Translate

বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৭

বাংলাদেশের বিভিন্ন ভন্ড পীরদের অাক্বিদা বিশ্বাস ও তার খন্ডন

বাংলাদেশে পরিচিত ভণ্ডপীরদের ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাস ও তার খণ্ডনঃ

- মুফতী মনসূরুল হক দা. বা.
প্রধান মুফতী ও শাইখুল হাদীস,
জামিয়া রহমানিয়া, মুহাম্মাদপুর,ঢাকা।
----------------------------------
এনায়েতপুরী ও তার অনুসারীদের আক্বীদা-বিশ্বাসঃ

এনায়েতপুরীর নাম মাওলানা শাহ সূফী মুহাম্মাদ ইউনুস আলী। তার পিতার নাম মাওলানা শাহ সূফী আব্দুল কারীম। সে ১৩০০ হিজরীতে সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী থানার এনায়েতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করে।

এনায়েতপুরী ও তার অনুসারীদের ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাসঃ

১. আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাঝে কোন পার্থক্য নেই, শুধু মীম হরফ ছাড়া। আল্লাহ তা‘আলা হলেন আহাদ। আর হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন আহমাদ।

খণ্ডনঃ
হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর খোদার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই বললে আল্লাহ তা‘আলারও স্ত্রী ও সন্তানাদি আছে বলতে হবে। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী ও সন্তান তখন আল্লাহ তা‘আলার স্ত্রী-সন্তান বলে গণ্য হবে। (নাউযুবিল্লাহ)। অথচ কুরআন শরীফে (সূরা ইখলাস) এসেছে,

لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ * وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ

অর্থ: তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তিনি কারো থেকে জন্ম নেননি এবং তার সমকক্ষ কেউ নেই।

২. এনায়েতপুরীর আক্বীদা হলো, ভালো-মন্দের ক্ষমতা পীর সাহেবের হাতে আছে।

খণ্ডনঃ
এটা কুরআন-হাদীসের বক্তব্যের স্পষ্ট বিরোধী। কুরআনে কারীমে বলা হয়েছে,

قُلْ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ فَمَالِ هَؤُلَاءِ الْقَوْمِ لَا يَكَادُونَ يَفْقَهُونَ حَدِيثًا

অর্থাৎ হে নবী! আপনি বলে দিন, সবকিছু আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে হয়। এই সম্প্রদায়ের কী হলো যে, তারা কোন কথা বুঝতেই পারে না। 

৩. এনায়েতপুরীর অনুসারীরা তাকে প্রায় নবী আ. এর সমমর্যাদা সম্পন্ন মনে করে। তাদের ধারণায় যে ব্যক্তি এনায়েতপুরীর সাক্ষাত পেয়েছে, সে জান্নাতী। 
প্রিয় পাঠক! এ ভ্রান্ত আক্বীদার খ-নের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কারণ এটা স্বীকৃত যে, কাউকে দেখার মাধ্যমে জান্নাতী হওয়া হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে খাস, তাও হুযুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জীবদ্দশায় দেখা এবং মুমিন অবস্থায় মৃত্যু হওয়ার শর্তে। তাছাড়া হাদীসে আছে,

من بطأ به عمله، لم يسرع به نسبه

অর্থাৎ যার আমল তাকে পিছনে ফেলেছে তার বংশ-মর্যাদা তাকে এগিয়ে নিতে পারেনি। 

মাইজভান্ডারী পীরের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ

চট্টগ্রাম ‘মাইজভান্ডার’ দরবারের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ আহমাদুল্লাহ। তার পিতার নাম মৌলভী সৈয়দ মতিউল্লাহ। তিনি ১২৩৩ বাংলা ১লা মাঘ মোতাবেক ১৮২৬ ইংরেজী রোজ বুধবার জন্মগ্রহণ করেন। তার ঈমান বিধ্বংসী কুফরী আক্বীদাগুলো নিম্নরূপ।

মাইজভান্ডারীর আক্বীদাঃ

১. পীর সাহেব মনের আশা পূরণ করেন এবং পরকালে মুক্তি দিবেন। 

২. মাইজভান্ডারীর ভণ্ডপীর বলে থাকে, গান-বাজনা জায়েয। 

অথচ শরীআতের দৃষ্টিতে গান-বাজনা সম্পূর্ণরূপে হারাম। হুযূর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, 

ليكونن من أمتي أقوام، يستحلون الحر والحرير، والخمر والمعازف

অর্থাৎ আমার উম্মতের মাঝে এমন সম্প্রদায়ের আগমন ঘটবে, যারা ব্যভিচার, রেশম, মদ এবং গান-বাজনাকে হালাল মনে করবে। 

উল্লিখিত আক্বীদা ছাড়াও আরো অনেক ঈমান বিধ্বংসী আক্বীদায় বিশ্বাসী মাইজলানডারই পীর ও তার মুরীদরা। কাজেই এ ভ্রান্ত দল থেকে নিজের ঈমান-আমল হিফাযত করা আবশ্যক।

সুরেশ্বরী পীরের পরিচিতিঃ

‘সুরেশ্বর’ শরীয়তপুর জেলার নাড়িয়া থানার একটি গ্রাম। এখানকার শাহ সূফী সৈয়দ জান শরীফ শাহ ‘সুরেশ্বরী পীর’ নামে খ্যাত। বর্তমানে সুরেশ্বরী পীরের অধঃস্তন উত্তরাধিকারী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত খানকায়ে সুরেশ্বর চৌধুরীপাড়া, ঢাকাতে অবস্থিত।

সুরেশ্বরীর ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাসঃ
তাদের আক্বীদা-বিশ্বাসের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক আক্বীদা হচ্ছে,

১. পীরের নিকট দীক্ষিত না হইলে কোন ইবাদত কবুল হয় না। 
এখানে বাইআত হওয়াকে ইবাদত-বন্দেগীর জন্য শর্ত তথা ফরয করা হয়েছে। অথচ কোন কিছুকে ফরয সাব্যস্ত করতে হলে কুরআন-হাদীসে স্পষ্ট বর্ণনা থাকা আবশ্যক, যা এখানে অনুপস্থিত। বাইআত হওয়াকে উলামায়ে কেরাম সুন্নাত বলেছেন। অতএব পীর ধরাকে ফরয বলা কোন দলীল ছাড়া শরী‘আতের মধ্যে অতিরঞ্জন করা, যা শরী‘আত বিকৃত করার ন্যায় জঘন্য অপরাধ। হাদীসে আছে,

عن عائشة رضي الله عنها، قالت : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : من أحدث في أمرنا هذا ما ليس فيه، فهو رد.

অর্থ: হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, দীনের মধ্যে নব আবিষ্কৃত বিষয় গ্রহণযোগ্য নয়।

২. চন্দ্রপুরীর মত ভণ্ডপীর সুরেশ্বরীর মতেও কামেল ওলীর কোন ইবাদত-বন্দেগীর প্রয়োজন হয় না। 

৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম গায়েব জানেন তথা তিনি সকল অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী। সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সব কিছুই তাঁর চোখের সামনে বিদ্যমান। 

খণ্ডনঃ
কুরআনে কারীমের বিভিন্ন আয়াতে আছে, অদৃশ্যের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কাছেই আছে। এটা আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ গুণ। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ

অর্থাৎ হে নবী! আপনি বলে দিন, যত মাখলুক আসমান এবং যমীনে রয়েছে, তাদের কেউ গায়েব জানে না একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া। আর (এ কারণেই) তারা জানে না, তারা কবে পুনরুত্থিত হবে? 

আটরশী পীরের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ

আটরশীর ‘বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের’ প্রতিষ্ঠাতা জনাব হাশমত উল্লাহর জন্ম হয় জামালপুর জেলার শেরপুর থানার অন্তর্গত পাকুরিয়া গ্রামে। তারপর ভণ্ডপীর এনায়েতপুরীর নির্দেশে ফরিদপুরে এসে ‘জাকের ক্যাম্প’ নামে সে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীকালে এটারই নাম দেয়া হয় ‘বিশ্ব জাকের মঞ্জিল’। 

আটরশীর ঈমান বিধ্বংসী আক্বীদাসমূহঃ

১. আটরশীর ভণ্ডপীরের বক্তব্য হলো, পরকালে পীর সাহেব মুরীদদের মুক্তির ব্যবস্থা করবেন।

অথচ স্বয়ং নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর গোত্রের লোক বনূ হাশেম, বনূ মুত্তালিবসহ নিজ কন্যা ফাতিমা রাযি. কেও বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের নাজাতের ব্যবস্থা নিজেরা করে নাও। আমি তোমাদেরকে রক্ষা করতে পারব না’।

২. দেওয়ানবাগী ভণ্ডপীরের মত আটরশীর এ ভ-ও মনে করে যে, পরকালে মুক্তির জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আবশ্যকীয়তা নেই। 

কুরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট বর্ণনামতে স্বচ্ছ ঈমানের দাবি হলো, মানুষের ভালো-মন্দ, সফলতা-ব্যর্থতা, ইজ্জত-সম্মান সব কিছুই আল্লাহ তা‘আলার অধীনে।
 
৩. অথচ ভণ্ডপীর আটরশীর কথা হলো, ভালো-মন্দের ক্ষমতা পীর সাহেবের হাতে।

এতসব কুফরী আক্বীদা সম্বলিত ব্যক্তি কীভাবে মানুষের পথনির্দেশক পীর হতে পারে? কাজেই ‘বিশ্ব জাকের মঞ্জিল’ এর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা আবশ্যক।

চন্দ্রপুরী পীরের পরিচিতিঃ

ফরিদপুর জেলার চন্দ্রপাড়া গ্রামের মৌলভী সৈয়দ আবুল ফযল সুলতান (মৃত ১৯৮৪ খ্রি.) ‘চন্দ্রপাড়ার পীর’ নামে খ্যাত। তিনি শাহ সূফী এনায়েতপুরীর শিষ্য। তিনি দেওয়ানবাগী পীর মাহবূবে খোদার পীর ও শ্বশুর।

চন্দ্রপুরীর ঈমান বিধ্বংসী আক্বীদাসমূহঃ

১. ভণ্ড চন্দ্রপুরী বলে থাকে, হযরত জিবরীল আ. ও আল্লাহ তা‘আলা এক ও অভিন্ন। চন্দ্রপাড়া পীরের জামাতা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘সূফী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ থেকে প্রকাশিত ‘মাসিক আত্মার বাণী’ ৫ম বর্ষ, ১ম সংখ্যায় আছে, ‘সুলতানিয়া মুজাদ্দেদীয়া তরীকার ইমাম চন্দ্রপুরী ফরমান, জিবরীল আ. বলতে অন্য কেহ নন। স্বয়ং হাকীকতে আল্লাহ’। (নাঊযুবিল্লাহ)।

অথচ পবিত্র কুরআনে  স্পষ্ট উল্লেখ হয়েছে যে, জিবরীল আ. আল্লাহ ভিন্ন পৃথক সত্তা। আল্লাহর পক্ষ হতে ওহী নিয়ে রাসূলের নিকট আগমনকারী ফেরেশতা। 

২. ভণ্ড চন্দ্রপুরীর আরেকটি কুফরী আক্বীদা হলো, বড় বুযুর্গদের ইবাদত লাগে না।

অথচ পবিত্র কুরআনে কারীমে স্বয়ং নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়ে বলেন,

وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِين

অর্থাৎ (হে নবী!) আপনি আপনার প্রভুর ইবাদত করুন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। 

আল্লাহ তা‘আলার নবীর সমান ইয়াকীন এবং বিশ্বাস অর্জন করা কোন মুসলমানের পক্ষে সম্ভব নয়। তদুপরি আজীবন নবীকে শরী‘আতের অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। সেখানে একজন উম্মত এই ক্ষমতা ও স্বাধীনতা কোত্থেকে পেল যে, সে শরী‘আতের অনুসরণ হতে মুক্ত হয়ে যাবে?

৩. ভণ্ড চন্দ্রপুরী আরো বলে থাকে, ফেরেশতাগণ আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানী করেন। (নাঊযুবিল্লাহ)

অথচ কুরআনে ফেরেশতাগণের গুণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ঘোষণা এসেছে যে,

لَا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُون

অর্থাৎ তাঁরা আল্লাহ তা‘আলা যা আদেশ করেন, তা অমান্য করেন না। এবং যা তাঁদেরকে আদেশ করা হয় তা পালন করেন।
 
চন্দ্রপুরী ও তার অনুসারীগণ এ ধরণের অনেক কুফরী আক্বীদা-বিশ্বাসে লিপ্ত। কাজেই আমাদেরকে এ ভন্ডের প্রতারণা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা আবশ্যক।

দেওয়ানবাগীর পরিচিতিঃ

দেওয়ানবাগী ভণ্ডপীর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ থানাধীন বাহাদুরপুর গ্রামে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করে। তার নাম মাহবূবে খোদা। ঢাকার অদূরে ‘দেওয়ানবাগ’ নামক স্থানে একটি এবং আরামবাগ, ঢাকাতে ‘বাবে রহমত’ নামে আরেকটি দরবার স্থাপন করেছে। মাহবূবে খোদা নিজে এবং তার ভক্তবৃন্দ তাকে ‘সুফি সম্রাট’ হিসাবে পরিচয় দিয়ে থাকে।

দেওয়ানবাগীর ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাস ও চিন্তাধারাঃ

১. ভণ্ড দেওয়ানবাগী মনে করে, মুক্তির জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা জরুরী নয়। সে বলে, ইসলাম বা মুসলিম কোন ব্যক্তি বা ধর্মের নাম নয়। এটা আল্লাহ প্রদত্ত নির্দিষ্ট বিধান এবং বিধান পালনকারীর নাম। যে কোন অবস্থানে থেকে এই বিধান পালন করতে পারলেই তাকে মুসলিম বলে গণ্য করা যায়।

অথচ পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট ঘোষণা মতে পরকালীন মুক্তির একমাত্র উপায় হলো, দীন ইসলাম গ্রহণ করা।

২. সে জান্নাত-জাহান্নাম, হাশর, মীযান, পুলসিরাত, কিরামান কাতিবীন, মুনকার-নাকীর, ফেরেশতা, হুর ইত্যাদি বিষয়কে অস্বীকার করেছে। অর্থাৎ এগুলোর এমন ব্যাখ্যা দিয়েছে, যা এগুলোকে অস্বীকার করার নামান্তর।

অথচ এগুলোকে সঠিকভাবে বিশ্বাস করার নাম ঈমান। যে ব্যক্তি অস্বীকার করবে, নিঃসন্দেহে সে ঈমানের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাবে।

৩. ভণ্ড দেওয়ানবাগী দাবি করে যে, কাবা শরীফ তার কাছে উপস্থিত। তাই হজ্জের প্রয়োজন নেই। 

অথচ ইসলামে হজ্জ পালন করা গুরুত্বপূর্ণ একটি ফরয। এর ফরয হওয়াকে অস্বীকার করা নিঃসন্দেহে কুফরী।

এতসব কুফরী আক্বীদা সত্ত্বেও ভণ্ড দেওয়ানবাগী নিজেকে বর্তমান যামানার মহান সংস্কারক, মুজাদ্দিদ, শ্রেষ্ঠতম আল্লাহর অলী দাবি করে থাকে এবং এ মিথ্যা দাবির প্রমাণ স্বরূপ শিরকী আক্বীদা সম্বলিত বিভিন্ন স্বপ্ন উল্লেখ করে থাকে। একজন মুসলমান হিসাবে এ বিবেচনা থাকা উচিত যে, একজন কুফরী আক্বীদার ভণ্ডপীর কীভাবে আল্লাহর অলী হতে পারে?

রাজারবাগের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও তার মতাদর্শঃ
রাজারবাগী পীর দিল্লুর রহমান। বর্তমানে সে রাজারবাগের মুহাম্মাদীয়া ও সুন্নাতী জামে মসজিদ দরবারে অবস্থান করছে।

তার ঈমান বিধ্বংসী কয়েকটি আক্বীদাঃ

১. সে নিজের নামের আগে-পরে প্রায় ৫২টি উচ্চ অর্থ সম্পন্ন খেতাব সংযুক্ত করেছে। সে বলে, এর মধ্য হতে অনেকগুলো খেতাব তাকে দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা। বাকিগুলো দিয়েছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম। (নাঊযুবিল্লাহ)

২. নিজেকে ইমামুস সিদ্দীকীন অর্থাৎ সিদ্দীকগণের ইমাম বলে থাকে এবং এর মাধ্যমে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ঐকমত্যের ভিত্তিতে উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. এর চেয়েও উর্ধে নিজেকে স্থান দিয়ে থাকেন। কাজেই তার ভণ্ড হওয়ার জন্য এ উপাধিই বড় প্রমাণ।

৩. সে ‘হাবীবুল্লাহ’ খেতাব ব্যবহার করেছে। অথচ ‘হাবীবুল্লাহ’ বলতে একমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই বোঝানো হয়।

৪. তার খেতাবগুলোর মধ্যে কুফরী জ্ঞাপক খেতাবও রয়েছে। যেমন ‘কাইয়ূমুয যামান’ খেতাবটি আল্লাহ তা‘আলার নাম ‘কাইয়ূম’ থেকে নেয়া, যার অর্থ হচ্ছে ‘জগতের ধারক ও রক্ষক’। তাহলে ‘কাইয়ূমুয যামান’ অর্থ দাঁড়াচ্ছে যামানার রক্ষক। এ কথাটি কেবল আল্লাহ তা‘আলার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অন্য কারো ক্ষেত্রে নয়। কোন মাখলূক কাইয়ূম হতে পারে না। হলে আব্দুল কাইয়ূম (জগতের রক্ষকের বান্দা) হতে পারে। সুতরাং কোন মানুষের জন্য নিজেকে সংশ্লিষ্ট অর্থের ধারক মনে করে এমন উপাধি গ্রহণ নিঃসন্দেহে কুফরী।

৫. মাসিক ‘আল-বাইয়িনাত’ সম্পর্কে সে এত বাড়াবাড়ি করেছে যে, ‘আল-বাইয়িনাত’ জুলাই ১৯৯৯ সংখ্যার ১৪৩ পৃষ্ঠায় লিখেছে, আল্লামা রূমী রহ. এর মসনবী শরীফকে যেমন ফার্সী ভাষার কুরআন শরীফ বলা হয়, তদ্রুপ আল-বাইয়িনাতও যেন বাংলা ভাষার কুরআন শরীফ। (নাঊযুবিল্লাহ)। অথচ কুফরী আক্বীদা সম্বলিত পত্রিকা আল বাইয়িনাতকে কুরআন বলা নিঃসন্দেহে কুফরী কথা।

৬. মাসিক ‘আল-বাইয়িনাত’ পত্রিকায় উলামায়ে কেরাম সম্পর্কে এমন গালি-গালাজ লেখা হয়, যা কোন ভদ্রতা ও শালীনতার আওতায় পড়ে না। 
অথচ গালি-গালাজ করা ফাসেকী ও হারাম। হাদীসে বলা হয়েছে,

  سباب المسلم فسوق  

অর্থাৎ মুসলামনকে গালি দেয়া ফাসেকী।

দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে বাংলাদেশের পরিচিত ভণ্ডপীরদের কিছু বিভ্রান্তি তুলে ধরা হয়েছে। মুসলমানদেরকে এসব ভণ্ড থেকে সতর্ক থাকতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে হিফাযত করুন। আমীন।

সোমবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৭

সীরাতুন্নবী পালনীয় না মিলাদুন্নবী? পর্যালোচনা

সীরাতুন্নবী পালনীয় না মীলাদুন্নবী : একটি প্রামাণ্য পর্যালোচনা।

দু’টি আরবী শব্দের সমন্বয়ে ‘সীরাতুন্নবী’ গঠিত-- ‘সীরাত’ ও ‘আন্-নবী’। আরবী ভাষার নিয়মে সন্ধি হয়ে হয়েছে সীরাতুন্নবী। ‘সীরাত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে জীবনী, চরিত, চরিত্র, অভ্যাস, অবস্থা, প্রকৃতি ইত্যাদি। পরিভাষায় কোনো মানুষের সীরাত বলতে বোঝায় তার জীবনেতিহাস। আর শুধু ‘নবী’ বললে যে কোনো নবী বুঝালেও ‘আন্-নবী’ বললে শুধু আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সা.-কেই বুঝায়। সুতরাং এই দুই শব্দের সমন্বয়ে গঠিত সীরাতুন্নবী শব্দটির অর্থ হলো আমাদের মহানবীর ৬৩ বছরের পবিত্র জীবনেতিহাস।

সীরাতুন্নবীর ন্যায় মীলাদুন্নবী শব্দটিও ‘মীলাদ’ ও ‘আন্-নবী’ নিয়ে গঠিত। মীলাদ অর্থ জন্ম। তাই মীলাদুন্নবী মানে হলো মহানবীর জন্ম। বর্তমানে মীলাদুন্নবী শব্দের আগে একটি ‘ঈদ’ শব্দ বসিয়ে বলা হয় ঈদে মীলাদুন্নবী। ঈদ অর্থ খুশি, আনন্দোৎসব। তাই ঈদে মীলাদুন্নবী অর্থ মহানবীর জন্ম দিবসের আনন্দ বা জন্মোৎসব।

সীরাতুন্নবী পালনীয় না মীলাদুন্নবী-- এ ব্যাপারে শরীয়া’র কয়েকটি মূলনীতি এবং সীরাতুন্নবী ও মীলাদুন্নবীর মৌলিক ও প্রকৃতিগত পার্থক্যটা খোলাসা করলে আশা করি পাঠক সহজেই উপলব্ধি করতে সমর্থ হবেন যে কোনটি পালনীয় আর কোনটি তা নয়।

১ম মূলনীতি: ইসলাম মানব মস্তিষ্কের চিন্তা-প্রসূত কোনো মতবাদ নয়। এর আগাগোড়া সবই আল্লাহপ্রদত্ত। তাই কোন্ কাজ ভালো আর কোনটি খারাপ, কোনটি পালনীয় আর কী বর্জনীয় তা নিরূপিত হবে একমাত্র শরীয়াহর বিচারে। আর তা হলো মহানবীর সুন্নাহ এবং সাহাবা কিরামের অনুসৃত পথ। কারণ হুযূর সা. 'মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোনটি', এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, “যে আদর্শের ওপর আমি এবং আমার সাহাবীগণ আছেন।” তাই কোনো কাজ বাহ্যিক দৃষ্টিতে যতোই সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক হোক, শরীয়াহ অনুমোদিত না হলে তা সাওয়াবের কাজ বলে পরিগণিত ও পালনীয় হবে না। আরেকটি কাজ বাহ্যিক দৃষ্টিতে যতোই অসুন্দর আর অনাড়ম্বর হোক, শরীয়াহ অনুমোদিত হলে তা সাওয়াবের কাজ বলেই পরিগণিত ও পালনীয়। উদাহরণত পেশাব লাগা কাপড় যতোই সুন্দর আর সাদা ধবধবে হোক তা পরে নামায জায়িয হয় না, কারণ তা শরীয়াহ অনুমোদিত নয়। কিন্তু পাক-পবিত্র হলে ময়লাযুক্ত কাপড় পরেও নামায জায়িয, কেননা তা শরীয়াহ অনুমোদিত।

প্রচলিত মীলাদুন্নবীর অস্তিত্ব পবিত্র কুরআন, হাদীস ও ফিকহের কিতাবাদির কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। পাওয়া যাওয়ার কথাও নয়; কারণ মীলাদ মাহফিলের সূচনা হয় ৬০৪ হিজরী সনে ইরাকের সুলতান আবূ সাঈদ মুযাফ্ফর এবং আবুল খাত্তাব বিন দাহিয়া কর্তৃক, তখনও সে মীলাদে ‘ক্বিয়াম’ ছিল না। ক্বিয়ামের সূত্রপাত হয় ৭৫১ হিজরী সনে। একদা মজযূব বুযুর্গ খাজা তক্বী উদ্দীন শাফিয়ীর মজলিসে রাসূল সা.’র শানে কবিতা আবৃত্তি করা হলে আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েন। তাঁর অনুকরণে উপস্থিত জনতাও দাঁড়িয়ে যান। পরবর্তীকালে আর কখনো কোনো মাহফিলে ঐ বুযুর্গ দাঁড়িয়েছেন বলে প্রমাণ মেলে না। কিন্তু সুযোগ সন্ধানীরা ঐ বুযুর্গের একদিনের ঘটনাকে মিলিয়ে দেয় দেড়শো বছর আগে আবিষ্কৃত মীলাদের সঙ্গে। অতঃপর আমাদের ভারত উপমহাদেশে এর আমদানি হয় বেনিয়া ইংরেজ দ্বারা। যার প্রমাণ মেলে ঈদে মীলাদুন্নবীর কট্টর সমর্থক মৌলভী আব্দুছ ছমীর রামপুরীর লেখা ‘আনওয়ারে ছাতিআ’ কিতাবের ১৭০ পৃষ্ঠায়। তিনি লিখেছেন: “তারাও (ইংরেজরা) নবী আলাইহিস সালামের জন্মানন্দ পালনের লক্ষ্যে তাদের কোর্ট, কাছারিতে ১২ই রবীউল আউয়ালকে মুসলমানের উভয় ঈদ ও শবে বরাতের ন্যায় ছুটির দিন মনোনীত করেছে।” এ ইতিহাস সামনে রেখে এবার আমরা ফিরে তাকাই রাসূলের মহত্তম জীবনের দিকে। ‘কেমন ছিলো তাঁর জীবন?’ এ প্রশ্নটি হযরত আয়েশাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন: হুবহু কুরআনই প্রতিফলন ছিলো তাঁর জীবন। রাসূলের হাদীস হচ্ছে কুরআনেরই বিশ্লেষণ। আর হাদীসের ব্যাখাসাপে অংশসমূহের বিশদ ব্যাখ্যা রয়েছে আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের ফিক্হের কিতাবাদিতে। ইসলামী শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির দ্বিতীয় প্রধান উৎস ও মানদণ্ড হলো রাসূলের জীবন চরিত বা সীরাতুন্নবী। এ সীরাতুন্নবী সমস্ত বনী আদমের সম্মিলিত সম্পদ। সকলেই এ প্রদীপের মুখাপেক্ষী। মানব জীবনের অবিকল পাথেয়, কেননা সীরাতুন্নবীর নির্দেশনা ছাড়া মানুষ তাঁর অভীষ্ট মানযিলে পৌঁছতে পারবে না। তাই তো দেখা যায়, পূর্ববর্তী বড় বড় হক্কানী উলামা কিরাম রাসূলের জীবন চরিত বুঝাতে যতো গ্রন্থ লিখেছেন, সবক’টিরই নামকরণ করেছেন “সীরাত” শব্দে। যথা: ‘সীরাতে ইবনে হিশাম’, ইবনে কাসীরের ‘আস-সীরাহ’, ইদ্রীস কান্দলবীর ‘সীরাত আল-মুস্তফা’, শিবলী নু’মানীর ‘সীরাতুন্নবী’ প্রভৃতি। রাসূল সা.’র জীবন চরিত সম্বলিত পূর্বসূরীদের কোনো কিতাব মীলাদুন্নবী নামে আছে বলে জানা যায় না।

রাসূল সা.’র যুগ থেকে ৬ শতাব্দি পর্যন্ত যে মীলাদের অস্তিত্ব খুঁজে মেলে না, আজ ঐ মীলাদের শুরুতে আরেকটি ঈদ শব্দ সংযোজন করে তাকে শি’আরে ইসলাম বা ইসলামের নিদর্শন বানিয়ে ফেলার চেষ্টা চলছে। মীলাদ পালনকারীদেরকে ‘আশিক্বানে রাসূল’ বা রাসূলপ্রেমিক উপাধি দেয়া হচ্ছে। আর ঐ মীলাদ নিয়ে যাঁরা গঠনমূলক সমালোচনা করেন, তাঁদেরকে ‘দুশমনানে রাসূল’, ‘মীলাদ বিরোধী’, ‘দুরূদ বিরোধী’ প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত করে জনসাধারণকে খেপিয়ে তোলা হচ্ছে।

ওপরের আলোচনা থেকে কি সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, রাসূলের যুগের ছ’শো বছর পরে উদ্ভাবিত মীলাদুন্নবী পালনীয় না কুরআনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি সীরাতুন্নবী?

২য় মূলনীতি: ইসলামে যতো ইবাদত রয়েছে, সে সবের নাম, সময় ও পালনের পদ্ধতি শরীয়াহ্ কর্তৃক নির্ধারিত রয়েছে। জনগণের মতামতের উপর ছেড়ে দেয়া হয় নি। ‘ঈদ’ নামটিও শরীয়ার দেয়া একটি ইবাদতের নাম। হযরত আনাস রা. কর্তৃক বর্ণিত, রাসূল সা.’র সহীহ হাদীস দ্বারা উম্মতের দু’টি ঈদ নির্ধারিত। ঈদুল ফিত্র এবং ঈদুল আয্হা। যার সময়, আদায় বা পালন পদ্ধতিও স্পষ্টত নির্দিষ্ট। প্রতিটি ঈদে রয়েছে দু’ রাকাত নামায, ৬ তাকবীর। রয়েছে দু’টি খুৎবা। সাহাবী, তাবিয়ী, তাবে তাবিয়ী ও ইমামগণ দু’টি ঈদই পালন করে গেছেন। ইসলামের প্রকৃতির সঙ্গে ঈদে মীলাদুন্নবীর দূরতম কোনো সম্পর্কও থাকতো, তাহলে রাসূল অবশ্যই বলে দিতেন। যদি বলা হয়, যেহেতু বিষয়টি নবীর একান্ত ব্যক্তিসত্তার সাথে সম্পর্কিত বলেই তা বলেন নি, তাহলে নবীর ভক্ত সাহাবা কিরাম যাঁরা নবীর প্রেমে সর্বস্ব কুরবান করে দুনিয়ার সামনে নযীর স্থাপন করে গেছেন, তাঁরা অবশ্যই নবীর জন্মদিনকে ‘ঈদ’ বানিয়ে জশনে ঈদে মীলদুন্নবী পালন করতে কার্পণ্য করতেন না। কিন্তু তাঁরা তা করেন নি। এমতাবস্থায় নবীর জন্মদিনকে ঈদ বানানো পরোক্ষভাবে এ কথার দাবি করা নয় কি যে, নবীর শুভজন্মে আমরা যতোটা আনন্দে উদ্বেল, তারা ততোটা ছিলেন না? তাঁর জন্যে আমাদের যে ভালবাসা রয়েছে, তাঁদের তা ছিল না। এ কি যুক্তিযুক্ত? যদি না হয়, তাহলে নবীর জন্মদিনকে ঈদ বানানো দ্বীনের মধ্যে নব উদ্ভাবন বা বিদআত ছাড়া আর কী হতে পারে! পথভ্রষ্ট খৃস্টানদের উদ্ভাবিত ঈসা আ. এর জন্মদিবসে বড়দিন তথা ঈদ পালন আর হিন্দুদের শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী পালনের অন্ধ অনুকরণ ছাড়া আর কী বলা যায়! তাছাড়া যে ১২ই রবীউল আউয়ালকে কেন্দ্র করে নবীর জন্মানন্দ বা ঈদ পালন করা হয়, সে ১২ই রবীউল আউয়ালই নবীর জন্ম তারিখ, এটি নিশ্চিত নয়; কারণ নবীর জন্ম তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। জনসাধারণের কাছে ১২ই রবীউল আউয়াল বহুল প্রচলিত হলেও ঐতিহাসিকদের কারো মতে ৮, কারো মতে ৯ রবীউল আউয়াল। আবার কারো মতে ৫৭০/৫৭১ খৃস্টাব্দের ২২শে এপ্রিল আল্লাহর রাসূলের শুভ জন্মদিন। (সীরাত আল-মুস্তফা)। কিন্তু ১২ই রবীউল আউয়াল যে নবীর ওফাত তারিখ, এতে কারো দ্বিমত নেই। থাকার কথাও নয়। সুতরাং ১২ই রবীউল আউয়াল ওফাতুন্নবী এটা নিশ্চিত। আর নবীর ওফাতের তারিখে নবীর কোনো উম্মত কি ঈদ পালন করতে পারে?

এবার যে সকল ভাইয়েরা ১২ই রবীউল আউয়াল ঈদ পালন করেন, তাদেরকে যদি সবিনয়ে জিজ্ঞেস করা যায়: আনন্দ-বিষাদের দ্বিবিধ সংশ্লেষজড়িত এ দিনটিকে যে ঈদ বানালেন, সে কি মীলাদুন্নবীর কারণে, না ওফাতুন্নবীর কারণে, তারা কি এর কোনো সদুত্তর দিতে পারবেন? যে দিনটি নিশ্চিত শোক আর অনিশ্চিত আনন্দের স্মৃতিবাহী, সেই দিনে শোকের কথা ভুলে গিয়ে শুধু আনন্দে মেতে থাকা কি কোনো বিবেকবানের পক্ষে শোভা পায়?

একটি উপমা দিয়ে ব্যাপারটি আরো পরিষ্কার করা যাক। ধরুন কারো পিতা যে তারিখে জন্মগ্রহণ করলেন, পঞ্চাশ বছর পর ঘটনাক্রমে ওই একই তারিখে মারা গেলেন। পরেরবার ওই তারিখে ওই ব্যক্তি তার পিতার নিকট অতীতের বিয়োগ-শোকে শোকাহত না হয়ে তাঁর একান্ন বছর আগেকার জন্মের আনন্দে উল্লসিত হয়ে উৎসব পালন করে, তবে তার সেই উৎসব উদযাপন খুব কি যৌক্তিক হবে?

৩য় মূলনীতি: ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। এতে কোনো সংযোজন, বিয়োজনের অবকাশ নেই। এ মূলনীতির আলোকে বলা যায়, ঈদে মীলাদুন্নবী নামে তৃতীয় ঈদের সংযোজনের অনিবার্য অর্থ হবে, রাসূল সা. আপন রিসালতের দায়িত্ব যথাযথ পালনে ত্রুটি করেছেন। ঈদে মীলাদুন্নবীর মত ঈদে আ’যম আর সাওয়াবের কাজ থেকে উম্মতকে মাহরূম রেখেছেন। তাই আমাদের পীর সহেবরা তা আবিষ্কার করেছেন। অথচ কোনো মুসলমানের পক্ষে জেনেবুঝে এরূপ আক্বীদা-বিশ্বাস পোষণ করা সম্ভব নয়। কাজেই ঈদে মীলাদুন্নবী কীভাবে পালনীয় হতে পারে?

প্রকৃতিগত পার্থক্য: (ক) মীলাদুন্নবীর অর্থ মহানবীর জন্ম। আর সীরাতুন্নবীর অর্থ মহানবীর জীবনেতিহাস। যেহেতু কারো জীবনালোচনা করতে গেলে তাঁর জন্মালোচনা বাদ দিয়ে হয় না, বিপরীতপে জন্মালোচনায় জীবনালোচনা করলে প্রসঙ্গ ঠিক থাকে না। তাই জীবনলোচনার ভেতর জন্মালোচনা আছে, জন্মালোচনার ভেতর জীবনালোচনা নেই। সীরাতুন্নবীর ভেতর মীলাদুন্নবী আছে, কিন্তু মীলাদুন্নবীর ভেতর সীরতুন্নবী নেই। যেভাবে পাঁচের ভেতর এক আছে, কিন্তু একের ভেতর পাঁচ নেই। সুতরাং সীরাতুন্নবী পালন করলে মীলাদুন্নবী পালন হয়, কিন্তু মীলাদুন্নবী পালন করলে সীরাতুন্নবী পালন হয় না।

(খ) সীরাতুন্নবী একটি ব্যাপক শব্দ। অর্থ যেমন ব্যাপক, তেমনি ভাব-ব্যঞ্জনাও। স্থান-কাল-পাত্রের নিরিখে তাঁর আদর্শ সর্বকালীন ও সর্বজনীন। সীরাতুন্নবী শব্দবন্ধ রাসূলের জন্ম ও মৃত্যুসহ গোটা ৬৩ বছরের জীবনকে অন্তর্ভুক্ত করে। কোনো বিশেষ সময়ের সীমানায় আবদ্ধ থাকে না। বছরের যে কোনো দিন, যে কোনো সময়, যে কোনো স্থানে জীবনালোচনা করে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা যায়।

পক্ষান্তরে মীলাদুন্নবী শব্দে শুধু রাসূলের জন্মই বোঝায়, যা একটি বিশেষ সময় তথা জন্মদিনের ক্ষণকালবোধক। কাজেই শব্দটির পরিধি নবীর জন্ম উপলক্ষে কোনো অনুষ্ঠান করা তথা শুধু ঐ দিবস পালন করাতেই সীমিত। আর কোনো দিবসকে শুধু দিবস হিসেবে পালন করা ইসলামী শরীয়ায় কোনো গুরুত্ব রাখে না। অতএব ৬৩ বছরের জীবনাদর্শ পালন না করে একদিনের জন্মোৎসব পালন করা যুক্তিসিদ্ধ নয়।

(গ) মীলাদুন্নবীর আলোচনা করা নফল, আর সীরতুন্নবী কায়েম করা ফরয। ফরয ছেড়ে নফল পালন করা, লুঙ্গি খুলে পাগড়ি বাঁধার মতোই। তাই সীরাতুন্নবী ছেড়ে মীলদুন্নবীর আনুষ্ঠানিকতা কোনো অর্থ ও তাৎপর্য বহন করে না।

(ঘ) আল্লাহর পবিত্র কালাম কুরআন এবং রাসূলের লক্ষাধিক হাদীসের কোথাও মীলাদুন্নবীর আলোচনা নেই, আছে ৬৩ বছরের জীবনাদর্শ; কারণ মহানবীর জন্মকালীন মু’জিযা খোদাপ্রদত্ত। তাঁর একান্ত ব্যক্তিসত্তার সাথে সম্পর্কিত। তাতে মানুষের শিক্ষণীয় ও পালনীয় কিছু নেই। তাছাড়া মানুষের জন্ম একটি গোপন অধ্যায়, যা আলোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কুরআন-হাদীসে তা আসেও নি। সুতরাং কুরআন, হাদীসের সম্পর্ক সীরাতুন্নবী সাথে, মীলাদুন্নবীর সাথে নয়।

মীলাদুন্নবী পালন কি সম্ভব? বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কারো জন্ম কখনোই পালন করা যায় না, শুধু আলোচনা করা যায়। কায়েম করা যায় না, পর্যালোচনা করা যায়। বিশেষত মহানবীর জন্মক্ষণে যেসব অলৌকিত ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, উদাহরণত, সীরাত গ্রন্থাদিতে আছে, মহানবী সা. মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারে তাঁর মা আমেনা বলেন: ‘‘আমি প্রসবকালে কোনোরূপ কষ্ট অনুভব করি নি।” তিনি মায়ের গর্ভ থেকে খৎনাকৃত এবং নাড়ি কাটাবস্থায় ভূমিষ্ঠ হন। জন্মগ্রহণ করেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। তাঁর জন্মমুহূর্তে তৎকালীন পারস্যের অগ্নিপূজকদের হাজার বছরের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ড নিভে যায়। রাজপ্রাসাদে ভূমিকম্প হয়ে ১৪টি প্রস্তরখন্ড খসে পড়ে। তাঁর জন্মক্ষণে পবিত্র কা’বা ঘরে কুরাইশদের স্থাপিত মূর্তিগুলো ভূমিসাৎ হয় ইত্যাদি। এরূপ বিস্ময়কর ঘটনা কি অন্য কারো জন্মের ক্ষেত্রে ঘটেছে? ঘটা কি সম্ভব! কাজেই মীলাদুন্নবী আলোচনা করা যেতে পারে, কায়েম নয়। তায্কিরা করা যেতে পারে, উদযাপন নয়। শুকরিয়া জ্ঞাপন কর যেতে পারে, পালন নয়। কেউ যদি মীলাদুন্নবী কায়েম করা, উদযাপন করা, আর পালন করার দাবি করে, তাহলে তা অবাস্তব, অযৌক্তিক এবং অসম্ভবের পায়ে মাথা লোটা ছাড়া কিছু হবে বলে মনে হয় না। অর্থগত দিক থেকেও সীরাতুন্নবীর বাস্তবায়ন সম্ভব, কিন্তু মীলাদুন্নবীর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়; কারণ রসূলের জন্ম হয়েছে একটি বিশেষ তারিখের সুনির্দিষ্ট মুহূর্তে। আরব দেশের সেই নির্দিষ্ট মুহূর্তটি বাংলাদেশের কত তারিখ, কী বার, কোন প্রহর ছিল, তা ঠিক করে বলা অসম্ভব। সুতরাং মীলাদুন্নবীর সঠিক উদযাপনও অসম্ভব।

আশ্চর্য হলেও অবাস্তব নয়: যে মীলাদুন্নবী পালনীয় নয় শুধু আলোচনীয়; যে আলোচনা ফরয নয়, নফল; সে মীলাদুন্নবীর পক্ষপাতিত্ব করতে গিয়ে যে সীরাতুন্নবী শুধু আলোচনীয় নয়, পালনীয়ও; যে সীরাতুন্নবীর অনুসরণ, অনুকরণ এবং জীবনে যার বাস্তব প্রতিফলন নফল নয় বরং ফরয; সে সীরাতুন্নবীর প্রতি বিষোদগার আর অনাস্থা জ্ঞাপন করা হয়। শ্লোগান দেয়া হয়, ‘মীলাদুন্নবী করতে হবে, সীরাতুন্নবী ছাড়তে হবে।’ ‘মীলাদুন্নবী কায়েম কর, সীরাতুন্নবী বন্ধ কর।’ এমনকী এক গোমূর্খকে একবার বলতে শুনলাম, ‘মীলাদুন্নবী কায়েম কর, সীরাতুন্নবীতে লাথি মারো’ (নাউযুবিল্লাহ)। ভাবতে অবাক লাগে, শুনতে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে, যে সীরাতুন্নবী তথা মহানবীর পুণ্যময় জীবনেতিহাস, যে সীরাতুন্নবী তথা পবিত্র কুরআনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি, ইসলামের প্রতিমূর্তি, সে সীরাতুন্নবী নিয়ে জঘন্যতম উক্তি আশিক্বে রাসূল দাবিদারদের মুখে কেমন করে শোভা পায়। আবু জাহল, আবু লাহাব তথা মক্কার কাফেরেরাও মহানবীর মহত্তম জীবন নিয়ে এত জঘন্য উক্তির সাহস করে নি, বরং নবুওয়াতপূর্বকার নবীজীবনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। এ ধরনের কটূক্তি করে মূলত যে তারা আপন ঈমান নামের বৃক্ষমূলে কুঠারাঘাত করছেন, তা উপলব্ধি করার জ্ঞানটুকুও বোধহয় হারিয়ে ফেলেছেন।

নবীপ্রেম ও মীলাদুন্নবী: মুমিনের ঈমানের দাবি হচ্ছে, তার জীবন, স্বজন ও সর্বস্বের চেয়ে রাসূল সা. কে বেশি ভালবাসা। রাসূল সা. বলেছেন: ‘‘তোমাদের কেউ পূর্ণ মুমিন হতে পারবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার সন্তানাদি, মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন তথা সকল মানুষ থেকে অধিক প্রিয় না হব।” (মিশকাত) ভালবাসা গোপন ব্যাপার। পরিচয় করা যায় লক্ষণ দেখে। রাসূলকে ভালবাসার নিদর্শন হলো, তাঁর আদর্শ ও সুন্নাতের অনুসরণ করা। অন্য হাদীসে রাসূল সা. বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি আমার আদর্শ গ্রহণ করল, সেই আমাকে ভালবাসল, সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে।” (ফয়যুল কালাম) সুতরাং নবীর সুন্নাতের অনুসরণ ব্যতিরেকে নবীপ্রেমের দাবি অবান্তর। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে আমাদের সমাজে যাদের মাথা থেকে পাতা পর্যন্ত রাসূলের সুন্নাত খুঁজে পাওয়া যায় না, যারা নবীর আনীত শরীয়াহ ও সুন্নাতমতো জীবন যাপনে উদাসীন, বরং এর বিপরীত পথে চলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, তাদেরকেই দেখা যায় ১২ই রবীউল আউয়ালে ঈদে মীলাদুন্নবী নামে মৌসুমী নবীভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনে তৎপর। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এ ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনই তাদের সারা বছরের রাসূলবিরোধী অপকর্মের ভর্তুকী আর কাফ্ফারা। তাছাড়া যারা ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন করে, তারা দিবসটি ঈদ বা খুশির দিবস হিসেবে উদযাপন করে। তাই দিবসটি তাদের কাছে অনুষ্ঠানসর্বস্ব। জৌলুস আর উৎসবই হয় মুখ্য। ফলে রঙের বৈচিত্র, রকমারি ফেস্টুন আর বর্ণাঢ্য মিছিল দ্বারা তারা দিবসটিকে মাতিয়ে তুলতে চন। লাল, নীল ও হলুদ বাতি জ্বালিয়ে, আগরবাতি পুড়িয়ে, মিষ্টি বিতরণ আর ভেরাইটিজ খাবারের আয়োজন করে দিবসটিকে সার্থক করে তুলতে চান। অথচ এসবের সাথে নবীপ্রেমের দূরতমও কি কোনো সম্পর্ক আছে? এসবের দ্বারা কি নবী খুশি হতেন? নবীর আদর্শ গ্রহন না করে, জীবনের সকল স্তর থেকে নবীর সুন্নাতকে বিদায় করে, শুধু নবীর জন্মোৎসব পালনের দ্বারা যদি আশিক্বে রাসূল হওয়া যেত, তাহলে আবূ লাহাবই সবচেয়ে বড় আশিক্বে রাসূল হওয়ার কথা। নবীর জন্মোৎসব পালনে সে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। দাসী ছোয়াইবার মুখ থেকে নবীর জন্মসংবাদ শুনতে পেয়ে আনন্দের আতিশয্যে তার বহুমূল্য এই দাসীকে মুক্ত করে জন্মোৎসব পালন করেছে। যার মূল্য ঐসব মীলাদানুষ্ঠানের ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি হবে। (সীরাত আল-মুস্তফা)

আসুন! আমরা আমাদের দৃষ্টি ও মনের সংকীর্ণতা ও বক্রতা দূর করে উদারতা ও সরলতাকে স্থান দেই। নিজের মত ও পথের অনুকূলে না হলেও সঠিক বিষয় জানা ও বোঝার মানসিকতা তৈরি করি। নবীপ্রেমকে শ্লোগান আর সময়ের সীমানায় সীমিত না রেখে জীবনের সর্বক্ষেত্রে নবীর আদর্শ বাস্তবায়ন করে প্রকৃত নবীপ্রেমিক হওয়ার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদেরকে সুমতি দিন, ঐতিহাসিক ও প্রামাণ্য সত্যকে গ্রহণ করে সত্যিকার নবীপ্রেমিক হওয়ার সৌভাগ্য দান করুন!
সংকলক
এম এম অাবদুল্লাহ ভুঁইয়া
(উলামায়ে দেওবন্দ বাংলাদেশ)