Translate

সোমবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০২২

তাজিমী সেজদাহ শির্ক

তা'জীমী সিজদা:রাসূল কারীম (ﷺ)'র সুন্নাহ্ নয় বরং ধর্ম ব্যবসায়ীদের আবিষ্কার তথা বিদ'আত-কুসংস্কার ও শীর্কের অন্তর্ভুক্ত 

এ কথাটি সকল মুসলমানের জানা আবশ্যক যে, মহান আল্লাহ যা কিছু নিষেধ করেছেন, তা যেমন নিষিদ্ধ, রাসূল কারীম (ﷺ) যা কিছু নিষেধ করেছেন, তাও ঠিক তেমনিভাবে নিষিদ্ধ। এতে কোনো পার্থক্য নেই। এর অমান্যকারী মূলত প্রিয় নবীজি (ﷺ)'র প্রচারিত দ্বীন অমান্যকারী নিঃসন্দেহে কাফির। মহান রাব্বুল আলামীন বলেন,
وَما آتاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَما نَهاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
" আর রাসূল (ﷺ) তোমাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন, তা গ্রহণ করো এবং তিনি তোমাদেরকে যা কিছু থেকে নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকো।"(সূরা-হাশর, আয়াত-৭)
মহান আল্লাহ অপর আয়াতে বলেন,
وما ينطق عن الهوى * إن هو إلا وحي يوحى
" আর তিনি (রাসূল কারীম) প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না। তিনি যা কিছু বলেন, তা হল- প্রত্যাদেশ, যা তাঁর উপর অবতীর্ণ করা হয়।" (সূরা-নাজম, আয়াত-৩) পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াতে এরকম বর্ণনা এসেছে।

এ বিষয়ে রাসূল কারীম (ﷺ) বলেন,
. أَلاَ وَإِنَّ مَا حَرَّمَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِثْلُ مَا حَرَّمَ اللَّهُ
 "সাবধান! নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল (ﷺ) যা কিছু হারাম ঘোষণা করেছেন, তা আল্লাহ যা কিছু হারাম ঘোষণা করেছেন তার অনুরূপ।"(ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং-১২)
এ বিষয়ে কুরআন-হাদীছের বর্ণনা সমূহ উল্লেখ করার পর আল্লামা ইবনে তাইমিয়াহ বলেন,
وقد اقامه الله مقام نفسه في أمره ونهيه واخباره وبيانه، فلا يجوز أن يفرق بين الله ورسوله في شيء من هذه الأمور.
" আর আল্লাহ তায়ালা রাসূল (ﷺ)কে কোনো বিষয়ের আদেশ দেয়া, কোনো কাজ থেকে নিষেধ করা, কোনো কিছুর সংবাদ দেয়া এবং কোনো কিছু বর্ণনা করার বিষয়ে নিজের স্থলাভিষিক্ত করেছেন। অতএব এ সকল বিষয়ের কোনো একটিতেও মহান আল্লাহ এবং রাসূল কারীম (ﷺ)'র মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা জায়েজ নেই।" ( ইবনে তাইমিয়াহ, আস্ সা'রিমুল মাসলূল আলা শা'তিমির্ রাসূল, মাকতাবা দারুল হাদীছ, কাহেরা, পৃ.৩৯)

 আলেমগণ বলেন, সিজদা দু' প্রকার। যেমন,
১). সিজদায়ে তা'ব্বুদী বা ইবাদতের উদ্দেশ্যে সিজদা,
২). সিজদায়ে তা'জীমী বা কারো সম্মানার্থে সিজদা।

                      #শরয়ী_হুকুম:
                       ------------------

প্রথম প্রকার তথা সিজদায়ে তা'ব্বুদীর শরয়ী হুকুম বর্ণনায় সকল আলেম ঐক্যমত পোষণ করে বলেন, এ সিজদা যদি কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করে, তাহলে নিঃসন্দেহে কাফির হয়ে যাবে।

দ্বিতীয় প্রকার সিজদা তথা সিজদায়ে তা'জীমীর শরয়ীয় হুকুম বর্ণনায় আলেমগণ বলেন, কারো সম্মানার্থে সিজদা করা কাবিরাহ গোনাহ্। কেউ কেউ কুফরীও বলেছেন। যেমন, প্রখ্যাত হানাফী ফকীহ শামসূল আইয়িম্মাহ আস্ সারাখসী (রা:) বলেন,
السجود لغير الله تعالي على وجه التعظيم كفر
" আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য সিজদা করা কুফরী"(ইবনে আবেদীন রাহ., রদ্দুল মুহ্তার, কিতাবুল ইকরাহ)

মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করা হারাম ঘোষণা করে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা বলেন,
لا تَسْجُدُوا لِلشَّمْسِ وَلا لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوا لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَهُنَّ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ.
"তোমরা সূর্যকে সিজদা করো না, চাঁদকেও নয়। সিজদা করো আল্লাহকেই, যদি তোমরা একান্ত মনে তাঁর ইবাদতকারী হয়ে থাকো।(সূরা-হা-মীম আস্ সাজদা, আয়াত-৩৭)
কিন্তু কুর'আনের অন্যান্য আয়াতে এ রকম ও আছে যে, আল্লাহ তায়ালা ফেরেস্তাগণকে হযরত আদম (আ:)কে সম্মান সূচক সিজদা দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন এবং তাঁরা তাঁকে (আদম) সিজদা করেছিলেন। হযরত ইউসুফ (আ:)কেও তাঁর ভাইয়েরা সিজদা করেছিলেন,(সূরা বাকারাহ, সূরা-ইউসূফ) যা দ্বারা এ যুগের কিছু পথভ্রষ্ট লোক তা'জীমী সিজদা বৈধ বলে মনগড়া দলিল দিয়ে থাকে।
 এ ব্যাপারে মুফাচ্চিরগণ বলেন, পূর্ববর্তী নবীগণের শরিয়তে কাউকে সম্মান সূচক সিজদা করা বৈধ ছিল। কোনো কোনো মুফাচ্চির এ কথাও বলেছেন যে, তা মূলত সিজদা ছিল না, ছিল সম্মানার্থে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানানো। "সিজদা" শব্দ দ্বারা রুকু করা বা মাথা ঝুঁকানোও বুঝানো হয়। যেমন, সূরা বাকারার ৫৮ নং এবং সূরা-আ'রাফের ১৬১ নং আয়াতে এসেছে,
وادخلوا الباب سجدا
" আর তোমরা সিজদারত অবস্থায় দরজা দিয়ে প্রবেশ করো।" এ আয়াতের তাফসীরে রয়ীসূল মুফাচ্চিরীন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, এ আয়াতে সিজদা দ্বারা রুকুকেই বুঝানো হয়েছে।(তাফসীরে ইবনে কাছীর)
 সূরা বাকারার ৫৮ নং আয়াতের তাফসীরে (যে আয়াতে ফেরেস্তাগণ আদম আলাইহিস্ সালামকে সিজদা করার কথা বলা হয়েছে)  প্রখ্যাত মুফাচ্চির আবু আব্দুল্লাহ আল-কুরতুবী (রা:) তাঁর সর্বজন সমাদৃত তাফসীর গ্রন্থ "আল-জামেউ লিআহকামিল কুরআ"এ তা'জীমী সিজদার নিষেধাজ্ঞা বিষয়ক রাসূল কারীম (ﷺ) থেকে বর্ণিত হাদীছ সমূহ উল্লেখ করার পর বলেন,
وَهَذَا السُّجُودُ الْمَنْهِيُّ عَنْهُ قَدِ اتَّخَذَهُ جُهَّالُ الْمُتَصَوِّفَةِ عَادَةً فِي سَمَاعِهِمْ وَعِنْدَ دُخُولِهِمْ عَلَى مَشَايِخِهِمْ وَاسْتِغْفَارِهِمْ، فَيُرَى الْوَاحِدُ مِنْهُمْ إِذَا أَخَذَهُ الْحَالُ بِزَعْمِهِ يَسْجُدُ لِلْأَقْدَامِ لِجَهْلِهِ سَوَاءٌ أَكَانَ لِلْقِبْلَةِ أَمْ غَيْرِهَا جَهَالَةً مِنْهُ، ضَلَّ سَعْيُهُمْ وَخَابَ عَمَلُهُمْ.
" এ সব হাদীছে যে সিজদা নিষেধ করা হয়েছে, মূর্খ সূফীরা সে সিজদাকেই তাদের রীতিতে পরিণত করে নিয়েছে তাদের সামা'র মজলিসে, তাদের পীর-মাশাইখের নিকট প্রবেশের সময় এবং ইস্তিগফারের সময়। তাদের কাউকে কাউকে দেখা যায় যে, যখন তার ধারণা মত তার হাল এসে যায়, তখন সে কিবলামুখী হয়ে কিংবা অন্যমুখী হয়ে (পীরের) পায়ের কাছে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। মূর্খতার কারণে সে এরূপ করে। তাদের প্রচেষ্টা নিষ্ফল হয়েছে এবং তাদের কর্ম বিফল হয়ে গেছে।"

অতএব ঐ সকল আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা করে তা'জীমী সিজদা কখনোই বৈধ বলা যাবে না। কারণ, এ প্রকার সিজদা (তা'জীমী) স্বয়ং শরিয়ত প্রণেতা, তাজেদারে কায়েনাত, হাবীবুর রহমান, শাফীউল মুযনিবীন, রাহমাতুল্লিল আলামীন, প্রিয় নবীজি (ﷺ)ই হারাম ঘোষণা করেছেন, যা অনেক সহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। যেমন, 

১. গাছপালা ও বোধশক্তিহীন জন্তু রাসূল কারীম (ﷺ)কে সিজদা করতে দেখে সাহাবায়ে কেরামও তাঁকে সিজদা করার অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি বলেন, 
لا آمُرُ أَحَدًا أن يَسجُدَ لأَحَدٍ ولو أَمَرْتُ أَحَدًا أن يسجُدَ لأَحَدٍ لأمرتُ المرأةَ أن تسجُدَ لزوجِها.
" আমি কোনো মানুষ (আল্লাহ ছাড়া) অন্য কাউকে সিজদা করার অনুমতি দেই না। যদি আমি কোনো মানুষ (আল্লাহ ছাড়া) অন্য কাউকে সিজদা করার অনুমতি দিতাম, তাহলে অবশ্যই মহিলাদের তাদের স্বামীকে সিজদা করার আদেশ দিতাম।"(ইবনে কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, খ. ৬, পৃ.১৪৪,
আলবানী, সিলসিলা সহীহা, খ.৭,পৃ.১৪৩৫)

২. অপর বর্ণনায় এসেছে, একবার হযরত মা'আয বিন জাবাল (রা:) সিরিয়ায় (অপর বর্ণনা মতে ইয়ামেনে) থাকাকালীন তথাকার লোকজন তাদের ধর্মীয় নেতা ও শাসকদের সিজদা করতে দেখলে মদীনা শরীফ ফিরে রাসূল কারীম (ﷺ)'র সাথে সাক্ষাৎ হওয়া মাত্র (সম্মানসূচক) সিজদা করেছিলেন, যার জন্য ভবিষ্যতে আর কখনো ঐ ধরনের সিজদা করতে বারণ করে রাসূল কারীম (ﷺ) বলেন,
فلا تفعلوا فإني لو كنت آمرا أحدا أن يسجد لغير الله لأمرت المرأة أن تسجد لزوجها.
" তোমরা এ কাজ (তা'জীমী) সিজদা আর কখনোই করবে না। যদি আমি কোনো মানুষ মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করার অনুমতি দিতাম, তাহলে অবশ্যই মহিলাদের তাদের স্বামীকে সিজদা করার আদেশ দিতাম।(ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং-১৯২৬) 

৩. অপর বর্ণনায় এসেছে, একবার এক আ'রাবি (গ্রাম্য লোক) রাসূল কারীম (ﷺ)'র নিকট এসে তাঁকে সিজদা করার অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি বলেন,
لو كنت آمرا أحدا يسجد لأحد لأمرت المرأة تسجد لزوجها
"যদি আমি কোনো মানুষ (আল্লাহ ছাড়া) অন্য কাউকে সিজদা করার অনুমতি দিতাম, তাহলে অবশ্যই মহিলাদের তাদের স্বামীকে সিজদা করার আদেশ দিতাম।"(প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম আবু আব্দুর রহমান আদ্ দারেমী (রা:) তাঁর সূনানে কিতাবুস্ সালাতের অন্তর্গত "باب النهي أن يسجد لأحد"এ বর্ণনা করেছেন)  হাদীছের এ বক্তব্যটি সুনানে তিরমীযি, সূনানে ইবনে মাজাহ, সূনানে দারেমী, মুসনাদে আহমদ ও সহীহ ইবনে হিব্বান সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ হাদীছ গ্রন্থে (হাসান ও সহীহ সনদে) হযরত মু'আয বিন জাবাল, আবু হুরায়রা, আব্দুল্লাহ বিন উমার, আনাস বিন মালিক, যায়েদ বিন আরকাম, বুরাইদাহ, সুরাকাহ বিন মালিক, মা আয়েশা ছিদ্দীকা, আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস,  আব্দুল্লাহ বিন আবী আওফা ও মা উম্মে সালামাহ (رضوان الله عليهم اجمعين) থেকে বর্ণিত আছে। এমনকি দ্বয়ীফ হাদীছও যদি এভাবে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়, তাহলে তা আর দ্বয়ীফ থাকে না। অতএব, এ সকল বর্ণনা দ্বয়ীফ বলে দিয়ে মনগড়া ব্যাখ্যার মাধ্যমে তা'জীমী সিজদা বৈধ ঘোষণা হয় সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সাথে ধোঁকাবাজি, না হয় উলূমুল হাদীছ বিষয়ে গণ্ড মূর্খতা।

৪. মাজার বা কবরে সিজদা করার ভয়াবহ পরিণতি বর্ণনায় রাসূল কারীম (ﷺ) তাঁর ইন্তেকালের পূর্বমুহূর্তে বলেন,
لعن الله اليهود والنصارى، اتخذوا قبور أنبيائهم مسجدا
"ইয়াহুদী ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রতি আল্লাহর লা’নত করেছেন। (কারণ,) তারা তাদের নবীদের কবরকে সিজদা করার স্থানে পরিণত করেছিল।"
 এ প্রসঙ্গে হযরত উম্মুল মু'মিনীন আয়িশা ছিদ্দিকা (রা:) বলেন, সে আশঙ্কা (সিজদার স্থানে পরিণত করার আশঙ্কা) না থাকলে নাবী কারীম (ﷺ)'র
 কবর শরীফ উম্মুক্ত রাখা হত, কিন্তু আমার আশংকা হয় যে, তা খুলে দেয়া হলে সিজদার স্থানে পরিণত করা হবে।

অতএব, কুরআন মতে তা'জীমী সিজদা বৈধ হওয়ার কথা বলে রাসূলে পাক (ﷺ) কর্তৃক হারাম ঘোষণাকে অগ্রাহ্য করা পুরো ইসলামী শরীয়ত অমান্য করারই নামান্তর। 

এ বিষয়ে অমুক হুজুর-তমুক হুজুর বলেছেন বলে রাস্তা বের করার নির্লজ্জ চেষ্টা করা মূলত অমুক-তমুক হুজুরকে রাসূল কারীম (ﷺ)'র উপরে প্রাধান্য দেয়া।(নাঊযূবিল্লাহ্) 

 শরীয়তের মালিক কোনো পীর-মৌলভী নয়, শরীয়তের মালিক হলেন- মহান রাব্বুল আলামীন যার উসিলায় পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন,শরীয়ত সৃষ্টি করেছেন তিনি তথা মুহাম্মাদুর্ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ). 
এক কথায় তাজিমী সেজদাহ  শির্ক  এর থেকে সকল কে বিরত থাকার তাওফিক দান করুক আমিন। 


হে আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলের ইমান-আকিদাহ হেফাজত করুন!প্রকৃত আহলে সুন্নাতের অনুসারী হওয়ার তাওফিক দান করুক আমিন।