মুফতি রফিকুল ইসলাম আল-মাদানী
ভারতবর্ষের গাইরে মুক্বাল্লিদ্ ও পৃথিবীর অন্যান্য গাইরে মুক্বাল্লিদ্দের মধ্যে যোগসূত্রঃ
১।
তৃতীয় শতাব্দীর শুরু লগ্নে ২০২ হিজরীতে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস দাউদে যাহেরীর (রহঃ) জন্ম। তিনি শরীয়তের সকল পর্যায়ে কিয়াস বর্জন করে কেবল কুরআন-হাদীসের প্রত্যক্ষ ও যাহেরী অর্থের ভিত্তিতে চলার মতবাদ রচনা করেন। তাঁর মতে ক্বিয়াস শরীয়তের কোন দলীল হতে পারে না। যদিও এ ক্বিয়াস কোরআন-হাদীসের আলোকে এবং কোন বিষয়ে কুরআন-হাদীসের স্পষ্ট উক্তি না থাকা সত্ত্বেই হোক না কেন! এ জন্যই তাকে দাউদে যাহেরী বা “ প্রত্যক্ষদর্শী ” এবং তাঁর অনুসারীদেরকে যাহেরিয়া বলা হয়।
( মু’জামুল মুয়াল্লিফিন, উমর রেজাঃ পৃ-১/৭০০ জীবনী নং-৫২৪০ ও আল-আলম খাইরুদ্দীনঃ পৃ-২/৩৩৩ )
২।
চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ৩৮৪ হিজরীতে আল্লামা ইবনে হাযাম যাহেরীর (রহঃ) জন্ম হয়। তিনি প্রথমে ছিলেন শাফেয়ী মায্হাবের অনুসারী। পরবর্তীতে তিনি দাউদে যাহেরীর মায্হাব অবলম্বন করেন এবং এক পর্যায়ে সকল মায্হাব ত্যাগ করে তাক্বলীদ্কে হারাম বলতে আরম্ভ করেন। এমনকি মুজতাদিহ ইমামগণকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও লাগামহীনভাবে তাদের প্রতি কটুক্তি করতে থাকেন। তার এ বাড়াবাড়ির অসংখ্য নযীর তার রচনাবলীতে বিদ্যমান রয়েছে।
৩।
হিজরী ৮ম শতাব্দীর ইমাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ) (মৃতঃ ৭২৮ হিজরী) ও হাফেজ ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রহঃ) (মৃতঃ ৭৫১ হিঃ) হাম্বলী মায্হাবের অন্যতম অনুসারী ছিলেন। তবে কিছু কিছু ইজতেহাদী বিষয়ে তাদের ব্যতিক্রমধর্মী মতামত তথা যাহেরিয়াদের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা ছিল।
এ কারণেই আল্লামা ইবনে বতুতা (রহঃ) ইবনে তাইমিয়্যা সম্বন্ধে লিখেনঃ
“ ইবনে তাইমিয়্যা বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতার সাথে আলোচনা করেন, তবে তার মাথায় কিছু ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তা-চেতনাও রয়েছে। ”
( তুহ্ফাতুন নাজ্জার থেকে মাওলানা ইসমাইল সাম্বলী প্রনীত তাক্বলীদে আইম্মাঃ পৃ-৫৩ )
এবং হাফেজ যাহাবী (রহঃ) ইবনুল ক্বাইয়্যিম সম্বন্ধে লিখেনঃ
“ তিনি নিজস্ব মতেই আত্নতৃপ্ত। মাথায় কিছু বৈচিত্র্য রয়েছে, যার ফলে গর্হিত অনেক কিছু প্রকাশ পেয়েছে। ”
( আলমু’জাম থেকে তাক্বলীদে আইম্মাঃ পৃ-৫৪ )
৪।
দ্বাদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত আলিম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহ্হাব নজদী (রহঃ) (মৃতঃ ১২০৬ হিঃ) মূলত হাম্বলী মায্হাবেরই মুক্বাল্লিদ্ ছিলেন। তৎকালীন আরবে বিশেষত নজ্দে শিরক্, বিদয়া’ত, কবরপূজা, মাযারপূজা, গাছপূজা, আগুনপূজা ও প্রতিমা-মানব ইত্যাদি পূজা-উপাসনার মোকাবিলা ও প্রতিরোধে তার কার্যকরী, সাহসী ও বীরবিক্রম পদক্ষেপ আসলেও গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসার দাবী রাখে। তাঁরই অবদানে তদানীন্তন আরব মধ্যযুগীয় বর্বরতা, সীমাহীন ভ্রষ্টতা ও শিরক কুফরের অতুলনীয় অন্ধকারাচ্ছন্নতা থেকে রেহাই পেয়েছে।
তবে অনেক বিষয়ে নিষ্প্রয়োজনীয় বাড়াবাড়ির ফলে তাঁর সঙ্গে তদানীন্তন সউদী আলেম উলামাদের মহামতানৈক্য সৃষ্টি হয়। তিনিই মহানবী (সঃ) এর রওজার উপর বিস্তৃত গম্বুজটি ভেঙ্গে দেয়ার পরিকল্পনা করেন এবং ভিন্ন মতাবল্মীদেরকে পবিত্র হজ্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন ও তাদেরকে কাফির, মুশরিক ইত্যাদি জঘন্যতম আখ্যায় আখ্যায়িত করতে থাকেন। ফলে ভয়াবহ ফিৎনা-ফাসাদ ও বিশ্ব মুসলিম সমাজে পারস্পরিক কোন্দলের সূচনা হয়। পক্ষান্তরে যারা তার মতবাদের তাক্বলীদ করতে থাকে তাদেরকে মুসলমানগণ ওহ্হাবী বলে আখ্যায়িত করতে থাকেন। এদিকে ভারতবর্ষের লা-মায্হাবীরাও যেহেতু নিছক ঝগড়া-বিবাদ ও মুসলমানদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হিসেবে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহ্হাব নজদীর অন্তঃসারশূণ্য বিচিত্র মতবাদ গ্রহণ করে যেত, তাই তাদেরকেও মুসলমানগণ ওহ্হাবী বলে আখ্যায়িত করতে থাকেন। আর তারা নিজেদেরকে মুহাম্মদী বা আহলে হাদীস বলে প্রচারের চেষ্টায় মেতে উঠে।
৫।
এ ধারার শেষ ব্যক্তি ক্বাযী শাওকানী (রহঃ) (মৃতঃ ১২৫৫ হিজরী) মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহ্হাব নজদীরই সমসাময়িক ছিলেন। তিনি প্রথমতঃ ছিলেন শিয়া মতালম্বী। তার রচনাবলী প্রায়ই পরস্পর বিরোধপূর্ণ ও নিরপেক্ষতাহীন মতামতে ভরপুর।
দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যেতে পারে হানাফী মায্হাব অনুযায়ী “ বিতর ” নামায্ ওয়াজীব। এ মতামত খন্ডন করার জন্য ইমাম শাওকানী হাদীসে মুয়া’য্ (রঃ) পেশ করেছেন, যাতে বলা হয়েছে যে, “ আল্লাহপাক রাত্র দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামায্ ওয়াজিব্ তথা ফরয করেছেন ” এ ছাড়াও তিনি হাদীসে আ’রাবী পেশ করেছেন, যাতে মহানবী (সঃ) গ্রাম্য লোকটিকে মাত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামায্ আদায় করতে বলায় তিনি প্রশ্ন করেন যে আমার উপর এ ছাড়া কি আর কোন নামায্ আছে? তদুত্তরে মহানবী (সঃ) ইরশাদ করেন “ না, এ ছাড়া সমস্তই নফল। ”
এ হাদীস দু’টির মাধ্যমে শাওকানী সাহেব প্রমাণ করেন যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামায্ ব্যতীত আর কোন নামায্ই ওয়াজিব বা ফরয নয়। তাই “ বিতর ” নামায্ও পাঁচ ওয়াক্তের বহির্ভূত বিধায় ওয়াজিব হতে পারে না বরং নফল নামাযেরই অন্তর্ভূক্ত।
( নাইলুল আওতারঃ পৃ – ৩/৩১ )
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপ ও হাস্যকর বিষয় হল যে, তিনি মাত্র এর কয়েক পৃষ্ঠা পরই “ তাহিয়্যাতুল মসজিদ ” নামাযের বর্ণনায় উপরোক্ত হাদীসগুলো দৃষ্টিগোচর করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের বহির্ভূত “ তাহিয়্যাতুল মসজিদ ” নামায্কে ওয়াজিব প্রমাণের ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। অথচ তিনি নিজেও “ তাহিয়্যাতুল মসজিদ ” সুন্নত হওয়ার পক্ষে সকল উলামায়ে কিরামের ইজ্মা (সর্বসম্মত রায়) নকল করেছেন।
( নাইলুল আওতারঃ পৃ – ৩/৬৮ )
সুতরাং তার এ ধরণের কর্মকাণ্ড পক্ষপাতিত্ব, অনিরপেক্ষতা ও নিছক গোঁড়ামি বৈ আর কি?
৬।
হিন্দুস্তানে ইসলাম আগমনের সূচনা থেকেই মুসলমানগণ হানাফী মায্হাবের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ইংরেজ হুকুমাত প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালেও মুসলমানদের মধ্যে কোন ধর্মীয় মতানৈক্য ছিল না। অবশেষে হিজরী ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এমন কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটে যারা দাউদে যাহেরী, ইবনে হাযাম, ইবনে তাইমিয়্যাহ, মুহাঃ ইবনে আব্দুল ওহ্হাব নযদী ও ক্বাজী শাওকানীর কেবল বৈচিত্র্যময় ও সমস্ত মুসলমানদের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ এবং হানাফী মায্হাব ও অন্যান্য মায্হাব অবলম্বীদের সঙ্গে মতানৈক্য অযথা বিরুদ্ধাচরণ, অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ ও তাদেরকে নির্মূল করার গভীর ষড়যন্ত্রে মরিয়া হয়ে উঠে। বিশেষ করে ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) ও হানাফীদেরকে কাফির, মুশরিক, মুনাফিক, কবরপূজারী ইত্যাদি শব্দে অপবাদ দেয়া যেন তাদের ঠিকাদারী ও নিত্য নৈমিত্তিক ব্যবসায় পরিণত হয়।
( আল্লাহ এ ধরণের অপবাদ রটানোর মত সমস্ত হারাম কাজ থেকে মুসলমানদের হেফাযত করুন এবং সবাইওকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন !)
৭।
উল্লেখ্য যে, ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ, ইবনুল ক্বাইয়্যিম ও মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহ্হাব (রহঃ) ছিলেন সমকালীন ইসলামী চিন্তাবিদ, যুগশ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ ও অসংখ্য মূল্যবান গ্রন্থের প্রণেতা। সাথে সাথে তাঁরা ছিলেন হাম্বলী মাযহাবের মুক্বাল্লিদ ও অনুসারী। যদিও তাদের মধ্যে কিছু বিতর্কিত বিষয়ও ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান গাইরে মুক্বাল্লিদ্রা তাদের গুণগত বিষয়গুলো উপেক্ষা করে কেবল বিতর্কিত বিষয়গুলো অবলম্বন করতঃ মুসলমানদের মধ্যে ফিৎনা-ফাসাদ ও মতানৈক্যের যোগান দিচ্ছে। এমনিভাবে তাদের সীমিত জ্ঞানে হানাফীদের বিশেষ করে দেওবন্দী উলামায়ে কিরামের মধ্যে ব্যতিক্রম কিছু উপলব্ধি করতে পারলেই অতিরঞ্জিত ও অপব্যাখ্যার মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। ইবনে তাইমিয়্যার পুরো জীবনই ছিল জিহাদী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ। তাতারীদের মোকাবিলায় জিহাদ করে তিনি কারাবরণও করেছেন। কিন্তু বর্তমান যুগে গাইরে মুক্বাল্লিদ হিসেবে যারা পরিচিত, আহলে হাদীস আন্দোলন নামে যারা বই লিখছে তাদের কেউ জিহাদে অংশ নিয়েছে বা কারাবরণ করেছে এমন নযীর কি এদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে? বরং তারা সর্বদা জালিম সরকার আর নাস্তিকদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে এবং তাদের সঙ্গে আঁতাত করে আপন স্বার্থ উদ্ধারের অবলম্বন করে চলছে। ভারতবর্ষে মুসলমানদের চিরশত্রু জালিম সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ সরকার ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদ অবৈধ প্রমাণের অপচেষ্টায় “ আল-ইক্বতেছাদ-ফী মাসাইলিল জিহাদ ” নামক অমূলক গ্রন্থ লিখার মুচলেকা ও চুক্তিপত্র গাইরে মুক্বাল্লিদ্ আলিম মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভীর মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছিল। হিন্দুস্তানে মুসলিম ও নাস্তিকদের মাঝে তো যুদ্ধ-জিহাদ বরাবরই চলে আসছে। বাংলাদেশেও কাদিয়ানী, বেরলভী, এন,জি,ও এবং বিভিন্ন ফিৎনা ফাসাদ ও নাস্তিকতার বিরুদ্ধে প্রায়ই জিহাদী আন্দোলন হয়ে থাকে। এতে কোন গাইরে মুক্বাল্লিদের নাম মাত্র ভূমিকা কি ছিল? বা আছে? এ সকল প্রশ্নের জবাব একটাই, আর তা হল “ না ”। অনুরূপভাবে তামাম বিশ্বের ইয়াহুদী খৃষ্টানরা যখন আফগান, ফিলিস্তিন, ইরাক তথা সমগ্র দুনিয়ার মুসলমানদের উপর বে-নযীর নির্যাতন আর মুসলিম নিধনের গভীর ষড়যন্ত্রে মরিয়া হয়ে উঠেছে তখন ইবনে তাইমিয়্যার তথাকথিত অন্যসারী গাইরে মুক্বাল্লিদ্দের ভূমিকা রহস্যজনক; বরং, তারা এবং তাদের ঠাকুরগণ ও তাদের ভক্তবৃন্দরা সম্ভাব্য সকল উপায়ে হানাদারদেরকে স্বাগত জানাচ্ছে, সহযোগিতা করছে। এ দেশে মিশনের নামে আমাদের ঈমান-আক্বীদা ঠিক করা তথা আমাদেরকে মুসলমান বানানোর অভিনয় করছে। অথচ জিহাদ করা আহলে হক্বের একটি পরিচয়। কুরআন-হাদীসের অসংখ্য স্থানে জিহাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাহলে কি গাইরে মুক্বাল্লিদরা জিহাদ থেকে গা ঢাকা দিয়ে ইবনে তাইমিয়্যার অনুসারী ও আহলে হক্বের দাবীর অনধিকার চর্চার স্পর্ধা দেখাচ্ছে না? সাথে সাথে আরও ভাবনার বিষয় যে, তাদের বই-পুস্তকের শিরোনাম “ আহলে হাদীস আন্দোলন ” মানে কোন্ আন্দোলন? মুক্তির আন্দোলন? নাকি সরলমনা মুসলমানদেরকে বিপথগামী ও ভ্রষ্ট করার আন্দোলন?
ভারতবর্ষের গাইরে মুক্বাল্লিদ্ ও পৃথিবীর অন্যান্য গাইরে মুক্বাল্লিদ্দের মধ্যে যোগসূত্রঃ
১।
তৃতীয় শতাব্দীর শুরু লগ্নে ২০২ হিজরীতে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস দাউদে যাহেরীর (রহঃ) জন্ম। তিনি শরীয়তের সকল পর্যায়ে কিয়াস বর্জন করে কেবল কুরআন-হাদীসের প্রত্যক্ষ ও যাহেরী অর্থের ভিত্তিতে চলার মতবাদ রচনা করেন। তাঁর মতে ক্বিয়াস শরীয়তের কোন দলীল হতে পারে না। যদিও এ ক্বিয়াস কোরআন-হাদীসের আলোকে এবং কোন বিষয়ে কুরআন-হাদীসের স্পষ্ট উক্তি না থাকা সত্ত্বেই হোক না কেন! এ জন্যই তাকে দাউদে যাহেরী বা “ প্রত্যক্ষদর্শী ” এবং তাঁর অনুসারীদেরকে যাহেরিয়া বলা হয়।
( মু’জামুল মুয়াল্লিফিন, উমর রেজাঃ পৃ-১/৭০০ জীবনী নং-৫২৪০ ও আল-আলম খাইরুদ্দীনঃ পৃ-২/৩৩৩ )
২।
চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ৩৮৪ হিজরীতে আল্লামা ইবনে হাযাম যাহেরীর (রহঃ) জন্ম হয়। তিনি প্রথমে ছিলেন শাফেয়ী মায্হাবের অনুসারী। পরবর্তীতে তিনি দাউদে যাহেরীর মায্হাব অবলম্বন করেন এবং এক পর্যায়ে সকল মায্হাব ত্যাগ করে তাক্বলীদ্কে হারাম বলতে আরম্ভ করেন। এমনকি মুজতাদিহ ইমামগণকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও লাগামহীনভাবে তাদের প্রতি কটুক্তি করতে থাকেন। তার এ বাড়াবাড়ির অসংখ্য নযীর তার রচনাবলীতে বিদ্যমান রয়েছে।
৩।
হিজরী ৮ম শতাব্দীর ইমাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ) (মৃতঃ ৭২৮ হিজরী) ও হাফেজ ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রহঃ) (মৃতঃ ৭৫১ হিঃ) হাম্বলী মায্হাবের অন্যতম অনুসারী ছিলেন। তবে কিছু কিছু ইজতেহাদী বিষয়ে তাদের ব্যতিক্রমধর্মী মতামত তথা যাহেরিয়াদের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা ছিল।
এ কারণেই আল্লামা ইবনে বতুতা (রহঃ) ইবনে তাইমিয়্যা সম্বন্ধে লিখেনঃ
“ ইবনে তাইমিয়্যা বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতার সাথে আলোচনা করেন, তবে তার মাথায় কিছু ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তা-চেতনাও রয়েছে। ”
( তুহ্ফাতুন নাজ্জার থেকে মাওলানা ইসমাইল সাম্বলী প্রনীত তাক্বলীদে আইম্মাঃ পৃ-৫৩ )
এবং হাফেজ যাহাবী (রহঃ) ইবনুল ক্বাইয়্যিম সম্বন্ধে লিখেনঃ
“ তিনি নিজস্ব মতেই আত্নতৃপ্ত। মাথায় কিছু বৈচিত্র্য রয়েছে, যার ফলে গর্হিত অনেক কিছু প্রকাশ পেয়েছে। ”
( আলমু’জাম থেকে তাক্বলীদে আইম্মাঃ পৃ-৫৪ )
৪।
দ্বাদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত আলিম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহ্হাব নজদী (রহঃ) (মৃতঃ ১২০৬ হিঃ) মূলত হাম্বলী মায্হাবেরই মুক্বাল্লিদ্ ছিলেন। তৎকালীন আরবে বিশেষত নজ্দে শিরক্, বিদয়া’ত, কবরপূজা, মাযারপূজা, গাছপূজা, আগুনপূজা ও প্রতিমা-মানব ইত্যাদি পূজা-উপাসনার মোকাবিলা ও প্রতিরোধে তার কার্যকরী, সাহসী ও বীরবিক্রম পদক্ষেপ আসলেও গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসার দাবী রাখে। তাঁরই অবদানে তদানীন্তন আরব মধ্যযুগীয় বর্বরতা, সীমাহীন ভ্রষ্টতা ও শিরক কুফরের অতুলনীয় অন্ধকারাচ্ছন্নতা থেকে রেহাই পেয়েছে।
তবে অনেক বিষয়ে নিষ্প্রয়োজনীয় বাড়াবাড়ির ফলে তাঁর সঙ্গে তদানীন্তন সউদী আলেম উলামাদের মহামতানৈক্য সৃষ্টি হয়। তিনিই মহানবী (সঃ) এর রওজার উপর বিস্তৃত গম্বুজটি ভেঙ্গে দেয়ার পরিকল্পনা করেন এবং ভিন্ন মতাবল্মীদেরকে পবিত্র হজ্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন ও তাদেরকে কাফির, মুশরিক ইত্যাদি জঘন্যতম আখ্যায় আখ্যায়িত করতে থাকেন। ফলে ভয়াবহ ফিৎনা-ফাসাদ ও বিশ্ব মুসলিম সমাজে পারস্পরিক কোন্দলের সূচনা হয়। পক্ষান্তরে যারা তার মতবাদের তাক্বলীদ করতে থাকে তাদেরকে মুসলমানগণ ওহ্হাবী বলে আখ্যায়িত করতে থাকেন। এদিকে ভারতবর্ষের লা-মায্হাবীরাও যেহেতু নিছক ঝগড়া-বিবাদ ও মুসলমানদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হিসেবে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহ্হাব নজদীর অন্তঃসারশূণ্য বিচিত্র মতবাদ গ্রহণ করে যেত, তাই তাদেরকেও মুসলমানগণ ওহ্হাবী বলে আখ্যায়িত করতে থাকেন। আর তারা নিজেদেরকে মুহাম্মদী বা আহলে হাদীস বলে প্রচারের চেষ্টায় মেতে উঠে।
৫।
এ ধারার শেষ ব্যক্তি ক্বাযী শাওকানী (রহঃ) (মৃতঃ ১২৫৫ হিজরী) মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহ্হাব নজদীরই সমসাময়িক ছিলেন। তিনি প্রথমতঃ ছিলেন শিয়া মতালম্বী। তার রচনাবলী প্রায়ই পরস্পর বিরোধপূর্ণ ও নিরপেক্ষতাহীন মতামতে ভরপুর।
দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যেতে পারে হানাফী মায্হাব অনুযায়ী “ বিতর ” নামায্ ওয়াজীব। এ মতামত খন্ডন করার জন্য ইমাম শাওকানী হাদীসে মুয়া’য্ (রঃ) পেশ করেছেন, যাতে বলা হয়েছে যে, “ আল্লাহপাক রাত্র দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামায্ ওয়াজিব্ তথা ফরয করেছেন ” এ ছাড়াও তিনি হাদীসে আ’রাবী পেশ করেছেন, যাতে মহানবী (সঃ) গ্রাম্য লোকটিকে মাত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামায্ আদায় করতে বলায় তিনি প্রশ্ন করেন যে আমার উপর এ ছাড়া কি আর কোন নামায্ আছে? তদুত্তরে মহানবী (সঃ) ইরশাদ করেন “ না, এ ছাড়া সমস্তই নফল। ”
এ হাদীস দু’টির মাধ্যমে শাওকানী সাহেব প্রমাণ করেন যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামায্ ব্যতীত আর কোন নামায্ই ওয়াজিব বা ফরয নয়। তাই “ বিতর ” নামায্ও পাঁচ ওয়াক্তের বহির্ভূত বিধায় ওয়াজিব হতে পারে না বরং নফল নামাযেরই অন্তর্ভূক্ত।
( নাইলুল আওতারঃ পৃ – ৩/৩১ )
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপ ও হাস্যকর বিষয় হল যে, তিনি মাত্র এর কয়েক পৃষ্ঠা পরই “ তাহিয়্যাতুল মসজিদ ” নামাযের বর্ণনায় উপরোক্ত হাদীসগুলো দৃষ্টিগোচর করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের বহির্ভূত “ তাহিয়্যাতুল মসজিদ ” নামায্কে ওয়াজিব প্রমাণের ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। অথচ তিনি নিজেও “ তাহিয়্যাতুল মসজিদ ” সুন্নত হওয়ার পক্ষে সকল উলামায়ে কিরামের ইজ্মা (সর্বসম্মত রায়) নকল করেছেন।
( নাইলুল আওতারঃ পৃ – ৩/৬৮ )
সুতরাং তার এ ধরণের কর্মকাণ্ড পক্ষপাতিত্ব, অনিরপেক্ষতা ও নিছক গোঁড়ামি বৈ আর কি?
৬।
হিন্দুস্তানে ইসলাম আগমনের সূচনা থেকেই মুসলমানগণ হানাফী মায্হাবের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ইংরেজ হুকুমাত প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালেও মুসলমানদের মধ্যে কোন ধর্মীয় মতানৈক্য ছিল না। অবশেষে হিজরী ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এমন কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটে যারা দাউদে যাহেরী, ইবনে হাযাম, ইবনে তাইমিয়্যাহ, মুহাঃ ইবনে আব্দুল ওহ্হাব নযদী ও ক্বাজী শাওকানীর কেবল বৈচিত্র্যময় ও সমস্ত মুসলমানদের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ এবং হানাফী মায্হাব ও অন্যান্য মায্হাব অবলম্বীদের সঙ্গে মতানৈক্য অযথা বিরুদ্ধাচরণ, অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ ও তাদেরকে নির্মূল করার গভীর ষড়যন্ত্রে মরিয়া হয়ে উঠে। বিশেষ করে ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) ও হানাফীদেরকে কাফির, মুশরিক, মুনাফিক, কবরপূজারী ইত্যাদি শব্দে অপবাদ দেয়া যেন তাদের ঠিকাদারী ও নিত্য নৈমিত্তিক ব্যবসায় পরিণত হয়।
( আল্লাহ এ ধরণের অপবাদ রটানোর মত সমস্ত হারাম কাজ থেকে মুসলমানদের হেফাযত করুন এবং সবাইওকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন !)
৭।
উল্লেখ্য যে, ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ, ইবনুল ক্বাইয়্যিম ও মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহ্হাব (রহঃ) ছিলেন সমকালীন ইসলামী চিন্তাবিদ, যুগশ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ ও অসংখ্য মূল্যবান গ্রন্থের প্রণেতা। সাথে সাথে তাঁরা ছিলেন হাম্বলী মাযহাবের মুক্বাল্লিদ ও অনুসারী। যদিও তাদের মধ্যে কিছু বিতর্কিত বিষয়ও ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান গাইরে মুক্বাল্লিদ্রা তাদের গুণগত বিষয়গুলো উপেক্ষা করে কেবল বিতর্কিত বিষয়গুলো অবলম্বন করতঃ মুসলমানদের মধ্যে ফিৎনা-ফাসাদ ও মতানৈক্যের যোগান দিচ্ছে। এমনিভাবে তাদের সীমিত জ্ঞানে হানাফীদের বিশেষ করে দেওবন্দী উলামায়ে কিরামের মধ্যে ব্যতিক্রম কিছু উপলব্ধি করতে পারলেই অতিরঞ্জিত ও অপব্যাখ্যার মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। ইবনে তাইমিয়্যার পুরো জীবনই ছিল জিহাদী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ। তাতারীদের মোকাবিলায় জিহাদ করে তিনি কারাবরণও করেছেন। কিন্তু বর্তমান যুগে গাইরে মুক্বাল্লিদ হিসেবে যারা পরিচিত, আহলে হাদীস আন্দোলন নামে যারা বই লিখছে তাদের কেউ জিহাদে অংশ নিয়েছে বা কারাবরণ করেছে এমন নযীর কি এদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে? বরং তারা সর্বদা জালিম সরকার আর নাস্তিকদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে এবং তাদের সঙ্গে আঁতাত করে আপন স্বার্থ উদ্ধারের অবলম্বন করে চলছে। ভারতবর্ষে মুসলমানদের চিরশত্রু জালিম সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ সরকার ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদ অবৈধ প্রমাণের অপচেষ্টায় “ আল-ইক্বতেছাদ-ফী মাসাইলিল জিহাদ ” নামক অমূলক গ্রন্থ লিখার মুচলেকা ও চুক্তিপত্র গাইরে মুক্বাল্লিদ্ আলিম মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভীর মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছিল। হিন্দুস্তানে মুসলিম ও নাস্তিকদের মাঝে তো যুদ্ধ-জিহাদ বরাবরই চলে আসছে। বাংলাদেশেও কাদিয়ানী, বেরলভী, এন,জি,ও এবং বিভিন্ন ফিৎনা ফাসাদ ও নাস্তিকতার বিরুদ্ধে প্রায়ই জিহাদী আন্দোলন হয়ে থাকে। এতে কোন গাইরে মুক্বাল্লিদের নাম মাত্র ভূমিকা কি ছিল? বা আছে? এ সকল প্রশ্নের জবাব একটাই, আর তা হল “ না ”। অনুরূপভাবে তামাম বিশ্বের ইয়াহুদী খৃষ্টানরা যখন আফগান, ফিলিস্তিন, ইরাক তথা সমগ্র দুনিয়ার মুসলমানদের উপর বে-নযীর নির্যাতন আর মুসলিম নিধনের গভীর ষড়যন্ত্রে মরিয়া হয়ে উঠেছে তখন ইবনে তাইমিয়্যার তথাকথিত অন্যসারী গাইরে মুক্বাল্লিদ্দের ভূমিকা রহস্যজনক; বরং, তারা এবং তাদের ঠাকুরগণ ও তাদের ভক্তবৃন্দরা সম্ভাব্য সকল উপায়ে হানাদারদেরকে স্বাগত জানাচ্ছে, সহযোগিতা করছে। এ দেশে মিশনের নামে আমাদের ঈমান-আক্বীদা ঠিক করা তথা আমাদেরকে মুসলমান বানানোর অভিনয় করছে। অথচ জিহাদ করা আহলে হক্বের একটি পরিচয়। কুরআন-হাদীসের অসংখ্য স্থানে জিহাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাহলে কি গাইরে মুক্বাল্লিদরা জিহাদ থেকে গা ঢাকা দিয়ে ইবনে তাইমিয়্যার অনুসারী ও আহলে হক্বের দাবীর অনধিকার চর্চার স্পর্ধা দেখাচ্ছে না? সাথে সাথে আরও ভাবনার বিষয় যে, তাদের বই-পুস্তকের শিরোনাম “ আহলে হাদীস আন্দোলন ” মানে কোন্ আন্দোলন? মুক্তির আন্দোলন? নাকি সরলমনা মুসলমানদেরকে বিপথগামী ও ভ্রষ্ট করার আন্দোলন?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন