মুফতী মীযানুর রহমান সাঈদ
কুরআনের দৃষ্টিতে লাইলাতুল বারাআত - ২
এ মহাগ্রন্থের ২৫ তম পারা ও ৪৪ নং সূরা “ দুখানের ” শুরুতে যে পাঁচটি আয়াত রয়েছে সে আয়াতগুলোই লাইলাতুল বারাআত বিষয়ক আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু। তাই আয়াতগুলো প্রথমে অর্থসহ পেশ করা হচ্ছে।
حم وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ ۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ أَمْرًا مِّنْ عِندِنَا ۚ إِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينَ
“ হা মীম (এ অক্ষরদুটি হরূফে মুকাত্ত্যিয়াত বা বিকর্তিত বর্ণ যার অর্থ আল্লাহই ভাল জানেন) শপথ প্রকাশ্য কিতাবের। নিশ্চয় আমি কুরআন নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে। নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক জ্ঞানপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। আমার পক্ষ থেকে আদেশক্রমে আমিই প্রেরণকারী। ”
( সূরা দুখানঃ ১-৫ )
আয়াতে উল্লেখিত ليلة مباركة লাইলাতুম মুবারাকাহ (বরকতময় রাত) শব্দের ব্যাখ্যা বা তাফসীরকে কেন্দ্র করেই “ কুরআনের দৃষ্টিতে লাইলাতুল বারাআত ” শীর্ষক আলোচনার সূত্রপাত।
আমরা গত পর্বে বিশ্ববিখ্যাত ও সর্বজননন্দিত দুটি তাফসীর গ্রন্থ যথা তাফসীরে কাবীর ও তাফসীরে রুহুল মাআনী থেকে এ আয়াত সমূহের তাফসীর আলোকপাত করেছিলাম এবং মুফাসসিরে কেরা্মের এক জামাআত এর তাফসীরে শবে ক্বদরের পাশাপাশি শবে বরাতও করেছিলেন, তার প্রমাণও উল্লেখ করেছিলাম।
এই পর্বে আমরা আরও কিছু যুগ প্রসিদ্ধ ও সর্বজনগ্রাহ্য কিছু তাফসীর গ্রন্থের উদ্ধৃতি পেশ করব ইনশাল্লাহ।
তৃতীয় তাফসীরগ্রন্থ তাফসীরে রুহুল বায়ান
আল্লামা ইসমাঈল হক্কানী (রহঃ) তাঁর তাফসীর গ্রন্থ রূহুল বয়ানে مباركة ليلة লাইলাতুমমুবারাকাহ শব্দ দ্বারা কোন রাতটিকে বুঝায়, এ নিয়ে বিশেষ আলোচনা করতঃ এক দল মুফাসসিরীনের দৃষ্টিতে এ রাত থেকে লাইলাতুল বারাআত বুঝানো হয়েছে মর্মে বর্ণনা করার পর লিখেনঃ
“ কোন কোন তাফসীরকারক এখানে লাইলাতুমমুবারাকাহ থেকে মধ্য-শাবানের রাত বুঝিয়েছেন। এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর মুমিন বান্দাদের জন্য “ বারাআত ” নির্ধারণ করেন। যথাঃ বর্ণিত আছে যে, হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহঃ) এ রাতে যখন নামায থেকে মাথা উঠিয়েছেন তখন একটি সবুজ রং এর কাগজ (হাতে) পেলেন যার নূরের রস্মি আসমান পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। সেখানে লিখা ছিল “ আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর বান্দা ওমর ইবনে আব্দুল আযীযের জন্য জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তির ঘোষণা দেয়া হলো। ” এবং এ রজনীতে নেক বান্দাদেরকে আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে মুক্তি দেয়া হয়, অনুরূপভাবে বদকার বান্দাদের আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত বলেও ঘোষণা দেয়া হয়। এ রজনীর আরো বহু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ”
( রূহুল বয়ানঃ খ – ৮, পৃ – ৪০৪ )
অতঃপর আল্লামা ইসহাক হক্কানী (রহঃ) শবে বরাতের প্রায় ছয়টি বৈশিষ্ট্য সবিস্তারে বর্ণনা করেন তাঁর এ তাফসীরে।
চতুর্থ তাফসীরগ্রন্থ তাফসীরে কুরতুবী
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) তাঁর সুপ্রসিদ্ধ তাফসীরগ্রন্থ জামিউল আহকামিল বয়ান এ উল্লেখ করেনঃ
“ বরকতময় রাত্রি বলতে ক্বদরের রাতকে বুঝানো হয়েছে। কেউ বলেছেন, সেটা মধ্য শা’বানের রাত। এবং এ রজনীর আরো চারটি নাম রয়েছে। যেমন লাইলাতুমমুবারাকাহ, লাইলাতুলবারাআত, লাইলাউস্সক, লাইলাতুররহমাহ। হযরত ইকরামা বলেছেন, এ আয়াতে লাইলাতুম মুবারাকাহ অর্থ মধ্য শাবানের রাত্রি। তবে প্রথম মতটি অধিক শুদ্ধ।
فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ
অর্থাৎ আমারই নির্দেশক্রমে উক্ত রাতে প্রতিটি প্রজ্ঞাসম্পন্ন বিষয়ে ফয়সালা করা হয়।
ইবনে আব্বাস (রঃ) বলেনঃ এর অর্থ দুনিয়াবী প্রজ্ঞাসম্পন্ন বস্তুর ফয়সালা আগামী ক্বদরের রাত পর্যন্ত গৃহীত হয়।
হযরত ইকরামা বলেনঃ এ প্রজ্ঞাসম্পন্ন বিষয়ের ফয়সালা মধ্য শা’বানের রাতেই করা হয় এবং পূর্ণ বছরের যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালা হয়। জীবিতদেরকে মৃত্যুবরণকারীদের থেকে পৃথক করা হয়। ”
( তাফসীরে কুরতুবীঃ খ – ১৬, পৃ – ৮৫ )
একটি প্রশ্ন
উল্লেখ্য ইমাম কুরতুবী (রহঃ) তার স্বীয় গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে গিয়ে কাজী আবু বকর ইবনুল আরাবীর উদ্ধৃতীও পেশ করেছেন যে, তিনি বলেছেনঃ যারা مباركة ليلة লাইলাতুম মুবারাকাহ দ্বারা মধ্য শাবানের রাত্র বলে বুঝেন, তাদের এ মতটি বাতিল বলে গণ্য। কারণ আল্লাহ তাআলা তাঁর অকাট্য বাণী কুরআনে বলেছেন, রমজান হচ্ছে ঐ মাস যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, আর যে রাতে কুরআন অবতরণ করেছেন সূরা ক্বদরে সেটিকে লাইলাতুল ক্বদর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অতএব এ আয়াতেও যে মোবারক রাতে কুরআন নাযিল করার কথা বলা হয়েছে – এর ব্যাখ্যাও রমজানের সে পবিত্র রাত্রই ধর্তব্য হবে, যার নাম শবে ক্বদর।
( দেখুন কুরতুবীঃ খ – ১৬, পৃ – ৮৫ )
তার সঠিক উত্তর
উপরোক্ত বক্তব্যটি কুরতুবীতে উল্লেখ থাকলেও সেটা ইমাম কুরতুবীর মতামত নয়। কেননা তার মতামত সুস্পষ্টভাবে তিনি পূর্বেই উল্লেখ করেছেন, أصح والأول অর্থাৎ প্রথম মতটি অধিক সহীহ। এর অর্থ দ্বিতীয় মতকে ভ্রান্ত বা ভুল বলা চলবে না। বরং সেটি صحيح তথা ‘ সঠিক ’ বলে গণ্য হবে। কেননা অধিক সঠিকের বিপরীতটা যে শুধু সঠিক হয় তা ওলামায়ে কেরামের নিকট স্বীকৃত। সুতরাং ইবনুল আরাবীর মতানুসারে এটিকে বাতিল বলা (যাবে না)। কারণ এটা তার একক মতামত, অন্য কেউ তা গ্রহণ করেননি।
পঞ্চম তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরে তবরী
ইমাম আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জাবীর তাবারী (রহঃ) তার প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থে লিখেছেনঃ
“ লাইলাতুমমুবারাকাহ এর ব্যাখ্যা সম্পর্কে তাফসীরকারকগণের মতভেদ রয়েছে যে, রাতটি বছরের কোন রাত? কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ শবে ক্বদর (অতঃপর তাদের দলীল পেশ করেছেন) এবং অন্যান্য মুফাসসিরগণ বলেছেনঃ রাতটি মধ্য-শা’বানের রাত।
فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ
“ সে রাত্রে সকল প্রজ্ঞাসম্পন্ন বিষয়ের ফয়সালা করা হয়। ”
এ আয়াতেও সে ‘ রাত ’ বলতে কোন রাত বুঝানো হয়েছে, এ বিষয়েও মুফাসসিরগণের মতভেদ রয়েছে। (যেমন মতভেদ ছিল مباركة ليلة লাইলাতুমমুবারাকার মধ্যে)
কেউ কেউ বলেছেনঃ এ আয়াতেও রাত থেকে শবে কদরকে বুঝানো হয়েছে। আবার কারো কারো মতে এ আয়াতেও শবে বরাতকে বুঝানো হয়েছে। ”
( তাফসীরে তবরীঃ খ – ১১, পৃ – ২২১-২২২ )
ইমাম ইবনে জারীর প্রত্যেক মতের স্বপক্ষে বহু হাদীস দ্বারা প্রমাণ পেশ করেছেন – যা এখানে উল্লেখ করার অবকাশ নেই।
ষষ্ঠ তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরে বগবী
ইমাম বাগাভী (রহঃ) তার স্বীয় তাফসীরে বাগাভীতে উল্লেখ করেনঃ
“ লাইলাতুমমুবারাকাহ সম্পর্কে কাতাদাহ, ইবনে জায়েদ (রহঃ) বলেছেন যে, এটা কদরের রাত্র। তবে অন্যান্য মুফাসসির বলেছেন, লাইলাতুম মুবারাকাহ এর অর্থ মধ্য-শাবানের রাত। এবং হযরত ইকরামা (রহঃ) বলেছেনঃ মধ্য-শাবানের রাত্র, যাতে পূর্ণ বৎসরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ফয়সালা করা হয়। ”
( তাফসীরে বাগাভীঃ খ – ৪, পৃ – ১১১ )
শেষ কথাঃ
উপরোক্ত সুপ্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ সমূহ ভাল মত অধ্যয়ন করলে, এ কথা দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, লাইলাতুম মুবারাকার তাফসীরে মুফাসসিরে কেরাম শবে বরাতও উল্লেখ করেছেন। তাই এসব তাফসীরগ্রন্থসমূহে উভয় মতের কথা অর্থাৎ শবে ক্বদর ও শবে বরাত - উভয় মতের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাফসীর বিশারদ্গণ শুধু উল্লেখই করেন নি, বরং প্রত্যেক মতের স্বপক্ষে দলীলও পেশ করেছেন।
তাই কেউ যদি বলে যে উক্ত আয়াতসমূহ দ্বারা শবে বরাত বুঝানো যাবে না কিংবা কোন মুফাসসিরে কেরাম উক্ত আয়াতসমূহ দ্বারা শবে বরাত বুঝান নি বা এটা তাফসীর বির রায় (মনগড়া তাফসীর) তাহলে সে যেমন মুসলমানদের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য দায়ী থাকবে; ঠিক তেমনি কেউ যদি কোরআনের এই আয়াতসমূহের তাফসীরে শবে ক্বদরকে অগ্রাধিকার দিয়ে কোরআনে শবে বরাত নেই বলে শবে বরাতের ফযীলতকেই অস্বীকার করে বসে, সেও হাদীস অস্বীকারকারী তথা ইসলামী শরীয়ত অস্বীকারকারী বলে পরিগণিত হবে, কারণ শবে বরাতের ফযীলত সহীহ হাদীস এবং উসূলে হাদীসের নীতিমালা দ্বারা প্রমাণিত।
তাই কাউকে ভ্রান্ত বলার আগে আমাদের চিন্তা করা উচিত যে, আমরা নিজেরাই ভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছি কি না ?
আজ পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় সূরা, সূরা বাকারার ৮ এবং ৯ নং আয়াত পেশ করে শেষ করব ইনশাল্লাহ।
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَا هُم بِمُؤْمِنِينَ
يُخَادِعُونَ اللَّهَ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّا أَنفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ
আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি অথচ আদৌ তারা ঈমানদার নয়। তারা আল্লাহ এবং ঈমানদারগণকে ধোঁকা দেয়। অথচ এতে তারা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে ধোঁকা দেয় না, অথচ তারা তা অনুভব করতে পারে না।
আসুন আগে আমরা সবাই একটু যাচাই করে নিই, আমরা এসব লোক দেখানো ধোঁকাবাজ ঈমানদারদের অনুসরণ করছি না কি হক্ক্বানী ঈমানদারগণের অনুসরণ করছি।
আল্লাহ আমাদের এসব বাতিল ফিরক্বা থেকে হেফাজত করুন।
আমীন।
( চলবে ইনশাল্লাহ )
( পরবর্তী পর্বঃ কুরআনের দৃষ্টিতে লাইলাতুল বারাআত - ৩ )
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন