Translate

রবিবার, ৭ অক্টোবর, ২০১২

..জল মানব নওশের আলী

কিভাবে থাকবেন পানির নিচে দিনের পর দিন, জেনে নিন এই জলমানবের কাছে

  


জল মানব নওশের আলী

মিরসরাই, ৭ অক্টোবর: ১৯৭১ সালে কথা। নওশের আলী তখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়েন। স্কুল ছুটির পর কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করলেন, যে বেশিক্ষণ পানিতে ডুবে থাকতে পারবে সবাই মিলে তাকে মিষ্টি খাওয়াতে হবে। সেদিন নওশের ডুবে থাকেন টানা দুই মিনিটি। জিতে নেন এক কেজি মিষ্টি।

সেই থেকে শুরু আরো বেশিক্ষণ ডুবে থাকলে আরো বেশি মিষ্টি পাওয়া যাবে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও দুই মিনিটের বেশি থাকা যাচ্ছিল না। কারণ খুঁজতে গিয়ে নেমে পড়েন কোমর বেঁধে। মনে প্রশ্ন আসে, পানিতে মাছ কিভাবে বেঁচে থাকে? শুরু হলো কিশোর নওশেরের বিশেষ এক্সপেরিমেন্ট! কাচের পাত্রে মাছ রেখে ঘাপটি মেরে দেখতে লাগলেন মাছের চলাফেরা।

এরপর নিজে নিজে বানিয়ে ফেললেন এয়ারটাইট ট্যাংক। কয়েকটা মাছ রাখেন তাতে। এরপর আলো-বাতাস যাতে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য বন্ধ করে দিলেন ট্যাংক। মারা গেল মাছগুলো। ট্যাংক খোলা রেখে দেখলেন মাছ আর মারা যাচ্ছে না।

এবার শুরু হলো মাছের শ্বাস-প্রশ্বাস পর্যবেক্ষণ প্রজেক্ট। দেখলেন, মাঝে মাঝে মাছ পানির উপরে এসেও হা করে শ্বাস নেয়। আবার কখনো লেজ-পাখনা নিয়ে বুদ্ধুদ সৃষ্টি করে তা থেকে অক্সিজেন গিলে নেয়। তা দেখেই আইডিয়া পেয়ে যান নওশের আলী।

মাছের মতোই হাতের ঝাপটায় পানিতে বাতাসের বুদ্ধুদ তৈরি করে চালাতে থাকেন অনুশীলন। এভাবে গড়িয়ে যায় এক বছর। এরপর একদিন ওই বয়সে পানির নিচে কাটিয়ে দিলেন ১৫ মিনিট।

তারপর ১৯৭২ সালে খুলনার পাইকগাছা থানার অফিসার শিশু নওশের আলীর কথা শুনে তাকে থানায় আমন্ত্রণ জানান। থানার পুকুরে প্রথমবারের মতো সবার সামনে ১৫ মিনিট পানিতে ডুবে থাকেন তিনি। তাঁকে দেখতে সেদিন দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসে অনেকেই। এরপর খুলনার রেডিও সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয় তার সংবাদ।

এরপর থেকে কেউ তাকে ‘জলমানব’ আবার কেউ ‘মৎসকুমার’ ডাকতে শুরু করে দিল। পরের বছর ডুব দিতে গেলেন কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা কলেজের পুকুরে। দুই ঘণ্টা ১৫ মিনিট ডুবে থেকে হতবাক করে দিলেন হাজার হাজার দর্শককে। একই বছর রাজশাহীর সোনাদীঘিতে ছিলেন তিন ঘণ্টা ১০ মিনিট।

১৯৭৫ সালে খুলনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার আয়োজনে খুলনা পাইওনিয়ার গার্লস স্কুলের পুকুরে এক ডুবে কাটিয়ে দিলেন ২৮ ঘণ্টা।

১৯৭৬ সালে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামে আসেন নওশের আলী। প্রদর্শনী দেখতে লোকারণ্য হয়ে ওঠে লালদীঘি ময়দান। চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার আয়োজিত প্রদর্শনীতে সেবার লালদীঘিতে ৩০ ঘণ্টা ডুবেছিলেন নওশের আলী। এরপর আরো তিনবার আসেন বন্দরনগরীতে।

১৯৭৭ সালে বন্দর পুকুরে ৪০ ঘণ্টা, ১৯৮৮ সালে লালদীঘিতে ৪০ ঘণ্টা এবং ১৯৯০ সালে ৫২ ঘণ্টা পানির নিচে কাটিয়ে দেন নওশের আলী। এরপর আরো বেশি সময় ডুবে থাকার নেশায় চেপে বসে তাঁকে। নিজের রেকর্ড ভাঙতে চালান আপ্রাণ চেষ্টা; সফলও হন তিনি।

রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের আয়োজনে ২০০৪ সালে এক ডুবে টানা ৭২ ঘণ্টা তথা তিন দিন কাটিয়ে আরো আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন নওশের আলী। এখানো অনায়াসে ৭২ ঘণ্টা ডুবে থাকতে পারবেন বলে মনে করেন এ জলমানব।

সর্বশেষ তিনি চট্টগ্রামে আসেন গত ২৮ সেপ্টেম্বর। ২৯ সেপ্টেম্বর শনিবার। ঘড়ির কাটা তখন সকাল সাড়ে অটটা ছুঁই ছুঁই। পুকরে চার পাশে শত শত মানুষের ভীড়। বৃদ্ধ, শিশু-কিশোর, স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী কেউ বাদ নেই। তারা অধিক আগ্রহে বসে আছে জলমানব নওশের আলী কিভাবে পানিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবে থাকবেন তা দেখার জন্য

ডুব দেয়ার আগে ডাক্তারি পরীক্ষা সেরে নেন নওশের আলী। ডাক্তার সায় দিলেই পানিতে নামেন। নামার আগে চুক্তিপত্র লিখে দেন, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। তারপর দেন ডুব।

অপেক্ষার পালা শেষ করে মাইকে ঘোষণা হলো বাংলাদেশের আলোচিত নওশের আলী পানিতে ডুবে দিতে যাচ্ছে। যথারীতি মাইকের মাধ্যমে উপস্থিত মানুষের কাছে দোয়া চেয়ে সকাল ১০টায় ডুব দিলেন পানিতে। সারাদিন শত শত মানুষ এই জলমানবকে দেখতে ভীড় জমান মিরসরাই উপজেলার ১৫ নম্বর ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া এলাকায় ইউপি সদস্য কামাল উদ্দিন পাশার পুকুরের পাড়ে।

বেলা সাড়ে ১২ টায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, নওশের আলী নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে থেকে তার কৌশল দেখাচ্ছেন। মাঝে মধ্যে দুধ, কলা, আপেল, ডিম এমনকি চা সিগারেট নিয়েও খাচ্ছেন। কখনো গানের তালে তালে হাত উপরে তুলে নৃত্যের ভঙ্গি করছেন।

মাইকে প্রশ্ন করলে হাত তুলে ইশারায় প্রশ্নের জবাব দেন। পানির নিচে নওশের সিগারেট টানার সময় বাতাসে ধোঁয়া ভেসে উঠতে দেখা যায়। এ অবিশ্বাস্য দৃশ্য পুকুরের পাড়ে উপস্থিত দর্শকদের অবাক করে।

বিকেল তিন টায় গিয়েও পানির নিচে ডুবে থাকতে দেখা গেছে। ডুব প্রদর্শনী দেখতে আসা স্থানীয় ফজলে ওয়াহিদ আদর ও নিজামপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থী খালেদা আক্তার বলেন, পত্র-পত্রিকায় তার নাম শুনেছি কিন্তু এভাবে ডুব প্রদর্শনী দেখতে পারব কখনো ভাবিনি।

প্রথমদিকে অনেকেই ভেবেছিলেন, নওশের আলী বুঝি অক্সিজেন ছাড়াই বাঁচেন। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। জলের তলায় শ্বাস তাকে নিতেই নয়। ডুবন্ত অবস্থায় দুই হাত পানির উপরে এনে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এতে পানির নিচে তৈরি হয় বুদ্বুদ। আর কায়দা করে ওই বুদ্বুদ থেকেই বাতাস গিলে নেন নওশের আলী।

অক্সিজেন ছাড়া কোনো প্রাণী বাঁচতে পারে না। তাহলে কিভাবে এ কাজ সম্ভব জানতে চাইলে নওশর আলী জানান, “পানির নিচে বিশেষ কায়দায় অক্সিজেন তৈরি করে ডুবে থাকি। ডুবে থাকা অবস্থায় পানিতে হাত দিয়ে আঘাত করলে বড় জায়গা তৈরি হয়। এ জায়গা থেকে অক্সিজেন নিয়ে আবার পানিতে ছেড়ে দিই।”


পুরোটাই শারীরিক কসরতের ব্যাপার, কোনো তুকতাক জাদুমন্ত্র নয়। তবে খুঁটিনাটি দিকগুলো নিজের শিক্ষার্থী ছাড়া আর কাউকে জানাতে রাজি নন নওশের আলী। জলের তলায় যেন এক ঘেয়ে না লাগে সে জন্য বিনোদনের ব্যবস্থাও আছে।

পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নওশের আলীর দিকে তাকিয়ে থাকাটাও তো ধৈর্যের ব্যাপার। আর তাই নওশের আলীর বাহিনী সব সময় মেতে থাকে গান-বাজনায়। নাচ-গানের তালে পানির নিচেও চলে নওশের আলীর শারীরিক কসরত। এ দীর্ঘ সময় কার না খিদে লাগে।

কিন্তু পানির তলায় মাছ-ভাত তো আর খাওয়া সম্ভব নয়। তাই পুরোটা সময় নওশের আলী তরল খাবার খেয়েই কাটিয়ে দেন। প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধও খান। স্যুপ আর জুসের পাশাপাশি কদাচিৎ সেদ্ধ ডিম খান তিনি।

নওশের আলীর হিসাব মতে, ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট সাড়ে ১৩ হাজার ঘণ্টা কাটিয়েছেন। তার নাম শুধু দেশে মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বাংলাদেশের গণ্ডী পেরিয়ে আর্ন্তজাতিক পর‌্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে তার সুখ্যাতি।

১৯৭৫ সালে তিনি কলকাতার চব্বিশ পরগনায় ছড়িয়াল চেকপোস্টের এক পুকুরে ১২ ঘণ্টার ডুব দেন নওশের। এর দু-এক বছরের মধ্যে আবার কলকাতার বশীরহাটে আট ঘণ্টাব্যাপী চলে তাঁর প্রদর্শনী।

২০০৪ সালে পত্রিকায় প্রকাশের পর দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের এসবিএস টিভি চ্যানেলের আয়োজনে দেশটির একটি লেকে ৩০ ঘণ্টা চলে তার প্রদর্শনী। অগ্রহায়ণ, পৌষ ও মাঘ এই তিন মাস হাড় কাঁপানো শীতের মাঝেই স্বপ্নপুরীর লেকে চলে নওশের আলীর প্রদর্শনী। বছরের অন্য সময় যান বাইরের প্রদর্শনীতে।

নওশের আলী এখন ডুবে থাকার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তার কয়েকজন সহযোগীকে। দক্ষ হয়ে উঠেছেন আবদুল মান্নান ও আবুল হোসেন। পানিতে বুদ্বুদ তৈরি করে ঘণ্টাখানেক ডুবে থাকতে পারেন তারা।

নওশের আলী মাকে হারিয়েছেন ছোট বেলায়। তরুণ বয়সে বাবাকেও হারান। তিন ভাই, চার বোনের মধ্যে নওশের আলী তৃতীয়। বিয়ে করেননি। গিনেস বুক অব রেকর্ডসে নাম উঠলেই তিনি করবেন, তার আগে নয়। এছাড়া আরেকটি স্বপ্ন-এক ডুবে পাড়ি দেবেন ইংলিশ চ্যানেল।

নওশের জানান, গিনেস বুক কর্তৃপক্ষ তার আবেদনে সাড়া দিয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সহযোগীতা কামনা করেন। Click this link...
ট্যাগ/কি-ওয়ার্ড : ভিন্ন খবর

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন