Translate

বুধবার, ১৮ জুলাই, ২০১২

কওমী মাদরাসার সুচনার ইতিহাস ও কিছু কথা

দারুল উলুম দেওবন্দ” ভারত উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ও সুপ্রাচীন ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানবিগত শতাব্দীর মুসলিম বিশ্বে খ্যাতনামা মনীষীবর্গের জন্মদাতাউম্মাহর ইলম ও আমলের পথে সফল রাহবারএই মাদারে ইলমীর পরিচয়, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং ভারতবর্ষে তার অবদান কী তা জানতে হলে আমাদের কে ফিরে তাকাতে হবে প্রায় দেড় শতাব্দী পেছনে
১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল মুসলমানদের পক্ষ থেকে হিন্দুস্তানকে ফিরিঙ্গী আগ্রাসন মুক্ত করার সর্বশেষ সশস্ত্র পদক্ষেপএই আন্দোলনের মাধ্যমে উপনেবেশিক শক্তি এতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, মুসলিম জাতি কোন অবস্থাতেই গোলামীর জিন্দেগী বরন করে নিতে সম্মত হবে নাতাই তারা কর্ম কৌশল পরিবর্তন করলযে পিঙ্গল বর্ণের নরপিশাচ হিন্দুস্তানের মাটিতে লক্ষ মুসলমানের বুকের তাজা রক্তে খুনের দরিয়া রচনা করেছে, তারাই আবার সর্বসাধারনের কল্যাণকামীর মুখোশ পরে তাদের সামনে হাজির হলউদ্দেশ্য ছিল, ভয়-ভীতি দেখিয়ে কিংবা গায়ের জোরে যে কওমকে দমন করা যায় না, ধীরে ধীরে তাদের চিন্তা-চেতনা ও মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন আনাযেন তারা ধর্মীয় অনুশাসন, স্বকীয় সভ্যতা ও দীপ্তিমান অতীতকে ভুলে গিয়ে অদূর ভবিষ্যতে নিজেকে সতন্ত্র জাতি হিসেবে মূল্যায়ন করতে না পারে
এই হীন উদ্দেশ্য সফল করার সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ ছিল মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করাএবং এর মাধ্যমে তাদের দিল-দেমাগে পাশ্চাতের চতুর্মূখী প্রভাব বদ্ধমূল করাযেন এতে প্রভাবিত হয়ে তারা নিজ বিবেক দিয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেএ লক্ষকে সামনে রেখে লর্ড ম্যাকলএদেশের মানুষের জন্য এক নতুন শিক্ষানীতির সুপারিশ করেন তা বাস্তবায়নের লক্ষে তিনি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেনতাতে ভারতবর্ষের জাতীয় শিক্ষানীতি তথা মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ন্যাক্কারজনক ভাবে উপহাস করা হয়এবং ওলামায়ে কেরামের উপর ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপন করা হয় পরিশেষে তিনি স্পষ্ঠ ভাষায় লেখেন, ” এখন আমাদের কর্তব্য হল, এমন একদল লোক তৈরি করা যারা আমাদের অধিকৃত অঞ্চলের অধিবাসী ও আমাদের মাঝে দোভাষীর দায়িত্ব পালন করবেযারা রক্ত ও বর্ণে হিন্দুস্তানী হলেও চিন্তা-চেতনা, মেধা-মনন ও চারিত্রিক দৃষ্টিকোন থেকে হবে ইংরেজ্”
দূরদর্শী ওলামায়ে কেরাম এই সুদূর প্রসারী চক্রান্ত ও তার ভয়াবহতা সম্পর্কে বেখবর ছিলেন নাতাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, এখেন পরিস্থিতিতে মুসলমানদের দ্বীন-ঈমান রক্ষার্থে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে অদূর ভিবষ্যতে তারা সতন্ত্রজাতি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে নাকয়েক খান্দান পরে হয়তো ইসলাম ও তার মৌলিক বৈশিষ্ট্যাবলী সম্পর্কে সচেতন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে নাতাই তাঁরাও সম্মুখ সমরে লড়াই পরিহার করতঃ কার্যপদ্ধততে পরিবর্তন আনায়নে সচেষ্ট হলেননব উদ্ভুত শিক্ষানীতির ধ্বংসের হাত থেকে মুসলিম জাতিকে রক্ষার একটি মাত্র পথ তখন খোলা ছিলদারুল উলূম প্রতিষ্ঠার প্রায়াসে তাঁরা সে দিকেই অগ্রসর হয়েছিলেন
হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী, রশিদ আদম্মদ হাঙ্গুহী, হাজী আবেদ হুসাইন (রহঃ) ১৮৫৮ সালের জিহাদে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেনএমন কি উত্তর প্রদেশের একটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হনএ কারনে অবশ্য দীর্ঘদিন যাবৎ তাঁদেরকে ইংরেজ প্রশাসনের কোপানলের শিকার হয়ে থাকতে হয়েছিল সশস্ত্র সংগ্রাম আপাত ব্যর্থ হলে তাঁরা নীরব ও সফল আন্দোলনের বীজ দেওবন্দের মাটিতে বপন করেনযা ধীরে ধীরে গোটা ভারতবর্ষে আপন শাখা-প্রশাখা, পত্র-পল্লব বিস্তার করে এক মহীরুহের রূপ ধারন করেযার সুশীতল ছায়ায় ইসলাম ও মুসলিম জাতির ইহতহাস, ঐতিহ্য, ধর্মীয় মূল্যবোধ, তাহযীব-তামাদ্দুন ও স্বাতন্ত্রবোধ লালিত হতে থাকেহাঁ, সেই সাজারে তুবার নাম দরুল উলুম
তদানীন্তন হিন্দুস্তানে কোন দ্বীনি মারকায প্রতিষ্ঠা করা ছিল নিজেকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দেবার নামান্তরসুলতান মুহাম্মদ তুঘলকের শাসনামলে শুধুমাত্র দিল্লিদতই সহস্রাধিক মাদরাসা ছিলকিন্তু ফিরিঙ্গি আগ্রাসনের পর পুরো ভারতবর্ষের কোথাও একটি মাদরাসা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছিলওলামায়ে কেরামকে আযাদী আন্দোলনে অংশ গ্রহণের অপরাধে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হত কিংবা আন্দামান দ্বীপে নির্বাসন দেয়া হতআর যারা মুক্ত ছিলেন, সংঘবদ্ধ হওয়া তাদের জন্য ছিল দুষ্করতাই আকাবিরত্রয় প্রতিষ্ঠানের জন্য গ্রামকেই বেছে নিয়ে প্রভুত কল্যাণের এই ধারা রচনা করেন
১৫ মুহাররম ১২৮৩ হিজরী মোতাবেক ৩০ মে ১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দে নিতান্ত অনাড়ম্বর এক অনুষ্টানে এই নীরব আন্দোলন প্রতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেএখলাসের সাথে দ্বীনের খেদমতই যেহেতু একমাত্র লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল তাই কোন প্রচার মাধ্যমের আশ্রয় না নিয়ে দেওবন্দের ছোট্র পল্লিতে, ছাত্তা মসজিদের আঙ্গিনায়, একটি ডালিম গাছের ছায়ায়, আবে হায়াতের এই নহর তারা রচনা করেনদুই বুযুর্গের মাধ্যমে কার্যত প্রতিষ্ঠানটির পদযাত্রা শুরু হয় প্রথমজন শিক্ষক; হযরত মাওলানা মোল্লা মাহমুদদ্বিতীয়জন ছাত্র; দেওবন্দের নওজোয়ান মাহমুদ হাসানযিনি পরবর্তীতে শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান নামে খ্যাত হনএবং ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন
লর্ড ম্যাকল কর্তৃক ইসলামকে মিটিয়ে দেওয়ার হীন ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতঃ দ্বীনকে অক্ষুন্ন রাখা ছিল দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার অন্যতম মৌলিক উদ্দেশ্য এরই সাথে ওলামায়ে কেরামের এক জানবাজ জামাত তৈরি করাও ছিল সময়ের দাবী, যারা যে কোন পরিস্থিতিতে দ্বীনকে আগলে রাখবেন এবং সর্বস্তরের জনসাধারণের কাছে পৌছে দিবেনযেন সাধারণ মানুষ ইসলামের হেদায়েত অনুসারে জীবন যাপন ও তার আলোকে নিজ ভবিষ্যত গড়তে পারে
যদি বলা হয় দারুল উলূমনিজস্ব পরিমণ্ডলে সফল, তাহলে অতুক্তি হবে না প্রতিষ্ঠার সূচনা লগ্ন থেকে তালীম তরবিয়ত, তাযকীয়া-তাসাউফ, দাওয়াত-সিয়াসত সহ প্রতিটি অঙ্গনের জন্য সে জন্ম দিয়ে আসছে যুগের খ্যাতনামা মনীষীবর্গকে যারা দ্বীনকে আগলে রেখেছেন অক্ষুন্ন আদলেতার অমিয় বাণী পৌছে দিয়ে যাচ্ছেন উম্মাহর প্রতিটি ব্যক্তির কানেআহারে-অনাহারে, দুঃখে-সাচ্ছন্দ্যে যে কোন প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে, আপন স্বার্থকে পেছনে ফেলে উম্মতের মাঝে ধর্মীয় মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখতে তারা নিবেদিত প্রাণবাতিলের শত ঝড় ঝাপটার মুখে হিমালয়ের মত অবিচল, তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা সমুদ্র তরঙ্গের ন্যয় উত্তাল, নববী আদর্শের মূর্ত প্রতিক
মুফতী শফী (রাহঃ) (“দারুল উলূম দেওবন্দ আওর উসকি মেযায”… অবলম্বনে) সূত্র- ইছলাহী ইজতিমা স্মারক

২টি মন্তব্য: