Translate

শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০২০

হাতেম ‎তায়ীকে ‎নিয়ে ‎ভূলধারণা ‎নিরশন ‎

দাতা হাতেম তাই এবং আমার ভুল ধারণা. 
আহমেদ কবির

ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত দয়ালু, উদার, দানশীল হাতেম তাইয়ের নাম শুনে আসছি। গল্প পড়েছি তাঁকে নিয়ে। নাটক হয়েছে, এমনকি ছবিও হয়েছে বড় পর্দায়! বাংলাদেশের সোহেল রানা অভিনীত দাতা হাতেম তাই শেষ করার ধৈর্য আমাদের বন্ধুদের ছিল না বলে হল থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। সব সময়ই আমার ধারণা ছিল, দাতা হাতেম তাই কাল্পনিক মানুষ, গল্পের নায়ক। বাস্তবে এমন কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব ছিল না। আমার সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

 কারণ, হিজরি ৮ সালে মক্কা বিজয়ের পর আরবের যেসব ছোট ছোট শহরে মূর্তিপূজা তখনো ছিল, নবী (সা.) সেই সব শহরে অভিযান চালিয়ে সমগ্র আরবকে মূর্তিপূজামুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি প্রায় তিনশত সৈন্যসহ আলী ইবনে আবু-তালিবকে সৌদি আরবের উত্তর-পশ্চিমের শহর হাইলে আত-তায়ি গোত্র অভিমুখে পাঠালেন। হাইল শহরে একজন নামকরা ব্যক্তি হাতেম আত-তাইয়ের বাস ছিল, যার নাম প্রায় সব আরবই জানত। তাঁর দানশীলতা ও উদারতা ছিল শিখরছোঁয়া এবং এটাই ছিল তাঁর খ্যাতির কারণ। হাতেম তাই ছিলেন তাই গোত্রের প্রধান এবং তিনি ইসলাম-পূর্ব ৫৭৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে আদি ইবনে হাতেম গোত্রের প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
আদি যখন জানতে পারলেন মুসলমানরা বিভিন্ন অমুসলিম গোত্রে অভিযান চালাচ্ছে, তখন তিনি পালানোর রাস্তা খুঁজতে থাকেন। কিছু সম্পদসহ উট প্রস্তুত করে রাখেন। যখন নিশ্চিত হলেন মুসলমানরা আসছে, তখন তিনি তাঁর গোত্রকে পরিত্যাগ করে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে সৌদি আরবের উত্তরে রোমানদের কাছাকাছি এক শহরে পালিয়ে আসেন। আদি আগেই খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে রোমানদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল।
এদিকে মুসলমানরা হজরত আলী ইবনে আবু-তালিব (রা.)-এর নেতৃত্বে আত-তাই গোত্রকে পরাজিত করে কিছু যুদ্ধবন্দীকে মদিনায় নিয়ে আসেন। বন্দীদের মধ্যে একজন নারী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের দাবি জানালেন এই বলে যে তিনি হাতেম তায়ের মেয়ে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তাঁকে একটি উট, কিছু টাকা দিলেন এবং বললেন, পছন্দের যেকোনো জায়গায় তিনি নিরাপদে যেতে পারবেন। তিনি তাঁকে মুক্তি দিয়ে দিলেন শুধু হাতেম তাইয়ের মেয়ে হওয়ার কারণে। ভাই কোথায় আছেন, সে খবর পেয়ে তাঁর কাছে গিয়ে প্রথমে ক্রোধ প্রকাশ করলেন তাঁকে রেখে পালিয়ে আসার কারণে, তারপর ভাইকে পরামর্শ দিলেন মোহাম্মদ (সা.)-এর কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য। আদিকে বললেন, ‘তিনি যদি নবী হন, তাহলে তাঁর প্রতি বিশ্বাস রেখে তাঁর ধর্ম যত তাড়াতাড়ি গ্রহণ করবে, ততই তোমার মঙ্গল হবে। আর যদি তিনি রাজা হন, তাহলে কিছু অনুগ্রহ বা সাহায্য পাওয়ার চেষ্টা করতে পারো।’
আদি ইবনে হাতেম নিজেই বর্ণনা করেন, ‘মোহাম্মদ (সা.)-এর চেয়ে আর কেউ আমার কাছে এত বিদ্বেষের ছিলেন না, কিন্তু আমি নিজেকে বললাম, গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দেখি না, যদি তিনি সত্য বাণী বলেন, তাহলে সরাসরি তাঁর কাছ থেকে শুনব আর যদি তা না হয়, তাতে আমার তেমন ক্ষতির কিছু নেই।’ তাই তিনি ৮ম হিজরির শেষের দিকে অথবা ৯ম হিজরির প্রথম দিকে মদিনায় গেলেন। মদিনায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু লোক তাঁকে চিনে ফেলে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘উনি হাতেম তাইয়ের ছেলে আদি’ এবং লোকেরা তাঁকে ঘিরে ফেলল। তারপর তারা তাঁকে রাসুলুল্লাহর (সা.) কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘উনি হাতেম তাইয়ের ছেলে আদি।’
নবী (সা.) আদিকে বললেন, ‘ইয়া আদি, আসলিম তুসলিম’ (হে আদি, ইসলাম গ্রহণ করো এবং তুমি নিরাপদ হবে)। আদি উত্তর দিলেন, ‘আমি তো একটি ভালো ধর্মের অনুসারী।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও দুইবার বললেন এবং আদি একই উত্তর দিলেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘ইয়া আদি, আনা আলামু বি দিনিকা মিনকা’ (হে আদি, আমি তোমার ধর্ম সম্বন্ধে তোমার থেকে বেশি জানি)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তুমি কি তোমার গোত্রের প্রধান নও?’ আদি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তাদের আয়ের চার ভাগের এক ভাগ কর হিসাবে নাও?’ আদি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তুমি কি জানো যে তোমার নিজের ধর্ম এটা নিষেধ করে?’ আদি কিছুটা লজ্জা পেলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আদির হাত ধরে তাঁর ঘরের দিকে রওনা দিলেন। আদি বলেন, ‘পথিমধ্যে এক শিশুসহ একজন বৃদ্ধা ওনাকে থামালেন এবং তাঁর সমস্যার কথা বলতে লাগলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) নারীটি আশ্বস্ত হওয়া পর্যন্ত কথা বললেন। আমি তখন চিন্তা করছিলাম এই লোক রাজা নন। আমরা তাঁর ঘরে এলে উনি এক পুরাতন ছেঁড়া মাদুর আমার নিচে দিয়ে বসতে বললেন। আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে আর কিছু না দেখে তাঁকে বসতে বললাম। তিনি জোর করে আমাকেই বসতে বললেন। আমি বসলে উনি মাটিতেই বসলেন। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি আর কোনো গড জানি কি না আল্লাহ ছাড়া? আমি উত্তর দিলাম, না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আমি আর কাউকে জানি কি না আল্লাহ থেকে বেশি ক্ষমতাবান ও শক্তিশালী? আমি আবার বললাম, না। তখন তিনি বললেন, ইয়াহুদরা মাকদুব ও নাসারারা মিসগাইডেড এবং ভুল যা তারা বিশ্বাস করে।
‘তারপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি বোধ হয় ইসলাম গ্রহণ করছ না আমার আশপাশের মানুষগুলোর অবস্থা দেখে (রাজনৈতিক দুর্বলতা ও দারিদ্র্য ইত্যাদি)। তুমি কি আল-হিরার নাম শুনেছ? আমি বললাম, হ্যাঁ, শুনেছি। তবে কখনো যাইনি ওই শহরে। নবী (সা.) বললেন, প্রকৃতপক্ষে এটা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র, যখন কোনো মহিলা আল-হিরা শহর থেকে মক্কায় কাবা তাওয়াফ করার জন্য কোনো নিরাপত্তাসঙ্গী ছাড়াই আসবে। তার ভয়ের কোনো কারণ থাকবে না এবং সত্যি সত্যিই এটা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র যখন কিসরার ধনভান্ডার আমাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। আমি তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কিসরা? হরমুজের ছেলে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, কিসরা, হরমুজের ছেলে। আর প্রকৃতপক্ষে এটাও সময়ের ব্যাপারমাত্র যখন মানুষ মদিনার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ছাদকা দিতে চাইবে কিন্তু একজনকেও ছাদকা দেওয়ার যোগ্য পাবে না।
‘আমি রাসুলুল্লাহর (সা.) তিনটার দুইটাই স্বচক্ষে দেখেছি। মুসলমান রাজ্যের শান্তি ও নিরাপত্তা নিজে দেখেছি এবং আমি নিজে অংশগ্রহণ করেছি টেসিফান (Ctesiphan, the Capital of Sasaniad empire) সাসানিদ রাজ্যের রাজধানী বিজয়ের যুদ্ধে (Battle of Nihawand, 651). যা-ই হোক, আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করি। আমি প্রায়ই রাসুলুল্লাহর (সা.) সঙ্গে সাক্ষাৎ করতাম। একবার আমি তাঁকে আমার পিতা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আমার বাবা তাঁর আত্মীয়স্বজনদের প্রতি ছিলেন সদয়, দয়ালু এবং মানুষের প্রতি খুব দানশীল ছিলেন; তিনি কি তাঁর কাজের প্রতিদান-পুরস্কার পাবেন? রাসুলুল্লাহ (সা.) উত্তরে বললেন, তোমার বাবা যা কামনা-আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন এবং তিনি তা পেয়েছেন যা চেয়েছিলেন।’ (ইবনে হিব্বান)
এই হাদিসের মানে, কেউ যদি নাম-যশের, দুনিয়ায় সুখ্যাতির জন্য করে, তবে তা সে দুনিয়াতেই পাবে, আর কেউ যদি আল্লাহর কাছে পাওয়ার জন্য করে, তাহলে তার পাওনা আদায় ওইখানেই হবে।
আদি ইবনে হাতেম (রা.) বেঁচেছিলেন অনেক দিন, অনেকের মতে, ১২০ বছরের কাছাকাছি। তিনি ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান (রা.)-এর হত্যা (Killing of Uthman) দেখেছেন, তিনি ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলীর (রা.) সঙ্গে মুয়াবিয়ার (রা.) বিরুদ্ধে সাফিন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, যার ফলে শিয়া সম্প্রদায়ও তাঁকে সন্মান করে।

Dr.Qadi-র Seerah of Prophet (s) থেকে। 
সংকলিত প্রথম আলো ২৯ জুলাই ২০১৭ অনলাইন সংস্করণ থেকে। 

সংকলক 
এম  এম  আবদুল্লাহ  ভূঁইয়া  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন