Translate

মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

জুমার খোৎবাহ আরবীতে নাকী মাতৃভাষায় ,জুমার খোৎবা বাংলা ভাষায় দেয়া যাবে কি

জুমার খোৎবা বাংলা ভাষায় দেয়া যাবে কি ?


এটা বর্তমান সময়ের একটা মৌলিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন কারণ আজকাল অনেকে জুমা বা ঈদের খোৎবাকে ওয়াজ নসিহত মনে করে আরবী খোৎবার বিপরীতে বাংলা বা ইংরেজীতে , বা বাংলা আরবী ও ইংরেজী ইত্যাদি ভাষার সংমিশ্রনে খোৎবা দিয়ে থকেন।এই জন্য আমাদের সকলের কাছে এ বিষয়টি পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন যে,আসলে জুমার এ খোৎবাটি নিচক বক্ততা,না জিকিরের অন্তর্ভূক্ত। তাই এ ব্যাপারে আমি আহলে হক্ব মিডিয়ার প্রশ্নো্ত্তর পর্বে আমি ফতোয়া তলব করেছিলাম , সন্মানীত মুফতি লুৎফুর রহমান ফরায়েজী ছাঃ পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা এর কাছে । তখন তিনি যে উত্তরটি প্রদান করেছিলেন সর্ব প্রথম আমি তা হুবহু তুলে ধরছি।

আচ্ছালামু আলইকুম ,

প্রশ্ন:—- আমাদের দেশে সচরাচর আরবীতেই খুৎবা দিয়ে থাকেন , আবার ইদানীং কোথাও কোথাও শুধু বাংলাতেই খুৎবার প্রচলন দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে অনেক দেশ যেখানে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ ও অন্যান্য ভাষার লোকজন ও আছে সেখানে , বাংলা আরবী ইংরেজী ইত্যাদীর সংমিশ্রনে খোৎবা দিয়ে থাকেন । এমনটি জায়েয কিনা ?আর আমাদের দেশে আরবীর সংমিশ্রনে বাংলাতে খোৎবা দেয়া যাবে কি ?

এম এম আবদুল্লাহ ভূঁইয়া,মক্কা সৌদি আরব

উত্তর

وعليكم السلام ورحنة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

জুমআর খুতবা অন্য কোন ভাষায় প্রদান করা বিদআত। আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষায় খুতবা প্রদান করা রাসূল সাঃ এবং পরবর্তীতে কোন সাহাবী থেকেই প্রমাণিত নয়।

নবীজী সাঃ এর মৃত্যুকালের শেষ সময়ে আরবের বাহিরের অনেক অনারবী মুসলমানই মসজিদে নববীতে এসে নামায পড়তো। কিন্তু কোনদিনও কোন জুমআর খুতবা অন্য ভাষায় অনুবাদ করা হয়নি।

সাহাবায়ে কেরামের জমানায় এর কোন নজীর পাওয়া যায় না। হযরত উমর রাঃ এর জমানায় অনারবী মানুষে ভরে গিয়েছিল মদীনা। কিন্তু কোনদিন মসজিদে নববীতে জুমআর খুতবা আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় দেয়া হয়েছে বা দোভাষী দিয়ে অন্য ভাষায় তা অনুবাদ করা হয়েছে এর কোন নজীর নেই।

সেই সাথে সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন দেশে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে গেছেন। সেসব রাষ্ট্রে ইসলামের আলো ছড়িয়েছেন। কিন্তু অনারবী রাষ্ট্রে এসে আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় খুতবা দিয়েছেন বা তাদের আরবী খুতবা অন্য ভাষায় অনুবাদ করে জুমআর সময় শুনানো হয়েছে এর কোন নজীর নেই।

যে কাজ রাসূল সাঃ করেননি, বা পরবর্তী সাহাবায়ে কেরাম করেননি। সে কাজ দ্বীন হিসেবে করা সুনিশ্চিতভাবেই বিদআত। এতে কোন সন্দেহ নেই। তাই জুমআর খুতবা আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষায় প্রদান করা বিদআত। এটি পরিত্যাজ্য।

নামাযের কিরাত যেমন আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষায় পড়া বিদআত। ঠিক তেমনি জুমআর খুতবা আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষায় দেয়া বিদআত।

যারা এ বিদআতি কাজটি করে যাচ্ছেন, তাদের কাছে এ বিষয়ে রাসুল সাঃ থেকে এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে সহীহ হাদীসের দলীল চান। তাহলেই দেখবেন, দলীল নয় মনের খাহেশাতই হচ্ছে তাদের দলীল।

সুতরাং এ বিদআতি কাজ থেকে সকলেরই বিরত থাকতে হবে।

হযরত ইরবাস বিন সারিয়া রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন,

مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ يَرَى بَعْدِي اخْتِلَافًا كَثِيرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ، وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ، فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ، وَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ

তোমাদের মাঝে আমার পর জীবিত থাকবে, তারা অনেক মতভেদ দেখবে। তখন তোমাদের উপর আমার এবং আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত আঁকড়ে ধরবে। সেটিকে মাড়ির দাত দিয়ে কামড়ে রাখবে। আর সাবধান থাকবে নব উদ্ভাবিত ধর্মীয় বিষয় থেকে। কেননা ধর্ম বিষয়ে প্রতিটি নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৭১৪৪}

عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ»

হযরত আয়শা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের ধর্মে নেই এমন বিষয় ধর্মীয় বিষয় বলে আবিস্কার করে তা পরিত্যাজ্য। {সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৭১৮, বুখারী, হাদীস নং-২৬৯৭}

একটি মনগড়া কিয়াসের জবাব:- যারা রাসূল সাঃ ও সাহাবায়ে কেরামের পদ্ধতিকে বাদ দিয়ে নিজের নফসের পূজা করে আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় খুতবা দিয়ে থাকেন, তারা কুরআন ও হাদীস রেখে নিজের অজ্ঞ মস্তিস্কপ্রসূত একটি ভ্রান্ত কিয়াসের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। সেটি হল, তারা বলেন, খুতবা হল একটি বক্তৃতা। আর বক্তৃতা সেই ভাষায়ই দিতে হবে, যে ভাষায় মানুষ বুঝে থাকে।

জবাব ১,খুতবা মানে শুধু বক্তৃতা এটি অজ্ঞতাসূচক বক্তব্য। কুরআন ও হাদীসে জুমআর খুতবাকে শুধু বক্তৃতা সাব্যস্ত করা হয়নি।বরং কুরআন-হাদিসে খুতবাকে জিকির বলা হয়েছে। প্রমান দেখুনو

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِن يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ [٦٢:٩]

মুমিনগণ, জুমআর দিনে যখন নামাযের আযান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের পানে ত্বরা কর এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝ। ( সুরা জুমা আয়াত ৯ )আই আয়াতের মধ্যকার যিকরুল্লাহ দ্বারা প্রায় সকল মুফাসসিরদের মতে খুতবা উদ্দেশ্য । (তাফসিরে রাযি ১/৪৪৬, তাফসিরে রুহুল মাআনি ২৮/১০২, তাফসিরে ইবনে আব্বাস রাঃ)হাদিসেও খুতবাকে যিকির হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ।

فإذا خرج الإمام حضرت الملائكة يستمعون الذكر

যখন ইমাম খুতবা দিতে বের হন তখন ফেরেশতারা এসে যিকির শুনে অর্থাৎ খুতবা শোনে । (বোখারি ১/৩০১, মুসলিম হাদিস নং ৮০৫)সুতরাং কুরআন তিলাওয়াত ও জিকির যেমন অন্য ভাষায় দেয়া হয় না।তেমনি খুতবাও অন্য ভাষায় দেয়ার বিধান নেই।

২,হাদীসে জুমার খুতবাকে দুই রাকাত নামজের স্থলাবিসিক্ত করা হয়েছে ।হযরত ওমর ও আয়েশা রঃ থেকে বর্ণিতحَدِيثُ عُمَرَ وَغَيْرِهِ أَنَّهُمْ قَالُوا إنَّمَا قَصُرَتْ الصَّلَاةُ لِأَجْلِ الْخُطْبَةِ জুমার নামাজ কে খুতবার জন্য ছোট করে দেওয়া হয়েছে। (ইবনে হাজার আসকালানি তালখিসুল হাবির ২/১৭৬)

كَانَتِ الْجُمُعَةُ أَرْبَعًا فَجُعِلَتِ الْخُطْبَةُ مَكَانَ الرَّكْعَتَيْنِ জুমার নামাজ চার রাকাত ছিল অতঃপর খুতবাকে দুই রাকাতের স্থলাবিসিক্ত করা হয়েছে (বাইহাকি ৫২৫৮ নং)শুধু নিছক বক্তৃতার নাম খুতবা নয়। এটি নামাযের মতই গুরুত্বপূর্ণ ও দুই রাকাতের স্থলাভিসিক্ত। তাই নামাযে যেমন আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষায় পড়া যায় না, তেমনি খুতবাও অন্য ভাষায় পড়া যাবে না।

খুতবা অন্য ভাষায় দেয়ার দাবি ইসলামকে খেলনা বস্তু বানানোর ষড়যন্ত্র

আজান, ইকামত, তাকবীর, কুরআন, তিলাওয়াত, জিকির ও খুতবা এ সবই ইসলামের প্রতীক। এর কোনটিরই অন্য ভাষায় পড়ার কোন নজীর রাসূল সাঃ থেকে নেই। নেই সাহাবায়ে কেরাম রাঃ থেকে। এমনকি তাবেয়ী বা তাবেয়ীগণ থেকেও নেই।তাই এসবকে অনুবাদ করে বলার দাবি করা ইসলামের প্রতিককে পাল্টে ফেলার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। আল্লাহ তাআলা আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় খুতবা প্রদানকারী বিদআতি ব্যক্তিদের থেকে মুসলিম উম্মাহকে হিফাযত করুন। আমীন والله اعلم بالصواب

সন্মানীত পাঠকবৃন্দ :-

আমরা উপরোক্ত ফতোয়া বা আলোচনার আলোকে জানতে পারলাম যে জুমার খোৎবা সহ দুই ঈদের খোৎবা এটা নিছক কোন বক্ততা নয় বরং এটা একটা জিকির ।এবং জুমার খোৎবা দুই রাকাত নামাজের স্হলা বিসিক্ত সুতরাং নামাজ যেমন আরবী ছাডা অন্য ভাষায় পড়ার সূযোগ নেই তেমনি জুমার খোৎবাও অন্য ভাষায় পড়ার বা দেয়ার সুযোগ নেই।খোৎবার ভেতরে বাংলা ভাষার সংমিশ্রণ করা হুজুরপাক (সা.)-এর সুন্নাতে মুতাওয়ারেছার বরখেলাপ, যা মুসলমানদের কাম্য হতে পারে না। যদি কোনো মসজিদে প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তাহলে ইমাম সাহেব খোৎবার আজানের পূর্বে অথবা জুমার নামাজের পরে খোৎবার সারমর্ম মুসল্লিগণকে বুঝিয়ে দিতে পারেন । অথবা দেশের কোন কোন স্হানে প্রচলিত আছে যে সামর্থ থাকলে তা ছাপিয়ে বিতরণ করতে পারেন। তাহলে আসুন এই নিয়ে বিশদ আলোচনার মাধ্যমে মূল কথাটি অনূধাবন করার চেষ্টা করি।

খোতবা বলতে কী বুঝায় :---

খুতবা একটি পারিভাষিক শব্দ। শরীয়তের পরিভাষায় এর স্বতন্ত্র পরিচয় রয়েছে। শুধু আভিধানিক অর্থের মাধ্যমে এর পরিচয় লাভ করা সম্ভব নয়। এটা শুধু খুতবাতে নয়; বরং ইসলামী পরিভাষায় ব্যবহৃত সকল শব্দের ক্ষেত্রে একই নিয়ম। যেমন- সালাত, যাকাত, সাওম ইত্যাদি।

সালাত শব্দের আভিধানিক অর্থ দুআ। যদি কোন ব্যক্তি পুরো দিনও দুআয় মগ্ন থাকে, তাহলে কেউ তাকে বলবে না যে, সে সালাত আদায় করছে; বরং শরীয়ত সালাত আদায়ের যে পদ্ধতি বাতলে দিয়েছে তা অবলম্বনেই একমাত্র সালাত আদায় সম্ভব।

যাকাতের আভিধানিক অর্থ পবিত্রতা। সাওম এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। কিন্তু এসব আভিধানিক অর্থ দ্বারা যাকাত ও সাওমের পরিচয় পাওয়া যায়না। শুধু পবিত্রতার মাধ্যমে যাকাত আদায়ের দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়না। যে কোনো জিনিস থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে সাওমের দায়িত্ব পালিত হয় না। কেননা, আভিধানিক অর্থের বাহিরে এসব শব্দের নিজস্ব পারিভাষিক অর্থ ও পরিচয় আছে।

শরীয়তের পরিভাষায় এসব শব্দ বিশেষ কিছু ইবাদতকেই বুঝায়। যা তার নির্ধারিত নিয়ম কানুনের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়।

এমনিভাবে খুতবার আভিধানিক অর্থ বক্তৃতা। কিন্তু এর মাধ্যমে খুতবার বাস্তবতা ও পরিচয় পাওয়া যায় না। শরীয়তের দৃষ্টিতে খুতবা সম্পাদিত হওয়ার জন্য শরীয়তের পক্ষ থেকে কিছু নিয়ম-কানুনের অনুসরণ করা অপরিহার্য। এসব নিয়ম-কানুন ও বৈশিষ্টাবলীর প্রতি লক্ষ্য করলে খুতবার শরয়ী তাৎপর্য স্পষ্ট হয়।

খুতবা দেওয়ার মাসনুন তরীকা :-- 

উপমহাদেশের বিখ্যাত ফকীহ ও মুহাদ্দিস শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী র. তার রচিত মুয়াত্তায়ে মালেকের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘মুসাফ্ফা’-তে লিখেন-

لما لاحظنا خطبة النبي (ص) وخلفائه (رض) وهلم جرا فنجد فيها وجود أشياء منها : الحمد والشهادتين والصلوة علي النبي (ص) والامر بالتقوي وتلاوة آية والدعا للمسلمين وللمسلمات وكون الخطبة عربية …………..الخ. (مصفي شرح موطأ: ১/১৫৩)

অর্থ: রাসূল স., খুলাফায়ে রাশেদীন, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন এবং পরবর্তী যুগের ফুকাহায়ে কিরাম ও উলামায়ে দীনের খুতবা সমূহ লক্ষ্য করলে দেখতে পাই যে, তাদের খুতবাতে নিম্নের বিষয়গুলো ছিলো। যথা:

আল্লাহ তাআলার হামদ্, শাহাদাতাইন (অর্থাৎ তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য) রাসূল স. এর প্রতি দরুদ, তাকওয়ার আদেশ মূলক কুরআন পাকের আয়াত, মুসলমানদের জন্য দুআ। তারা সকলেই আরবী ভাষায় খুতবা দিতেন। মুসলিম বিশ্বের বহু অঞ্চলের ভাষা অনারবী হওয়া সত্ত্বেও গোটা বিশ্বে আরবী ভাষাতেই খুতবা দিয়েছেন। (মুসাফ্ফা-খ:১ পৃ: ১৫৪)

সুতরাং রাসূল স., খুলাফায়ে রাশেদীন, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈনের খুতবার উপর ভিত্তিকরে ফুকাহায়ে কিরাম বলেন- খুতবাতে নিম্নের বিষয়গুলো থাকা সুন্নাত। যথা:

১. হামদ ২.সানা ৩.শাহাদাতাইন ৪.রাসূল স. এর উপর দরুদ ৫.তাকওয়ার আদেশ মূলক কুরআনের আয়াত ৬.আরবী ভাষায় ওয়াজ নসীহত ৭.দুই খুতবার মাঝে বসা ৮.দ্বিতীয় খুতবায় পুনরায় হামদ, সানা, শাহাদাতাইন ও দরুদ পাঠ করা। ৯.সকল মুসলমানদের জন্য দুআ করা। ১০.উভয় খুতবা নামাযের তূলনায় সংক্ষিপ্ত হওয়া ইত্যাদি।

ফিক্হ ও ফাতওয়ার গ্রন্থ থেকে উপরোক্ত বিষয়গুলোর প্রমাণ

আল্লামা কাসানী র. বলেন-

ক্স ينبغي أن يخطب خطبة خفيفة يفتتح فيها بحمد الله تعالى ويثني عليه ويتشهد ويصلي على النبي ويعظ ويذكر ويقرأ سورة ثم يجلس جلسة خفيفة ثم يقوم فيخطب خطبة أخرى يحمد الله تعالى ويثني عليه ويصلي على النبي ويدعو للمؤمنين والمؤمنات . (بدائع الصنائع: ১/৫৯১)

আল্লামা শামী র. বলেন-

ক্স قوله ( ويبدأ ) أي قبل الخطبة الأولى بالتعوذ سرا ثم بحمد الله تعالى والثناء عليه والشهادتين والصلاة على النبي والعظة والتذكير والقراءة قال في التجنيس والثانية كالأولى إلا أنه يدعو للمسلمين مكان الوعظ. (رد المحتار : ৩/২১)

وكذا في البحر الرائق: ১/২৫৮ ، فتح القدير : ২/৫৭ ،الفتاوي الهندية : ১/১৪৬-৪৭ ،حاشية الطحطاوي علي مراقي الفلاح : ص৫১৫.

