Translate

রবিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১২

ইনোসেন্স অফ মুসলিম্‌স , প্রতিক্রিয়া ,ফিরে দেখা :ক্রোধের কারণ :

২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ১১শ বার্ষিকী উপলক্ষে এ বছর Innocense of Muslims (মুসলিমদের নির্দোষিতা) শিরোনামে আমেরিকা থেকে একটি সিনেমা চিত্র ইন্টারনেটে ছাড়া হয়েছে। যাতে পবিত্র কুরআন, ইসলাম ও ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (ছা.) সম্পর্কে জঘন্যতম মন্তব্য ও কুরুচিপূর্ণ চিত্রায়ন করা হয়েছে। ভিডিও চিত্রটি তারা ইউটিউব নামক সামাজিক ওয়েবসাইটে পোষ্ট করেছে এবং আরবীতে অনুবাদসহ মধ্যপ্রাচ্যে ছেড়েছে। ১০০ জন ইহুদীর ৫০ লক্ষ ডলার ব্যয়ে দীর্ঘদিন ধরে নির্মিত উক্ত নিকৃষ্টতম চলচ্চিত্রটির নির্মাতা ও প্রযোজক হ’ল ইসরাঈলী বংশোদ্ভূত মার্কিন ইহুদী নাগরিক ক্যালিফোর্ণিয়ার ৫৬ বছর বয়সী রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী স্যাম বাসিলে। উক্ত সিনেমায় ইসলামকে ‘ক্যান্সার’ ও মুসলমানকে ‘গাধা’ হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে। সেখানে শেষনবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে কুৎসিত চরিত্রের মানুষ হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে এবং তাঁকে জঘন্যতম ভাষায় গালি-গালাজ করা হয়েছে। যেমন ইতিপূর্বে ২০১০ সালে ডেনমার্কের কার্টুনিস্ট ফিনলে গার্ড জেনসেন রাসূল (ছা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র তৈরী করে প্রচার করেছিল ও সারা বিশ্বের নিন্দা কুড়িয়েছিল। সিনেমাটি তথ্যগত ভাবে ডাহা মিথ্যায় ভরা এবং নির্মাণশৈলীর দিক দিয়ে চরম বিকৃত রুচির পরিচায়ক।

সিনেমায় কী ছিল দেখানো হয়েছে : মাত্র ১০ মিনিটের যে অংশ ইন্টারনেটে ছাড়া হয়েছে তা দেখে কোনো মুসলিমের রক্ত ঠান্ডা থাকার কথা নয়। সিনেমাটিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিগত চরিত্রে কালিমা লেপনের চেষ্টা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নারী লিপ্সু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। একসঙ্গে একাধিক নারীর শয্যাগ্রহণকারী হিসেবেও দেখানো হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। স্ত্রীদের কর্তৃক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুতাপেটা করার দৃশ্যও সংযোজন করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অমুসলিম নিধনকারী হিসেবেও উপস্থাপন করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কখনও দাড়ি বিহীন সন্ত্রাসী হিসেবে আবার কখনো জুব্বা গায়ে ভণ্ড চরিত্রে উপস্থান করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একান্ত সাহাবী আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু, উমরা রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ অন্যান্য সাহাবীদের চরমভাবে অপমান করা হয়েছে। উম্মাহাতুন মুমিনীন তথা নবীর স্ত্রীদেরও উপস্থাপন করা হয়েছে বেপর্দা ও নগ্নভাবে। [নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক]

পৃথীবির সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব : যে মানুষটি শুধু তাঁর সমকালীন মিত্র ও সঙ্গীদের প্রিয়তম ব্যক্তি ছিলেন না, ছিলেন আদর্শিকভাবে তাঁর ঘোর শত্রুদের চোখেও শ্রদ্ধেয় ও বরেণ্য। সমসাময়িক অনুচরবৃন্দ থেকে নিয়ে কিয়ামত দিন পর্যন্ত যে মানুষটি সকল বিবেকবান চক্ষুষ্মান অনুসারীর দৃষ্টিতে সবচে ভালোবাসার পাত্র। যাকে ‘সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী’ অভিধায় ভূষিত করেছেন খোদ নিখিল সৃষ্টির নিপুণ স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। [আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় রাসূল সম্পর্কে সার্টিফিকেট দিয়ে বলেন,
﴿ وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٖ ٤ فَسَتُبۡصِرُ وَيُبۡصِرُونَ ٥ بِأَييِّكُمُ ٱلۡمَفۡتُونُ ٦ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِۦ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ ٧ ﴾ [القلم: ٤، ٧]
‘আর নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের ওপর অধিষ্ঠিত। অতঃপর শীঘ্রই আপনি দেখতে পাবেন এবং তারাও দেখতে পাবে- তোমাদের মধ্যে কে বিকারগ্রস্ত? নিশ্চয় আপনার রবই সম্যক পরিজ্ঞাত তাদের ব্যাপারে যারা তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, আর তিনি হিদায়াতপ্রাপ্তদের সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞাত’। {সূরা আল-কলম, আয়াত : ৪-৭}]
যে মানুষটির জীবনেতিহাস ও মানবজাতির প্রতি তাঁর অপরিসীম অবদানের আলেখ্য পড়ে ভক্তিগদগদ হয়ে ওঠেন আধুনিক বিশ্বের নিরপেক্ষ অসংখ্য মনীষী, আমেরিকারই নাগরিক মাইকেল এইচ হার্ট তাঁর সারা জাগানো বই ‘দ্যা হানড্রেড’ এ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মহামানব হিসেবে এক নাম্বারে রেখেছেন। ইউলিয়াম ম্যুর থেকে নিয়ে অসংখ্য পণ্ডিত ও মনীষী তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হিসেবে অকুণ্ঠ স্বীকৃতি দিয়েছেন। সেই মানুষকে নিয়ে যখন ব্যঙ্গ কার্টুন আঁকা হয়, সিনেমা বানিয়ে তাঁর চরিত্রে ইচ্ছে মত কালিমা লেপন করা হয়, তখন শুধু সারাবিশ্বের ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ পাঠকারীদের অন্তরই নয়, বিবেকবান প্রতিটি মানুষের হৃদয়ই কেঁদে ওঠে। মুহাম্মদ নামের এই নিরক্ষর মহাজ্ঞানী ব্যক্তিটি শুধু অসংখ্য মানুষের নবীই নন, তিনি সবার ভালোবাসার বাতিঘর। তাঁকে সবচে বেশি ভালোবাসা ঈমানের অপরিহার্য অংশ। যেমন, আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ»
‘তোমাদের কেউ সে অবধি মুমিন হতে পারবে না, যাবৎ আমি তার কাছে প্রিয়তর হই তার পিতা ও সন্তান থেকে এবং সকল মানুষ থেকে।’ [বুখারী : ১৫; মুসলিম : ৪৪]
পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতি : পশ্চিমাদের বিবেক-বিবেচনা দেখে তখনই দুঃখটা জাগে যখন দেখি তারা চিন্তা-বাকস্বাধীনতার শ্লোগান দিতে দিতেই আইন করে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করে। যখন তারা কেবল নিজেদের ভোগ-বিলাসের অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে রাজনীতির বলী বানায় অসংখ্য নিরীহ বনি আদমকে। যে নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে তারা বিশ্বজুড়ে শোরগোল করে অবলীলায় তাদেরই মিসাইল আর বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে নির্দয়ভাবে। পক্ষান্তরে কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসায় আঘাত করে যে কুলাঙ্গার সিনেমা বানায় তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে প্রশ্রয় দেয়া হয়। তথাকথিত চিন্তা ও বাকস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে আর কত অন্যায়কে জায়েয করা হবে?
বৃটিশ রাজপুত্র ইউলিয়াম তার স্ত্রী কেটকে নিয়ে ফ্রান্সের সাগরপারে বেডরুমের বিনোদন করেছেন তাঁর ‘বিশ্বব্যাপী’ দীর্ঘ মধুচন্দ্রিমার অংশ হিসেবে। সেখানে তোলা তাদের কিছু নগ্ন ছবি পত্রিকায় প্রকাশ করায় তিনি ও বৃটিশরা বেজায় চটেছেন পত্রিকার ওপর। এটাকে তিনি ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বলে অপমান জ্ঞানে মামলা করেছেন। আদালত কালবিলম্ব না করে তাঁর পক্ষে রায়ও দিয়েছে। অথচ একই সময়ে পৃথিবীর সবচে ত্যাগী মানুষ, মানুষের মুক্তি ও শান্তির চিন্তায় অস্থির রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদাহানী করে আমেরিকায় সিনেমা বানানো হলো। তথাপি এ ব্যাপারে পশ্চিমা নেতারা পরিষ্কার নিন্দাসূচক কিছু বলেন নি। মুসলিম ঔরসে জন্ম নেয়া ইয়াহূদীবান্ধব খাঁটি খ্রিস্টান বারাক ওবামাও কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ নেন নি।
তাকে গ্রেফতার করা হয় নি। উপরন্তু মাত্র সাত দিনের মাথায় সিনেমা নির্মাণের ক্ষোভ প্রশমিত না হতেই আবার ফ্রান্সের ‘শার্লি হেবদো’ সাময়িকী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যঙ্গাত্মক দুটি কার্টুন প্রকাশ করেছে। ফ্রান্সের মুসলিম নেতারা সাময়িকীতে প্রকাশিত ওই কার্টুন প্রকাশের নিন্দা জানিয়েছেন। বিক্ষোভের আশঙ্কায় ফ্রান্স ২০টি দেশে তাদের দূতাবাস ও কার্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে। পশ্চিমাদের তথাকথিত নীতিকথা আর আদর্শের পুরোটাই যে ভেক আর ভণ্ডামি তা আরও সপ্রমাণ হলো।
পশ্চিমাদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে বলে যথার্থ মন্তব্য করেছেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মুহম্মদ। ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতার’ ওপর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের এক বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করে মাহাথির এ মন্তব্য করেন। ওই চলচ্চিত্র তৈরি প্রসঙ্গে হিলারি ক্লিনটন বলেছেন, এর প্রচার ও প্রকাশ বন্ধ করা হলে মতপ্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ন হবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবমাননা করায় সারা বিশ্বের মুসলিমরা যখন তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছেন এবং বিভিন্ন জায়গায় সংঘাত-সংঘর্ষে বহু মানুষ হতাহত হচ্ছে তখন চলচ্চিত্রটির প্রচার বন্ধ না করে বরং সংঘাতকে আরো উস্কে দিলেন হিলারি।
এর জবাবে মাহাথির মুহম্মদ তার ওয়েবসাইটে লিখেছেন, ‘মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের অধিকারের দোহাই দিয়ে হিলারি মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারী এ চলচ্চিত্রের পক্ষে কথা বলেছেন। আমি মনে করি, পশ্চিমাদের মূল্যবোধ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের কথা বলে তারা একে অপরকে অপমান করতেও আর দ্বিধা করছে না।’
মাহাথির মুহাম্মদ আরও বলেন, ‘মানুষ যদি একে অপরকে অবজ্ঞা ও অপমান করতে থাকে তাহলে কি ধরনের সংস্কৃতি গড়ে উঠবে? রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি কোথাও কোন শান্তি থাকবে না।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই থাকবে। কিন্তু অপমান করার অধিকার কারও নেই।’
মাহাথির মুহাম্মদ জোর দিয়ে বলেন, অন্য জাতির ধর্ম ও মূল্যবোধকে আঘাত করা হলে বিশ্ব থেকে শান্তি বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের মাঝেও ঘৃণা ও সংঘাত বেড়ে যাবে। [দৈনিক সংবাদ ২২/৯/২০১২ সংখ্যা]
বিশ্ব মানবতার প্রতি শান্তির ধর্ম ইসলাম ও মহানবীর অবিস্মরণীয় অবদান : যে ধর্মের নাম থেকে নিয়ে কর্ম ও চিন্তার প্রতিটি পর্যায়ে লক্ষ্যণীয় ‘শান্তিশব্দে’র সক্রিয় উপস্থিতি, যে ধর্ম শুধু তার অনুসারীদেরই নয়, বিধর্মীদেরও দেয় নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার ও মর্যাদা। সে ধর্মকে জোর করে উগ্র বানাবার উন্মাদ প্রচেষ্টা বড়ই হাস্যকর। বলতে দ্বিধা নেই আজ বিশ্ব সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে যে মৌলিক চেতনাগুলোর ওপর, তার অধিকাংশের চারা রোপন করেছে এই ইসলাম। এত অত্যাচার অপপ্রচারেও যে ধর্মের অনুসারীদের দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না, বিশ্বের সব মতবাদ আর ইজমের কাছে হতাশ হয়ে যে ধর্মের শান্তির শীতল ছায়ায় আশ্রয় নিচ্ছেন পাশ্চাত্যের সর্বোচ্চ শিক্ষিত ও সভ্য মানুষগুলো, সে ইসলামের ওপর কেন এত রাগ আর এত বদনাম গাওয়া তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
পাশ্চাত্যের জানা উচিত, আল্লাহর ওহী প্রাপ্তির মাধ্যমে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বমানবতাকে মানুষের দাসত্ব থেকে একমাত্র শরীকবিহীন আল্লাহর ইবাদতের পথ দেখিয়েছেন। এর ফলে আল্লাহ বৈ সব কিছুর দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে মানুষ। তিনি বিশ্বমানবতাকে সকল কল্পকথা ও কুসংস্কার এবং সব রকমের মিথ্যা ও প্রতারণার সামনে শির না নোয়াবার শিক্ষা দিয়েছেন। অক্ষম প্রতিমা ও অলীক প্রভুদের বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করেছেন। মুক্ত করেছেন অসুস্থ চিন্তাধারা থেকে। বিশ্ব মানবতার চেতনায় ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার চারা রোপন করেছেন। তাঁর প্রতি অবতীর্ণ গ্রন্থ পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿ لَآ إِكۡرَاهَ فِي ٱلدِّينِۖ قَد تَّبَيَّنَ ٱلرُّشۡدُ مِنَ ٱلۡغَيِّۚ فَمَن يَكۡفُرۡ بِٱلطَّٰغُوتِ وَيُؤۡمِنۢ بِٱللَّهِ فَقَدِ ٱسۡتَمۡسَكَ بِٱلۡعُرۡوَةِ ٱلۡوُثۡقَىٰ لَا ٱنفِصَامَ لَهَاۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ٢٥٦ ﴾ [البقرة: ٢٥٦]
‘দীন গ্রহণের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় হিদায়াত স্পষ্ট হয়েছে ভ্রষ্টতা থেকে। অতএব, যে ব্যক্তি তাগূতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’। {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ২৫৬}
জীবদ্দশায় তিনি নিজেও দ্ব্যর্থহীনভাবে মুসলিমের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসকারী অমুসলিমদের সকল অধিকার নিশ্চিত করেছেন। ধর্ম-বর্ণ-বংশ নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ প্রেরিত হয়েছেন। তাঁর শিক্ষার মধ্যে বরং এমন উপাদানেরও অভাব নেই যা পক্ষী ও প্রাণীকুলের প্রতি মায়া-মমতা ও কোমলতা দেখাতেও গুরুত্ব দেয়। নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এদের অকারণে কষ্ট প্রদান কিংবা এদের প্রতি বিরূপ আচরণকে।
তিনি তাঁর অগ্রবর্তী সকল নবীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের এক উজ্জ্বল চিত্র উপস্থাপন করেছেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন নবী ইবরাহীম, মুসা ও ঈসা (ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের নবী) প্রমুখ। ছোট-বড়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছেন। প্রস্থানের তিন মাস আগে বিদায় হজে প্রদত্ত তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি মানুষের রক্ত, সম্পদ ও সম্মানে আঘাত হানাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি মানুষের সহজাত প্রকৃতিবান্ধব এক দীন নিয়ে আবির্ভূত হন যা আত্মিক খোরাক ও দৈহিক চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রাখে। পার্থিব কাজ ও আখিরাতের আমলের মধ্যে ভারসাম্য বিধান করে। মানুষের সহজাত বাসনা ও ঝোঁককে করে পরিশীলিত ও পরিমার্জিত। অপরাপর জাতিগুলোর সভ্যতার মতো একে ধ্বংস বা অবদমিত করে না।
মানবতার কল্যাণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আন্তঃসম্প্রদায় ভ্রাতৃত্বের পূর্ণাঙ্গ নমুনা পেশ করেছেন। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন, কোনো মানব সম্প্রদায়ের ওপর অন্য কোনো মানব সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। মূল সৃষ্টি, অধিকার ও কর্তব্যের ক্ষেত্রে তারা সবাই সমান। শ্রেষ্ঠত্ব বিবেচিত হবে কেবল ঈমান ও তাকওয়া তথা বিশ্বাস ও আল্লাহভীতির নিরিখে। তিনি তাঁর সকল সঙ্গী-সাহাবীকে ধর্মসেবা এবং তাতে সম্পৃক্ত হবার সমান সুযোগ দিয়েছেন। তাইতো তাঁদের মধ্যে আরবদের পাশাপাশি ছিলেন (রোম দেশের) সুহাইব রূমী, (হাবশার) বিলাল হাবশী এবং (পারস্যের) সালমান ফারসী রাদিআল্লাহু আনহুম প্রমুখ।
পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক হামিদ মীরের অনুভূতি : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক, জিও টিভির প্রধান নির্বাহী হামিদ মীর তাঁর দৈনিক জং-এর এক কলামে লিখেছেন, ‘আমার কষ্ট ও যন্ত্রণা ছিল বর্ণনাতীত। এটা আমার সাংবাদিকতাসুলভ অনুসন্ধিৎসু মনোভাবের কারণে। সিএনএনে ইসলামবিরোধী একটি চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে লিবিয়ায় বিক্ষোভের খবর দেখার পর ইন্টারনেটে ওই চলচ্চিত্রটি খোঁজা শুরু করি। আমার এক সহকর্মী কোথাও থেকে ভিডিওটি ডাউনলোড করে আমার কাজ সহজ করে দেন। যখন ওই চলচ্চিত্রটি দেখা শুরু করি তখন আমার কাছে মনে হতে লাগল, কেউ যেন আমার মন ও মস্তিষ্কে হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে।
নিজেকে অনেক শক্ত মনের মানুষ বলে জানি, কিন্তু স্যাম ভাসেলির নির্মিত ইনোসেন্স অব মুসলিম নামের এই চলচ্চিত্র বর্তমান যুগের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদ। কারণ এই চলচ্চিত্রের দৃশ্য ও সংলাপগুলো বোমা বিস্ফোরণের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে আলকায়েদার হামলায় তিন হাজার লোক মারা গিয়েছিল। কিন্তু ১১ সেপ্টেম্বর ২০১২ ইউটিউবে প্রচারিত এই ভিডিওচিত্রটি কোটি মুসলিমের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওই চলচ্চিত্র কয়েক মিনিটের বেশি দেখতে পারি নি। এই ভয়াবহ চলচ্চিত্রের বিবরণ দেয়াও আমার জন্য অনেক কষ্টকর। শুধু এতটুকু বলব, এই চলচ্চিত্রের কয়েকটি দৃশ্য দেখে স্যাম বেসিলের বিপরীতে ওসামা বিন লাদেনের সন্ত্রাসবাদকে অতি তুচ্ছ বলে মনে হয়েছে। আমেরিকার জন্য এটা বড় পুরস্কার, এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী স্যাম বেসিল এত বড় অপকর্ম করার পরও আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশ্রয়েই আছে। আল্লাহ তা‘আলার কাছে লাখো শুকরিয়া যে, আজ পর্যন্ত কোথাও কোনো মুসলিম ঈসা আলাইহিস সালাম অথবা অন্য কোনো নবীর ব্যাপারে এ ধরনের বেয়াদবী করেন নি।’
হামিদ মীরের একটি যুক্তি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘আমেরিকার পক্ষ থেকে আমাদের দেশের মাদরাসাগুলোর ওপর অনেক অভিযোগ আরোপ করা হয়। অথচ দ্বীনি মাদরাসার ছাত্ররা কখনো খ্রিস্টান অথবা ইয়াহূদী ধর্মের এমন অবমাননার কথা চিন্তাও করে না যা করেছে স্যাম বাসেলি ইসলাম ও ইসলামের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে।
আমার আফসোস হয়, এ ব্যাপারে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তার প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া লোকদেখানো। এই চলচ্চিত্রকে আমেরিকার প্রশাসনবিরোধী হিসেবে অভিহিত করাই যথেষ্ট নয়, বরং এটাও স্বীকার করতে হবে, কিছু খ্রিষ্টান ও ইয়াহূদী সন্ত্রাসী আমেরিকাকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের অপচেষ্টা করছে। তারা তথাকথিত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আলকায়েদা, তালেবান ও হাক্কানী নেটওয়ার্ক থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর। আমি বারাক ওবামার কাছে স্যাম বাসেলের মতো সন্ত্রাসীর বিচার প্রার্থনা করব না, তবে আমেরিকান মিডিয়ার বন্ধুদের কাছে আবেদন করব, তারা যেন এটা খুঁজে বের করেন, তাদের দেশের সন্ত্রাসীদের কোন কোন গোপন সংগঠন সহযোগিতা করে। আমি বিশ্বাস করি, ডেরি জনস ও স্যাম ভাসেলি গোটা আমেরিকার প্রতিনিধিত্ব করে না। আমেরিকায় রমস ক্লার্কের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিও আছেন, যিনি পাকিস্তানি ডাক্তার আফিয়া সিদ্দিকীর মুক্তির জন্য আন্দোলন করছেন।
আমার কাছে মনে হচ্ছে, মুসলিম বিশ্বে আজ আমেরিকা ক্লার্কের দেশ হিসেবে পরিচিত নয়, পরিচিত হচ্ছে স্যাম বাসিলের দ্বারা।
স্যাম বাসিলের সন্ত্রাসবাদ আমাকে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। মুসলিমদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবমাননা করায় খ্রিস্টান বাদশাহর প্রতি রাগান্বিত হয়ে তলোয়ার হাতে নিয়েছিলেন। আর শেষ পর্যন্ত বায়তুল মোকাদ্দাস বিজয় করেছিলেন। কিন্তু আফসোস, আজ মুসলিম বিশ্বের কোনো শাসকের মধ্যে এই অনুভূতি ও উদ্যমটুকু নেই যে, নবীজীর অবমাননাকারী কুচক্রীদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে।’ [বার্তা ২৪ এর সৌজন্যে]




প্রতিক্রিয়া :
Every action has a reaction ‘প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা প্রতিক্রিয়া থাকে’। এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে সেটাই হয়েছে। মার্কিনী হামলায় সদ্য বিধ্বস্ত লিবিয়ার বেনগাযী শহরে মার্কিন কনস্যুলেটে জনগণের হামলায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টোফার স্টিভেন্সসহ ৪ জন মার্কিন কুটনীতিক ও ১০ জন লিবীয় রক্ষী নিহত হয়েছে। আফগানিস্তানে দু’জন মার্কিন সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছে। কায়রোতে হাযার হাযার মানুষ বিক্ষোভ করেছে ও দেওয়াল টপকে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করে গাড়ী পুড়িয়েছে ও মার্কিন পতাকায় আগুন দিয়েছে। একই অবস্থা তিউনিসিয়া, সূদান, ইয়ামন, লেবানন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কুয়েত ও বাংলাদেশ সহ বিশ্বের প্রায় সকল মুসলিম রাষ্ট্রে হয়েছে। এমনকি ইসরাঈলেও ইহুদী শান্তিবাদীরা এর বিরুদ্ধে মিছিল করেছে ও এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। ইরানী পার্লামেন্টের আর্মেনীয় ও আসীরিয় দু’জন খৃষ্টান প্রতিনিধি এর প্রতিবাদ করে বলেছেন, এরা অজ্ঞতার যুগে ফিরে গেছে। কুরআনে ঈসা ও মারিয়ামের মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। ফলে এরা কুরআন পুড়িয়ে নিজেদের নবীকে অপমান করেছে’। মার্কিন সাংবাদিক ও লেখক রিক সানচেজ বলেছেন, মুসলমানেরা যদি এখন বাইবেল পোড়ায়, তাহলে কেমনটা হবে? অতএব তাদের একাজটি একেবারেই অজ্ঞতাসুলভ হয়েছে’। প্রেসিডেন্ট ওবামা এ ঘটনার নিন্দা করেছেন ও রাষ্ট্রদূত হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়ে লিবিয়া সীমান্তে দু’টি রণতরী পাঠিয়েছেন। এছাড়াও বিদেশে সকল মার্কিন দূতাবাসে যরূরী সতর্কবার্তা পাঠিয়েছেন। ইরান মুসলিম বিশ্বের নিকট ক্ষমা প্রার্থনার জন্য প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতি আহবান জানিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং অনতিবিলম্বে উক্ত সিনেমা বন্ধ করার জন্য মার্কিন সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে। এভাবে বিশ্বের সর্বত্র নিন্দাবাদ অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বব্যাপী বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ভীত হয়ে বীরপুঙ্গব স্যাম বাসিলে গা ঢাকা দিয়েছে। অতঃপর গোপন অবস্থান থেকে টেলিফোনে বলেছে যে, ‘সে ইসলামকে ক্যান্সারের মত মনে করে এবং এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সে ইসলাম ধর্মের ত্রুটিগুলি মানুষের সামনে তুলে ধরেছে। যা ইসরাঈলের পক্ষে রাজনৈতিকভাবে সহায়ক হবে’। উল্লেখ্য যে, তার এই ভিডিও নির্মাণে সমর্থন জুগিয়েছেন নিউইয়র্কের বিতর্কিত খৃষ্টান ধর্মযাজক টেরি জোন্স। যিনি ২০১১ ও ১২ সালে প্রকাশ্যে কুরআন পোড়ানোর কারণে সারা বিশ্বে নিন্দিত হন। এখন প্রকাশ পেয়েছে যে, ঐ যাজক হ’ল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চর। পাদ্রী হওয়াটা তার বাহ্যিক রূপ মাত্র।

ফিরে দেখা :
১৯১৭ সালে কুখ্যাত বেলফোর চুক্তির মাধ্যমে জাতিসংঘের তদারকিতে ফিলিস্তীনের মুসলিম ভূখন্ডে ইহুদী রাষ্ট্র কায়েমের চক্রান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। হাযার বছরের আরব মুসলিমদের বিতাড়িত করে সেখানে বিভিন্ন দেশে ছড়ানো-ছিটানো ইহুদীদের বসতি স্থাপন করা হয়। উক্ত প্রক্রিয়া আজও অব্যাহত রয়েছে। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তীনের একাংশে ‘ইসরাঈল’ নামক রাষ্ট্র কায়েম করা হয় এবং সেখানকার স্থায়ী মুসলিম অধিবাসীরা বিতাড়িত হয়ে আশপাশের মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে উদ্বাস্তু হিসাবে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। আজও তারা সেভাবেই মানবেতর জীবন যাপন করছে। পরাশক্তিগুলির পারস্পরিক যোগসাজশে প্রতিষ্ঠিত ইসরাঈল রাষ্ট্র মূলতঃ মধ্যপ্রাচ্যের তৈল ভান্ডারের উপর স্থায়ীভাবে ছড়ি ঘুরানোর জন্য এবং সেখানকার তৈল স্বল্পমূল্যে ভোগ করার জন্য একটি সামরিক কলোনী মাত্র। পরাশক্তির সমর্থন ব্যতীত একদিনও এ রাষ্ট্রের টিকে থাকার ক্ষমতা নেই। আল্লাহ বলেন,

‘(ওদের নিরাপত্তার ব্যাপারে) আল্লাহর প্রতিশ্রুতি (নিরপরাধ বৃদ্ধ ও নারী-শিশুদের হত্যা না করা) ও মানুষের প্রতিশ্রুতি (সন্ধিচুক্তি) ব্যতীত তারা যেখানেই অবস্থান করুক না কেন ওদের উপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওরা আল্লাহর ক্রোধ অর্জন করেছে। আর ওদের উপর মুখাপেক্ষিতা আরোপ করা হয়েছে। একারণে যে, ওরা আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার করেছে এবং তারা নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। ওরা অবাধ্যতা করেছিল ও সীমা লংঘন করেছিল’ {আলে ইমরান ৩/১১২}।

খৃষ্টানরা ঈসা ও তার মা মারিয়ামের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে তাঁদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করেছে। ইহুদী ও নাছারা উভয় জাতি আল্লাহর কিতাবকে বিকৃত ও বিনষ্ট করেছে ও তার বিনিময়ে দুনিয়া উপার্জন করেছে। তাদের কেতাবে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছা.)-এর আগমনের সুসংবাদ লিপিবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও তারা তা মানেনি এবং শেষনবীকে পেয়েও তাঁকে স্বীকার করেনি। শুধু তাই নয়, তারা তাঁর ও তাঁর উম্মতের বিরুদ্ধে সবধরনের চক্রান্ত করেছে। অতঃপর বিগত নবীগণের ন্যায় শেষনবীকেও হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে। আজও তারা একই অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি করছে। তাই এদের হাত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর নিকটে আমাদেরকে সূরা ফাতিহায় প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে ঐ লোকদের পথে পরিচালিত করবেন না, যারা অভিশপ্ত হয়েছে ও পথভ্রষ্ট হয়েছে’। এই দো‘আর শেষে বলতে হয় ‘আমীন’ (হে আল্লাহ! আপনি কবুল করুন)। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এই লোকগুলি কারা? তিনি বললেন, ওরা হ’ল ইহুদী ও নাছারা’ {তিরমিযী}। মুসলিম উম্মাহকে সাবধান করে আল্লাহ বলেন,

‘হে বিশ্বাসীগণ! ইয়াহূদ ও নাছারাদের তোমরা বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। ওরা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যারা ওদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদের মধ্যেই গণ্য হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমা লংঘনকারীদের সুপথ প্রদর্শন করেন না’ {মায়েদাহ ৫/৫১}।

ওদের চক্রান্তে অতিষ্ঠ রাসূলকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেন, ‘ইহুদী-নাছারাগণ কখনোই আপনার উপর খুশী হবে না, যতক্ষণ না আপনি ওদের দলভুক্ত হন। আপনি বলে দিন যে, আল্লাহ প্রেরিত সুপথই হ’ল সুপথ। অতএব আপনি যদি আপনার নিকট নিশ্চিত জ্ঞান (অহি-র বিধান) এসে যাওয়ার পরেও ওদের খোশ-খেয়াল সমূহের অনুসরণ করেন, তাহলে আল্লাহর পক্ষ হতে আপনার কোন বন্ধু ও সাহায্যকারী থাকবে না’ {বাক্বারাহ ২/১২০}।

দুর্ভাগ্য! মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিজেদের কাছে অহি-র বিধান কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ থাকা সত্ত্বেও তা বাদ দিয়ে ইহুদী-নাছারাদের চালান করা নানা ভ্রান্ত মতবাদের অনুসারী হয়েছেন ও প্রায় সর্বক্ষেত্রে তাদের তাবেদার হয়েছেন। পাশ্চাত্য বিশ্বের নেতারা সালমান রুশদী সহ এযাবত কোন ব্যঙ্গকারীকে শাস্তি দেয়নি। বরং বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে তাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়েছেন। যদি তারা তাদের যথোপযুক্ত শাস্তি দিতেন, তাহলে আজকে এ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতো না। অতএব বর্তমান ঘটনার জন্য মূলতঃ পাশ্চাত্যের নেতারাই দায়ী। সেকারণ তাদের উপরে নেমে আসছে একের পর এক লাঞ্ছনা ও অপমানকর পরিণতি। শান্তিপ্রিয় বিশ্বের এ ক্ষোভ ও ঘৃণা থেকে বাঁচার উপায় তাদের নেই।

ক্রোধের কারণ :
(ক) ওরা কুরআনের উপরে নাখোশ। কারণ কুরআনই পৃথিবীর বুকে একমাত্র ইলাহী ধর্মগ্রন্থ, যা অবিকৃত রয়েছে ও ক্বিয়ামত পর্যন্ত থাকবে এবং যা পৃথিবীর সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ। এর হেফাযতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ নিয়েছেন {হিজর ১৫/৯}। কুরআন মানবজীবনের সকল দিক ও বিভাগের জন্য পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। যা সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ। যার পরিবর্তনকারী কেউ নেই {আন‘আম ৬/১১৫}। তাওরাত-ইনজীল ছিল অপূর্ণাঙ্গ ও কেবল সে যুগীয়। তাই আল্লাহ তার স্থায়ীত্বের দায়িত্ব নেননি। ফলে তা স্বাভাবিকভাবেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাই রাগে ও ক্ষোভে ওরা কুরআনকে গুলি করে। যেমন ইরাকের আবু গারীব কারাগারে তারা করেছে। কুরআনকে পুড়িয়ে মনের ঝাল মিটায়। যেমন পাদ্রী টেরি জোন্স নিউইয়র্কে গত বছর ও এ বছর করেছে। ইরাকে গত ১৯শে মে’১২ এবং আফগানিস্তানে মার্কিন সেনারা এ বছর কুরআন পুড়িয়েছে। ১৯৮৯ সালে ওরা সালমান রুশদীকে দিয়ে Satanic Verses (স্যাটানিক ভার্সেস) লিখিয়ে কুরআনের আয়াত সমূহকে ‘শয়তানের পদাবলী’ বলেছে। ১৯৯৪ সালে তাসলীমা নাসরীনকে দিয়ে ‘লজ্জা’ উপন্যাস লিখিয়ে কুরআন পরিবর্তনের দাবী করেছে। যেমন ইতিপূর্বে আবু জাহলরা দাবী করেছিল {ইউনুস ১০/১৫}।

(খ) ওরা ‘ইসলাম’-কে বরদাশত করতে পারে না। কেননা ‘আল্লাহর নিকট মনোনীত একমাত্র দ্বীন হ’ল ইসলাম’ {আলে ইমরান ৩/১৯}। ইসলামের বাণী যার অন্তরে প্রবেশ করে, সে মুসলমান হয়ে যায়। যেমন নাইন ইলেভেনের পরে পাশ্চাত্যের মানুষ এখন অধিক হারে ইসলাম কবুল করছে। তাদেরই হিসাব মতে ২০৫০ সালের মধ্যে ‘ইসলাম’ বিশ্বধর্মে পরিণত হবে। বড় কথা হ’ল, অন্য ধর্ম ছেড়ে মানুষ ইসলাম কবুল করে। কিন্তু ইসলাম ছেড়ে অন্য ধর্ম কবুলের ঘটনা একেবারেই বিরল। তাই তারা ইসলামকে ‘ক্যান্সার’ বলেছে। আর মুসলমানকে বোকা, ‘গাধা’ বলেছে। আর সেকারণেই খাঁটি ঈমানদারগণের উপর ওদের রাগ বেশী। তাই এ বছর আফগানিস্তানে তালেবানদের মৃত লাশের উপর দাঁড়িয়ে মার্কিন সেনাদের পেশাব করতে এবং তা ভিডিও চিত্রে ধারণ করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতেও এদের লজ্জা হয়নি। দেশে দেশে প্রকৃত ইসলামী নেতারাই এখন এদের টার্গেট।

(গ) মুহাম্মাদ (ছা.)-এর উপর রাগের কারণ, তিনিই একমাত্র বিশ্বনবী। মূসা ও ঈসা সহ সকল নবী ছিলেন গোত্রীয় নবী। শেষনবীর আবির্ভাবের পর সকল মানুষের জন্য অনুসরণীয় একমাত্র নবী হলেন মুহাম্মাদ (ছা.)। যার আগমনের সুসংবাদ স্বয়ং ঈসা (আ.) দিয়ে গিয়েছেন {ছফ ৬১/৬}। রাসূল (ছা.) বলে গেছেন ‘যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন, তার কসম করে বলছি যে, ইহুদী হৌক, নাছারা হৌক, পৃথিবীর যে কেউ আমার আবির্ভাবের কথা শুনেছে, অতঃপর মৃত্যুবরণ করেছে। অথচ আমার আনীত দ্বীনের উপর ঈমান আনেনি, সে ব্যক্তি জাহান্নামের অধিবাসী হবে’ {মুসলিম}। তিনি আরও বলেন, ভূপৃষ্ঠের এমন কোন শহর-গ্রাম ও বস্তিঘর থাকবে না, যেখানে ইসলামের কলেমা প্রবেশ করবে না। তারা সম্মানিত অবস্থায় ইসলাম কবুল করবে অথবা অসম্মানিত অবস্থায় এর অনুগত হবে। আর এভাবেই দ্বীন আল্লাহর জন্য পরিপূর্ণ হয়ে যাবে’ {আহমাদ}। ইহুদী-নাছারা ও তাদের দোসরদের হাযারো চেষ্টা সত্ত্বেও ইসলাম দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। এক হিসাবে জানা যায় ইসলামের বিরুদ্ধে বছরে তারা ৫০০ কোটি ডলার ব্যয় করে এবং তাদের দু’শোর বেশী ইলেকট্রনিক মিডিয়া বর্তমানে এ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। বিভিন্ন দেশের মুসলিম সরকার ও ইসলামী নেতাদের তারা ছলে-বলে-কৌশলে দলে ভিড়াচ্ছে। অথবা ভয় দেখিয়ে গোলাম বানিয়ে রেখেছে। কিন্তু মার্কিন সেনারাই এখন মুসলমান হয়ে যাচ্ছে। খোদ টনি ব্লেয়ারের শ্যালিকা মুসলমান হয়ে গেছেন। তাই বর্তমানে যা কিছু ঘটছে, সবই তাদের আদর্শিক পরাজয়ের ক্ষুব্ধ বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আল্লাহ বলেন, হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা নিজেদের ব্যতীত অন্যদের মিত্ররূপে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের ক্ষতি করতে পিছপা হবে না। তোমরা যাতে বিপন্ন হও, তারা সেটাই কামনা করে। তাদের মুখ থেকে বিদ্বেষ সমূহ বেরিয়ে আসে। আর যা তাদের অন্তরে লুকিয়ে রাখে, তা আরও ভয়ংকর। আমরা তোমাদের নিকট আয়াত সমূহ বিবৃত করছি। যাতে তোমরা বুঝ’। ‘সাবধান! তোমরা তাদের ভালোবাস, কিন্তু তারা তোমাদের ভালবাসে না। অথচ তোমরা (পূর্ববর্তী) সকল ইলাহী কিতাবে বিশ্বাস করে থাক। যখন ওরা তোমাদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে আমরা বিশ্বাস করি। আর যখন তোমাদের থেকে পৃথক হয়ে যায়, তখন তোমাদের প্রতি আক্রোশে আঙ্গুল কাটে। আপনি বলুন, তোমরা তোমাদের ক্রোধে মরো। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকলের হৃদয়ের খবর রাখেন’ {আলে ইমরান ৩/১১৮-১৯}।

অতএব হে মুসলিম ভাই ও বোন! ধৈর্য ধারণ কর। নিজের দ্বীনের উপর আরও দৃঢ় হও। অন্যদের থেকে সাবধান থাক। সার্বিক জীবনে ইসলামের যথার্থ অনুসারী হও। ‘পৃথিবীর মালিক আল্লাহ। তিনি যাকে খুশী এর উত্তরাধিকারী করেন। তবে শুভ পরিণাম কেবলমাত্র আল্লাহভীরু বান্দাদের জন্যই নির্ধারিত’ {আ‘রাফ ৭/১২৮}।

জাতিধর্ম নির্বিশেষে বিশ্বের যেসকল বিবেকবান মানুষ এ ঘটনার নিন্দা করেছেন, আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সাথে সাথে এর প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য মুসলিমদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। নইলে শত্রুরা এটাকে অজুহাত বানাবে। মনে রাখা আবশ্যক যে, মসজিদে নববীতে জনৈক বেদুঈন দাঁড়িয়ে পেশাব করেছিল। ছাহাবীগণ তাকে মারতে উদ্যত হলে রাসূল (ছা.) তাদের নিবৃত্ত করেন ও সেখানে পানি ঢালতে বলেন। অতঃপর বলেন, ‘তোমরা প্রেরিত হয়েছ সরল নীতির ধারক হিসাবে, কঠোর নীতির ধারক হিসাবে নয়’ {বুখারী}। বস্তুতঃ এখানেই ইসলামের সৌন্দর্য। আর এভাবেই ইসলাম মানুষের অন্তর জয় করে থাকে ও সর্বত্র বিজয়ী হয়।

পরিশেষে আমরা প্রেসিডেন্ট ওবামা সহ সকল ইহুদী-নাছারা ও অমুসলিম বনু আদমকে ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তির স্বার্থে মৃত্যুর আগে ইসলাম কবুল করার আহবান জানাচ্ছি। সেদিনের খ্রিষ্টান বাদশাহ নাজাশী ও তাঁর পাদ্রীরা কুরআন শুনে মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন। আজকের ওবামারা কি সেটা পারেন না? অতএব দু’দিনের এ দুনিয়াবী মরীচিকায় আচ্ছন্ন না থেকে আসুন আল্লাহ প্রেরিত অভ্রান্ত সত্যের কাছে মাথা নত করি ও জান্নাতের অধিকারী হই। কুরআনকে বুকে ধারণ করি ও মনেপ্রাণে ইসলাম কবুল করে ধন্য হই। ঐ শুনুন, আপনাদের জন্যই নেমে এসেছে আসমানী তারবার্তা: ‘(কিয়ামতের দিন অবিশ্বাসীদের শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে) তবে তাদের নয়, যারা তওবা করে এবং ঈমান আনে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে। আল্লাহ তাদের পাপসমূহ পুণ্যের দ্বারা পরিবর্তন করে দিবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ {ফুরক্বান ২৫/৭০}। হে আল্লাহ! তুমি কুরআন, ইসলাম ও ইসলামের নবীর সম্মানকে আরও উচ্চ কর এবং অসম্মানকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাও। যেমন তুমি দিয়েছিলে ফেরাঊনকে। আমীন! ইয়া রব্বাল আলামীন!!

সৌজন্যেঃ আত-তাহরীক 

http://www.sonarbangladesh.com/blog/siddiquee/129360#Comment872971
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন