Translate

মঙ্গলবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২০

লিকোরিয়া ‎সমস্যার ‎সমাধান ‎

লিকোরিয়া সমস্যার সমাধান 

আমরা প্রায় সময় দেখি শুধু মাত্র পুরুষের যৌন সংক্রান্ত আলোচনা, মনে হয় যেন মহিলাদের কোন যৌন সমস্যাই নেই। আসলে তাই নয়  পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যাই নারী তাদের ও যৌন সমস্যা আছে কিন্তু লাজ্ শরমের কারণে তারা প্রকাশ করতে পারেনা বা করেন না।

তাই আজকে তাদের কমন একটা  সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে আলোচনা করব। 
. লিকোরিয়া -ঃ  লিকোরিয়া চলমান সাধারণ একটা রোগ হলেও কিন্তু এটা অনেক জটিল রোগের কারণও বটে তাই অবহেলার সূযোগ নেই। যদি দুর্গন্ধ যুক্ত ঘন আঠালো ধরনের হয়ে থাকে, চুলকানী থাকে ,কোমর  ব্যথা,যৌনি পথে ব্যথা,জ্বর জ্বর ভাব,  তাহলে চিকিৎসার বিকল্প নেই।আর না হয় এটা লিকোরিয়া  স্বাভাবিক নিয়ম  হিসাবে বিবেচিত হবে  চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। 
এখানে চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছু  ঔষধের  আলোচনা  করা হল আবস্থা ভেদে চিকিৎসক এর পরামর্শে ব্যবহার করা যেতে পারে। 
(১,)
"নিম তেলের" সাথে "নারিকেল তেল মিশিয়ে ২ বার আক্রান্ত স্হানে ব্যবহার অথবা লজ্জাস্হানে অলিভওয়েল ব্যবহার উপকারী।  

(২)
"অশোকা 3x লিউকোরিয়া প্লাস " 
কার্যকরীতাঃ 
বাদক বেদনা,সাদা স্রাব,অনিয়মিত স্রাব, কষ্টকর স্রাব,জরায়ু প্রদাহ ও দূর্বলতায় কার্যকর। 

(৩)
"হাব্বে মারওয়ারীদি, লিউকোরিয়া কিউর ক্যাপ"
কার্যকরীতাঃ   
ইহা সাদা স্রাব অনিয়মিত মাসিক,জরায়ু দূর্বলতায় কার্যকরী।  

৪,)
"ম্যানোস্টোজ টেবলেট)" 
কার্যকরীতাঃ 
সাদা স্রাব ও অস্বাভাবিক রক্ত স্রাব সহ ব্যথায় কার্যকর 
" ৫")
"পালসেটিল)" 
কার্যকরীতাঃ 
মাসিকের বেদনা,সাদা স্রাব রক্ত স্বল্পতা,অনিয়মিত মাসিক,মাইগ্রেশনে,জরায়ু বেদনাও ডেলীভারী- কালীন সমস্যায় কার্যকর। 

সৌজন্যে 
 ভূঁইয়া  ন্যাচরাল হার্বস 
০১৮২৯৩১৮১১৪

শনিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২০

আকুপাংচার ‎কি ‎ও ‎কেন? ‏


আলমগীর আলম

আলমগীর আলম

ক্যাটেগরিঃ স্বাস্থ্য

কুপ্রেসার চিকিৎসা পদ্ধতি একটি সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবা। প্রত্যেক মানুষ নিজেই অনুশীলনের মাধ্যমে নিজের রোগ নির্ণয়, নিরাময় এবং রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম। এ পদ্ধতি অনুশীলন ও প্রয়োগের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে নিজ বা নিজেদের রোগ নির্ণয় করে তা নিরাময় করতে পারেন খুব সহজেই। মার্কিন চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডাঃ উইলিয়াম ফ্রিটজ জেরাল্ড একদল উদীয়মান চিকিৎসক নিয়ে আধুনিক গবেষণায় আজকের আকুপ্রেসারকে বিকাশিত করেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন অনেক জটিল ও কঠিন রোগও শুধু আকুপ্রেসার দিয়ে নিরাময় সম্ভব যা ঔষধে অনেক সময়ের প্রয়োজন পড়ে না। আকুপ্রেসার চিকিৎসা পদ্ধতি এমন একটি পদ্ধতি যা অনেক কঠিন রোগও খুব সহজেই নিরাময় হয়ে যায়। আমাদের দেশে এখন অনেক মানুষ আকুপ্রেসার করছেন, রয়েছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে দিনে দিনে আকুপ্রেসার লোকপ্রিয়তা পাচ্ছে।

Hand

আকুপ্রেসার কী?

আকুপ্রেসার চিকিৎসা পদ্ধতি হচ্ছে হাতের এবং পায়ের বিশেষ কিছু পয়েন্ট রয়েছে যা চাপ দিলে নির্দিষ্ট পয়েন্টের নির্দিষ্ট রোগ নিরাময় হয়ে যায়। স্রষ্টা তার মহান সৃষ্টিকে নিজে লালিত করেন তাই প্রকৃতির অংশ হিসেবে মানুষ যেন তার স্বাস্থ্য ঠিক রাখার উপায় জানা থাকে সেজন্য মানুষের সকল রোগের চিকিৎসা হাত ও পায়ের নির্দিষ্ট পয়েন্টগুলো দিয়ে রাখছেন।

মানুষ প্রকৃতির সন্তান, এই প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রকৃতির মধ্যে থেকেই প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে লড়াই সংগ্রাম করে বাঁচার অদম্য আকাঙ্খা মানুষকে বর্তমান অবস্থায় দাঁড় করিয়েছে। মানুষ তার প্রয়োজনে গাছপালা, লতাপাতা, লতা-গুল্ম, ফলমুল নিজের করে নিয়েছে। সেই সাথে তার আহারের জন্য ফলমূল অসুখ-বিসুখের জন্য নানান লতাপাতার কাছে আশ্রয় নিয়েছে। প্রকৃতির নানান খোয়ালে নানান আঞ্চলিকতায় স্বাদ ভিন্নতার কারণে মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট ভিন্নতায় তার গঠন এবং কাঠামোগত কারণের ও একটি স্বতন্ত্রতা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আকুপ্রেসার পয়েন্ট পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য এক ও অভিন্ন।

আকুপ্রেসারের ইতিহাস

সুশ্রুত সংহিতার মতে ভারতবর্ষে ছয় হাজার বছর আগে আজকের আধুনিক আকুপ্রেসার প্রচলন ছিল, মুণি ঋষিগণ তাদের রোগ নিরাময়ের জন্য এক গোপন বিদ্যা হিসেবে নিজের কাছে রাখতো, মুণিঋষির ভক্তকুল অসুস্থ হলে আকুপ্রেসারের মাধ্যেমে রোগ নিরাময় করতেন। সেই সাথে খাদ্যের প্রতুলতা এবং পথ্যের প্রাপ্তির জন্য ভক্তের থাকার স্থান বদলের নির্দেশ দিতেন, সেই আলোকে ভক্ত তার জন্য উপযোগী স্থান এবং উপযোগী পথ্য যেখানে আছে সেখানেই থাকতেন। পরবর্তীকালে এই আকুপ্রেসার শ্রীলংকায় যেয়ে আকুপাংচার নামধারণ করে চীনের ব্যাপক পরিচিতি পায়। আকুপ্রেসার বিভিন্ন জাতির কাছে বিভিন্ন নামে যা আকুপ্রেসার, রিফ্লেক্সোলজি, সুজোক, জোন থেরাপী ইত্যাদি নামে প্রসার পায়।

Basic CMYK

আকুপ্রেসার শরীরে কীভাবে কাজ করে?

এই চিকিৎসা পদ্ধতি শরীরে অবস্থিত বহুমাইল বিস্তৃত স্নায়ু দ্বারা যোগাযোগ ব্যবস্থায় জৈব বিদ্যুৎ তৈরী করার মাধ্যমে কাজ করে। মানুষের শরীরে রক্তের ধীর গতি এবং বিদ্যুৎ সঞ্চালনে বাধাই রোগ। মানবদেহ এক আশ্চর্য সুপার কম্পিউটার। এর প্রতিটি অঙ্গ একে অপরের সাথে মিলে মিশে শরীরটাকে ঠিক রাখার জন্য অবিরাম কাজ করে থাকে। এই যন্ত্রগুলো নিরলসভাবে কাজ করে তা শত বছরেরও বেশী টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট উপযোগী। এই আশ্চর্য কম্পিউটারটি চালানোর জন্য যা প্রয়োজন তা হলো সুষম বিদ্যুৎ যা শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী বিদ্যুৎ প্রবাহ ঠিক থাকে। তা না থাকলেই শরীরে নানান জটিলতা সৃষ্টি হয় এবং রোগের উৎপত্তি শুরু হয় যা জীবনের প্রাণহানীর মূল কারণ।

আকুপ্রেসারের মাধ্যমে যে সমস্যাগুলো দূর কর যায়

ঘাড়ের ব্যথা, স্পন্ডলাইসিস, কোমরের ব্যথা (লাম্বার), আর্থারাইটিস, অস্ট্রোপ্রোসিস, হাঁটুব্যথা, মাথাব্যথা, সাইনাস, মাইগ্রেন, হার্টের সমস্যা, লিভারের সমস্যা, ফুসফুসের সমস্যা, এজমা, পুং ও স্ত্রীতন্ত্রের জটিল সমস্যাগুলো অত্যন্ত সফলতার সাথে কাজ করে। এছাড়া নার্ভের যে কোন সমস্যা, প্যারালাইসিস, স্ট্রোক পরবর্তী পুনর্বাসন, উচ্চ রক্তচাপ, থাইরয়েডের সমস্যা ইত্যাদি।

আকুপ্রেসার করার সুবিধা

১. এই চিকিৎসা নিজেই রোগ নির্ণয় করতে পারবে (হাতের তালুতে চাপ দিলে যেখানে ব্যথা অনুভব হবে বুঝতে হবে সেখানেই সমস্যা রয়েছে, সেই ব্যথা দূর করার জন্য আকুপ্রেসার করতে হবে)।
২. হাতের তালুতে ও হাতের উপরিভাগেই সব সমস্যার সমাধান
৩. বয়সের কোন ব্যাপার নেই, সব বয়সী মানুষই আকুপ্রেসার করতে পারবে
৪. কোন খরচ নেই, কোন রাসায়নিক ডায়াগনসিস লাগে না
৫. সময়ের কোন ব্যাপার নেই, যখন তখন যে কোন অবস্থাতেই আকুপ্রেসার করা যায়।

কীভাবে আকুপ্রেসার করবে?

পদ্ধতিগতভাবে আকুপ্রেসার হলো একটি স্বতন্ত্র চিকিৎসা পদ্ধতি। এই চিকিৎসা পদ্ধতি জানা থাকলে নিজেই নিজের শরীরের অবস্থা জানা এবং অসুস্থ হলে তা থেকে নিরাময়ের জন্য এর চাইতে সহজ এবং পরিপূর্ণ পদ্ধতি পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই যা মানুষের জন্য স্রষ্টার দেয়া এক অন্যন্য স্বাস্থ্যরক্ষা পদ্ধতি। হাতের এবং পায়ের বিশেষ পয়েন্টে চাপ দিয়ে জানা যায় বর্তমান শরীরের কী অবস্থা এবং কোন জটিল বা জন্মগত রোগও আকুপ্রেসার দিয়ে নিরাময় সম্ভব।

শরীরে যে কোন সমস্যাই থাক না কেন ক্রোনিক কিংবা একিইউট তা আকুপ্রেসার দ্বারা আপনার শরীরের জৈব বিদ্যুৎ দ্বারা ধীরে ধীরে সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম। সেইজন্য নিজের হাতের তালুতে পয়েন্টগুলো লক্ষ করুন, তারপর প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিটি পয়েন্টে ৫০ টি করে চাপ দিন। চাপ হবে সহ্যক্ষমতার মধ্যে এবং একটি চাপের সাথে আরেকটি চাপের মধ্যে ১ সেকেন্ড সময় নিয়ে চাপ দিতে হবে। এতে কাজ হবে ভাল। প্রতিদিন দুবেলা কমপক্ষে একটি প্রেসার দেওয়ার অন্তত ৮ ঘণ্টা পর আরেকবার চাপ দিতে হবে। সপ্তাহে ৬ দিন আকুপ্রেসার করতে হবে, একদিন বিরতি দিয়ে আকুপ্রেসার করতে হবে। চাপের ক্ষেত্রে একটু এদিক ওদিক হলেও বুঝতে পারবেন যে, যেখানে ব্যথা অনুভব করবেন সেখানেই চাপ দিবেন। ছবিতে পয়েন্টগুলো দেওয়া আছে প্রয়োজন অনুযায়ী আকুপ্রেসার করুন।

সাবধানতা

১. গর্ভবতী মায়েরা এই আকুপ্রেসার করবেন না।
২. ভরা পেটে আকুপ্রেসার করা যায় না।
৩. দিনে দুবারের বেশি আকুপ্রেসার করা অনুচিত।
৪. একবারে ২০ মিনিটের বেশি আকুপ্রেসার করা যাবে না।
৫. একটি পয়েন্টে ২ মিনিটের বেশি আকুপ্রেসার করা যাবে না।

আমাদের দেশে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে আকুপ্রেসার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। যা মানুষ নিজে নিজেই প্রয়োগ করে নিজের শরীর সুস্থ রাখতে পারবে। যারা একাধিক রোগে ভুগছেন এবং একাধিক ঔষধ সেবন করছেন তারা নিয়মিত আকুপ্রেসার করলে ঔষধ খাওয়া বাদ দিতে পারবেন। আর এমন কিছু সমস্যা রয়েছে তা ঔষধেও সারে না কিন্তু আকুপ্রেসারে সারবে যেমন ঘাড়, কোমর ও নার্ভের জটিল সমস্যাগুলো। তাই আকুপ্রেসার ব্যাপক প্রচার প্রয়োজন।

আলমগীর আলম
আকুপ্রেসার বিশেষজ্ঞ
ন্যাচারোপ্যাথি সেন্টার,
ফ্লাট – বি -৭, ৮৩ নয়া পল্টন (গাজী নীড়), ঢাকা।

সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২০

হাতেমতায়ীর ‎জীবনি ‎

ছোটবেলা থেকে পাঠ্যবইয়ের সুবাদেই হোক আর দাস্তানে-হাতেম-তাঈ টিভি সিরিজের দর্শক হিসেবেই হোক, দানবীর হাতেম তাঈ এর নাম শোনে নি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আশ্চর্য হলেও সত্য, অনেকেই তাকে কেবল উপকথার চরিত্র হিসেবেই মনে করে, অথচ তিনি সত্যিকারের রক্ত মাংসের মানুষ ছিলেন! তার পরোপকার আর মহৎ হৃদয়ের গল্প এতটাই অবিশ্বাস্য যে তিনি ইতিহাসের তাম্রলিপি থেকে উপকথার পাতায় স্থান পেয়ে গেছেন।

হাতেম-আল-তাঈ এর পুরো নাম হাতেম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবন সাদ আত-তাঈ। অর্থাৎ বাবার নাম আব্দুল্লাহ। দাদা সা’দ আবু সাফফানা, ছিলেন তাঈ বংশের, সময়কাল ষষ্ঠ শতাব্দী। তাঈ বংশ বাস করত সৌদি আরবের উত্তর পশ্চিম কোণে “হাইল” নগরীতে।


হা’ইল এলাকা সৌদি আরবের এখানে; Image Courtesy: pytheya.blogspot.com


তার জনদরদী ঘটনাগুলো মুখে 

মখে ছড়াতে ছড়াতে কিংবদন্তী পর্যায়ে চলে গেছে, তাই সত্য-মিথ্যা আলাদা করা দায়। আজকের লেখাতে কেবল বহুল প্রচলিত ঘটনাগুলোই লিখছি, রূপকথার দিকে না গিয়ে।

তাঈ বংশ কিন্তু রাজা বা শাসক ছিলেন। অর্থাৎ আরবের হাইল অঞ্চলের কর্ণধার। তারা ছিল আরব খ্রিস্টান। যদিও বাংলাতে প্রচলিত কাহিনী পড়লে অনেকের এই ধারণা থাকতে পারে, হাতেম তাঈ বুঝি মুসলিম ছিলেন। ইয়েমেন থেকে তাদের আগমন।

কথিত আছে, যখন হাতেমের মা গর্ভবতী হন তখন স্বপ্নে দেখেন তাকে বলা হচ্ছে, তুমি কি দশজন গড়পড়তার সন্তান চাও, নাকি একজন উদার সন্তান চাও? তিনি উদার সন্তান চাইলেন। এভাবেই নাকি হাতেমের জন্ম হয়। তার মা গুনাইয়া বিনতে আফিফ তাঈয়া-ও ছিলেন অসাধারণ দানশীলা এক নারী। তার থেকেই এই গুণটা পান হাতেম।

হাতেমের মা প্রায়ই বলতেন, ছোটবেলায় হাতেম আর তার ভাইকে যখন দুধ খাওয়াতেন তখন হাতেম এক স্তন কখনই মুখে পুরতেন না যতক্ষণ না তার ভাই অন্য স্তন মুখে পুরে। খুব ছোট বয়সেই বাবা আব্দুল্লাহকে হারান হাতেম। এরপর দাদা সা’দের কাছে বড় হন তিনি।

হাতেমের বাড়ি ছিল এখানেই; Image Courtesy: Pytheya.blogspot.com

শহরের আর বাকি ৬,০০০ শিশুর সাথেই বেড়ে উঠতে লাগলেন হাতেম। জীবনে কোনোদিন কোনো গালি মুখে আনেননি। সকলের প্রতি ছিলেন দয়ালু। রাজ্যের সকলেই তাকে বড্ড ভালোবাসত।

একবার এক কাফেলা হাইল অঞ্চল দিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তাদের খাবার শেষ হয়ে যায়। তারা পথিমধ্যে বালক হাতেমের দেখা পান এবং তাকে অবস্থার কথা বলেন। হাতেম জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কত জন? তারা উত্তর করল, ১২ জন। সাথে সাথে হাতেম তাদের জন্য ১২টি উট জবাই করে ফেললেন, তার দাদার উট। অথচ কেবল একটি উটই যথেষ্ট ছিল অর্ধশতাধিক মানুষের জন্য! এ খবর দাদার কাছে পৌঁছালে তিনি এই ঘটনাকে অপচয় বলে মন্তব্য করেন এবং হাতেমকে ত্যাগ করেন! তবে দাদা মারা গেলে রাজা হন রাজপুত্র হাতেম তাঈ।

হাতেমের দানশীলতার গল্প দেশ বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। বাইজান্টাইন সম্রাট এই ঘটনার সত্যতা পরীক্ষা করতে চাইলেন। তিনি শুনেছিলেন, হাতেম আর যাই বিলিয়ে দিক না কেন, কখনোই তার ঘোড়া দেন না, এটা নাকি তার খুব প্রিয়। সম্রাট দরবার থেকে এক লোককে পাঠালেন। লোকটি যখন হাতেমের বাসায় পৌঁছালো তখন রাত। আর সেটা এমন মৌসুম ছিল যে সব ঘোড়া অনেক দূরে এক অঞ্চলে চড়াতে নিয়ে যেতে হত। বাসায় হাতেমের নিজের ঘোড়া বাদে আর কোন ঘোড়া ছিল না। রাতে ভালো মতই আপ্যায়ন করলেন হাতেম। লোকটি মুগ্ধ হয়ে গেল।

পরদিন সকালে লোকটি হাতেমকে বলল, সম্রাট হাতেমের ঘোড়াটি চেয়েছেন। হাতেম সাথে সাথে বিচলিত হয়ে পড়লেন। বললেন, “কাল রাত্রে এসেই এই কথা বললেই পারতেন! আমি তো আপনার আতিথেয়তার জন্য এ বাসায় থাকা একমাত্র ঘোড়াটি জবাই করেছি কাল, ওটাই আমার ঘোড়া ছিল, আমি চাইনি একজন অতিথি আসবেন আর ভালোমন্দ খাওয়াতে পারব না!” [উল্লেখ্য, আরবে জনপ্রিয় খাবার ছিল ঘোড়ার মাংস।] হাতেম তার সেরা ঘোড়াগুলো লোকটিকে দিয়ে দিতে চাইলেন। পুরো ঘটনা শুনে সম্রাট একমত হলেন, হাতেমের চেয়ে দানশীল আর কেউ হতে পারে না। তার সম্পর্কে শোনা কথাগুলো সত্য।

ইয়েমেনের রাজা নুমান হাতেমের নামে এত সুখ্যাতি শুনে খুবই ঈর্ষান্বিত হন। তিনি তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চাইলেন, এজন্য এক অ্যাসাসিন বা গুপ্তঘাতক প্রেরণ করেন হা’ইল নগরীর উদ্দেশ্যে। তখন তারা মরুতে তাঁবু করে ছিল। সমস্যা হলো, গুপ্তঘাতক হাতেমকে কোনোদিন দেখেনি, তাই চিনতেও পারবে না। ওখানে পৌঁছে সে আশ্রয় নিল একজনের কাছে। প্রচুর খাওয়াদাওয়া করার পর গুপ্তঘাতক বেরিয়ে যেতে চাইলেন, কিন্তু দয়ালু লোকটি তাকে জিজ্ঞেস আরো থেকে যেতে বললেন। গুপ্তঘাতক বলল, “কিন্তু আমার যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।” আরব লোকটি তখন বললেন, “অনুগ্রহ করে আমাকে সেই কাজে সাহায্য করতে দিন।

তখন গুপ্তঘাতক তার উদ্দেশ্য বলল এবং অবশেষে তাকে অনুরোধ করল যেন হাতেম তাঈকে চিনিয়ে দেয়। সাথে সাথে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন আরব, এরপর বললেন, “কাটুন আমার মাথা, আমিই হাতেম, আশা করি আপনার রাজা সন্তুষ্ট হবেন আর আপনাকে পুরস্কৃত করবেন। এখনই রাতের আঁধার। কেউ জানবেও না।

খোদার কসম, আমি আপনার উপর একটা হাতও উঠাতে পারব না!” বলল গুপ্তঘাতক। সাথে সাথে সে চলে গেল এবং ইয়েমেনের রাজা নুমানকে ঘটনা জানালো। নুমান বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল, “হাতেম! তুমি আসলেই স্বর্গীয়!

ওদিকে আরো একজন আরব রাজা হাতেম তাঈর রাজ্য কেড়ে নিতে চাইতেন। তিনি হাতেমের কাছে আত্মসমর্পণের আহ্বান করে পত্র দিলেন। সকলেই বললেন, এ রাজ্যের অনেকেই আপনার জন্য রক্ত দেবে জীবন দেবে, আমরা যুদ্ধ করব। কিন্তু হাতেম বললেন, তিনি তার জন্য একজনকেও রক্ত ঝরাতে দেবেন না।

হাতেম রাজ্য ত্যাগ করে এক গুহায় চলে গেলেন, আর সেখানেই একাকী বাস করতে লাগলেন। ওদিকে রাজা এসে রাজাহীন রাজ্য দখল করে নিলেন বিনা রক্তপাতে, কিন্তু অনুভব করলেন যে, সবার আনুগত্য আসলে আগের রাজা হাতেমের প্রতিই। তিনি ঘোষণা করলেন, যে হাতেমকে ধরিয়ে দিতে পারবে তাকে ৫,০০০ স্বর্ণমুদ্রা দেয়া হবে।

ঘটনাক্রমে হাতেম যেখানে থাকতেন, তার কাছেই এক কাঠুরে পরিবার থাকত। একদিন ছদ্মবেশী হাতেম শুনলেন, কাঠুরে বলছে স্ত্রীকে, “আমি তো এখন বুড়ো, আমরা যদি হাতেমকে ধরে দিতে পারতাম তাহলে অন্তত বাচ্চাগুলোর জন্য কিছু করে যেতে পারতাম।” তখন স্ত্রী তাকে কড়া ভাষায় এ জঘন্য কথা বলবার জন্য শাসায়।

এ কথাগুলো চলবার সময়ই হাতেম নিজেকে প্রকাশ করে বললেন, “এই নাও, আমি ধরা দিচ্ছি, এতে যদি তোমার পরিবারের উপকার হয়, তবে এ মৃত্যুতেই সার্থকতা।” বুড়ো লোকটি লজ্জায় শেষ হয়ে গেল, “না না, আমি এ কাজ পারব না।” তার চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল।

ওদিকে আশপাশের লোকজন হাতেমকে দেখে তাকে বেঁধে ফেলল এবং অর্থলোভে তাকে রাজার কাছে নিয়ে গেল। পেছন পেছন গেল সেই কাঠুরে। সকলে দাবি করতে লাগল যে সে নিজেই হাতেমকে ধরেছে, আর হাতেম ও কাঠুরে নীরবে দেখতে লাগলো। অবশেষে হাতেম নিজেই বললেন, “সকলের সামনে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, এই কাঠুরে লোকটিই আমাকে ধরেছে, তাকে ৫,০০০ সোনার মুদ্রা দেয়া হোক।


রাজা এতটাই অবাক হলেন হাতেমের কথাতে যে তিনি হাতেমকে তার রাজ্য ফিরিয়ে দিলেন আর তার সৈন্য সামন্ত নিয়ে চলে গেলেন।

হাতেম তাঈ-র প্রথম স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেন তার দুই ছেলে আব্দুল্লাহ এবং আদি ইবনে হাতেম তাঈ এবং এক কন্যা সুফানা। যতদিন স্ত্রী বেঁচে ছিলেন তিনি বিয়ে করেননি আর। কিন্তু প্রথম স্ত্রী মারা যান।

হাতেম নিজে কবি মানুষ ছিলেন। ঘাসান এর রাজকন্যা ছিলেন মাই’আ বা মারিয়া। তিনি ছিলেন রূপবতী আর তাকে বিয়ে করতে অনেক রাজপুত্র বা রাজা উন্মুখ ছিলেন। মারিয়াকে কবিতা শুনিয়ে মুগ্ধ করতে চেষ্টা করে দুবিয়ানের বিখ্যাত কবি নাবিঘা, এবং নাবিত গোত্রের আরেকজন। কিন্তু হাতেমের কবিতাই পছন্দ হয় মারিয়ার। হাতেমের কবিতার শুরুটা ছিলঃ “হে মারিয়া! সম্পদ সকালে আসে তো বিকেলেই বিদায় নেয়…

মারিয়া তিনজনের বাড়িতেই এক গরিব দুঃখিনী সেজে যান। তারা তাকে খাওয়াতে প্রত্যেকেই উট জবাই দেয়, কিন্তু বাকি দুজন যেখানে তাকে লেজ খেতে দিয়েছিল, সেখানে হাতেম তাকে সেরা গোশতের টুকরোটা দিয়েছিলেন। যেদিন তারা মারিয়াকে কবিতা শোনাতে এলেন, সেদিন তিনি তাদের পাত্রে নিজের হাতে তুলে দিলেন; দুজনের পাত্রে দিলেন লেজ আর হাতেমের পাত্রে সেরা গোশতের টুকরো। সাথে সাথে তারা বুঝতে পারল সেই গরিব মেয়েটি ছদ্মবেশে মারিয়াই ছিল।

শেষ পর্যন্ত মারিয়া হয় হাতেম তাঈ এর দ্বিতীয় স্ত্রী।

হাতেম যখন মারা গিয়েছিলেন তখন তার কবর হয় এক পাহাড়ের চূড়োয়। তার কবরের উপর দুটো পাথরের পাত্রের আকারে ভাস্কর্য বানানো হয় (যা তার দানশীলতা প্রকাশ করে, যে পাত্র থেকে তিনি গরিবদের খাওয়াতেন।) সাথে ছিল চারজন বিলাপী মেয়ের মূর্তি। বাতাস যখন সেই মূর্তি গুলোকে আঘাত করত, এমন শব্দ হতো যেন শুনে মনে হতো, মূর্তিগুলো বিলাপ করছে।


কথিত আছে, একবার এক দল মুসাফির তার কবরের কাছে রাত কাটায়, আর কবরের কাছে এসে বলে, আজ রাত্রে আমরা তোমার অতিথি, হাতেম। সেদিন রাত্রে তাদের এক উট অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাই সেটাকে মেরে তাদের খেতে হয়। ভালোই উদরপূর্তি করে সে রাতে তারা। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তারা দেখে রাজা আদি ইবনে হাতেম তাঈ (রাঃ) এক উট নিয়ে এসেছেন তাদের জন্য। তিনি নাকি রাত্রে স্বপ্নে দেখেছেন, তার বাবা এসে তাকে বলছেন, তিনি যে উটটাকে মেরেছেন অতিথিদের খাওয়াতে সেটার জায়গায় নতুন একটি উট দিয়ে আসো। এ ঘটনা শেষ পর্যন্ত আলিফ লায়লার ২৭০তম রজনীর কাহিনী হয়ে দাঁড়ায়।


হাতেম তাঈ মারা যাবার পর রাজা হয় তার ছেলে আদি ইবনে হাতিম তাঈ। তিনি অবশ্য হাতেমের মতো ছিলেন না, বরং তিনি ২৫% খাজনা আদায় করতেন সকলের কাছ থেকে। তাছাড়া খ্রিস্ট ধর্মের পাশাপাশি তারা মূর্তিপূজাও শুরু করে দেয়- অনেকটা হাইব্রিড এক ধর্ম। তার রাজত্বের শেষ দিকে এসে তিনি আবারো তাঈ বংশের হাইল রাজ্য হারাবার আশংকায় পড়েন আরেকজন আরব নেতার কাছে। সে আরব নেতা আর কেউ নন, ইসলাম ধর্মের শেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.)। আদি’র নিজের ভাষ্যমতে তিনি প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন মুহাম্মাদ (সা.)-কে।

হাতেম তাঈ যখন মারা গিয়েছিলেন, তখন মুহাম্মাদ (সা.) এর বয়স ছিল মাত্র আট বছর। সেটা ছিল ৫৭৮ সাল। বহু বছর পর ৬৩০ সালে তাঈ বংশ থেকে পৌত্তলিকতা অপসারণের জন্য আলি (রা.)-কে প্রেরণ করেন মুহাম্মাদ (সা.)। হাইল বিজয় করে মুসলিম বাহিনী। আর রাজপরিবার ও তাঈ সেনাবাহিনী যুদ্ধবন্দী হয়ে পড়ে। রাজা আদি ইবনে হাতিম তাঈ পালিয়ে সিরিয়া চলে যান।

যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে ছিলেন সুফানা, হাতিমের কন্যা। সাথে আরো প্রায় নয়শ বন্দী ছিল। সুফফানা নবীর কাছে অনুরোধ করেন ভাইকে খুঁজতে যাবার অনুমতি দিতে। মুহাম্মাদ (সা.) হাতেম তাঈর বদান্যতা স্মরণ করে তাকে ভালো কাপড় চোপড় দিয়ে, টাকা পয়সা আর ভালো বাহন দিয়ে পাঠান। যেদিন তিনি তার ভাই আদি-কে খুঁজে পান, তখন আদি বিশ্বাস করতে পারেননি সুফফানার এত ভালো অবস্থা দেখে। তখন আদি নিজেই নবী(সা.)-এর কাছে আসেন। তিনি ভেবেছিলেন কোন প্রাসাদ দেখবেন, কিন্তু দেখলেন সামান্য এক মসজিদ।


নবীজী (সা.) তার শত্রু আদি ইবনে হাতিম (রা)-কে বসালেন কুশনে, সেই কুশন আবার সামান্য খেঁজুর পাতাতে তৈরি। আর নবীজী (সা.) নিজে বসলেন মাটিতে। বললেন, “তুমি প্রজাদের থেকে ২৫% খাজনা চাও, তাই না?” আদি বললেন, “হ্যাঁ।

নবীজী বললেন, “এটা কিন্তু তোমার ধর্মে অবৈধ।

আদি বললেন, “তা ঠিক

আদি তার পিতা হাতেম তাঈ এর কথা জানালেন, নবীজী তাকে আগেই চিনতেন, যদিও ইসলাম আসবার আগেই হাতেম দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। নবীজী বললেন, “তোমার বাবা স্মরণীয় হয়ে থাকতে চেয়েছিলেন।

এরপর তিনি আদি-কে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান করলেন। সাথে সাথে তিনি ইসলাম গ্রহণ করে ফেলেন। সাথে সাথে সকল যুদ্ধবন্দী এবং হাইল শহরের সকলেই ইসলাম গ্রহণ করে ফেলেন। অবশ্য কবি জুহাইর এর লেখনি থেকে জানা যায়, হাতেম তাঈ নাকি তার খ্রিস্ট ধর্মগ্রন্থ থেকে ধারণা লাভ করে আগে থেকেই তার সন্তানদের আসন্ন আরবীয় নবীর ব্যাপারে বলে গিয়েছিলেন, কিন্তু ৫০ বছর পেরিয়ে সে কথার মূল্য হারিয়ে ফেলে তার সন্তানেরা।

দু বছর পর মুহাম্মাদ (সা.) মারা যাবার পর আরবের অনেক গোত্র ইসলাম ত্যাগ করে। কিন্তু হাতেম তাঈ এর গোত্র এই কঠিন সময়েও মুসলিম থেকে যায়। বরং তারা আলী (রা.) এর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জামাল ও সিফফিনের যুদ্ধে ছিল।


হাতেম তাঈ এর কেচ্ছাকাহিনী নিয়ে অনেক বই লিখা হয়েছে, তবে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে রূপবতী হুসনে বানু-র সাত ধাঁধার জন্য সাতটি দুর্ধর্ষ অভিযানের রূপকথা। কিন্তু কেবল রূপকথা হবার কারণে সে কাহিনী আর এখানে বর্ণনা করা হলো না।


যুগ যুগ ধরে মহত্ত্বের প্রতীক হাতেম তাঈ এর মতো দানশীল ব্যক্তির আগমন যদি বার বার হতো, তবে পৃথিবীটা অন্যরকম হতো। 

সংকলিত