খুতবার পরিমাণ:-

আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে সূরা জুমার ৯ম আয়াতে খুতবাকে ‘যিকির’ বলেছেন। এই যিকির নামক খুতবার পরিমাণ কতটুকু তা নিয়ে ইমাম আবু হানিফা র., ইমাম আবু ইউসফ র. ও ইমাম মুহাম্মদ র. এর মাঝে মত পার্থক্য রয়েছে।

ইমাম আবু হানিফা র. বলেন, খুতবাতে শুধু যিকির পাওয়া যাওয়াই শর্ত। অর্থাৎ কেউ যদি খুতবাতে শুধু যিকির করে অর্থাৎ শুধু আলহামদু লিল্লাহ বা সুবহানাল্লাহ বলে খুতবা শেষ করে, তাহলে তার নামায সহীহ হয়ে যাবে। তবে এটা মাকরূহ।

ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ র. বলেন, খুতবাতে লম্বা আলোচনা তথা: আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা, সানা, শাহাদাতাইন, রাসূল স. এর উপর দরুদ ইত্যাদি থাকা জরুরী। যার উপর খুতবা শব্দের প্রয়োগ করা যায়। তাঁরা আরো বলেন, খুতবা কমপক্ষে তাশাহহুদ পরিমাণ দীর্ঘ হওয়া জরুরী ।

আল্লামা শামী র. বলেন-

وكفت تحميدة أو تهليلة أو تسبيحة ) للخطبة المفروضة مع الكراهة وقالا لا بد من ذكر طويل وأقله قدر التشهد الواجب. (الدر المختار : ৩/২০)

অর্থ: ইমাম আবু হানিফা র.-এর মতে শুধু আলহামদু লিল্লাহ বা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বা সুবাহানাল্লাহ বলার দ্বারাই খুতবার ফরযিয়্যাত আদায় হয়ে যাবে। তবে এটা মাকরূহ। আর ইমাম আবু ইউসুফ র. ও ইমাম মুহাম্মদ র. বলেন, খুতবা তাশাহহুদ পরিমাণ দীর্ঘ হওয়া জরুরী।

আল্লামা কাসানী র. বলেন-

وصح الاقتصار في الخطبة علي ذكرخالص لله تعالي نحو تسبيحة أو تحميدة أو تهليلة او تكبيرة مع الكراهة لترك السنة عند الامام وقالا: لابد من ذكر طويل يسمي خطبة واقله قدر التشهد. (حاشية الطحطاوي: ص৫১৩، وكذا في البدائع: ১/৫৯০) 

উসুলে ফিকাহ্-এর আলোকে :-

উসুল ফিকাহ্-এর মূলনীতির আলোকে আরবি ভাষায় খোৎবা অকাট্য ও অলঙ্ঘনীয় সুন্নাত। কেনান মহানবী (সা.) খোলাফায়ে রাশেদীন, অন্যান্য সাহাবা, তাবেঈন- তবে তাবেঈন সকল মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও ফুকাহায়ে কিরাম র. ধারাবাহিকভাবে আরবী ভাষাতেই খুতবা দিয়ে আসছেন। কাজেই আরবী ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় খুতবা দেয়া শরীয়ত পরিপন্থী ও বিদআত বলে বিবেচিত হবে। (আহসানুল ফাতওয়া: ৪/১৫৪)

অর্থাৎ গোটা ইসলামের সোনালী যুগ থেকে সর্বাদা আরবি ভাষায় খোৎবা দান করা হতো বিধায়, এটি সুন্নাতে নববী, সুন্নাতে খোলাফায়ে রাশেদীন, সুন্নতে আইম্যায়ে মুজতাহেদীন , সুন্নাতে মুতাওয়াতেরা (নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিক সুন্নাত) ও সুন্নাতে মুতাওয়ারেছাহ (বা যুগপরম্পরা সুন্নাত)।সূতরাং এর বিপরীত চিন্তাভাবনা হবে বেদআত।

ইতিহাসের আলোকে :- আমরা ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাবো যে , সাহাবা, তাবেঈন এবং অপরাপর ইসলামের সিপাহশালার ও শাসকগণ অনেক অরানব রাষ্ট্র জয় করেছিলেন অনারব দেশসমূহে শ্রোতাদের প্রয়োজন কোথাও অনারবি ভাষায় খোৎবা দান করেছিলেন বলে কোনো প্রমাণ নেই।যেমন সপ্তম শতকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে আগত সাহাবা প্রতিনিধি দল, অতঃপর মেঘনার মোহনা থেকে সুদূর কক্সবাজার পর্যন্ত ব্যাপক বিচরণকারী আরব বণিক তথা দ্বীন প্রচারক দলসমূহ এবং বাংলার গ্রেট ধর্মপ্রচারক বায়েজিদ বোস্তামী, শাহ জালাল, নূর কুতুব ও খানজাহান আলী (রহ.)সহ অগণিত অলি-দরবেশ বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। তারা এখানকার মাতৃভাষায় দাওয়াহ কর্ম পরিচালনা করেছিলেন বলে ডক্টর এবনে গোলাম ছমদ, ডক্টর এনামুল হক ও আবদুল মান্নান তালিব প্রমুখ অভিমত প্রকাশ করেন। কিন্তু কোনো প্রচারকর্মী সমসাময়িক নব-মুসলিমদের কাছে বাংলায় খোৎবা দান করেছিলেন বলে আদৌ প্রমাণ নেই।

খোৎবা ও বক্ততার মধ্যে প্রার্থক্য:-

খোৎবা জিকির, না ভাষণ এ বিষয়ে মুফতি শফি (রহ.) বলেন, (ক) খোৎবার আসল উদ্দেশ্য হল জিকির, যা বিশেষ একটি ইবাদত। কিন্তু গৌণভাবে ওয়াজ-উপদেশ ও হয়ে যায় । কেননা (১) খোৎবায় দুটি ফরজ এবং পনেরটি সুন্নাত রয়েছে (আলমগীরি-১/১৪৬), যা সাধারন কোন ওয়াজ বা বক্ততায় নেই।

(২) জুমার খোৎবা হচ্ছে চার রাকাত বিশিষ্ট জোহরের ফরযের বাকি দুই রাকাত নামাজ (বাহার- ১/১০৮), (৩) খোৎবার মাঝখানে কথা বলা যাবে না (মবছুত লিচ ছুরুখছী-২/২৬), কিন্তু বক্তিতার মাঝ খানে কথা বলতে দোষ নেই

(৪) জুমার নামাজ ছহী হওয়ার খোৎবা শর্তবিশেষ (ফতহুল ক্বদীর) ও (৫) খোৎবার সময় নামাজ পড়া, কথা বলা, তাসবিহ-তাহলিল করা, সালাম দেয়া, এবং অন্যায় কাজে মৌখিক নিষেধ করা সবকিছুই নিষিদ্ধ (হেদায়া, বাহার)।তবে অন্যায় কাজের বাধা খতিবের জন্য প্রযোয্য।অথচ ওয়াজ-বক্তৃতায় এগুলো নিষিদ্ধ নয়। আর না ওয়াজের জন্য কিছু ফরজ ও সুন্নাত রয়েছে। না ওয়াজ জুমার জন্য শর্তস্বরূপ। কাজে এ কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, খোৎবা প্রচলিত ওয়াজ-বক্তৃতা নয়। - বরং জিকিরের অর্তভূক্ত।

এই বিশেষ জিকির যা ইমাম সাহেব উচ্চস্বরে করেন আর শ্রোতামন্লীড না বুঝলেও তা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করেন।

(5) নবী করিম (সা.)-এর খোৎবায় রোম, পারস্যসহ বিভিন্ন অনারব দেশের লোক শরিক হতো। তখন সাহাবীদের মধ্যে অনুবাদকর্মে সক্ষম ব্যক্তি অনেক বিদ্যমান ছিলেন। খোৎবা প্রচলিত ওয়াজ-বক্তৃতা হলে রাসূল (সা.) নিঃসন্দেহে অনুবাদের ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু খোৎবার ব্যাপারে তা করেছিলেন বলে ইতিহাসে কোথাও প্রমাণ নেই। নবী করিম (সা.)-এর পরে সাহাবীরা বাঁধ ভাঙা জোয়ারের ন্যায় অনারব দেশসমূহে ঢুকে পড়েন এবং বিজিত এলাকায় সর্বত্র জুমা ও ঈদ কায়েম করেন। প্রাদেশিক গভর্নরগণ রাষ্ট্রীয় কাজে দোভাষী ব্যবহার করতেন। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) দাওয়াহ কর্মের জন্যে বেতনধারী একজন দোভাষী রেখেছিলেন (বোখারী অফুদ অধ্যায়)। কিন্তু তারা অনারবি ভাষায় কখনো খোৎবা দেননি। আর না কেউ খোৎবার কাজে কোনো দোভাষীকে ব্যবহার করেছিলেন। কাজেই বোঝা গেল খোৎবা নামাজের ক্বেরাত, তাসবীহ, তাশাহুদ ইত্যাদির ন্যায় জিকির বিশেষ, বক্ততা নয়, নামাজে সুরা কেরাতের যেমন অর্থ না বুঝা সত্বেও আরবীর বিকল্প নেই তেমনি খোতবাও, তবে আরবী না বুঝাটা আমাদের দূর্বলতা, আর আমাদের ব্যক্তি স্বার্থে শরিয়তের হুকম রদ বদল হবেনা এটা ই সত্য।

খুতবার ভাষা নিয়ে ইমামগণের মতামত :--

খুতবার ভাষা কি হবে:- , এ ব্যাপারে যদি আমরা চার মাযহাবের দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাই যে, চার মাযহাব মতে জুমআর খুতবা আরবীতে দেয়া আবশ্যক।

মালেকী মাযহাব

মালেকী মাযহাবে জুমআ সহীহ হওয়ার জন্য সর্ববস্থায় উভয় খুতবা আরবী ভাষায় দেয়া শর্ত। যদি উপস্থিত লোকদের মধ্যে কেউ আরবীতে খুতবা দিতে সক্ষম না হয়, তাহলে তারা অন্যান্য দিনের ন্যায় জুমআর দিনও যোহর নামায পড়বে। জুমআ পড়বে না।

মাওসুআ গ্রন্থে রয়েছে-

ذَهَبَ الْمَالِكِيَّةُ : إِلَى أَنَّهُ لاَ بُدَّ أَنْ تَكُونَ الْخُطْبَةُ بِاللُّغَةِ الْعَرَبِيَّةِ ، فَوُقُوعُهَا بِغَيْرِ الْعَرَبِيَّةِ لَغْوٌ ، فَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِي الْجَمَاعَةِ مَنْ يَعْرِفُ الْعَرَبِيَّةَ وَالْخَطِيبُ يَعْرِفُهَا وَجَبَتْ ، فَإِنْ لَمْ يَعْرِفِ الْخَطِيبُ الْعَرَبِيَّةَ لَمْ تَجِبْ ، وَلاَ بُدَّ أَنْ تَكُونَ جَهْرًا فَإِسْرَارُهَا كَعَدِمِهَا وَتُعَادُ جَهْرًا ، وَلاَ بُدَّ أَنْ تَكُونَ لَهَا بَالٌ. (الموسوعة الفقهية الكويت: ১৯/১৮০) وكذا في (كتاب الفقه علي المذاهب الاربعة: ১/৩৬৯، حاشية الدسوقي: ১/৩৮৭، حاشية شرح منح الجليل: ১/২৬০، جواهر الاكليل: ১/৯৫)

শাফেয়ী মাযহাব

নামাযে তাকবীরে তাহরীমার ন্যায় আরবী ভাষায় খুতবা দেয়াও শর্ত। হ্যাঁ, উপস্থিত লোকদের কেউ যদি আরবী ভাষায় খুতবা দিতে না পারে এবং সময় স্বল্পতার কারণে আরবী খুতবা শিখতে না পারে, তাহলে উপস্থিত লোকদের কোন একজন স্বীয় ভাষায় খুতবা দিতে পারবে। আর যদি খুতবা শিক্ষা করা সম্ভব হয় তাহলে সবার উপর আরবী ভাষায় খুতবা শিক্ষা করা ওয়াজিব। যদি সুযোগ থাকা সত্তেও কেউ শিক্ষা না করে, তবে সবাই গুনাহগার সাব্যস্ত হবে। এমতাবস্থায় তাদের জুমআর নামায সহীহ হবে না; বরং যোহরের নামায আদায় করবে।

নিহায়াতুল মুহতাজ গ্রন্থে আছে-

ويشترط كونها اي الخطبة عربية لاتباع السلف والخلف ولانها ذكر مفروض فاشترط فيه ذلك كتكبيرة الاحرام. (نهاية المحتاج الي شرح المنهاج: ২/৩০৪، كتاب الفقه علي مذاهب الاربعة: ১/৩৬৯، زاد المحتاج: ১/৩২৭، اعانة الطالبين علي حل الفاظ فتح المعين: ২/ ৬৮)

হাম্বলী মাযহাব

হাম্বলী মাযহাবে আরবী ভাষায় খুতবা দিতে সক্ষম হলে অনারবীতে খুতবা দেয়ার অনুমতি নেই। যেমন, নামাযে অনারবীতে কেরাত পড়ার অনুমতি নেই। তবে উপস্থিত মুসল্লিদের কেউ যদি আরবী ভাষায় খুতবা দিতে সক্ষম না হয়, তাহলে অন্য ভাষায় খুতবা দিলে সহীহ হয়ে যাবে।

الحنابلة قالوا : لا تصح الخطبة بغير العربية ان كانوا قادرا عليها فان عجز عن الاتيان بها اتي بغيرها مما يحسنه. (كتاب الفقه علي مذاهب الاربعة: ১/৩৬৯)

ولا تصح الخطبة بغير العربية مع القدرة عليها بالعربية. (كشف القناع عن متن الاقناع: ২/৩৬، كباب الفروع: ২/১১৩)

হানাফী মাযহাব

হানাফী মাযহাব মতে আরবী ভাষায় খুতবা দিতে সক্ষম হলে অনারবী ভাষায় খুতবা দেয়া বা আরবী ভাষায় খুতবা পাঠ করে বাংলা বা অন্য কোন ভাষায় তরজমা করা মাকরুহে তাহরীমী ও না জায়েয।

وصح شروعه مع كراهة التحريم بتسبيح وتهليل وتحميد كما صح لوشرع بغير عربية. الدر المختار: ২/১৮২-১৮৩)

وعلي هذا الخلاف الخطبة وجميع اذكار الصلوة. (الدر المختار: ২/১৮৩، البحر الرائق: ১/৫৩৫)

ماذكر في التحفة والذخيرة والنهاية من ان الاصح انه يكره الافتتاح بغير الله اكبر عند ابي حنيفة (رح) فالمراد به الكراهة التحريم. (البحر الرائق: ১/৫৩৪، وفيه ايضا: وقالا لايجوز الا عند العجز وبه قالت الثلاثة. (البحر الرائق: ১/৫৩৫) وكذا (حاشية ابن عابدين: ২/১৮২، المبسوط للسرخسي: ১/১৩৬، الهداية: في هامشه: ১/১০১، حاشيةالطحطاوي: ص২৮০، المحيط البرهاني: ২৩৩، تاتار خانية: ২/৫২، عمدة الرعاية: ১/২০০، كفاية المفتي: ৩/২১৭، فتاوي محمودية: ১২/৩৬৮)

একটি সন্দেহ ও তার নিরসন:- 

সন্দেহ: কেউ কেউ বলেন, মাতৃ ভাষায় খুতবা দিতে হবে। তাদের ভাষ্য হচ্ছে- খুতবা শুধু একটি বয়ান বা বক্তৃতার নাম। আর বয়ান ও বক্তৃতা দ্বারা উদ্দেশ্য থাকে শ্রোতারা তা বুঝা এবং উপদেশ গ্রহণ করা। যদি আরবী ভাষায় খুতবা দেয়া হয়, তাহলে অনারবী শ্রোতারা তা থেকে কীভাবে উপকৃত হবে ? তাই মাতৃ ভাষায় খুতবা দিতে হবে। আরবী ভাষায় খুতবা দেয়া যাবে না।

নিরসন: তাদের এই ধারণাটি সঠিক নয়। কেননা, খুতবা ওয়াজ বা বক্তৃতার নাম নয়; বরং খুতবা হলো জুমআর নামাযের সংশ্লিষ্ট একটি ইবাদত, যা দুই রাকাত নামাযের স্থলাভিষিক্ত। খুতবা যে শুধু বক্তৃতার নাম নয়; বরং একটি বিশেষ ইবাদত এর স্বপক্ষে নিম্ন কয়েকটি প্রমাণ উল্লেখ করা হলো:

১. বক্তৃতাকে আরবীতে ‘তাযকীর’ বলা হয়, অথচ কুরআন ও হাদীসে খুতবাকে ‘যিকির’ বলা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ (سورة الجمعة: ৯)

অর্থ: হে মুমিনগণ ! জুমআর দিন যখন সালাতের জন্য আহবান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও। (সূরা: জুমআ: ৯) এখানে যিকির দ্বারা উদ্দেশ্য হলো জুমআ।

২. সকল ফুকাহায়ে কিরাম জুমআর নামায সহীহ হওয়ার জন্য খুতবাকে শর্ত বলেছেন-

ويشترط لصحتها سبعة اشياء الرابع: الخطبة فيه. (الدر المختار: ৩/১৯)

وكونها شرطا لانعقاد الجمعة . (بدائع الصنائع: ১/৫৮৯) ( وكذا في فتح القدير: ২/৫৫) (حاشيةالطحطاوي: ص৫১৩)

যদি খুতবা দ্বারা ওয়াজ করাই উদ্দেশ্য হতো, তাহলে এটাকে জুমআর নামায সহীহ হওয়ার পূর্বশর্ত বলা অর্থহীন।

৩. জুমআর খুতবা জুমআর নামাযের ওয়াক্তে হওয়া শর্ত। যেমনটি ফুকাহায়ে কিরাম লিখেন-

فلو خطب قبله وصلي فيه لم تصح. (الدر الختار: ৩/১৯)

অর্থ: যদি জুমআর নামাযের ওয়াক্ত আসার পূর্বে খুতবা দেয়া হয়। আর ওয়াক্ত আসার পর নামায পড়ে তাহলে জুমআ সঠিক হবে না। (বাদায়ে: ২/২৫৬, হিন্দিয়া: ১/১৬৮)

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, যদি খুতবা দ্বারা উদ্দেশ্য ওয়াজ বা বক্তৃতা হতো, তাহলে জুমআর নামাযের ওয়াক্ত হওয়া শর্ত করা হতো না; বরং যে কোন সময় কিছু ওয়াজ নসিহত করাই যথেষ্ট হতো। সময় নির্ধারণই প্রমাণ বহন করে এটি একটি ইবাদত। শুধুমাত্র ওয়াজ বা নসিহত নয়।

৪. জুমআর নামায সহীহ হওয়ার জন্য খুতবা পাঠ করা শর্ত। আর খুতবা শ্রবণ করা ওয়াজিব। তবে যদি উপস্থিত মুসল্লিদের সকলেই বধীর বা ঘুমন্ত থাকে এবং তাদের সামনে খুতবা দেয়া হয়, তাহলেও তা জুমআ আদায়ের জন্য যথেষ্ট হবে। যেমন, আল্লামা শামী র. বলেন-

كونها قبلها بحضرة جماعة ينعقد الجمعة بهم ولو كانوا صما او نياما. (حاشية ابن عابدين: ৩/১৯، البحر الرائق: ২/১৫৭)

অর্থ: জুমআ বিশুদ্ধ হতে কম পক্ষে তিন জন লোকের সম্মুখে নামাযের পূর্বে খুতবা দেয়া শর্ত। যদিও মুসল্লিগণ বধীর বা ঘুমন্ত হোক। যদি খুতবা ওয়াজ বা বক্তৃতা-ই হতো তাহলে বধীর ও ঘুমন্ত লোকদের সামনে খুতবা দেয়ার কি অর্থ?

৫. খুতবা দেয়ার পর যদি খতীব সাহেব কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং তাতে দীর্ঘ সময় বিলম্ব হয়ে যায়, তাহলে পূনরায় খুতবা দিতে হবে। যদিও শ্রোতা প্রথম বারের শ্রোতারা-ই হোক না কেন ।

ولو خطب ثم رجع الي بيته فتغدي او جامع واغتسل ثم جاء استقبل الجمعة وكذا في المحيط. (البحر الرائق: ২/২৫৮)

যদি খুতবা দ্বারা ওয়াজ বা নসিহত করাই উদ্দেশ্য হতো, তাহলে একবার খুতবা দেয়ার পর বিলম্ব হওয়ার কারণে পূর্বের শ্রোতাদের সামনে পূনরায় খুতবা দেয়ার কি অর্থ ?

৬. খুতবা শুধু ওয়াজ বা বক্তৃতার নাম নয়। এর বড় প্রমাণ হলো, ইমাম আবু হানিফা র.-এর মতে শুধু আলহামদু লিল্লাহ বা সুবহানাল্লাহ পড়ার দ্বারা খুতবা আদায় হয়ে যায়।

واذا خطب بتسبيحة واحدة او بتهليل وبتحميد اجزائه لقول ابي حنيفة رح. (المبسوط: ২/৪৭)

অথচ ‘সুবহানাল্লাহ’ বা ‘আলহামদু লিল্লাহ’ কে কেউ ওয়াজ বা বক্তৃতা বলে না।

উপরোক্ত প্রমাণগুলো দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বুঝে আসে যে, খুতবা ওয়াজ বা বক্তৃতার নাম নয়; বরং একটি বিশেষ ইবাদত বা যিকির। তবে খুতবা নামক ইবাদতে আরবী ভাষায় ওয়াজ, নসিহত থাকা একটি স্বতন্ত্র সুন্নাত। সুতরাং যখন প্রমাণিত হলো, খুতবার উদ্দেশ্য ওয়াজ নসিহত নয়; বরং ইবাদত। তাই অনারবী শ্রোতাদের সামনে আরবী ভাষায় খুতবা দেয়ার দ্বারা কি ফায়দা ? এ ধরণের প্রশ্নের কোন অবকাশ নেই। যদি কেউ এমন প্রশ্ন করে, তাহলে সর্ব প্রথম নামায ও কুরআনের ব্যাপারে করতে হয়। যখন কুরআন বা নামাযের ব্যাপারে এই ধরণের প্রশ্ন নেই। তাহলে খুতবার ব্যাপারে প্রশ্ন করাও অনর্থক।

খুতবা ও নামাযের মাঝে যে সব বিষয়ে মিল রয়েছে

১. নামযের সময় নির্ধারিত; খুতবার সময় ও নির্ধারিত।

২. নামায বিনা ওযরে দাড়িয়ে পড়তে হয়; খুতবাও দাড়িয়ে দিতে হয়।

৩. নামাযের পূর্বে ইকামত আছে, তেমনি খুতবার পূর্বে আযান আছে।

৪. নামাযের মধ্যে যেমন সালাম কালাম করা যায় না, তেমনি ভাবে খুতবাতেও সালাম কালাম করা যায় না।

৫. নামায ও খুতবার বিষয়বস্তু মৌলিকভাবে এক। নামাযে যেমন, সূরা ফাতেহা পড়া হয় যাতে আল্লাহ তাআলার হামদ আছে, এমনিভাবে খুতবাতেও আল্লাহ তাআলার হামদ থাকতে হয়।

৬. খুতবাতে রাসূল স. এর উপর দরুদ পাঠ করা হয়। নামাযেও রাসূল স. এর উপর দরুদ পাঠ করা হয়।

৭. খুতবাতে আল্লাহ তাআলার তাওহীদ ও রাসূল স. এর রিসালাতের সাক্ষ্য আছে, নামাযেও তাশাহহুদ আছে।

৮. খুতবায় কুরআনের তিলাওয়াত আছে, নামাযেও কুরআনের তিলাওয়াত করতে হয়।

৯. খুতবায় মুসলমানদের জন্য দুআ করা হয়, নামাযেও সালামের পূর্বে দুআ আছে।

১০. ইমাম আবু হানিফা র.ও মুহাম্মদ র. বলেন, খুতবা নামাযের স্থলাভিষিক্ত। খুতবাতে কারো হাঁচির উত্তরে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলা যাবে না। কারো সালামের উত্তর দেয়া যাবে না। (যেমনিভাবে নামাযে কারো হাঁচি ও সালামের উত্তর দেয়া যায় না।)

উল্লিখিত আলোচনা দ্বারা খুতবা ও নামাযের সাদৃশ্যতা সুস্পষ্টভাবে বুঝে আসে। সুতরাং নামাযের তাকবীর, কেরাত, তাসবীহ, দুআ ইত্যাদি যেভাবে আরবী ভাষায় পড়া আবশ্যক, অন্য ভাষায় পড়া বা তরজমা করা জায়েয নেই। তদ্রুপ খুতবা আরবী ভাষায় পড়া আবশ্যক। 

লেখক:-

মৌলানা আবদুল্লাহ ভূঁইয়া 

ফাজেলে জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়া, 

সিনিয়র শিক্ষক মাদ্রাসা হোছাইনিয়া আজিজুল উলুম রাজঘাটা, লোহাগাড়া ,চট্টগ্রাম, 

ব্লগার ও ইসলামি অনলাইন এক্টিভিস্ট 

৪টি মন্তব্য:

  1. এটাতো নিচক বক্ততা নয়, এটা জিকিরের অন্তভূক্ত, নামাজে সুরা কেরাত যেমন অর্থ না বুঝা সত্বেও আরবীর বিকল্প নেই তেমনি খোতবাও, তবে আরবী না বুঝাটা আমাদের দূর্বলতা, আর আমাদের ব্যক্তি স্বার্থে শরিয়তের হুকম রদ বদল হবেনা এটা ই সত্য

    উত্তরমুছুন
  2. আরবী না বুঝাটা আমাদের দূর্বলতা, আর আমাদের ব্যক্তি স্বার্থে শরিয়তের হুকম রদ বদল হবেনা এটা ই সত্য, একটা কথা চিন্তা করবেন, ইসলামের সোনালী যুগ বাদই দিলাম আজ থেকে এক শত বছর আগেও এমন ভাবে অনারবীতে খোতবা দেয়ার প্রচলনের ইতিহাস পাওয়া যাবেনা, এটা শরিয়তের মধ্যে একটা বিকৃতী সাধন,

    উত্তরমুছুন
  3. আপ্নাদের সকল মতবাদের উত্তর একটি মাত্র আয়াত দিয়েই দেয়া যায়... সূরা দুখান এর ৫৮ নাম্বার আয়াত দেখুন...

    আর মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন্না, কে বলেছে আপ্নাদের বাংলা না পড়তে, এমন কিছু গুরুক্ত পূর্ণ বিষয় বলছেন যা মানুষ বুঝতেই পারছেনা, এটা হাসি ছারা আর কিছুই না। আমি বিশ্বাস করিনা রাসুল (সঃ) এমন কিছু বলবেন , আপনারা যে রেফারেন্স হাদিস থেকে দিচ্ছেন তা ভুল আছে, যার প্রমান ওই আয়াত পড়লেই বুঝা যায়।

    জুমুয়ার খুৎবা শুনার মধ্যেই রয়েছে অনেক জ্ঞান, কিন্তু সেখানে ভাশার জ্ঞান ই নেই সেখানে বুঝের জ্ঞান কিভাবে হবে??????

    উচিৎ আগে আরবিতে পড়ে , তারপর তার অর্থ বাংলায় বুঝিয়ে দেয়া।

    এটা ভাব্বেন্না যে, আল্লাহ্‌ কোন বস্তু... আল্লাহ্‌ অবশ্যই বান্দার মনের অবস্থা যানে, অতএব বান্দা বুঝতে ছাইলে সেখানে ভাশার বাধ্যতা দেখিয়ে কাউকে বিভ্রান্ত করবেন্না।

    >>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>

    আপনারা কেউ জান্তে ছাইলে আগে কোরআন পড়ুন, মনে রাখবেন হাদিস অনেক বিকৃত হয়ে আছে। আগে কোরআন পড়ুন বুঝে তারপর সেই জ্ঞান দিয়েই বুঝবেন কন্টা জাল হাদিস আর কোনটা আল হাদিস।

    উত্তরমুছুন
  4. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন