়।

রেজভীরা মূর্খতার কারনে নবী করীম (স:) এর হাযির-নাযির এর পক্ষে তাশাহহুদে পঠিত ‘আসসালামুআলাইকা আইউহান নাবিয়্যু’ “হে নবী আপনাকে সালাম” এ দলীল পেশ করে থাকে। তারা জানে না যে, নবী করীম (স:) কে আল্লাহ প্রদত্ত্ব সালামেরই আমরা অনুসরণ করে মিরাজের ঘোষণা করছি প্রতি নামাযের প্রতি বৈঠকে। কুরআন সম্বন্ধে জ্ঞান না থাকার কারনে তারা আবার এ দলীল পেশ করেন- “ (হে নবী! )আপনি কি দেখেননি আপনার রব হস্তী অধিপতিদের প্রতি কি করেছেন ? (সূরা ফীল : 1)
আমরা বলি এ ফর্মূলা অনুযায়ী কুরআনে মক্কার কাফেরদেরকে তাদের পূর্ববর্তী ঘটনা দেখার কথা বলেছেন। যেমন- “ তারা (কাফেরগণ) কি দেখে না তাদের পূবে কত মানব গোষ্ঠিকে আমি ধ্বংস করেছি, যারা তাদের মাঝে ফিরে আসবে না। ” (সূরা ইয়াসীন: 31)। তাহলেতো মক্কার কাফেরদেরকেও হাযির নাযির বলতে হয়!

কবরে মৃত ব্যাক্তিকে নবী করীম (স:) কে দেখানো হবে (মূলত মৃত ব্যাক্তিকে জিজ্ঞেস করা হবে, এই ব্যক্তি কে যিনি তোমাদের মধ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন) বলে রেজভীরা বলে, একই সময়ে বহু কবরে যদি রাসূলুল্লাহ (স:)- কে দেখানো যেতে পারে তবে তিনি কেন সদাসর্বদা সর্বত্র হাযির-নাযির থাকবেন না ? কবরে নবী করীম (স:) এর ছবি দেখানো হবে কোন সহীহ হাদিসে নেই। হাদীসে আছে কবরে মৃত ব্যাক্তি মু’মিন হলে বলবে, তিনি আল্লাহর রাসূল। আর কাফির হলে বলবে, হায়! হায়! আমি জানি না। কবরে নবী করীম (স:) কে দেখানো হলেও তিনি এ বিষয়ে অবগত হবেন না। যেমন একবার মসজিদে নববীর এক খাদিম রাতে ইন্তেকাল করলে সাহাবীগণ নবী করীম (স:) কে কষ্ট প্রদান না করার উদ্দেশ্যে তাকে না জানিয়ে সেই খাদিমের লাশ রাতেই দাফন করলেন। পরদিন তিনি অবগত হয়ে বললেন, “ তোমরা আমাকে কেন সংবাদ দাওনি ?” এরপর তিনি তার কবরে গিয়ে দু’আ করেন। কবরে যদি তিনি তাকে দেখতেন তবে তার সম্বদ্ধে জিজ্ঞাসা করতেন না। এটা তাদের নির্বুদ্ধিতামূলক দলীল। কারণ এক এক জগতের এক এক হুকুম। আলমে আরওয়াহ, আলমে দুনিয়াহ, আলমে বরযখ, আলমে আখিরাতের মধ্যে কোনও সাদৃশ্য নেই। আলমে দুনিয়ায় নামায, রোযা ফরয। অন্যান্য আলমে এগুলো ফরয নয়। এরূপ তুলনাকে অসাদৃশ্যমূলক তুলনা বলে।

এখন আমরা কুরআনের একখানি আয়াত পেশ করছি। কুরআনের অন্য কোন আয়াত দ্বারা কিয়ামত পর্যন্ত এর জওয়াব দানের জন্য আমরা রেজভীদের আহ্বান জানাই। আল্লাহ পাক বলেন- “ আপনিকি অনুধাবন করেননা আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে আল্লাহ তা জানেন। তিন ব্যাক্তির মধ্যে এমন কোন গোপন পরামর্শ হয় না যাতে তিনি চতুর্থজন হিসেবে উপস্থিত না থাকেন এবং পাঁচ ব্যাক্তির মধ্যে এমন কোন গোপন পরামর্শ হয় না যাতে ষষ্ঠজন হিসেবে তিনি উপস্থিত থাকেন না। তারা এতদপেক্ষা কম হোক আর বেশি হোক; তারা যেখানেই থাকুকনা কেন আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন। ” (সূরা মুজাদালা : 7)

নবী করীম (স:) যদি হাযির-নাযির হতেন তবে উক্ত আয়াতে তিন ব্যাক্তির মধ্যে গোপন পরামর্শে আল্লাহর সাথে নবী (স:) কে হিসাবে ধরে নিতেন। সুতরাং 3+1 = 4, 5+1=6 যেদিন এই অংক ভুল প্রমাণিত হবে সেদিনই নবী করীম (স:) হাযির-নাযির প্রমাণিত হবেন। অথবা 3+1=5, 5+1=7 এই অংকের ফল যিনি শুদ্ধ বলবেন কেবল তার জন্যই রাসূলুল্লাহ (স:) হাযির নাযির।

রাসূলুল্লাহ (স:) কে হাযির-নাযির মেনে নিলে মক্কা শরীফ থেকে তার মদীনা শরীফে হিজরত, খানায়ে কা’বা থেকে মসজিদে আকসায় ইসরা, সেখান থেকে সিদরাতুল মুনতাহায় মিরাজ, এভাবে বদর, ওহুদ, খন্দক, তাবুক, হুনাইন, তায়িফ ইত্যাদি স্থানে তাঁর যুদ্ধের সফর, উপরন্তু হজ্জ্ব ও ওমরাহ করা, হুজরা মুবারাক থেকে মসজিদে নববী, সেখান থেকে হুজরা মুবারকে আসা-যাওয়া, মদীন শরীফের এক গলি থেকে অন্য গলি পর্যন্ত যতায়াত পুরোপুরি বাতিল প্রতিপন্ন হয়। কেননা যখন তিনি সর্বত্র হাযির-নাযির তখন মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরতের অর্থ কি ? এই শিরকী আকীদার কারনে না তিনি মুহাজির হতে পারেন, না তিনি মিরাজের অধিকারী হতে পারেন। (নাউযুবিল্লাহ)। এই বদ আকীদার কারনে যে সব ভ্রমন, হিজরত, জিহাদ, মিরাজ, হজ্জ্ব, ওমরাহ ইত্যাদি হয়েছিল সে সবের অস্বীকার আবশ্যম্ভাবী হয়ে দাড়ায়। কেননা, তিনি যখন সর্বত্র হাযির-নাযির তখন মক্কা থেকে হিজরত করার পরও মক্কায়ই থেকে যান। এরপর হিজরত কিভাবে হল ?

ষষ্ঠ হিজরী সনে বনী মুস্তালিক যুদ্ধে হযরত আয়েশা (রা:) রাসূলুল্লাহ (স:) এর সাথী ছিলেন। যুদ্ধ থেকে ফিরার পথে এক স্থানে সবাই বিশ্রাম গ্রহণ করলেন। শেষরাতে ব্যক্তিগত প্রয়োজন সেরে কাফেলা চলার জন্য তিনি নির্দেশ দিলেন। হযরত আয়েশা (রা:) প্রাকৃতিক প্রয়োজনে জঙ্গলের দিকে চলে যান এবং প্রয়োজন সেরে যখন ফিরছিলেন তখন তার গলায় হার নেই দেখতে পান। সেটা তালাশ করতে বেশ কিছু সময় চলে যায়। স্বস্থানে ফিরে এসে দেখেন কাফেলা রওয়ানা হয়ে গেছে। হযরত আয়েশা (রা:) এর জন্য পালকী জাতীয় একটি হাওদা ছিল। এটির মধ্যে তিনি বসতেন এবং বাহকরা সেটা উটের পিঠে বেধে দিতেন। তারা শুণ্য হাওদাকেই উটের পিঠে বসিয়ে দিলেন, হযরত আয়েশা (র:) এর ভিতরে রয়েছেন মনে করে। তখন তিনি ছিলেন অল্প বয়স্কা ক্ষীণাঙ্গিনী। তিনি এতে নেই এমন ধারণা কারো হয়নি। সাফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল (রা:) পিছনে ছিলেন। তিনি এসে হযরত আয়েশা (র:) কে চিনতে পারলেন। যেহেতু পর্দার আয়াত নাযিলের পূর্বে তিনি তাকে দেখেছিলেন। তিনি স্বীয় উট বসালেন, হযরত আয়েশা (রা:) এতে চড়লেন, সাফওয়ান (র:) উটের রশি ধরে পায়ে হেটে চললেন। পথে তাদের মধ্যে একটি কথাও হয়নি। মুনাফিকরা এ বিষয়ে হযরত আয়েশা (র:) কে জঘন্য অপবাদ দিল। রাসূলুল্লাহ (স:) আয়েশা (র:) সম্বন্ধে হযরত আলী (র:) ও আয়েশা (র:) এর খাদিমাকে জেজ্ঞেস করলেন। প্রায় একমাস পরে হযরত আয়েশার পবিত্রতা সম্পর্কে কুরআন মাজিদের আয়াত নাযিল হল (দ্রষ্টব্য তাফসীর সূরা নূর, আয়াত নং 11 )। আয়াত নাযিলের পূর্ব পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (স:) হযরত আয়েশা (রা:) এর সাথে পূর্বের মত ভালবাসা মিশ্রিত আলাপ করতেন না। আয়াত নাযিলের পর যখন আয়েশা (র:) এর মা তাকে রাসূলুল্লাহ (স:) এর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নির্দেশ দিলেন তখন হযরত আয়েশা (রা:) বললেন- না, আমি সেই আল্লাহর কুতজ্ঞতা প্রকাশ করব যিনি আমাকে পবিত্র ঘোষণা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (স:) হাযির-নাযির হলে আয়াত নাযিলের পূর্বেই জানতে পারতেন যে, এটা মিথ্যা অপবাদ। আর হযরত আয়েশা (র:) যে উটের পিঠে হাওদার মধ্যে নেই এটাও বলে দিতেন।

বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, হিজরী চতুর্থ সনে মুশরিকদের এক প্রতিনিধি দল (ষড়যন্ত্র করে) রাসূলুল্লাহ (স:) এর খিদমতে হাযির হয়ে বলল, আপনি আমাদের সাহায্যে কিছু লোক দিন। তিনি আসহাবে সুফফার 70 জন সাহাবা নির্বাচন করে তাদের সাথে প্রেরণ করলেন। বীরে মাউনার নিকট পৌঁছে ঐ কাফের রা এক (খোঁড়া) সাহাবী ছাড়া বাকী সবাইকে শহীদ করে ফেলে। ঐ সাহাবায় কেরাম নিজেদের জীবনের শেষ সময়ে হৃদয়বিদারক কাহিনী আল্লাহর নিকট সোপর্দ করে বললেন, ইয়া আল্লাহ! আপনার প্রিয় রাসূল (স:) ও অন্যন্য সাথদের আমাদের অবস্থা অবহিত করুন। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ হতে রাসূলুল্লাহ (স:) এর প্রতি এ সম্পর্কে একটি নির্দেশ নাযিল হয় যা সাহাবায় কেরাম পাঠ করতেন। তিনি এক মাস পর্যন্ত ফজরের নামাজের শেষ রুকুর পর কাফিরদের বিরুদ্ধে বদ দুআ করেছেন। এ ঘটনার জন্য তিনি খুবই চিন্তিত ও পেরেশান ছিলেন। যদি তিনি হাযির-নাযর হতেন তবে তিনি কাফেরদের এ বিষয়ে পরামর্শ করতে দেখতেন ও শুনতেন। তাদের দুরভিসন্ধি অবগত হতেন। এরপর কেন তিনি নিজের সরলপ্রাণ সাহাবীদের সেই কাফিরদের হাতে সোপর্দ করলেন ? এতে আরও জানা গেল, সেই সাহাবীদেরও এই আকীদা ছিল না যে, রাসূলুল্লাহ (স:) হাযির-নাযির। এই আকীদা ছিলনা বলেই তাদের মর্মান্তিক ঘটনার কথা রাসূল (স:) কে জানিয়ে দেওয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে তারা আবেদন করেন।

বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, কোনও যুদ্ধে এক কাফির সৈন্য বহু সাহাবীকে শহীদ করে। হযরত উসামা (র:) তাকে হত্যা করার জন্য তার প্রতি অগ্রসর হলে সে কালিমা পাঠ করে নেয়। হযরত উসামার এ সন্দেহ রয়ে গেল যে, সে পাণ বাচানোর জন্য কালিমা পাঠ করেছে। এ জন্য তাকে হত্যা করলেন। রাসূলুল্লাহ (স:) যখন এ ঘটনা জানতে পারলেন তখন তিনি হযরত উসামাকে বললেন, তুমি তাকে কেন হত্যা করেছ ? তুমি কি তার অন্তর চিরে দেখেছিলে ? হে উসামা! কেয়ামতের দিন তুমি কালিমার কি জওয়াব দিবে? চিন্তা করুন! একজন কালিমা পাঠকারীর জন্য রাসূলুল্লাহ (স:) এত ব্যাকুল হলেন আর প্রতিপক্ষের কথামত স্বয়ং হাযির-নাযির হয়েও 70 জন প্রিয় সাহাবীকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করালেন? (নাউযুবিল্লাহ)।

মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে, মদীনার মুনাফিকরা রাসূলুল্লাহ (স:) এর বাদী মারিয়াকে মাবুর নামক এক দাসের সাথে অপবাদ দিল। এ অপবাদ প্রবলভাবে দ্রুত প্রচারিত হলে রাসূলুল্লাহ (স:) পর্যন্ত বিশ্বাস করলেন। তিনি হযরত আলী (র:) কে তলোয়ার দিয়ে বললেন, মাবুরকে যেখানে পাওয়া যাবে হত্যা করে দিও। যেহেতু রাসূলুল্লাহ (স:) এর এর নির্দেশ ছিল তাই হযরত আলী (র:) এর এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করার অধিকার ছিল না।

তালাশ করতে করতে অবশেষে মাবুরের সন্ধান পাওয়া গেল। তিনি এক কূপে আত্মগোপন করে বসে ছিলেন। হযরত আলীকে এ অবস্থায় দেখে তিনি আতঙ্কিত হলেন। হযরত আলী (র:) যখন তাকে আবদ্ধ করছিলেন টানা-হেচড়ায় তার লুঙ্গি খুলে যায়। তিনি উলঙ্গ হয়ে পড়েন। হযরত আলী (রা:) দেখলেন- “ আল্লাহ জন্মগতভাবেই তার পুরুষাঙ্গ সৃষ্টি করেন নি।” হযরত আলী (রা:) তাকে হত্যা না করে ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ (স:) কে ঘটনা খুলে বললেন। এতে বুঝা গেল “ উপস্থিত ব্যাক্তি সে জিনিস দেখতে পান যা অনুপস্থিত ব্যক্তি দেখতে পান না।” এখানে উপস্থিত (শাহিদ) দ্বারা হযরত আলীকে আর অনুপস্থিত দ্বারা রাসূলুল্লাহ (স:) কে বুঝোনো হয়েছে।

খায়বার বিজয়ের পর এক ইয়াহুদী নারী বকরীর গোশতের সাথে বিষ মিশিয়ে রাসূলুল্লাহ (স:) এর নিকট হাদীয়া পাঠায়। তিনি কয়েক গ্রাস খান এবং কতিপয় সাহাবীও সে গোশত খেলেন। সুতরাং হযরত বিশর বিন বরা’আ বিন মারূর (র:) সে গোশতের প্রতিক্রিয়ায় শাহাদাত বরণ করেন। বরং মিশকাত শরীফে আছে, যে সব সাহাবী সে গোশত খেয়েছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজন শহীদ হন। (মিশকাত শরীফ, 2য় খন্ড, আবূ দাউদ শরীফ, 2য় খন্ড)। কয়েক গ্রাস খাবার পর রাসূলুল্লাহ (স:) বললেন, এ গোশত খেয়োনা। গোশতের টুকরা আমাকে বলছে এর মধ্যে বিষ আছে। যদি রাসূলুল্লাহ (স:) হাযির-নাযির হতেন তবে ইয়াহুদী নারী যে বিষ প্রয়োগ করছে তা তিনি দেখতেন। নিজে বিষ খেতেন না এবং সাহাবীদেরকেও বিষ খেতে নিষেধ করতেন। দেখে শুনে কি তিনি ঐ সাহাবীদের বিষ খাওয়ায়ে হত্যা করেছিলেন ? (নাউযুবিল্লাহ)।

একবার রাসূলুল্লাহ (স:) হযরত আবু হোরায়রা (রা:) কে দেখতে না পেয়ে বললেন- “ দাওসী যুবক সম্বন্ধে কে অবগত আছ ?” (আবু দাউদ শরীফ) আচ্ছা, হাযির নাযির ও আলিমুল গায়েবের কি এরূপ অবস্থা হয়ে থাকে যে, জানবেন এক জিনিস আর প্রকাশ করবেন অন্য জিনিস ? (নাউযুবিল্লাহ)।

বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত কা’ব বিন মালিক (র:) বলেন, আমি তাবূক যুদ্ধে শরীক হতে পারিনি। তিনি বললেন, এত বিপুল সংখ্য্যক সৈন্য রাসূলুল্লাহ (স:) এর সঙ্গে যাচ্ছিল যে, যদি কোন লোক এ ধারণায় শরীক না হত যে, যতক্ষণ আসমান থেকে ওহী নাযিল না হবে ততক্ষণ রাসূলুল্লাহ (স:) তার অনুপস্থিতির বিষয়ে অবগত হবেন না তবে এ ধারণা সঠিক হত। রাসূলুল্লাহ (স:) এর নিজের মুখেই শুনেন, তিনি বলেন, “যদি কোন লোক এ ধারণায় শরীক না হত যে, যতক্ষণ আল্লাহর ওহী নাযিল না হবে তিনি তার ব্যাপারে অবগত হবেন না তবে এ ধারণা সঠিক হত।”

রাসূলুল্লাহ (স:) সব দেখেন না, আল্লাহ সব দেখেন। আল্লাহ হাযির-নাযির, খালিক-মালিক। তিনি শরীয়তের বাইরে। খালিকের সাথে যারা মাখলূকের তলনা খোঁজে তাদর জন্য আক্ষেপ! স্রষ্টা তো সব কিছুই দেখবেন। একটি অণূও স্রষ্টার অগোচরে থাকবে না। অথচ রাসূলুল্লাহ (স:) এর অগোচরে তার পূর্বেকার অনেক নবী-রাসূল রয়েছেন। যেমন আল্লাহ বলেন- “ আমি তো আপনার পূর্বে অনেক রাসূল পাঠিয়েছিলাম। তাদের কারে কারো কথা আপনার নিকট বিবৃত করেছি এবং কারো কারো কথা আপনার নিকট বিবৃত করিনি।”

রাসূলুল্লাহ (স:) এর ইন্তিকাল সম্পর্কে উমর (র:) এর উক্তি :
রাসূলুল্লাহ (স:) এর যখন ইন্তিকাল হয়ে গেল, তখন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (র:) বললেন, একদল মুনাফিক বলে বেড়াচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ (স:) এর ইন্তিকাল হয়েছে। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (স:) এর ইন্তিকাল হয়নি; বরং তিনি তার রবের সঙ্গে সাক্ষাত করতে গেছেন, যেমন মূসা ইবনে ইমরান তার সম্প্রদায়ের কাছ থেকে চল্লিশ দিনের জন্য চলে গিয়েছিলেন। এরপর যখন বলা হল, তিনি ইন্তিকাল করেছেন, তখন তিনি তাদের কাছে ফিরে আসেন। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (স:)ও মূসা (আ:) এর ন্যায় অবশ্যই ফিরে আসবেন। এরপর তাদের হাত পা কর্তন করবেন, যারা বলে রাসূলুল্লাহ (স:) এর ইন্তিকাল হয়ে গেছে।

হযরত আবু রবক (র:) বললেন, হে উমর1 শান্ত হও! চুপ কর। কিন্তু উমর (র:) নিরস্ত হলেন না। তখন হযরত আবূ বকর (র:) পাঠ করলেন- “ মুহাম্মদ (স:) একজন রাসূল মাত্র; তার পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছেন। সুতরাং তিনি যদি মারা যান অথবা নিহত হন, তবে তোমরা কি পিঠ ফিরাবে ? ” ( সূরা আল-ইমরান : 144)।

হযরত উমর (র:) বলেন, আবু বকর (র:) কে এ আয়াত পাঠ করতে শুনতেই আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। আমার পা আমাকে বহন করতে পারছিল না। তখন আমি উপলব্ধি করলাম যে, রাসূলুল্লাহ (স:) ইন্তিকাল করেছেন।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (র:) বলেন, আল্লাহর কসম! উমর যখন ফিলাফতের মর্যাদায় আসীন তখন একদিন আমি তার সঙ্গে হাটছিলাম। তিনি তার কোন কাজে যাচ্ছিলেন। তার হাতে ছিল দোররা। আমি ছাড়া আর কেউ তার সঙ্গে ছিল না। তিনি আপন মনে কথা বলছিলেন এবং দোররা দ্বারা নিজের পায়ে আঘাত করছিলেন। সহসা তিনি আমার প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, হে ইবনে আব্বাস! রাসূলুল্লাহ (স:) এর ইন্তিকাল হয়ে গেলে আমি যা বলছিলাম তার কারণ কি ছিল তা কি তুমি জান ? আমি বললাম হে আমীরুল মু’মিনীন! আমি তো জানি না। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! তার কারণ এ ছাড়া আর কিছুই ছিল না যে, আমি কুরআনের এ আয়াত পাঠ করতাম- “ এভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থি জাতি রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ এবং রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষীস্বরূপ। ” ( সূরা বাকার : 143)। আল্লাহর কসম! আমি বুঝেছিলাম যে, রাসূলুল্লাহ (স:) তার উম্মতের মধ্যে জীবিত থাকবেন, যাতে তাদের সর্বশেষ কাজ সম্পর্কে সাক্ষ্য দিতে পারেন। এটাই আমাকে সেদিনকার কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। (সীরাতুন্নবী/ইবনে হিশাম 4র্থ খন্ড)।
এতে প্রমাণিত হল, সাক্ষী থাকার জন্য রাসূলুল্লাহ (স:)- এর জীবিত ও সর্বত্র হাযির-নাযির থাকার প্রয়োজন নেই। দুনিয়ার জীবনেও রাসূলুল্লাহ (স:) সব স্থানে হাযির-নাযির ছিলেন না। যেমন আল্লাহ বলেন- “ ‌আপনি যখন দেখবেন, তারা আমার আয়াত সম্বন্ধে উপহাসমূলক আলোচনায় মগ্ন হয় তখন আপনি দূরে সরে পড়বেন, যে পর্যন্ত না তারা অন্য প্রসঙ্গে প্রবৃত্ত হয় এবং শয়তান যদি আপনাকে ভুলিয়ে দেয় তবে স্মরণ হওয়ার পর জালিম সম্প্রদায়ের সাথে বসবেন না। ( সূরা আল-আনয়াম : 68)।

উপরোল্লিখিত আলোচনায় আমরা কুরআন-হাদীস দ্বারা প্রমাণ করেছি যে, রাসূলূল্লাহ (স:) শারীরিক বা রূহানীভাবে হাযির-নাযির নন। এরপরও রেজভীরা যদি বলে রাসূলুল্লাহ (স:) হাযির-নাযির, তাদের এ মনগড়া বিশ্বাসের মুকাবেলায় আমরা এ হাদীস পেশ করছি, “ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নাফরমানী করে কোন মাখলুকের আনুগত্য করা যাবে না।” (বুখারী শরীফ)

যারা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের ডাকে সাড়া দেয় না বরং নিজেদের খেয়াল-খুশী মত বা পীর-মুর্শিদের মনগড়া খেয়াল-খুশীমত চলে তাদের সম্বন্ধে আল্লাহ পাক কুরআনে বলেছেন, “ এরপর তারা যদি আপনার ডাকে সাড়া না দেয়, তা হলে জানুন, তারা তো কেবল নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে। আল্লাহর পথ-নির্দেশ অগ্রাহ্য করে যে ব্যক্তি নিজ খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে সে ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত আর কে ? ” (সূরা কাসাস : 50)।

আলিমুল গাইব

যন্ত্র বা মাধ্যম ছাড়া সন্দেহাতীতভাবে স্বয়ং যা জানা যায় তাই এলমে গায়েব। হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ তাফসীর “মাদারিক” কিতাবে গায়েবের সজ্ঞায় বলা হয়েছে, “ যে বিষয়ের অনুকূলে কোন দলীল প্রমাণ নেই এবং যে সম্পর্কে কোন সৃষ্টিও অবগত নয় তাকে গায়েব বলে।” যা ইন্দ্রিয়ানুভূতির অগোচর এবং জ্ঞান ও বুদ্ধির অগম্য তা গয়েব। আল্লাহর নিকট কিছুই অদৃশ্য বা অজানা নেই, তাই তিনি‘ আলিমুল গাইব’।

রেজভীরা ইলমে গায়েবের অর্থ ও সংজ্ঞা না বুঝে, যে জ্ঞান আল্লাহর জন্যে এবং আল্লাহর শানের একমাত্র উপযুক্ত সে জ্ঞান রাসূলুল্লাহ (স:) এর জন্য সাব্যস্ত করে শিরক ফিস্ সিফাত এর অমার্জনীয় অপরাধে অপরাধী হয়েছে। আল্লাহর সত্তা যেমন উপকরণবিহীন তার ইলম ও উপকরণবিহীন। আল্লাহর মাধ্যম ছাড়া মাখলুকের ইলম কোন না কোন মাধ্যমে অর্জিত হয়। প্রকাশ্য অথবা গোপন, অতীত অথবা বর্তমান, দুনিয়া অথবা আখিরাত সবকিছুই আল্লাহর জন্য সমান। কোন জিনিস তার জ্ঞানের অগোচরে নেই। যমীনের বুকে বিশাল মরুভূমিতে যত বালু-কনা রয়েছে, বাগান ও বন-জঙ্গলের গাছ পালায় যত পাতা রয়েছে, প্রতি শাখায় যত ফুল এবং প্রতি ছড়ায় যত শষ্যদানা রয়েছে মানুষের মাথায় ও পশুর চামড়ায় যত লোম রয়েছে আল্লাহর জ্ঞানের এক ক্ষুদ্রতম অংশ সেগুলোর হিসাব রাখার জন্য যথেষ্ট। অথচ এসবের খবর রাখা কোন মানুষ, নবী বা ফেরেশতার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কখনো কখনো আল্লাহ তায়ালা কারো কারো জ্ঞানের সামনে তার ধারণক্ষমতা অনুযায়ী বিশ্ব-জগতের কিছু রহস্য উদ্ভাসিত করে দেন অথবা কোন অদৃশ্য বিষয় প্রকাশ করে দেন। তও একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত।

পক্ষান্তরে আল্লাহ তা’য়ালা যে গুণের অধিকারী তা তিনি পরিস্কার ভাষায় বলেছেন- “ গায়েবের চাবি তারই নিকট রয়েছে। তিনি ছাড়া অন্য কেউ তা জানে না। জলে ও স্থলে যা কিছু আছে তা তিনিই জানেন, তার অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও পড়ে না, মাটির অন্ধকারে এমন কোন বস্তু নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই।” (সূরা আনয়াম : 59)

তিনি প্রতিটি আওয়াজ যেভাবে শুনতে পান অনুরূপভাবে প্রতিটি জিনিসও দেখতে পান। যত গভীর অন্ধকারই হোক না কেন সেখানেও তার দৃষ্টি পৌঁছে যায়। গহীন অন্ধকারে আচ্ছন্ন জিনিস দেখার জন্য তিনি আলোর মুখাপেক্ষী নন। তিনি কারো অনুরূপ নন এবং অন্য কেউই তার অনুরূপ নয়। তিনি কোন স্থানে গন্ডিবদ্ধ নন, তিনি আরশের মধ্যে রয়েছেন এবং একই সঙ্গে সব জিনিসের সাথেও রয়েছেন। তিনি সর্বত্র পরিব্যাপ্ত।

রাসূলুল্লাহ (স:) কে আল্লাহ তা’য়ালা এমন ইলম দান করেছেন যা অন্য কোনও নবী বা ফেরেশতাকে দান করা হয়নি, সব নবী, সব মানুষ ও সব ফেরেশতার ইলম রাসূলুল্লাহ (স:) এর জ্ঞান সমুদ্রের একটি বিন্দুমাত্র। আগের পরের অসংখ্য ঘটনা, কবর জীবনের অবস্থা, হাশর ময়দানের চিত্র, জান্নাত-জাহান্নামের অবস্থান এক কথায় নবীজির শানের উপযুক্ত সমুদয় জ্ঞান তাকে দান করা হয়েছে। এর পরিমাণ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। সাথে সাথে আমরা এ আকীদাও রাখি যে, রাসূলুল্লাহ (স:) এর পবিত্র জ্ঞানের সাথে গোটা সৃষ্টির জ্ঞানের যেমন কোন তুলনা হতে পারে না তেমনি আল্লাহর অসীম জ্ঞানের সাথে রাসূলুল্লাহ (স:) এর জ্ঞানের তুলনা চলে না।

ইলমে গায়েব সম্বন্ধে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ইসলামী বিশ্বকোষে প্রকাশিত লেখা থেকে নিম্নে উদ্বৃত করছি। গাবা ‘আন অনুপস্থিত থাকা এবং গাব ফী, অদৃশ্যভাবে থাকা, মূল শব্দটির দ্বিবিধ অর্থ। সাম্প্রতিককালের পয়োগ রীতি অনুসারে, গায়েব (এবং বিশেষত গায়ব:) অনুপস্থিতি বোধক (এবং গায়বা: শুহুদ = উপস্থিত এর বিপরীত; সূফীতত্ত্বের একটি পারিভাষিক শব্দ) কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গায়ব বা অদৃশ্যভাবে অস্তিত্বশীল, ইন্দ্রিয়ানুভূতি এবং যুক্তি-বুদ্ধির অগম্য; অতএব যুগপৎ মনুষ্য জ্ঞানে অনুপস্থিত এবং আল্লাহর প্রজ্ঞায় গুপ্তার্থ জ্ঞাপক। ধর্মসংক্রান্ত শব্দ ভান্ডারের পারিভাষিক শব্দ হিসেবে আল গায়ব এর দ্বিতীয় অর্থ ব্যক্ত করে। সুতরাং ইহা ‘মহা রহস্য’ শব্দটি দ্বারা অনূদিত হতে পারে। বিরল ব্যতিক্রমসহ পবিত্র কুরআনে ইহার এরূপ অর্থ দৃষ্ট হয়। পবিত্র গন্থে মূল শব্দটি বারংবার ব্যবহৃত হয়েছে।

“ অদৃশ্যের জ্ঞানতো কেবল আল্লাহরই আছে” (কুরআন 10:20) “ অদৃশ্যের কুঞ্জি তারই নিকট রয়েছে, তিনি ব্যাতিত অন্য কেউ তা জানে না।” (6:59) এখানে আল্লাহর সংরক্ষিত রহস্যের (Divine mystery) উল্যেখ করা হয়েছে। এবং ইহা আপনা হতেই মানুষের বোধশক্তির অগম্য।
পবিত্র কুরআন সমস্ত গায়ব মানুষের নিকট প্রকাশ করে না, কিন্তু সমগ্র পবিত্র কুরআন গায়েবের একটি (আংশিক) সংবাদ। ফখরুদ্দীন আর-রাযী এ অর্থেই তার মহান ভাষ্যের নামকরণ করেন, “মহা রহস্যের চাবিসমূহ” (মাফাতিহুল গায়ব)।
হাম্বলীপন্থী ইবনে বাততা বলেন, মানুষ অবশ্যই নিজেকে আল্লাহর অসীম ক্ষমতার আশ্রয়ে সমর্পিত করবে এবং ঐশী মহারহস্যে (গায়ব) বিশ্বাস স্থাপন করবে। কারণ মানুষের ব্যক্তিগত বুদ্ধি-জ্ঞান মানুষকে এই রহস্য জ্ঞাত হওয়ার পর্যায়ে উন্নীত করতে অক্ষম।”
আল্লাহর সংরক্ষিত এই মহা রহস্য-এইভাবে একই সঙ্গে “বস্তুনিচয়ের রহস্য” মানুষের (প্রত্যেক মানুষের) আদৃষ্ট। ইহা আল্লাহর নিকট সংরক্ষিত, তিনি যে পরিমাণ ইচ্ছা করেন, নবীদের নিকট সেটুকুই প্রকাশ করেন।” (ইসলামী বিশ্বকোষ, দশম খন্ড, পৃষ্ঠা : 381)।

আল্লাহ আলিমুল গায়ব কুরআনের ভাষায়

আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান, “ বলুন, আল্লাহ ছাড়া আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে কেউই গায়েবের জ্ঞান রাখে না। এবং তারা জানে না তারা কখন পুনরুত্থিত হবে।” (সূরা আল-আনয়াম : 65)।
“ তিনি গায়ব ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা, তারা যাকে শরীক করে তিনি তার উর্দ্ধে।” (সূরা মুমিনূন : 92)
“ বলুন, আমি তোমাদের এটা না যে, আমার নিকট আল্লাহর ধন-ভান্ডার আছে। গায়ব সম্বন্ধেও আমি অবগত নই; এবং তোমাদের এটাও বলি না যে, আমি ফেরেশতা। আমার প্রতি যা ওহী হয় আমি কেবল তারই অনুসরণ করি। বলুন, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান ? তোমরা কি চিন্ত কর না” (সূরা আল-আনআম : 50)।
“ বলুন, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তাছাড়া আমার নিজের ভাল-মন্দের উপরও আমার কোন অধিকার নেই। আমি যদি গায়ব জানতাম তবে তো আমি বহু কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না। আমি তো কেবল মুমিনদের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদবাহী। (সূরা আরাফ : 188)
রাসূলুল্লাহ (স:) তার আশেপাশের অনেক মুনাফিকদের সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। যেমন আল্লাহ বলেন- “ মরুবাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের আশে পাশে আছে তাদের কেউ কেউ মুনাফিক এবং মদীনাবাসীদের মধ্যেও কেউ কেউ, তারা মুনাফিকীতে সিদ্ধ। আপনি তাদরেকে জানেন না আমি তাদেরকে জানি।” (সূরা তওবা : 101)।

রাসূলুল্লাহ (স:) নিজেও তার সম্পর্কে এ ধরণের আকীদা পোষণ নিষেধ করতেন। যেমন একবার মদীনার ছোট ছোট বালিকারা তার শানে কবিতা বললেন- “ এবং আমাদের মাঝে আছেন নবী (স:) তিনি জানেন আগামীকালের কথা। ” তাদের এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (স:) বললেন - “ এটা বলো না বরং অন্য যা বলতেছিলে, তাই বল। আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা আগামীকাল কি হবে। ”
হযরত আয়েশ (র:) বলেন, “ যে ব্যাক্তি মনে করে নবী (স:) গাযেব জানেন সে আল্লাহকে বড় অপবাদ দিল।” (বুখারী শরীফ)।

হানাফী ফিকাহ গ্রন্থের ফতোয়া

“ যে ব্যক্তি বিনাসাক্ষীতে কোন মহিলাকে বিয়ে করে এরপর বলে আল্লাহ ও রাসূলকে সাক্ষী করলাম, সে কুফরী করল।” (আলমগীরি)
কিতাবে এর কারণ র্দশিয়ে বলা হয় যে, লোকটি রাসূলুল্লাহ (স:) কে ‘আলিমুল গায়ব ও হাযির-নাযির মনে করে। অথচ এ ধরনের আকীদা পোষণ সম্পূর্ণ কুফরী।
“ এরপর ভালভাবে জেনে রাখুন, কখনো আল্লাহ তাদেরকে যা জানিয়েছেন তাছাড়া নবীগণ (আ:) গায়েবের বিষয়াবলী জানতেন না। তারপর নবী (স:) গায়েব জানতেন এ কুফরী আকীদা সর্ম্পকে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।” (ফিকতে আকবর)
“ কারো ইলমে গায়েবের দাবী করা কুরআনের সুস্পষ্ট দলীলের পরিপন্থী, সুতরাং এতে সে কাফির সাব্যস্ত হয়।” (ফতোয়ায় শামী)। ‍ৎ

আলিমুল গায়েবের অপব্যখ্যা

“ এবং আপনি যা জানতেন না তা আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন। আপনার প্রতি আল্লাহরঅসীম অনুগ্রহ রয়েছে। (সূরা নিসা : 113)।
রেজভীরা উক্ত আয়াত দ্বারা নবী করীম (স:) কে ‘আলিমুল গায়েব’ প্রতিপন্ন করে। আয়াতে ‘মা’ শব্দটি র্সাবিক অর্থে গ্রহণকরত জ্ঞান রাসূলুল্লাহ (স:) এর জন্য সাব্যস্ত করে তারা আলিমুল গায়েবের দলীল পেশ করে। এর উত্তরে আমরা কুরআন মাজিদের অন্য আয়াত পেশ করছি। “ মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না” (সূরা আলাক: 5) তবেতো তাদের ফর্মূলা অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষই ‘আলিমুল গায়েব’ সাব্যস্ত হয়ে যায়। (নাউযুবিল্লাহ)।
তারা এ দলীল পেশ করে, “ এবং আমি প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরুপ আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করলাম” (সূরা নাহল : 89) আমরা বলি মূসা (আ:) এর কিতাব সম্পর্কেও অনুরূপ বলা হয়েছে- “ এবং আমি মূসাকে দিয়েছিলাম কিতাব যা সৎ কর্মপরায়ণদের জন্য সম্পূর্ণ, যা সব কিছুর বিশদ বিবরণ।” (সূরা আল-আনআম : 154)।
“ আমি তার (মুসার) জন্য ফলকে সর্ববিষয়ে উপদেশ ও সর্ববিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা লিখে দিয়েছি।” (সূরা আরাফ : 145)।
“কুল্লু শাইইন” কোন স্থানে বেশি ও আধিক্য অর্থে ব্যবহৃত হয়। কোন স্থানে তৎসংশ্লিষ্ট বিষয় বুঝাবার জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। কুরআনে মৌমাছিকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেন- “ এরপর (হে মৌমাছি) প্রত্যেক ফল হতে কিছু কিছু আহার কর।” (সুরা নাহল : 69)

আয়াতে প্রত্যেক ফল অর্থে আশেপাশের ফলসমূহ বুঝায়। তা না হলে আরবের মৌমাছি বাংলাদেশের আম ও কাঁঠাল ফল আহার করেনি। রানী বিলকিস সম্পর্কে বলা হয়েছে- “ তাকে (বিলকিসকে) সব কিছু হতে দেয়া হয়েছে।” (সূরা নামল : 23)
আয়াতে সব কিছু অর্থে তার যুগে তার প্রয়োজনীয় সবকিছু দেয়া হয়েছিল বোঝায়। তা না হলে বিলকিসকে আধুনিক যুগের যন্ত্রপাতি, টেলিফোন, টেলিভিশন, এটম বোম ইত্যাদি দেয়া হয়নি।

তারা দলীল হিসাবে এ আয়াত পেশ করেন। - “ বলুন, আমি জানি না তোমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা কি আসন্ন, না আমার প্রতিপালক এর জন্যে কোন দীর্ঘ মেয়াদ স্থির করবেন। তিনি গায়েবের পরিজ্ঞাতা, তিনি তার গায়েবের জ্ঞান কারও নিকট প্রকাশ করেন না, তার মনোনীত রাসূল ছাড়। সেইক্ষেত্রে আল্লাহ রাসূলের সামনে ও পেছনে প্রহরী নিয়োজিত করেন। রাসূলগণ তাদের প্রতিপালকের বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছেন কিনা জানার জন্যে। রাসূলগণের নিকট যা আছে তা তার জ্ঞানগোচর এবং তিনি সবকিছুর বিস্তারিত হিসাব রাখেন।” (সূরা জ্বিন : 25-28)
আয়াতের ব্যাখ্যা হচ্ছে- কাফিররা কিয়ামতের নির্দিষ্ট দিন-তারিখ বলে দেবার জন্য পীড়াপীড়ি করে। তাদের বলে দিন কিয়ামতের আগমন ও হিসাব-নিকাশ নিশ্চিত, তবে এর নির্দিষ্ট দিন-তারিখ আল্লাকহ কাউকেও বলেন নি। তাই আমি জানি না কিয়ামতের দিন নিকটে না আমার পালনকর্তা এর জন্য দীর্ঘ মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দিবেন। আমার না জানার কারণ এই যে, আমি আলিমুল গাইব নই। এটি আল্লাহর বিশেষ গুণ। এখানে কোন নির্বোধ ব্যক্তির মনে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ (স:) যখন কোন গায়েবের জ্ঞান রাখেন না তখন তিনি রাসূল হলেন কিরূপে? কেননা, রাসূলের নিকট আল্লাহ তায়ালা হাজারো গায়েবের বিষয় ওহীর মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। উক্ত ধারণা নিরসনের জন্য পরবর্তী আয়াতে “ইল্লা” (ব্যাতিক্রম) বর্ণনা করা হয়েছে গায়েব ও গায়েবের সংবাদের মধ্যে পার্থক্য বুঝানোর জন্যে। অর্থাৎ রাসূল গায়েব জানেন না, তবে যে পরিমাণ গায়েবের সংবাদ কোন রাসূলকে দেয়া প্রয়োজন সে পরিমাণ গায়েবের সংবাদ ওহীর মাধ্যমে রাসূলকে দান করা হয়েছে। যখন রাসূলের প্রতি আমার পক্ষ হতে ওহী অবতীর্ণ হয় তখন ওহীবাহী ফেরেশতার চারপাশে ফেরেশতাগণের পাহারা থাকে যাতে শয়তান কোনরূপ হস্তক্ষেপ করতে সক্ষম ন হয়। এখানে রাসূল শব্দ দ্বারা প্রথমে রাসূল ও নবীগণকে প্রদত্ত গায়েবের প্রকার নির্ধারণ করা হয়েছে। আর তা হল শরীআত ও বিধি-বিধানের জ্ঞান ও সময়োপযোগী গায়েবের সংবাদ। সুতরাং “ইল্লা” বা ব্যাতিক্রমের মাধ্যমে নবী-রাসূলগণের জন্য প্রয়োজনীয় গায়েবের সংবাদ প্রেরণ প্রমাণিত হল। পরিভাষায় এই ব্যতিক্রমকে “ইসতিসনা মুনকাতি” (বিচ্ছিন্ন ব্যাতিক্রম) বলা হয়। যে গায়েব সম্পর্কে বলা হয়েছিল যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না, ব্যতিক্রমের মাধ্যমে সেই গায়েব প্রমাণ করা হয়নি বরং নবী-রাসূলের জন্য গায়েবের সংবাদ-প্রাপ্তি প্রমাণিত হয়েছে। রেজভীরা গায়েব ও গায়েবের সংবাদের মধ্যে পার্থক্য বোঝে না। নবীগণ গায়েবের সংবাদবাহী ছিলেন, ‘আলিমুল গায়েব’ ছিলেন না।

তারা মাওয়াহিব হতে দলীল হিসেবে এ হাদীস পেশ করেন- “ আল্লাহ তা’য়ালা আমার প্রতি দুনিয়াকে উঠালেন আমি এর দিকে দৃষ্টিপাত করলাম এবং কিয়ামত পর্যন্ত এতে যা কিছু হবে তার প্রতিও” (ইবনে ওমর রা:)।
প্রথমত এ হাদীস একটি যয়ীফ হাদীস। এরুপ যয়ীফ হাদীস দ্বারা কোন দলীল প্রতিষ্ঠিত হয় না। এ হাদীস কুরআনের দলীল ও সহীহ হাদীস সমূহের বিপরীত। ইবনে উমর (র:) বর্ণিত এ হাদীস সম্বেন্ধে কানজুল উম্মালে বলা হয়েছে, এর সনদ দূর্বল।
দ্বিতীয়ত সহীহ মেনে নিলেও হাদীসটি খবরে ওয়াহেদ এবং খবরে ওয়াহেদ কুরআনের সুস্পষ্ট দলীলের বিপরীতে টিকে না।
তৃতীয়ত কুরআন ও অনেক সহীহ হাদীস দ্বারা দেখা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (স:) ইন্তিকাল পর্যন্ত বহু বষয়ে অবগত ছিলেন না। ইন্তিকালের পর কিয়ামত পর্যন্ত বহু বষয়ে অবগত থাকবেন না। যেমন আল্লাহ বলেন, “ যেদিন আল্লাহ রাসূলগণকে একত্রিত করবেন এবং জিজ্ঞেস করবেন তোমরাকি উত্তর পেয়েছিলে ? তারা বলবেন, আমাদেরতো কোন জ্ঞান নেই, আপনিই গায়েব সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।” (সূরা মায়িদা : 109)।
বুখারী শরীফে র্বণিত আছে, হাশরের দিন আমার উম্মতের একদল আমার নিকট আনা হবে; তাদের হাউযে কাওসার হতে ফিরিয়ে দেয়া হবে। তখন আমি বলব, হে আল্লাহ! এরা আমার সাথী (উম্মত)।তখন আল্লাহ আমাকে বলবেন, আপনি জানেন না আপনার (ইন্তিকালের) পর এরা কি বেদাত করেছে। তখন আমি বলব, দূর হও, দূর হও।



রাসূলুল্লাহ (স:) আলিমুল গায়েব ছিলেন না কুরআনী ঘটনাবলী
নিম্নের কুরআনী ঘটনাবলী থেকে প্রমাণিত হয়, রাসূলুল্লাহ (স:) আলিমুল গায়েব ছিলেন না।

প্রথম ঘটনা :
“ হে নবী! আল্লাহ আপনার জন্য যা হালাল করেছেন তা আপনি হারাম করছেন কেন ?” (সূরা তাহরীম : 01)

সহীহ হাদীস অনুযায়ী এ আয়াত নাযিল হওয়ার কারণ এই যে, নবী করীম (স:) মধু খুবই পছন্দ করতেন। যখন রাসূলুল্লাহ (স:) উম্মুল মুমিনীন হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ (র:) এর হুজরায় তাশরীফ নিতেন তখন তিনি হুযুর (স:) এর খিদমতে মধু পেশ করতেন। এ জন্য তাঁর হুজরায় তুলনামূলকভাবে হুযুর (স:) এর যাতায়াত বেশি হয়। অন্যান্য উম্মুল মুমিনীন স্বাভাবিক কারনে ঈর্ষাণ্বিতা হন। তারা পরামর্শ করে একদিন হুযুর (স:) কে বললেন, আপনার মুখ থেকে মাগাফীর এর দুর্গন্ধ আসছে। (মাগাফীর এক প্রকার দুর্গন্ধযুক্ত আঠা) হুযুর (স:) বললেন, আমি তো মাগাফীর খাইনি। যয়নবের ঘরে মধু খেয়েছি। উম্মাহুতুল মুমিনীন বললেন, সম্ভবত মৌমাছি মাগাফীর গাছের ফুল চুষেছিল। যেহেতু হুযুর (স:) দুর্গন্ধ খুবই অপছন্দ করতেন তাই তিনি বললেন, আমি মধু পান করব না। এর উপর উল্লিখিত আয়াত নাযিল হল এবং এ বিষয়ে আল্লাহর পক্ষ হতে তাকে সাবধান করা হল। এ ঘটনায় নিম্ন বর্ণিত ফলাফল নির্গত হয়।
1. স্ত্রীদের কথায় এ কথা বিশ্বাস করলেন যে, মুখ মুবারক হতে মাগাফীর এর দুর্গন্ধ সত্যিই আসছে।
2. এ কথাও বিশ্বাস করলেন যে, সে মৌমাছি মাগাফীর এর ফুলের রস চুষে থাকবে।
3. যদি হুযুর (স:) আলিমুল গাইব হতেন, তবে তিনি প্রথমেই জানতেন যে, যদি আমি মধু না খাওয়ার প্রতিজ্ঞা করি তবে এটা আল্লাহর অপছন্দ হবে এবং তার নিকট থেকে সাবধান বাণী আসবে, ফলে তিনি আল্লাহর ইচ্ছার পরিপন্থি প্রতিজ্ঞা করতেন না।

দ্বিতীয় ঘটনা :
“আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করেছেন। কারা সত্যবাদী তা আপনার নিকট স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত এবং কারা মিথ্যাবাদী তা না জানা পর্যন্ত আপনি কেন তাদেরকে অব্যাহতি দিলেন? (সূরা তওবা : 43)

নবম হিজরীতে রাসূলুল্লাহ (স:) তাবূক অভিযানে বের হওয়ার অভিপ্রায় করলেন। সবাইকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ঘোষণা করা হল। মুনাফিকরা হাযির হয়ে নিজেদের বিভিন্ন বাহানা পেশ করে যুদ্ধে অংশগ্রহণের অক্ষমতা জানাল। হুযুর (স:) তাদের সবাইকে অনুমতি প্রদান করলেন। এ জন্য আয়াত নাযিল হল এবং মৃদু ভাষায় হুযুর (স:) কে সাবধান করে বলা হল, আপনি তাদের বাহানার সত্য-মিথ্যা প্রকাশ পাবার পূর্বে কেন অনুমতি দিলেন ? এটা সুস্পষ্ট কথা যে, তিনি আলিমুল গাইব ছিলেন না বলেই অনুমতি দিয়েছিলেন। অন্যথায় তারা যে মিথ্যা বাহানা পেশ করছে তা তিনি জানতেন।

তৃতীয় ঘটনা :
“ দেশে ব্যাপকভাবে শত্রুকে পরাভূত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোন নবীর জন্য সংগত নয়, তোমরা কামনা কর দুনিয়ার সম্পদ এবং আল্লাহ চান আখিরাতের কল্যাণ, আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আল্লাহর পূর্ব-বিধান না থাকলে তোমরা যা গ্রহণ করছ তজ্জন্য তোমাদের উপর মহা-শাস্তি পতিত হত। (সূরা আনফাল : 67-68)

নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থসমূহের বর্ণনানুসারে উল্লিখিত আয়াত নাযিলের কারণ এই যে, বদর যুদ্ধে কাফির ও মুশরিকদের 70 জন লোক মুসলমানের হাতে বন্দী হয়। হুযুর (স:) তাদের ব্যাপারে সাহাবীগণের পরামর্শ চাইলেন। হযরত আবু বকর (র:) আরজ করলেন, আমার মতে এই বন্দীদের সাথে বৈধ ব্যবহার করা হোক এবং কিছু মুক্তিপণ আদায় করে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হোক। এতে আমাদের আর্থিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে। আর এ আশাও পোষণ করা যায় যে, একদিন তারা হেদায়েতের পথে এসে ইসলাম গ্রহণ করবে। হযরত উমর (র:) আরজ করলেন, “ হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তা’য়ালা আপনাকে তাদের মুক্তিপণ হতে অমুখাপেক্ষী করেছেন। এরা সবাই কাফির মুশরিকদের নেতা। যদি এখানে তাদের ধ্বংস করে দেয়া হয় তবে কুফর এর শক্তি ভেঙ্গে পড়বে। তাই আমার মত এই যে, আমাদের মধ্যে যে যার প্রিয় ও নিকট আত্মীয় তাকে তার নিকট সোপর্দ করা হোক। সে-ই তার গর্দান কাটবে। আমার অমুক প্রিয় ব্যক্তিকে আমার নিকট সোপর্দ করা হোক। হুযুর (স:) হযরত ওমর (র:) এর অভিমত গ্রহণ না করে হযরত আবূ বকর (র:) এর পরামর্শ গ্রহণ করলেন। তখন উপরোক্ত আয়াত নাযিল হয়। অর্থাৎ বন্দীদের ছেড়ে দেয়া সংগত ছিল না, বরং সবাইকে হত্যা করাই ছিল সংগত। এ ঘটনায় দিবালোকের ন্যায় প্রকাশ পায় যে, হুযুর (স:) আলিমুল গাইব ছিলেন না।

চতুর্থ ঘটনা :
“কখনই আপনি কোন বিষয়ে এ কথা বলবেন না, আমি তা আগামীকাল করব, ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে’ এ কথা না বলে। যদি ভুলে যান তবে আপনার প্রতিপালককে স্মরণ করবেন।” (সূরা কাহফ : 23,24)

মুফাসসিরীন বলেন, এ আয়াত নাযিল হওয়ার কারণ এই যে, যখন কুরাইশরা নবী করীম (স:) কে আসহাবে কাহফ, যুলকারনাইন ও রূহ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করল তখন তিনি বললেন, আগামীকাল বলব এবং এ কথার সাথে ইনশাআল্লাহ বলতে ভুলে গেলেন। এ জন্য 15 দিন মতান্তরে 40 দিন পর্যন্ত ওহী আসা বন্ধ থাকে। এরপর এ আয়াত নাযিল হয়- কোন কাজ করার প্রতিজ্ঞা করবেন না ইনশাআল্লাহ ছাড়া। যদি সে সময় ভুলে যান তবে যখন স্মরণ হবে তখনই বলে নিবেন। এতে বুঝা গেল যে, নবী করীম (স:) আসহাবে কাহফ ইত্যাদি সম্বন্ধে অবগত ছিলেন ‍না এবং ওহীর মাধ্যমে আল্লাহ না জানালে তিনি কিছুই বলতে পারেন না।

পঞ্চম ঘটনা :
“মুমিনগণ যখন বৃক্ষতলে আপনার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করল তখন আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন।” (সূরা ফাতহ : 18)

হুদাইবিয়ার সন্ধি নবী করীম (স:) এর পবিত্র জীবনের প্রসিদ্ধতম ঘটনা। সে বছর হুযুর (স:) কুরবানী করার জন্যে প্রায় 14 শত সাহাবাসহ কা’বা যিয়ারতের উদ্যেশ্যে রওয়ানা হলেন। পথে কাফিররা বাধা প্রদান করল। নবী করীম (স:) হযরত উসমান (র:) কে আবু সুফিয়ান ও মক্কার অন্যান্য সর্দারের নিকট এ বার্তাসহ পাঠালেন যে, আমি যুদ্ধ করতে আসিনি। আমাদেরকে কা’বা শরীফ তাওয়াফ করতে দাও। কুরাইশরা হযরত উসমান (র:) কে বন্দী করল। মুসলমানদের মধ্যে তখন এ ভুল সংবাদ প্রচারিত হল যে, কাফিররা তাকে হত্যা করেছে। হুযুর (স:) চিন্তিত হলেন। সাহাবা কিরামের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হল। সবাই যুদ্ধ করতে এবং হযরত উসমান হত্যার প্রতিশোধ নিতে অস্থির হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে সবাই হুযুর (স:) এর নিকট বাইআত নেন এবং হুযুর (স:) ও হযরত উসমানের হয়ে বাইআত নেন। অথচ কাফিররা হযরত উসমান (র:) কে হত্যা করেনি।
এ ঘটনা দ্বারা কত সুন্দরভাবে প্রকাশ পায় যে, হুযুর (স:) আলিমুল গাইব ছিলেন না। আলিমুল গাইব হলে হযরত উসমান হত্যার ভুল সংবাদে প্রভাবান্বিত হতেন না।

রাসূলুল্লাহ (স:) আলিমুল গায়েব ছিলেন না হাদীসে বর্ণিত কিছু ঘটনা

প্রথম ঘটনা :
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (র:) বলেন, নবী করীম (স:) সাহাবীবৃন্দকে নিয়ে নামায আদায় করছিলেন। নামাযের মধ্যে হঠাৎ জুতা মুবারক খুলে ফেললেন। সাহাবীগণ যখন দেখলেন তিনি জুতা মুবারক খুলেছেন তখন তারাও নিজেদের জুতা খুলে নিলেন। নবী করীম (স:) নামাজ শেষ করে বললেন, কি জন্য তোমরা তুজা খুলেছ ? তারা বললেন, আমরা আপনাকে আপনার জুতা খুলতে দেখেছি তাই আমরা আমাদের জুতা খুলেছি। নবী করীম (স:) বললেন, আমার নিকট জিবরাঈল এসে আমাকে জানালেন যে, আপনার জুতাদ্বয়ে নাপাকী রয়েছে। (আবু দাউদ)

এ ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, নবী করীম (স:) আলিমুল গাইব ছিলেন না। আলিমুল গাইব হলে জুতায় যে নাপাকী রয়েছে তা জানতেন এবং নামাযের পূর্বেই জুতা মুবারক খুলে নিতেন।

দ্বিতীয় ঘটনা :
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (র:) বর্ণনা করেন, একবার হযরত জিব্রাঈল (আ:) নবী করীম (স:) এর কাছে (কোন নির্দিষ্ট সময়ে দেখা করার জন্য) আসার ওয়াদা করেছিলেন, (আর সেই ওয়াদা মতে ঐ নির্ধারিত সময়ে কোন এক নির্দিষ্ট ঘরে রাসূলুল্লাহ (স:) তার অপেক্ষায় বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকেন। ) কিন্তু জিব্রাঈল (আ:) আসতে দেরী করেন। এতে রাসূলুল্লাহ (স:) মনে খুব কষ্ট পেলেন। পরে যখন ঘর থেকে বাহিরে এলেন তখন (ঘরের বাহিরে) জিব্রাঈল (আ:) এর সাক্ষাৎ পেলেন। রাসূলুল্লাহ (স:) তার কাছে (ঐ নির্দিষ্ট সময়ে না আসার জন্য) কষ্ট পাওয়ার অভিযোগ করলেন। জিব্রাঈল (আ:) রাসূলুল্লাহ (স:) কে বললেন, “ যে ঘরে কোন প্রাণীর ছবি থাকে আর যে ঘরে কুকুর থাকে সে ঘরে আমরা কখনো প্রবেশ করিনা। তাই যথা সময়ে এসেও বাধ্য হয়ে ঘরের বাহিরে এখানে আপনার অপেক্ষায় আছি। (বুখারী, লিবাস অধ্যায়)

চিন্তা করুন, রাসূলুল্লাহ (স:) সর্বত্র হাযির-নাযির হলে আলোচ্য ঘরের বাহিরে তার জন্য অপেক্ষামাণ জিব্রাঈল (আ:) কে না দেখার কারণ ও কৈফিয়ৎ কি ? যে ঘরে তিনি অবস্থান করছিলেন সে ঘরে ছবি বা কুকুর থাকা সত্ত্বেও তিনি তা জানতে পারেন নি। মানবিক পঞ্চেন্দ্রিয়েল আওতার বাইরে কোন কিছুর অবস্থান জানা একমাত্র আলিমুল গায়েব লা-শরীক আল্লাহর পক্ষেই সম্ভব।

তৃতীয় ঘটনা :
আহযাবের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (স:) প্রচন্ড শীত ও বৃষ্টির রাতে শত্রুবাহিনীর সংবাদ জানতে ইচ্ছা করলেন। সুতরাং তিনি বার বার বলতে লাগলেন, কে আছে যে শত্রুর নিকট গিয়ে আমাকে সংবাদ দিবে তারা কি করছে। অবশেষে হযরত হুজাইফা (রা:) এর নাম নিলেন। তিনি গিয়ে তাদের সংবাদ নিয়ে আসলেন। রাসূলুল্লাহ (স:) আলিমুল গায়েব হলে হুজাইফাকে পাঠাতেন না।

চতুর্থ ঘটনা :
রাসূলুল্লাহ (স:) মিরাজ হতে আগমনের পর যখন সাহাবীগণকে রাত্রের কিয়দংশে মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসা ভ্রমানের ঘটনা বললেন, তখন মক্কার কাফিররা তার একথা অবিশ্বাস করে বলল, আপনি যদি বাইতুল মুকাদ্দাস গিয়ে থাকেন তবে মসজিদুল আকসার বর্ণনা দিন। তৎক্ষণাৎ হযরত জিব্রাঈল (আ:) রাসূলুল্লাহ (স:) এর সামনে আল্লাহর নির্দেশে মসজিদুল আকসার চিত্র তুলে ধরেন। রাসূলুল্লাহ (স:) তা দেখে দেখে সব বলে দিলেন।
রাসূলুল্লাহ (স:) সেই মসজিদে গিয়েছিলেন, নামাজও আদায় করেছিলেন অথচ মসজিদের দরজ-জানালা ইত্যাদির কথা স্মরণ না থাকার কারনে তার সামনে সমজিদের চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। যদি তিনি হাযির-নাযির ও আলিমুল গাইব হতেন তবে মসজিদের চিত্র তার সামনে তুলে ধরার প্রয়োজন ছিল না। উক্ত ঘটনা হাদীসের কিতাবসমূহে লিপিবদ্ধ আছে।

পঞ্চম ঘটনা :
একবার কতিপয় মুনাফিক এসে নবী করীম (স:) কে বলল, আমরা মুসলমান হয়েছি। আমাদেরকে কিছু ক্বারী দিন। তিনি তাদের কথা বিশ্বাস করে তাদের সাথে দশজন ক্বারী দিলেন। পথিমধ্যে তারা ক্বারীদের হত্যা করে। তিনি আলিমুল গাইব হলে তাদেরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতেন না।

আমরা বিশ্বাস করি নবুওয়াতের জন্য প্রয়োজনীয় সব জ্ঞান রাসূলুল্লাহ (স:) কে দেয়া হয়েছিল। তার পূর্বে কত নবী-রাসূল এসেছেন, যেহেতু এটা নবুওয়াতের সাথে সম্পৃক্ত নয় তাই সব নবীদের কথা তাকে বলা হয়নি। যেহেতু সাগরে কত ফোটা পানি আছে, পশুর শরীরে কত লোম আছে, মরুভূমিতে কত বালকণা আছে, গাছে কত পাতা আছে, আকাশে কত তারকারাজি আছে ইত্যাদি জানা নবুওয়াতের জন্য অপরিহার্য নয়, তাই এগুলো জানা কোন নবীর কাজ নয়। এসব আল্লাহ জানেন। প্রতিটি জিনিসের হিসাব তার কাছে রয়েছে। তিনি কোন কিছু ভোলেন না
কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, বদরের যুদ্ধে কোন কাফির কোন স্থানে মারা যাবে তা তিনি পূর্বেই বলে দিয়েছিলেন। এরূপ অনেক কথাই তিনি বলেছিলেন যা পরে সত্যি সত্যি সংঘটিত হয়েছিল। তাদের উত্তরে আমরা বলব, তিনি আল্লাহর পক্ষ্য থেকে ওহীপ্রাপ্ত হয়ে অনুরূপ কথা বলেছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, “ এবং তিনি মনগড়া কথা বলেন না, এ তো ওহী যা প্রত্যাদেশ করা হয়।” (সূরা নাজম : 3-4)

রাসূলুল্লাহ (স:) বলেন, “ আমি যখন তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে তোমাদেরকে নির্দেশ দেই তখন তা গ্রহণ করবে। আর আমি যখন আমার নিজের মতানুসারে তোমাদের কোন বিষয়ের নির্দেষ দেই তখন আমি একজন মানুষ।” (মুসলিম শরীফ)।

বদর যুদ্ধে মুজাহিদ বাহিনীকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (স:) প্রথমে এক স্থানে শিবির স্থাপন করলেন। হযরত হুবাব ইবনে মুনযির (রা:) জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (স:)! এই জায়গাটাকি আপনি আল্লাহর নির্দেশেই বছাই করেছেন, যার কাছ থেকে এক চুলও এদিক ওদিক সরতে পারি না, না এটা আপনার নিজের রণকৌশলগত অভিমত ? তিনি বললেন, এটা নেহাত একটা রণকৌশল এবং আমার নিজস্ব অভিমত। হুবাব (রা:) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (স:)! এ জায়গাটা ভাল নয়। অতএব আপনি সবাইকে নিয়ে এখান থেকে এগিয়ে যান। আমরা ঐ কূপের কাছে গিয়ে ছাউনী স্থাপন করবো যা কুরাইশদের অতি নিকটে। এরপর আমরা সেই জায়গার আশেপাশে যে কূপ আছে তা বন্ধ করে দেব। সেখানে একটি হাউয তৈরী করে তাতে পানি ভর রাখব। পরে আমরা শত্রুদের সাথে লড়াই করব। তখন আমরা পানি পান করতে পারবো কিন্তু ওরা পারবে না। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (স:) বললেন, “তুমি ঠিকই বিলেছ”। এরপর তিনি সবাইকে নিয়ে কুরাইশদের নিকটে অবস্থিত কূপের কাছে পৌছলেন এবং সেখানে তাবু ফেললেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম)
রাসূলুল্লাহ (স:) আলিমুল গায়েব হলে প্রথমেই উক্ত স্থানে তাবু ফেলতেন। এ থেকে এ কথাও জানা গেল যে, রাসূলুল্লাহ (স:) ব্যক্তিগত অভিমত কখনো পরিত্যাগ করে সাহাবীদের অভিমত গ্রহণ করেছেন।
কুরআন ও হাদীস শরীআতের মূল উৎস। কুরআনের সাথে হাদীসের বাহ্যিক বৈপরিত্য দেখা দিলে কুরআনের উপর আমল করতে হবে। আর কুরআনের অস্পষ্ট আয়াতের মুকাবেলায় সুস্পষ্ট আয়াতের অনুসরণ করতে হবে। যারা দ্ব্যর্থবোধক অস্পষ্ট আয়াতের অনুসরণ করে তাদের সম্বন্ধে আল্লাহ পাক বলেন, “ তিনিই আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত আছে সুস্পষ্ট, সেগুলোই কিতাবের মূল অংশ। আর অন্যগুলো অস্পষ্ট সুতরাং যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে তারা ফিৎনা ও অপব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে তন্মধ্যেকার অস্পষ্টগুলোর অনুসরণ করে। আর সেগুলোর ব্যাখ্যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। (সূরা আল-ইমরান : 07)
রাসূলুল্লাহ (স:) বলেন, আমি তোমাদের মধ্যে দুটি বিষয় ছেড়ে গেলাম। যতদিন এ দুটি শক্তভাবে আকড়ে থাকবে ততদিন তোমরা গোমরাহ হবে না, আল্লাহর কিতাব ও তার রাসূলের সুন্নাত। ( মিশকাত)

সুন্নীরা তাদের সুন্নীয়্যাত (মূলত শির্ক, বেদাত) প্রমাণ করার জন্য যে সকল মিথ্যা ও দূর্বল হাদীস বয়ান করে থাকে :

১. আপনি না হলে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতাম না
এ ধরণের বানোয়াট কথগুলির একটি হলো:
لـولاك لما خـلقـت الأفـلاك
“আপনি না হলে আমি আসমান যমিন বা মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতাম না।”

আল্লামা সাগানী, মোল্লা আলী কারী, আব্দুল হাই লাখনবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস একবাক্যে কথাটিকে বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ এই শব্দে এই বাক্য কোনো হাদীসের গ্রন্থে কোনো প্রকার সনদে বর্ণিত হয় নি।
এখানে উল্লেখ্য যে, এই শব্দে নয়, তবে এই অর্থে দুর্বল বা মাওযূ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এখানে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করছি।
=============================================
২. আরশের গায়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ) -এর নাম
একটি যয়ীফ বা বানোয়াট হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لما اقترف آدم الخطيئة قال يا رب أسألك بحق محمد لما غفرت لي فقال الله يا آدم وكيف عرفت محمدا ولم أخلقه قال يا رب لأنك لما خلقتني بيدك ونفخت في من روحك رفعت رأسي فرأيت على قوائم العرش مكتوبا لا إله إلا الله محمد رسول الله فعلمت أنك لم تضف إلى اسمك إلا أحب الخلق إليك فقال الله صدقت يا آدم إنه لأحب الخلق إلي ادعني بحقه فقد غفرت لك ولولا محمد ما خلقتك
“হযরত আদম (আ:) যখন (নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণ করে) ভুল করে ফেলেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেন: হে প্রভু, আমি মুহাম্মাদের হক্ক (অধিকার) দিয়ে আপনার কাছে প্রার্থনা করছি যে আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। তখন আল্লাহ বলেন, হে আদম, তুমি কিভাবে মুহাম্মাদকে (সঃ) চিনলে, আমি তো এখনো তাঁকে সৃষ্টিই করিনি? তিনি বলেন, হে প্রভু, আপনি যখন নিজ হাতে আমাকে সৃষ্টি করেন এবং আমার মধ্যে আপনার রূহ ফুঁ দিয়ে প্রবেশ করান, তখন আমি মাথা তুলে দেখলাম আরশের খুঁটি সমূহের উপর লিখা রয়েছে: (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ)।

এতে আমি জানতে পারলাম যে, আপনার সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি বলেই আপনি আপনার নামের সাথে তাঁর নামকে সংযুক্ত করেছেন। তখন আল্লাহ বলেন, হে আদম, তুমি ঠিকই বলেছ। তিনিই আমার সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি। তুমি আমার কাছে তাঁর হক্ক (অধিকার) দিয়ে চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। মুহাম্মাদ (সঃ) না হলে আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না।”


ইমাম হাকিম নাইসাপূরী হাদীসটি সংকলিত করে একে সহীহ বলেছেন। কিন্তু সকল মুহাদ্দিস একমত যে হাদীসটি যয়ীফ। তবে মাউযূ কিনা তাতে তারা মতভেদ করেছেন। ইমাম হাকিম নিজেই অন্যত্র এই হাদীসের বর্ণনাকারীকে মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন।

আমি ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ইমাম হাকিম অনেক যয়ীফ ও মাউযূ হাদীসকে সহীহ বলেছেন এবং ইমাম ইবনুল জাওযী অনেক সহীহ বা হাসান হাদীসকে মাউযূ বলেছেন। এজন্য তাদের একক মতামত মুহাদ্দিসগণের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়, বরং তাঁদের মতামত তাঁরা পুনর্বিচার ও নিরীক্ষা করেছেন।

এই হাদীসটির সনদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে সনদটি খুবই দুর্বল, যেকারণে অনেক মুহাদ্দিস একে মাউযূ হাদীস বলে গণ্য করেছেন। হাদীসটির একটিই সনদ: আবুল হারিস আব্দুল্লাহ ইবনু মুসলিম আল-ফিহরী নামক এক ব্যক্তি দাবী করেন, ইসমাঈল ইবনু মাসলামা নামক একব্যক্তি তাকে বলেছেন, আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম তার পিতা, তার দাদা থেকে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা:) থেকে বর্ণনা করেছেন।

বর্ণনাকারী আবুল হারিস একজন অত্যন্ত দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। এছাড়া আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম (১৮২ হি) খুবই দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী ছিলেন। মুহাদ্দিসগণ তাঁর বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করেন নি। কারণ তিনি কোনো হাদীস ঠিকমত বলতে পারতেন না, সব উল্টোপাল্টা বর্ণনা করতেন। ইমাম হাকিম নাইসাপূরী নিজেই তার ‘মাদখাল ইলা মা’রিফাতিস সহীহ’ গ্রন্থে বলেছেন: “আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম তার পিতার সূত্রে কিছু মাউযূ বা জাল হাদীস বর্ণনা করেছেন। হাদীস শাস্ত্রে যাদের অভিজ্ঞতা আছে, তারা একটু চিন্তা করলেই বুঝবেন যে, এ সকল হাদীসের জালিয়াতির অভিযোগ আব্দুর রাহমানের উপরেই বর্তায়।”

এই হাদীসটি উমার (রা) থেকে অন্য কোন তাবেয়ী বলেন নি, আসলাম থেকেও তাঁর কোন ছাত্র তা বর্ণনা করেন নি। যাইদ ইবনু আসলাম প্রসিদ্ধ আলেম ছিলেন। তাঁর অনেক ছাত্র ছিল। তাঁর কোন ছাত্র এই হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। শুধুমাত্র আব্দুর রহমান দাবী করেছেন যে তিনি এই হাদীসটি তাঁর পিতার নিকট শুনেছেন। তার বর্ণিত সকল হাদীসের তুলনামূলক নিরীক্ষা করে ইমামগণ দেখেছেন তাঁর বর্ণিত অনেক হাদীসই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা পর্যায়ের। এজন্য ইমাম যাহাবী, ইবনু হাজার ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে মাউযূ বলে চিহ্নিত করেছেন। ইমাম বাইহাকী হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বলেছেন যে, এই কথাটি মূলত ইহূদী-খৃস্টানদের মধ্যে প্রচলিত শেষ নবী বিষয়ক কথা; যা কোনো কোনো সাহাবী বলেছেন। অন্য একটি দুর্বল সনদে এই কথাটি উমার (রা) এর নিজের কথা হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু আব্দুর রহমান অন্যান্য অনেক হাদীসের মত এই হাদীসেও সাহাবীর কথাকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর কথা হিসাবে বর্ণনা করেছেন।


======================>

এই মর্মে আরেকটি যয়ীফ হাদীস আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাসের কথা হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। এই হাদীসটিও হাকিম নাইসাপূরী সংকলন করেছেন। তিনি জানদাল ইবনু ওয়ালিক এর সূত্রে বলেন, তাকে আর্ম ইবনু আউস আল-আনসারী নামক দ্বিতীয় শতকের এক ব্যক্তি বলেছেন, তাকে প্রখ্যাত তাবে তাবেয়ী সাঈদ ইবনু আবূ আরূবাহ (১৫৭ হি) বলেছেন, তাকে প্রখ্যাত তাবিয়ী কাতাদা ইবনু দিআমাহ আস-সাদূসী (১১৫ হি) বলেছেন, তাকে প্রখ্যাত তাবিয়ী সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব (৯১হি) বলেছেন, তাকে ইবনু আব্বাস (রা) বলেছেন:
أوحى الله إلى عيسى يا عيسى آمن بمحمد وأمر من أدركه من أمتك أن يؤمنوا به فلولا محمد ما خلقت آدم ولولا محمد ما خلقت الجنة ولا النار ولقد خلقت العرش على الماء فاضطرب فكتبت عليه لا إله إلا الله محمد رسول الله فسكن
“মহান আল্লাহ ঈসা (আ)-এর প্রতি ওহী প্রেরণ করে বলেন, তুমি মুহাম্মাদের উপরে ঈমান আনয়ন কর এবং তোমার উম্মাতের যারা তাঁকে )পাবে তাদেরকে তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নের নির্দেশ প্রদান কর। মুহাম্মাদ ( ) না হলে জান্নাত ও জাহান্নামওনা হলে আদমকে সৃষ্টি করতাম না। মুহাম্মাদ ( সৃষ্টি করতাম না। আমি পানির উপরে আরশ সৃষ্টি করেছিলাম। তখন আরশ কাঁপতে শুরু করে। তখন আমি তার উপরে লিখলাম: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’; ফলে তা শান্ত হয়ে যায়।”
---------------------------
ইমাম হাকিম হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন, হাদীসটির সনদ সহীহ। ইমাম যাহাবী তার প্রতিবাদ করে বলেন, “বরং হাদীসটি মাউযূ বলেই প্রতীয়মান হয়।” কারণ এই হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী এই ‘আর্ম ইবনু আউস আল-আনসারী’ নামক ব্যক্তি। সে প্রসিদ্ধ কয়েকজন মুহাদ্দিসের নামে হাদীসটি বর্ণনা করেছে। অথচ এদের অন্য কোনো ছাত্র এই হাদীসটি তাদের থেকে বর্ণনা করেনি। এই লোকটি মূলত একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। তার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। এই জানদাল ইবনু ওয়ালিক ছাড়া অন্য কোনো রাবী তার নাম বলেন নি বা তার কোনো পরিচয়ও জানা যায় না। এজন্য ইমাম যাহাবী ও ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী বলেন যে, এই হাদীসটি ইবনু আব্বাসের নামে বানানো জাল বা মিথ্যা হাদীস। এই অর্থে আরো জাল হাদীস মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন।

4. নূরে মুহাম্মাদীই (সঃ) প্রথম সৃষ্টি
উপরের হাদীসগুলি আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত নয়, যদিও হাদীসগুলি বিভিন্ন গ্রন্থে সনদসহ বা সনদ বিহীনভাবে সংকলিত হয়েছে এবং মুহাদ্দিসগণ এগুলির সনদ আলোচনা করে জাল ও মিথ্যা বলে উল্লেখ করেছেন। বিশেষত, ‘মুমিন আল্লাহর নূরে সৃষ্টি’ এই হাদীসটি দাইলামীর গ্রন্থে রয়েছে। এই গ্রন্থের অনেক জাল হাদীসই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, কিন্তু এই হাদীসটি আমাদের সমাজে প্রসিদ্ধ নয়। পক্ষান্তরে একটি ‘হাদীস’ যা কোনো হাদীসের গ্রন্থে সংকলিত হয় নি, কোথাও কথাটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না, সেই কথাটি আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত। শুধু প্রচলিতই নয়, এই সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, সনদহীন কথাটি সর্ববাদীসম্মত মহাসত্যের রূপ গ্রহণ করেছে এবং তা ইসলামী বিশ্বাসের অংশ হিসাবে স্বীকৃত। এমনকি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের স্বীকৃত ‘আকীদা ও ফিকহ’ গ্রন্থেও যা ‘হাদীস’ হিসাবে উল্লিখিত।
হাদীসটি নিম্নরূপ:
أّوَّلُ مَا خَـلَـقَ اللهُ نُـوْرِيْ
“আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন”।
একটি সুদীর্ঘ হাদীসের অংশ হিসাবে হাদীসটি প্রচলিত। হাদীসটির সার সংক্ষেপ হলো, জাবির (রা) রাসুলুল্লাহ (সঃ)-কে প্রশ্ন করেন, আল্লাহ সর্বপ্রথম কী সৃষ্টি করেন? উত্তরে তিনি বলেন:

أوَّلُ مَا خَـلَـقَ اللهُ نُـوْرَ نَبِيِّـك مِـنْ نُـوْرِهِ….
“সর্বপ্রথম আল্লাহ তোমার নবীর নূরকে তার নূর থেকে সৃষ্টি করেন।”
=> এরপর এই লম্বা হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই নূরকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে তা থেকে আরশ, কুরসী, লাওহ, কলম, ফিরিশতা, জিন, ইনসান এবং সমগ্র বিশ্বকে সৃষ্টি করা হয়।….
কথাগুলি ভাল। যদি রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর নামে মিথ্যা কথা বলার বা যা শুনব তাই বলার অনুমতি থাকতো তাহলে আমরা তা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতাম ও বলতাম। কিন্তু যেহেতু তা নিষিদ্ধ তাই বাধ্য হয়ে আমাদেরকে প্রতিবাদ করতে হয়।
রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর নূরকে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করা হয়েছে, বা তাঁর নূর থেকে বিশ্ব বা অন্যান্য সৃষ্টিকে সৃষ্টি করা হয়েছে অর্থে যা কিছু প্রচলিত সবই ভিত্তিহীন বানোয়াট ও মিথ্যা কথা।

=> কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, হাদীসটি বাইহাকী বা আব্দুর রায্যাক সান‘আনী সংকলন করেছেন। এই দাবিটি ভিত্তিহীন। আব্দুর রায্যাক সান‘আনীর কোনো গ্রন্থে বা বাইহাকীর কোনো গ্রন্থে এই হাদীসটি নেই। কোনো হাদীসের গ্রন্থেই এই কথাটির অস্তিত্ব নেই।

=> সহীহ, যয়ীফ এমনকি মাউযূ বা মিথ্যা সনদেও এই হাদীসটি কোনো হাদীসের গ্রন্থে সংকলিত হয়নি। সাহাবীগণের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত শত শত হাদীসের গ্রন্থ লিপিবদ্ধ ও সংকলিত হয়েছে, যে সকল গ্রন্থে সনদসহ হাদীস সংকলিত হয়েছে।

=> আমাদের সমাজে প্রচলিত যে কোনো হাদীস এ সকল গ্রন্থের অধিকাংশ গ্রন্থে পাওয়া যাবে। যে কোনো হাদীস আপনি খুঁজে দেখুন, অন্তত ১০/১৫ টি গ্রন্থে তা পাবেন। অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ বা প্রসিদ্ধ হাদীস আপনি প্রায় সকল গ্রন্থে দেখতে পাবেন। অর্থাৎ, এ ধরনের যে কোনো একটি হাদীস আপনি ৩০/৩৫ টি হাদীসের গ্রন্থে এক বা একাধিক সনদে সংকলিত দেখতে পাবেন। কিন্তু হাদীস নামের أول ما خلق الله نوري এই বাক্যটি খুঁজে দেখুন, একটি হাদীস গ্রন্থেও পাবেন না। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর যুগ থেকে পরবর্তী শত শত বৎসর পর্যন্ত কেউ এই হাদীস জানতেন না। কোনো গ্রন্থেও লিখেননি। এমনকি সনদবিহীন সিরাতুন্নাবী, ইতিহাস, ওয়ায বা অন্য কোনো গ্রন্থেও তা পাওয়া যায় না।

=> যতটুকু জানা যায়, ৭ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ আলিম মুহিউদ্দীন ইবনু আরাবী আবূ বাক্র মুহাম্মাদ ইবনু আলী তাঈ হাতিমী (৫৬০-৬৩৮হি/১১৬৫-১২৪০খৃ) সর্বপ্রথম এই কথাগুলিকে ‘হাদীস’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইবনু আরাবী তাঁর পুস্তকাদিতে অগণিত জাল হাদীস ও বাহ্যত ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক অনেক কথা উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী যুগে বুযুর্গগণ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বশত এ সকল কথার বিভিন্ন ওযর ও ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। আবার অনেকে কঠিনভাবে আপত্তি করেছেন। বিশেষত মুজাদ্দিদে আলফে সানী হযরত আহমদ ইবনু আব্দুল আহাদ সারহিন্দী (১০৩৪ হি) ইবনু আরাবীর এ সকল জাল ও ভিত্তিহীন বর্ণনার প্রতিবাদ করেছেন বারংবার। কখনো কখনো নরম ভাষায়, কখনো কঠিন ভাষায়।

এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন : “আমাদের নস্স বা কুরআন ও হাদীসের পরিষ্কার অকাট্য বাণীর সহিত কারবার, ইবনে আরাবীর কাশফ ভিত্তিক ফস্স বা ফুসূসুল হিকামের সহিত নহে। ফুতূহাতে মাদানীয়া বা মাদানী নবী (সঃ) -এর হাদীস আমাদেরকে ইবনে আরাবীর ফতূহাতে মাক্কীয়া জাতীয় গ্রন্থাদি থেকে বেপরওয়া করিয়া দিয়াছেন।” অন্যত্র প্রকৃত সূফীদের প্রশংসা করে লিখেছেন : “তাহারা নসস, কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট বাণী,পরিত্যাগ করত শেখ মহিউদ্দীন ইবনে আরাবীর ফসস বা ফুসূসুল হিকাম পুস্তকে লিপ্ত হন না এবং ফুতূহাতে মাদানীয়া, অর্থাৎ হাদীস শরীফ বর্জন করত ইবনে আরাবীর ফুতূহাতে মাক্কীয়ার প্রতি লক্ষ্য করেন না।” “… নস্স বা আল্লাহর বাণী পরিত্যাগ করত ফসস বা মহিউদ্দীন আরবীর পুস্তক আকাক্সক্ষা করেন না এবং ফতূহাতে মাদানীয়া বা পবিত্র হাদীস বর্জন করত ফুতূহাতে মাক্কিয়া পুস্তকের দিকে লক্ষ্য করেন না।”
সর্বাবস্থায়, ইবনু আরাবী এই বাক্যটির কোনো সূত্র বা উৎস উল্লেখ করেন নি। কিন্তু তিনি এর উপরে তাঁর প্রসিদ্ধ সৃষ্টিতত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেন। খৃস্টান ধর্মাবলম্বীদের লোগোস তত্ত্বের আদলে তিনি ‘নূরে মুহাম্মাদী তত্ত্ব’ প্রচার করেন।

খৃস্টানগণ দাবি করেন যে, ঈশ্বর সর্বপ্রথম তার নিজের ‘জাত’ বা সত্ত্বা থেকে ‘কালেমা’ বা পুত্রকে সৃষ্টি করেন এবং তার থেকে তিনি সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেন। ইবনু আরাবী বলেন, আল্লাহ সর্বপ্রথম নূরে মুহাম্মাদী সৃষ্টি করেন এবং তার থেকে সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেন।
ক্রমান্বয়ে কথাটি ছড়াতে থাকে। বিশেষত ৯/১০ম হিজরী শতক থেকে লেখকগণের মধ্যে যাচাই ছাড়াই অন্যের কথার উদ্ধৃতির প্রবণতা বাড়তে থাকে। শ্রদ্ধাবশত বা ব্যস্ততা হেতু অথবা অন্যান্য বিভিন্ন কারণে নির্বিচারে একজন লেখক আরেকজন লেখকের নিকট থেকে গ্রহণ করতে থাকেন। যে যা শুনেন বা পড়েন তাই লিখতে থাকেন, বিচার করার প্রবণতা কমতে থাকে।
দশম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ আলিম আল্লামা আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ আল-কাসতালানী (৯২৩ হি) তার রচিত প্রসিদ্ধ সীরাত-গ্রন্থ ‘আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া’ গ্রন্থে এই হাদীসটি ‘মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাকে’ সংকলিত রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। আগেই বলেছি, হাদীসটি মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক বা অন্য কোনো হাদীস গ্রন্থে বা কোথাও সনদ-সহ সংকলিত হয় নি। আল্লামা কাসতালানী যে কোনো কারণে ভুলটি করেছেন। কিন্তু এই ভুলটি পরবর্তীকালে সাধারণভুলে পরিণত হয়। সকলেই লিখছেন যে, হাদীসটি ‘মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাকে’ সংকলিত। কেউই একটু কষ্ট করে গ্রন্থটি খুঁজে দেখতে চাচ্ছেন না। সারা বিশ্বে ‘মুসান্নাফ’, ‘দালাইলুন নুবুওয়াহ’ ও অন্যান্য গ্রন্থের অগণিত পাণ্ডুলিপি রয়েছে। এছাড়া গ্রন্থগুলি মুদ্রিত হয়েছে। যে কেউ একটু কষ্ট করে খুঁজে দেখলেই নিশ্চিত হতে পারেন। কিন্তু কেউই কষ্ট করতে রাজি নয়। ইমাম সুয়ূতী ও অন্যান্য যে সকল মুহাদ্দিস এই কষ্টটুকু করেছেন তাঁরা নিশ্চিত করেছেন যে, এই হাদীসটি ভিত্তিহীন ও অস্তিত্বহীন কথা।

গত কয়েক শত বৎসর যাবৎ এই ভিত্তিহীন কথাটি ব্যাপকভাবে মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। সকল সীরাত লেখক, ওয়ায়েয, আলেম এই বাক্যকে এবং এ সকল কথাকে হাদীসরূপে উল্লেখ করে চলেছেন।

এই ভিত্তিহীন ‘হাদীস’টি, ইসলামের প্রথম ৫০০ বৎসরে যার কোনোরূপ অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না, তা বর্তমানে আমাদের মুসলিম সমাজে ঈমানের অংশে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ থেকে অত্যন্ত কঠিন একটি বিভ্রান্তি জন্ম নিয়েছে। উপরে আমরা দেখেছি যে, এই ভিত্তিহীন জাল ‘হাদীস’টিতে বলা হয়েছে: ‘আল্লাহ তাঁর নূর থেকে নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন।” এ থেকে কেউ কেউ বুঝেছেন যে, তাহলে আল্লাহর সত্তা বা ‘যাত’ একটি নূর বা নূরানী বস্তু। এবং আল্লাহ স্বয়ং নিজের সেই যাতের বা সত্ত্বার অংশ থেকে তার নবীকে তৈরি করেছেন। কী জঘন্য শিরক! এভাবেই খৃস্টানগণ বিভ্রান্ত হয়ে শিরকে লিপ্ত হয়।

প্রচলিত বাইবেলেও যীশু খৃস্ট বারংবার বলছেন যে, আমি মানুষ, আমাকে ভাল বলবে না, আমি কিছুই জানি না, ঈশ্বরই ভাল, তিনিই সব জানেন, একমাত্র তাঁরই ইবাদত কর… ইত্যাদি। তবে যীশু ঈশ্বরকে পিতা ডেকেছেন। হিব্র“ ভাষায় সকল নেককার মানুষকেই ঈশ্বরের সন্তান, ঈশ্বরের পুত্র ইত্যাদি বলা হয় এবং ঈশ্বরকে পিতা ডাকা হয়। তিনি বলেছেন: ‘যে আমাকে দেখল সে ঈশ্বরকে দেখল’। এইরূপ কথা সকল নবীই বলেন।

কিন্তু ভণ্ড পৌল থেকে শুরু করে অতিভক্তির ধারা শক্তিশালী হতে থাকে। ক্রমান্বয়ে খৃস্টানগণ দাবি করতে থাকেন যীশু ঈশ্বরের ‘জাতের অংশ’। ঈশ্বর তার সত্ত্বা বা যাতের অংশ দিয়ে পুত্রকে সৃষ্টি করেন…। ৪র্থ-৫ম শতাব্দী পর্যন্ত আলেকজেন্দ্রিয়ার প্রসিদ্ধ খৃস্টান ধর্মগুরু আরিয়াস (অৎরঁং) ও তার অনুসারীগণ যীশুকে ঈশ্বরের সত্ত্বার অংশ নয়, বরং সৃষ্ট বা মাখলূক বলে প্রচার করেছেন। কিন্তু অতিভক্তির প্লাবনে তাওহীদ হেরে যায় ও শিরক বিজয়ী হয়ে যায়।
এই মুশরিক অতি ভক্তগণও সমস্যায় পড়ে গেল। বাইবেলেরই অগণিত আয়াতে যীশু স্পষ্ট বলছেন যে, আমি মানুষ। তিনি মানুষ হিসেবে তাঁর অজ্ঞতা স্বীকার করছেন। এখন সমাধান কী? তাঁরা ‘দুই প্রকৃতি তত্ত্বে’-র আবিষ্কার করলেন। তারা বললেন, খৃস্টের মধ্যে দুটি সত্তা বিদ্যমান ছিল। মানবীয় সত্তা অনুসারে তিনি এ কথা বলেছেন। তবে প্রকৃতপক্ষে তিনি ঈশ্বর ছিলেন…।
মুসলিম সমাজের অনেকে আজ এ ভাবে শিরকের মধ্যে নিপতিত হচ্ছেন। এই হাদীসটি যদি সহীহ বলে প্রমাণিত হতো তাহলেও এর দ্বারা একথা বুঝা যেত না। আল্লাহ আদমের মধ্যে ‘তাঁর রূহ’ দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। ঈসা (আ)-কে ‘আল্লাহর রূহ’ বলা হয়েছে। এতে কখনোই তাঁর নিজের রূহের অংশ বুঝানো হয় নি। বরং তার তৈরি ও সৃষ্ট রূহ বুঝানো হয়েছে। অনুরূপভাবে ‘তাঁর নূর’ বলতেও একই কথা বুঝানো হয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
আমাদের উচিত কুরআন কারীমের আয়াত ও সহীহ হাদীসগুলির উপর নির্ভর করা এবং ভিত্তিহীন কথাগুলি রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর নামে না বলা।
===========================================
4. নূরে মুহাম্মাদীর ময়ূর রূপে থাকা
এ বিষয়ক প্রচলিত অন্যান্য কাহিনীর মধ্যে রয়েছে নূরে মুহাম্মাদীকে ময়ূর আকৃতিতে রাখা। এ বিষয়ক সকল কথাই ভিত্তিহীন। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা মাউযূ হাদীসের গ্রন্থে এর কোনো প্রকার সনদ, ভিত্তি বা উল্লেখ পাওয়া যায় না। বিভিন্ন ভাবে গল্পগুলি লেখা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তায়ালা শাজারাতুল ইয়াকীন নামক একটি বৃক্ষ সৃষ্টি করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নূর মোবরককে একটি ময়ূর আকৃতি দান করত স্বচ্ছ ও শুভ্র মতির পর্দার ভিতরে রেখে তাকে সেই বৃক্ষে স্থাপন করলেন… ক্রমান্বয়ে সেই নূর থেকে সব কিছু সৃষ্টি করলেন… রূহগণকে তাঁর দিকে দৃষ্টিপাত করতে নির্দেশ দিলেন…. ইত্যাদি
5. রাসূলুল্লাহ (সঃ) তারকা-রূপে ছিলেন
আমাদের দেশে প্রচলিত ধারণা, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আদম সৃষ্টির পূর্বে তারকারূপে )বিদ্যমান ছিলেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন ভাষ্য প্রচলিত। যেমন, রাসূলুল্লাহ ( ফাতেমাকে (রা) বলেন, জিবরাঈল তোমার ছোট চাচা… ইত্যাদি। এ বিষয়ে প্রচলিত সকল কথাই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।
আমাদের দেশের সুপ্রসিদ্ধ একটি ইসলামী কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত একটি খুতবার বইয়ে লেখা হয়েছে:
عن : إنه سأل جبرائيل فقال: يا جبرائيل، كم قال: قال رسول الله أبي هريرة عمرت من السنين؟ فقال: يا رسول الله، لست أعلم غير أن في الحجاب الرابع نجماً يطلع في كل سبعين ألف سنة مرة، رأيته اثنين وسبعين ألف مرة. فقال: يا جبرائيل، وعزة ربي جلا جلاله، أنا ذلك الكوكب. رواه البخاري
উপরের কথাগুলির অনুবাদে উক্ত পুস্তকে বলা হয়েছে: “হযরত আবূ হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত, হযরত রাসূলে কারীম (সঃ) হযরত জিব্রাঈল (আ)-কে জিজ্ঞেস করেন, হে জিব্রাঈল, আপনার বয়স কত? তিনি উত্তর দিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি এ সম্পর্কে কিছু জানি না। তবে এতটুকু বলতে পারি যে, চতুর্থ পর্দায় (আসমানে) একটি সিতারা আছে যা প্রতি ৭০ হাজার বছর পর সেখানে উদিত হয়। আমি উহা এ যাবত ৭০ হাজার বার উদিত হতে দেখেছি। এতদশ্রবণে হুজুর (সঃ) বল্লেন, হে জিব্রাঈল, শপথ মহান আল্লাহর ইজ্জতের, আমি সেই সিতারা। (বুখারী শরীফ)।”

এ সকল কথা সবই ভিত্তিহীন মিথ্যা কথা যা হাদীস নামে প্রচলন করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, এই ভিত্তিহীন কথাটিকে বুখারী শরীফের বরাত দিয়ে চালানো হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, সীরাহ হালাবিয়া গ্রন্থের লেখক একজন অজ্ঞাতনামা লেখকের উপর নির্ভর করে এই জাল হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু আমরা কি একটু যাচাই করব না? এ সকল ইসলামী কেন্দ্রে এমন অনেক আলিম রয়েছেন যারা যুগ যুগ ধরে ‘বুখারী’ পড়াচ্ছেন। বুখারী শরীফের অনেক কপি সেখানে বিদ্যমান। কিন্তু কেউই একটু কষ্ট করে পুস্তকটি খুলে দেখার চেষ্টা করলেন না। শুধু সহীহ বুখারীই নয়, বুখারীর লেখা বা অন্য কারো লেখা কোনো হাদীসের গ্রন্থেই এই কথাটি সনদ-সহ বর্ণিত হয় নি। অথচ সেই জাল কথাটিকে বুখারীর নামে চালানো হলো।

কেউ কেউ এই ভিত্তিহীন কথাটিকে শুধু বুখারীর নামে চালানোর চেয়ে ‘বুখারী ও মুসলিম’ উভয়ের নামে চালানোকে উত্তম (!) বলে মনে করেছেন। উক্ত প্রসিদ্ধ দ্বীনী কেন্দ্রের একজন সম্মানিত মুহাদ্দিস, যিনি বহু বৎসর যাবত ছাত্রদেরকে ‘সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম’ পড়িয়েছেন তিনি এই হাদীসটি উল্লেখ করে লিখেছেন: “মুসলিম শরীফ ও বুখারী শরীফ”।
আমরা মনে করি যে, এ সকল বুযুর্গ ও আলিম জেনেশুনে এইরূপ মিথ্যা কথা বলেন নি। তাঁরা অন্য আলিমদের উদ্ধৃতির উপর নির্ভর করেছেন। কিন্তু আলিমদের জন্য এটি কখনোই গ্রহণযোগ্য ওযর নয়। এখন আমরা যতই বলি না কেন, যে এই হাদীসটি বুখারী শরীফ বা মুসলিম শরীফের কোথাও নেই, আপনারা সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম খুলে অনুসন্ধান করুন… সাধারণ মুসলমান ও ভক্তগণ সে সকল কথায় কর্ণপাত করবেন না। তাঁরা কোনোরূপ অনুসন্ধান বা প্রমাণ ছাড়াই বলতে থাকবেন, এতবড় আলিম কি আর না জেনে লিখেছেন!

5.রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নূরত্ব বনাম মানবত্ব
নূরে মুহাম্মাদী বিষয়ে আরো অনেক জাল ও সনদবিহীন কথা ইবনু আরাবীর পুস্তকাদি, সীরাহ হালাবিয়া, শারহুল মাওয়াহিব ইত্যাদি পুস্তকে বিদ্যমান। এসকল পুস্তকের উপর নির্ভর করে আমাদের দেশে ‘সাইয়েদুল মুরসালীন’ ও অন্যান্য সীরাতুন্নবী বিষয়ক পুস্তকে এগুলি উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলির বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব হচ্ছে না। সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে নূর দ্বারা তৈরি করা হয়েছে অর্থে বর্ণিত ও প্রচলিত সকল হাদীসই বানোয়াট। পাঠক একটু খেয়াল করলেই বিষয়টি অনুভব করতে পারবেন। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ হিজরী শতাব্দীতে ‘সিহাহ সিত্তাহ’ সহ অনেক হাদীসের গ্রন্থ সংকলন করা হয়েছে। এ সকল গ্রন্থে অনেক ‘অতি সাধারণ’ বিষয়েও অনেক হাদীস সংকলন করা হয়েছে। সহীহ, হাসান ও যয়ীফ হাদীসের পাশাপাশি অনেক জাল হাদীসও কোনো কোনো পুস্তকে সংকলন করা হয়েছে। কিন্তু ‘রাসূলুল্লাহ (সঃ) নূর দ্বারা তৈরি’ অর্থে একটি হাদীসও কোনো পুস্তকে পাওয়া যায় না।

মুহাদ্দিসগণ হাদীসের গ্রন্থসমূহে কত ছোটখাট বিষয়ে অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ লিখেছেন। অথচ ‘নূরে মুহাম্মাদী’ বিষয়ে কোনো মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রন্থে একটি অনুচ্ছেদও লিখেন নি। অনেক তাফসীরের গ্রন্থে বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যায় অনেক সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু সূরা মায়েদার উপর্যুক্ত ১৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় কোনো প্রাচীন মুফাস্সিরই রাসূলুল্লাহর নূর থেকে সৃষ্টি বিষয়ক কোনো হাদীস উল্লেখ করেন নি।

ইতিহাস ও সীরাত বিষয়ক বইগুলিতে অগণিত যয়ীফ ও ভিত্তিহীন রেওয়ায়াতের ভিত্তিতে অনেক অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ রচনা করা হয়েছে। কিন্তু ইসলামের প্রথম ৫০০ বৎসরে লেখা কোনো একটি ইতিহাস বা সীরাত গ্রন্থে ‘নূরে মুহাম্মাদী’ বিষয়টি কোনোভাবে আলোচনা করা হয় নি। আসলে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যুগ থেকে পরবর্তী ৫/৬ শত বৎসর পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর কোনো ব্যক্তি বা দল ‘নূরে মুহাম্মাদী’ তত্ত্বের কিছুই জানতেন না।

=============================================
এখন আমাদের সামনে শুধু থাকল সূরা মায়েদার ১৫ নং আয়াতটি, যে আয়াতের তাফসীরে কোনো কোনো মুফাস্সির বলেছেন যে, এখানে ‘নূর’ বলতে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। এখানে আমাদের করণীয় কী?

আমাদেরকে নিম্নের বিষয়গুলির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে:

(১) কুরআন-হাদীসের নির্দেশনাকে নিজের পছন্দ অপছন্দের ঊর্ধ্বে সর্বান্তকরণে গ্রহণ করার নামই ইসলাম। সুপথপ্রাপ্ত মুসলিমের দায়িত্ব হলো, ওহীর মাধ্যমে যা জানা যাবে তা সর্বান্তকরণে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করা এবং নিজের পছন্দ ও মতামতকে ওহীর অনুগত করা। পক্ষান্তরে বিভ্রান্তদের চিহ্ন হলো, নিজের পছন্দ-অপছন্দ অনুসারে ওহীকে গ্রহণ করা বা বাদ দেওয়া।

(২) কুরআন কারীমে বারংবার অত্যন্ত স্পষ্টভাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে ‘বাশার’ বা মানুষ রূপে ঘোষণা করা হয়েছে। এরশাদ করা হয়েছে: ‘আপনি বলুন, আমি মানুষ রাসূল ভিন্ন কিছুই নই’, ‘আপনি বলুন, ‘আমি তোমাদের মতই মানুষ মাত্র।’ অনুরূপভাবে অগণিত সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বারংবার বলেছেন যে, ‘আমি মানুষ’, ‘আমি তোমাদের মতই মানুষ’।

এর বিপরীতে কুরআন কারীমে বা হাদীস শরীফে এক স্থানেও বলা হয় নি যে, আপনি বলনু ‘আমি নূর’। কোথাও বলা হয় নি যে, ‘মুহাম্মাদ নূর’। শুধু কুরআনের একটি আয়াতের ব্যাখ্যায় কোনো কোনো মুফাস্সির বলেছেন যে, তোমাদের কাছে ‘নূর’ এসেছে বলতে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। এই ব্যাখ্যাও রাসূলুল্লাহ (সঃ) বা কোনো সাহাবী থেকে প্রমাণিত নয়, বরং পরবর্তী কোনো কোনো মুফাস্সির একথা বলেছেন।

(৩) এখন আমরা যদি কুরআন ও হাদীসের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাই তবে আমাদের করণীয় কী তা পাঠক খুব সহজেই বুঝতে পারছেন। আমরা কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন নির্দেশকে দ্ব্যর্থহীনভাবেই গ্রহণ করব। আর মুফাস্সিরদের কথাকে তার স্থানেই রাখব।

আমরা বলতে পারি: কুরআন ও হাদীসের নির্দেশ অনুসারে নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ (সঃ) মানুষ। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় নূর বলতে আমরা ‘কুরআন’-কে বুঝাবো। কারণ কুরআনে স্পষ্টত ‘কুরআন’কে নূর বলা হয়েছে, কিন্তু কুরআন-হাদীসের কোথাও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে স্পষ্টত নূর বলা হয় নি; কাজেই তাঁর বিষয়ে একথা বলা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।

অথবা আমরা বলতে পারি: কুরআন-হাদীসের নির্দেশ অনুসারে নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ (সঃ) মানুষ। তবে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় মানব জাতির পথ প্রদর্শনের আলোক-বর্তিকা হিসেবে তাঁকে নূর বলা যেতে পারে।

(৪) কিন্তু যদি কেউ বলেন যে, তিনি ‘হাকীকতে’ বা প্রকৃত অর্থে নূর ছিলেন, মানুষ ছিলেন না, শুধু মাজাযী বা রূপক অর্থেই তাঁকে মানুষ বলা যেতে পারে, তবে আমরা বুঝতে পারি যে, তিনি নিজের মন-মর্জি অনুসারে কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন নির্দেশনা বাতিল করে এমন একটি মত গ্রহণ করলেন, যার পক্ষে কুরআন ও হাদীসের একটিও দ্ব্যর্থহীন বাণী নেই।
=============================================

রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মর্যাদার প্রাচীনত্ব বিষয়ক সহীহ হাদীস
উপর্যুক্ত বাতিল ও ভিত্তিহীন কথার পরিবর্তে আমাদের সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীসের উপর নির্ভর করা উচিত। সহীহ হাদীসে ইরবাদ ইবনু সারিয়া (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছি:
إني عند الله مكتوب بـخاتـم النبيين وإن آدم لـمنـجدل في طيـنته وسأخبـركم بأول ذلك دعوة أبي إبراهيم وبشارة عيسى ورؤيا أمي التي رأت حيـن وضـعتنـي أنه خرج منها نور أضاءت لها منه قصور الشام
“যখন আদম তার কাদার মধ্যে লুটিয়ে রয়েছেন (তাঁর দেহ তৈরি করা হয়েছে কিন্তু রূহ প্রদান করা হয় নি) সেই অবস্থাতেই আমি আল্লাহর নিকট খাতামুন নাবিয্যীন বা শেষ নবী রূপে লিখিত। আমি তোমাদেরকে এর শুরু সম্পর্কে জানাব। তা হলো আমার পিতা ইবরাহীমের (আ) দোয়া, ঈসার (আ) সুসংবাদ এবং আমার আম্মার দর্শন। তিনি যখন আমাকে জন্মদান করেন তখন দেখেন যে, তাঁর মধ্য থেকে একটি নূর (জ্যোতি) নির্গত হলো যার আলোয় তাঁর জন্য সিরিয়ার প্রাসাদগুলি আলোকিত হয়ে গেল।”

অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন,
قالوا يا رسول الله متى وجبت لك النبوة قال وآدم بين الروح والـجسـد
“তাঁরা (সাহাবীগণ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, কখন আপনার জন্য নবুয়ত স্থিরকৃত হয়? তিনি বলেন: যখন আদম দেহ ও রূহের মধ্যে ছিলেন তখন।”ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান, সহীহ গরীব বলেছেন।

অন্য হাদীসে মাইসারা আল-ফাজর (রা) বলেন,
متى كنت (كتبت) نبيا قال وآدم بين الروح والجسدقلت لرسول الله
“আমি )-কে বললাম, আপনি কখন নবী ছিলেন (অন্য বর্ণনায়: কখন আপনিরাসূলুল্লাহ ( নবী হিসেবে লিখিত হয়েছিলেন?) তিনি বলেন, যখন আদম দেহ ও রূহের মধ্যে ছিলেন।”

হাদীসটি হাকিম সংকলন করেছেন ও সহীহ বলেছেন। যাহাবীও হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন,
متى وجبت لك النبوة قال بين خلق آدم ونفخ الروح فيهقيل للنبي
“নবী কারীম (সা:) কে বলা হলো, কখন আপনার জন্য নবুয়ত স্থিরকৃত হয়? তিনি বলেন, আদমের সৃষ্টি ও তার মধ্যে রূহ ফুঁক দেওয়ার মাঝে।”

এই অর্থে একটি যায়ীফ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ৫ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবূ নু‘আইম ইসপাহানী (৪৩০হি) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটি সংকলন করেছেন। তাঁরা তাঁদের সনদে দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন রাবী সাঈদ ইবনু বাশীর (১৬৯হি) থেকে হাদীসটি গ্রহণ করেছেন। এই সাঈদ ইবনু বাশীর বলেন, আমাকে কাতাদা বলেছেন, তিনি হাসান থেকে, তিনি আবূ হুরাইরা থেকে,

তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন :
كُـنْـتُ أَوَّلَ النَّـبِـيِّـيْنَ فِيْ الْـخَـلْـقِ وَآَخِرُهم في البَعْـثِ
“আমি ছিলাম সৃষ্টিতে নবীগণের প্রথম এবং প্রেরণে নবীগণের শেষ।”

এই সনদে দুটি দুর্বলতা রয়েছে।

প্রথমত, হাসান বসরী মুদাল্লিস রাবী ছিলেন। তিনি এখানে (عن: আন) বা ‘থেকে’ শব্দ ব্যবহার করেছেন।

দ্বিতীয়ত, এই হাদীসের বর্ণনাকারী সাঈদ ইবনু বাশীর হাদীস বর্ণনায় দুর্বল ছিলেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস তাকে চলনসই হিসাবে গণ্য করেছেন। অনেকে তাকে অত্যন্ত দুর্বল বলে গণ্য করেছেন। যাহাবী, ইবনু হাজার আসকালানী প্রমুখ মুহাদ্দিস তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলির নিরীক্ষা করে এবং সকল মুহাদ্দিসের মতামত পর্যালোচনা করে তাকে ‘যয়ীফ’ বা দুর্বল বলে গণ্য করেছেন।

এই হাদীসটিকে কেউ কেউ তাবিয়ী কাতাদার নিজের মতামত ও তাফসীর হিসাবে বর্ণনা করেছেন।

ইবনু কাসীর এই হাদীসের বিষয়ে বলেন,
“সাঈদ ইবনু বাশীরের মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে। সাঈদ ইবনু আবূ আরূবাও হাদীসটি কাতাদার সূত্রে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তিনি কাতাদার পরে হাসান বসরী ও আবূ হুরাইরার নাম বলেন নি, তিনি কাতাদা থেকে বিচ্ছিন্ন সনদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। আর কেউ কেউ হাদীসটিকে কাতাদার নিজের বক্তব্য হিসাবে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহই ভাল জানেন।”

এই সর্বশেষ হাদীসটি ছাড়া উপরের ৪টি হাদীসই সহীহ বা হাসান সনদে বর্ণিত হয়েছে। এ সকল হাদীস স্পষ্টরূপে প্রমাণ করে যে, আদম (আ)-এর সৃষ্টি প্রক্রিয়া পূর্ণ হওয়ার আগেই তাঁর শ্রেষ্ঠতম সন্তান, আল্লাহর প্রিয়তম হাবীব, খালীল ও রাসূল মুহাম্মাদ (সঃ)-এর নবূয়ত, খতমে নবুয়ত ও মর্যাদা সম্পর্কে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

ভিত্তিহীন, সনদবিহীন কথাগুলিকে আন্দাযে, গায়ের জোরে বা বিভিন্ন খোঁড়া যুক্তি দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নামে বলার প্রবণতা ত্যাগ করে এ সকল সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করা আমাদের উচিত।

ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী প্রবর্তন ও প্রবর্তক: একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা

পরম করুণাময় আল্লাহর নামে শুরু করছি। তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা। সালাত ও সালাম মহান রাসূল, আল্লাহর হাবীব ও মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর পরিবারবর্গ ও সঙ্গীদের উপর। আজকের বিশ্বে মুসলিম উম্মার অন্যতম উৎসবের দিন হচ্ছে ‘‘ঈদে মীলাদুন্নবী’’। সারা বিশ্বের বহু মুসলিম অত্যন্ত জাঁকজমক, ভক্তি ও মর্যাদার সাথে আরবী বৎসরের ৩য় মাস রবিউল আউআল মাসের ১২ তারিখে এই ‘‘ঈদে মীলাদুন্নবী’’ বা নবীর জন্মের ঈদ পালন করেন। কিন্তু অধিকাংশ মুসলিমই এই ‘‘ঈদের’’ উৎপত্তি ও বিকাশের ইতিহাসের সাথে পরিচিত নন। যে সকল ব্যক্তিত্ব এই উৎসব মুসলিম উম্মার মধ্যে প্রচলন করেছিলেন তাঁদের পরিচয়ও আমাদের অধিকাংশের অজানা রয়েছে। এই নিবন্ধে আমি উপরোক্ত বিষয়গুলি আলোচনার চেষ্টা করব।
১) ঈদে মীলাদুন্নবী: পরিচিতি:
• ক) ‘‘মীলাদ’’ শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যা:মীলাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ: জন্মসময়। এই অর্থে ‘‘মাওলিদ’’ শব্দটিও ব্যবহৃত হয়[1]। আল্লামা ইবনে মানযূর তাঁর সুপ্রসিদ্ধ আরবী অভিধান ‘‘লিসানুল আরবে’’ লিখছেন:“ميلاد الرجل: اسم الوقت الذي ولد فيه” অর্থাৎ: ‘‘লোকটির মীলাদ: যে সময়ে সে জন্মগ্রহণ করেছে সে সময়ের নাম”[2]। স্বভাবত:ই মুসলিমগণ ‘‘মীলাদ’’ বা ‘‘মীলাদুন্নবী’’ বলতে শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মের সময়ের আলোচনা করা বা জন্ম কথা বলা বোঝান না। বরং তাঁরা ‘‘মীলাদুন্নবী’’ বলতে রাসূলুল্লাহ্র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) জন্মের সময় বা জন্মদিনকে বিশেষ পদ্ধতিতে উদযাপন করাকেই বোঝান। আমরা এই আলোচনায় ‘‘মীলাদ’’ বা ‘‘ঈদে মীলাদুন্নবী’’ বলতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম উদযাপন বুঝাব। তাঁর জন্ম উপলক্ষে কোন আনন্দ প্রকাশ, তা তাঁর জন্মদিনেই হোক বা জন্ম উপলক্ষে অন্য কোন দিনেই হোক যে কোন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর জন্ম পালন করাকে আমরা ‘‘মীলাদ’’ বলে বোঝব। শুধুমাত্র তাঁর জীবনী পাঠ, বা জীবনী আলোচনা, তাঁর বাণী, তাঁর শরী‘আত বা তাঁর হাদীস আলোচনা, তাঁর আকৃতি বা প্রকৃতি আলোচনা করা মূলত: মুসলিম সমাজে মীলাদ বলে গণ্য নয়। বরং জন্ম উদযাপন বা পালন বা জন্ম উপলক্ষে কিছু অনুষ্ঠান করাই মীলাদ বা ঈদে মীলাদুন্নবী হিসেবে মুসলিম সমাজে বিশেষভাবে পরিচিত।
• খ) মীলাদ’’ বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিন:মীলাদ অনুষ্ঠান যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মদিন পালন কেন্দ্রিক, তাই প্রথমেই আমরা তাঁর জন্মদিন সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করব। স্বভাবত:ই আমরা যে কোন ইসলামী আলোচনা কুরআনুল কারীম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসের আলোকে শুরু করি। কুরআনুল কারীমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ‘‘মীলাদ’’ অর্থাৎ তাঁর জন্ম, জন্ম সময় বা জন্ম উদযাপন বা পালন সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। কুরআন করীমে পূর্ববতী কোন কোন নবীর জন্মের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, তবে কোথাও কোনভাবে কোন দিন, তারিখ, মাস উল্লেখ করা হয় নি। অনুরূপভাবে ‘‘মীলাদ’’ পালন করতে, অর্থাৎ কারো জন্ম উদযাপন করতে বা জন্ম উপলক্ষে আলোচনার মাজলিস করতে বা জন্ম উপলক্ষে আনন্দ প্রকাশের কোন নির্দেশ, উৎসাহ বা প্রেরণা দেওয়া হয় নি। শুধুমাত্র আল্লাহর মহিমা বর্ণনা ও শিক্ষা গ্রহণের জন্যই এসকল ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। ঐতিহাসিক তথ্যাদি আলোচনার মাধ্যমে এর আত্মিক প্রেরণার ধারাবাহিকতা ব্যহত করা হয় নি। এজন্য আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিন সম্পর্কে আলোচনায় মূলত: হাদীস শরীফ ও পরবর্তী যুগের মুসলিম ঐতিহাসিক ও আলেমগণের মতামতের উপর নির্ভর করব:
হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিন:
হাদীস বলতে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা, কর্ম, অনুমোদন বা তাঁর সম্পর্কে কোন বর্ণনা বুঝি। এছাড়াও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহাবীগণের কথা, কর্ম বা অনুমোদনকেও হাদীস বলা হয়ে থাকে [3]। হিজরী দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীতে প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস ও তাঁর সাহাবাগণের মতামত সনদ বা বর্ণনাসূত্রসহ সংকলিত হয়। তন্মধ্যে ‘‘আল-কুতুবুস সিত্তাহ’’ নামে প্রসিদ্ধ ৬টি অতি প্রচলিত ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সকল হাদীসগ্রন্থের সংকলিত হাদীস থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মবার, জন্মদিন ও জন্মতারিখ সম্মন্ধে প্রাপ্ত তথ্য নিম্নরূপ:
এক. জন্মবার:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মবার সম্পর্কে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে:
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ الْأَنْصَارِيِّ رَضِي اللَّه عَنْه أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سُئِلَ عَنْ صَوْمِ الاثْنَيْنِ فَقَالَ: “ذَاكَ يَوْمٌ وُلِدْتُ فِيهِ وَيَوْمٌ بُعِثْتُ أَوْ أُنْزِلَ عَلَيَّ فِيه
আবু কাতাদা আল-আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সোমবার দিন রোজা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়। তিনি বলেন:
‘‘এই দিনে (সোমবারে) আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এই দিনেই আমি নবুয়ত পেয়েছি”[4]।
ইমাম আহমদ তাঁর মুসনাদে সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন:
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: “وُلِدَ النَّبِيُّ ﷺ يَوْمَ الاثْنَيْنِ وَاسْتُنْبِئَ يَوْمَ الاثْنَيْنِ وَتُوُفِّيَ يَوْمَ الاثْنَيْنِ وَخَرَجَ مُهَاجِرًا مِنْ مَكَّةَ إِلَى الْمَدِينَةِ يَوْمَ الاثْنَيْنِ وَقَدِمَ الْمَدِينَةَ يَوْمَ الاثْنَيْنِ وَرَفَعَ الْحَجَرَ الْأَسْوَدَ يَوْمَ الاثْنَيْنِ
ইবনে আববাস বলেন:
‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সোমবারে জন্মগ্রহণ করেন, সোমবারে নবুয়ত লাভ করেন, সোমবারে ইন্তেকাল করেন, সোমবারে মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনার পথে রওয়ান করেন, সোমবারে মদীনা পৌছান এবং সোমবারেই তিনি হাজারে আসওয়াদ উত্তোলন করেন”[5]।
এভাবে আমরা হাদীস শরীফ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম বার জানতে পারি। সহীহ হাদীসের আলোকে প্রায় সকল ঐতিহাসিক একমত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সোমবার জন্মগ্রহণ করেন।
দুই. জন্ম বৎসর:
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মবৎসর বা জন্মের সাল সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে:
عَنِ الْمُطَّلِبِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ قَيْسِ بْنِ مَخْرَمَةَ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ قَالَ: “وُلِدْتُ أَنَا وَرَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَامَ الْفِيلِ. وَسَأَلَ عُثْمَانُ بْنُ عَفَّانَ قُبَاثَ بْنَ أَشْيَمَ أَخَا بَنِي يَعْمَرَ بْنِ لَيْثٍ أَأَنْتَ أَكْبَرُ أَمْ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَكْبَرُ مِنِّي وَأَنَا أَقْدَمُ مِنْهُ فِي الْمِيلادِ وُلِدَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَامَ الْفِيلِ. رواه الترمذي وقَالَ: هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ لا نَعْرِفُهُ إِلا مِنْ حَدِيثِ مُحَمَّدِ بْنِ إِسْحَقَ.
কায়স ইবনে মাখরামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
আমি ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুজনেই ‘‘হাতীর বছরে’’ জন্মগ্রহণ করেছি। উসমান ইবন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু কুবাস ইবন আশইয়ামকে প্রশ্ন করেন: আপনি বড় না রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বড়? তিনি উত্তরে বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার থেকে বড়, আর আমি তাঁর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘‘হাতীর বছরে’’ জন্মগ্রহণ করেন”[6]। হাতীর বছর অর্থাৎ যে বৎসর আবরাহা হাতী নিয়ে কাবা ঘর ধ্বংসের জন্য মক্কা আক্রমণ করেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে এ বছর ৫৭০ বা ৫৭১ খ্রীষ্টাব্দ ছিল [7]।
তিন. জন্মমাস ও জন্ম তারিখ:
এভাবে আমরা হাদীস শরীফের আলোকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম বৎসর ও জন্ম বার সম্পর্কে জানতে পারি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন হাদীসে তাঁর জন্মমাস ও জন্মতারিখ সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। একারণে পরবতী যুগের আলেম ও ঐতিহাসিকগণ তাঁর জন্মতারিখ সম্পর্কে অনেক মতভেদ করেছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিন: আলেমগণ ও ঐতিহাসিকদের মতামত:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম তারিখ সম্পর্কে যেহেতু হাদীসে রাসূলের হাদীসে কোন বর্ণনা আসে নি এবং সাহাবীগণের মাঝেও এ বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট মত প্রচলিত ছিল না, তাই মুসলিম ঐতিহাসিকগণ এ বিষয়ে বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন। ইবনে হিশাম, ইবনে সা‘দ, ইবনে কাসীর, কাসতাল্লানী ও অন্যান্য ঐতিহাসিক ও সীরাতুন্নবী লিখকগণ এ বিষয়ে নিম্নলিখিত মতামত উল্লেখ করেছেন:
o কারো মতে, তাঁর জন্ম তারিখ অজ্ঞাত, তা জানা যায় নি, এবং তা জানা সম্ভব নয়। তিনি সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছেন এটুকুই শুধু জানা যায়, জন্ম মাস বা তারিখ জানা যায় না। এ বিষয়ে কোন আলোচনা তারা অবান্তর মনে করেন।
o কারো কারো মতে, তিনি মুহাররম মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন।
o অন্য মতে, তিনি সফর মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন।
o কারো মতে, তিনি রবিউল আউআল মাসের ২ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় হিজরী শতকের অন্যতম ঐতিহাসিক ও মাগাযী প্রণেতা মুহাদ্দিস আবু মা‘শার নাজীহ ইবন আব্দুর রহমান আস-সিনদী (১৭০হি:) এই মতটি গ্রহণ করেছেন।
o অন্য মতে, তাঁর জন্ম তারিখ রবিউল আউআল মাসের ৮ তারিখ। আল্লামা কাসতাল্লানী ও যারকানীর বর্ণনায় এই মতটিই অধিকাংশ মুহাদ্দিস গ্রহণ করেছেন। এই মতটি দুইজন সাহাবী ইবনে আববাস ও জুবাইর ইবন মুতয়িম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও সীরাতুন্নবী বিশেষজ্ঞ এই মতটি গ্রহণ করেছেন বলে তারা উল্লেখ করেছেন। প্রখ্যাত তাবেয়ী ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে মুসলিম ইবনে শিহাব আয-যুহরী (১২৫হি:) তাঁর উস্তাদ প্রথম শতাব্দীর প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও নসববিদ ঐতিহাসিক তাবেয়ী মুহাম্মাদ ইবনে জুবাইর ইবনে মুতয়িম (১০০হি:) থেকে এই মতটি বর্ণনা করেছেন। কাসতালানী বলেন: ‘‘মুহাম্মাদ ইবনে জুবাইর আরবদের বংশ পরিচিতি ও আরবদের ইতিহাস সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম তারিখ সম্পর্কিত এই মতটি তিনি তাঁর পিতা সাহাবী জুবাইর ইবন মুতয়িম থেকে গ্রহণ করেছেন। স্পেনের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকিহ আলী ইবনে আহমদ ইবনে হাযম (৪৫৬হি:) ও মুহাম্মাদ ইবনে ফাতুহ আল-হুমাইদী (৪৮৮হি:) এই মতটিকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছেন। স্পেনের মুহাদ্দিস আল্লামা ইউসূফ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল বার ( ৪৬৩ হি:) উল্লেখ করেছেন যে, ঐতিহাসিকগণ এই মতটিই সঠিক বলে মনে করেন। মীলাদের উপর প্রথম গ্রন্থ রচনাকারী আল্লামা আবুল খাত্তাব ইবনে দেহিয়া (৬৩৩ হি:) ঈদে মীলাদুন্নবীর উপর লিখিত ‘‘আত-তানবীর ফী মাওলিদিল বাশির আন নাযীর’’ গ্রন্থে এই মতটিকেই গ্রহণ করেছেন।
o অন্য মতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম তারিখ ১০ই রবিউল আউয়াল। এই মতটি ইমাম হুসাইনের পৌত্র মুহাম্মাদ ইবন আলী আল বাকের (১১৪হি:) থেকে বর্ণিত। দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আমির ইবন শারাহিল আশ শা‘বী (১০৪হি:) থেকেও এই মতটি বর্ণিত। ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবন উমর আল-ওয়াকেদী (২০৭হি:) এই মত গ্রহণ করেছেন। ইবনে সা‘দ তার বিখ্যাত ‘‘আত-তাবাকাতুল কুবরা’’-য় শুধু দুইটি মত উল্লেখ করেছেন, ২ তারিখ ও ১০ তারিখ [8]।
o কারো মতে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম তারিখ ১২ রবিউল আউয়াল। এই মতটি হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (১৫১হি:) গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন: ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাতীর বছরে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন” [9]। এখানে লক্ষণীয় যে, ইবনে ইসহাক সীরাতুন্নবীর সকল তথ্য সাধারণত: সনদ সহ বর্ণনা করেছেন, কিন্তু এই তথ্যটির জন্য কোন সনদ উল্লেখ করেন নি। কোথা থেকে তিনি এই তথ্যটি গ্রহণ করেছেন তাও জানান নি বা সনদসহ প্রথম শতাব্দীর কোন সাহাবী বা তাবেয়ী থেকে মতটি বর্ণনা করেন নি। এ জন্য অনেক গবেষক এই মতটিকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন [10]।
o অন্য মতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম তারিখ ১৭ই রবিউল আউয়াল।
o অন্য মতে তাঁর জন্ম তারিখ ২২ শে রবিউল আউয়াল।
o অন্য মতে তিনি রবিউস সানী মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন।
o অন্য মতে তিনি রজব জন্মগ্রহণ করেছেন। ।
o অন্য মতে তিনি রমযান মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন। ৩য় হিজরী শতকের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক যুবাইর ইবনে বাক্কার (২৫৬ হি:) থেকে এই মতটি বর্ণিত। তাঁর মতের পক্ষে যুক্তি হলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বসম্মতভাবে রমযান মাসে নবুয়ত পেয়েছেন। তিনি ৪০ বৎসর পূর্তিতে নবুয়ত পেয়েছেন। তাহলে তাঁর জন্ম অবশ্যই রমযানে হবে [11]।
২) মীলাদুন্নবী বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিবস পালন বা উদযাপন:
• ক) পূর্বকথা:উপরের আলোচনা থেকে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মবার, জন্মমাস ও জন্মতারিখ সম্পর্কে হাদীস ও ঐতিহাসিকদের মতামত জানতে পেরেছি। তাঁর জন্মদিন সম্পর্কে ইসলামের প্রথম যুগগুলির আলেম ও ঐতিহাসিকদের মতামতের বিভিন্নতা থেকে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারছি যে, প্রথম যুগে, সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিন পালন বা উদযাপন করার প্রচলন ছিল না। কারণ তাহলে এধরণের মতবিরোধের কোন সুযোগ থাকত না। মুহাদ্দিস, ফকিহ ও ঐতিহাসিকদের গবেষণা আমাদের এই অনুমানকে সত্য প্রমাণিত করছে।আমরা জানি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিন পালন বা রবিউল আউয়াল মাসে ‘‘ঈদে মীলাদুন্নবী’’ পালনের বৈধতা ও অবৈধতা নিয়ে আলেম সমাজে অনেক মতবিরোধ হয়েছে, তবে মীলাদুন্নবী উদযাপনের পক্ষের ও বিপক্ষের সকল আলেম ও গবেষক একমত যে, ইসলামের প্রথম শতাব্দিগুলিতে ‘‘ঈদে মীলাদুন্নবী’’ বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিন পালন করা বা উদযাপন করার কোন প্রচলন ছিল না। নবম হিজরী শতকের অন্যতম আলেম ও ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে হাজর আল-আসকালানী (মৃত্যু: ৮৫২হি: ১৪৪৯খ্রি:) লিখেছেন:
‘‘মাওলিদ পালন মূলত: বিদ‘আত। ইসলামের সম্মানিত প্রথম তিন শতাব্দীর সালফে সালেহীনদের কোন একজনও এ কাজ করেন নি” [12]।
নবম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের প্রখ্যাত মুদাদ্দিস ও ঐতিহাসিক আল্লামা আবুল খাইর মুহাম্মাদ ইবন আব্দুর রহমান আস-সাখাবী (মৃত্যু: ৯০২হি: ১৪৯৭খ্রি:) লিখেছেন:
‘‘ইসলামের সম্মানিত প্রথম তিন যুগের সালফে সালেহীনদের (সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীদের) কোন একজন থেকেও মাওলিদ পালনের কোন ঘটনা খুজে পাওয়া যায় না। মাওলিদ পালন বা উদযাপন পরবর্তী যুগে উদ্ভাবিত হয়েছে। এরপর থেকে সকল দেশের ও সকল বড় বড় শহরের মুসলিমগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মমাস পালন করে আসছেন। এ উপলক্ষ্যে তারা অত্যন্ত সুন্দর জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবময় খানাপিনার মাহফিলের আয়োজন করেন, এ মাসের রাত্রে তাঁরা বিভিন্ন রকমের দান-সদকা করেন, আনন্দপ্রকাশ করেন এবং জনকল্যাণমূলক কর্ম বেশী করে করেন। এ সময়ে তাঁরা তাঁর জন্মকাহিনী পাঠ করতে মনোনিবেশ করেন”[13]।
লাহোরের প্রখ্যাত আলেম সাইয়েদ দিলদার আলী (১৯৩৫খ্রি:) মীলাদের সপক্ষে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন:
‘‘মীলাদের কোন আসল বা সুত্র প্রথম তিন যুগের (সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীগণ) কোন সালফে সালেহীন থেকে বর্ণিত হয় নি; বরং তাঁদের যুগের পরে এর উদ্ভাবন ঘটেছে”[14]।
আলেমদের এই ঐক্যমতের কারণ হলো, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীতে সংকলিত অর্ধশতাধিক সনদভিত্তিক হাদীসের গ্রন্থ, যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কর্ম, আচার-আচরণ, কথা, অনুমোদন, আকৃতি, প্রকৃতি ইত্যাদি সংকলিত রয়েছে, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীদের মতামত ও কর্ম সংকলিত হয়েছে সে সকল গ্রন্থের একটিও সহীহ বা দুর্বল হাদীসে দেখা যায় না যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় বা তাঁর মৃত্যুর পরে কোন সাহাবী সামাজিকভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে তাঁর জন্ম উদযাপন, জন্ম আলোচনা বা জন্ম উপলক্ষে আনন্দ প্রকাশের জন্য নির্দিষ্ট কোন দিনে বা অনির্দিষ্টভাবে বৎসরের কোন সময়ে কোন অনুষ্ঠান করেছেন।
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই ছিলেন তাঁদের সকল আলোচনা, সকল চিন্তা চেতনার প্রাণ, সকল কর্মকান্ডের মূল। তাঁরা রাহমাতুল্লিল আলামীনের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) জীবনের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেছেন, তাঁর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা আলোচনা করে তাঁর ভালবাসায় চোখের পানিতে বুক ভিজিয়েছেন। তাঁর আকৃতি, প্রকৃতি, পোষাক আশাকের কথা আলোচনা করে জীবন অতিবাহিত করেছেন। কিন্তু তাঁরা কখনো তাঁর জন্মদিন পালন করেন নি। এমনকি তাঁর জন্মমুহুর্তের ঘটনাবলী আলোচনার জন্যও তাঁরা কখনো বসেন নি বা কোন দান-সাদকা, তিলাওয়াত ইত্যাদির মাধ্যমেও কখনো তাঁর জন্ম উপলক্ষে আনন্দ প্রকাশ করেন নি। তাঁদের পরে তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীদের অবস্থাও তাই ছিল।
বস্ত্তত: কারো জন্ম বা মৃত্যুদিন পালন করার বিষয়টি আরবের মানুষের কাছে একেবারেই অজ্ঞাত ছিল। জন্মদিন পালন ‘‘আ‘জামী’’ বা অনারবীয় সংস্কৃতির অংশ। প্রথম যুগের মুসলিমগণ তা জানতেন না। পারস্যের মাজুস (অগ্নি উপাসক) ও বাইযান্টাইন খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল জন্মদিন, মৃত্যুদিন ইত্যাদি পালন করা। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে পারস্য, সিরিয়া, মিসর ও এশিয়া মাইনরের যে সকল মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আসেন তাঁরা জীবনের সকল ক্ষেত্রে সাহাবীদের অনুসরণ অনুকরণ করতেন এবং তাঁদের জীবনাচারণে আরবীয় রীতিনীতিরই প্রাধান্য ছিল। হিজরী তৃতীয় শতাব্দী থেকে মুসলিম সাম্রাজ্যে অনারব পারসিয়ান ও তুর্কী মুসলিমদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে মুসলিম সাম্রাজ্যে বিভিন্ন নতুন নতুন সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতির প্রচলন ঘটে, তন্মধ্যে পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী অন্যতম।
• খ) ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন: প্রাথমিক প্রবর্তন ও সীমিত উদযাপন:আমরা জানতে পারলাম প্রথম যুগগুলোর পরে মীলাদ অনুষ্ঠান বা ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের শুরু হয়েছে। কিন্তু কবে থেকে? কে শুরু করলেন? আসুন আমরা তাদের সাথে পরিচিত হই এবং কিভাবে তাঁরা এই অনুষ্ঠান পালন করতেন তা জানার চেষ্টা করি।ইতিহাসের আলোকে যতটুকু জানতে পেরেছি, দুই ঈদের বাইরে কোন দিবসকে সামাজিক ভাবে উদযাপন শুরু হয় হিজরী ৪র্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শিয়াদের উদ্দোগে। সর্বপ্রথম ৩৫২ হিজরীতে (৯৬৩খ্রি:) বাগদাদের আববাসী খলীফার প্রধান প্রশাসক ও রাষ্ট্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক বনী বুয়াইহির শিয়া শাসক মুইজ্জুদ্দৌলা ১০ই মুহাররাম আশুরাকে শোক দিবস ও জিলহজ্জ মাসের ৮ তারিখ গাদীর খুম দিবস উৎসব দিবস হিসাবে পালন করার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশে এই দুই দিবস সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সাথে পালন করা হয়। যদিও শুধুমাত্র শিয়ারাই এই দুই দিবস পালনে অংশ গ্রহণ করেন, তবুও তা সামাজিক রূপ গ্রহণ করে। কারণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার ফলে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ প্রথম বৎসরে এই উদযাপনে বাধা দিতে পারেন নি। পরবর্তী যুগে যতদিন শিয়াদের প্রতিপত্তি ছিল এই দুই দিবস উদযাপন করা হয়, যদিও তা মাঝে মাঝে শিয়া-সুন্নী ভয়ঙ্কর সংঘাত ও গৃহযুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায় [15]।ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন করার ক্ষেত্রেও শিয়াগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। উবাইদ বংশের রাফেযী ইসমাঈলী শিয়াগণ [16] ফাতেমী বংশের নামে আফ্রিকার উত্তরাংশে রাজত্ব স্থাপন করেন। ৩৫৮ হিজরীতে (৯৬৯ খ্রি:) তারা মিশর দখল করে তাকে ফাতেমী রাষ্ট্রের কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলেন এবং পরবতী ২ শতাব্দীরও অধিককাল মিশরে তাদের শাসন ও কর্তৃত্ব বজায় থাকে। গাজী সালাহুদ্দীন আইঊবীর মিশরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের মাধ্যমে ৫৬৭ হিজরীতে (১১৭২খ্রি:) মিশরের ফাতেমী শিয়া রাজবংশের সমাপ্তি ঘটে [17]। এই দুই শতাব্দীর শাসনকালে মিশরের ইসমাঈলী শিয়া শাসকগণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ২ ঈদ ছাড়াও আরো বিভিন্ন দিন পালন করতেন, তন্মধ্যে অধিকাংশই ছিল জন্মদিন। তাঁরা অত্যন্ত আনন্দ, উৎসব ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ৫টি জন্মদিন পালন করতেন:
১) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিন,
২) আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর জন্মদিন,
৩) ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহার জন্মদিন,
৪) হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহুর জন্মদিন ও
৫) হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর জন্মদিন।এ ছাড়াও তারা তাদের জীবিত খলীফার জন্মদিন পালন করতেন এবং ‘‘মীলাদ’’ নামে ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মদিন (বড়দিন বা ক্রীসমাস), যা মিশরের খ্রিষ্টানদের মধ্যে প্রচলিত ছিল তা আনন্দপ্রকাশ, মিষ্টি ও উপহার বিতরণের মধ্য দিয়ে উদযাপন করতেন [18]।
• গ) ঈদে মীলাদুন্নবীর প্রাথমিক উদযাপন: যুগ ও প্রবর্তক পরিচিতি: ‎‎হিজরী ৪র্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে মিশরে এই উদযাপন শুরু হয়। এ যুগকে আববাসীয় খেলাফতের দুর্বলতার যুগ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন ঐতিহাসিকগণ। আববাসীয় খেলাফতের প্রথম অধ্যায় শেষ হয় ২৩২ হি: (৮৪৭খ্রি:) ৯ম আববাসী খলিফা ওয়াসিক বিল্লাহের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। এরপর সুবিশাল মুসলিম সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবনতির সূচনা হয়। কারণ কেন্দ্রীয় প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। বিশাল সাম্রাজ্য বিভিন্ন ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে যায়। এসকল রাষ্টের মধ্যে অবিরত যুদ্ধ বিগ্রহ চলতে থাকে। এছাড়া কেন্দ্রীয় প্রশাসনের দুর্বলতার কারণে বিভিন্ন এলাকায় সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তরা লুটতরাজ চালানোর সুযোগ পায়। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যহত হয়। বিশেষ করে ৩৩৪ হি: (৯৪৫খ্রি:) থেকে বাগদাদে শীয়া মতাবলম্বী বনূ বুয়াইহ শাসকগণ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যান, ফলে ইসলামী জ্ঞানচর্চা, হাদীস ও সুন্নাতের অনুসরণ ব্যহত হয়। রাফেযী শিয়া মতবাদের প্রসার ঘটতে থাকে। অপরদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নী জনগণ শিয়াদের বাড়াবাড়িতে অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিবাদ করলে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিয়া-সুন্নী সংঘর্ষ ও গৃহযুদ্ধের রূপ ধারণ করত। এ সকল সংঘর্ষ মূলত: দেশের সার্বিক অবস্থার আরো অবনতি ঘটাত। আভ্যন্তরীন অশান্তি ও অনৈক্য বহির্শত্রুর আগ্রাসনের কারণ হয়। এশিয়া মাইনর, আর্মেনীয়া, ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন খ্রিষ্টান শাসক সুযোগমত ইসলামী সম্রাজ্যের অভ্যন্তরে আগ্রাসন চালাতে থাকেন। এছাড়া ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপপ্রচার ও উস্কানীমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে থাকেন। এই পরিস্থিতিতে জ্ঞানচর্চা, ধর্মীয় মূল্যবোধের বিকাশ ব্যহত হয়। অপরদিকে সমাজের মানুষের মধ্যে বিলাসিতা ও পাপাচারের প্রসার ঘটতে থাকে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে ইসলাম বিরোধী আচার আচরণ, কুসংস্কার, ধর্মীয় বিকৃতি ছড়িয়ে পড়ে।এই যুগের বিচ্ছিন্ন ইসলামী সম্রাজ্যের একটি বিশেষ অংশ ও ইসলামী সভ্যতার অনত্যম কেন্দ্র মিশরে ফাতেমী খলীফা আল-মুয়িজ্জু লি-দীনিল্লাহ সর্বপ্রথম ঈদে মীলাদুন্নবী, অন্যান্য জন্মদিন পালন ও সে উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের শুরু করেন। তিনি ৩৫৮ হিজরীতে মিসর অধিকার করেন এবং কায়রো শহরের পত্তন করেন। তিনি সিরিয়া ও হেজাজের বিভিন্ন অঞ্চল ও তাঁর অধীনে আনেন। ৩৬২ হিজরীতে (৯৭২খ্রি:) মুয়িজ্জ কায়রো প্রবেশ করেন এবং কায়রোকেই তাঁর রাজধানী হিসাবে গ্রহণ করেন। ৩৬৫ হিজরীতে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর শাসনামলে মিশরে শিয়া শাসকদের যে সকল উৎসবাদি প্রচলিত হয় তার অন্যতম ছিল ঈদে মীলাদুন্নবী উৎসব [21]।আল মুয়িজ্জ এর প্রচলিত এই ঈদে মীলাদুন্নবী ও অন্যান্য জন্মদিন পালন ও উদযাপন পরবর্তী প্রায় ১০০ বৎসর কায়রোতে শিয়াদের মধ্যে এই উৎসব চালু থাকে। ৪৮৭ হি: (১০৯৪ খ্রি:) ফাতেমী খলীফা আল-মুসতানসিরের মৃত্যু হলে সেনাপতি আল-আফযাল ইবন বদর আল-জামালীর সহযোগিতায় মুস্তানসিরের ছোট ছেলে ২১ বৎসর বয়স্ক আল-মুস্তা‘লী খলীফা হন। সেনাপতি আফযাল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে পড়েন। তিনি ৪৮৮ হিজরীতে ফাতেমীদের প্রচলিত ঈদে মীলাদুন্নবী উৎসব ও অন্যান্য জন্মদিনের উৎসব বন্ধ করে দেন। পরবর্তী কোন কোন ফাতেমী শাসক পুনরায় এ সকল উৎসব সীমিত পরিসরে চালু করেন, তবে ক্রমান্বয়ে ফাতেমীদের প্রতিপত্তি সঙ্কুচিত হতে থাকে এবং এ সকল উৎসব জৌলুস হারিয়ে ফেলে[22]।
• ঘ) ঈদে মীলাদুন্নবীর প্রাথমিক উদযাপন: অনুষ্ঠান পরিচিতি ‎‎আহমদ ইবন আলী আল-কালকাশান্দী (৮২১হি:) লিখেছেন:
‘‘রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে ফাতেমী শিয়া শাসক মীলাদুন্নবী উদযাপন করতেন। তাদের নিয়ম ছিল যে, এ উপলক্ষে বিপুল পরিমাণে উন্নত মানের মিষ্টান্ন তৈরী করা হত। এই মিষ্টান্ন ৩০০ পিতলের খাঞ্চায় ভরা হতো। মীলাদের রাত্রিতে এই মিষ্টান্ন সকল তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলদের মধ্যে বিতরণ করা হতো, যেমন প্রধান বিচারক, প্রধান শিয়া মত প্রচারক, দরবারের কারীগণ, বিভিন্ন মসজিদের খতীব ও প্রধানগণ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানদির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ। এ উপলক্ষে খলীফা প্রাসাদের সামনের ব্যালকনীতে বসতেন। আসরের নামাযের পরে বিচারপতি বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মকর্তাদের সংগে আজহার মসজিদের গমন করতেন এবং সেখানে এক খতম কুরআন তিলাওয়াত পরিমাণ সময় বসতেন। মসজিদ ও প্রাসাদের মধ্যবর্তী স্থানে অভ্যাগত পদস্থ মেহমানগণ বসে খলীফাকে সালাম প্রদানের জন্য অপেক্ষা করতেন। এ সময়ে ব্যালকনির জানালা খুলে হাত নেড়ে খলিফা তাদের সালাম গ্রহণ করতেন। এরপর কারীগণ কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং বক্তাগণ বক্তৃতা প্রদান করতেন। বক্তৃতা অনুষ্ঠান শেষ হলে খলীফার সহচরগণ হাত নেড়ে সমবেতদের বিদায়ী সালাম জানাতেন। খিড়কী বন্ধ করা হতো এবং উপস্থিত সকলে নিজ নিজ ঘরে ফিরতেন। এভাবেই তারা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর জন্মদিনও পালন করত…”[23]।
আহমদ ইবন আলী আল-মাকরীযী (৮৪৫হি:) এ সকল জন্মদিন উৎসবের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন:
‘‘এ সকল জন্মদিনের উৎসব ছিল তাদের খুবই বড় ও মর্যাদাময় উৎসব সময়। এ সময়ে মানুষেরা সোনা ও রূপার স্মারক তৈরী করত, বিভিন্ন ধরণের খাবার, মিষ্টান্ন ইত্যাদি তৈরী করে বিতরণ করা হতো”[24]।
৩) ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন: প্রকৃত প্রবর্তন ও ব্যাপক উদযাপন:
এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, হিজরী ৪র্থ শতাব্দী থেকেই ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের শুরু হয়। তবে এখানে লক্ষণীয় যে, কায়রো এই উৎসব ইসলামী বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েনি। সম্ভবত: ইসমাঈলীয় ফাতেমী শিয়াদের প্রতি সাধারণ মুসলিম সমাজের প্রকট ঘৃণার ফলেই তাদের এই উৎসবসমূহ অন্যান্য সুন্নী এলাকায় জনপ্রিয়তা পায় নি বা সামাজিক উৎসবের রূপ গ্রহণ করে নি। তবে ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে জানা যায় ৬ষ্ঠ হিজরীর দ্বিতীয়ার্ধ (৫৫০-৬০০) থেকেই মিশর, সিরিয়া বা ইরাকের ২/১ জন ধার্মিক মানুষ প্রতি বৎসর রবিউল আউআল মাসের প্রথমাংশে বা ৮ বা ১২ তারিখে খানাপিনার মাজলিস ও আনন্দ প্রকাশের মাধ্যমে ‘‘ঈদে মীলাদুন্নবী’’ পালন করতে শুরু করেন[25]।
তবে যিনি ঈদে মীলাদুন্নবীর প্রবর্তক হিসাবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ এবং যিনি ঈদে মীলাদুন্নবীকে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম উৎসব হিসাবে প্রতিষ্ঠা দানের কৃতিত্বের দাবিদার তিনি হচ্ছেন ইরাক অঞ্চলের ইরবিল প্রদেশের শাসক আবু সাঈদ কূকবুরী (মৃত্যু: ৬৩০হি:)। পরবতী পৃষ্ঠাগুলিতে আমরা তার জীবনী ও ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনে তাঁর পদ্ধতি আলোচনা করব। কিন্তু তার আগে আমরা যে যুগের প্রেক্ষাপটে তিনি এই উৎসবের প্রচলন করেন তা আলোচনা করব।
• ক) যুগ পরিচিতি: হিজরী ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতক:৪র্থ হিজরী শতকে ইসলামী জগতের অবস্থা কি ছিল তা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। পরবর্তী সময়ে অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। ৬ষ্ঠ হিজরী শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ৭ম হিজরী শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়কাল ছিল মুসলিম উম্মার জন্য দুর্দিন ও মুসলিম ইতিহাসের এক বেদনাদায়ক অধ্যায়। এ সময়ে আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও বাইরের শত্রুর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয় বিশাল মুসলিম রাজত্বের অধিকাংশ এলাকা।৬ষ্ঠ হিজরী শতাব্দী মাঝামাঝি এসে আমরা দেখতে পাই যে, এ সকল অভ্যন্তরীণ সমস্যার পাশাপাশি আরো একটি কঠিন সমস্যা মুসলিম উম্মাহর সামনে এসেছে, তা হলো বাইরের শত্রুর আক্রমণ, বিশেষ করে পশ্চিম থেকে ইউরোপীয় ক্রুসেডারদের আক্রমণ এবং পূর্ব থেকে তাতার ও মোগলদের আক্রমণ।ক্রুসেড যুদ্ধের শুরু হয় হিজরী ৫ম শতাব্দীর (খ্রীষ্টিয় একাদশ শতাব্দীর) শেষদিকে। ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকেই অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপে খ্রিষ্টান ধর্মযাজকগণ বিভিন্নভাবে ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী প্রচারণা করতে থাকেন। তারা বলতে থাকে যে, মুসলিমগণ মূর্তিপূজা করেন, তাঁরা মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পুজা করেন, নরমাংশ ভক্ষণ করেন, যিশুখ্রিষ্টের অবমাননা করেন ইত্যাদি কথা সারা ইউরোপে প্রচারিত হতে থাকে। পাশাপাশি মুসলিমদের স্পেন বিজয় ও পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশ বিজয় ইউরোপের খ্রিষ্টান শাসকদেরকে ভীত করে তোলে। তাঁরা তাঁদের অভ্যন্তরের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও জাতিগত বিভেদ ও শত্রুতা ভুলে পোপের নেতৃত্বে প্যালেষ্টাইনের পবিত্রভূমি উদ্ধারের নামে লক্ষ লক্ষ সৈনিকের ঐক্যবদ্ধ ইউরোপীয় বাহিনী নিয়ে মুসলিম সাম্রাজ্যের উপর আক্রমণ চালাতে থাকেন। ৪৯১ ও ৪৯২ হিজরী সালে (১০৯৭ ও ১০৯৮ খ্রি:) প্রথম ক্রুসেড বাহিনীর দশ লক্ষাধিক নিয়মিত সৈনিক ও স্বেচ্ছাসেবক এশিয়া মাইনর ও সিরিয়া এলাকায় বিভিন্ন মুসলিম দেশে হামলা করেন। এই হামলায় প্রায় ২০ সহস্রাধিক মুসলিম সাধারণ নাগরিক নিহত হন। ক্রুসেড বাহিনী নির্বিচারে নারীপুরুষ ও শিশুদের হত্যা করেন। তাঁরা ক্ষেতখামার ও ফসলাদিও ধ্বংস করেন। এই হামলার মাধ্যমে এশিয়া মাইনর ও সিরিয়া-প্যালেষ্টাইনের বিভিন্ন রাজ্য খ্রিষ্টানরা দখল করে এবং কয়েকটি খ্রিষ্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে [26]।পরবর্তী ২০০ বৎসরের ইতিহাস ইউরোপীয় খ্রিষ্টান বাহিনীর উপর্যুপরি হামলা ও মুসলিম প্রতিরোধের ইতিহাস। এ সময়ে খ্রিষ্টানগণ মিসর, সিরিয়া ও ইরাকের বিভিন্ন অঞ্চলে খ্রিষ্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিধাবিভক্ত মুসলিম শাসকগণ বিভিন্নভাবে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন এবং সর্বশেষ ৬ষ্ঠ হিজরী শতাব্দীর শেষদিকে সালাহুদ্দীন আইউবী অধিকাংশ খ্রিষ্টান রাজ্যের পতন ঘটান এবং প্যালেষ্টাইন ও অধিকাংশ আরব এলাকা থেকে ক্রুসেডিয়ারদের বিতাড়িত করেন [27]। এরপরেও মিশর, সিরিয়া ও লেবানন এলাকায় ক্রুসেডারদের কয়েকটি ছোট ছোট খ্রিষ্টান রাজ্য রয়ে যায়। তদুপরি ইউরোপ থেকে মাঝেমাঝে ক্রুসেড বাহিনীর আগমন ও বিভিন্ন মুসলিম অঞ্চলে আক্রমণ অব্যহত থাকে [28]।যে সময়ে মুসলিমরা দখলদার ক্রুসেড বাহিনীর কবল থেকে বিভিন্ন মুসলিম অঞ্চলকে মুক্ত করছেন, সে সময়ে, ৭ম হিজরী শতকের (১৩শ খ্রীষ্টিয় শতকের) শুরুতে মুসলিম সম্রাজ্যের পূর্বদিক থেকে তাতারদের বর্বর হামলা শুরু হয়। চেঙ্গিশ খানের নেতৃত্বে তাতার বাহিনী সর্বপ্রথম ৬০৬ হিজরীর দিকে (১২০৯ খ্রি:) মুসলিম রাজত্বের পূর্বাঞ্চলে হামলা চালাতে শুরু করে। শীঘ্রই তারা বিভিন্ন মুসলিম জনপদে হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করতে থাকে। মানব ইতিহাসের বর্বরতম হামলায় তারা এসকল জনপদের সকল প্রাণীকে নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে। বস্ত্তত: তাতাররা মধ্য এশিয়া, পারস্য, ইরাক, সিরিয়া ও এশিয়া মাইনরের অধিকাংশ মুসলিম জনপদ শাব্দিক অর্থেই বিরাণ করে দেয়। পরবর্তী শতাব্দীর ঐতিহাসিক আল্লামা যাহাবী (মৃত্যু ৭৪৮হি:) বলেন:
‘‘তাতাররা এসকল জনপদে কত মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে এ প্রশ্ন অবান্তর ও অর্থহীন, বরং প্রশ্ন করতে হবে: তারা কতজনকে না মেরে বাঁচিয়ে রেখেছিল”[29]।
৬৫৬ হিজরীতে (১২৫৮খ্রি:) হালাকু খানের নেতৃত্বে তাতাররা মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র ও রাজধানী বাগদাদ ধ্বংস করে। ৪০ দিনব্যপি গণহত্যায় তারা বাগদাদের প্রায় ২০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে [30]। পরবর্তী শতাব্দীর ঐতিহাসিক আল্লামা যাহাবী (মৃত্যু ৭৪৮হি:) লিখেছেন:
‘‘হালাকু মৃতদেহ গণনা করতে নির্দেশ দেয়। গণনায় মৃতদেহের সংখ্যা হয় ১৮ লক্ষের কিছু বেশী। তখন (নিহতের সংখ্যায় তৃপ্ত হয়ে) হালাকু হত্যাকান্ড থামানোর ও নিরাপত্তা ঘোষণার নির্দেশ দেয়”[31]।
বাইরের শত্রুর পাশাপাশি আভ্যন্তরীণ কলহ ও দুর্বলতা এ যুগে মুসলিম সমাজগুলোকে বিপর্যস্ত করে তোলে। কোন কোন আঞ্চলিক শাসক নিজের এলাকায় কিছু শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা আনতে পারলেও সার্বিকভাবে বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্যের আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে।[32]
পরবতী শতাব্দীর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে কাসীর (৭৭৪হি:), যিনি নিকট থেকে এ যুগের ঘটনাবলী জেনেছেন, তাতারদের নারকীয় বর্বরতার বর্ণনা দেওয়ার একপর্যায়ে লিখেন:
৬১৭হিজরী (১২২০খ্রি:) চেঙ্গিশ খান ও তার বাহিনীর বর্বর হামলা সমস্ত মুসলিম বিশ্বকে গ্রাস করে। ১ বৎসরের মধ্যে তারা প্রায় সমগ্র মুসলিম জনপদ দখল করে নেয় (বাগদাদ ও পার্শ্ববতী এলাকা বাদ ছিল)। … তারা এ বছরে বিভিন্ন বড়বড় শহরে মুসলিম ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের অগণিত মানুষকে হত্যা করে। মোটের উপর তারা যে দেশেই প্রবেশ করেছে সেখানকার সকল সক্ষম পুরুষ ও অনেক মহিলা ও শিশুকে হত্যা করেছে। গর্ভবতী মহিলাদেরকে হত্যা করে তাদের পেট ফেড়ে গর্ভস্থ শিশুকে বের করে হত্যা করেছে। যে সকল দ্রব্য তাদের প্রয়োজন তা তারা লুটপাট করেছে। আর যা তাদের দরকার নেই তা তারা পুড়িয়ে নষ্ট করে দিয়েছে। ঘরবাড়ী সবই তারা ধ্বংস করেছে বা পুড়িয়ে দিয়েছে। … মানব সভ্যতার শুরু থেকে এ পর্যন্ত এত ভয়াবহ বিপর্যয় ও বিপদ কখনো মানুষ দেখেনি .. ইতিহাসে এতবড় বর্বরতার কোন বিবরণ আর পাওয়া যায় না [33]।
এভাবে তাতারদের আগ্রাসন, ক্রুসেড হামলা, সামগ্রিক আইন শৃঙ্খলার অবনতি সমগ্র মুসলিম জাহানকে এমনভাবে গ্রাস করে যে, ৬২৮ হিজরীর (১২৩১খ্রি:) পরে অনেক বছর মুসলিমরা ইসলামের পঞ্চম রোকন হজ্জ পালন করতে পারে নি। ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর লিখছেন:
‘‘৬২৮ হিজরীতে মানুষেরা হজ্জ আদায় করেন। এরপরে যুদ্ধবিগ্রহ, তাতার ও ক্রুসেডিয়ারদের ভয়ে আর কেউ হজ্জে যেতে পারেন নি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন”[34]।
ইসলামী অনুশাসনের অবহেলা, পাপ-অনাচারের প্রসার, প্রশাসনিক দুর্বলতা, জুলুম অত্যাচারের সয়লাবের কারণে মুসলিমদের মধ্যে নেমে আসে ঈমানী দূর্বলতা। তাতারভীতি তাদেরকে গ্রাস করে। আল্লামা ইবনে কাসীর লিখেছেন:
‘‘তাতারভীতি মানুষদেরকে এমনভাবে গ্রাস করেছিল যে, একজন তাতার সৈনিক একটি বাজারে প্রবেশ করে, যেখানে শতাধিক মানুষ ছিল, তাতার সৈন্যটি একজন একজন করে সকল মানুষকে হত্যা করে বাজারটি লুট করে, খুনের এই হোলি খেলার মধ্যে একজন পুরুষও ঐ তাতারটিকে বাধা দিতে আগিয়ে আসতে সাহস পায়নি”[35]।
এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, হিজরী ৬ষ্ট ও ৭ম শতকের মুসলিম সমাজে চরম সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অশান্তি বিরাজ করছিল, যা ধমীয়, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও স্থবিরতা ও অবক্ষয় নিয়ে আসে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে সাংস্কৃতিক ও শিক্ষার অঙ্গনে স্থবিরতা আসে। মুসলিম সাম্রাজ্যের মধ্যে বিভিন্ন খ্রিষ্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে মুসলিমগণ বিভিন্ন খ্রিষ্টান ধর্মীয় ও সামাজিক আচার আচরণ দ্বারা প্রভাবিত হন। অপরদিকে পূর্বাঞ্চলীয় তাতার ও অন্যান্য কাফির সম্প্রদায়ের মানুষেরা মুসলিম সম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা দখল করে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাদের আচার আচরণ ও বিশ্বাস-কুসংস্কার মুসলিম সমাজে প্রবেশ করে। সর্বপোরি শিক্ষার ক্ষেত্রে স্থবিরতা আসার ফলে সমাজের মধ্যে অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও বিভিন্ন ধরণের কুসংস্কার ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক ভাবে।
সবকিছুর মধ্যেও কিছু কিছু রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা ও তৎকালীন আলেম সমাজের চেষ্টায় ইলমের প্রসার ও ইসলামী মূল্যবোধের দিকে আহবানের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। তবে বিশাল মুসলিম সমাজের প্রয়োজনের তুলনার আলেম ও সংস্কারকদের সংখ্যা কমে যেতে থাকে। এছাড়া সার্বিক সামাজিক অস্থিরতা, অজ্ঞতা ও অবক্ষয়ের ফলে সমাজে আলেমদের আবেদন কমতে থাকে। ফলে বিভিন্ন ধরণের ইসলাম বিরোধী কর্ম সমাজে প্রবেশ করে। সমাজের সাধারণ মানুষই নয় ধার্মিক মানুষেরাও এমন অনেক কাজ করতে থাকেন যা শরী‘আত সঙ্গত নয় এবং ইসলামের প্রথম যুগে কোন ধার্মিক মানুষের কাজ ছিল না। যেমন তৎকালীন সময়ে সূফীদের মধ্যে ‘‘সামা’’ বা গান বাজনার প্রসারের একটি উদাহারণের মাধ্যমে এই অবস্থা ব্যাখ্যা করতে চাই, কারণ মীলাদ অনুষ্ঠানের কর্মকান্ড বুঝতে তা আমাদের সাহায্য করবে।
ইসলামের প্রথম যুগগুলিতে ‘‘সামা’’ বা শ্রবণ বলতে শুধুমাত্র কুরআন শ্রবণ ও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী, কর্ম ও বাণী শ্রবণকেই বোঝান হত। এগুলিই তাঁদের মনে আল্লাহর ভালবাসা ও নবীর ভালবাসার জোয়ার সৃষ্টি করত। কোন মুসলিম কখনই আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য বা হৃদয়ে আল্লাহর ভালবাসা তৈরীর দোহাই দিয়ে গান শুনতেন না। সমাজের বিলাসী বা অধার্মিক মানুষদের মধ্যে বিনোদন হিসাবে গানবাজনার প্রচলন ছিল, কিন্তু আলেমগণ তা হারাম জানতেন। কখনই এ সকল কর্ম আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম বলে গণ্য হয় নি। তাঁরা সকলেই মূলত: কুরআন সুন্নাহর গভীর জ্ঞান অর্জন করা ও অর্জিত জ্ঞানের আলোকে জীবন পরিচালনার উপর গুরুত্ব প্রদান করতেন [36]।
কিন্তু পরবর্তী কালে মুসলিম বিশ্বের সার্বিক অস্থিরতা, ফিকহ, হাদীস ও অন্যান্য ইসলামী জ্ঞান চর্চার অভাব, বিজাতীয় প্রভাব ইত্যাদি কারণে কিছু কিছু মানুষের মধ্যে বিভিন্ন অনাচার প্রবেশ করে। এদের মধ্যে ক্রমে ক্রমে গান বাজনা, নর্তন কুর্দন ইত্যাদি অনাচার ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। গান বাজনা এক পর্যায়ে ধার্মিক মানুষদের ধর্মকর্মের অংশ হয়ে যায়। তারা একে ‘‘সামা’’ বা শ্রবণ বলতেন। তারা গানের তালে তালে নাচতে থাকতেন এবং অনেকেই আবেগে নিজের পরিধেয় কাপড় চোপড় ছিড়ে ফেলতেন। কেহ বাজনা সহ, কেহবা বাজনা ব্যতিরেকে গান গেয়ে ও নেচে নিয়মিত ‘সামা’র মাজলিস করতেন। কারণ তাদের ধারণা ছিল যে, এ সকল গান গজল আল্লাহ ভক্তদের মনে আল্লাহর ভালবাসার জোয়ার সৃষ্টি করত। তাঁরা ‘সামা’কে আল্লাহ প্রাপ্তির ও আল্লাহ প্রেম অর্জনের অন্যতম মাধ্যম মনে করতেন। আর এটা জানা কথা যে, সমাজে যখন কোন কাজ ব্যাপক ভাবে প্রচলিত হয়ে যায়, বিশেষত: ধার্মিক ও ভাল মানুষদের মধ্যে, তখন অনেক আলেম এসকল কর্মের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি প্রদান করেন এবং এগুলোকে জায়েয বা ইসলাম সম্মত বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। গান বাজনার ক্ষেত্রেও এই অবস্থা হয়। কোন কোন আলেম সূফীদের প্রতি সম্মান হেতু এবং হৃদয়ে গানের ফলে যে আল্লাহর ভালবাসার তথাকথিত আবেশ ও আনন্দ পাওয়া যায় তার দিকে লক্ষ্য করে এগুলোর পক্ষে মিথ্যা ওকালতি করেছেন। যেমন, প্রখ্যাত দার্শনিক গাযালী (৫০৫হি:)। তিনি তাঁর সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘‘এহইয়াউ উলুমিদ্দীন’’ গ্রন্থে সুদীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে গান বাজন ও নর্তন কুর্দনের পক্ষে যুক্তি প্রমান পেশ করার চেষ্টা করেছেন। তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে, এসকল কর্ম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ ও সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীদের যুগে প্রচলিত বা পরিচিত ছিল না [37]।
অপরদিকে সত্যনিষ্ঠ আলেম সমাজের বহুল প্রচলনকে মেনে নিতে পারেন নি। তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ ও সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীদের যুগকেই প্রামাণ্য বলে মনে করেছেন, এ সকল যুগে যেহেতু গান বাজনা, নর্তন কুর্দন ইত্যাদি কখনই আল্লাহর পথের পথিকদের কর্ম ছিল না, বরং সমাজের পাপী অশ্লীলতায় লিপ্ত লোকেদের কর্ম ছিল, তাই সূফী ও জাহেলদের মধ্যে বহুল প্রচলন সত্বেও তাঁরা এগুলিকে মেনে নেন নি, বরং তা রোধ করার চেষ্টা করেছেন। তবে পূর্বোক্ত ইসলামী বিশ্বের সার্বিক অবস্থা সামনে নিলে সে যুগের আলেমদের সংস্কারমূলক কাজের সীমাবদ্ধতা আমরা সহজেই বুঝতে পারি। তাঁরা বাষ্ট্রীয় সমর্থন থেকে বঞ্চিত ছিলেন। সমাজে অজ্ঞতার প্রভাব ছিল বেশী। তা সত্বেও তাঁরা সেই যুগে ইসলামের আলোর মশাল জ্বালিয়ে রেখেছেন, সমাজের মানুষদেরকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা প্রদানের চেষ্টা করেছেন। তাঁরাই ছিলেন দ্বীনের সঠিক মশাল। আল্লাহ তাদেরকে রহমত করুন ।
• খ) প্রবর্তক: ব্যক্তি ও জীবন:আগেই বলেছি যে, মিশরের শিয়া শাসকগণ প্রথম ঈদে মীলাদুন্নবীর প্রবর্তন করেন। ৬ষ্ঠ হিজরী শতকের শেষ দিকে মিশরের বাইরেও কোন কোন ধর্মপ্রান মানুষ ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতি বৎসর রবিউল আউয়াল মাসের প্রথম দিকে ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করতে শুরু করেন। তবে ইরবিলের শাসক আবু সাঈদ কূকুবূরীর মাধ্যমেই এই উৎসবকে সুন্নী জগতে এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বে জনপ্রিয় উৎসবে পরিণত হয়। এজন্য বিভিন্ন সীরাতুন্নবী বিশেষজ্ঞ ও ঐতিহাসিকগণ তাঁকেই ঈদে মীলাদুন্নবীর প্রবর্তক হিসাবে উল্লেখ করেছেন; কারণ তিনিই প্রথম এই উৎসবকে বৃহৎ আকারে পালন করতে শুরু করেন এবং সাধারণের মধ্যে এই উৎসবের প্রচলন ঘটান। আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন ইউসূফ সালেহী শামী (মৃত্যু: ৯৪২হি: ১৫৩৬খ্রি:) তার প্রখ্যাত সীরাতুন্নবী গ্রন্থে- (সীরাহ শামীয়া) ঈদেমীলাদুন্নবী পালনের আহবান জানাতে যেয়ে আলোচনার প্রথম দিকে লিখছেন:
‘‘সর্বপ্রথম যে বাদশাহ এই উৎসব উদ্ভাবন করেন তিন হলেন, ইরবিলের শাসক আবু সাঈদ কূকুবূরী…’’[38]
আল্লামা যাহাবী কুকবূরীর পরিচিতি প্রদান করতে গিয়ে লিখছেন:
‘‘ধার্মিক সুলতান সম্মানিত বাদশাহ মুযাফ্ফরুদ্দীন আবু সাঈদ কূকুবুরী ইবনে আলী ইবনে বাকতাকীন ইবনে মুহাম্মাদ আল-তুরকমানী’’[39] । তাঁরা তুকী বংশোদ্ভুত। তাঁর নামটিও তুর্কী। তুকী ভাষায় কূকুবুরী শব্দের অর্থ ‘‘নীল নেকড়ে’’[40]।
তাঁর পিতা আলী ইবনে বাকতাকীন ছিলেন ইরাকের ইরবিল অঞ্চলের শাসক। তিনি অত্যন্ত সাহসী ও বীর যোদ্ধা ছিলেন। ক্রুসেড যোদ্ধাদের থেকে অনেক এলাকা জয় করে তাঁর শাসনাধীনে নিয়ে আসেন। তিনি ধার্মিকতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। অনেক মাদ্রাসা ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।
বীরত্ব ও ধার্মিকতার এই পরিবেশে কূকুবুরী ৫৪৯ হি: সনে (১১৫৪ খ্রি:) জন্মগ্রহণ করেণ [41]। তাঁর বয়স যখন মাত্র ১৪ বৎসর তখন ৫৬৩ হি: সনে (১১৬৮ খ্রি:) তাঁর পিতা মারা যান [42]। পিতার মৃত্যুর পরে কূকুবূরী ইরবিলের শাসনভার গ্রহণ করেন [43]। তিনি অল্পবয়স্ক হওয়ার কারণে আতাবিক মুজাহিদ উদ্দীন কায়মায তাঁর অভিভাবক হিসাবে নিযুক্ত হন [44]। উক্ত অভিভাবক কিছুদিনের মধ্যেই কুকুবুরীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং কুকুবুরীকে শাসনকার্য পরিচালনায় অযোগ্যতার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত করে তাঁর ভাই ইউসুফকে ক্ষমতায় বসান [45]। কূকুবুরী তখন ইরবিল ত্যাগ করে ইরাকের মাওসিল অঞ্চলের শাসক সাইফুদ্দীন গাযী ইবনে মাউদূদের নিকট গমন করেন। তিনি কুকুবুরীকে মাউসিলের শাসনাধীন হাররান অঞ্চলের শাসক হিসাবে নিয়োগ করেন [46]। কিছুদিন হাররানে অবস্থান করার পরে তিনি যে যুগের প্রসিদ্ধ বীর, মিসর ও সিরিয়ার শাসক গাজী সালাহুদ্দীন আল-আইউবীর দরবারে যোগ দেন। তিনি সালাহুদ্দীনের সাথে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সালাহুদ্দীন কুকুবুরীর বীরত্বে ও কর্তব্যনিষ্ঠায় এতই মুগ্ধ হন যে, তিনি তাঁর বোন রাবীয়া খাতুনের সাথে কুকবুরীর বিবাহ দেন এবং তাকে হাররান ও রুহা অঞ্চলের শাসক নিযুক্ত করেন [48]। ৫৮৩ হিজরীতে (১১৮৭খ্রি:) হিত্তীনের যুদ্ধে সালাহুদ্দীন আইউবীর মুসলিম বাহিনী সম্মিলিত খৃষ্টান ক্রুসেড বাহিনীকে শোচনীয়রূপে পরাজিত করে এবং জেরুজালেম ও সমগ্র্ প্যালেষ্টাইন থেকে ইউরোপীয় বাহিনীর চুড়ান্ত পরাজয়ের সূচনা করে। এই যুদ্ধে কুকুবুরী অতুলনীয় বীরত্ব প্রদর্শন করেন। এ সময়ে তাঁর ভাই ইরবিলের শাসক ইউসুফ মারা যান। তখন সালাহুদ্দীন কুকুবুরীকে পুনরায় ইরবিলের শাসনক্ষমতা প্রদান করেন।[49]
কুকবুরী অত্যন্ত ধার্মীক ছিলেন। পরবতী শতাব্দীর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইমাম যাহাবী (মৃ: ৭৪৮ হি:) বলেন:
‘‘যদিও তিনি (কুকবুরী) একটি ছোট্ট রাজ্যের রাজা ছিলেন, তিনি ছিলেন সচেচেয়ে বেশী ধার্মিক, সবচেয়ে বেশী দানশীল, সমাজকল্যানেব্রত ও মানবসেবী বাদশাহদের অন্যতম। প্রতি বছর ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের জন্য তিনি যে পরিমান অর্থব্যয় করতেন তা সবার মুখে প্রবাদের মত উচ্চারিত হত”[50]।
তিনি শাসন কার্য পরিচালনার ফাঁকে ফাঁকে আলেমদের নিকট থেকে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করতেন [51]।
আবু সাঈদ কুকবুরীর সমসাময়িক ঐতিহাসিক আল্লামা ইয়াকুত আল-হামাবী (মৃত্যু ৬২৬হি:) কুকবুরীর বর্ণনা দিকে গিয়ে লিখেছেন:
‘‘আমীর মুযাফ্ফরুদ্দীন কূকুবূরী এই ইরবিল শহরের উন্নয়নমূলক প্রভুত কর্ম করেন। এই আমীরের চরিত্র বৈপরিত্যময়। একদিকে তিনি প্রজাদের উপর অনেক জুলুম অত্যাচার করেন, অবৈধভাবে প্রজাদের নিকট থেকে সম্পদ সংগ্রহ করেন। অপরদিকে তিনি কুরআন পাঠক ও ধার্মিক মানুষদের সাহায্য করেন, দরিদ্র ও অসহায়দের জন্য তাঁর দানের হাত খুবই প্রশস্ত। কল্যাণকর্মে তিন মুক্তহস্তে ব্যয় করেন, অমুসলিমদের নিকট বন্দী মুসলিমদেরকে টাকার বিনিময়ে মুক্ত করেন…”[52]।
কর্মময় জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে প্রায় ৮২ বৎসর বয়সে কুকবূরী ৬৩০ হিজরীর ৪ঠা রমযান (১৩/৬/১২৩৩ খ্রি:) মারা যান [53]। তাঁর সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনের অন্যতম কর্ম যা তাকে সমসাময়িক সকল শাসক থেকে পৃথক করে রেখেছে এবং ইতিহাসে তাকে বিশেষভাবে স্মরণীয় করে রেখেছে তা হলো ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের প্রচলন। তিনি ৫৮৩ থেকে ৬৩০ পর্যন্ত দীঘ প্রায় ৪৫ বৎসরের শাসনামলের কোন বছরে প্রথম এই অনুষ্ঠান শুরু করেন তা সঠিক ভাবে জানতে পারিনি। প্রখ্যাত বাঙ্গালী আলেমে দীন, মাওলানা মোহাম্মদ বেশারতুল্লাহ মেদিনীপুরী উল্লেখ করেছেন যে, হিজরী ৬০৪ সাল থেকে কূকুবূরী মীলাদ উদযাপন শুরু করেন [54]। তিনি তাঁর এই তথ্যের কোন সূত্র প্রদান করেন নি। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে প্রতিয়মান হয় যে, ৬০৪ হিজরীর আগেই কূকুবূরী মীলাদ উদযাপন শুরু করেন। ইবনে খাল্লিকান লিখেছেন:
‘‘৬০৪ হিজরীতে ইবনে দেহিয়া খোরাসান যাওয়ার পথে ইরবিলে আসেন। সেখানে তিনি দেখেন যে, বাদশাহ মুযাফফরুদ্দীন কূকুবূরী অতীব আগ্রহ ও উদ্দীপনার সাথে মীলাদ উদযাপন করেন এবং এ উপলক্ষ্যে বিশাল উৎসব করেন। তখন তিনি তাঁর জন্য এ বিষয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেন…”[55]।
এ থেকে স্পষ্ট যে, ইবনে দেহিয়া ৬০৪ হিজরীতে ইরবিলে আগমনের কিছু পূর্বেই কূকুবূরী মীলাদ উদযাপন শুরু করেন, এজন্যই ইবনে দেহিয়া ইরবিলে এসে তাকে এই অনুষ্ঠান উদযাপন করতে দেখতে পান। তবে উদযাপনটি ৬০৪ হিজরীর বেশী আগে শুরু হয়নি বলেই মনে হয়, কারণ বিষয়টি ইবনে দেহিয়া আগে জানতেন না, এতে বোঝা যায় তখনো তা পার্শবর্তী দেশগুলিতে প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। এতে আমরা অনুমান করতে পারি যে, কূকুবূরী ৬ষ্ঠ হিজরী শতকের শেষ দিকে বা ৭ম হিজরী শতকের শুরুতে (৫৯৫-৬০৩ হিজরী) মীলাদ পালন শুরু করেন।
• গ) প্রথম মীলাদ গ্রন্থ লেখক: ব্যক্তি ও জীবন:মীলাদ অনুষ্ঠান প্রচলন করার ক্ষেত্রে আরেক ব্যক্তিত্বের অবদান আলোচনা না করলে সম্ভবত: আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি হলেন ‘‘মীলাদুন্নবী’’র উপরে সর্বপ্রথম গ্রন্থ প্রণেতা আল্লামা আবুল খাত্তাব ওমর ইবনে হাসান, ইবনে দেহিয়া আল-কালবী (৬৩৩হি:), যার গ্রন্থ পরবর্তীতে ‘‘মীলাদ’’ কেন্দ্রীক অসংখ্য গ্রন্থ রচনার উৎস ছিল। মীলাদের উপরে লিখিত গ্রন্থের জন্য কুকবুরী তাকে একহাজার দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) পুরস্কার প্রদান করেন [56]।ইবনে দেহিয়া ৫৪৪ হিজরীতে (১১৫০খ্রী) জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬৩৩হিজরীতে (১২৩৫খ্রী) মিশরে মারা যান। প্রায় ৯০ বৎসরের জীবনে তিনি তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের প্রায় সর্বত্র ভ্রমন করেন। তিনি বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন এবং ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞানে তাঁর অবদান রাখেন। তবে লক্ষ্যনীয় যে ঈদে মীলাদুন্নবীর প্রথম পুস্তক লেখক ইবনে দেহিয়া সমসাময়িক বা পরবর্তী আলেম ও লেখকদের প্রশংসা অর্জন করতে পারেন নি। বরং সকল ঐতিহাসিক ও লেখক তাঁর কর্মময় জীবনের বর্ণনার পাশাপাশি তাঁর কিছু কিছু আচরণ ও কর্মের সমালোচনা করেছেন।আল্লামা জিয়াউদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহেদ আল-মাকদেসী (৫৬৯-৬৪৩হি:) বলেছেন:
‘‘আমি ইস্পাহানে তাকে দেখেছি। তবে তাঁর থেকে কিছু শিক্ষা গ্রহণ করিনি। কারণ তাঁর অবস্থা আমার ভাল লাগেনি। তিনি ইমামদের খুবই নিন্দামন্দ করতেন” [57]।
আল্লামা যাহাবী লিখেছেন:
‘‘তিনি বিভিন্ন ইসলামী শাস্ত্রে পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন, আরবী ভাষা ও হাদীস শাস্ত্রে তিনি বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, তবে তিনি হাদীস বর্ণনাকারী হিসাবে জয়ীফ বা দুর্বল ছিলেন”[58]।
তাঁর এই স্বভাবের কারণে তিনি যখন মরক্বো ও তিউনিসিয়া অঞ্চলে অবস্থান করছিলেন তখন সে দেশের আলেমগণ একত্রে তার বিরুদ্ধে, তাঁকে অগ্রহণযোগ্য ঘোষনা দিয়ে একটি ঘোষণাপত্র লিখেন [59]।
ঐতিহাসিক আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল গনী, ইবনে নুকতা (৬২৯হি:) লিখেছেন:
‘‘তিনি বড় জ্ঞানী ও মর্যাদার অধিকারী হিসাবে সমাজে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজের বিষয়ে এমন অনেক বিষয় দাবী করতেন যা ছিল একেবারেই অবাস্তব। তিনি দাবী করতেন যে, সহীহ মুসলিম ও সুনানে তিরমিযী তাঁর মুখস্ত রয়েছে। একজন ছাত্র পরীক্ষামূলক ভাবে সহীহ মুসলিমের কয়েকটি হাদীস, সুনানে তিরমিযীর কয়েকটি হাদীস ও কয়েকটি বানোয়াট বা মাওযু হাদীস একত্রে লিখে তাঁকে দেন। তিনি হাদীসগুলো পৃথক করতে বা কোনটি কোন কিতাবের হাদীস তা জানাতে পারেন নি”[60]।
আল্লামা যাহাবী বলেন:
‘‘তাঁর গ্রন্থাবলীর মধ্যে সহীহ ও জয়ীফ বর্ণনার ক্ষেত্রে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা খুবই আপত্তিকর”[61]।
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (৮৫২হি:) ঐতিহাসিক ইবনে নাজ্জার (৬৪৩হি:) থেকে বর্ণনা করেছেন:
‘‘আমরা দেখেছি, সকল মানুষ একমত ছিলেন যে, ইবনে দেহিয়া মিথ্যা কথা বলেন এবং বিভিন্ন অসত্য দাবী করেন” [62]।
ইবনে হাজার আসকালানী অন্য এক বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন:
‘‘তাঁর সমসাময়িক এক আলেম বলেন: একদিন আমি সুলতানের দরবারে ছিলাম, যেখানে ইবনে দেহিয়াও ছিলেন। সুলতান আমাকে একটি হাদীস জিজ্ঞাসা করলে আমি হাদীসটি বলি। তখন তিনি আমাকে হাদীসটির সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। আমি তখন হাদীসটির সনদ মনে করতে পারি না এবং আমার অপারগতা জানাই। পরে আমি দরবার ত্যাগ করলে ইবনে দেহিয়া আমার সাথে আসেন এবং বলেন: যখন সুলতান আপনাকে সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন তখন যে কোন একটি বানোয়াট সনদ বলে দিলে আপনার কি ক্ষতি হতো? সুলতান ও তার দরবারের সবাই জাহেল, তারা কিছুই বুঝতে পারত না। তাতে আপনাকে ‘জানি না’ বলতে হতো না এবং উপস্থিত সভাসদদের কাছে আপনার মর্যাদা বৃদ্ধি পেত। উক্ত আলেম বলেন: ইবনে দেহিয়ার এই কথায় আমি বুঝতে পারলাম তিনি মিথ্যা বলতে পরোয়া করেন না”[63]।
ইবনে হাজার আসকালানী অন্য একজন সমসাময়িক আলেমের উদ্ধিৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন:
‘‘ইবনে দেহিয়া যখন ইস্পাহানে আসলেন তখন আমার পিতার খানকায় আসতেন। আমার আববা তাকে খুবই সম্মান করতেন। একদিন তিনি আমার আববার কাছে একটি জায়নামাজ নিয়ে আসেন এবং জায়নামাজটি তার সামনে রেখে বলেন: এই জায়নামাজে আমি এত এত হাজার রাকাত নামায আদায় করেছি এবং আমি কা’বা শরীফের মধ্যে এই জায়নামাজে বসে কয়েকবার কুরআন করীম খতম করেছি। আমার আববা খুবই খুশী হয়ে জায়নামাজটি গ্রহণ করেন এবং মাথায় রাখেন ও চুমু খেতে থাকেন। তিনি এই হাদীয়া পেয়ে খুবই খুশি হন। এ দিকে কাকতালীয় ভাবে সন্ধ্যার দিকে একজন স্পাহানী স্থানীয় ব্যক্তি আমাদের কাছে আসেন। তিনি কথাপ্রসঙ্গে বলেন: আপনাদের খানকায় যে মরোক্কীয় আলেম আসেন তাকে দেখলাম বাজার থেকে অনেক দামে একটি খুব সুন্দর জায়নামাজ কিনলেন। তখন আমার আববা (একটু খটকা লাগায়) ইবনে দেহিয়ার প্রদত্ত জায়নামাজটি আনতে বলেন। জায়নামাজটি দেখে ঐ ব্যক্তি কসম করে বলে যে, সে এই জায়নামাজটিই কিনতে দেখেছে ইবনে দেহিয়াকে। এতে আমার আববা চুপ হয়ে যান এবং আমাদের মন থেকে ইবনে দেহিয়ার প্রতি সকল সম্মান চলে যায়” [63]।
আল্লামা ইবনে কাসীর (৭৭৪ হি:) লিখেছেন:
‘‘ইবনে দেহিয়া সম্পর্কে অনেকে অনেক কিছু বলেছেন। বলা হয় তিনি মাগরিবের নামায কসর করার বিষয়ে একটি মিথ্যা হাদীস বানিয়ে বলেছেন। আমার ইচ্ছা ছিল হাদীসটির সনদ দেখব, কারণ সকল মুসলিম আলেম একমত যে, মাগরীবের নামায কসর হয় না… আল্লাহ আমাদেরকে এবং তাঁকে দয়া করে ক্ষমা করে দিন [65]।
ইবনে দেহিয়ার মিথ্যাচার সম্পর্কে একটি বিবরণ প্রদান করেছেন সমসাময়িক ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লিকান (৬৮১ হি:)। ইবনে দেহিয়ার প্রতি তাঁর অগাধ আস্থা ও শ্রদ্ধা ছিল বলে তাঁর লেখা থেকে প্রতীয়মান হয়। তাঁর লেখা মীলাদের বইটি তিনি ৬২৫ হিজরীতে কুকবুরীর দরবারে বসে পড়তে পেরে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করতেন [66]। কিন্তু তিনি আশ্চার্য্য হন যে, উক্ত বইয়ের শেষে ইবনে দেহিয়া একটি বড় আরবী কসীদা লিখেছেন কুকবূরীর প্রশংসায়। তিনি দাবী করেছেন যে, কসীদাটি তিনি নিজে লিখেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ইবনে খাল্লিকান জানতে পারেন যে, কবিতাটি সিরিয়ার হালাবশহরের বাসিন্দা কবি আস‘আদ ইবন মামাতীর (মৃত্যু ৬০৬হি:) লেখা ও তাঁর কাব্য গ্রন্থে সংকলিত, তিনি উক্ত কসীদা দ্বার তৎকালীন অন্য একজন শাসকের প্রশংসা করেন [67]।
সবকিছুর মধ্য দিয়ে আমরা বলতে পারি যে, ইবনে দেহিয়া সে যুগের একজন বিদ্যান ব্যক্তি ছিলেন। যে গ্রন্থটি তাকে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে দিয়েছে তা হলো ‘‘মীলাদুন্নবী’’ বা রাসূলুল্লাহরে জন্মবিষয়ে লেখা তার বই ‘‘আত- তানবীর ফী মাওলিদিল বাশীর আন-নাযির’’। কারণ এটিই ছিল ‘‘মীলাদুন্নবী’’ বা রাসূলুল্লাহরে জন্মবিষয়ে লেখা প্রথম বই। ইবনে খাল্লিকানের বর্ণনা অনুসারে আমরা দেখতে পাই, ইবনে দেহিয়া ৬০৪ হিজরীতে ইরবিলে প্রবেশ করেন। তিনি বছর দুয়েক সেখানে বাদশাহ কূকুবূরীর রাষ্ট্রীয় মেহমান হিসাবে অবস্থান করেন। এ সময়ে তিনি এই বইটি সংকলন করেন। ৬০৬ হিজরীতে তিনি এই বইটি লেখা সমাপ্ত হলে তা কূকুবূরীকে পড়ে শোনান [68]।
এখানে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ বা তৎপরবর্তী মুসলিম সমাজের আলেমগণ ৬০০ বৎসর যাবৎ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মকে কেন্দ্র করে কি একটি বইও লিখেন নি?
এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে সেই যুগগুলির অবস্থা বুঝতে হবে। প্রথম যুগের মুসলিমগণ, সাহাবী ও তাবেয়ীগণের সাবক্ষণিক কর্ম ও ব্যস্ততা ছিল মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে। তাঁদের সকল আবেগ, ভালবাসা ও ভক্তি দিয়ে তাঁরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন ও কর্ম জানতে, বুঝতে, শেখাতে ও লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছেন। তাদের কর্মকান্ডের যে বর্ণনা হাদীস শরীফে ও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং তাদের যুগে লিখিত ও সংকলিত যে সকল বই পুস্তকের বর্ণনা আমরা পাই বা যে সকল বই পুস্তক বর্তমান যুগ পর্যন্ত টিকে আছে তার আলোকে আমরা দেখতে পাই যে, তাঁরা মূলত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কর্ম, চরিত্র, ব্যবহার, আকৃতি, প্রকৃতি, জীবনপদ্ধতি জানতে বুঝতে ব্যস্ত ছিলেন, তাঁর জীবনী সংকলনের দিকে যে যুগের মুসলিমদের মনোযোগ দেখা যায় না। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের অনুকরণীয়, অনুসরণীয় ও তাঁর প্রবর্তিত বিধানাবলীর দিকটায় তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন, তাঁর জীবনের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা, বা জীবনী রচনার দিকে তারা গুরুত্ব প্রদান করেন নি। ফলে আমরা দেখতে পাই যে, সাহাবীগণের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিন, জন্ম তারিখ বা জন্মমাস নিয়ে কোন আলোচনাই পাওয়া যায় না। স্বভাবত:ই তাঁর জন্ম কেন্দ্রীক কোন গ্রন্থও তখন রচিত হয়নি। প্রথম তিন শতাব্দীতে রচিত হাদীস গ্রন্থ সমূহে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম সংক্রান্ত যৎসামান্য কয়েকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যা আগে আলোচনা করেছি। এছাড়া প্রথম শতাব্দীর শেষ থেকে সীরাতুন্নাবী বা নবী জীবনী বিষয়ক গ্রন্থ লেখা হতে থাকে বলে মনে হয়। তবে এ যুগে মূলত: সীরাতুন্নাবীর মাগাযী বা যুদ্ধবিগ্রহ বিষয়ক বিষয়েই বিশেষভাবে লিখা হত [69]। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতকের উল্লেখযোগ্য সীরাতুন্নবী গ্রন্থ হল মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (মৃত্যু ১৫১হি:/৭৬৮খ্রি:), আব্দুল মালেক ইবনে হিশাম (মৃত্যু ২১৮হি:/৮৩৪খ্রি:), মুহাম্মাদ ইবনে সা’দ (২৩০হি:/৮৪৫খ্রি:) প্রমুখের লিখা ‘‘সীরাতুন্নবী গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। এ সকল গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মসংক্রান্ত কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। এছাড়া ৩য় হিজরী শতক থেকে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ লিখিত সকল ইতিহাস গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মসংক্রান্ত বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যেমন খলীফা ইবনে খাইয়াত ‘শাবাব’ আল উসফুরী (২৪০হি:/৮৫৪খ্রি:), আহমদ ইবনে ইয়হইয়া আল বালাযুরী (২৭৯হি:/৮৯২খ্রি:), আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনে জরীর (৩১০হি:/৯২৩খ্রি:) ও অন্যান্য ঐতিহাসিকদের লিখিত ইতিহাস গ্রন্থ। ৫ম হি: শতক থেকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কতৃক সংঘটিত মোজেজা বা অলৌকিক ঘটনাবলী পৃথকভাবে সংকলিত করে ‘‘দালাইলুন নুবুওয়াত’’ নামে কয়েকটি গ্রন্থ লেখা হয়, যেমন আবু নু‘আাইম আহমদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-আসফাহানী (৪৩০হি:/১০৩৯খ্রি:) ও আবু বকর আহমদ ইবনে হুসাইন আল- বাইহাকী (৪৫৮হি:/১০৬৬ খ্রি:) সংকলিত ‘‘দালাইলুন নুবুওয়াত’’ গ্রন্থ। এ সকল গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম কালীন অলৌকিক ঘটনাবলীর কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। সর্বাবস্থায় আমরা দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মকে নিয়ে পৃথক গ্রন্থ কেউই রচনা করেন নি। বস্ত্তত: তাঁর জন্ম উদযাপন যেমন ইসলামের প্রথম শতাব্দীগুলোতে মুসলিম উম্মাহর অজানা ছিল, তেমনি তাঁর জন্ম বা ‘‘মীলাদ’’ নিয়ে পৃথক গ্রন্থও ৬ষ্ঠ শতাব্দীর আগে কেউ রচনা করেন নি। কারণ তাদের কাছে জন্ম বৃত্তান্ত বড় কোন বিষয় বলে বিবেচিত হতো না।
উপসংহার:
এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, মিশরের ইসমাঈলীয় শাসকগণ দ্বারা প্রবর্তিত হলেও ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনকে সমস্ত মুসলিম বিশ্বে অন্যতম উৎসবে পরিণত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান ইবরিলের শাসক আবু সাঈদ কূকুবূরীর। তাঁকেই আমরা মীলাদ অনুষ্ঠানের প্রকৃত প্রবর্তক বলে মনে করতে পারি। এর অন্যতম প্রমাণ হলো ৪র্থ হিজরী শতকে মিশরে এই উদযাপন শুরু হলে তার কোন প্রভাব বাইরের মুসলিম সমাজগুলোতে পড়ে নি। এমনকি পরবতী ২০০ বৎসরের মধ্যেও আমরা মুসলিম বিশ্বের অন্য কোথাও এই উৎসব পালন করতে দেখতে পাই না। অথচ ৭ম হিজরী শতকের শুরুতে কুকবূরী ইরবিলে ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন শুরু করলে তা তৎকালীন মুসলিম সমাজগুলিতে সাড়া জাগায়। পরবর্তী ২০০ বৎসরের মধ্যে এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন মুসলিম সমাজে অনেক মানুষ ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করতে শুরু করে।
যে সকল কর্ম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে, সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীদের যুগে ধর্মীয় কর্ম, আচার বা উৎসব হিসাবে প্রচলিত, পরিচিত বা আচরিত ছিল না, পরবর্তী যুগে মুসলিম সমাজে ধর্মীয় কর্ম হিসাবে প্রচলিত হয়েছে সে সকল কাজ কখনো পরবর্তী যুগের মুসলিমদের জন্য আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম হতে পারে না।
যেহেতু মিশরের শাসকগণ ও পরবর্তীকালে আবু সাঈদ কূকবুরী প্রবর্তিত ঈদে মীলাদুন্নবী জাতীয় কোন অনুষ্ঠান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে, সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীদের যুগে প্রচলিত বা পরিচিত ছিল না তাই স্বভাবত:ই তা বিদ‘আত ও পরিত্যাজ্য। সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ তাঁদের প্রচন্ডতম নবীর ভালবাসা সত্ত্বেও কখনো তাঁদের আনন্দ এভাবে উৎসব বা উদযাপনের মাধ্যমে প্রকাশ করেন নি, কাজেই পরবর্তী যুগের মুসলিমদের জন্যও তা শরী‘আত সঙ্গত হবে না। পরবর্তী যুগের মুসলিমদের উচিৎ প্রথম যুগের মুসলিমদের ন্যায় সার্বক্ষণিক সুন্নাত পালন, সীরাত আলোচনা, দরুদ ও সালাম এবং আন্তরিক ভালবাসার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানানো। অমুসলিমদের অনুকরণে জন্মদিন পালনের মাধ্যমে রাসূলের ভালবাসা প্রকাশ পায় না। বরং এ সকল অনুষ্ঠানের প্রসার সাহাবীদের ভালবাসা, ভক্তি ও আনন্দ প্রকাশের পদ্ধতিকে হেয় প্রতিপন্ন করার মানসিকতা সৃষ্টি করে, কারণ যারা এ সকল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভালবাসা ও আনন্দ প্রকাশ করবেন, তাঁদের মনে হতে থাকবে যে সাহাবীদের মত নীরব, অনানুষ্ঠানিক, সার্বক্ষণিক ভালবাসা ও ভক্তি প্রকাশ পদ্ধতির চেয়ে তাদের পদ্ধতিটাই উত্তম। যা নিঃসন্দেহে ভ্রষ্টতা। এ ব্যাপারে বহু আলেম সাবধান করে গেছেন। যেমন, সপ্তম-অষ্টম হিজরী শতাব্দীর অন্যতম আলেম ইমাম আল্লামা তাজুদ্দীন উমর ইবন আলী আল-ফাকেহানী (মৃত্যু: ৭৩৪ হিজরী/ ১৩৩৪খ্রি:), আল্লামা আবু আব্দুল্লাহ মুহম্মদ ইবন মুহম্মদ ইবনুল হাজ্জ (৭৩৭হি:/১৩৩৬খ্রি:), ৮ম হিজরী শতকের প্রখ্যাত আলেম আবু ইসহাক ইব্রাহীম ইবন মূসা ইবন মুহাম্মাদ আশ-শাতিবী (মৃত্যু ৭৯০ হি:) ও অন্যান্য উলামায়ে কেরাম [70]।
আমরা আগেই বলেছি যে, জন্মদিন পালনের ন্যায় মৃত্যুদিন পালনও অনারব সংস্কৃতির অংশ, যা পরবর্তী সময়ে মুসলিম সমাজেও প্রচলিত হয়ে যায়। রবিউল আউয়াল মাস যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম মাস, তেমনি তাঁর মৃত্যুর মাসও বটে। তাই এটি দুঃখের কারণ হতে পারে। কোন কোন বর্ণনা থেকে দেখা যায় যে, ৭ম হিজরী শতাব্দীর শেষে এবং ৮ম হিজরী শতকের প্রথমাংশেও মীলাদুন্নবী পালন অনেক দেশের মুসলিমদের কাছে অজানা ছিল, তারা জন্মদিন পালন না করে মৃত্যু দিবস পালন করতেন। বস্ত্তত: এ সবই গর্হিত বিদ‘আত। ইসলামে বিদ‘আতের কোন স্থান নেই। তাই জন্ম দিবস বা মৃত্যু দিবস এসব পালন থেকে আমাদেরকে দূরে থাকতে হবে।
আল্লাহই আমাদের সহায় হোন ও তৌফিক দিন। দো‘আ করি তিনি দয়া করে আমার এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে কবুল করেন। আল্লাহর মহান রাসূল, হাবীব ও খলীল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর উপর অগণিত সালাত ও সালাম। আল্লাহুম্মা সাল্লি আলাইহি ওয়া সাল্লিম মা যাকারুয যাকিরুন ওয়া গাফালা আন যিকরিহিল গাফিলূন।
________________________________________
[1] ড: ইবরাহীম আনীস ও সঙ্গীগণ, আল-মুজাম আল ওয়াসীত (বৈরুত, দারুল ফিকর) ২/১০৫৬।
[2]ইবনে মনজুর, লিসানুল আরব (বৈরুত, দারু সাদের) ৩/৪৬৮।
[3]আব্দুল হাই লাখনাবী, যাফরুল আমানী ফী মুখতাসারিল জুরজানী (সংযুক্ত আরব আমিরাত, দুবাই, দারুল ইলম, ১ম সংস্করণ, ১৯৯৫) ৩১-৩৪ পৃ।
[4]সহীহ মুসলিম (মিশর, কাইরো, দারু এহইয়াইল কুতুবিল আরাবিয়্যাহ, তারিখবিহীন) ২/৮১৯।
[5]আহমাদ ইবনে হাম্বাল, আল-মুসনাদ (মিসর, দারুল মা’আরিফ, ১৯৫০) ৪/১৭২-১৭৩, নং ২৫০৬ (সম্পাদক আহমদ শাকির সনদ আলোচনা করে বলেছেন: হাদীসটির সনদ সহীহ)
[6]তিরমিযী, আল-জামিয়, প্রাগুক্ত ৫/৫৫০, নং ৩৬১৯। ইমাম তিরমিযী বলেছেন: হাদীসটি হাসান গরীব।
[7]আকরাম যিয়া আর-উমারী, আস-সীরাতুন নাবাবীয়্যাহ আস-সহীহা (মদীনা মুনাওয়ারা, মাকতাবাতুল উলুম ওয়াল হিকাম, ৪র্থ সংস্করণ ১৯৯৩ ) ১/৯৬-৯৮, মাহদী রেজকুল্লাহ আহমদ, আস-সীরাতুন নাবাবীয়াহ (সৌদি আরব, রিয়াদ, বাদশাহ ফয়সল কেন্দ্র, ১ম সংস্করণ, ১৯৯২) ১০৯-১১০ পৃ।
[8]ইবনে সা’দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা (বৈরুত, দারু এহইয়ায়েত তুরাসিল আরাবী) ১/৪৭।
[9]ইবনে হিশাম, আস-সীরাতুন নাবাবীয়্যাহ (মিশর, কায়রো, দারুর রাইয়ান, ১ম সংস্করণ, ১৯৭৮)১/১৮৩
[10]মাহদী রেজকুল্লাহ আহমদ, আস-সীরাতুন নাবাবীয়াহ, ১০৯ পৃ।
[11]ইবনে সা’দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা ১/১০০-১০১, ইবনে কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (বৈরুত, দারুল ফিকর, ১ম সংস্করণ, ১৯৯৬) ২/২১৫, আল-কাসতালানী, আহমদ বিন মুহাম্মাদ, আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যা (বৈরুত, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যা, ১ম সংস্করণ ১৯৯৬) ১/৭৪-৭৫, আল-যারকানী, শরহুল মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়্যা (বৈরুত, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যা, ১ম সংস্করণ ১৯৯৬) ১/২৪৫-২৪৮, ইবনে রাজাব, লাতায়েফুল মায়ারেফ, প্রাগুক্ত ১/১৫০ ।
[12]আস-সালেহী, মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ, সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ ফী সীরাতি খাইরিল ইবাদ, আস-সীরাতুশ শামিয়্যাহ (বৈরূত, দারুল কুতুব আল- ইলমিয়্যাহ, প্রথম প্রকাশ, ১৯৯৩) ১/৩৬৬
[13]আস-সালেহী, সীরাত ১/৩৬২
[14]সাইয়েদ দিলদার আলী, রাসূলুল কালাম ফিল মাওলিদ ওয়াল কিয়াম (লাহোর), ১৫ পৃ।
[15]ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, প্রাগুক্ত ৭/৬৪২, ৬৫৩, ৮/৩, ৯, ১১, ১৫, ১৬,. ১৭, …. .
[16]আগাখানী, বুহরা, বাতেনী শিয়াদের পূর্বপূরুষ।
[17]বিস্তারিত দেখুন: মাহমূদ শাকির, আত-তারিখুল ইসলামী (বাইরূত, আল-মাকতাব আল-ইসলামী, ১ম সংস্করণ ১৯৮৫ ইং) ৬/১১১-১১২, ১২৩-১২৪, ১৩৬-১৩৭, ১৬৫-১৬৮, ১৮০-১৮২, ১৯৩-১৯৬, ২০৮-২০৯, ২৩৩, ২৪৮, ২৬৫, ২৮৭-২৮৯, ৩০৩-৩০৭।
[18]আল-মাকরীযী, আহমদ বিন আলী, আল-মাওয়ায়িজ ওয়াল ইতিবার বি যিকরিল খুতাতি ওয়াল আসার (মিশর, কাইরো, মাকতাবাতুস সাকাফা আদ দীনীয়্যাহ) ৪৯০-৪৯৫ পৃ।
[19]বিস্তারিত দেখুন: ইবনে কাসীর: আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, প্রাগুক্ত, ৭ম খন্ড, মাহমূদ শাকির, আত-তারিখ আল-ইসলামী, ৫ম ও ৬ষ্ট খন্ড।
[20]বিস্তারিত দেখুন: যাহাবী, মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে ওসমান, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা’ (বৈরুত, মুয়াস্সাসাতুর রিসালা, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, ১৯৮৯ ইং) ১৫/১৪১-১৫৯, আল-শাহরাস্তানী, আল-মিলাল ওয়ান নিহাল (বৈরুত, দারুল মা’রিফা, ১৯৮০) ১/১৯১-১৯৮, ওয়ামী, আল-মাউসূয়া আল-মুয়াসসারা (রিয়াদ, ওয়ামী, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৮) ৪৫-৫২ পৃ।
[21]যাহাবী, নুবালা , ১৫/১৬৪। আরো দেখুন: ইবনে খাল্লিকান, ওয়াফাইয়াতুল আ’ইয়ান (ইরান, কূম, মানশুরাতুশ শরীফ আর-রাযী, ২য় সংস্করণ) ৫/২২৪-২২৮, আল-যিরিকলী, আল-আলাম বৈরুত, দারুল ইলম লিল মালাঈন, ৯ম সংস্করণ, ১৯৯০) ৭/২৬৫।
[22]ইজ্জত আলী আতিয়্যা, আল-বিদয়াত (বৈরুত, দারুল কিতাব আল-আরাবী, ২য় সংস্করণ, ১৯৮০) ৪১১ পৃ, ইসমাঈল বিন মুহাম্মাদ আল-আনসারী, আল-কাউলুল ফাসল (সৌদী আরব, রিয়াদ, আর-রিয়াসা আল-আমাহ লি ইদারাতিল বুহুস, ১৯৮৫) ৬৪-৭২।
[23]আল-কালকাশান্দী, সুবহুল আ’শা (মিশর, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়) ৩/৪৯৮-৪৯৯। অথচ এটাও সত্য যে, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর জন্মদিন নির্ধারণও কোন প্রমাণিত বিষয় নয়।
[24]আল-মাকরীযি, আল-মাওয়ায়িজ ওয়াল ইতিবার , প্রাগুক্ত, ৪৯১ পৃ।
[25]আস-সালেহী, সীরাত শামীয়্যাহ, প্রাগুক্ত, ১/৩৬৩, ৩৬৫।
[26]মাহমুদ শাকির, প্রাগুক্ত ৬/৩৪-৩৮, ২৫২-২৫৭।
[27]প্রাগুক্ত ৬/২৫৯-৩৫৬।
[28]বিস্তারিত দেখুন: ; যাহাবী, আল-ই’বার ফী খাবারি মান গাবার (বইরুত, দারুল কুতুব আল-ইলমীয়্যা) ৩/১২৮-৩১২।
[29]যাহাবী, ,প্রাগুক্ত, ৩/১৭২।
[30]মাহমুদ শাকির, প্রাগুক্ত ৬/৩৯-৪১, ৩৪৫-৩৫৬: যাহাবী, আল-ইবার , প্রাগুক্ত, ৩/২৭৮।
[31]যাহাবী, আল-ই’বার , প্রাগুক্ত, ৩/২৮৭।
[32]বিস্তারিত দেখুন: ; যাহাবী, আল-ই’বার , প্রাগুক্ত, ৩/১১-২৮৫।
[33]ইবনে কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, প্রাগুক্ত, ৮/৫৯৪-৫৯৫।
[34]ইবনে কাসীর, প্রাগুক্ত, ৯/১০।
[35]ইবনে কাসীর, প্রাগুক্ত, ৮/৫৯৭।
[36]যাহাবী, নুবালা, ১৪/৬৬-৭০।
[37]আবু হামিদ আল-গাযালী, এহইয়াউ উলূমিদ্দীন (বৈরুত, দারুল ফিকর, ১৯৯৪) ২/২৯২-৩৩২।
[38]আস-সালেহী, সীরাত, প্রাগুক্ত, ১/৩৬২।
[39]যাহাবী, নুবালা’, প্রাগুক্ত, ২২/৩৩৪।
[40]ইবনে খাল্লিকান, ওয়াইয়াতুল আ’ইয়ান, প্রাগুক্ত, ৪/১২১।
[41]যিরিকলী, মুহম্মদ খাইরুদ্দীন, আল-আ’লাম, প্রাগুক্ত, ৫/২২৭।
[42]যাহাবী, নুবালা’, প্রাগুক্ত, ২২/৩২৫; আল-ই’বার, প্রাগুক্ত, ৩/৪০, ২০৮পৃ।
[43]যাহাবী, আল-ই’বার , প্রাগুক্ত, ৩/২০৮পৃ।
[44]যাহাবী, নুবালা’, প্রাগুক্ত, ২২/৩৩৫।
[45]প্রাগুক্ত।
[46]প্রাগুক্ত।
[47]প্রাগুক্ত। সালাহুদ্দীন আইউবীরা ৬ভাই ও দুই বোন ছিলেন। যাহবী, আল-ইবার , প্রাগুক্ত, ৩/৫৪।
[48]যাহাবী, আল-ইবার , প্রাগুক্ত, ৩/৮৫, ইবনে কাসীর, আল-বিদায়া, প্রাগুক্ত, ৮/৪৭০-৪৭৩, মাহমূদ শাকির, আত-তারীখুল ইসলামী, প্রাগুক্ত, ৬/৩৩২।
[49]যাহাবী, নুবালা’, প্রাগুক্ত, ২২/৩৩৫, আল-ইবার , প্রাগুক্ত, ৩/২০৮।
[50]যাহাবী, প্রাগুক্ত, ৩/২০৮।
[51]আল-যিরিকলী, আ”লাম, প্রাগুক্ত, ৫/২৩৭।
[52]ইয়াকুত আল-হামাবী, মু’জামুল বুলদান (বৈরুত, দারু এহইয়াইত তুরাস আল-আরাবী, ১৯৭৯) ১/১৩৮।
[53]যাহাবী, আল-ইবার ৩/২০৮, নুবালা ২২/৩৩৭, ইবনে কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৯/১৮।
[54]মোহাম্মদ বেশারাতুল্লাহ, হাকিকতে মোহাম্মাদী ও মীলাদে আহমাদী (পার্বত্য চট্টগ্রাম, মোহাম্মদ মুশতাকুর রহমান, প্রথম সংস্করণ) ৩০১-৩০২পৃ।
[55]ইবনে খাল্লিকান ৩/৪৪৯। আরো দেখুন: ১/২১১, ৪/১১৯
[56]যাহাবী, নুবালা ২২/৩৩৬, আস-সালেহী, সীরাত ১/৩৬২, ইবনে কাসীর, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৯/২৬।
[57]যাহাবী, নুবালা ২২/৩৯১।
[58]যাহাবী, নুবালা ২২/৩৯১।
[59]যাহাবী, নুবালা ২২/৩৯১। মিযানুল ইতিদাল ৩/১৮৬।
[60]যাহাবী, নুবালা ২২/৩৯২। আরো দেখুন: সুয়ূতী, জালালুদ্দীন আব্দুর রহমান, তাবাকাতুল হুফ্ফায (বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৩) ৫০১ পৃ.।
[61]মিযানুল ইতিদাল ৩/১৮৮।
[62]ইবনে হাজার, লিসানুল মিযান (বৈরুত, দারুল ফিকর, ২য় সংস্করণ) ৪/২৯৫।
[63]ইবনে হাজার, লিসানুল মিযান ৪/২৯৫।
[64]ইবনে হাজার, লিসানুল মিযান ৪/২৯৬।
[65]ইবনে কাসীর , আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৯/২৬।
[66]ইবনে খাল্লিকান, প্রাগুক্ত ১/২১২, ৩/৪৪৯-৪৫০।
[67]ইবনে খাল্লিকান, প্রাগুক্ত ১/২১১-২১২, ৩/৪৫০।
[68]ইবনে খাল্লিকান, প্রাগুক্ত ১/২১২, ৩/২৯, ৪/১১৯।
[69]ফুয়াদ সিযকিন, তারিখুল তুরাস আল আরাবী (সৌদি আরব, রিয়াদ, আল-ইমাম বিশ্ববিদ্যালয় ১ম সংস্করণ ১৯৮৩), প্রথম খন্ড, ২য় অংশ, ৬৫-৮৬ পৃ।
[70]বিস্তারিত দেখুন: আশ-শাতেবী, আবু ইসহাক ইবরাহীম, আল-ই’তিসাম (সৈাদী আরব, আল-খুবার, দারু ইবনে আফফান, ৪র্থ সংস্করণ ১৯৯৫) ২/৫৪৮, আস সালেহী, আস-সীরাতুশ শামিয়্যা, প্রাগুক্ত ১/৩৬২-৩৭৪।

ঈদে মিলাদুন্নবীঃ দূর হোক সকল ভ্রান্ত ধারণা
রাসুলুল্লাহ (সা) এর জন্ম দিবস কবে?


কোন তারিখে রাসুলে আকরাম (সা) জন্ম গ্রহণ করেছেন তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। অনেকের মতে তাঁর জন্ম দিন হল ১২ রবিউল আউয়াল। আবার অনেকের মতে ৯ রবিউল আউয়াল। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে গবেষণা করে প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে যে রাসুলুল্লাহ (সা) এর জন্মদিন আসলে ছিল ৯ রবিউল আউয়াল সোমবার। বর্তমান বিশ্বে সকলের নিকট সমাদৃত, সহিহ হাদিস নির্ভর শুদ্ধতম সিরাতগ্রন্থ হল ‘আর-রাহীক আল-মাখতুম’। নবী করিম (সা) এর জন্ম দিবস সম্পর্কে এ গ্রন্থে বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা) ৫৭১ খৃস্টাব্দে ২০ এপ্রিল মোতাবেক ৯ রবিউল আউয়াল সোমবার প্রত্যুষে জন্ম গ্রহণ করেন। এটা গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যুগের প্রখ্যাত আলেম মুহাম্মাদ সুলাইমান আল-মানসূর ও মিশরের প্রখ্যাত জোতির্বিজ্ঞানী মাহমুদ পাশা।

আল্লামা শিবলী নোমানী ও সাইয়েদ সুলাইমান নদভী (রহ) প্রণীত সাড়া-জাগানো সিরাত-গ্রন্থ হল ‘সিরাতুন্নবি’। এ গ্রন্থে বলা হয়েছে, নবী করিম (সা) এর জন্ম দিবস সম্পর্কে মিশরের প্রখ্যাত জোতির্বিজ্ঞানী মাহমূদ পাশা এক পুস্তিকা রচনা করেছেন। এতে তিনি প্রমাণ করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা) এর পবিত্র জন্ম ৯ রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার, মোতাবেক ২০ এপ্রিল ৫৭১ খৃস্টাব্দ। মাহমুদ পাশা যে প্রমাণ-পত্র দিয়েছেন তা কয়েক পৃষ্ঠাব্যাপী বিস্তৃত।”

তাদের গবেষণা বিষয়ের একটি দিক হল যে আল্লাহর রাসুল (সা) সহিহ হাদিসে নিজেই বলেছেন তার জন্ম সোমবার দিন হয়েছে। মাহমুদ পাশা গবেষণা ও হিসাব করে দেখিয়েছেন, সে বছর ১২ রবিউল আউয়াল তারিখের দিনটা সোমবার ছিল না ছিল বৃহস্পতিবার। সোমবার ছিল ৯ রবিউল আউয়াল।

তাই বলা যায়, জন্ম তারিখ নিয়ে অতীতে যে অস্পষ্টতা ছিল বর্তমানে তা নেই। মাহমুদ পাশার গবেষণার এ ফল প্রকাশিত হওয়ার পর সকল জ্ঞানী ব্যক্তিই তা গ্রহণ করেছেন এবং কেউ তার প্রমাণ খণ্ডন করতে পারেননি। অতএব নবী করিম (সা) এর জন্ম দিবস হল ৯ রবিউল আউয়াল; ১২ রবিউল আউয়াল নয়। তবে সর্বসম্মতভাবে তাঁর ইন্তেকাল দিবস হল ১২ রবিউল আউয়াল। যে দিনটিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মোৎসব পালন করা হয় সে দিনটি মূলত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইটি ওয়াসাল্লামের জন্ম দিবস নয়, বরং তা ছিল তাঁর মৃত্যু দিবস। তাই দিনটি ঈদ হিসেবে পালন করার আদৌ কোন যৌক্তিকতা নেই।

রাসুলে করিম (সা) এর জন্মদিন পালন সম্পর্কে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি
কোন ব্যক্তির জন্মদিবস পালন করা ইসলামসম্মত নয়। এটা হল খৃস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধসহ অমুসলিমদের রীতি। ইসলাম কারো জন্মদিবস পালন অনুমোদন করে না।
এর প্রমাণসমূহ নিচে তুলে ধরা হল।

এক. ইসলাম আজ পর্যন্ত অবিকৃত আছে এবং ইনশাআল্লাহ থাকবে। ইসলামে সকল হুকুম আহকাম, আচার-অনুষ্ঠান সুনির্ধারিত ও কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু নবি করিম (সা) এর জন্ম দিবস বা মিলাদ পালনের কথা কোথাও নেই। এমনকি নবিপ্রেমের নজিরবিহীর দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী সাহাবায়ে কেরাম রাজিয়াল্লাহু আনহুমদের কেউ এ ধরনের কাজ করেছেন বলে কোন প্রমাণ নেই। তাই ঈদে-মিলাদ পালন করা নিশ্চয়ই একটি বেদআতি কর্ম। বেদআত জঘন্য গুনাহের কাজ।

দুই. ইসলামে কম হলেও একলাখ চব্বিশ হাজার নবি, তারপরে খুলাফায়ে রাশেদিন ও অসংখ্য সাহাবা, মনীষী, আওলিয়ায়ে কেরাম জন্ম গ্রহণ করেছেন ও ইন্তেকাল করেছেন। যদি তাদের জন্ম বা মৃত্যু দিবস পালন ইসলাম-সমর্থিত হত বা সওয়াবের কাজ হত তাহলে বছরব্যাপী জন্ম-মৃত্যু দিবস পালনের ঘূর্ণাবর্তে আবদ্ধ হয়ে যেতে হত আমাদের সকল মুলমানদের।

তিন. নবী করিম (সা) এর জন্মদিন পালনের প্রস্তাব সাহাবায়ে কেরাম রাজিয়াল্লাহু আনহুম কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। যেমন হিজরি ক্যালেন্ডার প্রবর্তিত হওয়ার সময় হযরত উমর রাজিয়াল্লাহু আনহু সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে বৈঠকে বসলেন। কোন এক স্মরণীয় ঘটনার দিন থেকে একটি নতুন বর্ষগণনা পদ্ধতি প্রবর্তন করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কেউ কেউ প্রস্তাব করলেন রাসুলুল্লাহ (সা) এর জন্ম তারিখ থেকে সন গণনা শুরু করা যেতে পারে। উমর (রা) এ প্রস্তাব বাতিল করে দিয়ে বললেন, এ পদ্ধতি খৃস্টানদের। উমর (রা) এর এ সিদ্ধান্তের সাথে সকল সাহাবায়ে কেরাম একমত পোষণ করলেন। এবং রাসুলে করিম (সা) এর হিজরত থেকে ইসলামি সন গণনা আরম্ভ করলেন।

চার. রাসুলুল্লাহ (সা) এর সাহাবাগণ ছিলেন সত্যিকারার্থে নবিপ্রেমিক ও সর্বোত্তম অনুসারী। নবিপ্রেমের বেনজির দৃষ্টান্ত তারাই স্থাপন করেছেন। তারা কখনো নবি করিম (সা) এর জন্মদিনে ঈদ বা অনুষ্ঠান পালন করেননি। যদি এটা করা ভাল হত ও মহব্বতের পরিচায়ক হত তবে তারা তা অবশ্যই করতেন। জন্মোৎসব পালন করার কালচার সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা ছিল না তা বলা যায় না। কেননা তাদের সামনেই তো খৃস্টানরা ঈসা আলাইহিস সালাম-এর জন্মদিন ( বড়দিন) উদযাপন করত।

পাঁচ. জন্ম দিবস কেন্দ্রিক উৎসব-অনুষ্ঠান খৃস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য অমুসলিমদের ধর্মীয় রীতি। যেমন বড় দিন, জন্মাষ্ঠমী, বৌদ্ধ পূর্ণিমা ইত্যাদি। তাই এটা মুসলিমদের জন্য পরিত্যাজ্য। বিধর্মীদের ধর্মীয় রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান যতই ভাল দেখা যাক না কখনো তা মুসলিমদের জন্য গ্রহণ করা জায়েজ নয়। এ কথার সমর্থনে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করলাম।

(ক) রাসুলে করিম (সা) বলেছেন –‘যে ব্যক্তি কোন জাতির সাদৃশ্যতা গ্রহণ করবে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে।’

(খ) আজানের প্রচলনের সময় কেউ কেউ রাসুলুল্লাহ (সা) এর কাছে প্রস্তাব করলেন, সালাতের সময় হলে আগুন জ্বালানো যেতে পারে। কেউ প্রস্তাব করলেন ঘণ্টাধ্বনি করা যেতে পারে। কেউ বললেন বাঁশী বাজানো যেতে পারে। কিন্তু রাসুলে করিম (সা) সকল প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন আগুন জ্বালানো হল অগ্নিপুজারী পারসিকদের রীতি। ঘণ্টা বাজানো খৃস্টানদের ও বাঁশী বাজানো ইহুদীদের রীতি।

(গ) মদিনার ইহুদীরা আশুরার দিনে একটি রোযা পালন করত। রাসুলে করিম (সা) দুটি রোযা রাখতে নির্দেশ দিলেন, যাতে তাদের সাথে সাদৃশ্যতা না হয়।

(ঘ) হিজরি সনের প্রবর্তনের সময় অনেকে রাসুলে করিম (সা) এর জন্মদিন থেকে সন গণনার প্রস্তাব করেন। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যাত হয়, খৃস্টানদের অনুকরণ হওয়ার কারণে।

ইসলামে ঈদ দুটি, ঈদুল ফিতর ও আজহা

সাহাবি আনাস বিন মালিক (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলে কারিম (সা) যখন মদিনায় আসলেন তখন দেখলেন বছরের দুটি দিনে মদিনাবাসী আনন্দ-ফুর্তি করছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন এ দিন দুটো কি? উত্তরে তারা বলল, আমরা ইসলামপূর্ব মূর্খতার যুগে এ দুদিন আনন্দ-ফুর্তি করতাম। রাসুলুল্লাহ (সা) বললেন- আল্লাহ তায়ালা এ দুদিনের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুটো দিন তোমাদের দিয়েছেন। তা হল ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর। (আবু দাউদ) ইসলামে ঈদ শুধু দুটি। এ বিষয়টি শুধু সহিহ হাদিস দ্বারাই প্রমাণিত নয়, তা রবং ইজমায়ে উম্মত দ্বারাও প্রতিষ্ঠিত। যদি কেউ ইসলামে তৃতীয় আরেকটি ঈদের প্রচলন করে তবে তা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। বরং তা দীনের মধ্যে একটা বেদআত ও বিকৃতি বলেই গণ্য হবে। যখন কেউ বলে সকল ঈদের সেরা ঈদ- ঈদে মিলাদ’ তখন স্বাভাবিক ভাবেই এর অর্থ হয় ইসলামে যতগুলো ঈদ আছে তার মধ্যে ঈদে মিলাদ হল শ্রেষ্ঠ ঈদ। কিভাবে এটা সম্ভব? যে ঈদকে আল্লাহ ও তার রাসুল স্বীকৃতি দেননি। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন ও ইমামগণ যে ঈদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন তা ইসলামে শ্রেষ্ঠ ঈদ বলে বিবেচিত হতে পারে কিভাবে? কোনভাবেই নয়। যে ঈদ আল্লাহর রাসুল (সা) প্রচলন করে গেলেন তা শ্রেষ্ঠ হবে না। এটা কিভাবে মেনে নেয়া যায়? কোনভাবেই নয়।
তা সত্ত্বেও যদি ঈদ পালন করতেই হয় তবে তা ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে না করে ৯ রবিউল আউয়ালে করা যেতে পারে। তাহলে অন্তত সাইয়েদুল মুরসালিন (সা) এর ইন্তেকাল দিবসে ঈদ পালন করার মত ধৃষ্ঠতা ও বেয়াদবির পরিচয় দেয়া হবে না। অবশ্য এটাও কিন্তু বেদআত বলে গণ্য হবে।

সারকথা, ১২ রবিউল আউয়ালে ঈদে মিলাদ উদযাপন করা শরিয়তবিরোধী কাজ। এ ধরনের কাজ হতে যেমন নিজেদের বাঁচাতে হবে তেমনি অন্যকে বিরত রাখার চেষ্টা করতে হবে।

যে কারণে ঈদে মিলাদুন্নবি পালন করা যাবে না

প্রথমত ইসলাম পরিপূর্ণ ধর্ম। কোরআন ও হাদিসের কোথাও ঈদে মিলাদ পালন করতে বলা হয়নি। রাসূলে কারিম (সা) এর সাহাবায়ে কেরাম বা তাবেয়িনগণ কখনো এটা পালন করেননি। তাই এটা বেদআত ও গোমরাহি।

রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, “আমাদের এ ধর্মে যে নতুন কোন বিষয় প্রচলন করলে তা প্রত্যাখ্যাত হবে।” (বুখারি ও মুসলিম) তিনি আরো ইরশাদ করেন, “সাবধান ! ধর্মে প্রবর্র্র্তির্ত নতুন বিষয় থেকে সর্বদা দূরে থাকবে। কেননা নব-প্রবর্তির্ত প্রতিটি বিষয় হল বেদআত ও প্রতিটি বেদআত হল পথভ্রষ্ঠতা।” (আবু দাউদ, তিরমিজী, ইবনে মাজা, মুসনাদে আহমাদ) দ্বিতীয়তঃ ঈদে মিলাদুন্নবি হল খৃস্টানদের বড় দিন, হিন্দুদের জন্মাষ্ঠমী ও বৌদ্ধদের বৌদ্ধ-পূর্ণিমার অনুকরণ। ধর্মীয় বিষয়ে তাদের আচার-অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করা ঈমানের দাবি। অথচ ঈদে মিলাদ পালনের মাধ্যমে তাদের বিরোধিতা না করে অনুসরণ করা হয়।

তৃতীয়তঃ সর্বসম্মতভাবে ১২ রবিউল আউয়াল নবী আকরাম (সা) এর ইন্তেকাল দিবস। এতে কারো দ্বিমত নেই ও কোন সন্দেহ নেই। এ দিনে মুসলিম উম্মাহ ও সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর রাসুল (সা) এর ইন্তেকালের শোকে পাথর হয়ে হয়ে গিয়েছিলেন। এসব জেনে-শুনে ঠিক এ দিনটিতে ঈদ তথা আনন্দ-উৎসব পালন করা চরম বেঈমানি ও নবীর শানে বেয়াদবি ভিন্ন অন্য কিছু হতে পারে না।

চতুর্থতঃ মিলাদুন্নবী পালন করে অনেকে মনে করে নবী কারিম (সা) এর প্রতি তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য আদায় হয়ে গেছে। তাই তারা রাসুলে কারিম (সা) এর সিরাত ও আদর্শের প্রতি কোন খেয়াল রাখেন না। বরং তারা সিরাতুন্নবী নামের শব্দটাও বরদাশত করতে রাজি নয়।

পঞ্চমতঃ আল্লাহ ও তার রাসুল (সা) কর্তৃক নির্ধারিত ইসলামের দু’ ঈদের সাথে তৃতীয় আরেকটি ঈদ সংযোজন করা ইসলাম-ধর্ম বিকৃত করার একটা অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।


মীলাদুন্নবী বিদআত সমর্থনকারীর প্রতিবাদ

প্রশ্ন :
নিম্নের বিষয়গুলোর প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি : বিষয়টি তর্ক বরং ঝগড়ার রূপ নিয়েছে, যারা বলে মীলাদুন্নবী বিদআত এবং যারা বলে মীলাদুন্নবী বিদআত নয় উভয় পক্ষের মধ্যে। যারা বলে মীলাদুন্নবী বিদআত, তাদের দলিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে অথবা সাহাবাদের যুগে অথবা কোন একজন তাবেঈর যুগে এ মীলাদুন্নবী ছিল না। অপরপক্ষ এর প্রতিবাদ করে বলে : তোমাদের কে বলেছে, আমরা যা কিছু করব, তার অস্তিত্ব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে অথবা সাহাবাদের যুগে অথবা তাবীঈদের যুগে থাকা চাই। উদাহরণত আমাদের যুগে হাদিস শাস্ত্রের দু’টি শাখা “রিজাল শাস্ত্র” ও “জারহু ও তাদিল শাস্ত্র” ইত্যাদি বিদ্যমান, এগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ছিল না, এ জন্য কেউ এর প্রতিবাদ করেনি। কারণ, নিষিদ্ধ হওয়ার মূল যুক্তি হচ্ছে নতুন আবিষ্কৃত বিদআত শরী‘আতের মূলনীতি বিরোধী হওয়া, কিন্তু মীলাদুন্নবী বা মীলাদ মাহফিল কোন মূলনীতি বিরোধী ? অধিকাংশ তর্ক এ নিয়েই সৃষ্টি হয়। তারা আরও দলিল পেশ করে যে, ইবন কাসির -রাহিমাহুল্লাহ- মীলাদুন্নবী সমর্থন করেছেন। দলিলের ভিত্তিতে বিশুদ্ধ কোনটি ?

উত্তর : আল-হামদুলিল্লাহ
প্রথমত :
প্রথমত জানা প্রয়োজন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম তারিখ নির্দিষ্টভাবে নির্ণয় সম্ভব হয়নি, এ ব্যাপারে আলেমদের বিভিন্ন অভিমত রয়েছে। ইবন আব্দুল বারর মনে করেন, তিনি রবিউল আউয়াল মাসের দুই তারিখে জন্ম গ্রহণ করেছেন। ইবন হাজম প্রাধান্য দেন রবিউল আউয়াল মাসের আট তারিখ। কেউ বলেছেন রবিউল আউয়াল মাসের দশ তারিখ, যেমন আবু জাফর বাকের। কেউ বলেছেন রবিউল আউয়াল মাসের বারো তারিখ, যেমন ইবন ইসহাক। কেউ বলেছেন, তিনি রমযান মাসে জন্ম গ্রহণ করেছেন, যেমন ইবন আব্দুল বারর জুবাইর ইবন বাক্কার থেকে বর্ণনা করেছেন। দেখুন : “আস-সিরাতুন নববিয়াহ” পৃষ্ঠা : (১৯৯-২০০)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের নির্দিষ্ট তারিখ সম্পর্কে আলেমদের এ মত বিরোধই প্রমাণ করে যে, এ উম্মতের শ্রেষ্ঠ জামাত ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অধিক মহব্বতকারী সাহাবায়ে কেরাম তার জন্মের নির্দিষ্ট তারিখ সম্পর্কে নিশ্চিত ও চূড়ান্ত ছিলেন না, এ দিনটি পালন করা তো পরের কথা। এ দিন উদযাপন ছাড়াই মুসলমানদের কয়েক শতাব্দী গত হয়েছে, অবশেষে ফাতেমি নামে একটি বদদ্বীন ফেরকা এ দিনটির প্রচলন ও সূচনা করে।

শায়খ আলী মাহফুজ -রাহিমাহুল্লাহ- বলেন :
“সর্বপ্রথম এ দিনটি উদযাপন করা হয় মিসরের কায়রোয় : ফাতেমি খলিফারা চতুর্থ শতাব্দীতে এর প্রচলন আরম্ভ করে। তারা ছয়টি মীলাদ বা জন্ম উৎসব প্রবর্তন করে : মীলাদুন্নবী, মীলাদে আলী -রাদিআল্লাহু আনহু-, মীলাদে ফাতেমাতুজ জোহরা- রাদিআল্লাহু আনহা-, মীলাদে হাসান ও হুসাইন- রাদিআল্লাহু আনহুমা- এবং বর্তমান খলিফার মীলাদ। সেই থেকেই তাদের দেশে এ মীলাদগুলো (জন্মানুষ্ঠান) যথারীতি পালন করা হচ্ছিল। অবশেষে এক সময়কার সেনাবাহিনী প্রধান আফজাল এসব মীলাদ রহিত করে দেন। খলিফা আমের বিআহকামিল্লাহ নিজ শাসনকালে পুনরায় এসব মীলাদ চালু করেন, অথচ মানুষ এসব মীলাদ ভুলতে আরম্ভ করেছিল। সপ্তম শতাব্দীতে “ইরবিল” শহরে সর্বপ্রথম এ মীলাদ আরম্ভ করেন বাদশাহ আবু সাঈদ, সেই থেকে আজ পর্যন্ত চলে আসছে তা, বরং তাতে আরও বৃদ্ধি ও সংযোজন ঘটেছে। তাদের রিপু ও প্রবৃত্তির চাহিদা মোতাবেক সব কিছু তারা এতে যোগ করেছে। তাদেরকে এর প্রত্যাদেশ করেছে মানব ও জিন শয়তানেরা”। “আল-ইবদা ফি মাদাররিল ইবতেদা” (পৃষ্ঠা নং: ২৫১)

দ্বিতীয়ত :
প্রশ্নে উল্লেখিত মীলাদুন্নবী উদযাপনকারীরা বলেছে : “তোমাদের কে বলেছে, আমরা যা কিছু করব, তার অস্তিত্ব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে অথবা সাহাবাদের যুগে অথবা তাবেঈদের যুগে থাকা চাই”। এর থেকে প্রকাশ পায় যে, তারা বিদআতের অর্থ জানে না, যে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বহু হাদিসে সতর্ক করেছেন। প্রশ্নে তারা যে মূলনীতি উল্লেখ করেছে, সে মূলনীতি হচ্ছে ইবাদাতের ক্ষেত্রে, যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা হয়। অতএব এমন কোন ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যাবে না, যার বিধান বা অনুমোদন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে প্রদান করেননি। এ মূলনীতি বিদআত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিষেধাজ্ঞা থেকেই প্রমাণ হয়। বিদআতের সংজ্ঞাই হচ্ছে আল্লাহর অনুমোদন বিহীন ইবাদাত রচনা করা ও তার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার চেষ্টা করা। এজন্যেই হুযাইফা রাদিআল্লাহু আনহু- বলেছেন : “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব ইবাদাতের মাধ্যমে ইবাদাত করেননি, তোমরাও তার মাধ্যমে ইবাদাত কর না”।

এ প্রসঙ্গে ইমাম মালেক -রাহিমাহুল্লাহ- বলেছেন :
“সে যুগে যা দ্বীন বা ধর্ম ছিল না, এ যুগেও তা দ্বীন বলে গণ্য হবে না”। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে যা দ্বীন ছিল না, সে যুগে যার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদাত করা হয়নি, তার পরবর্তী যুগে তা দ্বীন ও ধর্মের অংশ হিসেবে গণ্য হবে না।

প্রশ্নকারীর উদাহরণ “জারহু ও তাদিল শাস্ত্র” এবং ইহা এক অনিন্দনীয় বিদআত :
মূলত যারা বিদআতকে দু’ভাগে ভাগ করে “বিদআতে হাসানা” ও “বিদআতে সায়্যেআহ” তারা এ অভিমত পেশ করেছে। তারা এর চেয়ে আগে বেড়ে শরী‘আতের বিধানের ন্যায় বিদআতকেও পাঁচভাগে ভাগ করেছে : (ওয়াজিব, ইস্তেহবাব, ইবাহাত, হারাম ও মাকরুহ)। এ ভাগ সর্বপ্রথম ইজ্জ ইবন আব্দুস সালাম উল্লেখ করেন, অতঃপর তার শিষ্য কুরাফি তার অনুরসণ করেন।
এ বণ্টনের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করায় শাতেবি -রাহিমাহুল্লাহ- কুরাফির প্রতিবাদ করে বলেন : “এ বণ্টন স্বরচিত, এর পক্ষে শরী‘আতের কোন দলিল নেই, বরং এ বণ্টন স্ব-যুক্তির বিচারেই বাতিল ও প্রত্যাখ্যাত। কারণ বিদআতের সংজ্ঞা হচ্ছে, শরী‘আতের কোন দলিল যা প্রমাণ করে না তাই বিদআত, না সরাসরি কুরআন-না হাদিস, না তার থেকে নিঃসৃত কোন নীতি। যদি শরী‘আতের এমন দলিল থাকে, যার দ্বারা ওয়াজিব অথবা নুদুব অথবা ইবাহাত প্রমাণিত হয়, তাহলে এসব বিদআত থাকে না, বরং অন্যান্য আদিষ্ট আমলের অন্তর্ভুক্ত অথবা তার মধ্যে উত্তম আমল হিসেবে গণ্য হয়। অতএব এগুলোকে (ওয়াজিব, ইস্তেহবাব, ইবাহাত, হারাম ও মাকরুহ) বিদআত গণ্য করা এবং এগুলোর স্বপক্ষে ওয়াজিব অথবা নুদুব অথবা ইবাহাতের দলিল বিদ্যমান থাকার দাবি করা, মূলত দুই বিপরীত বস্তুকে একত্র করার শামিল।
হ্যাঁ, এ বণ্টনের অন্তর্ভুক্ত “মাকরুহ” ও “হারাম” বিদ‘আত হিসেবে সমর্থন যোগ্য অন্য বিবেচনায় নয়, অর্থাৎ বণ্টন হিসেবে বিদ‘আত বিবেচ্য নয়। কারণ নিষেধাজ্ঞার উপর অথবা মাকরুহ হওয়ার উপর যদি কোন দলিল থাকে, তখন সেটা বিদআত নয়, বরং তা পাপের অন্তর্ভুক্ত, যেমন হত্যা, চুরি, মদপান ইত্যাদি। অতএব কোন বিদআতের ক্ষেত্রেই এ বণ্টন কল্পনা করা যায় না, শুধু মাকরুহ ও হারাম ব্যতীত, যেমন বিদআতের আলোচনায় বলা হয়।
কুরাফি বিদআত প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে সাথীদের যে ঐক্য বর্ণনা করেছেন তা ঠিক, কিন্তু তিনি যে বিদআতের শ্রেণী ভাগ বর্ণনা করেছেন, এর ফলে তার উপর ঐক্য দাবি করা ঠিক নয়। আশ্চর্যের বিষয় ! মত বিরোধ সত্ত্বে এবং ঐক্য ভঙ্গের কারণ জানা থাকার পরও তিনি কিভাবে ঐক্য দাবি করলেন! হয়তো, বরং নিশ্চিত এ ব্যাপারে তিনি তার উস্তাদের অনুসরণ করেছেন কোন ভাবনা ছাড়াই।
অতঃপর তিনি (শাতেবি রহ.) এ বণ্টনের ব্যাপারে ইজ্জ ইবন আব্দুস সালামের কারণ বর্ণনা করেন। তিনি মূলত “মাসালেহে মুরসালাহ”-কে বিদ‘আত নামকরণ করেছেন। অতঃপর তিনি বলেন : কিন্তু কুরাফির তার শায়খের এ বণ্টন তার পছন্দের বিরুদ্ধে নকল করার কোন কারণ গ্রহণযোগ্য নয়, আর না অন্যের পছন্দ অনুযায়ী তা প্রকাশ করা। কারণ তিনি এ বণ্টনের মাধ্যমে ইজমা ও ঐক্যের খেলাফ করেছেন, তাই এ বণ্টন ইজমা ও উম্মতের ঐক্য মতের খেলাফ”। আল-ই‘তিসাম : (পৃষ্ঠা নং: ১৫২-১৫৩) পাঠকবর্গকে আমরা তার কিতাব দেখার অনুরোধ করছি, কারণ তিনি পরিপূর্ণ রূপে ও সুন্দরভাবে এর প্রতিবাদ করেছেন- রাহিমাহুল্লাহ-

ইজ্জ ইবন আব্দুস সালাম তার বিদআতের বণ্টন অনুসারে বলেন : ওয়াজিব বিদআতের অনেক উদাহরণ রয়েছে :
এক. আল্লাহর কালাম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস বুঝার জন্য ইলম নাহু বা আরবি ব্যাকরণ শাস্ত্র নিয়ে মশগুল হওয়া। শরী‘আত হিফাজত করার জন্য এ ইলম অর্জন করা ওয়াজিব। কারণ, এ ইলম ব্যতীত শরী‘আত হিফাজত করা সম্ভব নয়, আর যা ব্যতীত ওয়াজিব আদায় করা সম্ভব নয়, তা অর্জন করাও ওয়াজিব।
দুই. কুরআন ও হাদিসের শব্দ মুখস্থ করা।
তিন. উসূলে ফিকাহ আবিষ্কার করা।
চার. সহীহ ও দুর্বল হাদিস পার্থক্য করার জন্য “জরহু ও তাদিল শাস্ত্র” শিক্ষা করা। শরী‘আতের নীতিমালা দ্বারা প্রমাণিত যে, শরী‘আত সংরক্ষণ করা ফরয, যেহেতু এসব ইলম ব্যতীত শরী‘আত সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়, তাই এসব ইলম অর্জন করাও ফরয”। “কাওয়েদুল আহকাম ফি মাসালেহেল আনাম” : (২/১৭৩)
ইমাম শাতেবি এরও প্রতিবাদ করেছেন, তিনি বলেন : “আর ইজ্জুদ্দিনের কথা : ‘যা ব্যতীত ওয়াজিব আদায় হয় না, তা অর্জন করাও ওয়াজিব’। এসব ব্যাপারে পূর্বসূরিদের আমল থাকা জরুরী নয়, আর না নির্দিষ্টভাবে শরী‘আতের কোন দলিল এর পক্ষে থাকা জরুরী, কারণ এগুলো “মাসালেহে মুরসালাহ” এর অন্তর্ভুক্ত, বিদ‘আতের নয়।” আল-ইতিসাম : (পৃষ্ঠা নং: ১৫৭-১৫৮)

এ প্রতিবাদের সারসংক্ষেপ : এসব ইলমকে শরী‘আতের নিন্দনীয় বিদআত হিসেবে গণ্য করা ঠিক নয়, কারণ শরী‘আতের সাধারণ বিধান ও তার সাধারণ নীতি এসব ইলমের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে এবং এর গুরুত্বের সাক্ষী দেয়। অর্থাৎ শরী‘আতের যেসব দলিল দ্বীন ও সুন্নত হিফাজত করার নির্দেশ দেয় এবং শরী‘আতের জ্ঞান ও কুরআন-হাদিস যথাযথ মানুষের নিকট পৌঁছানোর তাগিদ প্রদান করে, তা এ জাতীয় ইলম অর্জনের প্রতিও উদ্বুদ্ধ করে।
আবার এও বলা যায় : এসব ইলম আভিধানিক অর্থে বিদআত, শরয়ী বিদআত নয়, শরয়ী সকল বিদআতই নিন্দনীয়। আর আভিধানিক বিদআতের কতক ভাল আর কতক মন্দ।
ইবন হাজার আসকালানি -রাহিমাহুল্লাহ- বলেছেন : শরী‘আতের দৃষ্টিতে সকল বিদআত নিন্দনীয়, কিন্তু আভিধানিক অর্থে নিন্দনীয় নয়, কারণ আভিধানিক অর্থে পূর্বের নমুনা ব্যতীত যে কোন আবিষ্কারই বিদআত, কি ভাল কি মন্দ। ফাতহুল বারি : (১৩/২৫৩)
তিনি আরও বলেন : “"البِدَع" শব্দ بدعة এর বহুবচন, পূর্বের নমুনাহীন প্রত্যেক আবিষ্কারই বিদআত, আভিধানিক অর্থে ভাল-মন্দ সব আবিষ্কার এর অন্তর্ভুক্ত, তবে শরয়ী পরিভাষায় শুধু মন্দকেই বিদআত বলা হয়, যদি শরী‘আত অনুমোদিত কোন বিষয়ে কখনো বিদআত ব্যবহার হয়, তাহলে সেটা তার আভিধানিক অর্থে”। ফাতহুল বারি : (১৩/৩৪০)
ফাতহুল বারির (৭২৭৭) নং হাদিসের টিকায় রয়েছে, শায়খ আব্দুর রহমান আল-বারাক -হাফিজাহুল্লাহ- বলেছেন : “এ বণ্টন হচ্ছে আভিধানিক অর্থে, কিন্তু শরয়ী অর্থে সকল বিদআত গোমরাহী, যেরূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
"وشر الأمور محدثاتها ، وكل بدعة ضلالة". صحيح مسلم : (1441)
“আর সবচেয়ে খারাপ বস্তু হচ্ছে বিদআত, আর প্রত্যেক বিদআত গোমরাহী”। [সহীহ মুসলিম: ১৪৪১]
বিদআত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এমন সাধারণ মন্তব্য থাকা সত্ত্বেও বিদআতকে ভাগ করে, ওয়াজিব অথবা মুস্তাহাব অথবা মুবাহ বলা দুরস্ত নয়, বরং শরী‘আতের মধ্যে প্রত্যেক বিদ‘আতই হারাম অথবা মাকরুহ। এ মাকরুহ বিদআতের উদাহরণ যেমন ফজর ও আসরের সময়ে নির্দিষ্টভাবে মুসাফাহ করা, অনেকে বলে এটা মুবাহ তথা বৈধ বিদআত।
আরও একটি বিষয় বিবেচনা যোগ্য : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে কোন বাঁধা না থাকা এবং সকল আয়োজন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও মীলাদুন্নবী উদযাপন না করা। মীলাদুন্নবী ও নবীর মহব্বত উভয় সাহাবাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল, যার ভিত্তিতে তারা ইচ্ছা করলে মীলাদুন্নবী উদযাপন করতে পারতেন, এতে কোন বাঁধাও ছিল না, এ সত্ত্বেও যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবায়ে কেরাম মীলাদুন্নবী উদযাপন করেননি, তাই এটা অবৈধ, যদি বৈধ হতো তাহলে তারা সকলের আগেই এ অনুষ্ঠান পালন করতেন।
শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ -রাহিমাহুল্লাহ- বলেছেন : “অনুরূপ কতক লোকের (মীলাদুন্নবী) আবিষ্কার, তারা হয়তো নাসারাদের অনুকরণে, যেমন তারা ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মানুষ্ঠান পালন করে, অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত ও সম্মানের খাতিরে, আল্লাহ তাদের এ মহব্বত ও সম্মানের প্রতি সাওয়াব দিতেও পারেন, তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মদিনকে ঈদ হিসেবে পালন করার জন্য নয়, অধিকন্তু তার জন্মের নির্দিষ্ট তারিখ সম্পর্কে দ্বিমত তো রয়েছেই। কারণ আমাদের পূর্বসূরি ও আদর্শ মনীষী কেউ এটা পালন করেননি, অথচ তখনো এর দাবি বিদ্যমান ছিল, কোন বাঁধা ছিল না, যদি এটা কল্যাণকর হতো অথবা ভাল হতো, তাহলে আমাদের পূর্বসূরিগণই এর বেশী হকদার ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত আমাদের চেয়ে তাদের মধ্যে বেশী ছিল। তারা তাকে আমাদের চেয়ে অধিক সম্মান করতেন। আমাদের চেয়ে তারা কল্যাণের ব্যাপারে অগ্রগামী ছিলেন। বস্তুত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিপূর্ণ মহব্বত ও সম্মানের পরিচয় হচ্ছে, তার আনুগত্য ও অনুসরণ করা, তার নির্দেশ পালন করা এবং প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে তার সুন্নত জীবিত করা, তার আনিত দ্বীন প্রচার করা এবং এ জন্য অন্তর-হাত ও মুখ দ্বারা জিহাদ করা, কারণ এটাই আমাদের পূর্বসূরি মুহাজির, আনসার ও তাদের যথাযথ অনুসারীদের নীতি ও আদর্শ ছিল”। ইকতেদাউস সিরাত : (পৃষ্ঠা: ২৯৪-২৯৫)
এটা সরল ও সাধারণ কথা : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত অনুসরণের মধ্যেই তার প্রতি মহব্বত প্রকাশ পায়। আরও প্রকাশ পায় তার সুন্নতের শিক্ষা বিস্তার ও প্রসার করা এবং তার সুন্নতের উপর থেকে যে কোন হামলা প্রতিরোধ করা ইত্যাদিতে। মূলত এটাই ছিল সাহাবাদের পদ্ধতি।
কিন্তু পরবর্তী যুগের লোকেরা নিজেদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে এবং এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শয়তানও তাদের ধোঁকা দিচ্ছে। তাদের ধারণা এসবের মাধ্যমে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত প্রকাশ করছে, কিন্তু তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত জীবিত করা, তার অনুসরণ করা, তার দিকে দাওয়াত দেয়া ও মানুষকে তা শিক্ষা দেয়া এবং তার উপর থেকে হামলা প্রতিহত করা থেকে অনেক দূরে।

তৃতীয়ত : এ ব্যক্তি যে বলেছে ইবন কাসির -রাহিমাহুল্লাহ- মীলাদুন্নবী বৈধ বলেছেন, আমাদের সামনে সে এর দলিল পেশ করুক, কারণ আমরা তার এ ধরণের বক্তব্য সম্পর্কে জানি না, আমরা মনে করি তিনি এ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আল্লাহ ভাল জানেন।


ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

নিম্নের বিষয়গুলোর প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি : বিষয়টি তর্ক বরং ঝগড়ার রূপ নিয়েছে, যারা বলে মীলাদুন্নবী বিদআত এবং যারা বলে মীলাদুন্নবী বিদআত নয় উভয় পক্ষের মধ্যে। যারা বলে মীলাদুন্নবী বিদআত, তাদের দলিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে অথবা সাহাবাদের যুগে অথবা কোন একজন তাবেঈর যুগে এ মীলাদুন্নবী ছিল না। অপরপক্ষ এর প্রতিবাদ করে বলে : তোমাদের কে বলেছে, আমরা যা কিছু করব, তার অস্তিত্ব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে অথবা সাহাবাদের যুগে অথবা তাবীঈদের যুগে থাকা চাই। উদাহরণত আমাদের যুগে হাদিস শাস্ত্রের দু’টি শাখা “রিজাল শাস্ত্র” ও “জারহু ও তাদিল শাস্ত্র” ইত্যাদি বিদ্যমান, এগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ছিল না, এ জন্য কেউ এর প্রতিবাদ করেনি। কারণ, নিষিদ্ধ হওয়ার মূল যুক্তি হচ্ছে নতুন আবিষ্কৃত বিদআত শরী‘আতের মূলনীতি বিরোধী হওয়া, কিন্তু মীলাদুন্নবী বা মীলাদ মাহফিল কোন মূলনীতি বিরোধী ? অধিকাংশ তর্ক এ নিয়েই সৃষ্টি হয়। তারা আরও দলিল পেশ করে যে, ইবন কাসির -রাহিমাহুল্লাহ- মীলাদুন্নবী সমর্থন করেছেন। দলিলের ভিত্তিতে বিশুদ্ধ কোনটি ?

উত্তর : আল-হামদুলিল্লাহ
প্রথমত :
প্রথমত জানা প্রয়োজন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম তারিখ নির্দিষ্টভাবে নির্ণয় সম্ভব হয়নি, এ ব্যাপারে আলেমদের বিভিন্ন অভিমত রয়েছে। ইবন আব্দুল বারর মনে করেন, তিনি রবিউল আউয়াল মাসের দুই তারিখে জন্ম গ্রহণ করেছেন। ইবন হাজম প্রাধান্য দেন রবিউল আউয়াল মাসের আট তারিখ। কেউ বলেছেন রবিউল আউয়াল মাসের দশ তারিখ, যেমন আবু জাফর বাকের। কেউ বলেছেন রবিউল আউয়াল মাসের বারো তারিখ, যেমন ইবন ইসহাক। কেউ বলেছেন, তিনি রমযান মাসে জন্ম গ্রহণ করেছেন, যেমন ইবন আব্দুল বারর জুবাইর ইবন বাক্কার থেকে বর্ণনা করেছেন। দেখুন : “আস-সিরাতুন নববিয়াহ” পৃষ্ঠা : (১৯৯-২০০)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের নির্দিষ্ট তারিখ সম্পর্কে আলেমদের এ মত বিরোধই প্রমাণ করে যে, এ উম্মতের শ্রেষ্ঠ জামাত ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অধিক মহব্বতকারী সাহাবায়ে কেরাম তার জন্মের নির্দিষ্ট তারিখ সম্পর্কে নিশ্চিত ও চূড়ান্ত ছিলেন না, এ দিনটি পালন করা তো পরের কথা। এ দিন উদযাপন ছাড়াই মুসলমানদের কয়েক শতাব্দী গত হয়েছে, অবশেষে ফাতেমি নামে একটি বদদ্বীন ফেরকা এ দিনটির প্রচলন ও সূচনা করে।

শায়খ আলী মাহফুজ -রাহিমাহুল্লাহ- বলেন :
“সর্বপ্রথম এ দিনটি উদযাপন করা হয় মিসরের কায়রোয় : ফাতেমি খলিফারা চতুর্থ শতাব্দীতে এর প্রচলন আরম্ভ করে। তারা ছয়টি মীলাদ বা জন্ম উৎসব প্রবর্তন করে : মীলাদুন্নবী, মীলাদে আলী -রাদিআল্লাহু আনহু-, মীলাদে ফাতেমাতুজ জোহরা- রাদিআল্লাহু আনহা-, মীলাদে হাসান ও হুসাইন- রাদিআল্লাহু আনহুমা- এবং বর্তমান খলিফার মীলাদ। সেই থেকেই তাদের দেশে এ মীলাদগুলো (জন্মানুষ্ঠান) যথারীতি পালন করা হচ্ছিল। অবশেষে এক সময়কার সেনাবাহিনী প্রধান আফজাল এসব মীলাদ রহিত করে দেন। খলিফা আমের বিআহকামিল্লাহ নিজ শাসনকালে পুনরায় এসব মীলাদ চালু করেন, অথচ মানুষ এসব মীলাদ ভুলতে আরম্ভ করেছিল। সপ্তম শতাব্দীতে “ইরবিল” শহরে সর্বপ্রথম এ মীলাদ আরম্ভ করেন বাদশাহ আবু সাঈদ, সেই থেকে আজ পর্যন্ত চলে আসছে তা, বরং তাতে আরও বৃদ্ধি ও সংযোজন ঘটেছে। তাদের রিপু ও প্রবৃত্তির চাহিদা মোতাবেক সব কিছু তারা এতে যোগ করেছে। তাদেরকে এর প্রত্যাদেশ করেছে মানব ও জিন শয়তানেরা”। “আল-ইবদা ফি মাদাররিল ইবতেদা” (পৃষ্ঠা নং: ২৫১)

দ্বিতীয়ত :
প্রশ্নে উল্লেখিত মীলাদুন্নবী উদযাপনকারীরা বলেছে : “তোমাদের কে বলেছে, আমরা যা কিছু করব, তার অস্তিত্ব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে অথবা সাহাবাদের যুগে অথবা তাবেঈদের যুগে থাকা চাই”। এর থেকে প্রকাশ পায় যে, তারা বিদআতের অর্থ জানে না, যে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বহু হাদিসে সতর্ক করেছেন। প্রশ্নে তারা যে মূলনীতি উল্লেখ করেছে, সে মূলনীতি হচ্ছে ইবাদাতের ক্ষেত্রে, যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা হয়। অতএব এমন কোন ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যাবে না, যার বিধান বা অনুমোদন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে প্রদান করেননি। এ মূলনীতি বিদআত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিষেধাজ্ঞা থেকেই প্রমাণ হয়। বিদআতের সংজ্ঞাই হচ্ছে আল্লাহর অনুমোদন বিহীন ইবাদাত রচনা করা ও তার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার চেষ্টা করা। এজন্যেই হুযাইফা রাদিআল্লাহু আনহু- বলেছেন : “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব ইবাদাতের মাধ্যমে ইবাদাত করেননি, তোমরাও তার মাধ্যমে ইবাদাত কর না”।

এ প্রসঙ্গে ইমাম মালেক -রাহিমাহুল্লাহ- বলেছেন :
“সে যুগে যা দ্বীন বা ধর্ম ছিল না, এ যুগেও তা দ্বীন বলে গণ্য হবে না”। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে যা দ্বীন ছিল না, সে যুগে যার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদাত করা হয়নি, তার পরবর্তী যুগে তা দ্বীন ও ধর্মের অংশ হিসেবে গণ্য হবে না।

প্রশ্নকারীর উদাহরণ “জারহু ও তাদিল শাস্ত্র” এবং ইহা এক অনিন্দনীয় বিদআত :
মূলত যারা বিদআতকে দু’ভাগে ভাগ করে “বিদআতে হাসানা” ও “বিদআতে সায়্যেআহ” তারা এ অভিমত পেশ করেছে। তারা এর চেয়ে আগে বেড়ে শরী‘আতের বিধানের ন্যায় বিদআতকেও পাঁচভাগে ভাগ করেছে : (ওয়াজিব, ইস্তেহবাব, ইবাহাত, হারাম ও মাকরুহ)। এ ভাগ সর্বপ্রথম ইজ্জ ইবন আব্দুস সালাম উল্লেখ করেন, অতঃপর তার শিষ্য কুরাফি তার অনুরসণ করেন।
এ বণ্টনের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করায় শাতেবি -রাহিমাহুল্লাহ- কুরাফির প্রতিবাদ করে বলেন : “এ বণ্টন স্বরচিত, এর পক্ষে শরী‘আতের কোন দলিল নেই, বরং এ বণ্টন স্ব-যুক্তির বিচারেই বাতিল ও প্রত্যাখ্যাত। কারণ বিদআতের সংজ্ঞা হচ্ছে, শরী‘আতের কোন দলিল যা প্রমাণ করে না তাই বিদআত, না সরাসরি কুরআন-না হাদিস, না তার থেকে নিঃসৃত কোন নীতি। যদি শরী‘আতের এমন দলিল থাকে, যার দ্বারা ওয়াজিব অথবা নুদুব অথবা ইবাহাত প্রমাণিত হয়, তাহলে এসব বিদআত থাকে না, বরং অন্যান্য আদিষ্ট আমলের অন্তর্ভুক্ত অথবা তার মধ্যে উত্তম আমল হিসেবে গণ্য হয়। অতএব এগুলোকে (ওয়াজিব, ইস্তেহবাব, ইবাহাত, হারাম ও মাকরুহ) বিদআত গণ্য করা এবং এগুলোর স্বপক্ষে ওয়াজিব অথবা নুদুব অথবা ইবাহাতের দলিল বিদ্যমান থাকার দাবি করা, মূলত দুই বিপরীত বস্তুকে একত্র করার শামিল।
হ্যাঁ, এ বণ্টনের অন্তর্ভুক্ত “মাকরুহ” ও “হারাম” বিদ‘আত হিসেবে সমর্থন যোগ্য অন্য বিবেচনায় নয়, অর্থাৎ বণ্টন হিসেবে বিদ‘আত বিবেচ্য নয়। কারণ নিষেধাজ্ঞার উপর অথবা মাকরুহ হওয়ার উপর যদি কোন দলিল থাকে, তখন সেটা বিদআত নয়, বরং তা পাপের অন্তর্ভুক্ত, যেমন হত্যা, চুরি, মদপান ইত্যাদি। অতএব কোন বিদআতের ক্ষেত্রেই এ বণ্টন কল্পনা করা যায় না, শুধু মাকরুহ ও হারাম ব্যতীত, যেমন বিদআতের আলোচনায় বলা হয়।
কুরাফি বিদআত প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে সাথীদের যে ঐক্য বর্ণনা করেছেন তা ঠিক, কিন্তু তিনি যে বিদআতের শ্রেণী ভাগ বর্ণনা করেছেন, এর ফলে তার উপর ঐক্য দাবি করা ঠিক নয়। আশ্চর্যের বিষয় ! মত বিরোধ সত্ত্বে এবং ঐক্য ভঙ্গের কারণ জানা থাকার পরও তিনি কিভাবে ঐক্য দাবি করলেন! হয়তো, বরং নিশ্চিত এ ব্যাপারে তিনি তার উস্তাদের অনুসরণ করেছেন কোন ভাবনা ছাড়াই।
অতঃপর তিনি (শাতেবি রহ.) এ বণ্টনের ব্যাপারে ইজ্জ ইবন আব্দুস সালামের কারণ বর্ণনা করেন। তিনি মূলত “মাসালেহে মুরসালাহ”-কে বিদ‘আত নামকরণ করেছেন। অতঃপর তিনি বলেন : কিন্তু কুরাফির তার শায়খের এ বণ্টন তার পছন্দের বিরুদ্ধে নকল করার কোন কারণ গ্রহণযোগ্য নয়, আর না অন্যের পছন্দ অনুযায়ী তা প্রকাশ করা। কারণ তিনি এ বণ্টনের মাধ্যমে ইজমা ও ঐক্যের খেলাফ করেছেন, তাই এ বণ্টন ইজমা ও উম্মতের ঐক্য মতের খেলাফ”। আল-ই‘তিসাম : (পৃষ্ঠা নং: ১৫২-১৫৩) পাঠকবর্গকে আমরা তার কিতাব দেখার অনুরোধ করছি, কারণ তিনি পরিপূর্ণ রূপে ও সুন্দরভাবে এর প্রতিবাদ করেছেন- রাহিমাহুল্লাহ-

ইজ্জ ইবন আব্দুস সালাম তার বিদআতের বণ্টন অনুসারে বলেন : ওয়াজিব বিদআতের অনেক উদাহরণ রয়েছে :
এক. আল্লাহর কালাম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস বুঝার জন্য ইলম নাহু বা আরবি ব্যাকরণ শাস্ত্র নিয়ে মশগুল হওয়া। শরী‘আত হিফাজত করার জন্য এ ইলম অর্জন করা ওয়াজিব। কারণ, এ ইলম ব্যতীত শরী‘আত হিফাজত করা সম্ভব নয়, আর যা ব্যতীত ওয়াজিব আদায় করা সম্ভব নয়, তা অর্জন করাও ওয়াজিব।
দুই. কুরআন ও হাদিসের শব্দ মুখস্থ করা।
তিন. উসূলে ফিকাহ আবিষ্কার করা।
চার. সহীহ ও দুর্বল হাদিস পার্থক্য করার জন্য “জরহু ও তাদিল শাস্ত্র” শিক্ষা করা। শরী‘আতের নীতিমালা দ্বারা প্রমাণিত যে, শরী‘আত সংরক্ষণ করা ফরয, যেহেতু এসব ইলম ব্যতীত শরী‘আত সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়, তাই এসব ইলম অর্জন করাও ফরয”। “কাওয়েদুল আহকাম ফি মাসালেহেল আনাম” : (২/১৭৩)
ইমাম শাতেবি এরও প্রতিবাদ করেছেন, তিনি বলেন : “আর ইজ্জুদ্দিনের কথা : ‘যা ব্যতীত ওয়াজিব আদায় হয় না, তা অর্জন করাও ওয়াজিব’। এসব ব্যাপারে পূর্বসূরিদের আমল থাকা জরুরী নয়, আর না নির্দিষ্টভাবে শরী‘আতের কোন দলিল এর পক্ষে থাকা জরুরী, কারণ এগুলো “মাসালেহে মুরসালাহ” এর অন্তর্ভুক্ত, বিদ‘আতের নয়।” আল-ইতিসাম : (পৃষ্ঠা নং: ১৫৭-১৫৮)

এ প্রতিবাদের সারসংক্ষেপ : এসব ইলমকে শরী‘আতের নিন্দনীয় বিদআত হিসেবে গণ্য করা ঠিক নয়, কারণ শরী‘আতের সাধারণ বিধান ও তার সাধারণ নীতি এসব ইলমের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে এবং এর গুরুত্বের সাক্ষী দেয়। অর্থাৎ শরী‘আতের যেসব দলিল দ্বীন ও সুন্নত হিফাজত করার নির্দেশ দেয় এবং শরী‘আতের জ্ঞান ও কুরআন-হাদিস যথাযথ মানুষের নিকট পৌঁছানোর তাগিদ প্রদান করে, তা এ জাতীয় ইলম অর্জনের প্রতিও উদ্বুদ্ধ করে।
আবার এও বলা যায় : এসব ইলম আভিধানিক অর্থে বিদআত, শরয়ী বিদআত নয়, শরয়ী সকল বিদআতই নিন্দনীয়। আর আভিধানিক বিদআতের কতক ভাল আর কতক মন্দ।
ইবন হাজার আসকালানি -রাহিমাহুল্লাহ- বলেছেন : শরী‘আতের দৃষ্টিতে সকল বিদআত নিন্দনীয়, কিন্তু আভিধানিক অর্থে নিন্দনীয় নয়, কারণ আভিধানিক অর্থে পূর্বের নমুনা ব্যতীত যে কোন আবিষ্কারই বিদআত, কি ভাল কি মন্দ। ফাতহুল বারি : (১৩/২৫৩)
তিনি আরও বলেন : “"البِدَع" শব্দ بدعة এর বহুবচন, পূর্বের নমুনাহীন প্রত্যেক আবিষ্কারই বিদআত, আভিধানিক অর্থে ভাল-মন্দ সব আবিষ্কার এর অন্তর্ভুক্ত, তবে শরয়ী পরিভাষায় শুধু মন্দকেই বিদআত বলা হয়, যদি শরী‘আত অনুমোদিত কোন বিষয়ে কখনো বিদআত ব্যবহার হয়, তাহলে সেটা তার আভিধানিক অর্থে”। ফাতহুল বারি : (১৩/৩৪০)
ফাতহুল বারির (৭২৭৭) নং হাদিসের টিকায় রয়েছে, শায়খ আব্দুর রহমান আল-বারাক -হাফিজাহুল্লাহ- বলেছেন : “এ বণ্টন হচ্ছে আভিধানিক অর্থে, কিন্তু শরয়ী অর্থে সকল বিদআত গোমরাহী, যেরূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
"وشر الأمور محدثاتها ، وكل بدعة ضلالة". صحيح مسلم : (1441)
“আর সবচেয়ে খারাপ বস্তু হচ্ছে বিদআত, আর প্রত্যেক বিদআত গোমরাহী”। [সহীহ মুসলিম: ১৪৪১]
বিদআত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এমন সাধারণ মন্তব্য থাকা সত্ত্বেও বিদআতকে ভাগ করে, ওয়াজিব অথবা মুস্তাহাব অথবা মুবাহ বলা দুরস্ত নয়, বরং শরী‘আতের মধ্যে প্রত্যেক বিদ‘আতই হারাম অথবা মাকরুহ। এ মাকরুহ বিদআতের উদাহরণ যেমন ফজর ও আসরের সময়ে নির্দিষ্টভাবে মুসাফাহ করা, অনেকে বলে এটা মুবাহ তথা বৈধ বিদআত।
আরও একটি বিষয় বিবেচনা যোগ্য : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে কোন বাঁধা না থাকা এবং সকল আয়োজন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও মীলাদুন্নবী উদযাপন না করা। মীলাদুন্নবী ও নবীর মহব্বত উভয় সাহাবাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল, যার ভিত্তিতে তারা ইচ্ছা করলে মীলাদুন্নবী উদযাপন করতে পারতেন, এতে কোন বাঁধাও ছিল না, এ সত্ত্বেও যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবায়ে কেরাম মীলাদুন্নবী উদযাপন করেননি, তাই এটা অবৈধ, যদি বৈধ হতো তাহলে তারা সকলের আগেই এ অনুষ্ঠান পালন করতেন।
শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ -রাহিমাহুল্লাহ- বলেছেন : “অনুরূপ কতক লোকের (মীলাদুন্নবী) আবিষ্কার, তারা হয়তো নাসারাদের অনুকরণে, যেমন তারা ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মানুষ্ঠান পালন করে, অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত ও সম্মানের খাতিরে, আল্লাহ তাদের এ মহব্বত ও সম্মানের প্রতি সাওয়াব দিতেও পারেন, তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মদিনকে ঈদ হিসেবে পালন করার জন্য নয়, অধিকন্তু তার জন্মের নির্দিষ্ট তারিখ সম্পর্কে দ্বিমত তো রয়েছেই। কারণ আমাদের পূর্বসূরি ও আদর্শ মনীষী কেউ এটা পালন করেননি, অথচ তখনো এর দাবি বিদ্যমান ছিল, কোন বাঁধা ছিল না, যদি এটা কল্যাণকর হতো অথবা ভাল হতো, তাহলে আমাদের পূর্বসূরিগণই এর বেশী হকদার ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত আমাদের চেয়ে তাদের মধ্যে বেশী ছিল। তারা তাকে আমাদের চেয়ে অধিক সম্মান করতেন। আমাদের চেয়ে তারা কল্যাণের ব্যাপারে অগ্রগামী ছিলেন। বস্তুত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিপূর্ণ মহব্বত ও সম্মানের পরিচয় হচ্ছে, তার আনুগত্য ও অনুসরণ করা, তার নির্দেশ পালন করা এবং প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে তার সুন্নত জীবিত করা, তার আনিত দ্বীন প্রচার করা এবং এ জন্য অন্তর-হাত ও মুখ দ্বারা জিহাদ করা, কারণ এটাই আমাদের পূর্বসূরি মুহাজির, আনসার ও তাদের যথাযথ অনুসারীদের নীতি ও আদর্শ ছিল”। ইকতেদাউস সিরাত : (পৃষ্ঠা: ২৯৪-২৯৫)
এটা সরল ও সাধারণ কথা : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত অনুসরণের মধ্যেই তার প্রতি মহব্বত প্রকাশ পায়। আরও প্রকাশ পায় তার সুন্নতের শিক্ষা বিস্তার ও প্রসার করা এবং তার সুন্নতের উপর থেকে যে কোন হামলা প্রতিরোধ করা ইত্যাদিতে। মূলত এটাই ছিল সাহাবাদের পদ্ধতি।
কিন্তু পরবর্তী যুগের লোকেরা নিজেদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে এবং এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শয়তানও তাদের ধোঁকা দিচ্ছে। তাদের ধারণা এসবের মাধ্যমে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত প্রকাশ করছে, কিন্তু তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত জীবিত করা, তার অনুসরণ করা, তার দিকে দাওয়াত দেয়া ও মানুষকে তা শিক্ষা দেয়া এবং তার উপর থেকে হামলা প্রতিহত করা থেকে অনেক দূরে।

তৃতীয়ত : এ ব্যক্তি যে বলেছে ইবন কাসির -রাহিমাহুল্লাহ- মীলাদুন্নবী বৈধ বলেছেন, আমাদের সামনে সে এর দলিল পেশ করুক, কারণ আমরা তার এ ধরণের বক্তব্য সম্পর্কে জানি না, আমরা মনে করি তিনি এ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আল্লাহ ভাল জানেন।

মীলাদুন্নবী ও জন্ম দিনের সিয়াম পালন করা

প্রশ্ন :
মীলাদুন্নবীর দিন সিয়াম পালন করা কি বৈধ, যেমন সহীহ মুসলিম, নাসায়ী ও আবু দাউদে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সোমবার দিনের সিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি বলেন : এ দিন আমি জন্ম গ্রহণ করছি... এ হাদীসের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইত্তেবায় কোন ব্যক্তির নিজের জন্ম দিনে সিয়াম পালন করা কি বৈধ ? আশা করছি বিষয়টি স্পষ্ট করবেন।

উত্তর :
আল-হামদুলিল্লাহ
প্রথমত :
তিরমিযীতে ইমাম মুসলিম আবু কাতাদা আল-আনসারী থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সোমবার দিনের সিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি বলেন : "এ দিন আমি জন্ম গ্রহণ করেছি এবং এ দিনেই আমার উপর ওহি নাযিল করা হয়েছে।” মুসলিম : (১১৬২) ইমাম তিরমিযি আবু হুরায়রা -রাদিআল্লাহু আনহু- থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : “সোমবার ও বৃহস্পতিবার আমল পেশ করা হয়, আমি চাই সিয়াম অবস্থায় আমার আমল পেশ করা হোক।” তিনি হাদিসটি হাসান বলেছেন। আল-বানি সহীহ তিরমিযীতে হাদিসটি সহীহ বলেছেন।
উপরের বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্মের শোকর আদায় কল্পে সোমবার দিন সিয়াম পালন করেছেন। আবার এ দিনের ফজিলতের কারণেও তিনি সিয়াম পালন করেছেন, যেমন এ দিনেই তার উপর ওহি নাযিল করা হয়েছে এবং দিনেই বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়, তাই তিনি পছন্দ করেন, তার আমল সিয়াম অবস্থায় পেশ করা হোক। অতএব সোমবার দিন সিয়াম পালন করার কয়েকটি কারণের একটি কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম।
এ হিসেবে কেউ যদি সোমবার দিন সিয়াম পালন করে, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিয়াম পালন করেছেন, এতে আল্লাহর মাগফেরাত কামনা করে, আল্লাহর নি‘আমতের শোকর আদায় ইচ্ছা করে, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম ও নবুওয়তের নি‘আমত এবং সে এ দিনে মাগফেরাত প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আশা করে, তাহলে ভাল, এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতও বটে। কিন্তু এর জন্য এ সপ্তাহ নয় অমুক সপ্তাহ, এ মাস নয় অমুক মাস নির্দিষ্ট করা যাবে না, বরং জীবনের প্রতি সোমবারেই সাধ্যমত সিয়াম পালন করার চেষ্টা করা।
তবে মীলাদুন্নবী উপলক্ষে বছরের শুধু একটি দিন সিয়ামের জন্য নির্দিষ্ট করা বিদআত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত বিরোধী। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবার দিন সিয়াম পালন করেছেন। হাদিসে এ দিনটিই নির্দিষ্ট। আর এ দিনটি বছরের প্রতি সপ্তাহে বিদ্যমান।
দ্বিতীয়ত :
বর্তমান মানুষেরা যে ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করছে ও তার জন্য মাহফিলের আয়োজন করছে, এসব বিদআত ও নাজায়েজ। মুসলিমদের আনন্দ-উৎসবের জন্য ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা ব্যতীত অন্য কোন ঈদ নেই।

এরপরও কোথায় মীলাদুন্নবী, যা প্রকৃত পক্ষেই নি‘আমত, সকল মানব জাতির জন্য রহমত, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন : "আর আমি তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি।” [সূরা আম্বিয়া : ১০৭] আর কোথায় অন্যান্য লোকের জন্ম ও মৃত্যু !? কোথায় ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম?! কোথায় ছিলেন তাদের পরবর্তী নেককার লোকেরা ?! এই আমাল থেকে ?! যদি নিজের জন্ম দিনের শোকর আদায় উপলক্ষে সিয়াম পালন করা বৈধ হতো, তাহলে অবশ্যই তারা তা পালন করতেন।

তাদের কারো থেকে প্রমাণিত নেই যে, সপ্তাহের কোন একদিন, অথবা মাসের কোন একদিন, অথবা বছরের কোন একদিন, অথবা নির্দিষ্ট কোন এক দিনকে তারা নিজের জন্ম দিন উপলক্ষে ঈদ পালন করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত যদি অন্য কারো জন্ম দিন উপলক্ষে সিয়াম পালন করা সাওয়াবের কাজ হতো, তাহলে আমাদের পূর্বে তারাই এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন, যারা অন্যান্য সকল কল্যাণে আমাদের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। তারা যেহেতু তা করেননি, এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, এসব আমল বিদআত, এর উপর আমল করা বৈধ নয়। আল্লাহ ভাল জানেন।

রাসূলে কারীম সা. এর জন্মদিন পালন সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

কোন ব্যক্তির জন্মদিবস পালন করা ইসলাম সম্মত নয়। এটা হল খৃষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধসহ বিভিন্ন অমুসলিমদের রীতি। ইসলাম কারো জন্মদিবস পালন অনুমোদন করে না।
এর প্রমাণসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হল-
এক. দ্বীনে ইসলাম আজ পর্যন্ত অবিকৃত আছে এবং ইনশাআল্লাহ থাকবে। ইসলামে সকল হুকুম আহকাম, আচার-অনুষ্ঠান সুনির্ধারিত ও কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু নবী কারীম সা.-এর জন্ম দিবস বা মীলাদ পালনের কথা কোথাও নেই। এমনকি নবী প্রেমের নজীরবিহীর দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমদের কেহ এ ধরনের কাজ করেছেন বলে কোন প্রমাণ নেই। তাই ঈদে-মীলাদ পালন করা নিশ্চয়ই একটি বেদআতকর্ম। আর বেদআত জঘন্য গুনাহের কাজ।
দুই. ইসলামে কম হলেও একলাখ চবি্বশ হাজার নবী, তারপরে খুলাফায়ে রাশেদীন ও অসংখ্য সাহাবা, মনীষি আওলিয়ায়ে কেরাম জন্ম গ্রহণ করেছেন ও ইন্তেকাল করেছেন। যদি তাদের জন্ম বা মৃতু্য দিবস পালন ইসলাম-সমর্থিত হত বা সওয়াবের কাজ হত তাহলে বছরব্যাপী জন্ম-মৃতু্য দিবস পালনে ঘূর্ণাবর্তে আবদ্ধ হয়ে যেতে হত আমাদের সকল মুলমানদের। অন্যান্য কাজসর্ম করার ফুরসত মিলত থোরই।
তিন. নবী কারীম সা. এর জন্মদিন পালনের প্রস্তাব সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। যেমন হিজরী ক্যালেন্ডার প্রবর্তিত হওয়া সময় উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে বৈঠকে বসলেন। কোন এক স্মরনীয় ঘটনার দিন থেকে একটি নতুন বর্ষগণনা পদ্ধতি প্রবর্তন করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কেউ কেউ প্রস্তাব করলেন রাসূলুল্লাহ সা. এর জন্ম তারিখ থেকে সন গণনা শুরু করা যেতে পারে। উমর রাঃ এ প্রস্তাব বাতিল করে দিয়ে বললেন যে এ পদ্ধতি খৃষ্টানদের। উমার রাঃ এর এ সিদ্ধান্তের সাথে সকল সাহাবায়ে কেরাম একমত পোষণ করলেন। এবং রাসূলে কারীম সা. এর হিজরত থেকে ইসলামী সন গণনা আরম্ভ করলেন।
চার. রাসূলুল্লাহ সা. এর সাহাবাগন ছিলেন সত্যিকারার্থে নবীপ্রেমিক ও সর্বোত্তম অনুসারী। নবী প্রেমের বে-নজীর দৃষ্টান্ত তারাই স্থাপন করেছেন। তারা কখনো নবী কারীম সা. এর জন্মদিনে ঈদ বা অনুষ্ঠান পালন করেননি। যদি এটা করা ভাল হত ও মহব্বতের পরিচায়ক হত তবে তারা তা অবশ্যই করতেন। আর জন্মোৎসব পালন করার কালচার সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা ছিল না তা বলা যায় না। কেননা তাদের সামনেই তো খৃষ্টানরা ঈসা আলাইহিস সালাম-এর জন্মদিন ( বড়দিন) উদযাপন করত।
পাচ. জন্ম দিবস কেন্দ্রিক উৎসব-অনুষ্ঠান খৃষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য অমুসলিমদের ধর্মীয়রীতি। যেমন বড় দিন, জন্মাষ্ঠমী, বৌদ্ধপূুর্ণিমা ইত্যাদি। তাই এটা মুসলিমদের জন্য পরিত্যাজ্য। বিধর্মীদের ধর্মীয় রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান যতই ভাল দেখা যাক না কখনো তা মুসলিমদের জন্য গ্রহণ করা জায়েয নয়। এ কথার সমর্থনে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করলাম।
(ক) রাসূলে কারীম সা. বলেছেন -

"যে ব্যক্তি কোন জাতির সাদৃশ্যতা গ্রহণ করবে সে তাদের অন্তর্ভূক্ত বলে গণ্য হবে।"
(খ) আজানের প্রচলনের সময় কেউ কেউ রাসূলুল্লাহ সা. এর কাছে প্রস্তাব করলেন যে সালাতের সময় হলে আগুন জ্বালানো যেতে পারে। কেউ প্রস্তাব করলেন ঘন্টাধনি করা যেতে পারে। কেউ বললেন বাঁশী বাজানো যেতে পারে। কিন্তু রাসূলে কারীম সা. সকল প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন আগুন জ্বালানো হল অগি্নপুজারী পারসিকদের রীতি। ঘন্টা বাজানো খৃষ্টানদের ও বাঁশী বাজানো ইহুদীদের রীতি।
(গ) মদীনার ইহুদীরা আশুরার দিনে একটি রোযা পালন করত। রাসূলে কারীম সা. দুটি রোযা রাখতে নির্দেশ দিলেন, যাতে তাদের সাথে সাদৃশ্যতা না হয়।
(ঘ) হিজরী সনের প্রবর্তনের সময় অনেকে রাসূলে কারীম সা. এর জন্মদিন থেকে সন গণনার প্রস্তাব করেন। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যাত হয়, খৃষ্টানদের অনুকরণ হওয়ার কারণে।

ইসলামে ঈদ কয়টি ?
ইসলামে ঈদ হল দুটি। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা।

সাহাবী আনাস বিন মালিক রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন ঃ রাসূলে কারীম সা. যখন মদীনায় আসলেন তখন দেখলেন বছরের দুটি দিনে মদীনাবাসীরা আনন্দ-ফুর্তি করছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন এ দিন দুটো কি ? তারা বলল যে আমরা ইসলামপূর্ব মুর্খতার যুগে এ দুুদিন আনন্দ-ফুর্তি করতাম। রাসূলুল্লাহ সা. বললেনঃ "আল্লাহ তাআলা এ দু'দিনের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুটো দিন তোমাদের দিয়েছেন। তা হল ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর। ( আবু দাউদ)
ইসলামে ঈদ শুধু দু' টি এ বিষয়টি শুধু সহীহ হাদীস দ্বারাই প্রমাণিত নয়, তা রবং ইজমায়ে উম্মত দ্বারাও প্রতিষ্ঠিত। যদি কেউ ইসলামে তৃতীয় আরেকটি ঈদের প্রচলন করে তবে তা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। বরং তা দ্বীনের মধ্যে একটা বেদআত ও বিকৃতি বলেই গণ্য হবে। যখন কেউ বলে 'সকল ঈদের সেরা ঈদ- ঈদে মীলাদ' তখন স্বাভাবিক ভাবেই এর অর্থ হয় ইসলামে যতগুলো ঈদ আছে তার মধ্যে ঈদে মীলাদ হল শ্রেষ্ঠ ঈদ। কিভাবে এটা সম্ভব ? যে ঈদকে আল্লাহ ও তার রাসূল স্বীকৃতি দেননি। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও ইমামগন যে ঈদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন তা ইসলামে শ্রেষ্ঠ ঈদ বলে বিবেচিত হতে পারে কি ভাবে ? কোন ভাবেই নয়। আর যে ঈদ আল্লাহর রাসূল সা. প্রচলন করে গেলেন তা শ্রেষ্ঠ হবে না। এটা কিভাবে মেনে নেয়া যায়? কোন ভাবেই নয়। তবে শুধু একদিক থেকে মেনে নেয়া যায়, আর তা হল যত ভূয়া ও ভেজাল ঈদ আছে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল এই ঈদ!
তা সত্ত্বেও যদি ঈদ পালন করতেই হয় তবে তা ১২ ই রবিউল আউয়াল তারিখে না করে ৯ ই রবিউল আউয়ালে করা যেতে পারে। তাহলে অন্তত সাইয়েদুল মুরসালীন সা. এর ইন্তেকাল দিবসে ঈদ পালন করার মত ধৃষ্ঠতা ও বেয়াদবির পরিচয় দেয়া হবে না। অবশ্য এটাও কিন্তু বেদআত বলে গণ্য হবে।
সার কথা ১২ই রবিউল আউয়ালে ঈদে-মীলাদ উদযাপন করা শরীয়ত বিরোধী কাজ। এ ধরণের কাজ হতে যেমন নিজেদের বাঁচাতে হবে তেমনি অন্যকে বিরত রাখার চেষ্টা করতে হবে।
যে কারণে ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করা যাবে না
প্রথমত ঃ
ইসলাম পরিপূর্ণ ধর্ম। কুরআন ও হাদীসের কোথাও ঈদে-মীলাদ পালন করতে বলা হয়নি। রাসূলে কারীম সা. এর সাহাবায়ে কেরাম বা তাবেয়ীনগন কখনো এটা পালন করেননি। তাই এটা বেদআত ও গোমরাহী।
রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন ঃ

"আমাদের এ ধর্মে যে নতুন কোন বিষয় প্রচলন করবে তা প্রত্যাখ্যাত হবে।" (বুখারী ও মুসলিম।)
তিনি আরো ইরশাদ করেন ঃ

"সাবধান ! ধর্মে প্রবর্তিত নতুন বিষয় থেকে সর্বদা দূরে থাকবে। কেননা নব-প্রবর্তিত প্রতিটি বিষয় হল বেদআত ও প্রতিটি বেদআত হল পথভ্রষ্ঠতা।" (আবু দাউদ, তিরমিজী, ইবনে মাজা, মুসনাদে আহমাদ)
দ্বিতীয়ত ঃ
ঈদে মীলাদুন্নবী হল খৃষ্টানদের বড় দিন, হিন্দুদের জন্মাষ্ঠমী ও বৌদ্ধদের বৌদ্ধ-পূর্ণিমার অনুকরণ। ধর্মীয় বিষয়ে তাদের আচার-অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করা ঈমানের দাবী। অথচ ঈদে-মীলাদ পালনের মাধ্যমে তাদের বিরোধিতা না করে অনুসরণ করা হয়।
তৃতীয়ত ঃ
সর্বসম্মতভাবে ১২ ই রবিউল আউয়াল নবী আকরাম সা. এর ইন্তেকাল দিবস। এতে কারো দ্বিমত নেই ও কোন সন্দেহ নেই। এ দিনে মুসলিম উম্মাহ ও সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর রাসূল সা. এর ইন্তেকালের শোকে পাথর হয়ে হয়ে গিয়েছিলেন। এসব জেনে-শুনে ঠিক এ দিনটিতে ঈদ তথা আনন্দ-উৎসব পালন করা চরম বেঈমানী ও নবীর শানে বেয়াদবী ভিন্ন অন্য কিছু হতে পারে না।
চতুর্থত ঃ
মীলাদুন্নবী পালন করে অনেকে মনে করে নবী কারীম সা. এর প্রতি তাদের দায়ীত্ব-কর্তব্য আদায় হয়ে গেছে। তাই তারা রাসূলে কারীম সা. এর সীরাত ও আদর্শের প্রতি কোন খেয়াল রাখেন না। বরং তারা সীরাতুন্নবী নামের শব্দটাও বরদাশ্ত করতে রাজী নয়।

পঞ্চমত ঃ
আল্লাহ ও তার রাসূল সা. কর্তৃক নির্ধারিত ইসলামের দু'ঈদের সাথে তৃতীয় আরেকটি ঈদ সংযোজন করা ইসলাম-ধর্ম বিকৃত করার একটা অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যথার্থ অনুসরণ করা হল ভালবাসার দাবি
আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ সা.কে কেন রাসূল হিসাবে প্রেরণ করলেন? তার প্রতি আমাদের করণীয় কি? আল্লাহ তাআলা রাসূলকে এ জন্য পাঠিয়েছেন আমরা যেন তার অনুসরণ করি। তার নির্দেশনা মত আল্লাহর হুকুম মান্য করি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন -

"আমি রাসূলকে এ জন্যই পাঠিয়েছি যে, আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে তার আনুগত্য করা হবে।" (সূরা আন-নিসা: ৬৪)
আল্লাহর রাসূল সা.কে ভালবাসা ও তাকে মুহাব্বত করা হবে ঈমানের দাবী। যার মধ্যে রাসূলের ভালবাসা নেই সে ঈমানদার নয়। রাসূলের ভালবাসার পরিচয় দেবেন কিভাবে? এর দুটি পদ্ধতি রয়েছে। এক. আল্লাহর নির্দেশ মত জীবনের সর্বক্ষেত্রে তার অনুসরণ করে ও এর জন্য যে কোন ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকারে প্রস্তুত থেকে। দুই. তাঁকে অনুসরণ না করে তার গুণগান ও প্রশংসাকীর্তনে ব্যস্ত থেকে, মীলাদ পড়ে, মীলাদুন্নবী উদযাপন করে।

আসলে ভালবাসা প্রমাণ করার কোন পদ্ধতিটি সঠিক? আমার মনে হয় মতলববাজ ব্যতিত সকল মানুষ উত্তর দেবে সঠিক হল প্রথমটিই।
আবু লাহাব রাসূলুল্লাহ সা.কে ভালবাসতেন। এতটাই ভালবাসতেন যে তাঁর জন্মগ্রহণের সুসংবাদ যে ক্রীতদাসীর কাছে শুনলেন আনন্দের অতিশয্যে সে ক্রীতদাসী সুয়াইবাকে মুক্ত করে দিলেন। এবং নবুয়্যত পূর্ব পুরো চলি্লশ ব


বিদআত -একটি জঘন্য পাপ

বিদআত মানে এমন কোন ইবাদাত যা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক নির্দেশিত নয়। মুসলিম হিসেবে আমাদের বিশ্বাস যে আল্লাহ সর্বকালের সর্বসেরা মানুষ হিসেবে মুহাম্মদ ইবন আব্দুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বেছে নিয়েছিলেন তার ধর্ম ইসলাম প্রচারের জন্য। এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দায়িত্ব সফলভাবে পালন করেছিলেন। মুসলিম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব তাকে অনুসরণ করা। এখন আমরা যদি কোন নতুন ইবাদাত বা আমল প্রবর্তন করি (টেকনোলজি বা সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণে যা আবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে এমন না, যেমন প্রচলিত মাদ্রাসা, মাইক ইত্যাদি) তবে তাঁর অর্থ যে রসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেননি এবং আমরা রসুলুল্লাহ (সাঃ) এর চেয়ে বেশি আল্লাহভীরু দেখে এই নতুন ইবাদাত করলাম। অথচ ক্বুরানে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেন –
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।”২
ইসলামের পরিপুর্ণতার পরে তাতে কোন কিছু যোগ বা পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই।

রসুলুল্লাহ (সাঃ) নিজেও বলে গেছেন – “নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী আল্লাহ্‌র কিতাব এবং সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদর্শ। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হল (দ্বীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয়। আর নব উদ্ভাবিত প্রত্যেক বিষয় বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআত হল ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম” ৩

ঈদে-মিলাদুন্নবির এই প্রথাটি ক্বুরান অথবা সহিহ সুন্নাহ বা কোন সাহাবিদের আমল থেকে প্রমাণিত নয়। ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন, “এ কাজটি পূর্ববর্তী সৎ ব্যক্তিগণ করেননি অথচ এ কাজ জায়িয থাকলে সওয়াব লাভের উদ্দেশ্যে তা পালন করার কার্যকারণ বিদ্যমান ছিল এবং পালন করতে বিশেষ কোন বাধাও ছিল না। যদি এটা শুধু কল্যাণের কাজই হতো তাহলে আমাদের চেয়ে তারাই এ কাজটি বেশী করতেন। কেননা তারা আমাদের চেয়েও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম-কে বেশী সম্মান করতেন ও ভালবাসতেন এবং কল্যাণের কাজে তারা ছিলেন বেশী আগ্রহী” ৪

আমরা রসুলুল্লাহ (সাঃ) কে অনুসরণ করব – অর্থাৎ তিনি যা করেছেন আমরা তাই করার চেষ্টা করব। আমরা তাঁর আগে আগেও চলবনা, তাঁর পথ ছেড়ে অন্য পথেও চলবনা। বিদআত পাপ হিসেবে এত ভয়াবহ কারণ মানুষ ভাবে সে ভাল কাজ করছে পক্ষান্তরে সে আল্লাহর রসুলের আমলে পরিবর্তন বা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে রসুলুল্লাহ (সাঃ) কে অপমান করে। অন্যান্য পাপের জন্য মানুষ অনুতপ্ত হয় ও ক্ষমা চায়, কিন্তু বিদআতকে যেহেতু মানুষ পাপ হিসেবেই চিহ্নিত করতে পারেনা তাই এর জন্য সে ক্ষমাও চায়না।

গোড়ায় গলদ
রসুলুল্লাহ (সাঃ) থেকে স্বীয় জন্ম তারিখ সম্পর্কে কোন বিবরণ পাওয়া যায়না। তাঁর জীবনীকার দের মধ্যে তিনি কবে জন্ম গ্রহণ করেছেন তা নিয়ে মতভেদ আছে। অনেকের মতে তার জন্মদিন হল ১২ রবিউল আউয়াল। আবার অনেকের মতে ৯ রবিউল আউয়াল। কিন্তু আসলে কোনটা ঠিক?

সহীহ হাদীস নির্ভর সীরাতগ্রন্থ ‘আর-রাহীক আল-মাখতূম’। রসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্ম দিবস সম্পর্কে এ গ্রন্থে বলা হয়েছে – “রসুলুল্লাহ (সাঃ) ৫৭১ খৃস্টাব্দে ৯ রবিউল আউয়াল মোতাবেক ২০ এপ্রিল সোমবার প্রত্যুষে জন্ম গ্রহণ করেন।”
এ যুগের প্রখ্যাত আলিম মুহাম্মাদ সুলাইমান আল-মানসূর ও মিশরের প্রখ্যাত জোতির্বিজ্ঞানী মাহমূদ পাশা নিখুঁতভাবে প্রমাণ করেন যে কবে রসুলুল্লাহ (সাঃ) জন্মেছিলেন। সহীহ মুসলিমে রসুলুল্লাহ (সাঃ) নিজেই বলেছেন তার জন্ম সোমবার দিন হয়েছে। মাহমূদ পাশা গবেষণা ও হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দে ১২ রবিউল আউয়াল তারিখের দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। আর সোমবার ছিল ৯ রবিউল আউয়াল।
মাহমূদ পাশার গবেষণার এ ফল প্রকাশিত হওয়ার পর সকল স্কলাররা তা গ্রহণ করেন এবং এখনোবধি কেউ তার প্রমাণ খণ্ডন করতে পারেননি। অতএব রসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্ম দিবস হল ৯ রবিউল আউয়াল।১

সর্বসম্মতভাবে রসুলুল্লাহ (সাঃ) এর মৃত্যু দিবস হল ১২ রবিউল আউয়াল। যে দিনটিতে আমাদের প্রিয় নবীর জন্মোৎসব পালন করা হয় সে দিনটি মূলত তাঁর মৃত্যু দিবস। মুসলিম হিসেবে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ মুহাম্মাদ (সাঃ)। তাঁর প্রস্থানের দিনটিকে আমরা ঈদ অর্থাৎ উৎসবের দিন হিসেবে পালন করব এটা প্রকারান্তরে বোঝায় যে তাঁর মৃত্যুতে আমরা আনন্দিত। তাই এদিনটি ঈদ হিসেবে পালন করা খুব বড় ধরণের বেয়াদবি।

জন্মদিন
পূর্ববর্তী নবীদের আনীত সব ধর্মগুলোরই Corruption pattern যদি আমরা লক্ষ করি তাহলে একটা মিল খুঁজে পাব। যেমন হিন্দুরা মুর্তিকে আল্লাহর স্থানে বসিয়েছে, খ্রিষ্টানরা ঈসা ও মারিয়াম (আঃ) কে আল্লাহর আসন দিয়েছে, মুসলিমরা কবর/পীর কে আল্লাহর প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েছে।
আবার হিন্দুরা কৃষ্ণের জন্মদিনকে জন্মাষ্টমী হিসেবে পালন করে, খ্রিষ্টানরা আল্লাহর দেয়া উৎসব বাদ দিয়ে ঈসা (আঃ) এর তথাকথিত জন্মদিনকে বড়দিন হিসেবে উদযাপন করে। এজন্য মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রবর্তিত ইসলামের একটি মূলনীতি হল – ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিধর্মীদের বিশেষত ইহুদী-খ্রিষ্টানদের বিরোধিতা করা। যারা সকল ঈদের বড় ঈদ হিসেবে মিলাদুন্নবি পালন করে তারা খ্রিষ্টানদের অনুকরণে এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছেন। এর পরের ধাপ হবে ঈদুল আযহা আর ঈদুল ফিতর বাদ হয়ে যাওয়া।

রসুলুল্লাহ (সাঃ) কে ভালবাসা মানে তাকে অনুসরণ করা, তাঁর অবাধ্যতা না করা। তাই আমাদের কর্তব্য মিলাদ বা ঈদে-মিলাদুন্নবি থেকে নিজেরা বেঁচে থাকা এবং আমাদের প্রিয়জনদের এসব বিদআত থেকে সাবধান করা।
—————————————————————————
১ – মাহমুদ পাশাঃ তারীখে খুযরী, ১/৬২
২ – সূরা আলে-ইমরান : ৮৫
৩ – সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৫৩৫ ও সুনান আন-নাসায়ী, হাদীস নং ১৫৬০
৪ – ইকতিযা আস-সিরাত আল মুস্তাকিম-২/৬১৫

বিদ্আত পরিচিতির মূলনীতি
আল্লাহ্‌র নিকট ইসলামই হচ্ছে একমাত্র মনোনীত দ্বীন। আল-কুরআনে তিনি বলেন,

{وَمَنْ يَّبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلاَمِ دِيْنًا فَلَنْ يُّقْبَلَ مِنْهُ}

“যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন অনুসন্ধান করে, তা কখনোই তার কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে না”।[1]

এ দ্বীনকে পরিপূর্ণ করার ঘোষণাও আল্লাহ্‌ আল-কুরআনে দিয়েছেন,

{اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْأِسْلامَ دِيناً}

“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।”[2]

এ ঘোষণার পর আল-কুরআন ও সুন্নাহ্‌র বাইরে দ্বীনের মধ্যে নতুন কোন বিষয় সংযোজিত হওয়ার পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গেল এবং বিদআত তথা নতুন যে কোন বিষয় দ্বীনী আমল ও আকীদা হিসেবে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত হওয়াও হারাম হয়ে গেল। এ আলোচনায় বিদআতের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরার পাশাপাশি কিভাবে আমাদের সমাজে প্রচলিত বিদআতগুলোকে সনাক্ত করা যায় সে সম্পর্কিত মূলনীতি তুলে ধরা হবে।
বিদআতের সংজ্ঞা :

বিদআত শব্দের আভিধানিক অর্থ হল: اَلشَّيْءُ الْمُخْتَرَعُ عَلٰى غَيْرِ مِثَالٍ سَابِقٍ অর্থাৎ পূর্ববর্তী কোন নমুনা ছাড়াই নতুন আবিষকৃত বিষয়।[3] আর শরীয়তের পরিভাষায়- مَا أُحْدِثَ فِى دِيْنِ اللهِ وَلَيْسَ لَهُ أَصْلٌ عَامٌ وَلاَخَاصٌّ يَدُلُّ عَلَيْهِ অর্থাৎ আল্লাহ্‌র দ্বীনের মধ্যে নতুন করে যার প্রচলন করা হয়েছে এবং এর পক্ষে শরীয়তের কোন ব্যাপক ও সাধারণ কিংবা খাস ও সুনির্দিষ্ট দলীল নেই।[4]

এ সংজ্ঞাটিতে তিনটি বিষয় লক্ষণীয় :

* নতুনভাবে প্রচলন অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামের যুগে এর কোন প্রচলন ছিল না এবং এর কোন নমুনাও ছিল না।
* এ নব প্রচলিত বিষয়টিকে দ্বীনের মধ্যে সংযোজন করা এবং ধারণা করা যে, এটি দ্বীনের অংশ।
* নব প্রচলিত এ বিষয়টি শরীয়তের কোন ‘আম বা খাস দলীল ছাড়াই চালু ও উদ্ভাবন করা।

সংজ্ঞার এ তিনটি বিষয়ের একত্রিত রূপ হল বিদআত, যা থেকে বিরত থাকার কঠোর নির্দেশ শরীয়তে এসেছে। কঠোর নিষেধাজ্ঞার এ বিষয়টি হাদীসে বারবার উচ্চারিত হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম বলেছেন,

وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُوْرِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ) رواه أبو داود والترمذى وقال حديث حسن صحيح

“তোমরা (দ্বীনের) নব প্রচলিত বিষয়সমূহ থেকে সতর্ক থাক। কেননা প্রত্যেক নতুন বিষয় বিদআ‘ত এবং প্রত্যেক বিদআত ভ্রষ্টতা”।[5]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম তাঁর এক খুতবায় বলেছেন:

إِنَّ أَصْدَقَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللهِ وَأَحْسَنَ الْهَدْيِ هَدْيُ مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الأُمُوْرِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ وَكُلُّ ضَلاَلَةٍ فِي النَّارِ. رواه مسلم والنسائى واللفظ للنسائى

“নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী আল্লাহ্‌র কিতাব এবং সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মদের আদর্শ। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হল (দ্বীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয়। আর নব উদ্ভাবিত প্রত্যেক বিষয় বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআত হল ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।[6]

বিদআতের বৈশিষ্ট্য :

বিদআতের চারটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে :

* বিদআতকে বিদআত হিসেবে চেনার জন্য সুনির্দিষ্ট কোন দলীল পাওয়া যায় না; তবে তা নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে মূলনীতিগত ‘আম ও সাধারণ দলীল পাওয়া যায়।
* বিদআত সবসময়ই শরীয়তের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও মাকাসিদ এর বিপরীত ও বিরোধী অবস্থানে থাকে। আর এ বিষয়টিই বিদআত নিকৃষ্ট ও বাতিল হওয়ার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এ জন্যই হাদীসে বিদআতকে ভ্রষ্টতা বলে অভিহিত করা হয়েছে।
* অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদআত এমন সব কার্যাবলী সম্পাদনের মাধ্যমে হয়ে থাকে যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম ও সাহাবাদের যুগে প্রচলিত ছিল না। ইমাম ইবনুল জাওযী রহ: বলেন,

البِدْعَةُ عِبارةٌ عَنْ فِعلٍ لَمْ يَكُنْ فابتُدِعَ

‘বিদআত বলতে বুঝায় এমন কাজকে যা ছিল না, অতঃপর তা উদ্ভাবন করা হয়েছে’।[7]
* বিদআতের সাথে শরীয়তের কোন কোন ইবাদাতের কিছু মিল থাকে। দু’টো ব্যাপারে এ মিলগুলো লক্ষ্য করা যায়:

প্রথমত : দলীলের দিক থেকে এভাবে মিল রয়েছে যে, কোন একটি ‘আম দলীল কিংবা সংশয় অথবা ধারণার ভিত্তিতে বিদআতটি প্রচলিত হয় এবং খাস ও নির্দিষ্ট দলীলকে পাশ কাটিয়ে এ ‘আম দলীল কিংবা সংশয় অথবা ধারণাটিকে বিদআতের সহীহ ও সঠিক দলীল বলে মনে করা হয়।

দ্বিতীয়ত : শরীয়ত প্রণীত ইবাদাতের রূপরেখা ও পদ্ধতির সাথে বিদআতের মিল তৈরী করা হয় সংখ্যা, আকার-আকৃতি, সময় বা স্থানের দিক থেকে কিংবা হুকুমের দিক থেকে। এ মিলগুলোর কারণে অনেকে একে বিদআত মনে না করে ইবাদাত বলে গণ্য করে থাকেন।

বিদআত নির্ধারণে মানুষের মতপার্থক্য :

বিদআত নির্ধারণে মানুষ সাধারণতঃ তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত :

এক : দলীল পাওয়া যায় না এমন প্রতিটি বিষয়কে এক শ্রেণীর মানুষ বিদআত হিসেবে চিহ্নিত করছে এবং এক্ষেত্রে তারা বিশেষ বাছ-বিচার না করেই সব কিছুকে (এমন কি মু‘আমালার বিষয়কেও) বিদআত বলে অভিহিত করছে। এদের কাছে বিদআতের সীমানা বহুদূর বিস্তৃত।

দুই : যারা দ্বীনের মধ্যে নব উদ্ভাবিত সকল বিষয়কে বিদআত বলতে রাজী নয়; বরং বড় বড় নতুন কয়েকটিকে বিদআত বলে বাকী সবকিছু শরীয়তভুক্ত বলে তারা মনে করে। এদের কাছে বিদআতের সীমানা খুবই ক্ষুদ্র।

তিন : যারা যাচাই-বাছাই করে শুধুমাত্র প্রকৃত বিদআতকেই বিদআত বলে অভিহিত করে থাকেন। এরা মধ্যমপ্রন্থাবলম্বী এবং হকপন্থী।

বিদআতের মৌলিক নীতিমালা :

বিদআতের তিনটি মৌলিক নীতিমালা রয়েছে। সেগুলো হল :

* একঃ এমন ‘আমলের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র নিকট সাওয়াবের আশা করা যা শরীয়ত সিদ্ধ নয়। কেননা শরীয়তের স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম হল- এমন আমল দ্বারা আল্লাহ্‌র নিকট সাওয়াবের আশা করতে হবে যা কুরআনে আল্লাহ নিজে কিংবা সহীহ হাদীসে তাঁর রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম অনুমোদন করেছেন। তাহলেই কাজটি ইবাদাত বলে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম যে আমল অনুমোদন করেননি সে আমলের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র ইবাদাত করা হবে বিদআত।
* দুইঃ দ্বীনের অনুমোদিত ব্যবস্থা ও পদ্ধতির বাইরে অন্য ব্যবস্থার অনুসরণ ও স্বীকৃতি প্রদান। ইসলামে একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, শরীয়তের বেঁধে দেয়া পদ্ধতি ও বিধানের মধ্যে থাকা ওয়াজিব। যে ব্যক্তি ইসলামী শরীয়ত ব্যতীত অন্য বিধান ও পদ্ধতি অনুসরণ করল ও তার প্রতি আনুগত্যের স্বীকৃতি প্রদান করল সে বিদআতে লিপ্ত হল।
* তিনঃ যে সকল কর্মকাণ্ড সরাসরি বিদআত না হলেও বিদআতের দিকে পরিচালিত করে এবং পরিশেষে মানুষকে বিদআতে লিপ্ত করে, সেগুলোর হুকুম বিদআতেরই অনুরূপ।

জেনে রাখা ভাল যে, ‘সুন্নাত’-এর অর্থ বুঝতে ভুল হলে বিদআত চিহ্নিত করতেও ভুল হবে। এদিকে ইঙ্গিত করে ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সুন্নাতকে বিদআত থেকে পৃথক করা; কেননা সুন্নাত হচ্ছে ঐ বিষয়, শরীয়ত প্রণেতা যার নির্দেশ প্রদান করেছেন। আর বিদআত হচ্ছে ঐ বিষয় যা শরীয়ত প্রণেতা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত বলে অনুমোদন করেননি। এ বিষয়ে মানুষ মৌলিক ও অমৌলিক অনেক ক্ষেত্রে প্রচুর বিভ্রান্তির বেড়াজালে নিমজ্জিত হয়েছে। কেননা, প্রত্যেক দলই ধারণা করে যে, তাদের অনুসৃত পন্থাই হ’ল সুন্নাত এবং তাদের বিরোধীদের পথ হল বিদআত।”[8]

বিদআতের উপরোল্লিখিত তিনটি প্রধান মৌলিক নীতিমালার আলোকে বিদআতকে চিহ্নিত করার জন্য আরো বেশ কিছু সাধারণ নীতিমালা শরীয়ত বিশেষজ্ঞ আলেমগণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যদ্‌দ্বারা একজন সাধারণ মানুষ সহজেই কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীসের ভিত্তিতে বিদআতের পরিচয় লাভ করতে পারে ও সমাজে প্রচলিত বিদআতসমূহকে চিহ্নিত করতে পারে। কেননা প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব হল শরীয়তের দৃষ্টিতে যা বিদআত তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জেনে নেয়া ও তা থেকে পুরোপুরি বেঁচে থাকা। নীচে উদাহরণ স্বরূপ কিছু দৃষ্টান্তসহ আমরা অতীব গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় নীতিমালা উল্লেখ করছি।

প্রথম নীতি :

অত্যধিক দুর্বল, মিথ্যা ও জাল হাদীসের ভিত্তিতে যে সকল ইবাদাত করা হয়, তা শরীয়তে বিদআত বলে বিবেচিত। এটি বিদআত চিহ্নিত করার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নীতি। কেননা ইবাদাত হচ্ছে পুরোপুরি অহী নির্ভর। শরীয়তের কোন বিধান কিংবা কোন ইবাদাত শরীয়তের গ্রহণযোগ্য সহীহ দলীল ছাড়া সাব্যস্ত হয় না। জাল বা মিথ্যা হাদীস মূলতঃ হাদীস নয়। অতএব এ ধরনের হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত হওয়া কোন বিধান বা ইবাদাত শরীয়তের অংশ হওয়া সম্ভব নয় বিধায় সে অনুযায়ী আমল বিদআত হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে থাকে। অত্যধিক দুর্বল হাদীসের ব্যাপারে জমহুর মুহাদ্দিসগণের মত হল এর দ্বারাও শরীয়তের কোন বিধান সাব্যস্ত হবে না।

উদাহরণ :

রজব মাসের প্রথম জুমু‘আর রাতে অথবা ২৭শে রজব যে বিশেষ শবে মি’রাজের সালাত আদায় করা হয় তা বিদআত হিসেবে গণ্য। অনুরূপভাবে নিসফে শা‘বান বা শবেবরাতের রাতে যে ১০০ রাকাত সালাত বিশেষ পদ্ধতিতে আদায় করা হয় যাকে সালাতুর রাগায়েব বলেও অভিহিত করা হয়, তাও বিদআত হিসেবে গণ্য। কেননা এর ফযীলত সম্পর্কিত হাদীসটি জাল।[9]

দ্বিতীয় নীতি :

যে সকল ইবাদাত শুধুমাত্র মনগড়া মতামত ও খেয়াল-খুশীর উপর ভিত্তি করে প্রণীত হয় সে সকল ইবাদাত বিদআত হিসেবে গণ্য। যেমন কোন এক ‘আলিম বা আবেদ ব্যক্তির কথা কিংবা কোন দেশের প্রথা অথবা স্বপ্ন কিংবা কাহিনী যদি হয় কোন ‘আমল বা ইবাদাতের দলীল তাহলে তা হবে বিদআত।

দ্বীনের প্রকৃত নীতি হল- আল কুরআন ও সুন্নাহ্‌র মাধ্যমেই শুধু আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের কাছে জ্ঞান আসে। সুতরাং শরীয়তের হালাল-হারাম এবং ইবাদাত ও ‘আমল নির্ধারিত হবে এ দু’টি দলীলের ভিত্তিতে। এ দু’টি দলীল ছাড়া অন্য পন্থায় স্থিরীকৃত ‘আমল ও ইবাদাত তাই বিদআত বলে গণ্য হবে। এ জন্যই বিদআত পন্থীগণ তাদের বিদআতগুলোর ক্ষেত্রে শরয়ী দলীলের অপব্যাখ্যা করে সংশয় সৃষ্টি করে। এ প্রসঙ্গে ইমাম শাতেবী রহ. বলেন, “সুন্নাতী তরীকার মধ্যে আছে এবং সুন্নাতের অনুসারী বলে দাবীদার যে সকল ব্যক্তি সুন্নাতের বাইরে অবস্থান করছে, তারা নিজ নিজ মাসআলাগুলোতে সুন্নাহ্‌ দ্বারা দলীল পেশের ভান করেন।”[10]

উদাহরণ :

১। কাশ্‌ফ, অন্তর্দৃষ্টি তথা মুরাকাবা-মুশাহাদা, স্বপ্ন ও কারামাতের উপর ভিত্তি করে শরীয়াতের হালাল হারাম নির্ধারণ করা কিংবা কোন বিশেষ ‘আমল বা ইবাদাতের প্রচলন করা।[11]

২। শুধুমাত্র ‘আল্লাহ’ কিংবা হু-হু’ অথবা ‘ইল্লাল্লাহ’ এর যিকর উপরোক্ত নীতির আলোকে ইবাদাত ব’লে গণ্য হবে না। কেননা কুরআন কিংবা হাদীসের কোথাও এরকম যিকর অনুমোদিত হয়নি।[12]

৩। মৃত অথবা অনুপস্থিত সৎব্যক্তিবর্গকে আহ্বান করা, তাদের কাছে প্রার্থনা করা ও সাহায্য চাওয়া, অনুরূপভাবে ফেরেশতা ও নবী-রসূলগণের কাছে দু‘আ করাও এ নীতির আলোকে বিদআত বলে সাব্যস্ত হবে। শেষোক্ত এ বিদআতটি মূলতঃ শেষ পর্যন্ত বড় শিরকে পরিণত হয়।

তৃতীয় নীতি :

কোন বাধা-বিপত্তির কারণে নয় বরং এমনিতেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম যে সকল ‘আমল ও ইবাদাত থেকে বিরত থেকেছিলেন, পরবর্তীতে তার উম্মাতের কেউ যদি সে ‘আমল করে, তবে তা শরীয়তে বিদআত হিসেবে গণ্য হবে।

কেননা তা যদি শরীয়তসম্মত হত তাহলে তা করার প্রয়োজন বিদ্যমান ছিল। অথচ কোন বাধাবিপত্তি ছাড়াই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম সে ‘আমল বা ইবাদাত ত্যাগ করেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ‘আমলটি শরীয়তসম্মত নয়। অতএব সে ‘আমল করা যেহেতু আর কারো জন্য জায়েয নেই, তাই তা করা হবে বিদআত।

উদাহরণ:

১। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ও জুমা‘ ছাড়া অন্যান্য সালাতের জন্য ‘আযান দেয়া। উপরোক্ত নীতির আলোকে বিদআত বলে গণ্য হবে।

২। সালাত শুরু করার সময় মুখে নিয়তের বাক্য পড়া। যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম ও সাহাবীগণ এরূপ করা থেকে বিরত থেকেছিলেন এবং নিয়ত করেছিলেন শুধু অন্তর দিয়ে, তাই নিয়তের সময় মুখে বাক্য পড়া বিদআত বলে গণ্য হবে।

৩। বিপদ-আপদ ও ঝড়-তুফান আসলে ঘরে আযান দেয়াও উপরোক্ত নীতির আলোকে বিদআত বলে গণ্য হবে। কেননা বিপদ-আপদে কী পাঠ করা উচিত বা কী ‘আমল করা উচিত তা হাদীসে সুন্দরভাবে বর্ণিত আছে।

৪। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম এর জন্মোৎসব পালনের জন্য কিংবা আল্লাহর কাছে সাওয়াব ও বরকত লাভের প্রত্যাশায় অথবা যে কোন কাজে আল্লাহর সাহায্য লাভের উদ্দেশে মিলাদ পড়া উপরোক্ত নীতির আলোকে বিদআত বলে গণ্য হবে।

চতুর্থ নীতি :

সালাফে সালেহীন তথা সাহাবায়ে কেরাম, ও তাবেয়ীন যদি কোন বাধা না থাকা সত্ত্বেও কোন ইবাদাতের কাজ করা কিংবা বর্ণনা করা অথবা লিপিবদ্ধ করা থেকে বিরত থেকে থাকেন, তাহলে এমন পরিস্থিতিতে তাদের বিরত থাকার কারণে প্রমাণিত হয় যে, কাজটি তাদের দৃষ্টিতে শরীয়তসিদ্ধ নয়। কারণ তা যদি শরীয়তসিদ্ধ হত তাহলে তাদের জন্য তা করার প্রয়োজন বিদ্যমান ছিল। তা সত্ত্বেও যেহেতু তারা কোন বাধাবিপত্তি ছাড়াই উক্ত ‘আমল ত্যাগ করেছেন, তাই পরবর্তী যুগে কেউ এসে সে ‘আমাল বা ইবাদাত প্রচলিত করলে তা হবে বিদআত।

হুজাইফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, “যে সকল ইবাদাত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম এর সাহাবাগণ করেন নি তোমরা সে সকল ইবাদাত কর না।”[13]

মালিক ইবনে আনাস রহ. বলেন, “এই উম্মাতের প্রথম প্রজন্ম যে ‘আমল দ্বারা সংশোধিত হয়েছিল একমাত্র সে ‘আমল দ্বারাই উম্মাতের শেষ প্রজন্ম সংশোধিত হতে পারে।”[14]

ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. কিছু বিদআতের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বলেন, “এ কথা জানা যে, যদি এ কাজটি শরীয়তসম্মত ও মুস্তাহাব হত যদ্‌দ্বারা আল্লাহ সাওয়াব দিয়ে থাকেন, তাহলে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী অবহিত থাকতেন এবং অবশ্যই তাঁর সাহাবীদেরকে তা জানাতেন, আর তাঁর সাহাবীরাও সে বিষয়ে অন্যদের চেয়েও বেশী অবহিত থাকতেন এবং পরবর্তী লোকদের চেয়েও এ ‘আমলে বেশী আগ্রহী হতেন। কিন্তু যখন তারা এ প্রকার ‘আমলের দিকে কোন ভ্রুক্ষেপই করলেন না তাতে বোঝা গেল যে, তা নব উদ্ভাবিত এমন বিদআত যাকে তারা ইবাদাত, নৈকট্য ও আনুগত্য হিসেবে বিবেচনা করতেন না। অতএব এখন যারা একে ইবাদাত, নৈকট্য, সাওয়াবের কাজ ও আনুগত্য হিসাবে প্রদর্শন করছে তারা সাহাবাদের পথ ভিন্ন অন্য পথ অনুসরণ করছেন এবং দ্বীনের মধ্যে এমন কিছুর প্রচলন করছেন যার অনুমতি আল্লাহ প্রদান করেননি।”[15]

তিনি আরো বলেন, “আর যে ধরনের ইবাদাত পালন থেকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম বিরত থেকেছেন অথচ তা যদি শরীয়াত সম্মত হত তাহলে তিনি নিজে তা অবশ্যই পালন করতেন, অথবা অনুমতি প্রদান করতেন এবং তাঁর পরে খলিফাগণ ও সাহাবীগণ তা পালন করতেন। অতএব এ কথা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করা ওয়াজিব যে এ কাজটি বিদআত ও ভ্রষ্টতা।”[16]

এর দ্বারা বুঝা গেল যে, যে সকল ইবাদাত পালন করা থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম নিজে এবং তাঁর পরে উম্মাতের প্রথম প্রজন্মের আলিমগণ বিরত থেকেছিলেন নিঃসন্দেহে সেগুলো বিদআত ও ভ্রষ্টতা। পরবর্তী যুগে কিংবা আমাদের যুগে এসে এগুলোকে ইবাদাত হিসেবে গণ্য করার কোন শরয়ী‘ ভিত্তি নেই।

উদাহরণ :

১। ইসলামের বিশেষ বিশেষ দিবসসমূহ ও ঐতিহাসিক উপলক্ষগুলোকে ঈদ উৎসবের মত উদযাপন করা। কেননা ইসলামী শরীয়াতই ঈদ উৎসব নির্ধারণ ও অনুমোদন করে। শরীয়াতের বাইরে অন্য কোন উপলক্ষকে ঈদ উৎসবে পরিণত করার ইখতিয়ার কোন ব্যক্তি বা দলের নেই। এ ধরনের উপলক্ষের মধ্যে একটি রয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম এর জন্ম উৎসব উদযাপন। সাহাবীগণ ও পূর্ববর্তী ‘আলিমগণ হতে এটি পালন করাতো দূরের কথা বরং অনুমোদন দানের কোন বর্ণনাও পাওয়া যায় না। ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন, “এ কাজটি পূর্ববর্তী সালাফগণ করেননি অথচ এ কাজ জায়িয থাকলে সওয়াব লাভের উদ্দেশ্যে তা পালন করার কার্যকারণ বিদ্যমান ছিল এবং পালন করতে বিশেষ কোন বাধাও ছিল না। যদি এটা শুধু কল্যাণের কাজই হতো তাহলে আমাদের চেয়ে তারাই এ কাজটি বেশী করতেন। কেননা তারা আমাদের চেয়েও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম-কে বেশী সম্মান ও মহব্বত করতেন এবং কল্যাণের কাজে তারা ছিলেন বেশী আগ্রহী।”[17]

২। ইতোপূর্বে বর্ণিত সালাত-আর রাগায়েব বা শবে মি‘রাজের সালাত উল্লেখিত চতুর্থ নীতির আলোকেও বিদআত সাব্যস্ত হয়ে থাকে।

ইমাম ইযযুদ্বীন ইবনু আব্দুস সালাম রহ. এ প্রকার সালাত এর বৈধতা অস্বীকার করে বলেন, “এ প্রকার সালাত যে বিদআত তার একটি প্রমাণ হলো দ্বীনের প্রথম সারির ‘উলামা ও মুসলমানদের ইমাম তথা সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন ও শরীয়াহ বিষয়ে গ্রন্থ প্রণয়নকারী বড় বড় ‘আলিমগণ মানুষকে ফরয ও সুন্নাত বিষয়ে জ্ঞান দানের প্রবল আগ্রহ পোষণ করা সত্ত্বেও তাদের কারো কাছ থেকে এ সালাত সম্পর্কে কোন বর্ণনা পাওয়া যায় নি এবং কেউ তাঁর নিজ গ্রন্থে এ সম্পর্কে কিছু লিপিবদ্ধও করেন নি ও কোন বৈঠকে এ বিষয়ে কোন আলোকপাতও করেননি। বাস্তবে এটা অসম্ভব যে, এ সালাত আদায় শরীয়তে সুন্নাত হিসেবে বিবেচিত হবে অথচ দ্বীনের প্রথম সারির ‘আলিমগণ ও মু’মিনদের যারা আদর্শ, বিষয়টি তাদের সকলের কাছে থেকে যাবে সম্পূর্ণ অজানা”। [আত তারগীব ‘আন সলাতির রাগাইব আল মাওদুয়া, পৃঃ ৫-৯]

পঞ্চম নীতি :

যে সকল ইবাদাত শরীয়াতের মূলনীতিসমূহ এবং মাকাসিদ তথা উদ্দেশ্য ও লক্ষের বিপরীত সে সবই হবে বিদআত।

উদাহরণ :

১. দুই ঈদের সালাতের জন্য আযান দেয়া। কেননা নফল সালাতের জন্য আযান দেয়া শরীয়ত সম্মত নয়। আযান শুধু ফরয সালাতের সাথেই খাস।

২. জানাযার সালাতের জন্য আযান দেয়া। কেননা জানাযার সালাতে আযানের কোন বর্ণনা নেই, তদুপরি এতে সবার অংশগ্রহণ করার বাধ্যবাধকতাও নেই।

৩. ফরয সালাতের আযানের আগে মাইকে দরূদ পাঠ। কেননা আযানের উদ্দেশ্য লোকদেরকে জামাআ’তে সালাত আদায়ের প্রতি আহ্বান করা, মাইকে দরূদ পাঠের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।

ষষ্ঠ নীতি :

প্রথা ও মু‘আমালাত বিষয়ক কোন কাজের মাধ্যমে যদি শরীয়তের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছাড়াই আল্লাহর কাছে সাওয়াব লাভের আশা করা হয় তাহলে তা হবে বিদআত।

উদাহরণ :

পশমী কাপড়, চট, ছেঁড়া ও তালি এবং ময়লাযুক্ত কাপড় কিংবা নির্দিষ্ট রঙের পোষাক পরিধান করাকে ইবাদাত ও আল্লাহর প্রিয় পাত্র হওয়ার পন্থা মনে করা। একই ভাবে সার্বক্ষণিক চুপ থাকাকে কিংবা রুটি ও গোশত্‌ ভক্ষণ ও পানি পান থেকে বিরত থাকাকে অথবা ছায়াযুক্ত স্থান ত্যাগ করে সূর্যের আলোয় দাঁড়িয়ে কাজ করাকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পন্থা হিসাবে নির্ধারণ করা।

উল্লেখিত কাজসমূহ কেউ যদি এমনিতেই করে তবে তা নাজায়িয নয়, কিন্তু এ সকল ‘আদাত কিংবা মোয়ামালাতের কাজগুলোকে যদি কেউ ইবাদাতের রূপ প্রদান করে কিংবা সাওয়াব লাভের উপায় মনে করে তবে তখনই তা হবে বিদআত। কেননা এগুলো ইবাদাত ও সওয়াব লাভের পন্থা হওয়ার কোন দলীল শরীয়তে নেই।

সপ্তম নীতি :

আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম যে সকল কাজ নিষেধ করে দিয়েছেন সেগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সাওয়াব লাভের আশা করা হলে সেগুলো হবে বিদআত।

উদাহরণ :

১।গান-বাদ্য ও কাওয়ালী বলা ও শোনা অথবা নাচের মাধ্যমে যিকর করে আল্লাহর কাছে সাওয়াবের আশা করা।

২। কাফির, মুশরিক ও বিজাতীয়দের অনুকরণের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সাওয়াব লাভের আশা করা।

অষ্টম নীতি :

যে সকল ইবাদাত শরীয়তে নির্ধারিত সময়, স্থান ও পদ্ধতির সাথে প্রণয়ন করা হয়েছে সেগুলোকে সে নির্ধারিত সময়, স্থান ও পদ্ধতি থেকে পরিবর্তন করা বিদআত বলে গণ্য হবে।

উদাহরণ :

১। নির্ধারিত সময় পরিবর্তনের উদাহরণ- যেমন জিলহাজ্জ মাসের এক তারিখে কুরবানী করা। কেননা, কুরবানীর শরয়ী সময় হল ১০ জ্বিলহাজ্জ ও তৎপরবর্তী আইয়ামে তাশরীকের দিনগুলো।

২। নির্ধারিত স্থান পরিবর্তনের উদাহরণ- যেমন মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও ই‘তিকাফ করা। কেননা, শরীয়ত কর্তৃক ই‘তিকাফের নির্ধারিত স্থান হচ্ছে মসজিদ।

৩। নির্ধারিত শ্রেণী পরিবর্তনের উদাহরণ- যেমন গৃহ পালিত পশুর পরিবর্তে ঘোড়া দিয়ে কুরবানী করা।

৪। নির্ধারিত সংখ্যা পরিবর্তনের উদাহরণ- যেমন পাঁচ ওয়াক্তের অতিরিক্ত ৬ষ্ঠ আরো এক ওয়াক্ত সালাত প্রচলন করা। কিংবা চার রাক‘আত সালাতকে দুই রাক‘আত, কিংবা দুই রাক‘আতের সালাতকে চার রাক‘আতে পরিণত করা।

৫। নির্ধারিত পদ্ধতি পরিবর্তনের উদাহরণ : অযু করার শরয়ী পদ্ধতির বিপরীতে যেমন দু‘পা ধোয়ার মাধ্যমে অযু শুরু করা এবং তারপর দু‘হাত ধৌত করা এবং মাথা মাসহ করে মুখমণ্ডল ধৌত করা। অনুরূপভাবে সালাতের মধ্যে আগে সিজদাহ ও পরে রুকু করা।

নবম নীতি :

‘আম তথা ব্যাপক অর্থবোধক দলিল দ্বারা শরীয়তে যে সকল ইবাদাতকে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে সেগুলোকে কোন নির্দিষ্ট সময় কিংবা নির্দিষ্ট স্থান অথবা অন্য কিছুর সাথে এমনভাবে সীমাবদ্ধ করা বিদআত ব’লে গণ্য হবে যদ্‌দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত ইবাদাতের এ সীমাবদ্ধ করণ প্রক্রিয়া শরীয়তসম্মত, অথচ পূর্বোক্ত ‘আম দলীলের মধ্যে এ সীমাবদ্ধ করণের উপর কোন প্রমাণ ও দিক নির্দেশনা পাওয়া যায় না।

এ নীতির মোদ্দাকথা হচ্ছে কোন উন্মুক্ত ইবাদাতকে শরীয়াতের সহীহ দলীল ছাড়া কোন স্থান, কাল বা সংখ্যা দ্বারা সীমাবদ্ধ করা বিদআত হিসেবে বিবেচিত।

উদাহরণ :

১। যে দিনগুলোতে শরীয়াত রোযা বা সাওম রাখার বিষয়টি সাধারণভাবে উন্মুক্ত রেখেছে যেমন মঙ্গল বার, বুধবার কিংবা মাসের ৭, ৮ ও ৯ ইত্যাদি তারিখসমূহ, সে দিনগুলোর কোন এক বা একাধিক দিন বা বারকে বিশেষ ফযীলাত আছে বলে সাওম পালনের জন্য যদি কেউ খাস ও সীমাবদ্ধ করে অথচ খাস করার কোন দলীল শরীয়তে নেই, যেমন ফাতিহা-ই-ইয়াযদাহমের দিন সাওম পালন করা, তাহলে শরীয়াতের দৃষ্টিতে তা হবে বিদআত, কেননা দলীল ছাড়া শরীয়াতের কোন হুকুমকে খাস ও সীমাবদ্ধ করা জায়িয নেই।

২। ফযীলাতপূর্ণ দিনগুলোতে শরীয়াত যে সকল ইবাদাতকে উন্মুক্ত রেখেছে সেগুলোকে কোন সংখ্যা, পদ্ধতি বা বিশেষ ইবাদাতের সাথে খাস করা বিদআত হিসাবে গণ্য হবে। যেমন প্রতি শুক্রবার নির্দিষ্ট করে চল্লিশ রাক‘আত নফল সালাত পড়া, প্রতি বৃহস্পতিবার নির্দিষ্ট পরিমাণ সদাকা করা, অনুরূপভাবে কোন নির্দিষ্ট রাতকে নির্দিষ্ট সালাত ও কুরআন খতম বা অন্য কোন ইবাদাতের জন্য খাস করা।

দশম নীতি :

শরীয়াতে যে পরিমাণ অনুমোদন দেয়া হয়েছে ইবাদাত করতে গিয়ে সে ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশী ‘আমল করার মাধ্যমে বাড়াবাড়ি করা এবং কঠোরতা আরোপ করা বিদআত বলে বিবেচিত।

উদাহরণ :

১। সারা রাত জেগে নিদ্রা পরিহার করে কিয়ামুল লাইল এর মাধ্যমে এবং ভঙ্গ না করে সারা বছর সাওম রাখার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা এবং অনুরূপভাবে স্ত্রী, পরিবার ও সংসার ত্যাগ করে বৈরাগ্যবাদের ব্রত গ্রহণ করা। সহীহ বুখারীতে আনাস ইবনে মালেক (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) এর হাদীসে যারা সারা বছর সাওম রাখার ও বিবাহ করে সংসার ধর্ম পালন না করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল তাদের উদ্দেশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম বলেছিলেন :



أَمَا وَاللهِ إِنِّي لأَخْشَاكُمْ للهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ لَكِنِّي أَصُومُ وَأُفْطِرُ وَأُصَلِّي وَأَرْقُدُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي- رواه البخاري

“আমি তোমাদের মধ্যে আল্লাহর প্রতি সবচেয়ে বেশী ভয় পোষণ করি এবং তাকওয়া অবলম্বনকারী| কিন্তু আমি সওম পালন করি ও ভাঙ্গি, সালাত আদায় করি ও নিদ্রা যাপন করি এবং নারীদের বিবাহ করি। যে আমার এ সুন্নাত থেকে বিরাগভাজন হয়, যে আমার দলভুক্ত নয়।”[18]

২। হাজ্জের সময় জামরায় বড় বড় পাথর দিয়ে রমী করা, এ কারণে যে, এগুলো ছোট পাথরের চেয়ে পিলারে জোরে আঘাত হানবে এবং এটা এ উদ্দেশ্যে যে, শয়তান এতে বেশী ব্যথা পাবে। এটা বিদআত এজন্য যে, শরীয়তের নির্দেশ হল ছোট পাথর নিক্ষেপ করা এবং এর কারণ হিসেবে হাদীসে বলা হয়েছে যে, “আল্লাহর যিকর ও স্মরণকে কায়েম করা।”[19] উল্লেখ্য যে, পাথর নিক্ষেপের স্তম্ভটি শয়তান বা শয়তানের প্রতিভূ নয়। হাদীসের ভাষায় এটি জামরাহ। তাই সকল ক্ষেত্রে নিরাপদ হল হাদীস অনুযায়ী ‘আমল করা ও আকীদা পোষণ করা।

৩। যে পোষাক পরিধান করা শরীয়তে মুবাহ ও জায়েয, যেমন পশমী কিংবা মোটা কাপড় পরিধান করা তাকে ফযীলাতপূর্ণ অথবা হারাম মনে করা বিদআত, কেননা এটা শরীয়তের দৃষ্টিতে বাড়াবাড়ি।

একাদশ নীতি :

যে সকল আকীদাহ, মতামত ও বক্তব্য আল-কুরআন ও সুন্নাতের বিপরীত কিংবা এ উম্মাতের সালাফে সালেহীনের ইজমা‘ বিরোধী সেগুলো শরীয়াতের দৃষ্টিতে বিদআত। এই নীতির আলোকে নিম্নোক্ত দু’টি বিষয় শরীয়াতের দৃষ্টিতে বিদআত ও প্রত্যাখ্যাত বলে গণ্য হবে।

প্রথম বিষয়ঃ নিজস্ব আকল ও বিবেকপ্রসূত মতামতকে অমোঘ ও নিশ্চিত নীতিরূপে নির্ধারণ করা এবং কুরআন ও সুন্নাহর বক্তব্যকে এ নীতির সাথে মিলিয়ে যদি দেখা যায় যে, সে বক্তব্য উক্ত মতামতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ তাহলে তা গ্রহণ করা এবং যদি দেখা যায় যে, কুরআন ও সুন্নাহর বক্তব্য উক্ত মতামত বিরোধী তাহলে সে বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা। অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহ্‌র উপরে নিজের আকল ও বিবেককে অগ্রাধিকার দেয়া।

শরীয়াতের দৃষ্টিতে এ বিষয়টি অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এ ব্যাপারে ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন : “বিবেকের মতামত অথবা কিয়াস দ্বারা আল কুরআনের বিরোধিতা করাকে সালাফে সালেহীনের কেউই বৈধ মনে করতেন না। এ বিদআতটি তখনই প্রচলিত হয় যখন জাহমিয়া, মু’তাযিলা ও তাদের অনুরূপ কতিপয় এমন ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে যারা বিবেকপ্রসূত রায়ের উপর ধর্মীয় মূলনীতি নির্ধারণ করেছিলেন এবং সেই রায়ের দিকে কুরআনের বক্তব্যকে পরিচালিত করেছিলেন এবং বলেছিলেন, যখন বিবেক ও শরীয়ার মধ্যে বিরোধিতা দেখা দিবে তখন হয় শরীয়াতের সঠিক মর্ম বোধগম্য নয় বলে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করা হবে অথবা বিবেকের রায় অনুযায়ী তা’বীল ও ব্যাখ্যা করা হবে। এরা হলো সে সব লোক যারা কোন দলীল ছাড়াই আল্লাহর আয়াতের ব্যাপারে তর্ক করে থাকে।”[20]

ইবনু আবিল ‘ইয্‌ আল-হানাফী রহ. বলেন, “বরং বিদআত‘কারীদের প্রত্যেক দলই নিজেদের বিদআত ও যাকে তারা বিবেকপ্রসূত যুক্তি বলে ধারণা করে তার সাথে কুরআন ও সুন্নাহর বক্তব্যকে মিলিয়ে দেখে। কুরআন সুন্নাহর সে বক্তব্য যদি তাদের বিদআত ও যুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয় তাহলে তারা বলে, এটি মুহকাম ও দৃঢ়বক্তব্য। অতঃপর তারা তা দলীলরূপে গ্রহণ করে। আর যদি তা তাদের বিদআত ও যুক্তির বিপরীত হয় তাহলে তারা বলে, এটি মুতাশাবিহাত ও আবোধগম্য, অতঃপর তারা তা প্রত্যাখ্যান করে……….অথবা মূল অর্থ থেকে পরিবর্তন করে”[21]

দ্বিতীয় বিষয় : কোন জ্ঞান ও ইলম ছাড়াই দ্বীনী বিষয়ে ফাতওয়া দেয়া।

ইমাম শাতিবী রহ. বলেন, “যারা অনিশ্চিত কোন বক্তব্যকে অন্ধভাবে মেনে নেয়ার উপর নির্ভর করে অথবা গ্রহণযোগ্য কোন কারণ ছাড়াই কোন বিষয়কে প্রাধান্য দেয়, তারা প্রকৃত পক্ষে দ্বীনের রজ্জু ছিন্ন করে শরীয়াত বহির্ভূত কাজের সাথে জড়িত থাকে। আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহে এ থেকে আমাদেরকে নিরাপদ রাখুন। ফাতওয়ার এ পদ্ধতি আল্লাহ তা‘আলার দ্বীনের মধ্যে নতুন উদ্ভাবিত বিদআতেরই অন্তর্ভুক্ত, তেমনি ভাবে আকল বা বিবেককে দীনের সর্বক্ষেত্রে Dominator হিসেবে স্থির করা নবউদ্ভাবিত বিদআত।”[22]

দ্বাদশ নীতি :

যে সকল আকীদা কুরআন ও সুন্নায় আসেনি এবং সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের কাছ থেকেও বর্ণিত হয়নি, সেগুলো বিদআতী আকীদা হিসেবে শরীয়তে গণ্য।

উদাহরণ :

১. সুফী তরীকাসমূহের সে সব আকীদা ও বিষয়সমূহ যা কুরআন ও সুন্নায় আসেনি এবং সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের কাছ থেকেও বর্ণিত হয়নি।

ইমাম শাতিবী রহ. বলেন, “তন্মধ্যে রয়েছে এমন সব অলৌকিক বিষয় যা শ্রবণকালে মুরিদদের উপর শিরোধার্য করে দেয়া হয়। আর মুরীদের কর্তব্য হল যা থেকে সে বিমুক্ত হয়েছে পুনরায় পীরের পক্ষ থেকে তা করার অনুমতি ও ইঙ্গিত না পেলে তা না করা…..এভাবে আরো অনেক বিষয় যা তারা আবিষ্কার করেছে, সালাফদের প্রথম যুগে যার কোন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় না।”[23]

২. আল্লাহর যাতী গুণাবলীর ক্ষেত্রে الجهة বা দিক নির্ধারণ, الجسم বা শরীর ইত্যাদি সার্বিকভাবে সাব্যস্ত করা কিংবা পুরোপুরি অস্বীকার করা বিদআত হিসেবে গণ্য। কেননা কুরআন, হাদীস ও সাহাবায়ে কিরামের বক্তব্যের কোথাও এগুলোকে সরাসরি সাব্যস্ত কিংবা অস্বীকার কোনটাই করা হয়নি।

এ সম্পর্কে ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ রহ. বলেন, “সালাফের কেউই আল্লাহর ব্যাপারে الجسم বা শরীর সাব্যস্ত করা কিংবা অস্বীকার করার বিষয়টি সস্পর্কে কোন বক্তব্য প্রদান করেননি। একইভাবে আল্লাহর সম্পর্কে الجواهر বা বস্তু এবং التحيز বা অবস্থান গ্রহণ অথবা অনুরূপ কোন বক্তব্যও তারা দেননি। কেননা এগুলো হলো অস্পষ্ট শব্দ, যদ্‌দ্বারা কোন হক প্রতিষ্ঠিত হয় না এবং বাতিলও প্রমাণিত হয় না।…..বরং এগুলো হচ্ছে সে সকল বিদআতী কালাম ও কথা যা সালাফ ও ইমামগণ প্রত্যাখ্যান করেছেন।”[24]

আল্লাহর সিফাত সম্পর্কিত মুজমাল ও অস্পষ্ট শব্দমালার সাথে সালাফে সালেহীনের অনুসৃত ব্যবহারিক নীতিমালা কী ছিল সে সম্পর্কে ইমাম ইবনু আবিল ইয্‌ আল-হানাফী রহ. বলেন, “যে সকল শব্দ (আল্লাহর ব্যাপারে) সাব্যস্ত করা কিংবা তার থেকে অস্বীকার করার ব্যাপারে নস তথা কুরআন-হাদীসের স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে তা প্রবলভাবে মেনে নেয়া উচিত। অতএব আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম যে সকল শব্দ ও অর্থ সাব্যস্ত করেছেন আমরা সেগুলো সাব্যস্ত করব এবং তাদের বক্তব্যে যে সব শব্দ ও অর্থকে অস্বীকার করা হয়েছে আমরাও সেগুলোকে অস্বীকার করবো। আর যে সব শব্দ অস্বীকার করা কিংবা সাব্যস্ত করার ব্যাপারে কিছুই আসেনি (আল্লাহর ব্যাপারে) সে সব শব্দের ব্যবহার করা যাবে না। অবশ্য যদি বক্তার নিয়তের প্রতি লক্ষ করলে বুঝা যায় যে অর্থ শুদ্ধ, তাহলে তা গ্রহণ করা হবে। তবে সে বক্তব্য কুরআন-হাদীসের শব্দ দিয়েই ব্যক্ত করা বাঞ্ছনীয়, মুজমাল ও অস্পষ্ট শব্দ দিয়ে নয়……..।”[25]

ত্রয়োদশ নীতি

দ্বীনী ব্যাপারে অহেতুক তর্ক, ঝগড়া-বিবাদ ও বাড়াবাড়িপূর্ণ প্রশ্ন বিদআত হিসেবে গণ্য। এ নীতির মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো শামিল:

১। মুতাশাবিহাত বা মানুষের বোধগম্য নয় এমন বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করা। ইমাম মালেক রহ.-কে এক ব্যক্তি আরশের উপর আল্লাহর استواء বা উঠার প্রকৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন “কিরূপ উঠা তা বোধগম্য নয়, তবে استواء বা উঠা একটি জানা ও জ্ঞাত বিষয়, এর প্রতি ঈমান রাখা ওয়াজিব এবং প্রশ্ন করা বিদআত।[26] ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ রহ. বলেন, “কেননা এ প্রশ্নটি ছিল এমন বিষয় সম্পর্কে যা মানুষের জ্ঞাত নয় এবং এর জবাব দেয়াও সম্ভব নয়।”[27] তিনি অন্যত্র বলেন, “ استواء বা আরশের উপর উঠা সম্পর্কে ইমাম মালেকের এ জবাব আল্লাহর সকল গুণাবলী সম্পর্কে ব্যাখ্যা হিসেবে পুরাপুরি যথেষ্ট।”[28]

২। দীনের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন কিছু নিয়ে গোঁড়ামি করা এবং গোঁড়ামির কারণে মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করা বিদআত বলে গণ্য।

৩। মুসলমানদের কাউকে উপযুক্ত দলীল ছাড়া কাফির ও বিদআতী বলে অপবাদ দেয়া।

চতুর্দশ নীতিঃ

দ্বীনের স্থায়ী ও প্রমাণিত অবস্থান ও শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখাকে পরিবর্তন করা বিদআত।

উদাহরণ :

১। চুরি ও ব্যভিচারের শাস্তি পরিবর্তন করে আর্থিক জরিমানা দণ্ড প্রদান করা বিদআত।

২। যিহারের কাফ্‌ফারার ক্ষেত্রে শরীয়াতের নির্ধারিত সীমারেখা পাল্টে আর্থিক জরিমানা করা বিদআত।

পঞ্চদশ নীতি:

অমুসলিমদের সাথে খাস যে সকল প্রথা ও ইবাদাত রয়েছে মুসলিমদের মধ্যে সেগুলোর অনুসরণ বিদআত বলে গণ্য।

উদাহরণ :

কাফিরদের উৎসব ও পর্ব অনুষ্ঠানের অনুকরণে উৎসব ও পর্ব পালন করা। ইমাম যাহাবী রহ. বলেন, “জন্ম উৎসব, নববর্ষ উৎসব পালনের মাধ্যমে অমুসলিমদের অনুকরণ।
সুন্নত ও বেদাত
সুন্নত ও বেদাত পরস্পর বিরোধী। যখন বলা হয় ওমুক কাজটি সুন্নত তখন এর অর্থ হল এটা বেদাত নয়। আর যখন বলা হয় এ কাজ বেদাত তখন এর অপর অর্থ হল যে, এ বস্তুটি সুন্নতের বিপরীত। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত বা সুন্নীদের আকীদা হল রাসূলুল্লাহ (স:) এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর একদিকে অতীতের সকল নবীগণের শরীয়াতসমূহ রহিত হয়ে গিয়েছে। অপর দিকে ভবিষ্যতে কিয়ামত পর্যন্ত নবুওয়াতের দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (স:) এর আগমণের পর শুধু তারই ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে আল্লাহ পাকের পছন্দ ও অপছন্দ জানা যেতে পারে। এ ছাড়া অন্য কোন রাস্তা নেই। রাসূলুল্লাহ (স:) আল্লাহর পক্ষ্য থেকে পছন্দ ও অপছন্দের যে বিধান দিয়েছেন এরই নাম দ্বীন ও শরীয়াত। যার পরিপূর্ণতার ঘোষণা তার ওফাতের তিন মাস পূর্বে আরাফাতের ময়দানে করে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে এ দ্বীন থেকে হ্রাস হতে পারে না, আর না তাতে কিছু সংযোজন করার অবকাশ আছে।
“সন্নত” তরীকা তথা রীতিনীতিকে বলা হয়। কাজেই আকাঈদ (দ্বীনের বিশ্বাস্য বিষয়াবলী), আমল (দ্বীনের কার্যাবলী), আখলাক (চরিত্র), মুআমালাত (লেন-দেন) এবং আদাত (চাল-চলন) এর মধ্যে রাসূলুল্লাহ (স:) এর যে তরীকা গ্রহণ করেছেন তা “সুন্নত” এবং এর বিপরীত হচ্ছে “বেদাত”। রাসূলুল্লাহ (স:) এর তরীকার জ্ঞান কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা আমাদের লাভ হয়।
রাসূলুল্লাহ (স:) তার নিজ সুন্নত এবং খুলাফায়ে রাশেদিনের সুন্নতকে অত্যাবশ্যক রূপে অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন, আর এ কারনেই খুলাফায় রাশেদীনের সুন্নতও রাসূলুল্লাহ (স:) এর সুন্নতের হুকুম রাখে। অধিকন্তু তিনি নিজ সাহাবায়ে কেরামগণের অনেক মর্যাদার কথা বর্ণনা করেছেন। তাদেরকে দ্বীনের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য এবং আমানতদার বলেছেন। এক হাদীসে তিনি এরশাদ করেন, “ আমার সাহাবীগণকে সম্মান কর। কেননা তারা তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম মানুষ। অতপর ঐ সকল ব্যক্তিবর্গ, যারা তাদের পরে আসবে। অতপর ঐ সকল ব্যক্তিগণ, যারা তাদের পরে আসবে। এর পর মিথ্যার প্রকাশ হবে।”
অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, “আমার যে সাহাবী যে কোন স্থানে ওফাত হবে, তিনি কেয়ামত দিবসে লোকদের নেতা ও নূর হয়ে উঠবে।”
এ বিষয়বস্তুটি অনেক হাদীস শরীফের মধ্যে এরশাদ হয়েছে। এদিকে কুরআনে কারীমে সাহাবায় কেরাম (র:) এর জামাতকে “আল-মু’মিনীন” (মুমিন সকল), “খইরা উম্মাত” (শ্রেষ্ঠ উম্মত) এর উপাধী প্রদাণ করত: তাদের অনুসরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর যে ব্যাক্তি তাদের রাস্তা থেকে সরে যাবে, সে ব্যক্তিকে পথভ্রষ্ট সাব্যস্ত করে জাহান্নামী হওয়ার ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। আর অসংখ্য আয়াতে কারীমায় সাহাবায় কেরাম (র:) কে রহমত, “রেদওয়ান” (সন্তোষ) এর সুসংবাদ শুনানো হয়েছে। এ কারণেই সাহাবায় কেরাম (রা:) এর সুন্নতই বস্তুত: রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর পবিত্র সুন্নতের আয়না স্বরূপ। যে কাজ সাহাবায় কেরাম (রা:) সর্বসম্মতভাবে করেছেন কিংবা যে কাজ সর্বসম্মতভাবে ত্যাগ করেছেন তা অকাট্য। আর এ থেকে অবাধ্য হওয়া কারো জন্য জায়েজ নয়। আর যে কাজ কতক সাহাবা (রা:) করেছেন এবং অন্য কেউ এর উপর আপত্তি করেননি, নি:সন্দেহে তা সত্য ও সঠিক হবে। আর এতে কারো দ্বিধা-সন্দেহ করার অবকাশ নেই।
মোটকথা, কোন বস্তুর উপর সাহাবায় কেরাম (র:) এর আমল করার দ্বারা উক্ত কাজটি সুন্নত হওয়ার প্রমাণ। আর যেহেতু রাসূলুল্লাহ (সঃ) তিনটি যুগের লোককে “খইরুল কুরুন” (শ্রেষ্ঠ যুগ) এর লোক বলেছেন অর্থাৎ সাহাবায় কেরাম (রা:), তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীন। এই জন্যেই উক্ত তিন যুগের মধ্যে কোন প্রকার বাধাবিপত্তি ব্যতীত যে বস্তুর উপর মুসলমানগণ আমল করেছেন তা সুন্নতের আওতাধীনে এসে যায়।
“সুন্নাত” এর উপরোক্ত ব্যাখ্যা দ্বারা বিদআত এর মূলতত্ত্ব নিজে নিজেই জ্ঞাত হওয়া যায়। অর্থাৎ যে বস্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ), সাহাবায় কিরাম (র:), তাবেয়ীন এবং তাবে তাবেয়ীন এর যুগে আমল ও প্রচলিত ছিল না, তাক দ্বীনের বিষয় মনে করাকে বেদাত বলা হয়। কিন্তু এর বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য কিছু ব্যাপার বুঝে নেয়া প্রয়োজন।
উপরোল্লিখিত তিন যুগের পর যেসব জিনিস অস্তিত্ব লাভ করেছে তা দু’প্রকার। একটি হলো. যাকে স্বয়ং উদ্দেশ্য বলে মনে করা হয়। দ্বিতীয়টি হলো, যা স্বয়ং মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, বরং কোন শরীয়াতের নির্দেশিত কাজ অর্জন করার উপায় মনে করে তাকে করা হয়ে থাকে। যেমন:
কুরআনে কারীম এবং হাদীসে নববীর মধ্যে দ্বীনের এলেম শিক্ষা করা, শিক্ষা দেয়া এবং নিজে পড়া অন্যকে পড়ানোর অসংখ্য ফযীলত বর্ণিত হয়েছে এবং এর অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এখন এলেম অর্জন করার যেসব মাধ্যম যা রাসূলুল্লাহ (সঃ), সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈন (র:) এর যুগের পরবর্তীতে আবিষ্কার হয়েছে, তাকে গ্রহণ করা বেদাত বলা যাবে না (তবে শর্ত হচ্ছে উক্ত মাধ্যমটি যেন স্বয়ং জায়েজ হয়) কেননা এসব মাধ্যম স্বয়ং মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। বরং তা শরীয়তের আদিষ্ট-এর অর্জনের ওসীলা বা মাধ্যম মাত্র। যেমন জিহাদের জন্য আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র, হজ্জ্বের সফরে আধুনিক যানবাহন ব্যাবহার ইত্যাদি। মোটকথা যেসব বস্তু শরীয়াতের নির্দেশিত কাজ পালনের জন্যে উপায় ও ওসীলার পদমর্যাদা রাখে, তা ব্যাবহার জায়েজ আছে। কিন্তু কোন বস্তুকে স্বয়ং সেই বস্তুকেই দ্বীনের কাজের পদমর্যাদা দিয়ে আবিষ্কার করার নামই বেদাত।
দ্বিতীয়ত : কুরআন-হাদীসে শরীয়তের অনেক মাসআলার মূলনীতি ও কানুনের আকারে বর্ণনা করা হয়েছে। আর মাসআলা উদ্ভাবকগণকে উক্ত মূলনীতি ও কানুনের আলোকে এসব নতুন মাসআলার হুকুম জানার হেদায়েত করা হয়েছে, যা ভাবিষ্যতে প্রকাশ পাবে। সুতরাং আল্লাহ পাক ও তার রাসূলের এ নির্দেশের বাস্তবায়নে দ্বীনের ইমামগণ যেসব মাসআলা কুরআন-হাদীস থেকে বের করেছেন তাকে বেদাত বলা যাবে না। কেননা এসব মাসআলা কুরআন ও হাদীস থেকেই বের করা হয়েছে। ইহাই কারন যে, কুরআন, সুন্নাহ, সাহাবায় কেরাম ও তাবেয়ীগণের আমল ও আইম্মায়ে মুজতাহেদীনের উদ্ভাবিত মাসআলা সমূহকেও দ্বীনের একাংশ মনে করা হয়। আর ইজতিহাদও শরীয়তের দলীলসমুহের মধ্য থেকে একটি পরোক্ষ দলীল।
তৃতীয়ত : যে বিষয়টি কুরআন মাজীদ দ্বারা প্রমাণিত নয়, হাদীসে নববী দ্বারাও নয়, সাহাবায় কেরাম ও তাবেয়ীনগণের আমল দ্বারাও নয় আর না উম্মতে ফকীহগণের ইজতিহাদ দ্বারা সাব্যস্ত হয়, তা শরীয়ত বহির্ভূত বিষয়। এ প্রকার বস্তুকে বুযুর্গের কাশফ ও ইলহাম দ্বারা শরীয়ত এর অন্তর্ভূক্ত করা যাবে না। এমনকি কোন শিক্ষিত ব্যাক্তির কেয়াসের মাধ্যমেও তাকে শরীয়তের অন্তর্গত করা যাবে না। কেননা দ্বীনে শরীয়তের দলীল মাত্র চারটি কুরআন, হাদীস, ইজমা ও মুজতাহিদীনগণের কিয়াস। ইহা ব্যাতিত অন্য কোন বস্তুকে নিজের থেকে শরীয়তের দলীল এর পদমর্যাদায় পেশ করা বেদাত। তাই এর দ্বারা দ্বীনের কোন বস্তু প্রমাণিত করা যাবে না।
চতুর্থত: বিদাত দু’প্রকার। এক ইতিকাদী (বিশ্বাসগত), দুই আমলী (কার্যগত)। ইতিকাদী বেদাত হল, কোন ব্যাক্তি কিংবা দলের এমন বিশ্বাস ও মতবাদ পোষণ করা যা রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবায় কেরাম ও তাবেয়ীনগণ এর বিপরীত হয়। “কতকের অন্ধকার কতক থেকে অধিক” এ মুলনীতির আলোকে বেদাতের অনেক প্রকার হয়। কোনটি স্পষ্ট কুফর। যেমন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর পরেও নবুওয়াতের দরজা খোলা আছে কাদিয়ানীদের এই বেদাত। কিংবা হযরত ঈসা (আ:) মৃত্যবরণ করেছেন ইত্যাদি। আর কিছু বেদাত কুফর নয় তবে পথভ্রষ্টতা বলা যায়। আর আমলী বেদাত হল, আকীদায় ঠিক আছে তবে কোন কোন আমল এমন গ্রহণ করা যা সলফে সালেহীন থেকে বর্ণিত হয়নি।
পঞ্চমত : রাসূলুল্লাহ (সঃ) বেদাতকে যতখানি তিরষ্কার করেছেন সম্ভবত কুফর আর শেরক এর পরে অন্য কোন কিছুকে এতটা তিরষ্কার করেননি। বেদাতকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) মরদূদ (রহমত থেকে বঞ্চিত), মালউন (অভিশপ্ত), এবং পথভ্রষ্টতা বলেছেন। এ থেকেই ‍অনুমান করা যায় যে, যে ব্যক্তি বেদাত আবিষ্কার করে কিংবা এতে জড়িত হয় সে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর দৃষ্টিতে কি পরিমাণ অপদস্থ ব্যক্তি। এক হাদীসে এরশাদ হয়েছে : “ তার কোন ফরয ও নফল ইবাদত আল্লাহ পাকের মহান দরবারে গৃহত নয়।”
অন্য এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল বলেন, “ যে ব্যক্তি কোন বেদাতীকে সম্মান করল, সে ইসলামকে ধ্বংস করতে সহায়তা করল।”
অন্য এক হাদীসে এসেছে, “ যে ব্যক্তি ‘আল-জামাত’ থেকে অর্ধ হাত পরিমাণ দূরে সরে গেছে সে যেন ইসলামের জোয়াল কাধ থেকে নামিয়ে দূরে নিক্ষেপ করে দিল। (মেশকাত)।
এ সকল হাদীস থেকেই অনুমান করা যায় য, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বাহ্যিক সামান্যতম বেদাতকে কি পরিমাণ ঘৃণা করেছেন। এখন কথা হল বেদাত এত ঘৃনিত কেন ? সম্মানিত উলামায় ইযাম (র:) গন এ প্রশ্নের জবাবে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এখানে তার সংক্ষিপ্ত কিছু কারণ তুলে ধরা হল।
প্রথমত : দ্বীন ইসলামের পরিপূর্ণতা রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর মাধ্যমে হয়ে গেছে। আর সেসব বিষয় যা দ্বারা আল্লাহ পাকের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, তা রাসূলুল্লাহ (সঃ) বর্ণনা করে দিয়েছেন। এখন যে ব্যক্তি দ্বীনের নামে কোন বেদাত স্থাপন করে লোকদেরকে সে দিকে আহবান করে, সে যেন এই দাবী করল যে, হযরত মুহাম্মদ (স:) এর দ্বীন অসম্পূর্ণ (নাউযুবিল্লাহ)। আর আল্লাহ পাকের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের যে রাস্তা এই বোকা বুঝেছে, তা রাসূলুল্লাহ (সঃ) ও জানতেন না (নাউযুবিল্লাহ)। কিংবা সে ইহা বলতে চায় যে, শরীয়তের যে জ্ঞান এবং আল্লাহ পাকের উদ্দেশ্যের অনুভূতি এ বিদাতীর হয়েছে তা রাসুলুল্লাহ (স:), সাহাবায় কিরাম এবং তাবেঈনগণের হয়নি।(নাউযুবিল্লাহ মিন যালিক)।
মোটকথা : যে কাজটি রাসুলুল্লাহ (স:), সাহাবায় কেরাম (র:) এবং তাবেঈনগণ (র:) করেননি বর্তমানে যদি কোন ব্যাক্তি উক্ত কাজটিকে ইবাদত এবং দ্বীনের কাজ বলে মনে করে, তাহলে সে না কেবল সলফে সালেহীনদের উপর বরং রাসুলুল্লাহ (স:) এর আনীত দ্বীনের উপর আক্রমন করেছে। সুতরাং এরূপ ব্যাক্তির অভিশপ্ত হওয়ার ব্যাপারে কি সন্দেহ রয়েছে ?
দ্বিতীয়ত : বিদয়া’ত ব্যতীত মানুষ যে গুনাহের কাজই করে সে উপলব্ধি করে যে, সে গুনাহ এর কাজ করছে, ফলে সে এ গুনাহে লজ্জিত হয় এবং পরে তওবা করে নেয়। কিন্তু বেদাত এমন জঘন্য গুনাহ যে, গুনাহকারী তা ভুলক্রমে হয়ে গেছে বলে মনে করে না, বরং সওয়াবের কাজই মনে করে থাকে। আর শয়তান এ গুনাহকে এমন সুন্দররূপে তার দৃষ্টির সামনে তুলে ধরে, যার ফলে তার ভুলনীতির বিষয়টি অনুভূতি পর্যন্ত হতে পারে না। ফলে মৃত্যু পর্যন্ত তওবা করা থেকে বঞ্চিত থাকে। এ কারনেই বড় বড় পাপীদের তওবা ভাগ্যে জুটে, কিন্তু বেদাতে আক্রান্ত রোগী কখনো আরোগ্য লাভ করে না। হ্যা, যদি আল্লাহ পাকের বিশেষ রহমত তাকে সাহায্য করে এবং তার পাপ তার সামনে প্রকাশ পেয়ে যায় তবে হয়ত তওবা নসীব হতে পারে।
তৃতীয়ত : বেদাতের অমঙ্গল ও অন্ধকার মানুষকে সুন্নতের নূর থেকে বঞ্চিত করে দেয়। রাসুলুল্লাহ (স:) এরশাদ করেছেন, “ যখন কোন জাতি বেদাত আবিষ্কার করে, তবে এ প্রকারের সুন্নত তাদের থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়। এ জন্য ছোট থেকে ছোট সুন্নতের উপর আমল করা বাহ্যিক ভাল থেকে ভাল বেদাত আবিষ্কার করার চাইতে আনেক উত্তম।”
অপর এক রেওয়াতে বর্ণিত হয়েছে “ যদি কোন জাতি স্বীয় দ্বীনের মধ্যে কোন বেদাত স্থাপন করে, তবে আল্লাহ পাক সে পরিমাণ সুন্নত তাদের থেকে ছিনিয়ে নেন এবং পরে কিয়ামত পর্যন্ত সে সুন্নত তাদের নিকট আর ফিরিয়ে দেন না।”
আর সুন্নত থেকে বঞ্চিত হবার কারণ হল, বেদাতে লিপ্ত হওয়ার দরুন তার অন্তর থেকে উজ্জ্ব্যল্যতা এবং যোগ্যতা দূর হয়ে যায়। তখন মানুষ সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। এর উপমা সেই অপারদর্শী আহমকের মত, যাকে কোন প্রতারক টাকা ভাঙ্গানোর নামে জাল নোটের বান্ডেল দিয়ে আসল নোট নিয়ে গেছে। সে বোকা আনন্দে আত্মহারা; একের পরিবর্তে শত শত নোট পেয়েছে। কিন্তু এ আনন্দ ততক্ষণ পর্যন্তই থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত সে বাজারে না যাবে। বাজারে গেলেই মূল্যহীন কাগজের টুকরোগুলোর প্রকৃত অবস্থা জানতে পারবে। শুধু তাই নয় বরং এ জাল নোট বহনের দায়ে হাতে হতকড়িও লেগে যাবে।
ভালভাবে জেনে রাখুন, আখেরাতের বাজারে কেবল রাসুলুল্লাহ (স:) এর সুন্নতের মুদ্রাই চলবে। যারা বেদাতের জাল মুদ্রার স্তুপ গ্রহণ করেছে আখিরাতে এর এক কড়ির মূল্যও হবে না; বরং মুহাম্মদী মুদ্রার বিপরীত জাল মুদ্র তৈরী এবং রাখার দায়ে জেলখানায় আবদ্ধ করা হবে। রাসুলুল্লাহ (স:) এরশাদ করেছেন, “ আমি তোমাদের পূর্বেই হাউযে কাওসারের পা‍র্শে উপস্থিত থাকব। যে ব্যাক্তি আমার নিকটে আসবে সে হাউযে কাউসার থেকে পানি পান করবে। যে একবার পান করবে সে কখনোই তৃষ্ণার্ত হবে না। কিছু সংখ্যক লোক সেখানে আসবে। আমি তাদের চিনব। তারাও আমাকে চিনবে। কিন্তু আমার ও তাদের মাঝে বাধার সৃষ্টি করে দেয়া হবে। আমি বলব, তারাতো আমার লোক। আমাকে জানানো হবে, আপনি জানেন না যে, আপনার পরে তারা কি কি বেদাত আবিষ্কার করেছিল। এ জবাব শুনে আমি বলব- “দূর হোক, দূর হোক ‍সেসব লোক, যারা আমার পরে আমার তরীকাকে পরিবর্তন করেছিল”।
এ হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয়ে যে, যারা রাসুলুল্লাহ (স:) এর সুন্নতকে ত্যাগ করে নতুন নতুন বেদাত আবিষ্কার করেছে, তারা কেয়ামতের দিন হাউযে কাওসারের পানী থেকে বঞ্চিত হবে। এর চেয়ে জঘন্য দুর্ভাগ্য আর কি হবে? এ কারনেই উম্মতের বড় বড় বুযুর্গগণের বেদাতের প্রতি অত্যন্ত ঘৃনা ছিল। ইমাম গাযালী (র:) তার ‘উমুরে আদীয়া’ কিতাবে সুন্নতের অনুসরণ এবং সুন্নতের অনুকরণ অনুকরণ করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করে লিখেন- “ যা কিছু আমি বর্ণনা করছি তা স্বভাবগত কার্যাবলীর মধ্যে সুন্নতের দিকে উৎহিত করার জন্য বর্ণনা করলাম। যেসব কার্যাবলী ইবাদতের সঙ্গে সম্পর্কিত তার প্রতিদান এবং সওয়াবের কথা বলা হয়েছে, তন্মধ্যে উযরে সুন্নতের অনুসরণ পরিত্যাগ করা গোপনীয় কুফর এবং স্পষ্ট বোকামী ছাড়া আর কিছুই কারণ হতে পারে না।
হযরত মুজাদ্দীদে আলফে সানী (রহ:) লিখেছেন, “ বান্দা আল্লাহ পাকের নিকট অনুনয় ও বিনয়, কাতরতা ও প্রার্থনা, অপমান ও বশ্যতার সঙ্গে গোপনে ও প্রকাশ্যে আরয করছি, দ্বীনের মধ্যে যেসব নতুন আবিষ্কার করা হয়েছে এবং যে বেদাত তৈরী করা হয়েছে, যা খায়রুল বাশার রাসুলুল্লাহ (স:) এবং খুলাফায় রাশেদীন (রা:) এর যুগে ‍ছিল না, যদিও সেগুলো আলোর দিক দিয়ে প্রভাতের ন্যায় উজ্জ্বল হয়; তবেও আল্লাহ পাক এ দুর্বল অধমকে এবং আমার সম্পর্কশীলদেরকে এ নব অবিষ্কৃত কাজে যেন জড়িত না করেন এবং এর বাহ্যিক সৌন্দর্যে যেন আসক্ত না করেন। রাসুলুল্লাহ (স:) ফয়েজ ও বরকতে।” (দফতরে আওয়াল, মাকতুবাত - 186)। প্রত্যেক মুসলমানকেই সহীহ আমল করতে হলে মুজাদ্দেদ আলফে সানী (র:) এর এ দুআয় শামীল হতে হবে।
চতুর্থত : রাসুলুল্লাহ (স:) এর উপরোল্লিখিত এরশাদ সুহকান, সুহকান (দূর হোক দূর হোক সেসব লোকেরা যারা আমার পরে আমার তরীকাকে পরিবর্তন করে দিয়েছে) থেকে বেদাত এর ঘৃনিত হওয়ার অপর একটি কারনও জানা গেল যে, বেদাত দ্বারা দ্বীনের মধ্যে তাহরীফ ও পরিবর্তন অপরিহার্যভাবে এসে যায়। এর ব্যাখ্যা হচ্ছে যে, আল্লাহ পাক এ দ্বীনকে কেয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী রাখার জন্যে অবতীর্ণ করেছেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মানুষকে গ্রহণ করার জন্যে অত্যাবশ্যক করে দিয়েছেন। আর এ কর্তব্য ঐ সময় পর্যন্ত বলবৎ থাকবে যতক্ষণ এ দ্বীনের প্রকৃত আকৃতি যথাযথভাবে সংরক্ষিতও থাকবে। যেভাবে পূর্বেকার ধর্ম মানুষের মতবাদ ও পৃবৃত্তির অভিলাষে পড়ে কদাকৃতিতে রূপান্তর হয়ে গেছে এবং তার বৈশিষ্ট পরিবর্তন হয়ে গেছে। এ দ্বীনের উপরও যেন সে প্রকার বিপদ না আসে।
সুতরাং যারা বেদাত আবিষ্কার করে, তারা প্রকৃতপক্ষে ইসলামের রূপকে কদাকৃতি করে দেয় এবং দ্বীনের মধ্যে পরিবর্তনের রাস্তা খুলে দেয়। যেহেতু আল্লাহ পাক এ দ্বীনের সংরক্ষণের ওয়াদা করেছেন, সেহেতু তিনি নিজ দয়ায় নিজেই এ ব্যাবস্থা করেছেন যে, প্রতি যুগে যুগে দ্বীনকে মানুষের অভিলাষের সংমিশ্রণ ও বেদাতের ভেজাল থেকে যেন পবিত্র থাকে। বেদাতীরা যখনই দ্বীনের সুন্দর অবয়বের উপর বেদাতরূপে আবর্জনা ফেলার চেষ্টা করে, তখনই উলামায় ইযামের একটি জামাত তৎক্ষনাৎ তাকে ঘয়ে মুছে পরিষ্কার করে দেয়। রাসুলুল্লাহ (স:) এরশাদ করেছেন, “ ভবিষ্যত উম্মতের মধ্যে এই এলেমের বাহক এমন সব ন্যয়পরায়ণ ব্যক্তি জন্ম নিবে, যারা সীমা অতিক্রমকারীদের পরিবর্তন, বাতিল পন্থিদের ভুল দাবী এবং মুর্খদের ব্যাখ্যাবলীকে নিরীক্ষণের মাধ্যমে পরিষ্কার করে দিবেন।
আলহামদুলিল্লাহ, এ কারনেই ইহার তো প্রশান্তি রয়েছে যে, বাতিলপন্থিরা এ দ্বীনের সুন্দর চেহারাকে পরিবর্তন করতে কখনো সক্ষম হবে না। কেননা আল্লাহ পাক স্বয়ং এর কর্মের নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অধিকন্তু এতেও সন্দেহ নেই যে, যেসব লোক নতুন নতুন জিনিস এবং বেদাত আবিষ্কার করে, তারা না কেবল নিজেদের ভাগ্যকে মন্দ থেকে মন্দতর করে চলেছে; বরং অনেক অজ্ঞ লোকদেরকেও পথভ্রষ্ট করছে।
এখন প্রশ্ন হল, সেসব লোক দ্বীনের মধ্যে নতুন নতুন বস্তু আবিষ্কার করছে কেন ? এবং আল্লাহ পাকের ভয় তাদেরকে বাধা দিচ্ছে না কেন ? ইহা বুঝার জন্য বেদাত আবিষ্কারের কারণসমূহ এবং চলচ্ছক্তির সংক্ষেপে আলোচনা করতে হবে।
প্রথমত : বেদাত আবিষ্কারের প্রথম করণ হল মুর্খতা। এর ব্যাখ্যা হল এই যে, বেদাতের মধ্যে একটি বাহ্যিক ও লৌকিক সৌন্দর্য রয়েছে। মানুষ এর বাহ্যিক আকার-আকৃতি দেখে ইহার উপর আসক্ত হয়ে পড়ে। আর প্রবৃত্তি এই ব্যাখ্যা বুঝিয়ে দেয় যে, ইহাতো খুব‌ই ভাল বস্তু। শরীয়তে এর নিষেধাজ্ঞা কিভাবে হতে পারে? কাজেই তার বাহ্যিক সৌন্দর্য এবং নিজের পছন্দকে মাপকাঠি করে মানুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়। আর এর অভ্যন্তরের যেসব মন্দাবলী এবং অনিষ্টসমূহ নিহিত রয়েছে সে দিকে তার দৃষ্টি ‍যায় না। এর উদাহরণ এমন যে, কোন একজন বিশ্রী কুষ্ঠরোগীকে ভাল পোষাক পরিয়ে ছেড়ে দেয়া হলে তার আভ্যন্তরীন অবস্থা সম্পর্কে যারা অনবহিত তারা সুন্দর পোষাক দেখেই তাকে জান্নাতের হুর বলে ধারনা করবে এবং দূর থেকেই তার ‍সৌন্দর্যের আশিক হযে যাবে। সাধারন জনসাধারনের দৃষ্টি বাহ্যিকতার উপরেই সীমাবদ্ধ থাকে। এ কারনেই তারা নবীর সুন্নতের প্রতি তত আশিক হয় না যতটুকু বেদাত এবং অনর্থক কাজে আসক্ত হয়। আর যারা জনসাধারণের আধ্যাত্মিক দুর্বলতা সম্পর্কে খবর রাখে তারা তাদেরকে নব আবিষ্কৃত বেদাতের জন্য তৈরী শিকার বলে বিবেচনা করে।
দ্বিতীয়ত : শয়তানের কাজই হল মিথ্যাকে সত্যরূপে প্রকাশ করা। আপনি জানেন যে, রাসুলুল্লাহ (স:) এর দ্বীন, তার সুন্নত এবং তার পবিত্র তরীকার সঙ্গে শয়তানের সবচেয়ে অধিক শত্রুতা রয়েছে। সে জানে যে, আদম (আ:) এর সন্তান-সন্ততিদের জান্নাতে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা হল এটিই। সে ইহা দেখে অনেক কষ্ট ও চরম চেষ্টার মাধ্যমে মানুষকে প্রলোভিত করে, তাদের দ্বারা পাপ কার্য করায়। এ পাপের কাটা তাদের অন্তর থেকে কোনভাবেই বের হয় না। যদি সে একবার আল্লাহ পাকের দরবারে উপস্থিত হয়ে সত্যিকারের তওবা করে নেয়, তখন শয়তানের সকল চেষ্টা ব্যার্থ হয়ে যায়্। তাই তওবা ও ইসতিগফার শয়তানের কোমর ভেঙ্গে দেয়। তাই বড় বড় পাপ করানোর পরও মানব সন্তান সম্বন্ধে তার ভয় থাকে যে, সে তওবা করে ফেলে কিনা। আর এ কারনেই শয়তান মানুষকে গোমরাহ করার জন্যে বেদাত এর এক ভয়-বিপদহীন রাস্তা আবিষ্কার করেছে, যা থেকে মানুষের কখনোই তওবার তওফিক হয় না। 
 
 
 

1 টি মন্তব্য: