Translate

বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০১৩

নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ , কয়েকটি ধারা ও কোরআনের ভাষ্য বা সাংঘ্ষীক


বর্তমান সরকার নারী উন্নয়ন নীতিমালার নামে যে খসড়া নীতি অনুমোদন করেছে, তা সিডও বাস্তবায়নের অঙ্গীকারের একটি কৌশলপত্র মাত্র। সিডও সনদের ধারাগুলোর হুবহু প্রতিধ্বনি করা হয়েছে নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ এর খসড়ায়।
সিডও সনদে মুসলিম দেশগুলোর পক্ষ থেকে যেসব ধারার উপর আপত্তি জানানো হয়েছে সেগুলো হলো— ২, ৩, ৯, ১৩ এবং ১৬ নং ধারা। এই ধারাগুলোর বক্তব্য আমরা হুবহু উদ্ধৃত করছি।
২. অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে—নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্যের প্রতি নিন্দা জানিয়েছে সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো। নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে তারা নিজ নিজ দেশে প্রয়োজনীয় আইন তৈরির ঘোষণা দিচ্ছে। সংবিধানে সমঅধিকারের ঘোষণা না থাকলে সমঅধিকারের নিশ্চয়তা দিয়ে সংবিধান নতুন করে প্রণয়ন করবে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব আইনকানুন ও বিধিবিধান বিলোপ করবে।
৩. রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সবক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র।
১৩. অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের সবক্ষেত্রে নারীর প্রতি সব বৈষম্য দূর করে সমতার ভিত্তিতে নারী ও পুরুষেরা সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এ অধিকারের মাঝে পারিবারিক সুযোগ-সুবিধা ও ব্যাংক লোনও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
১৫. চলাফেরার স্বাধীনতা, বাসস্থান পছন্দ এবং স্থায়ী নিবাস স্থাপনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা।
১৬. বিয়ে এবং পারিবারিক সম্পর্কসহ সব বিষয়ে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে রাষ্ট্র পদক্ষেপ নেবে এবং এসব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করবে।
১৬-১. বিবাহিত জীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার থাকবে।
১৬.২ বিবাহ, স্বামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাধিকার।
১৬-৩. বিয়ে এবং তালাকের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও সমান দায়দায়িত্ব থাকবে।
১৬-৫. শিশু লালন-পালনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও সমান দায়দায়িত্ব থাকবে।
১৬.৭ : সম্পত্তির মালিকানা, ব্যবস্থাপনা এবং বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সমান দায়িত্ব ও অধিকার।
বাংলাদেশ এই ধারাগুলোর ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিল। এতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কোরআন সুন্নাহ ও ইসলামী আইন এবং মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যে কারণে অতীতের সব কটি সরকার সিডও সনদের ইসলাম ও কোরআনবিরোধী ধারাগুলো প্রত্যাখ্যান করে আসছে। তারপরও কোন স্বার্থে বর্তমান সরকার সেই আপত্তি প্রত্যাহার করেছে
 ইসলামপ্রিয় ৯০ শতাংশ নাগরিকের আজ সেটিই জিজ্ঞাসা।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, নারী উন্নয়ন নীতিমালায় ইসলামবিরোধী কোন কিছু নেই। অথচ দেশের বিজ্ঞ আলেম-ওলামা ও ইসলামী বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নারী উন্নয়ন নীতিমালা কোরআন সুন্নাহ ও ইসলামী শরীয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বিগত ৭ মার্চ মন্ত্রিসভায় নারী উন্নয়ন নীতিমালা অনুমোদনের পর বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) পরিবেশিত খবরে বলা হয়, ‘ভূমিসহ সম্পদ-সম্পত্তিতেও উত্তরাধিকারে নারীর সমান অধিকার স্বীকৃতি দিয়ে নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ এর খসড়া অনুমোদন করছে মন্ত্রিসভা’। (প্রথম আলো, যুগান্তর, কালের কণ্ঠ)
আমাদের দৃষ্টিতে নারী উন্নয়ন নীতিমালার সমস্যাগুলো এবং ইসলামের সঙ্গে তথা কোরআন সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো নিম্নরূপ :
১. এই নীতিমালা সিডও সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারের কৌশল হিসাবে প্রণয়ন করা হয়েছে। সিডও সনদের ২, ৩, ৯, ১৩, ১৬ ধারায় ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নারীর নীতিতে সিডও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার স্পষ্ট ভাষায় বারবার ব্যক্ত করা হয়েছে। (দ্রষ্টব্য নারী উন্নয়ন নীতিমালা ৪ নং ধারার শেষ প্যারা। ৪.১, ১৭.২)
২. এই নীতিমালায় সিডও-এরই প্রতিধ্বনি করা হয়েছে মাত্র। সিডও সনদে নারীকে উপস্থাপন করা হয়েছে ইউরোপিয়ান জীবন ধারা ও সংস্কৃতির আলোকে। ফলে এই নীতিমালায় মুসলিম নারীর জীবন ধারা ও ইসলামী সংস্কৃতির মোটেই প্রতিফলন ঘটেনি, যে কারণে এই নীতিমালা ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশের জীবনাচারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমাদের বিশ্বাস, এই নীতিমালার মাধ্যমে মুসলমানদের মুসলিম সংস্কৃতি বর্জন করে ইউরোপিয়ান সংস্কৃতি অবলম্বনের দক্ষ কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে।
৩. ইসলাম নারী উন্নয়ন ও নারী অধিকারে সর্বোচ্চ প্রবক্তা হলেও এবং নারী নির্যাতনরোধে সর্বাধিক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করলেও পুরুষ প্রধান সমাজব্যবস্থার প্রবক্তা। পরামর্শের সব পর্যায়ে নারীকে সমঅধিকার প্রদান করলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অধিকার পুরুষকেই প্রদান করেছে। আল-কোরআনে এ মর্মে স্পষ্টতই উল্লেখ আছে।
দ্রষ্টব্য : সূরা বাকারা আয়াত-২২৮, সূরা নিসা : আয়াত-৩৮, বুখারি শরীফ : খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১০৫৭, মুসলিম শরীফ : খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১২২
৪. নারী উন্নয়ন নীতিমালা যেহেতু ইউরোপিয়ান নারীর কল্পচিত্রকে সামনে রেখে প্রণীত হয়েছে। অতএব, নীতিমালাটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইসলামের অলংঘনীয় বিধান পর্দার বিষয়টির প্রতি মোটেও লক্ষ রাখা হয়নি, ফলে এর অধিকাংশ ধারা পর্দার বিধান লংঘন না করে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। ফলে উন্নয়ন পরিকল্পনা হিসেবে উপস্থাপিত বিষয়গুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোরআনের বিরুদ্ধে প্রকাশ পেয়েছে এবং পর্দার বিধান লংঘন হওয়ার কারণে তা কোরআনবিরোধী বলে প্রতিপন্ন হয়েছে।
৫. ইসলাম মূলত নারী-পুরুষের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক জীবন গড়ে তুলতে চেয়েছে, নারী নীতি বাস্তবায়ন হলে তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে। অধিকারের টানাটানিতে পারিবারিক জীবন এক সংঘাতময় যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত হবে। পারিবারিক সৌহার্দ্য শেষ হয়ে যাবে, যা এখন ইউরোপের সমাজ ব্যবস্থায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এদিক থেকে এই নীতিমালা ইসলামের পারিবারিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
৬. ইসলাম পৈতৃক উত্তরাধিকারে নারীকে পুরুষের তুলনায় অর্ধেক প্রদান করেছে। এই বিধান সূরা নিসার ১১নং আয়াতের সুস্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে :
يُوصِيكُمُ اللَّهُ فِي أَوْلَادِكُمْ ۖ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنثَيَيْنِ ۚ فَإِن كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ ۖ وَإِن كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ ۚ وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِن كَانَ لَهُ وَلَدٌ ۚ فَإِن لَّمْ يَكُن لَّهُ وَلَدٌ وَوَرِثَهُ أَبَوَاهُ فَلِأُمِّهِ الثُّلُثُ ۚ فَإِن كَانَ لَهُ إِخْوَةٌ فَلِأُمِّهِ السُّدُسُ ۚ مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِي بِهَا أَوْ دَيْنٍ ۗ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ لَا تَدْرُونَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ لَكُمْ نَفْعًا ۚ فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ ۗ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا [
‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে আদেশ করেনঃ একজন পুরুষের অংশ দু?জন নারীর অংশের সমান। অতঃপর যদি শুধু নারীই হয় দু' এর অধিক, তবে তাদের জন্যে ঐ মালের তিন ভাগের দুই ভাগ যা ত্যাগ করে মরে এবং যদি একজনই হয়, তবে তার জন্যে অর্ধেক। মৃতের পিতা-মাতার মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্যে ত্যাজ্য সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ, যদি মৃতের পুত্র থাকে। যদি পুত্র না থাকে এবং পিতা-মাতাই ওয়ারিস হয়, তবে মাতা পাবে তিন ভাগের এক ভাগ। অতঃপর যদি মৃতের কয়েকজন ভাই থাকে, তবে তার মাতা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ ওছিয়্যতের পর, যা করে মরেছে কিংবা ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের পিতা ও পুত্রের মধ্যে কে তোমাদের জন্যে অধিক উপকারী তোমরা জান না। এটা আল্লাহ কতৃক নির্ধারিত অংশ নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞাতা ও প্রজ্ঞাময়।’ [সূরা নিসা : আয়াত-১১]
সুতরাং উত্তরাধিকারে যদি নারীকে পুরুষের সমান প্রদান করা হয়, তাহলে এটি হবে সুস্পষ্ট কোরআনবিরোধী।
অথচ সরকার মুখে বলছে, কোরআনবিরোধী কোনো বিষয় নারী নীতিতে নেই। সরকারের এই বক্তব্যকে অন্যক্ষেত্রে না হলেও শুধু উত্তরাধিকারের প্রশ্নে সরল অর্থে গ্রহণ করা যেত যদি সিডও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার দৃঢ়তার সঙ্গে নারী নীতিতে ব্যক্ত না করা হতো। সিডও সনদের আগে ধারাগুলো যে কুরআন সুন্নাহ ও ইসলামী জীবন দর্শনের পরিপন্থী তা আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত। যে কারণে মুসলিম দেশগুলো তা মেনে নেয়নি। স্বয়ং বাংলাদেশও সেগুলোকে কোরআন সুন্নাহর পরিপন্থী মনে করে সেগুলো সংরক্ষণ করে সিডও সনদে স্বাক্ষর করেছিল। সবক্ষেত্রে নারীর সম-অধিকারের ঘোষণার মাধ্যমে মুসলিম উত্তরাধিকার আইনকে অকার্যকর করাই যে সিডও সনদের মূল লক্ষ্য তা অন্ধজনও বুঝতে সক্ষম।
নারী নীতির ভূমিকা ২য় লাইন ৪, ৪.১, ১৬.১, ১৬.৮, ১৬.১২, ১৭.১, ১৭.৪, ২৩.৫ ধারাগুলো যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তাতে যে কোনো ব্যক্তি তাদ্বারা উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমান পাবে এই সিদ্ধান্ত উপনীত হতে পারবে। সিডও বাস্তয়নের অঙ্গীকারে আবদ্ধ সরকার পরে সেই ধারাগুলোকে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সমতার ব্যাখ্যা করবে না এ নিশ্চয়তা কে দেবে? (সংগৃহীত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন